মুনিয়া
অনিন্দ্য সান্যাল
অনিন্দ্য সান্যাল
আজ একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙল আমার। দেখলাম, আমি স্বর্গে চলে যাচ্ছি ............একটা অটোয় চেপে। অটোওলাটা কী যে খ্যাঁচখ্যাঁচ করছিল সারা রাস্তা ............ আমার কাছ থেকে কুড়ি টাকা বেশি নিল, তবু আমাকে মাঝ রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে বলল, আর যেতে পারব না, বাকিটা আপনি হেঁটে চলে যান।
রাস্তার দুপাশে সার সার ঝাউগাছ ছিল, একটা নোনা বাতাসে ভরে ছিল আবহাওয়া, তখনই অকস্মাৎ গুঁতো খেয়ে জেগে উঠে দেখি নিবেদিতা চা নিয়ে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে।
চায়ের কাপটা জানালার কিনারে রেখে বলে গেল নিবেদিতা, চা-টা খেয়ে বাজারে যেও, আবার ঘুমিয়ে প’ড়ো না যেন।
অথচ আবার সেই ঘুমিয়েই পড়লাম আমি। আরও একটা ইতস্তত স্বপ্নের পাড় ছুঁয়ে ছুঁয়ে হেঁটে যেতে থাকল আমার ঘুম।
[ চা বসন ভূত হবে না যান্ত্রিক আপদ গোলমাল তখন বাঁচবে যাবে না ত্যাঁদোড় যন্ত্রণা নাছোড় সাংঘাতিক মৃত্যু নয় ভূত নয় ভয় নয় সচরাচর কী বস্তু মাটি তাহার নয় যাবতীয় ওরা বাঁচবেই তবু বাঁচবেই মরবেই না কখনও না পেন অন্ধ হবে না কালি ঝরবে না তবু লিখবেই জন্ম লিখবে নিরবধি বিচিত্র কথা কী জাগতিক পাতা সরছে খস্ খস্ আওয়াজ উঠছে ভৌ ভৌ কী স্তব্ধতা ওরে বাবা তালগাছের ছায়া মৃন্ময়ী টেপরেকর্ডার কোনও বমি নয়, বইখাতা রাখা আছে পেন্সিল, কী আশ্চর্য ......] - চা-টা খেয়েছো !!!
চা খাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ানো দরকার। নইলে আবার ঘুমিয়ে পড়তে পারি। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে পা-টা যেন টলমল করে উঠল হঠাৎ। আমিতো মদ খাইনি কাল রাতে ! জানলার সামনে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়াতেই পাশের বাড়ির ছাদে কাপড় মেলতে আসা ঘোষালবাড়ির বউ আমাকে দেখে সরে গেল। কেন যে ভদ্রমহিলা আমাকে দেখলেই সরে যায়! নিবেদিতাকে একথা বলেছিলাম একবার। ও ভ্রূ কুঁচকে আমাকেই প্রশ্ন করেছিল, বাজেভাবে তাকাও নাকি -
আজও ঘোষালবাড়ির বউ হুট করে সরে যেতেই মনে মনে একটা গালাগালি বেরিয়ে এল মস্তিষ্ক থেকে জিভের টাগরা পর্যন্ত। এসে থমকে গেল। চায়ে চুমুক দিয়ে খানকি মাগী শব্দটাকে গিলে ফেললাম। তারপর পেটে বেগআসতেই বাথরুমে দৌড়। একটা টিকটিকি কমোডের পাশে ছুঁচুকলের পাইপ থেকে লাফিয়ে দেয়ালের উপর পড়েই ছুটে গিয়ে ছাদের দিকে চলে গেল। ঘরে টিকটিকি হলে নিবেদিতা দশ বছর আগে পুরী থেকে কেনা জগন্নাথের লাঠি দিয়ে তাড়া করে, বাথরুমে টিকটিকি থাকলে খুশি হয়, পোকা টোকা খাওয়ার জন্য বাথরুমে নাকি টিকটিকি পোষা সমীচীন।
কমোডে দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে মনে হল আর এক কাপ চা হলে বোধহয় ভালো হত। তাছাড়া চা-টা অনেকটা ঠান্ডাও হয়ে গিয়েছিল। তবে ইদানীং বার বার চা চাওয়াটা বেশ কঠিন। নিবেদিতা বলে দিয়েছে, গ্যাস সিলিন্ডারের দাম কত হয়েছে জানোই তো, চা খাওয়াটা একটু কমাও।
আচ্ছা ওরকম স্বর্গে চলে যাওয়ার স্বপ্ন কেন দেখলাম হঠাৎ, ওরকম অটোতে চেপে ঝাউবনের রাস্তায় !
হাসি পেল ভেবে। স্বর্গ, নরক কিছুই কি আমি মানি ? তবে ওরকম স্বর্গের স্বপ্ন !! স্বর্গ, নাকি মৃত্যুর স্বপ্ন দেখছিলাম আমি আসলে ?
যারা স্বর্গ নরক মানে না তাদের জন্য সরকারি কাজে কম্মে কোনও সংরক্ষণ আছে কি ?নাস্তিক কোটা ?
বাজারের মোড়ে দু দশজন লোক জুটিয়ে একজন গলা ফাটাচ্ছে এফ ডি আইয়ের বিরুদ্ধে। রিক্সাওয়ালা শ্যামল ঘন ঘন হাততালি দিচ্ছে। অন্ধ্রের মৃত রুইয়ের চকচকে আঁশে পিছলে পিছলে যাচ্ছে বক্তৃতার প্রতিটি শব্দ।
দিবাকর ওর নিজস্ব ইউনিফর্মে (জাঙ্গিয়ার মাপের হাফপ্যান্ট আর ফুলহাতা টি শার্ট) দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। দেখে এগিয়ে এল কাছে, দাদা একবার যাবো আপনার বাড়ি।
দিবাকর মেডিক্লেমের এজেন্ট, কয়েক সপ্তাহ ধরেই জোঁকের মতন পিছনে পড়ে আছে, এড়িয়ে গিয়ে বাজারের ভিড়ে হারিয়ে যেতে চাইলেও মাছের আঁশটে গন্ধ হয়ে গায়ের কাছে ঘেঁষে থাকবে। ওকে এড়িয়ে এক ফাঁকে সটকে পড়তে গিয়ে একটা কুকুরের গায়ে পা দিয়ে ফেললাম। ভাগ্য ভালো খ্যাঁক্ করে উঠলেও কামড়ায়নি। নয় তো মেডিক্লেম থেকে বাঁচতে গিয়ে এখনি ইঞ্জেকশান নিতে ছুটতে হত।
অনেক দেশে সারমেয় মাংসের কদর আছে। ইন্টারনেট ঘাঁটলেই দেখা যাবে দোকানে খাসির মাংসের মতো কুকুরের মাংস ঝোলানো আছে। এখনি যদি বলি আমাদের পাড়ার রাস্তার কুকুরগুলোকে সেই সব দেশে চালান করে দেওয়া হোক পশুপ্রেমিকেরা হই হই করে উঠবেন হয়তো। তারপর বাজারে গিয়ে খাসির মাংসের সিনা থেকে বেছে বেছে মাংস কাটিয়ে আনবেন। অনেকে অবশ্য যুক্তি দেয় যে এই সব রাস্তার কুকুরেরা স্ক্যাভেঞ্জারের কাজ করে। মাছের কাঁটা, মাংসের ছাঁট খেয়ে লোকালয় পরিস্কার রাখে। ভালো, কর্পোরেশনের অনেক কাজই তবে করে দেয় ওরা। ওদেরও পি এফ, গ্র্যাচুইটি থাকার ব্যবস্থা হোক। নিবেদিতাও একই কারণে বাথরুমে টিকটিকি জিইয়ে রাখে।
আপাতত দিবাকরকে এড়িয়ে যেতে পেরেছি। বাজার করছি নির্বিঘ্নে।
ফেরার সময় ইচ্ছে করেই ঘোষালদের বাড়ির সামনে একটু দাঁড়ালাম। শুধু শুধু তো আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। দু পায়ের ফাঁকে বাজারের ব্যাগটা চেপে ধরে সিগারেট ধরালাম একটা। ধরিয়ে, ধোঁয়া ছেড়ে ঘোষালদের বাড়ির ছাদের দিকে তাকাতেই দেখি সেই বউটি একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে, আমাকে দেখেও সরে গেল না এখন। আমরা কিছুক্ষণ চোখ চাওয়া-চাওয়ি করলেও কেউ এক ফোঁটাও হাসলাম না। আমি দু বার মাথা নেড়ে সিগারেটে ঘন ঘন টান দিতে দিতে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেলাম।
সেই রাতে আবারও একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম আমি। এবার রাস্তার পাশে কোনও ঝাউবন ছিল না। অটোও পাওয়া যায়নি আজ। আমি একটা লাঠি ঠুকে ঠুকে কংক্রিটের বাঁধানো রাস্তায় শব্দ করতে করতে চলেছি। বোধ জানান দিচ্ছে আমি একটা গোপন রঁদিভুতে যোগ দিতে চলেছি। সেখানে আমার মতন ছা-পোষা থলি হাতে মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবু কোন্ এক আশ্চর্য ক্ষমতার বলে অথবা কারোর সুপারিশে আমি সেখানে যাওয়ার একটা টিকিট পেয়ে গেছি যেন।
দু পাশে সুউচ্চ অট্টালিকা, অথচ বোধ জানান দিচ্ছে সেসব বাড়িতে এখন আর কেউ থাকে না, মাঝে মাঝে ঠান্ডা ভ্যাপসা বাতাসে মড়া পচার গন্ধ আসছে নাকে। গন্ধ আসছে বলে মনে হচ্ছে না আমি আমার স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ-ই রাস্তার পাশে একটা কাটা গলি থেকে বেরিয়ে এল একটি লোক, দেখতে অনেকটা পাইরেটস অফ দ্য ক্যারিবিয়ানের নায়কের মতন, চোখে বিষাক্ত সাপের ঠান্ডা দৃষ্টি, পরনে সমুদ্রের আঁশ লেগে থাকা তাপ্পি মারা ওভারকোট। আমাকে দেখে সে একটু ম্লান হাসল, তারপর মুখের ভাব তার যতটা কঠোর হওয়া সম্ভব ততটাই কঠোর হয়ে উঠল। কোনও কথা না বলে সে আমার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে থাকল।
খানিক যেতেই যেন মনে হল এবার আমার ফিরে যাওয়া উচিত, এ রাস্তা কিছুতেই আমার হতে পারে না, কোনও ভদ্রলোক কোনওদিন এ রাস্তায় হাঁটেনি। লোকটা বোধহয় আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে কাছাকাছি ঘেঁষে এল, আমার একটা হাত ধরতেই বুঝতে পারলাম তার হাত কী প্রচন্ড ঠান্ডা, ওর হাতের দিকে একবারও না তাকিয়েও মনে হল ওর হাতে এক ফোঁটা মাংস আর চামড়া নেই। সে অন্য হাত তুলে একটা বাড়ির ছাদের দিকে নির্দেশ করল। সে হাতটা গ্লাভ্সে ঢাকা। আমি মুখ তুলে ওর দেখানো বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ছাদের আলসেয় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ঘোষালবাড়ির বউ আর আমার মৃত বোন মুনিয়া। মুনিয়াকে ঘোষালবাড়ির বউয়ের সাথে দেখে আমি দারুণ অবাক হয়ে গেলাম। মুনিয়া এখনও বেঁচে আছে ! একটা অদ্ভুত আনন্দের শিহরণে যেন কেঁপে উঠলাম আমি। তক্ষুনি ছুটে যেতে চাইলাম বাড়িটার ছাদে। কিন্তু ঠান্ডা হাড়হিম হাতে পাইরেট আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরে থাকল। আমি মুনিয়ার দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলতে চাইলাম, মুনিয়া আমি এসেছি মুনিয়া, তোকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছি।
মুনিয়া একবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। ওর মুখে কোনও আনন্দ বা উত্তেজনা নেই। আমি পাইরেটের হাত ছাড়াতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু মুনিয়া অনুচ্চ কন্ঠে আমাকে বলল, ফিরে যা দাদা। এখানে আসিস না। এখানে এলে তুই আর ভালো ছেলে থাকবি না। আমি তো ভালো ছেলে নই মুনিয়া।
ঘোষালবাড়ির বউ ওর পিঠে হাত রেখে কী যেন ওর কানে কানে বলতেই দুজনে সরে গেল ছাদের ধার থেকে। তারপর ওদের আর দেখতে পেলাম না আমি।
দারুণ শীতবোধ নিয়ে জেগে উঠে আমি দেখলাম নিবেদিতা অবিন্যস্ত পোশাকে নীল আলোর নীচে শুয়ে রয়েছে। এখন সিজন চেঞ্জের সময়। আমি একটা হালকা চাদরে ওকে বুক পর্যন্ত ঢেকে দিয়ে বাথরুমে এলাম। কোমোডের পাশে ছুঁচুকলের ধার থেকে টিকটিকিটা তড়বড়িয়ে ছাদের দিকে ধাঁ।
মৃত্যুর সময় মুনিয়ার মুখ নীল ছিল। আমি ভেবেছিলাম ওকে বোধহয় সাপে কামড়েছে। পুলিশ এসেছিল। ময়নাতদন্ত হয়েছিল মুনিয়ার মৃত শরীরের। সেই প্রথম আমি মর্গের গন্ধ পেয়েছিলাম নাকে। তা ছাড়া মুনিয়ার শরীরে সব সময় একটা সুগন্ধি তেলের গন্ধ ভেসে থাকত কুয়াশার মতন ওর চুল জড়িয়ে। মুনিয়ার বুকে আমি একবার হাত রেখেছিলাম। জ্ঞানত। আমার সতেরো বয়সে আমি তার ছোট ছোট বুক জেগে ওঠা টের পেয়েছিলাম আমার অনুভূতির চেটোয়। চোখ বন্ধ করে টের পাচ্ছি কমোডের জলে আছড়ে পড়া আমার হিসুর শব্দ। মুনিয়ার ঠোঁট কমলালেবুর কোয়ার মতো ফোলা ফোলা ছিল।
যখন তার কাটা ছেঁড়া শরীর আমি মর্গের বারান্দা থেকে সরিয়ে নেব বলে দাঁড়িয়েছিলাম তখনও ওর ঠোঁট কমলালাবুর কোয়ার মতন অভিমানী ফুলে ছিল।
সকালে খুব সঙ্গত কারণেই যেন ঘোষালবাড়ির বউ ছাদ থেকে আমাকে জানালায় দেখেই ত্রস্ত পায়ে সরে গেল আমার দৃষ্টির আড়ালে।
ছবি : গুগল
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন