বই এবং পড়া
কবে থেকে যে বই এর উপর উপুড় হয়ে বসে জগত ভুলতে শিখেছি মনে নেই। মা বলতে পারবেন হয়ত। ছোটবেলাতে আর পাঁচটা সাধারন মেয়ের মত ফ্রক পরে লুকোচুরি, পুতুলখেলা আর এক্কাদোক্কা তো ছিলই। তার মধ্যে বই কম জুটলেও পড়ার আগ্রহটা কম ছিল না। প্রথমদিকে কেবল স্কুলের লাইব্রেরি তারপর আমাদের জয়গঙ্গা পাঠাগার। আরো মনে আছে, নতুন পাঠ্য বই কেনা হলেই মলাট লাগানোর ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে ইংরেজি বাংলা সাহিত্য পুস্তিকার গল্প ছড়া কবিতা সব পড়া হয়ে যেত। বস্তুত বই পড়া বলতে পাঠ্য বই এর বাইরে গল্প উপন্যাস নাটক নভেল পড়াই বুঝতাম বহুকাল। তা বাদে জুটত খরবের কাগজ কিম্বা ম্যাগাজিন। এক হিসেবে দেখতে গেলে সেগুলোতেই হাতেখড়ি অন্য রকম কিছু পড়ার। মিশরের পিরামিডের রহস্য, বারমুডা ট্রায়াঙ্গল, জাটিঙ্গার পাখি, অদ্ভুত বিভারদের গল্প থেকে হিরোশিমা নাগাসাকি, গুপ্তচরবৃত্তি, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, পার্ল হারবার এমন কত অজানা তথ্য, রোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চার পড়তাম ম্যাগাজিন গুলোতে। খবরের কাগজের আর্টিকেল, সম্পাদকীয় পড়া ধরার অনেক আগে থেকেই আমাকে টানতো ক্লাসিফায়েড বিজ্ঞাপনগুলো। সত্যি বলতে ওগুলো এখনও আমায় বেশ টানে। তাতে পাত্রপাত্রীর খোঁজ খবরই বেশি যদিও, কিন্তু তাতেও বেশ অদ্ভুত অদ্ভুত চাহিদা চোখে পড়ত। 'পৈতৃক সম্পত্তির একমাত্র দাবিদার' পাত্র থেকে 'ভাই থাকা আবশ্যিক' এমন পাত্রীর দাবি সহ অদ্ভুত কিম্ভুত কত চাহিদা দেখেছি। আশ্চর্য লেগেছিল একদিন 'চশমা পরিহিতা পাত্রী চাই' দেখেও। পাত্রপাত্রীর গুলো কম, বেশি দেখতাম বিবিধ গুলো। পুরোনো অ্যংলো সুইস ঘড়ি কিনতে চাই, অমুক সালের তমুক মাসের খবরের কাগজ কারুর কাছে আছে কিনা কিম্বা 'জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাই, যেখানেই থাকো, ভালো থেকো' বলে নামবিহীন বিজ্ঞাপন দেখলে কেমন যেন কল্পনার জগতে ঢুকে যেতাম। নিরুদ্দেশ সংবাদে 'সত্বর ফিরিয়া আসো, মাতা অসুস্থ' পড়ে সংগে একটা রোগাভোগা উজ্জ্বল চোখের ছেলের ছবি দেখে কেন জানি তারাপদ মনে হত। একবার এক দুর্ভাগা পিতামাতা বিয়ের সাজে কন্যার ছবি দিয়ে শোক প্রকাশ করে লিখে ছিলেন 'যাদের জন্য তোকে হারালাম ভগবান তাদের শাস্তি দেবেন'! বুকটা কেমন হু হু করে উঠতো। ছোট্ট ছোট্ট তিন চার লাইন গুলোর প্রতি কি অমোঘ আকর্ষণ বোধ করতাম। মনে আছে, ছেঁড়া ঠোঙা হাতে পেলেও একটু চোখ বুলিয়ে নিতাম। খবরের কাগজের আরেকটি ইন্টারেস্টিং অংশ ছিল পাঠকের মতামত। কিন্তু এসব ইকড়ি মিকড়ি স্মৃতি হাতড়ানো কি বই এর উপর লেখা প্রবন্ধের অংশ হতে পারে! না হয়ত, তবু আমার মনে হয় এগুলো নিয়ে দিব্যি আস্ত একটা বই লেখা যায়।
মনে পড়ে, স্কুলের লাইব্রেরি থেকে একবার আমাদের বিদেশী গল্পের অনুবাদ সিরিজটা দেওয়া হয়েছিল। কত গল্প যে সেই সময় পড়েছি - জুলে ভার্নের লেখা, টম সায়ারের গল্প, আংকেল টম, রিপ ভ্যান উইঙ্কিল - আরো কত। অনুবাদকও ছিলেন বটে, মনে হত যেন বাংলা সাহিত্যই পড়ছি। ক্লাস ইলেভেন থেকে টিউশন করতাম। একটা দুটো। আমার পড়াতে মোটেই ভালো লাগত না। শুধু বই কেনা আর অন্য একটা শখ পূরণের জন্য। জানতাম, বাবার পক্ষে সেসব দেওয়া সম্ভব না। সারা বছরের টিউশনের টাকা জমিয়ে বইমেলা যাওয়া ছিল আমার কাছে তীর্থস্থান দর্শনের মত। তখন জানতাম না, কলেজ স্ট্রিট থেকে সারা বছর বেশি ডিসকাউন্টে বই কেনা যায়। কত বই যে কিনেছি, পান্ডব গোয়েন্দা থেকে শুরু করে শরৎ রচনাবলী, কালকূট সমগ্র, শরদিন্দু অমনিবাস, মানিক, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, বনফুল। পরের দিকে হুমায়ূন আহমেদ। প্রতি বইমেলা থেকে তাঁর বই কিনতামই কিনতাম। বই এর প্রথম পাতায় লিখে রাখতাম তারিখ। আজও সেসব বই আমার কাছে অমূল্য সম্পদ।
তবে অস্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সেই হুমড়ি খেয়ে বই পড়ার দিনগুলো আর নেই। নেই সেই তীব্র ইচ্ছেটাই। ফেবুর জগতে এখন অনেক অনেক ধরনের লেখা পড়ি, তার মধ্যে বহু লেখাই বেশ উচ্চমানের, সাহিত্যগুণের মাপকাঠিতে সামনের সারিতে রাখার মত। তবু মাঝে মাঝেই আফশোষ হয়, নিজের কেনা বই, পত্রিকা অপঠিত পড়ে থাকে দীর্ঘদিন। আগে সেটা ভাবতেই পারতাম না। বরং একাধিক বার পড়েছি কত বই। অলস দুপুর বা কিছু না করবার ছুটি গুলো ছিল কেবল বই পড়বার জন্য। এখনও আসে মাঝেসাজে কিছু অলস দুপুর, কিছু না করবার ছুটিও যে পাই না তাও নয়। সব কোথা দিয়ে শেষ হয়ে যায় বুঝি না, সাদা কালো অক্ষর গুলো খসখসে কাগজের উপর না-ছোঁয়া রয়েই যায়।
28/12/18
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন