শ্রাবণের ধারার মতো
পর্ব ২
এই অবধি পড়ে ঊশ্রী ভীষণ মন খারাপ করে মাকে বলল,'মা তুমি কি ওদের আলাদা করে দেবে?'দেবপ্রিয়া মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,'সে তো ওদের উপর নির্ভর করছে রে।ওদেরকেই বুঝতে হবে কি ওরা চায়?'
-ইস্যুটা তো খুবই সাধারণ।
-সেটা তোমার মনে হচ্ছে,ওদের নয়।
-কিন্তু মা...
-উহু আর নয়।আমার লেখাকে প্রভাবিত করবে না।তুমি এবার নিজের কাজে যাও।
বৃষ্টি ঝরে পড়ছে অবিরাম।ঊশ্রী মায়ের চোখে কিছু খুঁজতে চেয়ে একবার তাকাল।দেবপ্রিয়া ততক্ষণে মন ডুবিয়ে দিয়েছে সোহাগে।
ঊশ্রী পা ফেলে এগিয়ে আসে বারান্দায়।বাবার কথা ভাবতে চায় কিন্তু অস্পষ্ট ছবিটাতে আলো ফেলতে পারেনা।'নিরাকার অবয়ব নিয়ে ঘর করা যায়না'বহুবার মা একথা বলেছে,নিজেকেই হয়তো।তবু শুনেছে সে।ছোটোবেলায় যতদিন ওর দিদা বেঁচে ছিলেন জিজ্ঞাসা করেছে,'এর মানে কি দিদামা!'
-ওরে বাবা ঊশ্রী এত কঠিন কথা তুই পুরোটা বললি কি করে হ্যাঁ?আমি তো মনে রাখতেই পারতাম না।
-আহ্!তুমি অন্য কথা বলছো কেন?
দিপালী নাতনীর কথায় গুরুত্ব না দিয়ে কেবলি কথা নিয়ে খেলতে খেলতে ওর মনটা সরিয়ে দিত অন্য দিকে।বড় হবার সাথে সাথে ঊশ্রী দেবপ্রিয়ার ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে ক্রমশ।মায়েতে মেয়েতে খোলা বারান্দা আবিষ্কার করেছে নিজেদের মধ্যে।বাবাকে নিয়ে আগ্রহ দেখালে দেবপ্রিয়া স্পষ্ট করে বলেছে,'অনুজ সত্য গোপন করত।যে সত্য আমার জানা দরকার ছিল।সম্পর্কের শুরু থেকেই এই লুকোচুরি আমি বুঝতাম।'
-তাহলে বিয়ে করলে কেন?
-কি জানিস মুনিয়া!মানুষ কি চায় সেটা বোধহয় সে নিজেই জানেনা।অনুজের গ্রেসফুল ব্যক্তিত্ব আদর করার ধরণ সব এত পছন্দ ছিল যে অনেক কিছু উপেক্ষা করে গিয়েছি।যখন একসাথে থাকতে এলাম তখন সব বদলে গেল।দমবন্ধ লাগতে শুরু করল।চলে এলাম।
ঊশ্রী মায়ের চোখে কখনো কোনো আক্ষেপ দেখেনি।কেন!মা কি বাবাকে ভালোবাসত না।একটা মানুষের জন্য মায়ের মনে কেন কোনো উত্তাপ নেই?
----------------------------- ----
সোহাগের পিত্রালয়ে ফিরিয়া যাইবার কোন উপায় নাই বলিয়া সে ধীরে ধীরে পরিস্হিতির সহিত মানাইয়া চলিবার রাস্তা খুঁজিতে লাগিল।বড় জা বিন্দুবালার সহিত সময় কাটাইতে লাগিল।বড়ির ডাল বাটা,পিঠে পুলির রকমারি কায়দা আয়ত্ত করিবার অভিপ্রায়ে নিজেকে ডুবাইয়া রাখিল কিন্তু সপ্তাহ পরেই তাহার প্রাণ যায় যায়।দক্ষিণের বারান্দায় আরাম কেদারায় হাত রাখিয়া কাঁদিয়া উঠিল।
-তুমি ফিরিবে না!আমার প্রেম মিথ্যা করিয়াই তোমার আহ্লাদ!ঐ চন্দ্রনাথের সঙ্গ তোমার এত প্রিয়।আজ সাতদিন হইল তুমি ফিরিলে না?
দাসী খুঁজিয়ে খুঁজিয়া আরাম কেদারার পার্শ্বে আলুথালু সোহাগবালাকে শুইয়া থাকিতে দেখিয়া মুখ বাঁকাইয়া গৃহিনীকে সংবাদ দিতে একতলায় নামিয়া আসিল।গৃহকত্রী যমুনাবতী রান্নাঘরে তদারকিতে ব্যস্ত।
-মাগো তোমার বৌ যে সোয়ামির দুককে আরাম কেদারা জড়িয়ে ঘুমুচ্চে।আর কত পোচ্ছয় দেবে গো মা?
-বেশি দুঃসাহসের কথা বললে তোর মুকে নুড়ো জ্বেলে দুবো হারামজাদি।দূর হ।মোতির মা একবার এদিক পানে এসো তো বাপু।
মোতির মা এই বাড়িতে দীর্ঘ তিরিশ বৎসর অতিক্রম করিয়াছে।যমুনাবতীর সুখ দুঃখের সঙ্গী।নীরবে আসিয়া দাঁড়াইতেই যমুনাবতী রেকাবিতে সামাণ্য সন্দেশ আর ফল দিয়া বলিলেন,'সামনে বসিয়ে খাইয়ে আসবে।আর জটিকে বলবে ওকে আজ সন্ধ্যায় যেন সাজিয়ে যায়।'মোতির মা কিছু বলিবার অভিপ্রায়ে তাকাতেই যমুনাবতী গম্ভীর স্বরে বলিয়া ওঠেন,'যাও মোতির মা,বিলম্ব আমার অপছন্দ।'মুখে যাহাই বলুক ছোটোছেলের আচরণ তাহার নিকটেও সুবিধার লাগে না।কি হইলে যে তাহার অন্তর পূর্ণ হইয়া ওঠে কে জানে?অমন সুন্দরী,বিদূষী স্ত্রী ছাড়িয়া জলহস্তীর ন্যায় চন্দ্রনাথের সহিত যত্রতত্র ভ্রমণে কি সুখ লাভ করে সে কেবল ঈশ্বরেই জানে।বড়োছেলে সৌম্যাদিত্য অপেক্ষায় নীরিহ আর তাহার স্ত্রী বিন্দুবালা নেহাতই সাধারণ।উহাদের জীবন ঘটিতে তুলিয়া রাখা জলের ন্যায়।গড়াইয়া খাইলেও হয় আবার নষ্ট করিলেও কারো কিছু যায় আসেনা।সোহাগবালা ইহাদের অনেক ঊর্ধ্বে।যমুনাবতী অন্তরে ছোটবৌটিকে স্নেহের অধিক ভালোবাসেন।মায়া দিয়ে গড়া মেয়েটির চোখ।শুধু হাতের বাঁধন আলগা বলিয়াই সব গড়াইয়া যায়।উজাড় করিয়া ভালোবাসিতে জানে ঝগড়া করিতে তার সাধ নাই।অভিমানে ফুলিয়া ওঠে কেবল অধিকার দাবী করিতে বিমুখ।এমন মেয়েকে ভালো না বাসিয়া উপায় কি?মোতির মা আসিয়া দাঁড়াইল।
-মা,ছোটবৌ খেয়েচে।
-বাঁচালে বাপু।তা সে কি করচে?কি হল মুকে কুলুপ আঁটলে যে।সে কি করচে?
-পুকুরঘাটের দিকে গিয়েচে।সাথে রাজ্যির জামাকাপড়।
-ওমা,সেকি কতা!শিগগিরই দাসীকে পাটাও।আদরের দুলালী সে অনতথো হবে মোতির মা।যাও যাও।
মোতির মা নিজেই পা চালাইয়া পুকুরঘাটের দিকে আগাইয়ে যাইতেই কাঁঠালতলা হইতে দেখিতে পাইল,সৌম্যাদিত্য সোহাগের হাত হইতে কাপড় গুলি লইতেছে আর দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া সোহাগ কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছে।মোতির মা প্রসন্ন মনে ফিরিতে গিয়াও পুনরায় পিছন ফিরিতেই আকাশ কালো করিয়া আসিল।কে জানে কিসের ইঙ্গিত!ঝড় বৃষ্টি পৃথিবী তোলপাড় করিতে আগ্রহী হইয়া উঠিল।
------------------------------ ------------------------------ --
দেবপ্রিয়া লেখা বন্ধ করে চুপ করে বসে রইল।কোনদিকে নিয়ে যাচ্ছে সে সোহাগকে?নিজেকে কখনো কখনো অচেনা লাগে।এমন বিচ্ছেদ কেন পরিকল্পনায় আসছে?কোন ভাবে কি এই ধূসরতার মধ্যে সে নিজেকে মগ্ন করে তুলেছে?অনুজের কথা কোনভাবেই সে মনে রাখতে চায়নি কিন্তু সত্যি কি সম্ভব ওকে ভুলে থাকা?এতটা উদাসীন কোন মানুষ কী করে হতে পারে?কোথায় আছে অনুজ?বল্লভপুরের কোনো মাটির ঘরের দোচালায়?নাকি পাহাড়ের কোলে কোথাও টেন্ট করেছে।আদিত্যনাথ কি অনুজের ছায়া?নাহ্ কিছুতেই এটা হতে দেওয়া যায় না।আদিত্যকে ভিন্ন শেড দিতে হবে যেভাবেই হোক।মরুনকিশোর কোথায় থাকে খোঁজ নিতে হবে।ওর নামের মানেটা জানা হয়নি।কি খুঁজছিল ও পুরীর মন্দিরে?কে জানে?গোধূলি মাসি ওর খবর দিতে পারবে।কালই একবার ফোন করতে হবে।বুকের বাঁদিকটা বড্ড চাপ ধরে আসে আজকাল।একটা ডাক্তার না দেখালেই নয়।ঊশ্রী এখনো কলেজ থেকে ফেরেনি বোধহয়।ফিরলেই আগে এইঘরে আসবে,'মা সোহাগের কি হল?ওর বর ফিরলো?মা আদিত্য কি গে?'প্রশ্নে প্রশ্নে পাগল করে দেবে।একা থাকাটাই এখন অভ্যাস।তবু মেয়েটা এলে মনে হয় যেন স্নান সেরে ঠাণ্ডা শরীরে এসে বসল নিশ্চিন্ত হয়ে।দুপুরের এই শেষ রোদের তেজে একটা মায়া গন্ধ আছে।বাড়ির পাশের আমগাছটায় এবারো মুকুলের বৃষ্টি নেমেছে।মা থাকলে ঠিক ঘরের ফুলদানিতে ওরা কেউ না কেউ ঠাঁই পেত।দেবপ্রিয়া জানে মা চলে যাবার আগে ভীষণ ভাবে চেয়েছিল অনুজকে জানানো হোক।কোনভাবেই এই ভাবনাকে প্রশ্রয় দিতে চায়নি সে।বহুকষ্টে যে মোহ ছেড়ে বেরিয়েছে সেখানে আর ফিরতে চায়না।এই সময়টায় গোটাবাড়ি ঘুমিয়ে থাকে।কাজের লোকেরা,ধলিদি সবাই ঘুমায়।কেবল ড্রাইভার ছেলেটা গান শোনে রেষ্টরুমে বসে।অনেকক্ষণ ধরে টেলিফোনটা বাজছে।ল্যাণ্ডলাইন।কেউ বোধহয় ধরার নেই।রকিং চেয়ারটায় গুটিসুটি দিয়ে বসল দেবপ্রিয়া।মেয়েটা ফিরছে না কেন?চারটে প্রায় বাজতে চলল অথচ অন্যদিন ফিরে যায়।আবার বাজছে ফোনটা।ভুরু কুঁচকে উঠল তবে কি মেয়ের কিছু!তাড়াতাড়ি দরজা দিয়ে বেরিয়ে ড্রইং রুমে ছুটল দেবপ্রিয়া।নাহ্ আবার কেটে গেল।কে হতে পারে?কেন ফোন করছে?ঘরে ফিরে মেয়েকে ফোন করল।সচরাচর ফোন করে জানতে চাওয়ার মানসিকতা ওর নয়।মেয়েকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতেই তার আগ্রহ।তবু...
-হ্যালো ঊশ্রী!
-হ্যাঁ মা বলো।
-ফিরছিস?
-একটু কাফে তে আছি মা,কিছু বলবে?দরকার আছে কিছু?
-না না,দরকার কিছু নেই।সাবধানে ফিরিস।
-আমি আধঘন্টার মধ্যে ঢুকে যাব।
-আচ্ছা বেশ।
ফোনটা রেখে দেবার পর অস্বস্তিটা বেড়ে গেল।কে হতে পারে এই সময়?আত্মীয় স্বজন কারো সাথেই তো তেমন যোগাযোগ রাখেনি সে।কিবা হত রেখে?একই উত্তর দিতে আর ভালো লাগতনা।কলিংবেলটা বাজছে।ধলিদি নিশ্চই উঠবে।চুপচাপ অপেক্ষা করে দেবপ্রিয়া।কানে আসে দরজা খোলার আওয়াজ।ফিসফিস শব্দ এবং আবার নিস্তব্ধতা।খুব মৃদু পায়ের আওয়াজ।খানিকপর ধলিদি ডাকে দরজার বাইরে থেকে।
-দিদি,এসেছে।
-কে?
-তোমার পিসতুতো বোনের বর।
-কি?বের করে দাও এখুনি।যাও।স্কাউন্ড্রেলটাকে ঢুকতে দিলে কেন?
কথা শেষ হবার আগেই পর্দা সরিয়ে ঢুকে এল বরুণ দত্ত।মাথার চুল ধুলো ভরা,পোশাক জীর্ণ,ময়লা,চোখ লাল।
-প্রিয়া,নিরুপায় হয়ে এসেছি।একটিবার কথা শোনো।তারপর যা সিদ্ধান্ত হয় নিও।
-তুমি এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাও।তোমার কোনো কথা শুনতে চাইনা আমি।যাও বলছি।
-একটু শোনো,তারপর...
-বরুণ আমি পুলিশে ফোন করব।
বরুণের চোখের আকুতি,অসহায়তা মুহূর্তে উবে গেল।এক ভয়ংকর শয়তানিতে হলদে হয়ে উঠল চোখ।গলায় মিথ্যে কান্না রেখে তাকাল।
-ঊশ্রীর কিছু ছবি এখনো আমার কাছে আছে।যদিও আমি সেসব তোমায় বলতে চাইনা।তোমার মন চঞ্চল হলে লেখালিখি আবার বন্ধ হয়ে যাবে আগের মতো।তারচে আমায় একটু সময় দাও প্লিজ।
মাথা চেপে ধরে দেবপ্রিয়া।জীবন কিছুতেই যেন নিয়ন্ত্রণে থাকে না।সামাণ্য বিচ্যূতি সামাণ্য ভুল এত দীর্ঘ কালো ছায়া ফেলে কি করে?সাড়ে চারটে প্রায় বাজে।মেয়েটা ফেরার আগে এই আপদকে বিদায় করতে হবে।কিন্তু এভাবে কতদিন আর কতদিন।একটা স্হায়ী সমাধান খুব প্রয়োজন।দেওয়ালে টিকিকিটা টিকটিক করে উঠল।
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন