পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

জয়তী রায়


ইতি সুমন

          

মেঘ
       আজকাল কেউ চিঠি লেখে না। ডাক পিয়নের চাকরি আর নেই মনে হয়। তবু , চিঠি লিখলাম তোকে। খাম খুললে অক্ষরের সঙ্গে পাবি আমার দেশের কুয়াশা, পাইনের গন্ধ, জঙ্গলের ধার ঘেঁষে ছোট নদীর কুল কুল শব্দ, জলের নীচে রঙ্গীন নুড়ি আর পাহাড়ের একাকিত্ব। সব তোর কাছে পৌঁছে যাবে এক অচেনা ডাকপিয়নের হাত বেয়ে। তুই যদি সেই ষোলোর মেঘ হতি, তবে তো খাম হাতে ধরে ঘুরে ঘুরে নেচে উঠতি। বাতাসে ফুলে উঠতো নীল ফুল ছাপা স্কার্ট, দেখা যেত সেই সুন্দর ফর্সা পা, আমার বুকে হাতুড়ি মারতে ওই দৃশ্য যথেষ্ট ছিলো। 
 মেঘ,
তোর কথা ভাবলে এই  ষাট পার  হয়েও নিজেকে তরুণ মনে হয়। প্রেমিক থাকা যে কতো সুন্দর, কতো রোমাঞ্চের , কতো সুখকর -- যারা প্রেমিক নয় তারা বুঝবে না কোনদিন। তুই আমার সেই প্রেমিকা , যে শর্তহীন প্রেমে ডুবিয়ে রেখেছিল আমাকে। এক স্থির আশ্বাস, এক পূর্ণ বিশ্বাস ঘিরে থাকতো আমাকে যে  তুই আছিস। আমার দেওয়া সমস্ত আঘাতকে অলংকার করে শরীরে জড়িয়ে নিয়ে আমার হয়েই থেকে গেলি। জীবন -- কতো তাড়াতাড়ি একঘেঁয়ে হয়ে যায়? তুই আর পুরোনো হলি না।  রয়ে গেলি লাইট হাউসের মতো আমার আশ্রয় হয়ে। 
 মেদিনীপুর থেকে যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং-- খুব সহজ রাস্তা নয়। গরিব আমার পরিবার, বলতেও লজ্জা নেই। পিজি হোস্টেলের খাবারে মেদিনীপুরের পেট ভরানো মুশকিল ছিলো। তুই  ক্লাস ইলেভেন। তোকে অঙ্ক করানোর টিউশন জোগাড় করে দিয়ে মস্ত উপকার করেছিল তোর দাদা নীলাদ্রি , সেই সঙ্গে বলতে ছাড়েনি তার  ছোট বোনটি একটি আস্ত গবেট---" সুমন! পারবি তো রে? বোনটা এক্কেবারে নিরেট। আর খুব দুষ্টু।" কোঁকড়া চুলে ভরা তোর মাথায় হাত বুলিয়ে নিলাদ্রী বললো। আমি তখন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। পয়সার খুব দরকার। সামনের চকচকে ডল পুতুলের মতো মেয়েটি দেখে শুধু টাকার অংকটাই মনে আসছিল। এক কথায় মাথা নাড়লাম। নিলাদ্রী ওর স্বভাব সিদ্ধ চওড়া হাসি হেসে পিঠ চাপড়ে দিলো আমার। বড়োলোকের ছেলে, এক ক্লাসে পড়েও দাদা গোছের ভাব, আমার শুকনো মুখ দেখে এটা ওর একধরণের উপকার করা যে, সেটা বেশ বুঝতে পারলাম।
তোর দাদাকে ভোলা মুশকিল। কি বলতো মেঘ? একটা দিন শুরু হয়, প্রকৃতির নিয়মে। কিন্তু চব্বিশ ঘন্টা পার করে আরেকটি দিনে পৌঁছনো কি ওতো সহজ? কতো ছোট ছোট কাঁটা ছড়িয়ে থাকে ওই একটি দিনের চলার পথে। তোর দাদা সেই বিরল মানুষ যে অন্যের পায়ের তলার কাঁটা গুলো তুলে, তাদের চলার পথ মসৃণ করার চেষ্টা করতো। সতীর্থদের অনুজের মতো স্নেহ করতো।  দ্যাখ, নীলাদ্রির কথা লিখতে লিখতে কাগজের উপর চোখের জল ঝরে পড়ছে। মেঘ, এই চিঠি আমার সেই শ্রদ্ধা বয়ে নিয়ে যাবে, যা একাত্তর সালের পুলিশের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাওয়া নিলাদ্রিকে আমি দেখাতে পারিনি। আমার বুকটা ফেটে যায় ভেবে যে একটা করে বুলেট নিজের শরীরে নিতে নিতে ওই মহান মানুষটা বলছে ," তুই পালা সুমন। তুই ছাড়া মেঘের কেউ নেই। তুই পালা। " আমি যাচ্ছিনা দেখে চিৎকার করে বললো--" রাজনীতি আমি করি । তুই নোস। আজ তোকে এখানে কায়দা করে পাঠিয়েছে অংশুমান। ক্ষমতার দালাল টা তোকে আমাকে শেষ করে, মেঘকে দখল করবে । তুই পালা।" 

মেঘ, 
একটা জীবন বহন করে কত ইতিহাস। কতো লোভ, হিংসা ,রাজনীতি ,কতো হত্যা, হিংস্রতা। জীবনে কতো কাহিনী। অংশুমান ক্ষমতার রাজনীতি করতো। হিংসে করতো নিলাদ্রীকে। অথচ মুখে তোষামুদি ভাব। মেঘ তুই এতো সুন্দরী ছিলি, তার উপরে এতো সরল চোখ, এতো মালিন্যহীন হীরের মতো ছিলি ,যে তোকে মনে হতো ঠিক এক ওয়েসিস। এক ফুলে ভরা কৃষ্ণচূঁড়া। ঠান্ডা কুঁজোর জল। তোর থেকে চোখ ফেরানো খুব মুশকিল হতো। অংশুমান লোভী শেয়ালের মতো ঘুর ঘুর করতো তোর আসে পাশে।  আর, নীলাদ্রির দরজা সবার জন্য খোলা। তোর মা বাবাও তাই। আমিও নিয়মিত আসতে লাগলাম। পড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পেট ভরে খাওয়া জুটে যেতো। সপ্তাহে তিনদিন পড়ানো গিয়ে ঠেকলো প্রায় রোজের হাজিরা। 
      নিলাদ্রী বাড়ি ফিরতো অনেক রাতে। সত্তরের সর্বনাশা রাজনীতির টানে ঘর ছাড়া হতো প্রায় ই। আমার দিকে বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে বলতো--" বেচারা মা আর বোনটা র খেয়াল রাখিস সুমন। বাবাকে নিয়ে ভাবিনা। ব্যবসাদার মানুষ। বাঁচার কায়দা জানেন।" 
 কলেজ করবো কি! নিত্য গন্ডগোল। তার মধ্যেই ভালো রেসাল্ট করে চাকরির স্বপ্ন দেখি। তোর বাড়ি যাওয়াটাও নেশার মতো ছিলো। যাদবপুর হোস্টেল থেকে রাণীকুঠি তোর বাড়ি হয়ে রাতে আবার  হোস্টেলে  ফেরা ওতো সহজ
ছিলো না সেই সময়। মাঝে বিজয়গড়  আর গলফ ক্লাব ,  নিত্য খুন হচ্ছে সেখানে। রোজ সন্ধ্যেবেলা হোস্টেল ফেরার সময় দরজা পর্যন্ত এসে উৎকণ্ঠিত তোর ফিসফিস গলা বলতো---" সাবধানে যেয়ো সুমন দা।" আমার গলার কাছে কি যেন একটা ডেলা পাকিয়ে উঠতো। নিলাদ্রী তখনো ফেরেনি। চাপা অস্থিরতা , তোর মার প্রতীক্ষার চোখ, তোর মায়া, একাত্তরের রাজনীতি-- সব নিয়ে আমরা দুজন দুজনকে ভালোবেসে ফেললাম। 

মেঘ, 
আমার কথা ছাড়। তোকে প্রত্যাশা করবে না এমন স্পর্ধা কোন পুরুষের ছিলো? কিন্তু আমার মধ্যে কি দেখলি তুই? চালচুলো নেই, একমাথা রুক্ষ্ম চুল, ঠিক মতো দাড়ি কাটিনা, কোনোরকম আধ ময়লা জামা প্যান্ট। রোগা ,ছোট চেহারা, লোকে যাদের ক্যাঙলা বলে মজা করে ওই রকম আরকি। 
যাদবপুরে আতলামী ভাবও রপ্ত ছিলো না। কষে তর্ক করতে পারতাম না। এতো রকম " না" ভারে ঝুঁকে পড়া জীবন আমার যে, ঝকঝকে মার্বেল মোড়ানো ঘরে , রাজকুমারীকে পড়ানো সেই সঙ্গে কাঁসার থালায় লুচি তরকারী মিষ্টি ,সঙ্গে শরবত--- চেয়ার টেনে তোর সামনে বসার পরে প্রথম কথা মনে হতো--," আজকে দাঁত মেজেছিলাম তো?" 
সায়েন্স নিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা দিবি তখন তুই। তখন এগারো ক্লাসে বোর্ড পরীক্ষা। অঙ্কে তুই মোটেও গবেট নোস।  মন দিয়ে পড়লেও কি যেন একটা গোলমাল চলতো তোর ভিতরে। আপাতঃ দৃষ্টির ধনী বাড়ি, অথচ বাবা কেমন রাগী মুখের, মা কিসব ওষুধ খান, একমাত্র ছেলে বাড়িই আসেনা প্রায়--একটা অসুখী গোপণ অসুখ ছড়িয়ে ছিলো বাড়িতে, যাকে তুই প্রাণ পনে চেষ্টা করতি স্বাভাবিক করতে। আজ দূরে বসে মায়ায় ভরে উঠছে বুক। তুই ষোলো আমি উনিশ। কিন্তু তোকে একদম মায়ের মতো লাগতো আমার। সবার জন্য চিন্তা ছিলো তোর, সবাইকে দেখে  রাখার একটা উদ্বেগ কাজ করতো। 

মেঘ, 
সেই রাত মনে পড়ে তোর? নিশ্চই পড়ে। আমার তো মনে হয় এই সেদিনের কথা। সেদিনও বাড়ি ফেরেনি নিলাদ্রী। কোথায় আছে কে জানে? সি আর পি পুলিশ আর কিছু গুন্ডা মিলে তান্ডব চালিয়ে তছনছ করেছে তোদের বাড়ি, মাসিমার মন শরীর দুটোই খুব খারাপ। কি করে কারফিউএর মধ্যে অলি গলি দিয়ে তোদের বাড়ি পৌঁছলাম জানি না। শুধু মন বলছিলো পৌঁছুতেই হবে,যে ভাবেই হোক। নেতাজী নগর , রাণীকুঠি ঘিরে সেদিন তান্ডব চলছে। যাদবপুর থমথমে। নকশাল সন্দেহে যাদবপুরকে ছিন্নভিন্ন করা হয় অকারণেই। ওই রকম অবস্থায় তোর বাড়ি পৌঁছুলে তুই কেমন চোখে তাকালি রে মেঘ! শুভদৃষ্টি কাকে বলে বলতো? যে দৃষ্টিতে ফুটে ওঠে প্রেম। মায়াময় আলো ছড়ানো দুপুর বিকেলের সন্ধিক্ষণ , সেই সময় তুই এমন ভাবে তাকালি , মনে পড়লে এই সত্তরেও বুকের মধ্যে বেজে ওঠে  আমজাদ আলী খানের সরোদ। 
   সেদিন বাড়ির শোচনীয় পরিবেশ, মাসীমা ধরেই নিয়েছেন নীলাদ্রি আর বেঁচে নেই, মেসমসাই যথারীতি রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে চিৎকার করছেন, তুই সামলে চলেছিস সব, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে, চাকর বকর কেউ খায়নি, থম থম করছে গোটা বাড়ি, এই সময় আমি ঢুকলাম। 
মেঘ, তুই যেন জানতি আমি আসবই। খুব স্বাভাবিক গলায় বললি--" এসো সুমন দা।" যত সম্ভব বাড়ি স্বাভাবিক করার চেষ্টা শুরু করলাম দুজনে মিলে। মাসীমা মেসমসাইকে কোনোমতে কিছু খাইয়ে শুতে পাঠিয়ে ভাবলাম ফিরে যাই হোস্টেল ? 
    দেখ মেঘ, এতদিন পরে এই চিঠি লেখার কি মানে হয়? প্রমাণ তো হয়েই গেছে আমি কাপুরুষ। কাপুরুষের তো এমন চিঠি লেখার অধিকার নেই। এমন কি সেই রাতের কথা বলার সমস্ত অধিকার আমি নিজেই নষ্ট করেছি। তবু বিশ্বাস কর মেঘ, সেই রাতে তুই কিছুতেই যেতে দিলিনা আমাকে। একাত্তরের বৈশাখ। আকাশ ভেঙে কাল বৈশাখীর তান্ডব শুরু হলো। ডানা ভাঙা পাখির মতো আশ্রয় নিলি আমার বুকে তুই। ঝড়ের তান্ডব তখন আমার রক্তে, চুম্বন কি আসলে ওতো দীর্ঘ হয়? জানিনা। তুই ছাড়া কাউকে চুম্বন করিনি তো আর। জীবনে প্রথম নারী শরীরে র গভীর ছোয়াঁ, অথচ ঠোঁট ছাড়া কোনো অঙ্গ স্পর্শ করতে পারলাম না। প্রচন্ড মায়ায় আমার মুখটা তোর বুকে ধরে রাখলি, কতক্ষন, কে জানে । সারারাত বোধহয়। 

মেঘ,
 শিলংয়ে বেশ আছি। ইঞ্জিনীয়র তো হতে পারলাম না। ওই সময় যাদবপুরে বহু ছেলেই পড়া শেষ করতে পারে নি। আমি তো রাজনীতি করতাম না। কিন্তু নিলাদ্রী তখন নকশাল আন্দোলনের পুরোভাগে। তুই হায়ার সেকেন্ডারি শেষ করেছিস। আমি থার্ড ইয়ারে উঠেছি। ক্লাস তো হয়েই না। উপাচার্য আসতেই পারেন না কলেজে। খতম রাজনীতি নিলাদ্রী করতো বলে বিশ্বাস আমি করিনি। তখন ও ফেরার। প্রায় দশ দিন বাড়ি আসেনি।। 
মেঘ,
 আমি কোনদিন তোকে চিঠি লিখতাম না। কোনদিন নিজের সাফাই দিতাম না। কিন্তু অভিমান আমারো তো হয়। তুই ভাবলি কি করে নিলাদ্রী র খবর আমি পুলিশকে দিয়েছি? গতকাল ডাক্তার যদি না বলতো আর তিনমাস মোটে আয়ু আমার, ভেতরটা পাগলের মতো করতে লাগলো তোকে চিঠি লিখবার জন্য। 
মেঘ,
নিলাদ্রী খবর পাঠিয়েছিল আমাকে ওর সঙ্গে দেখা করার জন্য।   জলপাইগুড়ির জঙ্গলে যেতে হলো আমাকে, কাউকে কিছু বলা বারণ, তোমাকে বললাম মেদিনীপুর যাচ্ছি। অংশুমান কিন্তু ফেউএর মতো লেগেছিলো আমার পিছনে। আমি পৌঁছনোর কিছুক্ষন পরেই বিরাট পুলিশ বাহিনী জঙ্গল ঘিরে ফেলে ।
         টের পাইনি পুলিশের কথা। অবাক হয়ে দেখছি নিলাদ্রীকে।  মুখভর্তি দাড়ি, রোগা কালো ঝুঁকে পড়া শরীর,চিনতেই কষ্ট হচ্ছিল। সঙ্গে অচেনা আরো কয়েকজন, ওমনি ভেঙে পড়া চেহারা, কিন্তু চোখ গুলো আত্মবিশাস আর সাহসে জ্বল জ্বল করছে। বললাম--" নিলাদ্রী , বাড়ি একবার চল। মাসিমার অবস্থা খুব খারাপ।" আগের মতোই দরাজ হেসে নিলাদ্রী উত্তর দিলো--" ধুর পাগলা। কলকাতা ঢোকার উপায় এখন নেই। অনেক কাজ। তোকে এই জন্য ডেকেছি যে মা আর মেঘ কে দেখিস। " 
----" তুই  চল  তো ফিরে।" অবুঝের মতো ঘাড় বেঁকিয়ে বললাম। কথা বলতে বলতে দেখি, দূরে শিষের আওয়াজ। মুহূর্তে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো ছেলে গুলো। ক্রুর চোখে তাকাচ্ছিল আমার দিকে। নিলাদ্রী বললো--" সুমন। তুই যে এসেছিস কেউ জানে না তো?" 
আমি মাথা নেড়ে না বলতে ও বললো --" পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। তুই পালা। শোন, কলকাতা ফিরে যাসনা। তুই টার্গেটেড হয়ে গেছিস। শিলং চলে যা। কাদের ভাই কে আমার নাম করিস।" বলতে বলতে বন্দুকের আওয়াজ। চমকে তাকিয়ে দেখলাম, এদের হাতে উঠে এসেছে বন্দুক। দৌড়ে দৌড়ে গাছের আড়ালে চলে যাচ্ছে সব। আমি দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক দেখছি। নিলাদ্রী হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল ঘন জঙ্গলের দিকে। পুলিশের পক্ষ থেকে আত্মসমর্পণের ঘোষণা করা হচ্ছে বার বার। বুঝলি মেঘ, ওই সময় জঙ্গল ভেদ করে তীরের মতো দৌড়ে এলো রোগা কালো ছেলে। নিলাদ্রীর কানে কানে কি যেন বললো। শুনে স্তম্ভিত হবার সময় পর্যন্ত নেই। শুধু আমার কানে কানে বললো---" অংশুমান। তোর পেছন পেছন এসেছে। ট্রেনে বাসে সব জায়গায় তোকে টার্গেট করেছে, হয়তো অনেক আগে থেকেই করেছে, সুমন, ও জানে আমি তোকে ভালোবাসি, বিশ্বাস করি।" 
    বলে এক অদ্ভুত কাতর চোখে তাকালো আমার দিকে কুড়ি বছরের ছেলেটা। কি মনে পড়ছিলো তখন তার? খিচুড়ী ডিম ভাজা খেতে ভালোবাসতো, মা অন্ত প্রাণ ছিলো--প্রথম বুলেট পাঁজরা ভেদ করে চলে যায়, তারপর বুলেট আর বুলেট--রক্তে ভেসে যাওয়া শরীর থেকে শুধু এইটুকু বললো --" পালা সুমন। মেঘকে দেখিস।"

মেঘ, 
কেউ বাঁচেনি সেদিন। ওতো গুলো তাজা প্রাণ কেন চলে গেলো, কার কি লাভ হলো বা লোকসান আজো বুঝিনা।  কাদের ভাই আমাকে আশ্রয় দিয়েছিল। আমার নাম পুলিশের খাতায় তুলে দিয়ে অংশুমান , তোর কাছে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বললো কিভাবে আমার জন্য নিলাদ্রী মার্ডার হয়েছে। কলকাতা যাবার উপায় আমার ছিলো না জেনেও কলকাতা গেলাম। কাদের ভাই আর আমি মিলে অনেক চেষ্টা করলাম তোকে সব বোঝানোর। সময় কম। যে কোনো মুহূর্তে গন্ধ শুঁকে পুলিশ আসবে। অথচ তুই কেমন অনড় হয়ে রইলি! কি অদ্ভুত বিকৃত উচ্চারণে বললি---" বিয়ে ফিয়ে এমনিও করবো না। মা কে দেখতে হবে। তুমি যাও সুমন দা।" রাগে অভিমানে গরগর করতে লাগলো ভেতরটা। আরে , আমি যদি পুলিশের দালাল হবো, পুলিশ তবে খুঁজবে কেন আমাকে? তুই কি শোকে পাগল হয়ে গেছিলি? এরপর অংশুমান কে খুন করা ছাড়া আমার কি উপায় ছিল বল?
মেঘ,
প্রেমিকাকে কত কিছু দেয় প্রেমিক। শরীর দেয়, স্বপ্ন দেয়, বই, ফুল কত কিছু। সত্তরের দশকের প্রেমিক রা বোধহয় ব্যর্থতা ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি। অংশুমান কে খুন করে আমি একটু শান্তি পেয়েছিলাম। আমার অসহায় প্রেমিক মন টা ওই আতংক থেকে নিশ্চিন্ত হলো যে এবার তোকে কেউ ছুঁতে পারবে না। 

মেঘ,
শিলংয়ে বসে তোর সব খবর নেবার চেষ্টা করি।  বাবার ব্যবসা সামলানো, মা  বাবার মৃত্যূ, সব নিয়ে তুই এগিয়ে চলেছিস একলা। আসলে ভালোই হয়েছে জানিস। আমাদের বিয়ে হলে, পুলিশ ছিঁড়ে খেতো তোকে। তার চেয়ে এই ভালো। শিলংয়ে হয়ে গেল অনেক দিন। কাদের ভাই মারা গেলেন। তার ফ্যামিলির একজন হয়ে বেঁচে বর্তে আছি একরকম। সময় পেলেই লিখি কবিতা। 
মনে পড়ে তোর ভেজা চুল লেপ্টে থাকা সরল মুখটি। মনে পড়ে, দুটি নরম কোমল ঠোঁট। মনে পড়ে উড়ন্ত  সাদা কবুতরের মতো তোর বুকের খাঁজে কালো তিল। 
কতো বয়স তোর মেঘ?  ষোলো হয়েই রইলি চিরকাল। 

এ চিঠিতে কোনো ঠিকানা রইলনা।  আপনমনে ভেসে যাক পাহাড়ে পাহাড়ে। অথবা হয়তো দেবো ঠিকানা। হয়তো পৌঁছে যাবে তোর কাছে কোনো একদিন। তখন তোর কি মনে হবে মেঘ? ঠিক কি করবি তুই? কল্পনা করে এই শীতেও উষ্ণ হয়ে ওঠে বুকের ভিতর। কল্পনা করি তুই কি করিস একলা একলা? জানি বুড়ি হয়েছিস, তবু সেই সুগন্ধী চুল সেই দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বড়ো চোখে তাকানো, সেই মায়াময় স্বরে জিজ্ঞেস করা---" আর একটা লুচি নেবে সুমন দা?" 

মেঘ
প্রেমিক কখনো খুনী হতে পারে না। অংশুমানকে খুন কাদের ভাই ই করেছিলো। তবে পূর্ণ সমর্থন ছিলো আমার। সব হিসেব চুকিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার আগে ,মেঘ রে, মেঘ ---একবার দেখা হয়না রে? একবার ? মাত্র একবার?
      তিনমাস আছি পৃথিবীতে। স্বপ্ন দেখার জন্য যথেষ্ঠ সময় দিলেন ঈশ্বর। বুলেটে  ঝাঁঝরা হওয়া একাত্তরের স্বপ্ন কেমন দুঃসাহসী হয়ে উঠছে দ্যাখ মেঘ। কেজানে? চিঠির আগে আমি ই পৌঁছে যাই কিনা তোর কাছে? ভয় নেই বুড়ো বয়েসে লুচির বায়না করবো না, তবে একটা চুমু  ভিক্ষে চাইবো। তোর পায়ের পাতায় আমার সমস্ত চুম্বন গোলাপ হয়ে ঝরে পড়বে। 
         ইতি
           সুমন


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন