মৃত্যু অথবা
অফিসে বার বার কাজে ভুল হচ্ছিল।
মালতীর সঙ্গে দেখা করে বেশ খানিকটা গুলিয়ে গেছে দীপুর। মালতী কাঁদছিল খুব।
“তুমি পালিয়ে এলে কেন?”
“আমি যে বৌমণিকে বাঁচাতে পারলাম না...। দিদি আমায় কী বলবে... আর...”
“আর?”
“মামাবাবু বললেন, আর থাকতে হবে না তোমার।”
“মামাবাবু বললেন, আর তুমি চলে গেলে?”
“দাদাও বললেন।”
“দাদা, মানে কিংশুকবাবু? কেন?”
মালতী ঢোঁক গিলে বলে, “আমি যে অনেককিছু শুনতে পেতাম... বৌমণি নিজেও আমাকে সব বলত। দিদির বিয়ে হওয়ার পর আরও একলা লাগত... আর শেষদিকে দাদা বুঝে গিয়েছিল আমি ওদের স্বামী-স্ত্রীর সব কথা শুনতে পাই... সেইজন্যেই হয়ত...”
“কী শুনতে মালতী?”
রাণার চোখের দিকে তাকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে মালতী। “বিশ্বাস করুন, বৌমণির মতো সতীলক্ষ্মীর চরিত্র নিয়ে... ছি ছি ছি... সেসব বলতেও মুখে বাধে।”
“চরিত্র নিয়ে এইসব কথা কি কিংশুকবাবু বরাবরই বলতেন?”
“না বাবু। বেশ কিছুদিন হল অফিসের এক পুরনো ম্যানেজারবাবুকে নিয়ে মামাবাবু এসেছিলেন। আর বৌমণি তাকে দেখেই খুব রেগে গিয়েছিলেন। আমাকে ডেকে বলেছিলেন, ওই লোকটা কেন এসেছে আমাকে খবর এনে দে মালতী।”
“সেই লোকটা কে?”
“সেই লোকটার নাম প্রমথ। সেই লোকটা নাকি এককালে আমাদের ডাক্তারবাবুর কম্পাউণ্ডার ছিল।”
“ডাক্তারবাবু মানে?”
“ওই যে, বুড়ো ডাক্তারবাবু। তার কাছে নাকি কাজ করত। মামাবাবু তাই বলেছিল।”
“এই প্রমথবাবুকে কোথায় পাওয়া যাবে মালতী?”
“মামাবাবুর কাছেই ওর নম্বর আছে। আমি জানি। বৌমণির কাছে ওকে মামাবাবু নিয়ে এসছিল।”
মালতীর কাছ থেকে ফেরার পর সারারাত রাণা যে রাত জেগে কী কাজ করল, দীপুর পক্ষে জানা অসম্ভব।
‘চা অ্যাণ্ড টা-তে চলে আয়। ওখানেই বসব। আমি আছি। কিরণমালা আসছে।’
রাণার নিরীহ মেসেজ দেখলেও দীপুর টেনশন বেড়ে যায়।
টি-বুটিকে ঢুকে দেখে রাণা একটা বিশাল আকৃতির ফিশ কবিরাজির ওপর ঝুঁকে পড়েছে। দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘসময় না খেয়ে রয়েছে বেচারা। অর্ণব দীপুকে দেখে হেসে বলে, “আপনি বসুন দাদা, এক্ষুনি গরম গরম ভাজিয়ে দিচ্ছি। অর্ডার হয়েই আছে।”
রাণা মুখ না তুলেই বলে, “এই কবিরাজি না খেলে জীবন বৃথা। আর মন দিয়ে খেলে কবিরাজিকে ঠিকঠাক চেনা যায়।”
দীপু বুঝল, এখন অন্য কথার উত্তর পাওয়া যাবে না। আগে পেট শান্ত করা যাক।
মিনিট পনেরো পরে দার্জিলিং চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দীপু জিগ্যেস করে, “কিরণমালা এলো না?”
“আসবে। আসতে বাধ্য। আজ তাকে আসতেই হবে...”
“মানে?”
“সব বলব। ধৈর্য ধরো। তিনি এলেন বলে। মেসেজ করেছেন, প্রায় এসে গেছেন।”
“আর কে আসবেন?”
“দেখা যাক...”
বলতে বলতেই বৈঠকী ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায় কিরণমালা। তাকে বসতে বলে চায়ের কথা বলে রাণা।
“আমি কিচ্ছু খাব না রাণা। আগে বলো, কী জেনেছ তুমি?”
রাণা হাসে। “যা জেনেছি, তার নাম সিস্টেম। তার আগে প্রথমেই বলি, কিংশুক রায়কে ফোনে কয়েক মিনিটের জন্য পেয়েছিলাম। তিনি স্ত্রীর মৃত্যুতে দুঃখপ্রকাশ করে আমাকে স্মরণসভায় যাবার নেমন্তন্ন করেছেন।”
“আমার মায়ের ডেস্ক কিন্তু এখনও বন্ধ। আমি চাবি পাইনি। খোলার জন্য তালা ভাঙতে হবে।”
“আপনি ভাগ্যিস আজ শ্বশুরবাড়িতে ছিলেন। এই সুযোগে ইরাবতীদেবীর ঘরে আজ সারা দুপুর আমি একাই ছিলাম। অনমিত্রবাবুকে বেশ জপাতে হল সেজন্য। সেখানে সবই রয়েছে। গয়নাগুলো ছাড়া। ওই গয়নার খোঁজ আপনাকেই নিতে হবে। ওটা পুলিশের সাহায্য লাগবে। আমার ধারণা, অনমিত্রবাবুর কাছেই ওগুলো রয়েছে।”
“তালা ভেঙে চুরি?”
“হতেই পারে। আমি আসলে ইরাবতীর লেখার খাতা আর কল্যাণবাবুর ডায়েরিটাই চাইছিলাম।
“যে কারণে আপনাকে ডেকেছি। এবার আসি ইরাবতী সান্যালের অতীত জীবনে। যে জীবন উনি শেষের দিকে বসে লিখতে শুরু করেছিলেন। ওনার মনে হয়েছিল, অন্য কারও কাছ থেকে সবাই সব জানার আগে উনিই সব লিখে যাবেন। মা হিসেবে সন্তানের প্রতি দায় হয়ত। ছেলেবেলা বাবা-মায়ের মৃত্যু, বিধবা বোনের পালিয়ে গিয়ে আবার বিয়ে করা অবধি খুব ফ্ল্যাট সরল গল্প। কিন্তু ওনার জীবন অন্য খাতে বয়ে যায় কল্যাণ রায়ের সঙ্গে দেখা হবার পর। এই জীবনের সাক্ষী ছিলেন একমাত্র ডাক্তার বিশ্বেশ্বর রায়চৌধুরী। চব্বিশ-পঁচিশ বছরের ইরাবতী যখন কল্যাণ রায়ের কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিতে যান, তিনি তখন শুধু সংসার টানছেন। স্বপ্ন ছিল লেখক হবার। স্বপ্নটা হারিয়ে যাচ্ছিল অভাবে-অনটনে। এই সময় অবিবাহিত কল্যাণের সঙ্গে যোগাযোগ ইরাবতীর। কল্যাণ শুধু ব্যবসায়ী ছিলেন না। তাঁর ছিল সেনসিটিভ মন। তাঁর বিরাট লাইব্রেরি দেখলেই বোঝা যায় তিনি কীসে বেশি আসক্ত ছিলেন। কল্যাণের প্রাণের বন্ধু বিশ্বেশ্বরেরও তাই। ইরাবতী তাঁদের দুজনের থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট, কিন্তু মননে আর মেধায় দুজনকে টেক্কা দিতেন। একটা অসম্ভব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে এই তিনজনের।
“ইরাবতীর প্রতি কল্যাণের আসক্তি বিশ্বেশ্বরের নজর এড়ায়নি। তিনি আড়ালে ‘কল্যাণী’ বলতেন ইরাবতীকে। এমনকি কল্যাণও। ইরাবতীর বন্ধ ডেস্ক ছাড়াও বইয়ের তাক ঘেঁটে বহু বই পেয়েছি আজ সারা দুপুর ধরে, সেখানে প্রথম পাতায় কল্যাণী’র নাম। কল্যাণের ডায়েরিতে কল্যাণীকে নিয়ে তার গভীর অনুভূতির দীর্ঘ বর্ণনা। খটকা লেগেছিল ডাক্তারবাবুর বাড়ি গিয়েই। তিনি ইরাবতীর নাম মনে করতে পারছেন না, কিন্তু বহু অতীতের কল্যাণী নামটি তাঁর অবচেতনে রয়েছে।”
কিরণমালা বলে ওঠে, “আমি জানতাম না জেঠু মা’কে কল্যাণী বলতেন... কিন্তু অনেক বইতে আমি কল্যাণী নামটি দেখেছি ...”
“আর আপনাকে বউমা ডাকতেন, তাই না?”
কিরণমালা চমকে উঠে চুপ করে যায়।
রাণা আবার বলতে শুরু করে, “ইরাবতীও ধীরে ধীরে আকৃষ্ট হন কল্যাণের প্রতি। কল্যাণের বইপত্রে আগ্রহ, নিয়মিত সংস্কৃতিচর্চা তার মনের লুকনো ইচ্ছেগুলোকে উসকে দেয়। এমন একটি জীবন পেলে মন্দ কী? আর্থিক অস্বাচ্ছন্দ্য সরিয়ে নিশ্চিন্ত জীবন। নিজের পছন্দ আর স্বপ্নে পৌঁছনোর জন্য এমন জীবনসঙ্গী কে না চায়? কিন্তু তার অস্বস্তি একটাই। কল্যাণের বয়স তাঁর তুলনায় অনেকটাই বেশি। ডায়েরি বলছে, কল্যাণ ইরাবতীকে কখনও বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেননি।
“সম্পর্ক ব্যাপারটা গোপনীয়তার আড়ালে থাকলে তার ধার বাড়ে। ইরাবতী আধুনিকমনস্ক, সময়ের থেকে এগিয়ে। কল্যাণের চিন্তাভাবনাও পরিণত। দূরদর্শী কল্যাণবাবুর পরিকল্পনামাফিক কোম্পানির সমস্ত পুরনো স্টাফ হঠাৎ বিভিন্ন জায়গায় বদলি হতে থাকেন। পাছে একই জায়গায় থেকে গেলে কল্যাণবাবুর গতিবিধি চোখে পড়ে। ইরাবতীর বদলি হয় কোম্পানির প্রোডাকশন সেকশনে। কলকাতার হেড অফিসের বদলে এবার বহরমপুরের ইউনিটে। ইরাবতীর পিছুটান ছিল না। বারাসতের পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে অতএব বহরমপুরে গিয়ে একা থাকতে শুরু করলেন ইরাবতী। আর মাঝে মাঝেই তখন বহরমপুরের প্রোডাকশন ইউনিট ভিজিট করার দরকার হত কল্যাণ রায়ের। তার সাক্ষী দেবার জন্য বহরমপুরের প্রোডাকশন ইউনিটের ম্যানেজার প্রমথ এখনও বহাল তবিয়তে বেঁচে রয়েছে।”
এই অবধি বলে একটু থামল রাণা। গলা খাঁকারি দিল একবার। কিরণমালা নিস্পন্দ, তার প্রতিক্রিয়া বোঝার কোনও উপায় নেই।
“কল্যাণের সন্তান ধারণ করেন ইরাবতী। কিন্তু সমস্যা একটাই। তাঁরা আইনত বিবাহিত নন। এই অবস্থায় কাউকে কিছু জানানো মানে ব্লাণ্ডার। আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়েছে, ইরাবতী সত্যিই আধুনিকমনস্ক ছিলেন, কিন্তু কল্যাণ এই সম্পর্ককে আইনী স্বীকৃতি দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তিনি মধ্যবয়সে এসে নিজের কোম্পানির একজন সাধারণ কর্মীকে বিয়ে করার ঝুঁকি নিতে পারেননি। পুরো ঘটনাটি জানতেন দুজন। একজন ডাক্তার বিশ্বেশ্বর, আর কোম্পানির প্রোডাকশান ম্যানেজার প্রমথ।
“কল্যাণ পরামর্শ দেন অ্যাবরশান। ইরাবতী বেঁকে বসেন। কল্যাণ তাঁর জীবনে না থাক, তাঁর সন্তানটিকে নিয়ে তিনি বাঁচবেন। এবার তিনি শরণাপন্ন হন বিশ্বেশ্বরের। বিশ্বেশ্বর বন্ধুকে জানান অ্যাবরশান করার সময় পেরিয়ে গেছে। ঝুঁকি নেওয়া অসম্ভব। অতএব একজন স্বামী-পরিত্যক্তা গর্ভবতী নারীর দায়িত্ব নিলেন বিশ্বেশ্বর। প্রমথ তার কাজে সঙ্গী। তাকে প্রচুর টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ রাখা হল। কল্যাণ হেড অফিসে জানিয়ে দিলেন, ইরাবতী খুবই অসুস্থ। সে সবেতন ছুটিতে আর অসুস্থ ইরাবতীর সব দায়িত্ব নিচ্ছে কোম্পানি। ইরাবতীর ভাই অনমিত্রকে আর এই ব্যাপারে কিচ্ছু জানানো হল না।
“বহরমপুরে থাকাকালীন বিশ্বেশ্বরের সাহায্যে একটি প্রিম্যাচিওর বেবি হয় ইরাবতীর। কী অবিশ্বাস্য এক লুকোচুরি খেলা। সাত মাসে জন্মানো প্রাইভেট নার্সিং হোমের ইনকিউবেটরে থাকা সেই বাচ্চাটিকে মৃত বলে জানিয়ে দেওয়া হল ইরাবতীকে। শরীরে-মনে ইরাবতী তখন বিধ্বস্ত। কল্যাণকে তিনি ভালোবাসেন কিন্তু তাঁর এসকেপিস্ট স্বভাবকে তিনি মেনে নিতে পারলেন না। তিনি এবার ট্রান্সফার চাইলেন অন্য কোথাও। বহরমপুর তাঁর বহু কিছু কেড়ে নিয়েছে।
“কল্যাণ কিন্তু অমানুষ নন। তিনি দায়িত্ব এড়াননি। প্রতি মুহূর্তে মানসিকভাবে পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন। এবার ড্যামেজ কন্ট্রোল। তিনি ইরাবতীর বিয়ের ব্যবস্থা করলেন নিজের ভাইপোর সঙ্গে। বাড়ি তোলপাড়। কিংশুককে কোম্পানির শেয়ার থেকে বঞ্চিত করার ভয় দেখিয়ে এই বিয়েতে রাজি করেন কল্যাণ। ইরাবতী তখন অভিমানে ফুঁসছেন, কিন্তু মনের মধ্যে চোরাস্রোতে বইছে একটা নিশ্চিন্ত জীবনের লোভ। তাঁকে যে বসে বসে লিখতে হবে, ওটাই তাঁর অক্সিজেন। আর তো নতুন কিছু পাওয়ার নেই। যা হারাবার সবই হারিয়ে বসে আছেন। প্রচণ্ড যন্ত্রণা বুকে নিয়ে একটি যুবতী বিয়ে করে তারই প্রেমাস্পদ মানুষটির ভাইপোকে। আর বিয়ের কয়েকমাস পরেই সুইসাইড করেন কল্যাণ। বোধহয় একই ছাদের তলায় বাস করে ইরাবতীকে প্রতিদিনের গ্লানি থেকে মুক্তি দিয়ে যান। নিজেও অপরাধের বোঝা আর বইতে পারছিলেন না।
আর সেই সাত মাসে জন্মানো মেয়েটির ঠাঁই হয় অনাথ আশ্রমে।
তার কথা জানতেন শুধু বিশ্বেশ্বর। আর জানতেন প্রমথ। বিয়ের বছর কয়েক পরে ইরাবতীকে এই সত্য জানিয়েছিলেন ডাক্তার রায়চৌধুরী। তাঁরও অপরাধবোধ কিছু কম ছিল না। কিংশুক-ইরাবতীর দাম্পত্যে কোনও বাঁধন ছিল না। কিংশুক অনিচ্ছায় বিয়ে করেন, নিজের কাজের জগতে আরও উন্নতির উচ্চাশায় ডুবে যান। আর ইরাবতীর খেলার পুতুল হয়ে ঘরে আসে ইরাবতী আর কল্যাণের সন্তান।”
কিরণমালার গাল বেয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ছে চোখের জল। কোনও হুঁশ নেই তার। অস্ফুটে বলতে শুরু করে, “বাবা কিছু একটা আঁচ করেছিলেন। হয়ত কেউ বলে দিয়েছিল বাবাকে। বাবার সঙ্গে মায়ের কিছু উত্তেজিত কথা কাটাকাটি আমি শুনে ফেলেছিলাম। বুঝতে পারিনি। মা তখন থেকেই বলতেন, আমার হঠাৎ কিছু হলে খোঁজ নিস ভালো করে। এমনকি, বিতান... আসলে জেঠুর ইচ্ছে ছিল আমার আর বিতানের বিয়ে হোক। কিন্তু বাবা প্রায় জোর করেই... মা বাধা দেননি একবারও। মায়ের কী জানি, কী মনে হয়েছিল!”
কিরণমালার দিকে একটা টিস্যু পেপার এগিয়ে দেয় রাণা।
“আপনার মা বিচক্ষণ ছিলেন। একই সঙ্গে অভিমানী। আপনার পিতৃপরিচয় প্রকাশিত না হলে বিয়ে বিতানের সঙ্গেই হত। সমস্যা হল হঠাৎ প্রমথর সঙ্গে অনমিত্রর যোগাযোগ হওয়ার পর। প্রমথ ইরাবতীকে ব্ল্যাকমেল করতে আসে। তার কাঁচা টাকার প্রয়োজন। বিশ্বেশ্বর ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত। অতএব, সে বলে, ইরাবতী আর কিংশুক রায়ের সোশ্যাল স্ট্যাটাস একমুহূর্তে ধুলোয় মিশে যাবে। কল্যাণ আর ইরাবতীর অবৈধ সন্তান নিয়ে সে সব সত্য ফাঁস করে দেবে। আমার ধারণা কিংশুক রায়কেও এরা চাপ দিয়ে কিছু আদায় করতে চেয়েছিল। কিংশুক রায় ভয় পাননি। কিন্তু তাঁর সঙ্গে ইরাবতীর সম্পর্ক আরও খারাপ জায়গায় চলে যায়। রোজকার ঝগড়াঝাঁটির সাক্ষী মালতী।
ইরাবতী যেদিন মারা যান, মালতীর কথা অনুযায়ী তার আগের দিন সন্ধ্যায় প্রমথ এসেছিল ওই বাড়িতে। ইরাবতী ডেস্ক থেকে গয়না বের করে দেন ওকে। অনমিত্র দেখে ফেলে ওই ডেস্কে গয়না রয়েছে।
“এই প্রমথবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছে তোমার?”
“হয়েছে। তবে কথা আদায় করতে একদম কষ্ট হয়নি। সে গুপ্ত তথ্য ফাঁস করতেই চায়। টাকার দরকার।”
“ইরাবতীর মৃত্যু তাহলে হার্ট অ্যাটাক?”
দীপুর প্রশ্নে রাণা বলে, “নিঃসন্দেহে হার্ট অ্যাটাকেই। ওষুধপত্র নিয়মিত খেতেন না। অনমিত্র এবং প্রমথকে তাঁকে সামলাতে হচ্ছিল। কিংশুকবাবুর চেঁচামেচি...”
কিরণমালা অস্ফুটে বলে, “আমার বিয়ের পরেই এত কিছু ঘটল।”
“আপনার বিয়ের পরেই ইরাবতীর এই আত্মজীবনী লেখার কথা মাথায় আসে। তবে সে লেখা তিনি এখনও কোনও প্রকাশককে দেননি। তাঁর কম্পিউটারে রয়েছে কোথাও। একটু খুঁজলে গুগল ড্রাইভে পাওয়া যেতে পারে। বা কোনও মেলে অ্যাটাচ করে রেখেছেন নিশ্চয়ই।
“ইরাবতীকে কেউ খুন করেনি ঠিকই। কিন্তু হার্টের পেশেন্টকে মানসিক চাপে রাখলে তার পরিণতি যা হয়, তাই হয়েছে। মালতী জানত, পরপর আট-দশদিন ধরে অনমিত্র আর কিংশুকের সঙ্গে অস্বাভাবিক ঝগড়া চলছিল ইরাবতীর। ইরাবতীকে ক্রমাগত ব্ল্যাকমেল করছিল অনমিত্র আর প্রমথ। বারাসতের বাড়িটিও তাকে লিখে দিতে বলে। মালতী অনেক কিছু শুনে ফেলে। ফলে ইরাবতীর মৃত্যুর পরে মালতী অনমিত্রর ভয়েই বাড়ি ছেড়ে পালায়। বেশিদূরে যায়নি। কলকাতাতেই ছিল। আজ এখানে তার আসার কথা। তার মুখে শুনে নেবেন বাকিটা।”
রাণা একটা সিগারেট ধরায়।
কিরণমালা চোখ মুছে উঠে দাঁড়ায়।
“অনেক কিছু জানলাম। যা আমার মা নিজে মুখে হয়ত আমাকে কোনওদিনই বলতে পারতেন না... তোমাকে কী বলব জানি না...”
কিরণমালাকে থামিয়ে দেয় রাণা। “আমাকে কিচ্ছু বলতে হবে না। আপনার প্রথমদিনের কথাটি মনে আছে আমার। সিস্টেম। দুজনের মৃত্যুর কারণই সেই সিস্টেম। আমাদের সমাজের সিস্টেম। কল্যাণ রায় আর ইরাবতী নিজেদের সম্পর্ককে পরিণতি দিতে পারেননি। সিস্টেম ছাড়া আর কাকেই বা দায়ী করা যায়?
“একটু খেয়াল রাখবেন, সাহিত্যিক ইরাবতী সান্যালের স্মৃতিসভায় কেউ যেন তাঁকে অসম্মান না করে। একজন মানুষ শুধু মন-প্রাণ দিয়ে লিখতে চেয়েছিলেন। সেই লেখাটুকুই তাঁর অবলম্বন। তাঁর একের পর এক স্যাক্রিফাইস কিন্তু ওই পরিচয়টুকুর জন্য। ওই সাহিত্যিক স্বীকৃতি তাঁর নিজস্ব অর্জন। সেটি যেন কেউ কেড়ে নিতে না পারে। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি অর্থহীন।”
কিরণমালা চোখ তুলে তাকায়। তার দুচোখ উপচে গাল বেয়ে নেমেছে জলের ধারা।
পুরোটা একসঙ্গে পড়লাম। ঝরঝরে মেদহীন লেখা। বেশ ভালো লাগল।
উত্তরমুছুন