পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ১৫ আগস্ট, ২০১৭

রীনা রায়


আলোর প্রতিক্ষায়"


                
তৃতীয় পর্ব

ও টর্চের আলোটা ফেলতেই দেখলো সবার মুখ রুমালে ঢাকা, একটা ভয়ের স্রোত ওর শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল । ও দৌড়ে পালাতে গেল, কিন্তু তার আগেই ওরা ওকে ধরে ফেলল। ও চীৎকার করার আগেই ও রা ওর মুখ চেপে ধরল। ও প্রানপনে বাধা দেবার চেষ্টা করলো, কিন্তু তিনজন শক্তসমর্থ পুরুষের সাথে ও পেরে উঠবে কি করে? 
ওরা খুব সহজেই ওকে তুলে নিয়ে চলে গেল । তারপর তিনজন মিলে ওর ওপর পাশবিক অত্যাচার করে গেছে । কতক্ষণ ও জানেনা কারণ ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল । ওরা প্রত্যেকেই নেশাগ্রস্ত ছিল। ওদের সবাইকে ও সহজেই চিনেছিলো।নেশার ঘোরে ওরা নিজেরাই জানিয়েছিল।
 
অভিদা , মজুমদার বাড়ির ছেলে অভিষেক মজুমদার । তাকে নাকি ভালবাসতো, কিন্তু অপর্ণার দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে বন্ধুদের পরামর্শে নাকি সে ওই কাজ করেছিল । হুঃ, ভালবাসা! ভালবাসা মানে কি শুধু শরীরের চাওয়া? না, ও ক্ষমা করতে পারেনি ওদের, কোনোদিন পারবেও না ।
 
সনাক্তকরণের দিন ওকে ডাকা হয়েছিল, ও প্রত্যেককে চিনিয়ে দিয়েছিল । মজুমদার বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে বাবার কাছে এসেছিলো। পরিবর্তে শর্ত ছিল অপর্ণা যেন ওদের চিনতে অস্বীকার করে। বাবা কঠোরভাবে ওদের ফিরিয়ে দিয়েছিলো।
সেদিন ওর ফিরতে দেরী হচ্ছে দেখে সাড়ে আটটার সময় বাবা বাসস্টপে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও ও না আসায় বাবা ভেবেছিলো ও হয়তো বাড়ি চলে এসেছে।বাড়ি এসে যখন শোনে যে অপু তখনও বাড়ি আসেনি, তখন গ্রামের কয়েকজনকে বলে । তারপর সারারাত ধরে খোঁজাখুজি চলে, পুলিশেও খবর দেওয়া হয়।
শেষে ভোরের দিকে কেউ একজন ওকে সংজ্ঞাহীন অবস্হায় রাস্তার ধারে পড়ে থাকতে দেখে ।
 
দুদিন হাসপাতালে থাকার পর ও বাড়ি ফিরেছিল ।কিন্তু ফিরে আসার পর মনে হয়েছিল, কেন ফিরল? বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই যেন হারিয়ে ফেলেছিল । সবসময় একটা আতঙ্কে থাকত, একটা ট্রমার মধ্যে দিন কাটতো।
তার ওপর মা ঐরকম অসুস্থ, কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল, শুধু অপুর দিকে তাকিয়ে থাকতো, আর দু চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তো।
 
মাসখানেক এইভাবে যাওয়ার পর পিসিমণি ওকে এসে নিয়ে গেছিলো। বাবাকে বলেছিলো, 'এখানে থাকলে মেয়েটাকে বাঁচানো যাবেনা, ওকে আমি নিয়ে যাচ্ছি, ওখানেই ওর চিকিত্সা হবে'।
 
তারপর ওর জীবনটা পুরোটাই বদলে গেছিলো। ডক্টর আকাশ সেনগুপ্ত অসীম ধৈর্যের সঙ্গে ওকে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছিল । প্রথমদিকে কোনো ছেলেকেই ও সহ্য করতে পারতোনা। আতঙ্কে চীৎকার করে উঠতো। আকাশ ওকে বাঁচতে শিখিয়েছে, আবার ও মানুষকে বিশ্বাস করতে শিখেছে। আস্তে আস্তে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ও ফিরে এসেছে। নিজেকে তৈরী করেছে।
 
আর সবসময় তার পাশে পেয়েছে পিসিমণি, পিসেমশাই ও আকাশকে । আকাশ ওর ভীষণ ভালো বন্ধু । আর এখন তো স্মিতার সাথেও ভীষণ ভাল একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে, স্মিতা আকাশের স্ত্রী। খুব ভাল মনের একজন মেয়ে । এদের জন্যই ও বেঁচে থাকার প্রেরণা পায়।
শুধু পড়াশোনা করে কেরিয়ার গড়াই নয়। শারীরিকভাবে অপর্ণা এখন অনেক সক্ষম। ও এখন ক্যারাটের ব্ল্যাক বেল্ট ধারী। ও অনুভব করেছে, আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই প্রত্যেকটি মেয়েরই নিজেকে গড়ে তোলা উচিত । তাই ওর প্রথমেই মনে হয়েছে নিজের গ্রামের মেয়েদের কথা, আর সেজন্যই প্রথম সুযোগেই ও গ্রামে এসেছে ।
কিন্তু গ্রামের কেউই তো কোনরকম আগ্রহই দেখালোনা। শুধু তাই নয় গ্রামে ওর উপস্থিতিটাও যেন কেউ সহ্য করতে পারছেনা।
ও ঠিক করলো যে কদিন এখানে থাকবে , বাড়িতে মা বাবা ভাই এর সাথেই সময় কাটাবে, তারপর ফিরে যাবে।
দিন কয়েক বাদে অফিসের একটা কাজে ওকে কলকাতায় যেতে হল। সকাল থেকেই আকাশটা মেঘলা ছিলো। ফিরতে একটু দেরীই হয়ে গেলো।বাসে উঠে দেখলো নয়না বসে আছে, ও একটু হাসলো কিন্তু নয়নার মায়ের কথাগুলো মনে পড়ে গেল তাই একটু দূরে অন্য সিটে গিয়ে বসলো। লক্ষ্য করলো নয়না কেমন যেন ভয়ে সিঁটিয়ে আছে, একটু পরেই কারণটা পরিস্কার হল। তিন চারজন ছেলে মিলে নয়নাকে সমানে বিরক্ত করে যাচ্ছে । ভালো করে তাকিয়ে দেখলো, ওরা কেউই ওদের গ্রামের নয়। প্রতিবাদ করতে গিয়েও নয়নার মায়ের কথাগুলো মনে পড়ে গেল। ও চুপ করে বসে রইলো। ভাবলো আর একটু পরেই তো ওরা নেমে পড়বে।
গ্রামে বাস থামতেই ও নেমে পড়ল, ওর পরে নয়নাও। বৃষ্টিটা বেশ জোরে পড়ছে, অপর্ণা ছাতাটা বের করলো। চারিদিক বেশ ফাঁকা, হয়তো বৃষ্টির জন্যই।
অপর্ণা একটু তাড়াতাড়িই হেঁটে যাচ্ছিল, হঠাৎ পিছনে গোঙানির আওয়াজ শুনে তাকিয়ে দেখে ছেলেগুলো নয়নার মুখটা চেপে ধরে ওকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে ।
তার মানে ছেলেগুলো ওদের পিছু পিছু বাস থেকে এখানে নেমেছে! অপর্ণা আর একটুও সময় নষ্ট না করে এগিয়ে গেল । ওদের হাত থেকে নয়নাকে উদ্ধার করতে অপর্ণার খুব বেশী সময় লাগলো না । নয়না তখন ভয়ে থরথর করে কাঁপছে। ওকে আগলে ধরে ওর বাড়ীর দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে অপর্ণা বাড়ি ফিরে এলো।
একটু রাতের দিকে অপর্ণাদের বাড়িতে বেল বাজলো। 'এতো রাতে কে এলো দেখি' বলতে বলতে বাবা দরজাটা খুলে দেখে নয়নার বাবা, মা এসেছে।
 
'তোমরা এত রাতে? কোনো বিপদ ঘটে নি তো? '
আমরা একটু অপুর কাছে এসেছি।

অন্তিম পর্ব
অপু বাড়ি ফিরে কাউকে কিছু বলেনি। কাকেই বা বলবে! মা অসুস্থ, শুধু শুধু টেনশন করবে । ভাইটা কৈশোর ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, ওর সাথে এসব কথা আলোচনা করা যায়না। আর বাবাকে ও কত দুশ্চিন্তায় ফেলবে? তাও ভেবেছিলো রাতের খাওয়ার পর বাবাকে বলবে, তার আগেই তো ওরা চলে এলো।
অপু এগিয়ে গিয়ে বললো, কাকিমা তোমরা ভেতরে এসো। ও তাকিয়ে দেখলো নয়নার মায়ের দুচোখ জলে ভেসে যাচ্ছে ।
 
কাকিমা ওকে দেখতে পেয়ে ওর হাতদুটো দু হাতে ধরে শুধু কেঁদে চললো, আর একটাই কথা বারবার বলে গেল ।তোকে অপমান করেছিলাম, তাই ঠাকুর আমাকে শিক্ষা দিলেন ।
 
কাকু ওর মাথায় হাত দিয়ে বললেন, তুই আমার নয়নাকে রক্ষা করেছিস, আমার ঘরের সম্মান বাঁচিয়েছিস, ঠাকুর তোর মঙ্গল করুন, তোর সব ইচ্ছে যেন পূর্ণ হয়।
অপর্ণা একটু হেসে বললো, 'আমার চাওয়া টা তো তোমরা জানোই কাকু, ওইটুকু পূর্ণ হলেই আমার অনেকটা পাওয়া হবে।'

এদিকে বাবা কিছু বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে । তখন ওরাই সব ঘটনা বিস্তারিত ভাবে বললো। বাবার দুচোখে জল, অপর্ণার মাথায় শুধু হাতটা রাখলো, অপর্ণার মনে হল ওর সব পাওয়া হয়ে গেছে ।

পরের দিন একটু বেলার দিকে অপর্ণা মেঘটা কেটেছে দেখে জামাকাপড় গুলো শুকোতে দিচ্ছিলো।
বেল বাজতে দরজা খুলে দেখে নয়নার ঠাকুমা এসেছেন । সঙ্গে নয়নার মা।
 
নয়নার মা-ই প্রথম কথা বললো। 'দ্যাখ না, মা তোর কাছে আসার জন্য এত জোর করলো যে না নিয়ে এসে পারলাম না।'
অপু মনে মনে ভাবলো, কয়েকটা মাত্র দিন আগেই তোমরা আমার মুখ দেখতে চাইতেনা আর আজ,,,,, মুখে বললো, 'এসো, এসো ভেতরে এসো।'
ও শুনেছিলো নয়নার ঠাকুমা বাঙলাদেশের মেয়ে । তখনকার দিনে ক্লাস টেন পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন, তারপর জোর করে ওনার বিয়ে দিতে গেলে উনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে গেলে কয়েকজন অসাধু লোকের হাতে পড়েন। তারা ওঁকে পাচার করার চেষ্টা করছিলো। তখন নয়নার ঠাকুর্দা ওনাকে উদ্ধার করেন ।ঠাকুমা আর বাড়ি ফিরে যেতে চাননি, তখন ঠাকুর্দা ওনাকে বিবাহ করেন ও গ্রামে নিয়ে আসেন ।

ঠাকুমা অপর্ণার হাত দুটো ধরে বললেন, 'সেদিন তুই আমার লগে কি কইবার তরে গেছিলি? আজ আমি নিজে তোর লগে শুনবার তরে এলুম।তুই আমার ঘরের মান বাঁচাইছস,,, ঠাকুর তোর মঙ্গল করবেন ।'
অপর্ণার মন আনন্দে নেচে উঠলো। তার আশা পূর্ণ হবে তাহলে!
 
ও ওর সমস্ত পরিকল্পনা বুঝিয়ে বললো।
ঠাকুমা সব শুনে বললেন, 'আর তোর চিন্তা করনের কিছু নেই, সব হয়ে যাবেখন্ ।'
ঠাকুমা এবার নিজে উদ্যোগী হয়ে সবার সাথে কথা বললেন ।অনেকেই অনিচ্ছা সত্বেও ঠাকুমার পীড়াপিড়িতে মত দিতে বাধ্য হল।
এরপর কয়েকটা দিন খুবই ব্যস্ততার মধ্যে কাটলো। 
খুব রিলাক্স লাগছিল অপর্ণার।অবশেষে তার একটা স্বপ্ন পূর্ণ হল। 
এদিকে ওর ছুটি শেষ হয়ে আসছে, ওকে ফিরতে হবে । ওখানে 'অ্যালেন' যে ওর প্রতীক্ষায় দিন গুনছে।
------------সমাপ্ত-------


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন