পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০১৭

রুমা ঢ্যাং অধিকারী


তিন্নির অকালসন্ধ্যা


-আরে লাহিড়ীবাবু দেখেছেন খবরের কাগজটা আজ তো নিউজ চ্যানেলগুলো একটা খবর পেয়ে যাবে আর সারাদিন একই খবর ভ্যানভ্যানিয়ে যাবে
-- কি খবর রায়বাবু?
চায়ে এক চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন লাহিড়ী বাবু আর সেইসঙ্গে সকালের হরিপদ ও তার চায়ের দোকানের বাকি খদ্দেরদের মুখে বিস্ময় জেগে উঠল

সকাল থেকেই তিন্নি আজ বেজায় খুশি ছোট থেকেই বাবা অখিলেশ মজুমদারের ন্যাওটা সেই বাবার আজ ছুটির দিন বাবাকে অফিসে যেতে দিতে মোটেও ইচ্ছে হয় না তারঅখিলেশের এতটাই আদরের যে তিন্নি মায়ের যে শাড়ির রং পছন্দ করে দেবে তিন্নির মাকে সেই শাড়িই নিতে হবে  অন্বেষাও মেয়েকে খুব ভালবাসেন এমনকি তিন্নির আবদারে বাড়িতে গয়না এলেই বাবাকে মডেল সেজে বসে থাকতে হত আজ অবশ্য সেই আদুরে মেয়ের অন্য আর একটা আনন্দের কারন আছে বাবার ছুটির দিনে তিন্নির বাঁধা গরু ছাড়া পায় মানে পড়া থেকে মুক্তির দিন সকাল থেকেই সেই খুশিতে তিন্নি নেচে বেড়াচ্ছে অখিলেশ ছুটির দিনে অন্বেষাকে নিয়ে থিয়েটারে যায় আর তিন্নি সেই বিকেলটা খ্যালে ঠাম্মার সাথে ছাদে আর সন্ধ্যেবেলা টিভি দেখে এমনটাই হয়ে আসছে ছোট থেকে
দুপুর আসতেই সেসবে জল ঢেলে মা আদেশ দিয়ে গ্যাছে পড়তেতিন্নি অগত্যা কাঁচুমাচু মুখ করে ঠাম্মার সাথে দাঁড়িয়ে ওদের যাওয়া দেখতে লাগল মায়ের কথাগুলো আদৌ তাকে খুশি করে নি কিন্তু মায়ের আদেশ অমান্য করার শক্তিও নেই অন্বেষাও মেয়ে অন্ত প্রাণ তাই বলে শাসনটা কিছুমাত্র কম ছিল না তাই সে কথার নড়চড় না করে বিকেল বিকেল পড়তে বসে গেল এই ভেবে যে সন্ধ্যেবেলা ঠাম্মার সাথে টিভি দেখবে 
তিন্নিকে প্রতিদিন নতুন পড়ার সাথে সাথে গোটা বই রিডিং দিতে হত গরমের ছুটি থাকায় সকালে নতুন পড়া করে নিয়েছে এখন শুধু বইগুলো রিডিং পড়তে তার বাকি জানলায় পা রেখে বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে চারপাশে নজর রেখে অনর্গল মুখস্থ আউড়ে যাচ্ছিল চতুর্থ শ্রেণীর বইগুলো  এমনসময় দেখল বাইরে বারান্দার যেপাশে ভাড়াটিয়া জেঠিমা তার মেয়ের চুল বাঁধতে বসেছিলেন সে দিক থেকে তিন্নির দিকের দরজা দিয়ে উঠোনে নেমে পাতকুয়ার দিকে কে যেন চলে গেল সাদা থান পরেঘোমটা দিয়ে প্রথমে তিন্নি ভাবল ছাদে ঠাম্মা টবের ফুলগাছে জল দিতে গেছেন এবার নেমে আবার পাতকুয়া থেকে জল তুলতে গেলেন বুঝি কিন্তু ভাল করে মনে করতে বুঝতে পারল যে ঠাম্মা ওইরকম শাড়ি পরে না ওরকম ঘোমটাও দেয় না  তাহলে কেএই ভেবে তিন্নি পিছুপিছু ছুটে গেল পাতকুয়ার দিকে কিন্তু কিছুই তার নজরে পড়ল না তিন্নিদের বাড়ির পেছনদিকেই পাতকুয়া আর তার পরেই খিড়কি দরজা তার একপাশে বাথরুমতিন্নি বাথরুমের দরজা খুলে দেখল না, কোথাও কিছু নেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তিন্নি ফিরে এসে জেঠিমাকে জিজ্ঞেস করল
-- কই না তো রে কাউকে দেখলাম না তো তেমন তোর ঠাম্মা তো ছাদে গ্যাছে গাছে জল দিতে এখনও নামে নি আমি তো এখানেই বসে আছি নামলে দেখতে পেতাম
-- কোথায় গেছে, দেখেছিস রে তিন্নি?  ( জেঠিমার মেয়ে পুঁটিদিদি এতক্ষন চুপ করে শুনে প্রশ্ন করল তিন্নিকে)
-- সাদা থান পরে পাতকুয়োর দিকে যেতে দেখলাম যে আমি
-- কি জানি হ্যা রে  তুই পড়তে পড়তে স্বপ্ন দেখছিলিস নাকি!  ( দিদি বলল)
- আরে না পরিষ্কার যেন দেখলাম আমি
-- না রে মানা কেউ যায় নি তুই নিশ্চিন্তে পড়তে যা আমি আছি তো এখান দিয়ে গেলে দেখতে পেতাম না!
-- তা ঠিক ধুরআজ বাপির ছুটির দিনকোথায় খেলব সারাদিন তা না খালি পড়ো আর পড়ো
তিন্নির ঠাকুমা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে তিন্নিকে দেখে বলতে শুরু করলেন -
-- ইতিসোনা, পড়া হয়ে গেছে নাকি! এখানে যে তুমি 
-- না ঠাম্মা হয় নি আচ্ছা ঠাম্মা তোমার সাথে ছাদে কি কেউ ছিলএকটু আগেসিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল?
-- না তো কে আবার থাকবে কেউ ছিল না 
-- না গো আমি একজন সাদা থান পরা পুরো ঘোমটা দিয়ে একজনকে পাতকূয়োর দিকে যেতে দেখলাম 
-- না না সে কি করে হবেএখানে তোর জেঠিমা,   দিদি বসে আছে এলে তো ওরা দেখতে পেততুই একলা আছিস বলে আমি তো দেখতে বলে গেছিলাম ওদের 
-- না গোআমি সত্যি বলছি একজনকে...
-- সে হবে তুই কি দেখতে কি দেখেছিস দিবাস্বপ্ন
-- দিবাস্বপ্ন কি
-- জেগে জেগে স্বপ্ন দেখা না পড়বার মতলব হচ্ছিল নাকি রে ইতিবাবু!
-- ধুর কেউ বিশ্বাস করে না!
এরপর বেশ কয়েকদিন যাবার পর তিন্নিদের বাড়ি রিপেয়ার এর কাজ শুরু হয়েছে মালপত্র সরাবার সময় আলমারি থেকে একটা ফটো অ্যালবাম বার করে তিন্নির মা বিছানায় রেখেছে তিন্নি বেশ খুশি আজ সে কত লুকানো জিনিস একসঙ্গে দেখতে পাচ্ছে নাড়াচাড়া করে খেলে যাচ্ছে সেসব নিয়ে ওর মা অ্যালবামটা রাখতেই তিন্নি সেটা নিয়ে পাতা উলটে দেখতে লাগল ওর অন্নপ্রাশনের ছবি, বাবা মায়ের বিয়ের ছবিবেড়াবার ছবি এরকম আরও নানান ছবির অ্যালবাম নাড়াচাড়া করতে করতে একজনকে দেখে তিন্নির চোখ আটকে গেল  অবিকল একইরকম দেখতে সেদিন শুধু মুখ দেখেনি তিন্নি ঘোমটা দেওয়া ছিল সাইড থেকে তিন্নি দেখেছিল বাকি চেহারা দেখে চেনা যাচ্ছে যে ইনি সেই যাকে সে সেদিন দেখেছিল উঠোন দিয়ে তিন্নি আর মাকে কিছু বলল না সেদিন কেউ বিশ্বাস করে নি সবাই হেসে কথা ঘুরিয়ে দিয়েছে আজ মা যে করবে না সেটা কে জানে তার থেকে চেপে যাওয়াই ভাল মনে করে জিজ্ঞেস করল কে উনি
-- কে দেখি ইনি তোর বড়মা তুই যখন দেড় বছরের ছিলিস তখন তোর বড়মা মারা যায় তুই সমানে দুটো সিঁড়ি ভেঙ্গে সদর দরজার কাছে সিঁড়িটার নিচে বড়মার কাছে চলে যেতিস তোর বড়মা কোথাও শুতে চাইতেন না তিনি ওখানে চৌকিতে শুতেন আর তোকেও আটকানো যেত না আটকালে খুব কাঁদতিস মারা যাবার আগে খুব ভুগছিলেন সেসময় তোর ঠাকুমা কিছুতেই যেতে দিতেন না তোর বড়মার কাছে পাছে তোর কিছু না হয়ে যায় জানিস বড়মা কি বলে গেছেন?
-- কি?
-- মারা যাবার আগে আমাকে একদিন ডেকে বললেন তিন্নিকে তোমরা কেউ মেরো না একদিন দেখবে অনেক বড় হবে, অনেক নাম করবে আর তুই!  পড়িস না,  সবসময় ফাঁকিবাজি আমি জানি তুই পড়লে কি ভাল রেজাল্ট করবি!
তিন্নি এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল আর মেলাচ্ছিল সেদিনের ঘটনার সাথে  যেন পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিল হামাগুঁড়ি দিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে বড়মার কাছে যাচ্ছেকোমর থেকে বিছে চেন ঝুলছে
তিন্নি এসব ভাবছে আয়নার সামনে বসে তিন্নির মা ডেকে ডেকে মেয়ের সাড়া না পেয়ে ঘরে ঢুকে মেয়ের কাঁধে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন -
-- কি রেচুপচাপ বসে কি ভাবছিস? বেরোবি নাদেরি হয়ে যাবে তো নাচের ক্লাশে যেতে!
-- কিচ্ছু ভাবি নি তো তুমি, কখন এলে
-- এই তো এইমাত্র ঘরে ঢুকেই দেখলাম তুই জানলার দিকে তাকিয়ে কি যেন ভেবে চলেছিস আজ তো তোর আনন্দের দিন রে তিন্নি মা তুই পুরষ্কার পাচ্ছিস সেকথা জানিয়ে স্বয়ং তোর আরাধ্য গুরু থানকুমনি কুট্টি ফোন করে খবর দিলেন  আর তুই বাংলার পাঁচের মত মুখ করে এখানে বসে আছিস!  নিচে কখন গ্যারেজ থেকে গাড়ি বার করে রাজু দাঁড়িয়ে আছে
-- এই তো যাচ্ছি, আমি রেডি তো হয়ে গেছি মা
-- জানো মা, গুরুজি যখন ফোনে জানালেন, আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছিল না!
--  যাবার আগে তোর বাপিকে আর ঠাকুমাকে নমষ্কার করে আশীর্বাদ চেয়ে নিয়ে যাবি কেমন?
-- শুধু বাপি, ঠাকুমা কেন মাযার ভবিষ্যৎবানী সফল হল, যে তোমাদের থেকে বয়সে বড় সেই বড়মাকে আগে যাই জানাতে তার ফটোর সামনে
--তোর মনে আছে এখনওতিন্নি!
-- হ্যাঁ  মাআমি আজও দেখতে পাই কোমরে বিছে চেন ঝুলিয়ে বড়মার কাছে হামাগুঁড়ি দিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে যাচ্ছি
-- তিন্নি!
তিন্নি বড়মার ফটোর কাছে যাবার জন্য টুল ছেড়ে উঠে দুপা এগোতেই দরজার কাছে ফুটে উঠল সেই চেহারা যাকে সে ছোটবেলায় দেখেছিল সেই সাদা থান পরা ঘোমটা দেওয়া এবারে তিন্নি পরিষ্কার খুব শান্তিময় স্মিতহাস্য মুখ দেখতে পেল তিন্নির দিকেই দুহাত তুলে আছে তিন্নি চারপাশ ঝাপসা হয়ে গেল বাইরে সূর্য সিঁদুরে টিপে সেজে কালো ভেলে সে নিজেকে এবার ঢেকে নিচ্ছে বাড়িতে বাড়িতে শঙ্খধ্বনির রোল উঠল তিন্নি গায়ে আতর মেখে 'ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে' নেচে আপন বাড়ির দিকে রওনা দিল আর ওর প্রতিবিম্ব ফুটে উঠল চারকোনা ফ্রেমে
খবরের কাগজের ফ্রন্টপেজের বোল্ড হেডলাইনের খবরে অলিগলিগুলো শুধু সরব হল





                                   



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন