পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

শুভশ্রী সাহা, সিলভিয়া ঘোষ

প্রেমে অপ্রেমে 

  

কলিংবেলটা  বাজাতেই  সাউন্ড অফ মিউজিকের শব্দ ভেসে এলো  পার্থর কানে। মনে মনে ও বলে উঠল বাহ সত্যি দারুণ রুচি তো। এসব এলাকায় এমনটাই আশাকরা যায়। দরজা খুলতেই বের হয়ে এলো বছর সতেরোর শ্যাম বর্ণের একটি মেয়ে। ঠোঁট ফাঁক করে জিজ্ঞাসা করল 'কাকে চাই?' দোহারা চেহারার,  চোখে মুখে দারিদ্র্যতা থাকা সত্ত্বেও একটা বুদ্ধিদীপ্ত  ভঙ্গীমা কাজ করে। পার্থ গলাটা একটু ঝাড়া দিয়ে বলল ঃ  ' মিসেস দেব বাড়ি আছেন? আমাকে এই সময় আসতে বলা হয়েছিলো! ' মেয়েটি চোখের ইশারায় ভিতরে ঢুকে হাত দেখিয়ে সোফায় বসতে বলল।  নরম সোফায় বসার পর সেন্ট্রাল এসির ঠাণ্ডায় পার্থের চোখটা  একটু  লেগে এসেছিলো  প্রায়, তার মিনিট তিনেক পর মিস্টার দেব এসে বললেন 'হ্যালো ইয়ং ম্যান হাউ আর ইউ? আসলে তোমাকে ডেকেছি আমি, মিসেস দেবের জন্য।' পার্থ খুব মন দিয়ে মিস্টার দেবের কথা গুলো শুনছে। কেমন যেনো রাজা  রাজরার মতোন  চালচলন ভদ্র লোকের ।কথার মাঝেই পার্থ বলে ওঠে ঃ ' হ্যা, বলুন তো আসল অসুবিধাটা কি মিসেস দেবের!' 

প্রায় এক সপ্তাহ এ বাড়িতে আসছে পার্থ। এই চৈত্রের দুপুরে তেতে পুড়ে বাইক চালিয়ে কামালগাছি থেকে বালিগঞ্জ প্লেসের এই বাড়িতে আসতে জীবনটা বের হয়ে যাবার জোগাড়। আজকাল  এখানে এসেই মিনিট পাঁচেক বসে যতক্ষণ না পিউ (কাজের  মেয়েটি) এসে এক গ্লাস ঠাণ্ডা সরবত না দেয়। পিউ এর সাথে চোখাচোখি হতেই আজ কেমন যেনো  ও রহস্যের হাসি হসলো চোখ দিয়ে  সেটা খেয়াল করল পার্থ। সরবতটা শেষ করতে করতে ও ভাবলো গত পরশু ফিজিওথেরাপির জন্য না কি অন্য কিছুর জন্য  সর্বাঙ্গ প্যারালাইজড এবং আংশিক  জিভের আড়ষ্টতা নিয়ে মিসেস দেব যে কথাটা বলেছিলেন,  প্রথম তিনবার বুঝতেই পারেনি ও ,পরে অবশ্য ওনার  মুখের কাছে  মুখ নিয়ে শুনতে পেয়ে  পঞ্চাশোর্ধ  অসম্ভব সুন্দরী নারীর সামনে কান লাল হয়ে  দাঁড়িয়ে থেকেছে মিনিট পাঁচেক। পার্থর পঁচিশ  বছরের জীবনে অনেক অভিজ্ঞতাই জমেছে। 

পিজিতে ট্রেনিং নেবার সময় স্যর অজয় পণ্ডিত  বলেছিলেন,  'তোমাদের কাছে এমন অনেক  পেশেন্টই আসতে পারেন যারা সেক্সচুয়াল অ্যাটাচমেন্ট আশা করেন বা বলতে পারো তাই চান। তখন কিভাবে তাকে হ্যান্ডেল করবে তাও জানতে হবে তোমাদের। এটাও শিক্ষার একটা অঙ্গ।' বছর বিশেক এক অঙ্গ প্যারালাইজড মিসেস  ঋক্তা দেবের  চেহারার গ্ল্যামার দেখে পার্থ ফিদা। তবুও ওমন প্রস্তাবে কেমন যেনো গুঁটিয়ে নিয়েছে দু দিন। 

শরীরের চাহিদা বড় অসহায় করে তোলে মানুষ কে। পার্থর জীবনে কী তার প্রভাব কম!  বছর পনেরো আগের কথা মনেহয়  পার্থর। মাঝ রাতে ছোটক্কু কে দেখতে পেয়েছিল বড় মামনির ঘরে যেতে,তখন মামনির বয়স প্রায় ৫৫। জ্যা এর সাথে  মামনির কোনদিন তেমন অন্তরঙ্গ মুহূর্ত  পার্থর মনে নেই। জ্যা মারা গেলেন তাও বছর দশেক হবে। আর ছোটক্কু ম্যানেনজাইটিস এ মারা  গেলো বছর চারেক আগে,  ওর  মুখাগ্নি  পার্থকেই করতে হলো, গত বছর মামনি মারা যেতে মা বলল 'এখানেও মুখাগ্নি  তোকেই করতে হবে ধরা পরতে হবিষ্যান্ন রান্না করে খেতে হবে বড়দার সাথে।' বড়দা কথা বলেনা তেমন পার্থের সাথে, যবে থেকে ছোটক্কু তার ভাগের সম্পত্তি পার্থের নামে দিয়ে গেছে...  
আজ পার্থ প্রস্তুত হয়ে এসেছে দরকারে যা যা করণীয় তাই তাই করবে...  শুধু  শুধু  লোভ সম্ভরণ করে কী লাভ! 

দরজা দিয়ে ঢুকতেই পরিচিত রুম ফ্রেশনারের গন্ধ নাকে এল পার্থর, বিশাল বেডরুম এর মাঝখানের একদম রোজউড কালারের খাট। এ ঘরের সব কিছুই ভিক্টোরিয়ান স্টাইল এর আগেই দেখেছে সে ,হয়ত মিসেস দেব কিছুটা পুরোনো দিনকে যেন মনে রাখতে চান। সম্বিত ফিরতেই পার্থ দেখল মিসেস দেব তার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে, চোখের কোণে কিছু কি চিকচিক করছে!! দূর এমন সেক্সি আইজ এ যৌনতার আমন্ত্রণ ছাড়া আর কিই বা হতে পারে... 

অস্থির লাগছে পার্থর নিজের, অসহ্য ছটফটানি ।কেউ জানবে না  বলে  মিস্টার দেব কথা দিয়েছেন, কিন্তু তার বিবেক আছে তো, তৃণা কে কি বলতে  পারবে সে কোনদিন  একথা !! তৃণা লড়াকু মেয়ে, মরালিষ্ট সে কখনো মেনে নেবে না। কিন্তু পার্থর এখন টাকার দরকার...নিজের পায়ে তাকে দাঁড়াতেই হবে,  যতই ছোটক্কুর দেওয়া  পয়সা কড়ি থাকুক না কেন , তৃণা নিজের পায়ে  না দাঁড়ালে  বিয়ে তো দূরের কথা বাড়িতেও জানাবে না বলেছে!! ওর মনে এখন দোলাচল, পজেটিভ নেগেটিভ কারেন্ট! সে বুঝতে পারছে, প্রতিটি মুহূর্ত সে শকড...

ক্রমে গোঙানির শব্দ বেড়ে যাচ্ছে, মিসেস দেব কি যেন বলতে চাইছেন, পার্থ এগিয়ে আসতেই যে দিক টি একটু সবল হয়েছে সেই হাত দিয়ে নিজের বুকটাকে স্পর্শ করাতে  চাইছেন যেন, ঈঙ্গিত টা স্পষ্ট।  পার্থ কেঁপে উঠল-- পাতলা নাইটির ভেতর দিয়ে করমচার মত লাল স্তন টি সুস্পষ্ট তার বৃন্ত আর সেটি উদ্ধত, পার্থ র সেদিকে চোখ পড়তেই নিজেকে শক্ত অনুভব করল সে-- একি হচ্ছে এমন তো সে চায় নি-- গরীবের ছেলে সৎভাবে রোজগার করতে চেয়েছিল। মিসেস দেব ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন,  উত্তেজনা তার জন্যে একদম নিষেধ...পার্থ ছুটে গেল কাত হয়ে যাওয়া মাথা বালিশে তুলেদিল। ঋক্তা তাকে আঁকড়ে ধরে কি যেন বলতে চাইল -- গোঙানিটা হঠাৎ আস্তে হয়ে যেতেই মনে হল সে যেন শুনল জয়'-- চমকে উঠল সে, এবার ঋক্তার দিকে তাকাতেই দেখল হ্যাঁ তিনি কাঁদছেন -- হাঁপাচ্ছেন পালস বিট বেড়ে গেছে অনেক বেশি।ছুটে গিয়ে বন্ধ দরজায় ধাক্কা দিতেই মিস্টার দেব নিজেই বাইরে থেকে খুলে দিলেন।
ভেতরে ঢুকে নিজেই গিয়ে মিসেস দেবের হাত ধরলেন আর বলতে লাগলেন, ঋক্তা,  ঋক্তা স্থির হও-- আমি বলছি, আমি বলছি ওকে....
ঘরের আলমারীর ড্রয়ার খুলে একখানি বাক্স নিয়ে এলেন, হাতির দাঁতের কাজ করা। তার মধ্যে থেকে একটি সাদা কালো ছবি বার করে সোজা করে ধরতেই পার্থ চমকে উঠল। তার ছবির মতন লাগছে। সে জানে এই ছবি জয়প্রভ বসুর-- তার  ছোটক্কুর...

মিস্টার অশিন দেব তার পর তাকে এক গল্প শুনিয়েছিলেন-- সিনেমার মত হলেও তার জীবনের চরম বাস্তব। জয়প্রভ আর ঋক্তার কলেজ জীবন থেকেই ভালোবাসা, জয়প্রভ আর্ট কলেজের কৃতি ছাত্র হলেও খ্যাপা আধ পাগলা, খ্যাপামী দিয়ে তো জীবন চলে না, আর আজ থেকে বত্রিশ বছর আগে আর্টে পেট ও চলত না। চা বাগানের মালিক দেবদত্ত রায় মানেন নি, আর জয়প্রভ যেন আগে থেকেই হেরে বসে ছিল। বিয়ে হল ধনীর পুত্র সুবিখ্যাত ব্যবসায়ী দেব পরিবারের ছেলে অশিনের সাথে। অশিন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে ফেলেছিল ঋক্তাকে, ঋক্তা পারেনি একদিন ও। বেড়াতে গিয়ে লোকে জানত দুর্ঘটনা কিন্তু আসলে , ঋক্তা পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে মরতে চেয়েছিল, কোনক্রমে পয়সার জোরে প্রান বাঁচলেও তার সাড় চলে যায় চিরতরে।  স্বামীকে তিনি বিয়ের রাতেই বলে দিয়ে মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন-- অশিন চেষ্টা করব ভেবে নিয়ে জেদ ধরে ছিলেন, ঋক্তা নিজে মুক্ত হতে চেয়ে বন্দী হয়ে গেলেন বিছানায়-- তার একটাই আবদার ছিল স্বামীর কাছে 'জয়প্রভ' -- একটি বার আসবেন তার বুকে মাথা রাখবেন। অনেক চেষ্টা চরিত্র করে অশিন ঠিকানা জোগাড় করে জানতে পারেন জয়প্রভ মৃত। ঋক্তাকে বলতে পারেন নি। বদলে পার্থ কে এনে দিলেন ঋক্তার কাছে। পার্থ র চেহারার সাথে প্রচুর মিল জয়প্রভর। নতুবা পার্থর মতন অল্প বয়েসী ফিজিওথেরাপিস্ট  তারা নেবেন কেন!!

পার্থ চুপ হয়ে গেল হঠাৎ। মিস্টার দেবের সামনে দিয়ে উঠে গিয়ে জড়তা হীন ভাবে আলতো করে বালিশ থেকে মাথা ঊঠিয়ে নিয়ে জড়িয়ে ধরলেন ঋক্তাকে-- আজ যেন চোখের সামনে  ভেসে উঠল তার  জন্মদাত্রী মায়ের  মৃত্যু শয্যার চেহারাটা । পরিষ্কার গলায় ডাকলো-- মামনি--
কুল ছাপিয়ে জল কি এমন ই ভাবে আসে!! ঋক্তা বত্রিশ বছরে এমন ডুকরে কেঁদে উঠলেন প্রথম। নির্বাক দুটি পুরুষের সামনে। পার্থ জোড়হাত করল মিস্টার অশিন দেব কে।  "আর কোন দিন ডাকলে আসতে পারব না কিন্তু, মামনি কে দেখবেন" এই কথা বলে -- পার্থ বেরিয়ে এসেছিল...
 ছমাস বাদে তাদের কামালগাছির বাড়িতে চিঠি এসেছিল ঋক্তার মৃত্যু সংবাদের।যাবার আগে,  বেশ কিছু টাকা আর পাইক পাড়ার একটি বাড়ী তার পুত্র সম পার্থ বসুর নামে উইল করে দিয়ে যান।পার্থ বসু এখন পাইক পাড়ায়,' ঋক্তা ফাউন্ডেশন এ নিয়মিত চেম্বার করেন।'

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন