পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ৯ এপ্রিল, ২০১৭

ভজন দত্ত


.
পৃথিবী জুড়ে টেরাকোটা শিল্পের বিকাশের পিছনে অর্থনৈতিক অগ্রগতি টেরাকোটা শিল্প ধরে যদি মানব সভ্যতার বিকাশের ধারা লক্ষ করা হয় তবে আশ্চর্য হতেই হয় সেই সময়ে পৃথিবীজুড়ে একটা শিল্পের বিকাশ ঘটছে ভারতে মগধকে কেন্দ্র করে যে শিল্পের বিকাশ ঘটেছে তা আস্তে আস্তে সারা ভারতেই ছড়িয়ে পড়েছে অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে সব শিল্পেরই নিবিড় যোগাযোগ টেরাকোটাও তার ব্যতিক্রম হয় নিঅর্থবান  শৌখিন মানুষ চিরকালই এর কদর করে আসছেন
বাঁকুড়ায় 'মাল'( মল্ল)রা বিষ্ণুপুর সংলগ্ন ঘাট রক্ষার মাধ্যমে একটি সামন্ত রাজ্যের সূচনা করেন আদিমল্লের নেতৃত্বে  ঘাট যারা দেখা শোনা করতেন তাদের বলা হোত ঘাটোয়াল সেই সময় বনের ভেতর পথগুলি সুরক্ষিত  নিরাপদ রাখা,অবাঞ্ছিত লোকজনব্যবসায়ী,পর্যটক,অনুপ্রবেশকারী দের প্রতি নজর রেখে রাজাকে খবর দেওয়াযুদ্ধের সময় রাজাকে সশস্ত্র সাহায্য করা ছিল ঘাটোয়ালদের কাজরাজারা এজন্য ঘাটোয়ালদের জমিবন দিতেন কর ছাড়া 'গিভ এন টেক পলিসি ' এই ব্যবস্থা ঘাটোয়ালি বলে পরিচিত বনের মধ্য দিয়ে যেতে হলে পথিক বা বণিক বা অন্য কাউকে প্রধান ঘাটোয়ালের কাছে ছাড়পত্র নিতে হত নজরানা দিয়ে না নিলেই লুঠ হবার আশঙ্কা ছিল এক ঘাটোয়ালের এলাকা থেকে আরেক ঘাটোয়ালের এলাকায় ঢুকতে আবার নজরানা দিলেই নির্বিঘ্নে যাতায়াত করা যেতমাল রাজা দের প্রতিষ্ঠিত মল্লরাজ্যের অর্থনৈতিক ভিত্তিটি ছিল এই ব্যবস্থাপ্রাচীন কাল থেকে 
অরণ্য অধ্যুষিত এই সব অঞ্চলে রাজাদের খাজনা আদায়ের ব্যাপারে ততখানি মাথাব্যথা ছিল না তাই এসব এলাকা নিয়ে সাধারণভাবে তাদের লক্ষ্য থাকতো কম এই সুযোগেই এই এলাকায় ঘাটোয়ালরাই ছিলেন ' রাজা ' মোগল আমলেষোড়শ শতক থেকে যে মল্লরাজ্যের যাত্রা শুরুআদিমল্লের হাত ধরে
এই সময় থেকেই বাঁকুড়া জেলায় টেরাকোটা শিল্পের বীজ বপনের কাজ শুরু হয়েছিল বলা যায়কারণ পরবর্তীকালে মল্লরাজারা উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে এক দূর্গনগরী বিষ্ণুপুরকে টেরাকোটা মন্দির দিয়ে সাজিয়ে তোলেন তাঁদের রাজবাড়ীর ধ্বংসস্তুপে কোনো একটি প্রাচীর দাঁড়িয়ে না থাকলেও মন্দিরগুলি আজো অপার বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে আছে



.
বাঁকুড়া জেলায় টেরাকোটার সবচাইতে প্রাচীন নিদর্শন একটি যক্ষীমূর্তি,পাওয়া গেছে পখন্না গ্রামে
বিশেষজ্ঞদের মতে এটি খ্রিপূ তৃতীয় শতকের অর্থাৎ টেরাকোটা চর্চা বাঁকুড়া জেলায় প্রাচীনত্বের দাবি রাখে বিষ্ণুপুর থেকে কাছেই ডিহর গ্রামেও অনুরূপ মূর্তি পাওয়া গেছে বাঁকুড়া বিষ্ণুপুর রাস্তার উত্তরে বালিয়াড়া গ্রামের উপকন্ঠে সোনাতপলের মন্দিরবহুলাড়ার মন্দির বহুচর্চিত,প্রশংসিত কিন্তু পরবর্তীকালে সপ্তদশ শতকে মল্ল আমলে নির্মিত মন্দিরগুলি সব আলো টেনে নিয়ে বিখ্যাত হয়ে আছে যা সম্ভব হয়েছিল মল্ল রাজাদের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় যেগুলির নির্মানকাল ১৬২২-১৭৫৮ খ্রিঃ
বহুলাড়ার মন্দিরটি প্রায় হাজার বছরের পুরানোএখনো দৃশ্যমান সিদ্ধেশ্বর মহাদেবের এই মন্দিরটি পোড়া ইটের তৈরীজেডিবেগলার সাহেব বলেছেন " The finest brick temple in the district, and the finest though not the largest brick temple that I have seen in Bengal... "
মন্দিরটি মাটি পুড়িয়ে ইট তৈরী করে সুদৃশ্য ভাবে নির্মিত হয়েছে তার প্রশংসা করেছেন সকলেই মন্দিরটির জৈন ধর্মের বেশ কিছু লক্ষণ থাকলেও ( inside a naked Jain standing figure)
দীর্ঘদিন ধরে এটি শিবমন্দির হিসাবেই খ্যাতি লাভ করেছে 
সম্প্রতি  বৈশাখ২৪ সোনাতপল ঘুরে এসে আমার এক বন্ধু জানালেন
সেখানের মন্দিরটিতেও শুরু হয়েছে শিবপূজা যেটি সূর্য মন্দির হিসেবে উল্লিখিত হয়েছে বিভিন্ন গবেষকের লেখায়জেলায় শিল্পসুষমামন্ডিত টেরাকোটা মন্দির নির্মানের আগে এই দুটি বিখ্যাত মন্দির কি টেরাকোটা শিল্পীদের ভাবতে সাহায্য করেনিপরবর্তী নির্মানকৌশল নির্ধারণে তো সাহায্য করেছিল একথাও নিশ্চিতভাবে বলা যায় মাটি পোড়ানের কৌশল ভালোভাবেই রপ্ত হয়েছিল বিষ্ণুপুরের মন্দিরগুলি নির্মানের আগেই
১৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে রাজা রঘুনাথ মল্লদেবের সময় তৈরী হয় পাঁচচূড়া মন্দিরযেটি শ্যামরায়ের মন্দির নামেও পরিচিতএর বারো বছর পর তৈরী হয় এখনকার জগদ্বিখ্যাত কৃষ্ণরায় জোড়বাংলা মন্দিরটি
এই পাঁচচূড়া শ্যামরায়ের মন্দিরের দেওয়ালের অলংকরণ কালের কালো কালিতে ঢেকে আছেবিশেষজ্ঞদের মতেশ্যামরায়ের মন্দিরটি, " লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মূর্তি  কারুকলার সমাবেশ যেন লক্ষ কোটি তরঙ্গভঙ্গিম কারুকার্যময় সমুদ্র অপরদিকে কৃষ্ণ রায় জোড়বাংলায় আছে সাধারণ নরনারীদের তালবাদ্য বাজানো  সঙ্গীতচর্চার দৃশ্য  বাস্তব যুদ্ধদৃশ্যের কাজ
বিষ্ণুপুরে এখনো সেল্ফি তোলার পজিসনে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচটি আগের দুটি ছাড়াও রাধাবিনোদমদনমোহন  শ্রীধর মন্দিরএর মধ্যে বসুপাড়ার শ্রীধর মন্দিরটি ( অষ্টাদশ শতকে নির্মিত)বাদ দিলে বাকিগুলি সপ্তদশ শতকেই নির্মিত
.
বিষ্ণুপুরের মন্দির টেরাকোটা নিয়েঅসাধ্য সাধন করে একটি গ্রন্থ লিখেছেন শ্রদ্ধেয় চিত্তরঞ্জন দাশগুপ্ত মহাশয় "বিষ্ণুপুরের মন্দির টেরাকোটা " নামেবন্ধু,ভাই প্রদীপ কর অত্যন্ত যত্ন সহকারে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেছেন ১৪২২এর কার্তিক মাসে মানে ডিসেম্বর২০১৫ তে এটিতে লেখক বিপুল সংখ্যক ফলকের পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করেছেনসেখানে বিভিন্ন নকশি  মূর্তি মোটিফ  দৃশ্যের বর্ণণা যেমন করা হয়েছে তেমনি সেগুলির উৎস  তাৎপর্য সম্পর্কে গভীর আলোচনা করেছেনউৎসাহী  আগ্রহী পাঠকপাঠিকাগণ উক্ত গ্রন্থটি সংগ্রহ করে বিশদ জানতে পারেন
টেরাকোটা শিল্পটি একটি গোষ্ঠী শিল্প দিনের পর দিন পেটে ভাতে বা জমির বন্দোবস্তে সৃষ্টির নেশায় ফুটিয়ে অপরূপ সব শিল্পকর্ম সেই সৃষ্টিতে পৃষ্ঠপোষকদের প্রভাব থাকবে না তা হতে পারে না সে কারণেই বৈষ্ণবধর্ম অনুরাগী রাজাদের ইচ্ছামত মন্দিরগুলির অলঙ্করণে কৃষ্ণলীলার চিত্রগুলি প্রাধান্য লাভ করেছে লোকায়ত সংস্কৃতির ভাবনাও আছে তাতে পারসিক,মোগল,রাজপুতবৃন্দাবন,গুজরাটি,ওড়িষ্যার প্রভাব আছে চিত্রগুলিতেযে 'বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য' কথা বলা হয় ভারত সম্পর্কে তা এখানেও দেখা যায় 
উক্ত গ্রন্থটির ৫২ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ থেকে-- " একদিকে শ্রীমদ্ভাগবতের চিত্রগুলির ধর্মীয় স্পর্শ অন্যদিকে গীতগোবিন্দ রসিকপ্রিয়া  রাগমালার লিরিক চিত্রগুলির গীতিময়তা ষোড়শসপ্তদশ শতকের রাজপুত চিত্রে কৃষ্ণলীলার যে বর্ণাঢ্য জগৎ সৃষ্টি করল তারই প্রভাব পড়ল রাজপুতানা তথা উত্তর ভারতে ললিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্ম;..... " এই প্রভাব অতিক্রম করা ছিল তখন প্রায় দুঃসাধ্য
বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা শিল্পেই শুধু নয় এর প্রভাব পড়েছিল পট,পাটা চিত্রে এমনকি সঙ্গীতেও
সারা বাংলাদেশে একটি মাত্র মন্দির নগরী বিষ্ণুপুর বাংলার একমাত্র সঙ্গীত ঘরাণাও বিষ্ণুপুরী ঘরাণা

(ক্রমশ )

------------------------
তথ্যসূত্র  সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী আগামী সংখ্যায় ]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন