পর্ব -১২
সৌমী আচার্য্য
আদিত্য ভাবিয়াছিল যেকথা কহিয়া সে চন্দ্রনাথের বাড়ি হইতে ফিরিয়া আসিয়াছে সম্ভবতঃ ইহারপর চন্দ্রনাথ আর কখনো সোহাগকে লইয়া তাহার অসূয়া ব্যঙ্গ বিদ্রুপে প্রকাশ করিবে না। যদিও তাহার বুকের ভিতর একটি সূক্ষ্ম ব্যথা জাগ্রত হইয়া আছে। চন্দ্রনাথকে সে হয়ত ভালোবাসে তাই কঠিন বাক্য বলিবার অভিপ্রায় হয়না। তবু চন্দ্রনাথ গৃহে আসিয়াই যখন চড়বড় করিয়া উঠিল, তাহার যথার্থই মনঃকষ্ট হইয়াছে। বাহিরের আকাশও তাই বুঝি গভীর কালো হইয়া উঠিয়াছে।
-তোমার পৌরুষত্ব সম্পর্কে আমি ভাবিত হইয়া পড়ি। যাহার বিবাহ তাহার হুঁশ নাই আর পাড়া পড়শির ঘুম নাই। যাহার স্ত্রী সে থম মারিয়া বসিয়া আছে আর তুমি কিনা পূর্ব নির্ধারিত কাজকম্ম ছাড়িয়া তাহার স্ত্রীকে লইয়া ডাক্তার বদ্দ্যি করিতেছ। অথচ তুমি জানিতে তোমায় ছাড়া আমি অসহায় হইয়া পড়িব বারাণসীতে।
-আমি আশ্চর্য হইতেছি চন্দ্রনাথ তোমার অনুভূতি নামক বস্তুটি সম্ভবত লোপ পাইয়াছে। কর্কট রোগ শুনিয়াও এত কঠিন বাক্য তুমি বলিতে পারিলে।
-দেখ আদিত্য আমি তোমাকে চিনি এহেন ঘটনায় বিচলিত হইবার পাত্র তুমি নও। বাহিরের ডাক উপেক্ষা করিয়াছ আসলে অন্য কাহারো প্ররোচনায়।
-তুমি কি সোহাগকে দোষারোপ করিতেছ? এই ভ্রমে থাকিও না যে সে আমারে কিছু কহিয়াছে। বস্তুত তাহার সহিত আমার বাক্যালাপ প্রায় বন্ধ। বিগত একমাসে সে আমার ঘরে নিজে হইতে আসে নাই পর্যন্ত।
-বাব্বা ইহা আবার সদর্পে ঘোষণা করিতেছ। ভালো।
-চন্দ্রনাথ আজ তোমারে একটি কথা স্পষ্ট জানাইতে সাধ হয়। তুমি আমার বন্ধু তবে আমার স্ত্রীকে উপহাস করা তোমার এক্তিয়ার নহে। এমনকি ঠাট্টা করিয়াও তুমি তাহাকে অসম্মান করিতে পারো না। তোমার স্ত্রীকে আমি বৌঠান বলিয়া সম্বোধন করি, তাহাকে উপযুক্ত সম্মান করিয়া থাকি। সুতরাং তুমিও এই শালিনতাটুকু বজায় রাখিবে এই আমার আশা।
-আমার স্ত্রী আমার বিষয়ে খবরদালালিটি কম করেন কিনা।
-চন্দ্রনাথ, সোহাগ আর দশটি স্ত্রীলোকের হইতে আলাদা বলিয়াই তাহাকে ছোট দেখাইতে চাহে কেহ কেহ। তাহাকে ঈর্ষা অথবা তাহার মতো স্ত্রী রত্ন না পাইবার জ্বালা হইতেই সম্ভবতঃ এই আচরণ, আমি তাহা বুঝি। সে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করিতে চাহেনা। কেবল তাহার হৃদয় জুড়ে আমার অবস্হানটিকে সগর্বে ঘোষণা করিতে চাহে মাত্র।
চন্দ্রনাথ ফোঁস করিয়া 'আচ্ছা' বলিয়া হাঁটা লাগাইল। আদিত্য ভারী বিব্রত হইয়া বসিয়া ভাবিতে লাগিল সত্যিই কি এত কিছু বলিবার প্রয়োজন ছিল।
-তুমি বলিতে পারিতে বারাণসীতে যাইবার কথা, আমি ঠিক সামালাইতে পারিতাম।
চমকে ওঠে আদিত্য। সোহাগ একটি রেকাবিতে সাদা নাড়ু, কুচো নিমকি আর খাস্তা কচুরী লইয়া দাঁড়াইয়া আছে। মেঘরঙা শাড়ির সহিত ফিরোজা পাড় মায়া জন্মাইয়াছে চেহারায়। চোখের নীচে কালচে ছোপ গভীর হইয়া জাগিয়া আছে। আদিত্যকে রেকাবিটি আগাইয়া দিয়া কহিল, 'কহো নাই কেন?'
-বসো সোহাগ। বৌঠান কি ঘুমাইতেছেন?
-না জোর করিয়া ভাসুরঠাকুরকে উহার সম্মুখে বসাইয়া আসিয়াছি। কথা কহিতেছে।
-বাহ্, উত্তম।
-আপনি কহিলেন না।
অতি আবেগে সোহাগ আদিত্যকে আপনি সম্বোধন করিয়া থাকে। আদিত্য আপনি ডাকটি শুনিয়া মনে মনে আবেগতাড়িত হইয়া উঠিল। এ যেন পূর্বরাগের প্রকাশ।
-সোহাগ মানুষ কখনোই নিজের অন্তরকে সঠিক ভাবে প্রকাশ করিতে সমর্থ হয়না। আজ তুমি নিজে হইতে কেন আসিয়াছ আমার ঘরে ইহা তুমিও জানো আমিও। আমি বারাণসীতে যদি যাইতাম তুমি আরো দূরে যাইতে।
সোহাগের চক্ষু হইতে টপটপ করিয়া জল ঝরিয়া পড়িল, 'আজ আপনি চন্দ্রনাথবাবুকে যাহা কিছু বলিয়াছেন আমি শুনিয়াছি। তবু মনে হয় আমি নিজেকে সঠিক ভাবে ব্যক্ত করিতে পারি নাই। আর আপনিও সবটা বোঝেন নাই।'
-আমিও পারি নাই সোহাগ।
-আপনি আমাকেও কখনো দূরদেশে সাথে করিয়া লইয়া যাইবেন। আপনি কখনো কখনো কেবল আমার জন্য সব ছাড়িয়া সবাইকে ছাড়িয়া আসিবেন। ঐ ছাদের আলসেতে আমরা দূর আকাশের ছায়াছবি দেখিব এইসব আশা করিয়াছি।
-সোহাগ!
আদিত্য সোহাগকে জড়াইয়া ধরিতেই সে বুকের উপর আছড়াইয়া পড়িল। আদরে আদরে পরস্পরকে অস্হির করিয়া তুলিতেই, বাহিরে শ্রাবণের ধারা ঝরিয়া পড়িল।
-----–------------------------ ------------------------------
এই প্রথমবার লেখা শেষ হতেই ঊশ্রীকে পড়ে শোনাল দেবপ্রিয়া। মেয়ে চেয়ে আছে বাইরে। দেওয়াল ঘড়িটা টিকটিক করেই চলেছে। নীচে ড্রাইভারের ঘর থেকে হিন্দীগানের সুর ভেসে আসছে।
-মা! জীবনের গল্পগুলো এত সহজে মেলেনা কেন?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন