পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০১৮

মলয় রায়চৌধুরী

হৃৎপিণ্ডের সমুদ্রযাত্রা : রবীন্দ্রনাথের দাদুর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ও দেবেন্দ্রনাথের সমালোচনা  

মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস
        হৃৎপিণ্ড : আর কতো দূর হুলি ?
        আমি : আরও চার মাস, রাজকুমার ।

        আমি, হুলি গন্ধবণিক, রাজকুমারের ভৃত্য, আমার সমস্যা হলো যে, মাথায় চুলের জঙ্গলে ভাববার কুয়াশা গড়ার দরকার হয় না, মুখ খুললেই নর্দমার পাঁকের তোড়ের মতন কথা ওগরাতে থাকি, গাঁয়ের নর্দমা নয়, সুতানুটি-গোবিন্দপুরের  বর্ষাকালের আধকাঁচা নর্দমা, যে নর্দমায় জোব চার্নক দাঁড়িয়ে হিসি করে গেছেন, লর্ড হবার আগে পোঁদপোঁছা টয়লেট-কাগজ ফেলে গেছেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাহি লুটেরা রবার্ট ক্লাইভ, চার্লস স্টুয়ার্ট যাকে আমরা বলতুম হিন্দু স্টুয়ার্ট যিনি প্রতিদিন গঙ্গাস্নান করতেন আর নিজের হিন্দু বউকে পাল্কিতে বসিয়ে নিজের সঙ্গে স্নান করাতে নিয়ে যেতেন,  ব্রিটিশ আমল থেকে জেরা করার মতন করে বকবক, বর্ষা ফুরোলেই কথা বন্ধ, পচা গন্ধের সঙ্গে আমোদে ফুলতে থাকে, এখন, কয়েকশো বছর পরে, বাতিল প্লাসটিকের থলে, নেতাদের হাসিমুখের পোস্টার আর কন্ডোমে জ্যাম ।
         আমার কথা বলতে হলে বলতে হয় যে, গ্রামসমাজ, ধর্ম আর গোষ্ঠীজীবন কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠ লোক, যাঁদের মতামত আদ্যিকালে সমাজের সব স্তরে প্রভাবী ছিল, সেই লোকগুলোর পরের প্রজন্মকে দেয়া একপ্রস্হ আচার আচরণকে  ঐতিহ্য আর পরম্পরা বলে মেনে নিতে খটকা লাগে ; সেসব আজ উপড়ে ফেলে দেয়া হয়েছে, আর তার জায়গায় এসেছে কারখানার পাতিমার্কা জীবন, সেই সঙ্গে জটিল আমলাবাজির বাড়বাড়ন্ত, নিয়মকানুন, হ্যান কোরো না, ত্যান কোরো না, ওখানে ঢুকতে পারবে না, সেখানে অনুমতি নিয়ে যেতে হবে । তাহলেই বুঝুন ।
         আইডেনটিটি কার্ড হাতে, দরোজার বাইরে দাঁড়িয়ে বিচি চুলকোন ।
         যাকগে যাক,  এখন রাজকুমারের ব্যাপারটাই বলি ; পরে অন্য ।
         আমি একজন রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড, ক্লিপার জাহাজে করে সুতানুটি-গোবিন্দপুরে, রাজকুমারের নিজের বাড়িতে ফিরছি, তাঁর ছেলেদের জিম্মায় হৃৎপিণ্ড বা হৃৎখণ্ডখানা হিল্লে করে আমার ছাড়ান, ওনাদের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তি , এর আগে আফ্রিকার পোঁদের তলা দিয়ে ফিরতে হতো, সেই যে-জলরাস্তায় ভাস্কো ডাগামা এসেছিল, আর তার পেছু-পেছু পর্তুগিজ জলদস্যুর দলবল, ওরা অবশ্য আলু, বাঁধাকপি, ফুলকপি, টোমাটো এনেছিল, তার আগে আমরা সেসব খেতুম না, রাজকুমারের বাড়ির লোকজনও খেতো না, জাত যাবার আঁৎকানির দরুন, রাজকুমার নিজে কিচ্ছু মানতেন না, বলতেন ওরা সময়-অন্ধ, নিজের সময়কে চিনতে পারছে না, বাইরের জগতের বদলে নিজেদের মাথার পাঁকে সাঁতরায় ।
         রাজকুমার ছিলেন আত্মগর্বী, বেপরোয়া, রুচিবাগীশ, কড়া-মেজাজের, বেয়াদপি করলে চাবকাতে কুন্ঠিত হতেন না, আয়েশি, ধবধবে ফর্সা, আদেশ না শুনলে বরখাস্ত করতেন, টাকা রোজগারের আর খরচ করার ঘাঁতঘোঁত খুঁজতেন, অন্নসত্র খুলে কাঙালিভোজন করাতেন, যোয়ান বয়সে খড়াদার গোঁসাইয়ের শিষ্য ছিলেন, পেঁয়াজও ছুঁতেন না,  কিন্তু ‘চৈতন্য মঙ্গল’ পড়া সুতানুটি-গোবিন্দপুরের বামুনরা ওনাকে ঠ্যাটা করার পর উনি বললেন, আচ্ছা দাঁড়া তোদের দেখাচ্ছি, আমি তোদের চেয়ে কতো বড়ো হই, কতো উঁচু হই, সেই যে উনি পালটে গেলেন, তারপর ওনার উন্নতি শুধু মরণই থামাতে পেরেছে । রাজকুমারের ভেতরে যে একজন সম্রাট রাজত্ব করছে, তা উনি বামুনদের খেলো-করা কথা শোনার পরই টের পেলেন ।
         ওনার বংশে কেউই ওনার মতন  শ্বেতাম্বর টাইকুন হতে পারেননি, দিগম্বর হয়ে গেছেন ।
         রাজকুমার বলতেন, বাঙালিরা এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে যে, যেকোনো নতুন ধারণাকেই মনে করে বিপজ্জনক, যেকোনো নতুন আবিষ্কার দেখলেই ভাবে আবার সেই খেটে মরতে হবে, সমাজে এগিয়ে যাবার নতুন পদক্ষেপকে মনে করে বুঝি বিদ্রোহ করে ফেলছে, তাই যখানে বসে আছে সেখাইনেই পাথরের মতন বসে থাকতে চায় ।
         রাজকুমারের বড়ো ছেলে ঠাকুর-দেবতা দেখতে পান না, ওনার ঠাকুর-দেবতা নাকি নিরাকার, যেমন মোচরমানদের হয়, বলেছিলেন আমায় রাজকুমার ।
         এই সমুদ্রযাত্রা  আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের, শান্তি আর অশান্তির জগাখিচুড়িতে ডুবে অদ্ভুত আনন্দ গড়ে ফেলতে পেরেছি, রাজকুমারের জন্য, চোখ বুজলেই আকাশে প্রায় কুড়িটা পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে পাই ।
        আমার প্রতিটি জন্মে থেকে গেছে এই নাতিশীতোষ্ণ বোধ, থেকে গেছে সমুদ্রে দেখা উড়ন্ত মাছেদের নোনা হাওয়া, ঢেউদের ওপরে ফেনার গান ।        
        সেইন্ট মার্টিন দ্বীপের একজন হাবশিকে, সে বলতে গেলে বাঙ্গাল হয়ে গেছে, পর্তুগিজরা আফ্রিকার সিমলোপা প্রদেশ থেকে আরও অনেক ছেলে-ছোকরার সঙ্গে ওকে জাল ফেলে চুরি করে এনেছিল, যাতে যুদ্ধে কাজে লাগাতে পারে, তা সে যাদের সঙ্গেই যুদ্ধ হোক না কেন, রণে বনে জঙ্গলে, রাজকুমার পর্তুগিজদের মোটা টাকা দিয়ে হাবশিটাকে ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন, এখন ব্যাটা নিজের দেশে ফিরতে চায় না, গিয়ে করবেটাই বা কী, নিজের ভাষাও তো ভুলে গেছে । সমুদ্রপথে আঁকশি দিয়ে, ও দুটো উড়ুক্কু মাছ ধরে লোহার চৌবাচ্চায় ঢাকা দিয়ে রেখেছে, এই জাহাজে, মাংসের টুকরো খেতে দেয়, শুকনো মাংস, উটের, ভেড়ার, হলুদ আর লঙ্কাগুড়ো মাখানো, যাতে পচে না যায়, জাহাজের খালাসি ক্যাপ্টেন সকলেই ওই মাংস খায় ।
         হাবশিটা আমার দেখাশোনা করে, আমি তো চাকর, ও হলো চাকরের ভৃত্য । সেইন্ট মার্টিন দ্বীপ এখন বাংলাদেশে । রাজকুমারের সময়ে বাংলাদেশ ছিল না, অখণ্ড বঙ্গদেশ ছিল, সেখানে ওনার জমিদারি ছিল, সে অনেক জমিজমা ছিল, মোচোরমানরা ভেন্ন হয়ে যেতে চাইলো, তাই আলাদা হয়ে গেছে, তারপর নিজেদের মধ্যে কচুকাটা খুনোখুনি করে আলাদারও আলাদা হয়ে গেছে, এখন সেই আলাদার আলাদার মধ্যেও আলাদা হবার মারিকাটারি চলছে, আদালত চত্বর থেকে গ্রিক দেবীর মূর্তি হাপিশ করে দিয়েছে, নেড়ে সালাফিস্টদের যা তে মন ভরে।  
        সুতানুটি-গোবিন্দপুরের এখনকার লোকেরা বলে যে ওরা আলাদা হয়ে ভালোই করেছে, নয়তো ছেচল্লিশের খুনোখুনি  বজায় থাকতো, এখন নিজেরা লড়ে মরছে, সে-ই ভালো ।
        রাজকুমার চোগা-চাপকান পরতে ভালোবাসতেন, কাঁধে কাশ্মিরি কাজ করা শাল, নাগরা জুতোয় মুক্ত বসানো, সবই বিলেতে ছেড়ে আসতে হয়েছে, ওনার সুইটহার্টরা কেউ-না-কেউ হাতিয়ে নিয়ে থাকবেন । এখন যাকে অ্যাটিচিউড বলে, ওনার চাল-চলন থেকে তা গর্বের গুঁড়ো হয়ে ঝরে-ঝরে পড়তো, হাওয়ায় উড়তো ওনার জ্যোতি ।
        ক্লিপার জাহাজ মানে তিন মাস্তুলের জাহাজ, সবকটা মাস্তুলে চারচৌকো নস্যি রঙের ছোটো-ছোটো পাল,  সবচেয়ে উঁচু মাস্তুল মায়িস, দ্বিতীয়টা ফোরমাস্ট, তৃতীয় মেজ্জিন ; দুবার বিলেত যাওয়া আর দুবার আসায় ক্লিপার জাহাজের অনেক ব্যাপার জেনে ফেলেছি ।
         আমি পেয়েছি চারচৌকো কেবিন, কাঠের মেঝেয় নীল রঙের কার্পেট, বার্নিশ-করা সেগুনকাঠের দেয়াল, ল্যামিনেশানে চকচকে, রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড নিয়ে যাচ্ছি বলে আমার দেখাশোনার জন্যে হাবশিটা রয়েছে, সে আফ্রিকার মোচোরমান ছোঁড়া, কিন্তু বাঙ্গাল হয়ে গেছে, না ও আমার ঘটি ভাষা বোঝে আর না আমি ওর বাঙ্গাল ভাষা বুঝি । সঙ্গে ঢিলা কুলুপ আনেনি, সমুদ্রের নোনতা জল ব্যবহার করে-করে নুনুতে নুনের পলি জমে হেজে যেতে বসেছে, নোনতা জল মানে যে জলে উড়ুক্কু মাছ দুটো পুষেছে, ফিদিন বদলাতে হয়, ক্যাপ্টেন বলেছে খাবার জল ব্যবহার করতে পারবে না । সুতানুটি-গোবিন্দপুর না পৌঁছানো অব্দি বেচারার অঙ্গখানা আস্ত থাকলে হয় ;  নুনুর খোসা ছাড়ানোয় যেমন সুবিধে আছে, তেমন অসুবিধেও আছে।
         রাজকুমারের এক মেয়ে আর পাঁচ ছেলে , ওনাদের পরিবারে বছর বছর বিয়োবার রীতি,  তা সত্বেও উনি বেশি ছেলেমেয়ে পয়দা করতে পারেননি কেননা ওনার বউ, ব্রাহ্মণ পুরুতদের পরামর্শে, ওনাকে ছুঁলে সাতবার পাল্কিসুদ্দু গঙ্গায় চান করতেন, তখন অবশ্য গঙ্গা এরকম গুয়ে গোবরে পাঁকে নর্দমার-কারখানার  জলে দুর্গাকালীর মূর্তি-ভাসানো খড়ে কালোকেলটে হয়ে যায়নি, মাদি ইলিশরা দুরছাই করে বর্মায় বিয়োতে পালায় নি, শুশুকরা এই নদীতে যাতে না সেঁদোতে হয় তার প্রতিজ্ঞা করেনি, দলদাসদের খুন করা মুন্ডুহীন ধড় ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় গাইতে-গাইতে ভাসতো না।
         ওনার বউ ছিলেন গোঁড়াবামুন- বাড়ির মেয়ে, বরের দেহের  চেয়ে বেশি গঙ্গার জলকে পবিত্র মনে করতেন ।
         রাজকুমার বলতেন, যারা গোঁড়া তারা অজানার চেয়ে পরিচিতকে পছন্দ করে, যা পরখ করা নয় তার চেয়ে বেশি পছন্দ করে যা আগে থাকতে পরখ করা, রহস্যের চেয়ে ঘটনাকে পছন্দ করে, সম্ভাব্যের চেয়ে যথাযথকে পছন্দ করে, অসীমের চেয়ে সীমিতকে পছন্দ করে, দূরের চেয়ে কাছেরকে পছন্দ করে, প্রাচুর্যের তুলনায় যা যথেষ্ট তাকে পছন্দ করে, নিখুঁতের হবার চেষ্টার চেয়ে যা সুবিধাজনক তাকে পেতে চায় ।
        একটা উড়ুক্কুমাছ লাফিয়ে উঠে বললে, গুড স্পিচ ।
         রাজকুমারকে  বিদেশিনী বন্ধুনিরা এতো চাইতো যে বউয়ের দরকার পড়তো না, নিজের চোক্ষে দেখা, কানে শোনা । আমার মাঝে-মাঝে সন্দেহ হয় যে কোনো বিদেশিনী বন্ধুনি ওনার টাকাকড়ি মণিমুক্তো চুরি করে ওনাকে মেরে ফেলার তাল করেছিল, তাই অতো কম বয়সে হঠাৎ মারা গিয়েছিলেন । তখনও ওনার কতো কাজ বাকি ।
         চাকর তো, তাই হলফ করতে পারি না, নইলে তাও করতুম আপনাদের খাতিরে ।
         যতোদূর মনে পড়ে, আমি আমার গত চার জন্মের কথা পুরোটা মনে রাখতে পেরেছি, গ্রীষ্মের কী-গরম কী-গরম ঘামে গলগল খরার গাঁয়ের ছমছমে রাত ( অক্ষাংশ ২২.৩৪ উত্তর, দ্রাঘিমাংশ ৮৮.২৪ পূর্ব ) ।
         হেমন্তের ফুরফুরে হাওয়ার সোনালি বিকেল ( অক্ষাংশ ২৫.৬ উত্তর, দ্রাঘিমাংশ ৮৫.৭ পূর্ব ) ।
         শীতের হিহি ঠাণ্ডা  লালশালুর দুপুর ( অক্ষাংশ ২৫.৩৬ উত্তর, দ্রাঘিমাংশ ৮৩.১৩ পূর্ব ) ।
         বর্ষার ঝমাজঝম বরফের সুপুরি বৃষ্টির সকাল ( অক্ষাংশ ১৯.০১ উত্তর, দ্রাঘিমাংশ ৭৩.০১ পূর্ব )।            বিশ্বাস না হলে লাহোরে আকবরের ফারসিতে খাকের কলমকারি নথি , ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা রানি ভিক্টোরোয়ার গেজেট আর দুই বাংলার ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, দুইরকম বাংলায় ছাপানো খবরের কাগজ দেখতে পারেন ; প্রতিবারই আমার নাম হুলি রেখেছেন আমার নিজের বাবা-মা বা অন্যের বাবা-মা, আমার চোখ কটা বলে তিনবার আর একবার আকাশ কালো করে নিম্নচাপের হুলোরাঙা মেঘ জমেছিল, তাই ।
         তার আগের জন্মগুলোর ঘটনা একটু-আধটু কখনও সখনও মনে পড়ে বটে, তবে গোলমাল হয়ে যায় যে তা ছয় বারের জন্মে ঘটেছিল নাকি দশ বারের,  নাকি অন্য কোনো, তবে হুলি নামটা পালটায়নি, বড়ো জাতে জন্মালে পদবি পালটেছে, ছোটো জাতে জন্মালে পদবির দরকার হয়নি ।
         রাজকুমার, মানে  ছয় ফুটের গৌররাঙা যে মানুষটার কথা থেকে-থেকে মনে পড়ছে, যিনি মেমদের কোমরে হাত রেখে সুইটহার্ট বলতেন, যদিও  সুইটহার্ট বলতে যে ঠিক কী বোঝায় তা আজও জানি না, মিষ্টি হৃদয় মানেই কি মিষ্টি মেয়ে, ভেতরে নোনতা বাইরে মিষ্টি কিংবা ভেতরে নোনতা বাইরে নোনতা হলেও তো তাকে চাওয়া যায়, নয় কি ?   
         সেই রাজকুমারের, যাঁর গোলাপি প্রজাপতির ডানার মতন কাঁপতে-থাকা  হৃৎপিণ্ডও বিশ্বাস করতে চাইছেন না যে, ওনার সঙ্গে কথাবাত্রার আগেও আমি জন্মেছিলুম, উনি যে ভাবছেন হুলি নামটা ওনার দেয়া,  তাও ভুল।
         রাজকুমার ঠাকুর ঘরে গরদের ধুতি কাঁধে সিল্কের চাদর দিয়ে দেবী-দেবতার এতো পুজোআচ্চা করতেন, অথচ বিশ্বাস করতে পারলেন না যে আমি এর আগেও জন্মেছি, হিন্দু যখন, তখন বার বার জন্মাবার সুযোগটা নেবো না কেন ! অ্যাঁ ?  শীতেও খালি গায়ে পুজো করতেন উনি ।
         এই জন্মটা না হয় শুদ্দুর হয়ে জন্মেছি, আগের জন্মে তো ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য হয়ে জন্মেছিলুম।    মনুস্মৃতির প্রোটোকলটা যে কোন খাতে বয়, তা ঠাহর করতে মাথা ডগমগ করে, বামুনের মধ্যেও এতো রকমের বামুন কেন, উনি রাঢ়ীশ্রেণির বামুন, অন্য বামুনগুলো বোধহয় আড়িশ্রেণি, ঘড়িশ্রেণি, বড়িশ্রেণি, নুড়িশ্রেণি, চুড়িশ্রেণি । নাহ, সংসারত্যাগী বামুন, দীক্ষা বিলোবার বামুন, গেরস্ত বামুন, জজমানি বামুন, মন্দিরের পুজুরি বামুন, ছেরাদ্দের বামুন, ব্রাত্য বামুন যারা পৈতে ফেলে দিয়েছে, বর্ণহীন বামুন যে জাতিপ্রথা মানে না । তাহলে বামুনদের মধ্যেও উঁচু জাত-নীচু জাত আছে, অ্যাঁ ।
        বাঙালিদের মধ্যে ক্ষত্রিয়  আর বৈশ্য নেই কেন, যার জন্যে আমাকে দুবার অবাঙালি হয়ে জন্মাতে হয়েছিল, শুদ্দুরদের মধ্যেও এতো ভাগাভাগি কেন, ওফ কতো রকমের শুদ্দুর যে হয় তা শুদ্দুররাই বলতে পারে না, কামার কুমোর ছুতার স্যাকরা লোহার মালি মালো তাঁতি তেলি জেলে চাষি, তারা তো কৌরব পক্ষে ছিল, তবে ক্ষত্রিয় নয় কেন !
       পাটনার আফিমকুঠীর এক আফিমচাষীর বিধবাকে বিয়ে করেছিল জোব চার্ণক, চাষীরা তো তখন শুদ্দুর ছিল না !
       পৌণ্ড্রক্ষত্রিয়, উগ্রক্ষত্রিয় বাঙালিরা সব গেলো কোথায় ? তারা তো ক্ষত্রিয় ছিল !
       নেপালের লুম্বিনীর  গৌতমও রাজকুমার ছিলেন, তিনিই যখন এই প্রোটোকল নষ্ট করতে পারলেন না, গাছের তলায় বসে বুদ্ধ হয়ে গেলেন, তখন যে-রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড আমি ফরম্যালিনের শরবতে চুবিয়ে সুতানুটি-গোবিন্দপুর ফিরছি, তিনি কীই বা করতে পারতেন ।
         কলকাতায় লুম্বিনী পার্ক নামে একটা পাগলামি সারাবার হাসপাতাল আছে যেখানে ঋত্বিক ঘটক, বিনয় মজুমদার, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আর আমি ছিলুম দিনকতকের জন্যে, বিজলির ছোবল মেরে-মেরেও  কোনো সুরাহা হয়নি।
         পুরুষের পাগলামি সারে না, সে যদি রাজকুমার হয়ে জন্মায়, তাহলেও ।
         হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না টু-পিস সাঁতারের পোশাকে বিদেশিনীদের ।
         তুই ভাবছিস দেখিনি, আমি চিরটকাল ভবিষ্যৎ দেখতে পেয়েছি ।
         হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগীতায় জিতে ফেরা ভারতীয় নিকোল ফারিয়া, দিয়া মির্জা, সুস্মিতা সেন, ঐশ্বর্য রায়, প্রিয়াঙ্কা চোপড়া, লারা দত্ত, যুক্তা মুখি, ডায়না হেডেনকে।
         তুই ভাবছিস জানতে পারিনি, আমি সবই আগাম জানতে পারি রে ।
         হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না সুচিত্রা সেনকে ; সুচিত্রা সেনও দেখে যেতে পারলেন না রাজকুমারকে ।
         আমরা দুজনে দুজনকে দেখেছি, তুই জানিস না ।
         রাজকুমারের হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে আমার কথাবাত্রা হয়েছিল ১৮৪৬ সালে, যখন কিনা আজ এটা ২০১৭ সাল, ১৪২৪ বঙ্গাব্দ, সেই সময় থেকে বয়সের হিসাব ধরলে এখন আমার বয়স  ১৭১ বছর, দাড়ি-চুল-গোঁফে চিরুনি পড়েনি বহুকাল, যশোর থেকে পালিয়ে আসার সময়ে আনা হয়নি, মেহেদি লাগিয়ে বাদামি জটাজুট হই, আর ভালো না লাগলে ন্যাড়া হয়ে যাই ।
         জাহাজের কেবিনে বসে কথা বলার সময়ে টের পাচ্ছিলুম যে দুঃখে-দুঃখে আমার গলার ভেতরে চার-পাঁচটা কাক ঢুকে বসে আছে ।
         এই ১৭১ বছরেও, চাকরদের হেড হরিখুড়ো যে গাঁয়ে থাকে, সেখানে এই ব্যাপারগুলো এখনও পালটায়নি : ১) শ্রাদ্ধ আর বিয়ের ভোজে বামুনদের আগে খাওয়ানো হয়, সব শেষে শুদ্দুরদের ; ২) নিচুজাতের মানুষকে খেতে দেবার জন্যে উঁচু জাতের বাড়িতে কাপ-গেলাস এমন অচ্ছুত করে রাখা থাকে যেন সেগুলো হাতবোমা ; ৩) গাজন বা শিবের অন্য পুজো্য নিচুজাতের কাউকে সন্ন্যাসী সাজতে দেয়া হয় না ; ৪) উঁচুজাতের বউ-মেয়েরা নিচুজাতের বউমেয়েদের ছুঁতে চায় না, এড়িয়ে যায় ; ৫) একজন পৈতেধারী বামুনের বারো বছরের ছেলেকে নিচুজাতের সত্তর বছরের বুড়ো পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ চায় ; ৬ ) অনেক গ্রামে জাত অনুযায়ী পাড়া ভাগ করা আছে ; ৭ ) গরিব পুজারী আর পিণ্ডদানকারী বামুনকে অন্য বামুনরা নিচু নজরে দ্যাখে ; ৮) উঁচুজাতের রান্নাঘর, শোবারঘর আর ঠাকুরঘরে নিচুজাতের লোকেদের ঢুকতে দেয়া হয় না ; ৯ ) নীচুজাতের মানুষকে যে থালায় খেতে দেয়া হয় তা উঁচুজাতের বাড়ির বউরা ধুতে চায় না, কাজের লোককে দিয়ে ধোয়ায় আর যদি কাজের লোক না থাকে তাহলে বাড়ির পুরুষরা ধুয়ে দ্যায় ; ১০ ) মোচোরমানদের জন্যে বাসন-কোসন আলাদা।
         হরিখুড়োর গাঁয়ে মোচরমানদের মধ্যেও উঁচু জাত নীচু জাত আছে, তাদের মধ্যে বিয়ে হয় না । সুন্নি মুসলমান আর শিয়া মুসলমান আছে, তাদের মধ্যে বিয়ে হয় না ।
        আমি বিয়েথা করিনি, রাজকুমারের দেখাশুনা কে করবে আমি যদি সংসারি হয়ে যাই !
         ১৭৫৬ সালে সিরাজ উদ দৌলা যখন কলকাতা আক্রমণ করেছিলেন, তখন আমি দু’পক্ষের লড়াইয়ের মাঝে পড়ে খুন হয়ে গিসলুম, তারপর গোবিন্দপুরের জঙ্গলে এক গর্ভবতী বাঘিনী আমাকে খেয়ে ফেলেছিল, যখন ওর বাচ্চা হলো, সেই সঙ্গে আমিও সুন্দরবনে জন্মেছিলুম, বাঘ হয়ে নয়, মানুষ হয়েই, বাঘিনী আমাকে অন্য রকমের দেখতে বলে খুবই আদর করতো, আমার সারা শরীর চাটতো আর আমার কাতুকুতু লাগতো।         বাঘিনীর পেটের ভেতরে আরও বেশ কয়েকজন মানুষ ছিল, তারা বললে, না, না, পেছন দিক দিয়ে জন্মাতে পারব না, বাঘিনী হজম করে আমাদের বদবুদার ন্যাড়ে প্রসব করে দিক সেও-ভি-আচ্ছা, আমাদের দাবি মানতেই হবে, আমরা সামনে দিক থেকে জন্মাতে চাই, ফলে সেই মানুষগুলো আর জন্মাতে পারলো না, সুন্দরীগাছের গোড়ায় বাঘিনীর গু হয়ে অমর হয়ে গেল ।
         ভাটার সময়ে সুন্দরীগাছের আকাশমুখো শেকড়ের মাঝে ন্যাড় হয়ে যাওয়া মানুষরা দেখা দিতো যখন, তারা চেঁচাতো সর্বহারা হওয়া ভালো, গরিব হওয়া ভালো, উদ্বাস্তু হওয়া ভালো, জবরদখল করা ভালো, ইংরেজি না শেখা ভালো ; এই সমস্ত কথা আউড়ে তারা অমর হতে চাইলে ।
        যে লোকটা এইসব স্লোগানের নেতা ছিল, সে নিজের মরিচঝাঁপি নামে উদ্বাস্তুদের দ্বীপকে চারিদিক থেকে ঘিরে গুলি চালিয়ে বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে লাশগুলোকে সমুদ্রে ফেলার হুকুম দিয়ে বিলেতে গরমকাল কাটাতে হার সিঙ্গল মল্ট খেতে চলে গিয়েছিল ।
         মানুষ যতোদিন বেঁচে থাকে, অমর হতে চায়, তা সে গু হয়েই হোক, কিংবা নিরাকার গোল্লা  হয়েই হোক।
         বাঘিনীর কাছ থেকেই আমি কাঁচা মাংস খেতে শিখেছিলুম, জন্তু আর মানুষ মেরে খেয়ে ফেলতুম, পরে শুনেছি যে বাঘিনীর  ছেলেপুলেরা এইশাল ওইশাল হ্যানশাল ত্যানশাল নাম নিয়ে মানুষ মারতো আর খেয়ে ফেলতো, লুকিয়ে ঘুরে বেড়াতো আর যাদের জমিজমা আছে তাদের জবাই করতো, ওদের দেখাদেখি সেপাই সান্ত্রিরাও   ঝাঁটছাল বালছাল আঁড়ছাল গাঁড়ছাল সেজে মানুষ খাওয়া আরম্ভ করেছিল, কিন্তু সেসময়ে আমি আরেকবার জন্মাইনি, দুই জন্মের মাঝে আরাম করছিলুম । ওদের কারোর গায়েই আমার মতন বাঘের চামড়ার ডোরা দাগ ছিল না, যে কজনের গায়ে চিতাবাঘের ফুটকি ছিল তারা শীতকালেও পুকুরে কুয়োয় কলতলায় নদীতে চান করে ধুয়ে ধুয়ে ফুটকির দাগ চামড়া থেকে মুছে ফেলতে পেরেছিল, মুছে ফেলে বলেছিল এইশাল ওইশাল হ্যানশাল ত্যানশাল চিতাবাঘদের দাগগুলো ছিল পদ্ধতিগত ভুল, এগুলোকে বাঘের ডোরার মান্যতা দেয়া যায় না ।
        ওরা কিন্তু অমর হতে পারেনি, ওদের নাম-সাকিনও কেউ মনে রাখেনি ; যে গেছে সে গেছে ; যা গেছে তা গেছে । ওদের যারা হালুমখোর বানালে, আর যারা হাপিশতোড় শেখালে, সেই , চারু এম, জ্যোতি বি, সিদ্ধার্থ আর,  আজ অমর, হাসি মুখ, ছবি হয়ে, ভক্তদের চুনওঠা দেয়ালে, দরমার বেড়ায়, চ্যাঁচারির কুঁড়েঘরে এই যে হেথায় কুঞ্জছায়ায় স্বপ্নমধুর গাইছেন ।
         আমি তো যতোদূর জানি ভুল মানে ভুল, তা সে পদ্ধতিগত হোক বা দিবঙ্গতবা সদগতিগত হোক ।
         বাঘিনীর পেছন দিক দিয়ে জন্মেছিলুম বলেই তো আমি এককালে ঠগীদলের সর্দার হতে পেরেছিলুম ; কমিউনিস্ট দলের সর্দার হবো তাও ভেবেছিলুম, কিন্তু বার বার জন্মাবার ফলে এমন ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলুম যে আর আগ্রহ  হয়নি । ততোদিনে কমিউনিজমও ক্লান্ত, ভোদকা টেনে ইয়েল্তসিন নামে এক মাতাল কামান দেগে উড়িয়ে দিলে হাজার হাজার লোকের জোর করে দেখানো স্বপ্ন ।
        আসলে কমিউনিজম হোক বা অন্য কোনো ইজম, সব ইজমই একসময়ে ক্লান্ত হয়ে যায়, তত্বতে গাঁটে-গাঁটে আরথ্রাইটিস হয়ে যায় । পুঁজির হলকা ভেতরে ভেতরে ফোঁপরা করে ফ্যালে সবকটা ইজমকে ।
         চীন দেশে কমিউনিজম ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছিল, তাই ওরা নতুন উপায় বার করলে, বললে সর্বহারা হওয়া ভালো নয়, গরিব হওয়া ভালো নয়, উদ্বাস্তু হওয়া ভালো নয়, ন্যাড়ের জীবন ভালো নয়, যে করেই হোক ইংরেজি শিখতেই হবে , ব্যাস, ওরা এখন সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাধর দেশ, ওদের চেপ্টা নাক প্রতি বছর একটু-একটু করে উঁচু হয়ে চলেছে। ওরা সব রকমের মাংস খায়, যেকোনো প্রাণী হলেই হলো, ঘাস থেকে ফড়িং তুলে খেতে ভালোবাসে, তেঁতুলে বিছের বড়া খেতে ভালোবাসে, রাস্তার ধারে কাঠিতে গিঁথে সাপের ফুলুরি বিক্রি করে । যখন মনোজ বসুর সঙ্গে চীনে গিয়েছিলুম, তখন খেয়েছি ।
        যারা চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান হাঁকতো, তারা বাঙালির গাঁ-গেরাম-গঞ্জ-শহর থেকে উধাও । চীনও সেই চেয়ারম্যানকে উধাও করে দিয়েছে ।
        এই যে গোরু-মোষের মাংস খাই, তার কোনো শাস্ত্রগত ভুল নেই, কিন্তু হিন্দিওয়ালারা, যারা শাকাহারি, মানে শাক দিয়ে ঢেকে টাকা খায়, টাক পড়ে গেছে বলে টিকি ঝরে গেছে, টিনের ত্রিশূলকে মনে করে সমাজ পালটানোর তত্ব, ভাবে, তাদের যা শেখানো হয়েছে তা-ই তো তারা ভাববে,  মনে করে, গোরু-মোষ খেলে নরকে যাবে।
         কী বোকামি বলুন ! আরে আমি তো হিন্দু, বার বার জন্মাই, জন্মাবো, জন্মেছি, সেখানে নরকে যাওয়া স্বর্গে যাওয়ার গোলমাল আসছে কোথ্থেকে শুনি, অ্যাঁ !
        মহাভারত বইয়ের, মহাভারত তো আমাদের ইতিহাস, কী না, অ্যাঁ, ব্যাসদেবজীর লেখা, তা ওই ইতিহাসের অনুশাসন পর্বে পাণ্ডবদের ক্যাবলা বড়ো ভাই যুধিষ্ঠিরকে ভীষ্ম বলেছিলেন শ্রাদ্ধে যাদের নেমন্তন্‌ করা হয়েছে তাদের যেন গোরুর মাংস ভালো করে রেঁধে খাওয়ানো হয়, তাহলে পূর্বপুরুষরা স্বর্গসুখ পাবেন ।
         বিরাট রাজা তো পুরো একটা খাটাল খুলেছিলেন টেস্টি-টেস্টি গোরু পোষার জন্য, এখনকার দিন হলে অবশ্য সেগুলো পাচার হয়ে যেতো আর গৌরাক্ষসরা পাচারকারীদের আড়ং ধোলাই দিয়ে তক্তা করে মাটিতে মিশিয়ে দিতো ।
         আরেকটা ইতিহাস, যেটা বাল্মীকিজি লিখেছিলেন, তাতে আছে যে বনবাসের পথে রাম-সীতা-লক্ষ্মণ যখন ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে পৌঁছেছিলেন, তখন ভরদ্বাজ সন্ন্যাসি ওনাদের মধুপর্ক, বৃষমাংস আর ফলমূল দিয়ে লাঞ্চ করিয়েছিলেন । বাল্মীকিজি শুদ্দুর ছিলেন শুনেছি, নারদের আশীর্বাদে ব্রাহ্মণ হয়ে গিসলেন ।
          চাণক্যর কথা তো জানেন, যাঁর সমান আই কিউ সেই সময়ে কোনো পণ্ডিতের ছিল না, উনি অর্থশাস্ত্র বইতে লিখে রেখে গেছেন যে রাখালরা মাংসের জন্য ছাপ দেয়া গোরুর মাংস কাঁচা কিংবা শুকিয়ে বিক্রি করতে পারে । ছাপ দেয়া মানে এখন যাকে বলে আধারকার্ড ।
         তারপর চরক, ওই যিনি ডাক্তার ছিলেন, উনি ওনার সংহিতায় লিখে গেছেন যে গোরুর মাংস খেলে বাত, নাক-ফোলা, জ্বর, শুকনোকাশি, রোগা হয়ে যাওয়া, পেট গরম সারে । চরক কিন্তু সত্যিকারের ডাক্তার, দেড়-দুকোটি টাকা দিয়ে এমবিবিএস আর এমডি হতে হয়নি ।
        ব্যাপারটা আমি জানি, তার কারণ বাবর আর ইব্রাহিম লোদি দুটো পার্টিকেই পানিপতের যুদ্ধের সময়ে আমি মাংস নুন তেল কাঠকয়লা সাপলাই দিতুম । সেই জন্মে আমার নামছিল হুলিকাঞ্চন গুপ্তা, বেনের বাড়ি জন্মেছিলুম, বাপ-ঠাকুর্দা আগে থাকতেই ব্যবসার ঘাঁতঘোঁত জানতো, সিংহাসনে যে পার্টিই বসুক না কেন, মাল তাকে তো বেচবেই, তার শত্তুরকেও বেচবে । শত্তুরকে একটু বেশি দামে খারাপ মাল বেচবে, যাতে যে সিংহাসনে বসে আছে, সে চটে না যায় । বেনে বলে আমরা ছিলুম শাকাহারি, দইয়ের রায়তা দিয়ে পুদিনার পরোটা খেতুম, কিন্তু ব্যবসা তো যেকোনো জিনিস নিয়ে করা যায়, কেনবার পার্টি হলেই হলো ; এই যে আজকাল বুদ্ধি ছড়ানোর এতো বই বিক্রি হচ্ছে, তাও তো ব্যবসা, মুকখুরা তো কিনছে ঝাঁপিয়ে পড়ে ।
         বাবর এসেছিল বাইরে থেকে, নাক চেপটা, দাড়িতে চারটে চুল, গোঁফে দুটো করে, সেই চেঙ্গিজ খানের বংশধর, যার তত্ব ছিল ধরো আর মারো, মেয়েদের লোটো আর তুলে নিয়ে যাও, বাড়িঘর পুড়িয়ে পাবলিকদের ভাগাও । সেই  টেকনিক রপ্ত করে তিনি আজ অমর, ওনার স্টেনলেস স্টিলের বিরাট মূর্তি বসেছে মোঙ্গোলিয়ার ফাঁকা মরুভূমিতে, সেই চেঙ্গিজ খান, তার কোনো এক প্রজন্ম ছিল বাবর, চেঙ্গিজ খানের একশো আটাত্তরটা বউ ছিল, বাবর নিশ্চয়ই কোনো তাগড়া বউয়ের নসল থেকে জন্মেছিল ।
         আসবার আগে বাবর এদেশের কিছুই জানতো না, শুধু তরমুজ খাওয়া জানতো । তবে বাবর লোকটা দিন নেই দুপুর নেই রাত নেই সন্ধে নেই লড়ে লড়ে যুদ্ধু  বিশেষজ্ঞ হয়ে গিয়েছিল, সেই তখনকার দিনে, মানে ১৫২৬ সালে, মোটে পনেরো হাজার সেনা নিয়ে সুলতান ইব্রাহিম লোদির চল্লিশ হাজার সেনাকে গুহারান হারিয়ে দিলে,  তার কারণ বাবরের ছিল কামান বন্দুক আর ঘোড়সওয়ার, যখন কিনা ইব্রাহিম লোদির এক হাজার হাতি বাবরের কামানের গোলায় ক্ষেপে গিয়ে নিজের সেনাদেরই পায়ে পিষে মেরে ফেললে, তাছাড়া সুলতানের সেনায় অনেক হিঁদু ছিল যারা মাংস খেতে চাইলে না, তাদের জন্যে ফলমূল চালডাল সাপলাই দিতে হয়েছিল, তারা বোধহয় ভেবেছিল নেড়ের সঙ্গে নেড়ে লড়ে মরুক, আমাদের তাতে কি, এক নেড়ে গিয়ে আরেক নেড়ে আসবে, অবস্হা যে কে সেই ।
         বাবরের পার্টি অনেক দূর দেশ থেকে এসেছিল বলে ওদের শুকনো মাংস খাইয়ে চালিয়ে দিয়েছিলুম, শুকনো মাংসই ওরা পছন্দ করতো, সঙ্গে কাঁচা মাংস নিয়ে তো আর যুদ্ধুর মাঠে যাওয়া যায় না । সেনারা তো সবাই নেড়ে, মাংস পেয়ে বাবর কতো যে সোনাদানা দিয়েছিল, বাড়িতে মাটির তলায় পুঁতে রাখতে হয়েছিল । এই যে শেষ পর্যন্ত বাবর জিতে গেল, তা তো আমাদের সাপলাই দেয়া শুকনো মাংসের জোরে, নয়তো ভারতে মোগল সাম্রাজ্য হতেই পারতো না । সিংহাসনে হাঁটু মুড়ে বসেও বাবর শুকনো মাংসের দোপেয়াজা রিজালা খেতে চাইতো, এক পিস তরুমুজ খেয়ে এক কামড় রিজালা, তখন জোরে ঢেঁকুর তোলা আর পাদায় ছিল সম্রাটদের একচ্ছত্র অধিকার ।
       একটা উড়ুক্কুমাছ লাফিয়ে উঠে বলল, গুড স্পিচ ।
       বাবরের ছেলেও রাজকুমার, বড্ডো রোগে ভুগতো, সাত মাসের মাথায় পয়দা হয়েছিল, হুমায়ুন, সেও বেশি দিন সিংহাসনে টিকলো না, আটচল্লিশ বছর বয়সে ওই যাকে বলে ইন্তেকাল, তাই করলো, যখন কিনা বাবর পশ্চিম দিকে মুখ করে নিজের জীবনের বদলে ছেলেকে বাঁচিয়ে রাখতে বলেছিল । পরে একজন কাব্যলিখিয়ের সুবিধে হল বাবরের পশ্চিমমুখো দোয়া চাইবার ব্যাপারটা নিয়ে ; না, বাবরের ভাষায় নয়, সুতানুটি-গোবিন্দপুরের ভাষায় ।
        হুমায়ুন বড্ডো আফিম খেতো, নেশার ঘোরে সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে ইন্তেকাল করেছিল, তার দোষ আমার বাপ-ঠাকুর্দার ওপর এসে পড়েছিল, ভালো জাতের আফিম সাপলাই করার জন্য, আমরা তো ওনার দরবারের সকলকেই, যারা আফিম ভালোবাসতো, তাদের বিশুদ্ধ আফিম সাপলাই দিতুম । তারপর থেকে বিশুদ্ধ জিনিস বিক্রি বন্ধ করে সবেতেই ভেজাল মেশাতে হয় ।
         হুমায়ুনের পরে যে সিংহাসনে বসল, সে সত্যিই কচি খোকা রাজকুমার, আকবর । উনিও যুদ্ধু করতে ভালোবাসতেন, আমারাও শুকনো মাংস সাপলাই করতে ভালোবাসতুম ।
        আমি যে রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড নিয়ে সুতানুটি-গোবিন্দপুরে ফিরছি, সেই রাজকুমারের বাপ-ঠাকুর্দা চালাক-চতুর লোক ছিলেন, সিরাজের দলকে সমর্থন করেননি ; বিলেতের সায়েবদের পক্ষে ছিলেন, যেমন ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র, যাকে সায়েবরা রাজা করে দিলে, রাজা নয় মহারাজা, আলিবর্দি খাঁ তাকে জেলে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, খাজনা দিতে পারেননি বলে, কিন্তু লোকটা ঘোড়েল, যেদিকে হাওয়া বয় সেই দিকে মুখের তত্বে বিশ্বাস করতেন ।   
         অন্য দেশে জামশেদজি টাটা, ঘনশ্যামদাস বিড়লা, ধিরুভাই আমবানি, আজিম প্রেমজি, নারায়ণ কৃষ্ণমূর্তি, রাহুল বাজাজ, ওয়ালচাঁদ হীরাচাঁদ, পালোনজি মিস্ত্রি, ইন্দু জৈন, কস্তুরভাই লালভাই, জামশেতজি জিজিভয়, টি ভি সুন্দরম আইয়ার, নবীন জিন্দল, অজিত গুলাবচাঁদ, আনন্দ মহেন্দ্র, অজয় পিরামল, আরদেশির গোদরেজ, বি এল মুঞ্জল, জি আর গোপীনাথ, কিরণ মজুমদার শা, এল আর কিরলোসকর, শিব নাদার, ভেনুগোপাল ধুতদের মতন ধনী পাঁয়তাড়া-বিশেষজ্ঞ জন্মেছেন , অথচ রাজকুমারের পর,  আমার এই-ওই জন্মে আমাদের দেশে কেউই অমন হতে পারল না ।
       রাজকুমার বিশ্বাস করতেন ইউরোপীয় বৌদ্ধিক প্রগতিতে, সময়ের সামাজিক প্রগতিতে, যুক্তিবাদী বিচার বিবেচনা আর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সাহায্যে পাওয়া মুক্তিতে, ইতিহাসের এমন এক গতিতে যার গড়াগ্গড়  রাস্তা হলো মানব কল্যাণমুখী । গোঁড়া হিন্দু বাঙালির মামদোবাজি থেকে সমাজকে ছাড়িয়ে এনে আরও তাড়াতাড়ি বাঙালির জীবনে যুক্তি আর বিচারবুদ্ধির ভূমিকাকে গূরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন উনি, কিন্তু সেই জন্যে সকলেই ওনাকে ইউরোপের নকলনবীশ বলে দুষতে লাগলো । বিলেতে গিয়ে ইউরোপীয়দের এমন তারিফ করলেন যে সে খবর পেয়ে সুতানুটি-গোবিন্দপুরের হিন্দু নেতারা খাপ্পা ।
       রাজকুমার কি কখনও বিষাদে ভুগেছেন ? নাহ, কক্ষোনো নয় ।
       হ্যাম, টেণ্ডারলয়েন, ফিলেটো, কোপা, বোস্টন বাট, হকস, চপস, রিবটিপ, জোল, বেকন, স্পাটা, টেস্টা কিংবা সালামির সঙ্গে দুপেগ  সিঙ্গল মল্টে বিষাদ ছাক্কাস।
       হায়, কম বয়সেই মারা গেলেন রাজকুমার ।
       রাজকুমার পড়ে যেতে পারলেন না ওনার জগৎবিখ্যাত নাতির এই লেখা, ‘সুবিচারের অধিকার’ শিরোনামে নাতি লিখেছিলেন, “মুসলমান ভ্রাতাদের প্রতি ইংরেজের স্তনে যদি ক্ষীরসঞ্চার হইয়া থাকে তবে তাহা আনন্দের বিষয়, কিন্তু ‘আমাদের’ প্রতি যদি কেবলই পিত্তসঞ্চার হইতে থাকে তাবে সে আনন্দ অকপটভাবে রক্ষা করা কঠিন হইয়া উঠে।”
       রাজকুমার পড়ে যেতে পারলেন না ওনার জগৎবিখ্যাত নাতির এই লেখা, ‘স্বামী শ্রদ্ধানন্দ’ শিরোনামে নাতি লিখেছিলেন, “অতএব যদি মুসলমান মারে আর ‘আমরা’ পড়ে পড়ে মার খাই -- তবে জানব, এ সম্ভব করেছে শুধু ‘আমাদের’ দুর্বলতা । আপনার জন্যেও, প্রতিবেশীর জন্যেও, ‘আমাদের’ নিজেদের দুর্বলতা দূর করতে হবে । ‘আমরা’ প্রতিবেশীদের কাছে আপিল করতে পারি, ‘তোমরা’ ক্রুর হোয়ো না, ‘তোমরা’ ভালো হও, নরহত্যার উপরে কোনো ধর্মের ভিত্তি হতে পারে না -- কিন্তু সে আপিল যে দুর্বলের কান্না।”
       হায়, রাজকুমার পড়ে যেতে পারলেন না, সতেরো বছর বয়সে লেখা ‘দেবদাস’ উপন্যাসের লেখকের জ্ঞানবাক্যি, যা নিয়ে কতোবার যে সিনেমা হয়েছে কতো ভারতীয় ভাষায়, দেবদাস সেজেছে ফণী শর্মা, প্রমথেশ বড়ুয়া, কে এল সায়গল, নাগেশ্বরা রাও, দিলিপ কুমার, হাবিব তালাশ, ঘাট্টামামেবি কৃষ্ণ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বুলবুল আহমেদ, ভেনু নাগাভাল্লি, প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জি, শাহরুখ খান, অভয় দেওল, নাদিম শাহ, শাকিব খান, রাহুল ভাট, সেই   লেখকের ‘বর্তমান হিন্দু-মুসলমান সমস্যা’ শিরোনামে এই মতামত, “হিন্দুস্তান হিন্দুর দেশ । সুতরাং এ-দেশকে অধীনতার শৃঙ্খল হইতে মুক্ত করিবার দায়িত্ব একা হিন্দুরই । মুসলমান মুখ ফিরাইয়া আছে তুরস্ক ও আরবের দিকে, -- এ দেশে তাহার চিত্ত নাই । যাহা নাই তাহার জন্য আক্ষেপ করিয়াই বা লাভ কি, এবং তাহাদের বিমুখ কর্ণের পিছু পিছু ভারতের জলবায়ু ও খানিকটা মাটির দোহাই পাড়িয়াই বা কি হইবে । আজ এই কথাটাই বুঝিবার প্রয়োজন হইয়াছে যে এ কাজ শুধু হিন্দুর, --- আর কাহারও নয় ।”
       হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না তাঁর প্রপৌত্রের আঁকা ভারতমাতা ।
       তুই কী করে জানলি দেখিনি ? আমি তো আগাম দাঙ্গাও দেখে ফেলেছি ।
       হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না তাঁর ছেলের অতিবামুন কাল্টের নিরাকার পরমব্রহ্ম কেমন করে ছবি আঁকার পৌত্তলিকতায় পৌঁছে গিয়েছিল ।

       তুই জানিস না, আমি তখনই জানতুম, কোথাকার ঠাকুর-দেবতা কোথায় পৌঁছোবে ।


ক্রমশ

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন