নীলভ্রমরের বিষাক্ত
ইতিকথা
শরৎকালের ঝলমলে আকাশে
দিব্যি পেঁজা তুলোর মতো মেঘ উড়ছিল ।কলকাতা থেকে আসতে আসতে মনটা বেশ ভালো হয়ে
গেছিল হিল্লোলের ।সারা বছর কলকাতার থাকতে হয়, শুধু দুর্গাপুজোর সময় গ্রামে আসতে
পারে ।এতদিন কলকাতায় থেকেও গ্রামের টান যায় নি হিল্লোলের, মিঠি প্রায়ই বলি
।সত্যিই গ্রামের টান যায় নি তার ।মিঠি নিজেও গ্রাম ভালোবাসে ।তাই প্রতিবার পুজোর
সময় গ্রামে আসার জন্য মুখিয়ে থাকে দু'জনেই ।
গ্রামে ঢোকার কিছুটা আগেই গাড়িটা গেল বিগড়ে ।অগত্যা মিঠিকে গাড়িতে বসতে বলে
মেকানিকের খোঁজে গেল হিল্লোল ।গাড়ি থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল মিঠি ।খানিকটা দূরে
একটা কুড়ে ঘর, বেশ ভাঙাচোরা ।শাশুড়ির মুখে শুনেছে, ওখানেই থাকে ডাইনি বুড়ি
।যদিও এই সময়ে এসব বিশ্বাসের কোনো মানেই হয় না ।তবু বিয়ে হয়ে থেকে এমনটাই শুনে
এসেছে ।কখনও দেখে নি তাকে ।আজ একা দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভীষণ কৌতুহল হচ্ছে ।যাবে কি
যাবে না ভাবতে ভাবতে শেষ অবধি পা বাড়ালো ওদিকেই ।
ঘরের চাল
অনেকটাই উড়ে গিয়েছে কোনো কালবৈশাখীতে, খাপরার বেড়াও নষ্ট হয়ে গেছে বৃষ্টির জলে
।ফাঁক দিয়ে ভেতরে চোখ রাখতেই আতঙ্কে মিঠির চোখ ঠিকরে বেড়িয়ে এল ।বুড়ির শরীর জুড়ে
থিকথিক করছে পোকা ।একটা চোখ কোনো বন্য জন্তু উপড়ে নিয়ে গেছে ।অথচ বুড়ি তখনও
বেঁচে, যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে ।
সপ্তমীর
সকাল.. মিঠি স্নান সেরে পুজোর মণ্ডপে এসেছে ।গত দুদিন ধরে শরীর খারাপ ।সেদিন হিল্লোল
অজ্ঞান অবস্থায় তাকে গাড়ির কাছে পেয়েছিল ।তারপর থেকে সেদিনের ওই দৃশ্যটা বারবার
ফিরে ফিরে আসছে, আর ভয়ে আঁতকে উঠছে সে ।অথচ কাউকে কিছু বলতে পারে নি ।অঞ্জলির জন্য
ফুল নিয়ে মা দুর্গার মুখের দিকে তাকাতেই আবার সেই বীভৎস মুখটা...... নানাআআআআ....
জ্ঞান ফিরতে শাশুড়ি
মার কাছে ভেঙে পড়ে মিঠি ।আর পারছে না গুমরে মরতে ।সব শুনে শাশুড়ি মা বকাবকি করতে
লাগলো মিঠিকে ।ওই ডাইনির বিষ নজরেই নাকি এমন হচ্ছে ।মিঠিকে বিশ্রাম নিতে বলে চলে
গেলেন তিনি ।অসুস্থ দুর্বল শরীরে কাঁদতে কাঁদতে কখন যেন ঘুমিয়ে গেল মিঠি ।
—"ডাইনি মরে না
কেন এখনও? "
—" এত নিষ্ঠুর
তুমি? "
—" হ্যাঁ হ্যাঁ
আমি নিষ্ঠুর।ভুলে যেও না আমার হিয়াকে ও মেরে ফেলেছে ।"
—"ওটা নিছক
দুর্ঘটনা ।"
—"না না তুমি জানো
না ।"
—"কি জানি না? যে
মানুষটা তোমার শূন্য কোল ভরাতে নিজের বুক থেকে তার সদ্যোজাত সন্তানকে তোমার কোলে
তুলে দেয়, সারা জীবন ডাইনি অপবাদ মাথা পেতে বয়ে চলে সেই মানুষটাকে জানতে আর কি
বাকি আছে?! "
খানিকক্ষণ সব চুপচাপ
।তারপর শাশুড়ি মার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে পাশের ঘর থেকে ।ততক্ষণে মিঠির কাছে
সবটুকু জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেছে শ্বশুর শাশুড়ির কথোপকথন থেকে ।
বিকেলের দিকে ডাইনির
মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে ।ডোমকে কিছু পয়সা দিয়ে বিদায় করে হিল্লোলের বাবা
।বাকি কাজ সেই সামলে নেবে ।মিঠি জানে কি অন্যায় হচ্ছে, তবু কিছু বলতে পারবে না
হিল্লোলকে ।মনে মনে শ্রদ্ধায় নুয়ে পড়ে ডাইনি মা-এর পা-এ ।
পরদিন সকালে অষ্টমীর
পুজোর জোগাড় চলছে ।নীলপদ্মের মালা গাঁথতে গাঁথতে আবারও মিঠির চোখে ভেসে ওঠে সেই
চোখ - কিন্তু আজ আর তার ভয় করে না ।হিল্লোলকে শহর থেকে ডাক্তারকাকু ফোন করে জানায়,
মিঠি কনসিভ করেছে ।সারা বাড়ি জুড়ে আনন্দের বন্যা বয়ে যায় ।মা স্বয়ং আসছেন মিঠির
কোল জুড়ে ।মিঠিও জানে, মা-ই নিশ্চিত ফিরে আসবে তার কোল জুড়ে ।
প্রচ্ছদ শিল্পী : সুদীপা কুন্ডু
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন