আত্মীয়
.
শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে আদ্যন্ত শহুরে রাহুল বোস চলল গ্রামের স্কুলে চাকরি করতে । ডাক্তার মা-বাবার একমাত্র সন্তান সুশিক্ষিত , সুদর্শন ও স্মার্ট রাহুল বোসের গ্রাম সম্পর্কে কোনও ঘৃণা বা নাকউঁচু ভাব কোনোদিনই ছিলনা । বরং হোস্টেলে থেকে পড়ার সময় গ্রামের ছেলেদের সরলতা রাহুলকে বেশ আকর্ষণ করত ।
তালডুংরী রাধানাথ মেমোরিয়াল হাইস্কুলের ইংরেজীর শিক্ষক রাহুল বোস নয় নয় করে ছ'মাস এই গ্রামে কাটিয়ে ফেলল। প্রথম কটা দিন হোস্টেলে কাটানোর পর রাহুলের আশ্রয় হয় গ্রামেরই মোড়ল, স্কুলের সেক্রেটারি অবিনাশ সেনের বাড়িতে। অবিনাশবাবুকে বেশ আকর্ষণ করেছিল সুদর্শন, সুশিক্ষিত রাহুলের ব্যবহার । যা তিনি কোনদিন করেননি, সাত পাঁচ না ভেবে রাহুলকে একেবারে অন্দরমহলে ঠাঁই দিয়েছিলেন । অন্য কোনো বাসনাও ছিলনা । কারণ দুই কন্যা সন্তানের পিতা অবিনাশের বড়টির বিয়ে হয়েছে বছর পাঁচেক আগেই । দুই পুত্রসন্তানের জননী শরৎশশী এখন পাকা গৃহিণী । আর কনিষ্ঠা কন্যা বিন্দুবাসিনী পূর্বেই বাগদত্তা । এই গ্রামেরই সম্পন্ন ব্যবসায়ী অবিনাশের বাল্যবন্ধু মণীন্দ্রনাথের একমাত্র পুত্র সুকুমার অবিনাশের ভাবি কনিষ্ঠ জামাতা । আগামী মাসের ১১ তারিখ বিবাহের তারিখ ঠিক করা আছে ।
আজ তালডুংরীর প্রাক্তন জমিদার অবিনাশ সেনের বাড়িতে সাজো সাজো রব । বিন্দুবাসিনীর বিবাহ উপলক্ষ্যে অতিথি আপ্যায়নের সমস্ত দায়িত্ব রাহুলের হাতে সঁপে দিয়ে অবিনাশ নিশ্চিন্ত । অবিনাশ কন্যা সম্প্রদানের জন্যে প্রস্তুত । আর ওদিকে বিন্দু পাড়ার অন্যান্য এয়োতি ও তার বান্ধবীদের নিয়ে সাজসজ্জায় ব্যস্ত । বর আসার সময় হয়ে এল প্রায় । অবিনাশ ঘরণী বরণের জন্য প্রস্তুত । এমনসময় মণীন্দ্রনাথের বাড়ীর চাকর দৌড়াতে দৌড়াতে এসে অবিনাশকে বললে " বাবু , বাবু সর্বনাশ হয়েছে ...." ॥
এখন আর দাঁড়ানোর সময় নেই । শিগগির গাড়ি বের কর , ওকে নিয়ে এখুনি সদরে ছুটতে হবে । শরৎশশীর ছোটপুত্র চন্দ্রদ্যুতি বিয়েবাড়িতে হুড়োহুড়ি করতে গিয়ে সিঁড়ি থেকে পড়ে গেছে । রক্ত ভেসে যাচ্ছে পাঁচবছরের ছোট্ট জ্ঞানহীন শরীরটা । দুই নাতি অবিনাশবাবুর প্রাণ । মেয়ের বিয়ে , অতিথি আপ্যায়ন , কন্যাদান সবকিছু ভুলে নাতির শরীরটা বুকে জড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসেন । সদরে পৌঁছাতেও দুঘন্টা লাগবে । শিশুটা বাঁচবে তো ? আনন্দের হাটে মুহুর্তে শোকের বাতাবরণ ।
অবিনাশ - পত্নী শোক সামলেও বধূবেশী ছোট মেয়ের কথাও ভুলতে পারেন না । উনি তো চলে গেলেন , এখন কন্যাদান কে করবে ? বংশে তো অবিনাশবাবু একা । আর আত্মীয়স্বজন তো বেশির ভাগ ই ওনার সঙ্গে সদরে গেছেন । মেয়েটা কি তবে লগ্নভ্রষ্টা হবে ? মা - মেয়ে দুজন দুজনকে জড়িয়ে কান্নাতে ভেসে যাচ্ছে । তখনি ঘরে ঢোকে রাহুল । ঠাকুরমশাই বলছেন এবার বিয়ে শুরু করতে হবে ।
বিয়ে তো হবে কন্যাদান কে করবে ?
মাসিমা আমি শুধু আপনাদের অতিথি, এখনো আপন হতে পারিনি। শুধু রক্তের সম্পর্ক থাকলেই বুঝি আত্মীয় হওয়া যায়, আত্মার বন্ধন বুঝি কিছু না ? কেন আমি কি বিন্দুর দাদা হয়ে ওকে সম্প্রদান করতে পারি না ?
রাহুলের এতবড় আন্তরিকতার কাছে কোন যুক্তিতর্কে না গিয়ে অবিনাশ পত্নী বিয়ে শুরু করতে বলেন ।
বিয়ের সমস্ত কাজ শেষে নবদম্পতি প্রণাম করে রাহুলকে । সুকুমারের হাত দুটো ধরে রাহুলের মিনতি, আমার ছোট বোনটাকে তোমায় দিলাম , ওকে ভালো রেখো। আমি একটু সদর থেকে আসি, এখনও কোন খবর তো পেলাম না ।
ধুতিটা ছেড়ে কোনরকমে জামা - প্যান্ট পড়ে বাইকটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সদর হাসপাতালের দিকে । অবিনাশবাবুর পাশে দাঁড়ালে উনি একটু মনের জোর তো পাবেন ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন