পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ৯ জানুয়ারী, ২০২২

মৌসুমী ঘোষ

                     



অষ্টভূজ

অষ্টভূজ / মৌসুমী ঘোষ

বল্লরী সেদিন মার্কেট থেকে ফিরে সরোজিনী গ্রুপে প্রচুর ছবি পোস্ট করল — ছবিতে কেউ মুখে, কেউ গলায় , কেউ কানে , কেউ হাতে ঝুলিয়ে রেখেছে মাস্কগুলো।  তন্বী লিখল¸ ‘মাস্ক পরলে আমারও চশমা ঝাপসা হয়ে যায়। তাছাড়া আমি তো বাড়ি থেকেই বেরোই না তাই মাস্ক নৈব নৈব চ।’

কথাকলি বিভিন্ন প্রিন্টেড মাস্কের ছবি দিয়ে ওর বুটিকে এভেলেবল জানাল। পারমিতা মাস্কগুলো দারুণ সেটা ইমোজিতে জানিয়ে লিখল, ‘দাম কত?’ তন্বী এগ-টোস্টের একটা টুকরো কেটে মুখে পুরে লিখল, ‘এবার পুজোয় তোর বুটিকে মাস্ক ফ্রি দিচ্ছিস তো শাড়ির সঙ্গে?’ বল্লরী লিখল, ‘কেন রে তন্বী, তুই তো মাস্ক পরিস না বললি?’ 

তন্বীর মুখে ঠিক এইসময় টোস্টের সঙ্গে একটা লঙ্কার কুচি পড়ল। কথাকলি লিখল, ‘তন্বী এখনও তো আমার বুটিকের চৌকাঠও মারাসনি, এখনই ফ্রি চাইছিস! ’ তন্বী লিখল, ‘আমি তো শাড়িই পরি না। তাছাড়া গত চার বছর আমি আমার ফ্ল্যাটের বাইরে ক’বার বেরিয়েছি তা গুণে বলা যাবে। জামা কাপড় যা কিনি অনলাইনে!’ 

কথাকলি লিখল, ‘সে কি তুই এ ওয়ান সিটিতে থাকিস, এদিকে মলে, বিগ বাজারে যাস না?’ তন্বী প্রেশারের ট্যাবলেট সমেত আরো গোটা দুয়েক ট্যাবলেট খেয়ে কিসব লিখতে গিয়েও ক্লিন করে দিল। 

বেশ খানিকক্ষণ গ্রুপে কে কী লিখছে একবারও দেখল না তন্বী। নেটফ্লিক্স অন করে ‘অপারেশন এম বি বি এস’টা দেখতে শুরু করে দিল। সারারাত অফিসের কাজ সেরে অনেক বেলা অবধি ঘুমিয়ে নিল। একেই রবিবার তায় লকডাউন আবার যথারীতি গ্রুপে চ্যাটিং করতে লাগল।

পাপিয়া লিখল, ‘আমার বর এইমাত্র বেসিনে খাসির মাংস নামিয়ে রাখল, আমি চলি।’ তন্বী লিখল, ‘এই মাংস প্রীতির জন্যই আমি প্রীতমকে ডিভোর্স দিয়েছি।’ পাপিয়া লিখল, ‘মানে!’ তন্বী লিখল, ‘প্রীতম মাঝে মাঝেই অফিস ফেরতা নিউমার্কেট থেকে বেআইনি হরিণের, শুয়োরের মাংস এনে রাঁধতে বলত। আমার টাকায় অফিস করল, তখনও লাভের মুখ দেখা যায় নি, এদিকে মাংস আর মদ চাই রোজ। ভাবতে পারিস!’ অনেকেই ইমোজি দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করল। উৎসাহ পেয়ে তন্বী লিখল, ‘শেষে যেদিন খরগোশের মাংস আনল, আমি ডিভোর্সের ডিসিশান নিয়েই নিলাম। অমন তুলতুলে একটা প্রাণীকে কেউ খাবার কথা ভাবতে পারে কি করে, জানি না।’

প্রভা হঠাৎ লিখল, ‘এর জন্য ডিভোর্স দিলি, ভাবা যায়!’ তন্বী ক্রোধে ফেটে পড়ল প্রভার ওপর। লিখল, ‘ডিভোর্স এখনো দিইনি তবে তাড়িয়ে দিয়েছি আমার ফ্ল্যাট থেকে।’ প্রভা লিখল, ‘তোর ফ্ল্যাট!’ তন্বী লিখল, ‘হ্যাঁ, মা-বাবা মারা যাবার পর ওখানকার বাড়ি বেচে এই বারোশো স্কোয়্যার ফুটের ফ্ল্যাটটা কিনেছিলাম।’ প্রভা লিখল, ‘সে তো আমরাও আমার মা-বাবাকে দেখাশুনো করব বলে শ্বশুড়বাড়ি ছেড়ে বাপের বাড়িতে এসে দোতলায় থাকি। তাবলে বর ভালো-মন্দ খেতে চাইলে, আমার বাপের বাড়ি, আমি রাঁধব কেন? বলে তাড়িয়ে দেব!’ 

তন্বী লিখল, ‘আসলে তোদের মতো মেয়েদের জন্যই সমাজে পুরুষরা মাংস প্রেমিক হয়ে উঠছে, বুঝলি?’ প্রভাও গেল ক্ষেপে, ‘তাতে কী, আমার বর নিজে রোজগার করে মাংস কিনে খায়।’ তন্বী বলল, ‘ তুই সেই মাংস রেঁধে দিয়ে সমাজে মাংসাশীদের ইন্ধন জোগাচ্ছিস।’ তর্কাতর্কি শুধু যে চরমে উঠল তা নয়। মোড় নিল নির্ভয়া কান্ডে। কারণ মাত্র ক’দিন আগেই নির্ভয়া কান্ডের চার দোষীর ফাঁসি হয়ে গেছিল লকডাউনের ঠিক আগেই।

এর মাঝে অবশ্য সুকন্যা গার্নিশিং করা ক্রিসপি চিকেনের ছবি পোস্ট করে ব্যাপারটা ডায়ালিউট করতে চাইল। বিপাশা বাড়িতে বানানো কালাকাঁদের ছবি দিয়ে ওদের থামতে বলল। কিন্তু কা কস্য পরিবেদন।

তন্বী মাংসাশী বলে পোস্ট করল নির্ভয়া কান্ডের চার আসামীর ছবি। প্রভা লিখল, ‘যাই বলিস যেসব মেয়েরা রাত অবধি একা রাস্তায় ঘোরে, একা জীবন-যাপন করে তাদের ক্ষেত্রে এসব ঘটে।’ তন্বীর কান গরম হয়ে গেল প্রেশার হাই হচ্ছে বুঝে ‘মিঃ সাইসাইন’ বলে একটা কোরিয়ান ওয়েব সিরিজের সিজিন-ওয়ান সাব-টাইটেল পড়ে পড়ে দেখতে শুরু করল। 

পরেরদিন সরোজিনী গ্রুপে পোস্ট দিল, ‘কোরিয়ান ভাষায় বন্ধুকে বলে, chingu (ছিন্‌-গু)। সঙ্গে সঙ্গে জয়তী লিখল, ‘ফ্রেঞ্চে মেয়ে বন্ধু amie (এমি) আর ছেলেদের ক্ষেত্রে ‘ই’ বসে না।’ জয়তী ফ্রেঞ্চ পড়ায় সরোজিনীতে। তন্বী লিখল, ‘খুব বিভেদকামী ভাষা তো ফ্রেঞ্চ!’ জয়তী লিখল, ‘আমাদের বন্ধু আর বান্ধবীদের মতো।’ ডাক্তার নীভা লিখল, ‘ভিটামিন সি বাজার থেকে উধাও। তাই তোরা সবাই প্রত্যেকদিন পাতিলেবু, কাঁচা হলুদ, রসুন খাবি আর গার্গেল করবি বাইরে থেকে ফিরেই।’ অনেকেই বিশাল বিশাল লাল হার্টের ইমোজি দিল নীভাকে। নীভা হাসির ইমোজি দিয়ে লিখল, ‘করোনা ভাইরাস তার চরিত্র পাল্টাচ্ছে বন্ধুগণ। আর মানুষও এখন নিউ নর্মাল লাইফ মেনে নিতে শুরু করে দিয়েছে।’

লকডাউন ক্রমে এনিভার্সারি উদযাপন করে দ্বিতীয় বছরে পদার্পণ করছিল। খুব শীঘ্র লোকাল ট্রেন চলবে জানা যাচ্ছিল। এরমধ্যে তন্বীর সঙ্গে হৃদ্যতা বেড়ে গেল জয়তীর। দুজনেই ওয়েব সিরিজের পোকা। জয়তীই একদিন সরোজিনী গ্রুপে লিখল, ‘ট্রেন চললেই তন্বীর ফ্ল্যাটে একদিন গেট টুগেদার হবে।’ হঠাৎ একটা আননোন নম্বর থেকে কেউ লিখল, ‘শান্তিনিকেতন থেকে মাত্র দশ কিমি দূরে আমার পৈতিক ভিটেটা রেনোভেশন করে রিসর্ট বানিয়েছি। নাম দিয়েছি 'অষ্টভূজ’। উপর-নিচ মিলিয়ে আপাতত আটটা রুম। তোরা সবাই আসিস।’ তন্বীর অষ্টভূজ নামটা খুব চেনা লাগল, পোস্টটা স্কিপ করে লিখল, ‘তুই কে রে?’ 

গ্রুপ এডমিন সুনীলা লিখল, ‘ও অহনা। মাধ্যমিকে বীরভূম থেকে মেয়েদের মধ্যে ফার্স্ট হয়ে আমাদের সরোজিনীতে ক্লাস ইলেভেন আর্টসে ভর্তি হয়েছিল।’ বল্লরী লিখল, ‘তোর ছবি পোস্ট কর অহনা।’ তন্বী ততক্ষণে গ্রুপের ডিপিটায় সবার মুখের ছবির কোলাজটায় অহনাকে তন্ন তন্ন করে খুঁজে চলল।

অহনা একটা মাটির দোতলা বাড়ির সামনে দাঁড়ানো নিজের এখনকার একটা ছবি দিয়ে লিখল, ‘স্কুল লাইফের ছবি পেলাম না তাই এটা দিলাম।’ পূর্বা একটা লালচে ছবি পোস্ট করল। পূর্বার বাড়িতে সরস্বতী পুজোরদিন তোলা সেই ক্লাস ইলেভেনের ছবিটায় নিজেকে দেখে চমকে উঠল তন্বী। অনেকক্ষণ দেখল, রোগা, শাড়ি পরা, বিনুনি বাঁধা বোকা বোকা মেয়েটা ও নিজে ভাবতেও হাসি পাচ্ছিল। ওর পাশেরজনই তো অহনা। এবার তন্বীর হালকা হালকা মনে পড়ল অহনার কথা। নীলার কথা, হেমার কথা, … রত্না দিদিমণি ওদের আটজনকে 'অষ্টভূজ' বলতেন।তন্বী লিখল, ‘তুই কি করিস অহনা?’ অহনা জানাল, ‘বিশ্বভারতীতে পড়াই আর অর্মত্য সেনের প্রতীচীতে যুক্ত আছি। কাল জেলা সংস্করণে প্রতীচীকে নিয়ে নিউজ আছে, তারসঙ্গে আমার ছবি আছে।’  


অনেকেই দারুণ লিখে বা ইমোজি দিয়ে অহনাকে অভিনন্দন জানাল। সর্বাণী লিখল, ‘তুই বিয়ে করিস নি, অহনা?’ অহনা জানাল, ‘নারে, সময় পাইনি, এত ব্যস্ত।' হাসির ইমোজি দিয়ে লিখল, 'আমার মরার পর্যন্ত সময় নেই।’ তন্বী লাভ সাইন দিয়ে লিখল, ‘ইস কী লাকি তুই।’ বল্লরী লিখল, ‘আহারে, তন্বী এখন বরকে তাড়িয়ে পস্তাচ্ছে।’ সবাই হাসির ইমোজি দিচ্ছিল।


সুনীলা লিখল, ‘সামনের রবিবার সন্ধ্যে ছ’টায় আমরা সবাই গুগুল মিটে আড্ডা দেব ভার্চুয়ালি।’ সবাই আনন্দের ইমোজি দিতে শুরু করল।

তন্বী অষ্টভূজের সবার মুখ মনে করতে করতে লিখল, ‘সাথীর খবর কেউ জানিস?’ সুনীলা বলল, ‘ইস্যু হতে গিয়ে দশ বছর আগে মারা গেছে।‘ তন্বী আবার লিখল, ‘আর স্নিগ্ধা?’ ‘ও আত্মহত্যা করেছিল বিয়ের পর পরই।’  সুনীলা ভয়েস মেসেজ করে জানাল।


তন্বী লিখল, ‘তাহলে এখন আমরা ষড়ভূজ।’ অহনা লিখল, ‘আসলে এই অষ্টভূজটার একটা গোপন দরজা ছিল তা আমরা বুঝতাম নারে তখন। আগে জানলে কিছুতেই কাউকে সেই দরজা খুলতে দিতাম না। আরো বেঁধে বেঁধে থাকতাম।’ 


তন্বীর দু’চোখ কখন জলে ভরে গেছে সেটা নিজেই বুঝতে পারেনি। পরেরদিন বাইপাশের ধারে টাটা ক্যানসার রিসার্চ সেন্টারে তার নিজের কেমো দেবার প্রথম ডেট। প্রীতম এসে নিয়ে যাবে। সেটা কি এবার সে গ্রুপে লিখে দেবে তবে! নাকি অহনাকে পার্সোনালি জানাবে! অহনা গোপন দরজাটা খুঁজে পেলেও পেতে পারে। পারলে ওই পারবে ওটা চেপ্পে বন্ধ করে রাখতে।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন