পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ৯ মে, ২০১৭

জয়তী রায়


শুভারম্ভ


   
মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্যদেবের জন্মের পর কেটে গেছে পাঁচশো বছরেরও বেশি। কিন্তু আজো তিনি আমাদের প্রাণে স্ব মহিমায় বিরাজিত। শ্রী চৈতন্যের জন্ম হয়েছিল ১৮ ফেব্রুয়ারী ১৪৮৬ নবদ্বীপ ধামে। মৃত্যু হয়েছিল ১৫৩৩ সালে। তখন ওনার বয়স ৪৬ বছর পুরী ধামে দেহান্ত হয়েছিল মহাপ্রভুর। ঈশ্বারপুরী ছিলেন তাঁর মন্ত্র গুরু ,কেশব ভারতী সন্ন্যাস গুরু।  চৈতন্যদেব বলতে মনে পড়ে প্রেম। ভালোবাসা ছিল তাঁর ধর্মের মূল কথা। রাধা ভাবে মগ্ন ছিলেন তিনি। কঠিন নিয়মের জাল থেকে ধর্মকে মুক্ত করে ভালোবাসার সুতোয় বাঁধলেন ভক্ত আর ভগবান কে। কিন্তু সেই সময়ের নিয়মের নিগড়ে বাঁধা হিন্দু সমাজ থেকে সরে এসে সম্পূর্ণ নতুন ভাবধারা " গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্ব"  প্রচারিত করা সহজ ছিল না। চেষ্টা করছি সেই সময় এবং মহাপ্রভু শ্ৰী চৈতন্যকে কিছুটা হলেও তুলে ধরতে। কেন তাঁর নাম নিমাই হলো; বা কী করে  মুসলমান কাজী জব্দ হলো, কিছু হলেও ইত্যাদি তথ্য সকলে জানেন। ওই সবের মধ্যে  খুব বেশী না গিয়ে আমি ওনার ভাব টি ধরার চেষ্টা করছি। চৈতন্যদেবের প্রধান পরিচয়-- তিনি একটি বিশেষ ধর্মের প্রবক্তা, এবং সেই ধর্মের সাহসের পরিচয় যেখানে দিতে হয়েছিল সেখানে তিনি একলা( চৈতন্যদেব/ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী) তাঁর উদার ধর্মনীতি কোনো বেদ বেদান্তের প্রভাবে গড়ে ওঠেনি। তাঁর একান্ত নিজস্ব বিশ্বাসের স্বরূপ হলো গৌড়ীয় বৈষ্ণব তত্ত্ব। পরবর্তী কালে জীব গোস্বামী সম্পূর্ণ বৈদিক মর্যাদায় স্থাপন করেছেন ভাগবত পুরাণ কে। কেননা ভাগবত পুরাণে চৈতন্য প্রবর্তিত সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিষ্ঠিত। কৃষ্ণই প্রথম এবং শেষ কথা।  জ্ঞান বৈরাগ্য মুক্তি সব কিছুর মূল হলোকৃষ্ণভক্তি

                    ---------------------

                           
১নং
মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য

---------///-------------------------------

               
শচী দেবী সেই তখন থেকে  ডেকে চলেছেন ---" নিমাই নিমাই নিমাই নিমাই।" চৈত্রের দুপুরের হাওয়া পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরছে। তকতকে করে নিকোনো উঠোনের  কোণে  জামরুল গাছে  অবিশ্রান্ত ডাকছে কোকিল। ধানের গোলা, তুলসী মঞ্চ রাধামাধবের মন্দির সব খানে ধাক্কা খেয়ে ডাক ফিরে আসছে মা শচী দেবীর কাছেই----" নিমাই নিমাই " ক্রমশঃ মায়ের গলায় আতঙ্ক ধরা পড়ে। বড়ছেলে বিশ্বরূপ সন্ন্যাস নিয়ে ঘর ছেড়েছে। দুটি মোটে সন্তান তাঁর। ছোট নিমাই খুবই ছোট। তবু অজানা আশংকায় কাঠ হয়ে উঠোনের বাইরে পা রাখেন শচী দেবী। মনে মনে পন্ডিত স্বামী জগন্নাথ মিশ্রের ওপরে রাগ হয় একটু। সেই কখন বেরিয়ে গেছেন। সব কাজ করবেন, কেবল সংসারটি ছাড়া। উঠোনের বাইরে  দুপুরের রোদ ভেজা একলা  বিষণ্ন রাস্তা। কেউ  কোত্থাও নেই। একি এমন তো হয়না! কি মনে হতে বাড়ির পেছেনে চলে আসেন। সেখানে  আস্তাকুঁড়ে গতকালের বৈষ্ণব ভোজনের মাটির হাঁড়ি কুড়ি ফেলা রয়েছে। সেই খানে বসে আছে তাঁর নয়নের মনি গোপাল নিমাই। হারানিধি পেয়ে চোখে জল এলেও মুখে রাগ দেখিয়ে বলে উঠলেন--- "  এঁটো আস্তাকুঁড়ে বসে আছো? এখন অবেলায় নাইতে হবে!"  নিমাই দুষ্টু হেসে মায়ের জলভরা চোখের দিকে তাকিয়ে কচি গলায় উচ্চারণ করলেন সেই অমোঘ দর্শণ---" লেখাপড়া করতে দেবে না যখন বসে থাকি এখানেই!" সে কি! পন্ডিতের বংশ। পান্ডিত্য ভরা জায়গা নবদ্বীপ সেখানে নিমাই লেখা পড়া করতে পারবে না?

 
পাঁচশো বছর আগে যিনি একলা এক নতুন ধর্ম মত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রচার করেছিলেন যা সনাতন হিন্দু ধর্মকে নাড়িয়ে দিয়েছিলো -- সেই চৈতন্যদেব কে ছোটবেলায় মূর্খ বানিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন তাঁর পিতা শ্ৰী জগন্নাথ মিশ্র। কেন?

*

 
জগন্নাথ দেব খুব চিন্তিত নিমাই কে নিয়ে। ছেলে যে ক্রমশঃ হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে! বৈষ্ণব ঘরে এমন অহংকারী উদ্ধত ছেলে আছে নাকি কেউ? মানছেন যে লেখাপড়ায় নিমাই তুখোড়। সুদর্শন গৌরকান্তি  দীর্ঘ বাহু  নির্মেদ শরীর নিমাই যখন মুখে মুখে শ্লোক বলে, নবদ্বীপ অঞ্চলে হেন মহিলা পুরুষ নেই যে মুগ্ধ চোখ তাকিয়ে থাকেনা! মৃদু মৃদু হেসে উপভোগ করে তা নিমাই। তাঁকে ঘিরে এলাকার যুবকেরা নতুন উন্মাদনায় মেতে ওঠে। রোজ রোজ নতুন নতুন পরিকল্পনা জেগে ওঠে নিমাইয়ের মাথায়। যেগুলো দেখে  ভুরু কুঁচকে যায় সমাজের মাথাদের।

 
সেই ছেলেবেলা থেকেই নিমাই মাথাব্যথার কারণ সমাজপতিদের। অনেক রকম আচারের চল রয়েছে বাংলাদেশে।  ছোয়াঁ বাঁচিয়ে চলা তার মধ্যে একটা। স্নান করে তো এদিক ওদিক মোটেও ছোঁবেন না।  নিমাই বার বার ছুঁয়ে দিতো পন্ডিতদের। গঙ্গার ঘাট। পূজো আচ্চার কেন্দ্র। নিমাই সেখানে গিয়ে পূজো লন্ড ভন্ড করে দিতো।

     
নিমাই যেন সমস্ত নিয়মের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে যেতে লাগলো। বড়ো হতে হতে আরো চোখে পড়তে লাগলো তাঁর ঝগরুটে স্বভাব। একেতো মেধাতে জ্বল জ্বল শরীর, তার উপরে পন্ডিত ধরে ধরে সে প্রমাণ করে ছাড়বে যে এই সব প্রথাগত কোনো কিছুরই কোনো মানে নেই।

   
গঙ্গার ঘাটে পা ঝুলিয়ে বসে ছিল নিমাই। চারিদিক ঘিরে তার সতীর্থরা। নিমাই একটু দুষ্টু হেসে বললেন--" ভাবছি গুরু বধ করি? কি বলো তোমরা?" সতীর্থরা সকলেই নিমাইয়ের সঙ্গে গঙ্গাদাস পন্ডিতের টোলে, কলাপ ব্যাকরণের ছাত্র। নিমাই তাদের মধ্যে সেরা।। নিমাই তাঁদের নেতাও বটে। তারা হৈ হৈ করে উঠলো। হোক গুরু শিষ্যের লড়াই। আর শাস্ত্র পাঠে তর্ক যুক্তির যে জায়গা, অর্থাৎ একজন পন্ডিতের দোষ বার করে পন্ডিতকে ভুল প্রমাণ করে অন্য যুক্তি দিয়ে নিজের যুক্তি রাখা, অথবা, নিজের যুক্তি নিজে কেটে অন্য যুক্তিকে রাখা---- এক সাংঘাতিক উত্তেজনার মুহূর্ত। লোক মুখিয়ে থাকে এমন তর্ক যুদ্ধ দেখবার জন্য। তা বলে নিজের গুরুকে তর্ক যুদ্ধে আহ্বান? তবে নিমাইয়ের পক্ষে সব সম্ভব। আকাশ ভেঙে পড়লো জগন্নাথ মিশ্রের মাথায়। ছিঃ ছিঃ একি কান্ড? এও কি সম্ভব? কিন্তু অর্বাচীন সন্তান কোনো বারণ শুনলে তো? বাড়ি মাথায় করে শচী দেবীর ওপরে রাগে ফেটে পড়েন মিশ্র --"

     "
তখনি বলেছিলাম ছেলেকে মূর্খ করে রাখো। বিদ্বান বড়ো ছেলে তো বুকে ঘা দিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে চলে গেলো। ছেলে বিদ্যা নিয়ে ছেলে খেলা করছে। ছেলেও থাকবে না শচী। মূর্খ ছেলে হলে সে আমার ঘরে থাকতো। তোমার কাছে থাকতো শচী।"  নিমাইয়ের ওপরে ক্রোধের চেয়ে হাহাকার ফুটে ওঠে যেন। শান্ত স্বরে স্বামীকে সান্ত্বনা দেন শচী ---" তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। নিমাই আমাকে ছেড়ে যাবে না। আর নবদ্বীপ এমন বিদ্বান পন্ডিতের জায়গা। সেখানে পন্ডিত বিশ্বরূপের ছোট ভাই হবে কিনা মূর্খ? আমি পারবো না গো। কেউ তার মেয়ে  বিয়ে দেবে না মূর্খের সঙ্গে।"

 
মিশ্রর কেমন শরীর খারাপ করতে লাগে। আগামী কাল নিমাই আর টোল গুরু পন্ডিত গঙ্গা দাসের তর্ক যুদ্ধ। সারা নবদ্বীপ মেতে উঠেছে এই ঘটনা ঘিরে। প্রবীণদল আর নবীন দল  স্বাভাবিক ভাবে দুটো ভাগ হয়ে গেছে। পরাজিত হলে নিমাই শান্ত হয়ে সমাজের সব নিয়ম কানুন মেনে নেবে কথা দিয়েছে। গঙ্গা দাস প্রবীণ বিচক্ষণ পন্ডিত। নিমাইয়ের পরাজয় অনিবার্য। মিশ্র হাত জোড় করে গৃহদেবতা গোপালকে প্রণাম করলেন---" হে দেব। নিমাই যেন হেরে না যায়।"

 *

   
নিমাইয়ের আহবানে তর্ক যুদ্ধে সামিল হলেন গুরু গঙ্গাদাস। দু দিকে দুই পক্ষের সমর্থক। মুহূর্তে মুহূর্তে ঝলসে উঠছে শান দেওয়া যুক্তি এক সময় উঠে দাঁড়ালেন গুরু গোবিন্দদাস। বুকে জড়িয়ে ধরলেন প্রিয় শিষ্যকে।  স্বীকার করে নিলেন নিজের পরাজয়। নিমাইয়ের অনুগামী চেলা চামুণ্ডাদের হৈ চৈ গঙ্গার তীর ধরে বয়ে চললো। প্রবীণ দল মাথা নিচু করে ভাবলেন আগামী কাল থেকে নিমাইয়ের অদ্ভুত অত্যাচার আরো বেড়ে যাবে!

(
ক্রমশঃ )



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন