ভুতুর
নীতু
রামু দা টিফিনের
ঘন্টা পেটাতে না পেটাতেই প্রতিদিনকার মতো গোটা স্কুলের সব ঘরগুলো মোটামুটি ফাঁকা করে
বাচ্চারা যথারীতি মাঠের দিকে। মাঠ ভর্তি জল এখন,যদিও যতটা সম্ভব স্কুল কর্তৃপক্ষ ফি
বছর বর্ষায় মাঠের ঘাসপালা ছেটে ফেলে চারিদিক পরিস্কার রাখার চেষ্টা করেন!তবুও গত এক
সপ্তাহ ধরে যা বৃষ্টি শুরু হয়েছে,তা তে স্কুলের ক্লাসরুম থেকে শুরু করে মাস্টার মশাইদের
স্টাফরুমও পর্যন্ত জলে জলাকার। যদিও হেডস্যার বলেই দিয়েছেন অভিভাবকদের এই জল ভেঙে স্কুলে
না আসলেও চলবে, তবুও এই বাচ্চাগুলোর কাছে যেন এমন মাটি কাদা পথ,এগুলোই বড় আনন্দের।
জল কাদার ধপাধপ্,ছপাছপ্...নিজেরাই কাদা মাখছে পায়ের সাথে সাথে ফুটবলকে সঙ্গী করে।
রেল লাইনের এপারে
যত ছোট বড় ঝুপড়ি গুলো গজিয়ে উঠেছে মূলত সেসব ঘরের ছেলে মেয়েরাই আসে এই লক্ষণপুর নিম্ন
বুনিয়াদী স্কুলে পড়তে। পড়াশুনা যে একেবারেই হয় না সেখানে তেমনও নয়, মোটামুটি লক্ষণপুরের
আর দুটো সরকারী স্কুলের থেকে ভালোই।
_______উ উ উ গোল ! হিপ হিপ হু-র-র-র-রে ! বর্ষার এই দিনগুলোতে বাচ্চাদের বড় প্রিয়জন হয়ে ওঠেন
ওদের খেলার মাস্টার মশাই সুবল স্যার। মাস্টার মশাইও তেমন, বড় ভালো মনের মানুষ। অনেকখানি
এই বাচ্চাগুলোর মতো। প্রত্যকের খবর নেন আলাদা আলাদা করে। যদিও লক্ষণপুরের এই স্কুলের
সমস্ত শিক্ষকরাই খুবই আপনজন গ্রামের প্রতিটি
মানুষের কাছে,বিশেষ করে এই ছোট্ট ছোট্ট ছেলেদের কাছে।
____ কি রে সব, আজও তো আমাদের স্কুলের মারাদোনাকে দেখছি না এই বলটার
পিছনে ছুটতে ? ব্যাটার হলোটা কি,জানিস তোরা ?____সুবল স্যারের চোখ কাউকেই যে এড়িয়ে
যেতে পারে না। খোঁজ পড়বেই তাই,__ভুতু যা তো,দেখ তো গিয়ে মহাপুরুষ আবার কোথায় অন্তর্ধান
হলেন। যেখানেই পাবি ব্যাটাকে এক্কেবারে পাঁজা কোলে করে তুলে নিয়ে আসবি__স্কুলে এসেছে
জল কাদা ভেঙে, অথচ খেলার মাঠে নেই মারাদোনা, উঁহু, মতলব ঠিক ভালো ঠেকছে না মোটেই ।
নীতুর এমনই পরিচয়
স্কুলে, কেউ মারাদোনা, কোনো মাস্টার মশাই আবার মেসি আবার কোনো বন্ধু ওকে বাইচুং বলে
ডাকে। নীতুর বেশ ভালোই লাগে অবশ্য তাতে,বেশ একটা গর্ব গর্ব ভাব তৈরী হয় মনের মধ্যে
ওর। তাই বলে যে লেখাপড়াতে মোটেই মন নেই তার, তাও নয়, খুব ভালো ফল নাহলেও ভালোই ,বিশেষ
করে লেখার হাতটা বেশ ভালোই । ছবিও আঁকে মন্দ না। সেই তো সেবার যেদিন ওর ঠাকুরদার সাথে
এসে স্কুলে ভর্তি হয়ে গেলো,ওইটুকু একটা ছেলে,অথচ,কি সুন্দর একটা ভাবুক মনের পরিচয় রেখেছিলো
! বাড়িতে সাতকূলে যার কেউ কখনো পড়া তো দূরের কথা ইস্কুলেও যাইনি কোনোদিন। সেই থেকেই
সবার খুব প্রিয় এই মহাপুরুষ নীতু। বিশেষ করে ভুতু তো ওর শ্বাস-প্রশ্বাস। এক পাড়াতেই
থাকে ওরা।
হাতের টিফিন বাক্সখানা
টক্ টক্ শব্দ করে একবার খুলছে,আর একবার বন্ধ করে কী যেন চারিদিকে সব উঁকিঝুঁকি দিয়ে
দেখে চলছে একমনে ভতুর প্রাণের বন্ধু নীতু।যদিও স্কুলে মিড ডে মিলের ব্যবস্থা আছে,তবু,বাপ
মা মরা নাতিটার জন্য নুন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থা ঠাকমা দুটো খানেক মুড়ি নিজের হাতে
ভেজে নীতুর জন্য স্কুল ব্যাগটায় দিয়ে দেয়।__ হঠাৎ করে এভাবে ভুতুকে দেখেই যেন ওর সব ইচ্ছাই
পূর্ণ হয়ে গেলো, এমনই একটা হাবভাব নীতুর চোখেমুখে।
____নে পিঠে ব্যাগ
বাঁধ,চল, এক্ষুনি পালাই । নীতু বেশ খানিকটা রহস্যে রেখে ভুতুকে বললো।
__মানে ! কোথায় পালাবি
রে? সুবল স্যার মাঠে ডাকছেন তোকে। চল্ মাঠে চল্।__ভুতুর রাখা এসব কোনো বাক্যই কানে
গেলো না একগুঁয়ে প্রকৃতির নীতুর। বরং হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে,ইস্কুলের দক্ষিণ
দিকে যে ছোট্ট পাঁচিলটা আছে, সেটা অনায়াসে পেরিয়ে গেলো রোগা পাতলা ভুতুকে পিঠে চাপিয়ে।
স্কুলের এইদিকে
সচরাচর তেমন কেউ আসেন না। হেড স্যারের ঘরের ঠিক পিছন দিকে এই অংশটা। একটা মস্ত বড় বেলগাছ
আর কয়েকটা ফলের গাছ সহ পাখ পাখালিদের দুপুরের কিচিরমিচির ছাড়া কিছুই নেই এখানে। একটু
ভাবুক প্রকৃতির নীতুর তাই বড় আকর্ষণ ইস্কুলের এই অংশটায়। প্রথম যখন স্কুলে আসতে শুরু
করে, তখন থেকেই এই জায়গাটা তার খুব পছন্দের। টু তে পড়াকালীন তো একদিন তাকে গোটা স্কুলের
টাইমেই পাওয়া যাইনি। চারিদিকে খোঁজ খোঁজ, অথচ,রোল
কলের খাতায় জ্বলজ্বল করছে তার উপস্থিতির চিহ্ন। হঠাৎ ছুটি হওয়ার একটু আগে সবাই দেখে
চুপিচুপি নীতু বীর মুখখানা লুকিয়ে ক্লাসের পিছনের বেঞ্চে বসে আছে। পরে অঙ্কের স্যারের
ভয়ে পেট থেকে বেরিয়ে আসে বাবুর অন্তর্ধান রহস্য।
___এই নীতু বলনা
বাবা কোথায় যাচ্ছিস এভাবে ? ভয়ে ভুতুর মুখ ক্রমশ শুকিয়ে যেতে থাকলো ।
___আরে বাবা! এতো ভয় কিসের রে তোর? তুই না নীতু বীরের বন্ধু
! এইজন্যই তোকে ক্লাসে সবাই ক্যাবলা দাশু বলে ক্ষেপায়___হা হা হা হা করে হেসে উঠে নীতু
ভুতুকে আশ্বস্ত করলো। জানিস তো, ক্যানেলের
জল দেখতে যাবো,চল্ । সবাই বলছে এখন জল ছেড়েছে তো, তাই অনেক রকম মাছও নাকি উঠছে। এই
হলো গিয়ে তোর মাছ ধরার বর্শি, আর এই ছিপে লাগানোর সুতো। স্কুলের ধ্বংস বিধ্বস্ত চিহ্ন
যুক্ত ব্যাগটা থেকে স্বযত্নে বের করে ভুতুর হাতে ধরালো নীতু। আর ছিপ বানানোর দুটো কঞ্চি
রাস্তার ঝোপঝাড় থেকেই পেয়ে যাবোক্ষণ __নীতু বেশ উৎসাহ নিয়েই এক নিমেষে বলে গেলো। অবশ্য ভুতুর যে মোটেই ইচ্ছা ছিলো না এসব করার তাও নয়। __কাল রাতেই পাড়ার জলদাদুর কাছ থেকেই এনেছি
সবগুলো বুঝলি ভুতু হুনুমান__মুখে একগাল খোলা হাসি ছড়িয়ে দিয়ে নীতু মাছ ধরার চার বানানোর
জন্য বেশ কিছুটা আটার গুঁড়ো একটা ছোট্ট প্যাকেট থেকে বের করে ভুতুর হাতে দিলো ।
আজ ঠিক একমাস হলো, ভুতুটা যে কোথায় চলে গেল ? বেশ তো
সবাই মিলে মাছ ধরছিলো ক্যানেল পারে। এক টুকরো নরম মাটি,তার এতো ক্ষমতা ! ছুটে আসা জলের
কাছে ধরা দিতেই হবে তাকে ? পা ফসকে চোখের সামনে দিয়ে ভুতুকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল চিরদিনের
জন্য । না, কেউ খুঁজে আর পেল না তাকে,কেউ না।
ভেবেছিলো আর যাবে না নীতু ওই স্কুলে কোনোদিন, ভুতুকে ছেড়ে একা ওখানে থাকবে সে কিভাবে।
পাড়ায় কানাঘুষো আলোচনাতে সে বুঝেছে ভুতুর বাড়ির লোকেরা নীতুকেই দায়ী করছে এরজন্য। ঠাম্মাও
সেদিন কাজের বাড়ি থেকে ফিরে এমনটাই বলছিলো দাদুকে। অথচ, শুনলেই তো হতো সেদিন ভুতুর কথা। সুবল স্যারের
কথা। কি এমন ক্ষতি হতো ওকে নিয়ে না গেলে জল দেখতে ! ঠাম্মা কতবার বলেছে ওর থেকে একটু
সরে থাকতে, ওদের পয়সা আছে, কিছু না হলেও এই ছোট্ট ঝুপড়ির ভিতরে একটা নিজস্ব মুদিখানার
দোকান আছে ওর বাবার, বাপ মা মরা নীতুর দাদু ঠাকমার মতন তো লোকের বাড়ির এঁটো বাসন মেজে,
অন্যের রিক্সা টেনে পেট চলে না !
নীতু মন খারাপ করিস
না রে ভাই আমার। আমি তো জানি,এতে তোর কোনো দোষই নেই। আসলে আমিই একটু বেশি সামনের দিকে
ঝুঁকে পড়েছিলাম বড়শিতে গাঁথা মাছটা তুলতে গিয়ে। যা এখন খেলার মাঠে,স্কুলের ফুটবলটার
যে তোকে আজ ভীষণ প্রয়োজন । কতদিন যে বেচারা
তোর পায়ের লাথি খাইনি__ হা হা হা হা । আর যখনই তোর মন খারাপ করবে, দেখবি আমি ঠিক তোর
পাশেই থাকবো সব সময়।
গরীব বড়লোক বলে কিছুই
নেই রে ভাই, শুধু এই বন্ধুত্বটুকুই সবকিছু...
নীতুর কেন যেন মনে
হলো ভুতু ঠিক আগের মত চুপিচুপি এসে ওর পিঠে একটা দড়াম করে কিল মেরে নিমেষেই লুকিয়ে
গেলো কোথাও।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন