পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২২

শ্যামলী আচার্য

                            



মৃত্যু অথবা  ( পর্ব ৩)



ঘড়ির কাঁটায় ন’টা সাতাশ বাজতেই রাণা একবার তাকায় দীপুর দিকে। সময়ের ব্যাপারে ও অসম্ভব খুঁতখুঁতে। দীপু জানে কিরণমালা ঠিক সাড়ে ন’টায় আসবে বলেছিল। দীপু সবেমাত্র বাঙালির টাইম ম্যানেজমেন্ট, মেয়েদের সাজতে সময় লাগে, এইসব নিয়ে দু’চার কথা বলবে ভাবছিল, ঠিক সেই সময় রাণার মোবাইল বেজে ওঠে।   
“আমি অপেক্ষা করছি। ভেতরে আসুন।” ফোনে কথা শেষ হতে না হতেই ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায় যে মহিলা, তার সঙ্গে কলেজের সেই যুবতীর মিল শুধু কাঠামোয়। বাইরের চেহারা রীতিমতো বদলেছে। মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত অর্থের জৌলুস। এতটা ঝলমলে আর ফ্যাশনেবল কিরণমালা কোনওকালেই ছিল না। তার সঙ্গে বাড়তি যোগ হয়েছে সপ্রতিভতা। 
কিরণমালা ঘরে ঢুকে নমস্কার করে দাঁড়ায়। “অনেকদিন পরে দেখা হল। কিন্তু আমার বেশি সময় নেই হাতে। খুব চটপট কাজের কথাগুলো বলতে চাই।” রাণার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে বলতেই দীপুর দিকে তাকায় কিরণমালা। চোখে প্রশ্নবোধক চিহ্ন।
রাণা পরিচয় করায়, “ও আমার বন্ধু। একটি প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করে। আমার ক্লাসমেট। দীপন মিত্র। মনে আছে কীনা জানি নয়া। আপনি ওকে কলেজে দেখে থাকতে পারেন। আপনি বসুন। দীপুর সামনে কথা বলতে আপত্তি থাকলে...”  
“না না। আমার কোনও অসুবিধে নেই। আমারও চেনা চেনা লাগছে ওনাকে... এনি ওয়ে...”
“বসুন প্লিজ।” 
কিরণমালা বসে। আঁচল গুছিয়ে নিয়ে একমুহূর্ত চুপ করে থাকে। মাথা নিচু। 
“আমার মায়ের খুনের তদন্ত করতে হবে। সেইজন্যেই আসা।”  
ঘরের মধ্যে বাজ পড়লেও দীপু এতটা চমকে যেত না। কিন্তু রানা একদম স্থির। নিস্পৃহ। 
“আপনার মা, মানে...”
“আমার মা। ইরাবতী সান্যাল। লেখালেখি করতেন, অনেকেই তাঁকে চেনেন।” 
“কিছু মনে করবেন না, আপনাকে আমরা কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে দেখেছি দূর থেকে। কিন্তু কখনও কোনও অবস্থাতেই আপনি নিজের বাবা-মায়ের পরিচয় কাউকে দেননি। এটা পার্সোনাল প্রশ্ন, তবু... উত্তর দেওয়া না দেওয়া আপনার ব্যাপার।”   
রাণার কথায় মৃদু হাসল কিরণমালা। 
“আজ অনেক কথা বলব বলেই এসেছি। আগে বলি, তিন-চার বছর বয়স পর্যন্ত আমার সেই অর্থে কোনও নিজস্ব পরিচয় ছিল না। মানে, আমি জানতাম না, কে আমার বাবা-মা। আমি কিংশুক রায় আর ইরাবতী সান্যালের দত্তক নেওয়া সন্তান। আমার ঠিকানা ছিল বেসরকারি একটি অনাথ আশ্রম। যেদিন একটা জমকালো বিরাট বাড়িতে আমাকে নিয়ে যাওয়া হল, সেদিন থেকে এই দুটি মানুষকে আমায় ‘বাবা-মা’ বলতে শেখানো হয়েছে। আর খুব ছেলেবেলার ঘটনা হলেও সেই দিনটা আমার এখনও মনে আছে। জ্ঞান হবার অনেক পরের ঘটনা তো...
“আমার ঠিকানা বদলে গেল। ফুটপাথ থেকে রাজপ্রাসাদ। অনেক আদবকায়দা শিখলাম। আর বহু কিছু পেতে শিখলাম। না চাইতেই পাওয়া। প্রচুর খেলনা, অগুনতি জামাকাপড়, টেবিল উপচোনো খাবার। এককথায় প্রাচুর্য। কিন্তু আমার ভেতরে একটা গরিব মন থেকে গেল। সবকিছু পেতে পেতেও পাওয়ার অভ্যেস হল না। কেবল মনে হত, এগুলো আমার নয়, আমার প্রাপ্য নয়। আমি এখানে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি। কেউ যেন একটা রঙিন সিনেমা দেখাচ্ছে, হঠাৎ সুইচ অফ করে ঘর অন্ধকার করে দেবে। আমার খুব ভয় করত। আমি কেমন গুটিয়ে থাকতাম। সহজ হতে পারতাম না। প্রথম এই অসুবিধে বুঝেছিলেন ইরাবতী সান্যাল। আমার মা।”  
রাণা আর দীপু দুজনেই লক্ষ্য করে ‘মা’ শব্দটা বলতে বলতে চোখ উপচে আসছে কিরণমালার। সে সামলে নেয় চট করে। বলতে থাকে, “অনেক জন্ম তপস্যা করলে অমন মা পাওয়া যায়। তিনি আমার বায়োলজিক্যাল মাদার নন ঠিকই, কিন্তু...। মা প্রচুর পড়তেন, রাত জেগে লিখতেন। কিন্তু আমাকে এতটুকুও অবহেলা করেননি কোনওদিন। নিজে যখন যা করেছেন, আমাকে পাশে বসিয়ে নিতেন। আমাকে ঘুম পাড়িয়ে কোলের কাছে রেখে লিখেছেন, বাঁহাতটা আমার মাথার ওপর, ডান হাতে কলম চলছে। অনেক বড় হয়েও আমি এমনটাই দেখেছি। আর শিখিয়েছেন, ‘নিজের পরিচয়ে বাঁচবে। অন্য কারও পরিচয়ে নয়। প্রতিটি মেয়ের নিজস্ব পরিচয় তৈরি হওয়া দরকার। সে কার মেয়ে, কার বৌ, কার মা, এটা তার পরিচয় নয়। বী ইওরসেলফ। মা নিজেই বারণ করেছিলেন আমি যেন কোথাও আমার বাবা-মায়ের পরিচয় ব্যবহার না করি। আমি মায়ের সব কথা শুনতাম। এই কথাটাও শুনেছি।”  
কিরণমালা কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। এই সুযোগে রাণা জিগ্যেস করে, “আর কিংশুক রায়? আপনার বাবা?” 
“বাবা? সত্যি কথা বলতে কি, বাবারা কেমন হন আমি জানি না। ছেলেবেলা থেকে মায়ের বই পড়ার নেশা দেখে আমারও বন্ধু হয়েছিল বই। আমাদের বাড়িতে একটা বিরাট লাইব্রেরি আছে। আবার বাবার কাকার। আমাদের কোম্পানির কর্ণধার কল্যাণ রায়ের। আমি সেখানে বইয়ে মুখ গুঁজে বসে থাকতাম। বন্ধু ছিল না তেমন। থাকলেও তাদের কাছে বাবাকে নিয়ে গল্প হত না। আর কিংশুক রায় বরাবর উচ্চাকাঙ্ক্ষী। নিজের কেরিয়ার, নিজের বিজনেস নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত। যতটুকু শুনেছি, মূলত মায়ের চাপেই তিনি আমাকে অ্যাডপ্ট করেন। স্নেহ-মমতা নিয়ে তাঁর শো-অফ ছিল না। আমাকে তিনি কোনওদিন খুব কাছে টেনে নেননি। আমিও দূরত্ব বজায় রেখেছি। মা’কেও দেখেছি একটা অদৃশ্য পাঁচিল তুলে রাখতেন। আমার আর মায়ের কিছু কমন জগত থাকলেও কিংশুক রায় আমাদের দুজনের কাছেই দূরের গ্রহের জীব।”  
কথা বলতে বলতেই একবার ঘড়ি দেখে কিরণমালা।  
“আমি কিন্তু আমার মায়ের মৃত্যুর তদন্ত করতে এসেছি। আমি নিশ্চিত, আমার মায়ের মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। তাঁকে মেরে ফেলা হয়েছে।”    
রাণা বলে, “কী করে নিশ্চিত হচ্ছেন? মাঝরাতে হার্ট অ্যাটাক। বাথরুমে পড়ে গিয়েছিলেন। সকালে কাজের মেয়ে দেখতে পায়। তখন ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান এসে ডেথ সার্টিফিকেট দিচ্ছেন। সবটাই আইনের চোখে অত্যন্ত স্বাভাবিক।” 
কিরণমালা একদৃষ্টে তাকায় রাণার দিকে, ধীরে ধীরে বলে, “আইন আমিও জানি। সেইজন্য আইনের দ্বারস্থ হইনি। জানি, লাভ নেই। আইন থাকলে আইনের ফাঁকও থাকে। খুব সুন্দর নিটোল করে সাজানো একটা খুনের প্ল্যান। মাঝরাতে বাথরুমে হার্ট অ্যাটাকের চেয়ে সহজ সরল স্বাভাবিক মৃত্যু আর হয় না। কিন্তু সত্যিই মাঝরাতে কী হয়েছিল মায়ের? হার্ট অ্যাটাক, না অন্য কিছু? পোস্ট মর্টেম তো হয়নি। কী করে জানা গেল মা’কে কেউ কিছু খাইয়েছিল কীনা। আমাকে জানতেই হবে। মা আমাকে বলে গিয়েছিলেন... মায়ের কিছু একটা মনে হয়েছিল... ইন ফ্যাক্ট মায়ের সঙ্গে আমার বণ্ডিং ভীষণ স্ট্রং ছিল। আমি জানতাম আমি চলে যাবার পরে মা খুব একা হয়ে পড়েছেন।”   
“আপনাকে মা বলেছিলেন... মানে? ইরাবতী সান্যালের মনে হয়েছিল তাঁকে খুন করা হতে পারে?” 
মাথা নিচু করে কিরণমালা।
“মা আমাকে আভাস দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আমি হঠাৎ মরে গেলে একটু খোঁজ নিস কিরণ। আমি শুনে রেগে যেতাম। তখন মা হেসে বলতেন, এত তাড়াতাড়ি মরব না, জানি অনেক পাপ করেছি, সব কর্মফল মিটিয়ে যেতে হবে না? আমি বকলে বলতেন, ভয় নেই রে, অনেক লেখা বাকি। সব লিখে রেখে যাব। তবু...। আমি জানি মায়ের হার্টে বেশ সমস্যা ছিল... সেইজন্যেই কি ওই রাস্তা দিয়ে... আমি জানি না রাণা, প্লিজ আপনি আমাকে হেল্প করুন। এই রহস্য উদ্ধার করতে না পারলে আমার মা’র কাছে আমি অপরাধী হয়ে থাকব...।”  
রাণা একবার তাকায় দীপুর দিকে। “আমি কেসটা নিলাম। আপ্রাণ চেষ্টা করব আপনার সন্দেহ যাতে মিথ্যে হয়, সেটা প্রমাণ করতে। শুধু আমার একটাই প্রশ্ন, কাকে সন্দেহ করেন আপনি?” 
কিরণমালা গম্ভীর হয়ে যায়। উঠে দাঁড়ায় সে। রাণার দিকে তাকিয়ে বলে, “সিস্টেম, সিস্টেমকে সন্দেহ করি আমি,” বলতে বলতেই ব্যাগের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একগোছা নোট বের করে এনেছে কিরণমালা। সামনের সেন্টার টেবিলে রেখে বলে, “এতে পাঁচ হাজার আছে। অ্যাডভান্স পেমেন্ট। আমি কলকাতায় আপাতত কয়েক সপ্তাহ থাকব। তার মধ্যে...। জানি, কাজটা কঠিন। কিন্তু পেশাদার গোয়েন্দার পক্ষে সব সম্ভব। তোমরা ভুলে যেও না, আমি মনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়েছি। আমি জানি, পারলে তুমিই পারবে। আসি। যে কোনও দরকারে ফোন কোরো।”    
রাণা আর দীপুকে সেভাবে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঘর থেকে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে যায় কিরণমালা। শেষ বাক্যে কিরণমালার হঠাৎ ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে সম্বোধন পরিবর্তনও কান এড়ায় না দুজনের। কিরণমালা কি তাদের সঙ্গে ফর্ম্যাল সম্পর্ক ছেড়ে বন্ধুত্বের সহজ পথে আসতে চাইছে? 
ফ্যানের হাওয়ায় টাকার গোছা থেকে নোটগুলো উড়ে পড়ে এদিক-সেদিক। দীপু কুড়িয়ে তুলতে তুলতেই শোনে রাণা অস্ফুটে উচ্চারণ করছে, “সিস্টেম।”  
....................................................................................................................................

(ক্রমশঃ)

1 টি মন্তব্য: