মৃত্যু অথবা
১
“আবার চিঁড়েতন! উফ! জ্বালিয়ে খেল...” অস্থির হয়ে হাতের তাসের গোছাটা একটানে ফেলে দেয় রাণা।
“ওই ফেললি তো সব উলটে... এই হল তোর দোষ। একটুও ধৈর্য নেই। ওরে জিততে গেলে হারতে শেখ।”
“চুক্কর, জ্ঞান দিস না। ” দীপুর কথায় আরও চটে ওঠে রাণা।
“এইজন্য লাইফে তোর কিস্যু হল না।” দীপু খুঁচিয়েই যাবে। জানে, রাণা এরপর রেগেমেগে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে। আর ফিরে আসবে ঘুগনি কিংবা আলুর দম হাতে নিয়ে। তার অর্ধেকটাই শেষ। তবু আনবে। দেখিয়ে দেখিয়ে বাকিটা খাবে।
দীপু মুচকি হাসে। ছেলেমানুষ। এই খ্যাপামি নিয়ে...
খবরের কাগজটা এলোমেলো হয়ে উড়ছিল হাওয়ায়। টেনে আনে সামনে। ভাঁজ করতে গিয়েই চোখে পড়ল খবরটা।
বিশিষ্ট সাহিত্যিকের অকালপ্রয়াণ। শ্রীমতী ইরাবতী সান্যাল। তাঁর স্মরণসভার আয়োজন করেছেন তাঁর শিল্পপতি স্বামী কিংশুক রায়। সমাজের গণ্যমান্য সব ব্যক্তিত্ব উপস্থিত থাকবেন। গানে, কবিতায় বেশ বর্ণাঢ্য ব্যাপার। স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন যেমন হয়। খবরটা এই অবধি ঠিকই ছিল। নিচে একমাত্র ভাগ্যহত কন্যার নামে চোখটা আটকে গেল। কিরণমালা রায়। ভুরু কুঁচকে যায় দীপুর। কিরণমালা ইরাবতী সান্যালের মেয়ে?
“অ্যাই রাণা, শোন একবার।”
সিগারেট ধরানোর জন্য দেশলাই বাক্সের গায়ে কাঠি ঘষতে গিয়ে থেমে গেল রাণা।
“দেখ এই খবরটা।”
“কোন খবর?” রাণা নিস্পৃহ গলায় দেশলাই জ্বালায়। কাঠিটা এক ঝটকায় নিভিয়ে জোরে টান দেয় সিগারেটে।
“এই যে, ইরাবতী সান্যাল। তাঁর স্মৃতিচারণ সভার বিজ্ঞাপন...।”
“হ্যাঁ, তা’ হয়েছে কী? ভদ্রমহিলা ভালো লিখতেন। একটু বেশি বয়সে লেখা শুরু করেন... আমি বেশ কিছু লেখা পড়েছি। খুব স্মার্ট গদ্য। ভদ্রমহিলার কত বয়স হয়েছিল রে? আটান্ন? না ষাট?”
দীপু অধৈর্য হয় সামান্য।
“আরে ধেত্তেরি নিকুচি করেছে ইরাবতীর বয়েসের। কিন্তু তুই এই কিরণমালা রায়কে চিনিস?”
রাণা ঘরের সিলিঙের দিকে তাকিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ে। কে বলবে, একটু আগে তাস ছুঁড়ে ফেলে চেঁচামেচি করছিল!
“রাণা, তুই শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা? এই কিরণমালা কি আমাদের কলেজের...?”
রাণা নিখুঁতভাবে মোলায়েম দুটি ধোঁয়ার রিং ছাড়ে পরপর। ছাদের দিকে উড়তে উড়তে মিলিয়ে যাওয়া রিঙের দিকে তাকিয়ে বলে, “আজ্ঞে হ্যাঁ, সাইকোলজি ডিপার্টমেন্ট। পরে যাকে আমরা ইউনিভার্সিটিতেও দেখেছি। একবছরের সিনিয়র।”
রাণার উত্তরে অবাক হয় দীপু। “কিরণমালা ইরাবতী সান্যালের মেয়ে? তুই জানতিস?”
রাণা আধশোয়া হয় সিগারেট মুখে নিয়ে। “তখন জানতাম না। মানে যখন আশুতোষ কলেজে সাইকোলজি অনার্স পড়ত, তখন ডেফিনিটলি চিনতাম না বা জানতাম না। তারপর রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের চত্বরেও টের পাইনি। শুধু জানতাম, ওর বাবা একজন বড়সড় বিজনেসম্যান। কিন্তু মায়ের পরিচয় গত কিছুদিন হল জেনেছি। তা’ও ইরাবতী সান্যালের মৃত্যুর পর। খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন, ফেসবুক... টুকটাক কিছু কথা বেরোচ্ছিল। সেখানে বলা হয়েছে, ইরাবতী সান্যালের একমাত্র কন্যা কিরণমালা। যিনি আপাতত প্রবাসে রয়েছেন। ডাক্তার স্বামীর কর্মস্থলে। তবে কোথাও মায়ের মৃত্যুতে তাঁর কোনও প্রতিক্রিয়া এখনও পাওয়া যায়নি।”
“আমার ভীষণ অদ্ভূত লাগছে রাণা। ইরাবতী সান্যাল লেখকমহলে যথেষ্ট পরিচিত নাম। একেবারে অখ্যাত এলেবেলে লেখক নন। নামী পাবলিকেশন থেকে বেশ কিছু বইপত্র রয়েছে, ভালো বিক্রি। ছোটদের জন্য উপন্যাস লিখেছেন, বড়োদের জন্য লিখেছেন। খুব টেকস্যাভি মহিলা। নিয়মিত লিখতেন, ফেসবুকে নিজের স্টেটাস আপডেট দিতেন। আমার মতো নীরস লোকেরও ওনার লেখা এদিক-সেদিকে চোখে পড়েছে। কিন্তু গোটা ছাত্রজীবনে কিরণমালা তার মায়ের পরিচয় কোথাও দেয়নি। মানে, মানুষ তো বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্পে আড্ডায় বসেও বলে, সেভাবেও বলেনি। কেন?”
রাণা আধবোজা চোখে সিলিঙের দিকে তাকিয়ে ছিল।
“মাথা খাটাচ্ছিস? নতুন কেস হিসেবে ভাবছিস? ধুস! আরে বাবা, ইরাবতী সান্যালকে কোনওদিন তাঁর হাজব্যাণ্ডের পরিচয় দিতে দেখেছিস? বাপের বাড়ির সান্যাল পদবীটাই ব্যবহার করতেন। নিজের লেখার জোরে নিজে পরিচিত হয়েছিলেন। ওনার স্বামীকে চিনিস তো? স্বনামধন্য শিল্পপতি। তাঁর মেয়ে-বউকে নিয়ে ভুলভাল সন্দেহ দেখালে কিংশুক রায় তোকে আমাকে ছবি করে দেবে... আর তাছাড়া কিরণমালা যখন আমাদের কলেজে পড়ত, তখন ওর মা এত লেখালেখি করতেনও না, বা লিখলেও সেভাবে প্রচারিত ছিলেন না। উল্লেখযোগ্য কোনও নাম ছিলেন না।”
“কিরণমালা বড়োলোকের মেয়ে জানতাম। গাড়ি করে আসত, যেত। কাউকে পাত্তা দিত না, কারও সঙ্গে কথা বলত না। তেমন ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব ছিল বলেও জানি না বা দেখিনি। আমরা সারাজীবন ওকে দেমাকি ভেবে এসেছি...”
“সুন্দরী মেয়েরা পাত্তা না দিলে সবাই যা ভেবে থাকে আর কি...”
রাণার ঠেস দেওয়া কথাটা পাশ কাটিয়ে গেল দীপু।
“সুন্দরী? কী জানি, আমার বরাবর মনে হয়েছে খুব ডাঁটিয়াল। ও যে অত বড় বিজনেসম্যানের মেয়ে, তা’ও জানতাম না আমরা। ফেয়ারওয়েলে না অ্যানুয়াল ফেস্টে মনে নেই, ওকে বোধহয় একটা বিজ্ঞাপনের ফর্ম দেওয়া হয়েছিল। একবারে তাতে একটা পঁচিশ হাজার টাকার চেক এনে দেওয়াতে ইউনিয়ন রুমে ফিসফাস শুরু হয়। মনে আছে তোর?”
রাণার সবই মনে আছে। সেদিনের ঘটনার রাণা প্রত্যক্ষ সাক্ষী।
রাণা তখন ইউনিভার্সিটির ছাত্র-সংসদের জিএস। শাসকদলের মদতপুষ্ট ইউনিয়নে প্রতি বছর বেশ ঘটা করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। ছাত্র-ছাত্রীদের চাঁদা, এদিক-সেদিক স্পনসর জোগাড় করে দিব্যি প্রোগ্রাম হয়। হঠাৎই কেউ একজন বায়না করে, এবার ক্লাসের সব স্টুডেন্টরা উদ্যোগী হয়ে বিজ্ঞাপন জোগাড় করে দিক। দেখা যাক না, কারও মামা-কাকা-জ্যাঠাকে দিয়ে আরও বেশি কিছু মাল আনানো যায় কিনা। সেই সময় ফর্ম ছাপিয়ে খুব যত্ন নিয়ে বিলি করা হল সব ডিপার্টমেন্টে। রাণা ছিল কেমিস্ট্রির, আর ফিজিওলজির রিনি। ফিজিক্সের অরিত্রও প্রচুর ছুটোছুটি করত। ওরা তিনজন সবথেকে অ্যাকটিভ মেম্বার। ওদের কাছেই ধীরে ধীরে জমা পড়ে সব ফর্ম আর চেক। সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টের কিরণমালা রায়ের কাছ থেকে একটা বিশাল অ্যামাউন্টের চেক পেয়ে রীতিমতো থমকে গিয়েছিল ওরা। যদিও কিরণমালা নিজে ইউনিয়ন রুমে আসেনি। ওর ডিপার্টমেন্টের অন্য কারও হাত দিয়ে পাঠিয়েছিল। হলই বা ক্রসড চেক, অ্যাকাউন্ট পেয়ি, কিন্তু এত উদাসীনভাবে কেউ অত টাকার চেক পাঠায়? সেদিনই ওদের প্রথম অবাক লাগে। সাদা খামের মধ্যে থেকে চেকটা বেরোতে প্রথমে একেবারে আঁতকে ওঠে অরিত্র।
“উরিস্লা! ইকিরে... এ তো দেখি অ্যাক্কেরে মেয়ের বিয়ের যৌতুক!”
রিনি আরও সরেস। সে উঁকি মেরে দেখে বলল, “ধুস, আড়াই হাজার টাকায় কারও মেয়ের বিয়ে হয়?”
রিনির নাকের সামনে চেকটা নাড়িয়ে অরিত্র বলতে থাকে, “চোখের ফিজিওলজিটা ভালো করে পড় রিনি, ওটা বোধহয় এবারের টার্মে ইম্পর্ট্যান্ট নয় বলে বাদ দিয়েছিস। পঁচিশের পরে তিনটে শূণ্য বসানো আছে মা আমার। নিজের চোখটা খুলে রেখে এবার আমার চশমা নাকে দিয়ে দেখ ভাই।”
রাণা একটা বড় ফাইল খুলে সব কাগজ মিলিয়ে ভরে টাকা এন্ট্রি করছিল। ওদের শূণ্য সংক্রান্ত আলোচনায় ফিরে তাকায়।
“কে আবার ক’টা শূণ্য পেল?”
“কে আর কী পাবে বস। এই দ্যাখো, ইউনিয়নের প্রোগ্রামে একধাক্কায় পঁচিশ হাজার টাকা। একেই বলে বিজ্ঞাপন।”
“সে কি রে! দিল কে? মানে এত দিলদরিয়া কে? তার ক’টি মেয়ে আছে তা’লে খোঁজ নে ভাই শিগগির। লাইন লাগাই...”
রিনি এতক্ষণে ধাতস্থ হয়েছে। “ভালো করে দেখ, এই চেক দিয়েছেন কিংশুক রায়। নামটা চেনা। তবে তাঁর মেয়ের নাম...”
রাণা হেসে বলে, “বলেই ফেল,ভাগাভাগি করে নেব আমি আর অরিত্র। তুই এ যাত্রা ফক্কা...”
রাণার হাসির ওপরে বাড়তি হাসি চাপিয়ে রিনি বলে, “মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড, কিংশুক রায়ের মেয়ের নাম কিরণমালা রায়। সাইকোলজি ডিপার্টমেন্ট। মাত্র এক ব্যাচ সিনিয়র। যদিও এজ ইজ জাস্ট আ নাম্বার... তবুও। নাম হল কিরণমালা, বুঝলে চাঁদু। তোদের সব গুড়ে কিচকিচ করছে বালি... হে হে হে।”
ওদের হাসাহাসি ওই অবধিই। কিরণমালা পঁচিশ হাজার টাকার বিজ্ঞাপন দিয়েছে বলে ইউনিভার্সিটিতে ইউনিয়ন থেকে তাকে আলাদা কোনও খাতির করা হয়েছে বলে শোনা যায়নি। বরং অত তাচ্ছিল্যভরে চেক পাঠিয়েছিল বলে আদর্শবোধে একটু আঘাত লাগে ছাত্র-সংসদের সাধারণ সম্পাদক রাণা সেনগুপ্তর। সেই বছরই কিরণমালার ফাইনাল ইয়ার। সে ইউনিভার্সিটিতে আসত খুব কম। এলেও গম্ভীর হয়ে ফার্স্ট বেঞ্চিতে বসত। চুপচাপ নিজের ক্লাস করে বাড়ি চলে যেত। ক্যান্টিনের আড্ডাতেও তাকে কেউ কখনও টানতে পারেনি। বছরখানেকের মধ্যে শোনা গেল কিরণমালা বিয়ে করে সাগরপাড়ি দিয়েছে। তার নাম স্মৃতি থেকে মুছে ফেলতে কারওরই তেমন সময় লাগেনি।
কিন্তু তাকে কিংশুক রায়ের মেয়ে বলে জানতে পারলেও তার মায়ের নাম যে ইরাবতী সান্যাল, এটা জানতে এত বছর লেগে গেল? ইরাবতীও কোথাও কোনওদিন তাঁর পারিবারিক পরিচয় প্রকাশ করতেন না। তাঁর মেয়েও কি সেই পথে নিজের পরিচয় গোপন রেখেছে? কিংশুক রায়ের তো সোশ্যাল মিডিয়াতে কোনও প্রোফাইলই নেই। পছন্দ আর কাজের জগত আলাদা হলে মানুষ কি এমনই হয়?
সাহিত্যিক ইরাবতী সান্যালের এই স্মরণসভায় কোনও রহস্যের লেশমাত্র নেই। শুধু তলায় কিরণমালার নাম দেখে এতদিন পরে নিজেদের মধ্যে আবার সেই পুরনো দিন ফিরে এল।
মোবাইলের রিং টোনে চন্দ্রবিন্দুর গান। মৌনমুখরতা।
রাণা ফোন হাতে তুলল। মুচকি হেসে স্ক্রিনটা বাড়িয়ে দিল দীপুর দিকে।
“কে রে?”
“সমাপতন। যাকে সহজ ইংরেজিতে বলে কো-ইনসিডেন্স।”
ট্রু কলারে অচেনা নম্বরের সঙ্গে একটা নাম ফুটে উঠেছে।
‘কিরণমালা রায়।’
(ক্রমশঃ)
বাহ্ সুন্দর শুরু
উত্তরমুছুনবাহ্, প্রথম পর্বেই টান থেকে গেল।
উত্তরমুছুনসুন্দর শুরু হল। চলুক...
উত্তরমুছুনবাহঃ খুব সুন্দর
উত্তরমুছুন