পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ২২ জুন, ২০১৯

শমিতা চক্রবর্তী .

একটি জিতে যাবার গল্প 
---------------------------
                                  

সমস্ত সোস্যাল মিডিয়ায় বাংলা ভাষা লুপ্ত হবার আশঙ্কার কথা শুনে শুনে সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম ! আমার ডোডো টাও কি তাহলে বাংলা টা শিখবেই না ! 
আজ অফিস আসার পথে বই পাড়ায় ঢুঁ মারলাম --অনেকগুলো বাংলা কমিকসের বই কিনেই ফেললাম --ডোডো টাকে বাংলা ভাষায় যদি এভাবেই আগ্রহী করে তোলা যায় ! 
                   বই এর পাতা ওলটাচ্ছি আর সেই ছোটবেলায় ফিরে যাচ্ছি --হাঁদা -ভোঁদা , নন্টে ফন্টে , টিনটিন --কী ভালো লাগতো ! 
               রোজকার মতো বাচ্চু বলে ছেলেটা আজও চা নিয়ে এসেছে --বইগুলোর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে দেখে প্রশ্ন করলাম --কি রে পড়তে জানিস ? 
--হ্যাঁ ফোর ক্লাস পর্যন্ত পড়েছি তো ! 
--তা পড়াটা ছাড়লি কেন ? 
--ঐ যে বাপ টাও চলে গেলো --আর আমি এই লালন চাচার দোকানে কাজে লেগে গেলাম --ঘর চালাতে টাকা পয়সা তো চাই ! 
             কতোই বা বয়স ছেলেটার --বড়জোর বারো , এই বয়সেই ঘর চালানোর দায়িত্ব বুঝে গেছে ! অবশ্য এদের সংসারে আকছার এমন ঘটছে --বাপ গিয়ে অন্যত্র সংসার পাতছে আর ছেলে মেয়ে নিয়ে প্রথম পক্ষ পথে বসছে ! বাচ্চুর গল্পটাও এর ব্যতিক্রম নয় ! ওর আরও দুটো ছোট ভাই বোন আছে --মা দুই বাড়ি রান্নার কাজ করে আর বাচ্চুর এই চায়ের দোকানের কাজ ! কোনমতে গড়িয়ে গড়িয়ে সংসার চলছে আর কি ! সেখানে লেখাপড়া বিলাসিতাই বৈকি ! 
           কমিকসের বইগুলো দেখে বাচ্চুর ঝলমলে চোখমুখ ভুলতে পারছিলাম না --ছেলেটার পড়ায় আগ্রহ আছে ! হয়তো সুযোগ পেলে .........

                            পরদিন বাচ্চুকে জিজ্ঞেস করলাম --হ্যাঁ রে তুই পড়তে চাস ? 
--চাই তো ! কিন্তু কাজও তো করতে হবে --নাহলে খাবো কি ! 
---তোকে যদি আমি কাজ দিই --আর স্কুলেও ভর্তি করে দিই ! 
আনন্দে চোখ চকচক করে উঠলো --একগাল হেসে সম্মতি সূচক ঘাড় কাত করলো ! 
--মা কে বলে রাখিস । 

                            আমাদের অতোবড় বাগান ! মালী ডমরু দাদার বয়স হয়েছে --সেই শ্বশুর মশাই এর আমলের লোক --আজকাল তেমন পেরে উঠছে না --বাচ্চু টা যদি ওর কাজে সাহায্য করে দেয় -তো ক্ষতি কি ! আর সেই সঙ্গে সরকারী স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলে বেচারা টার পড়াশুনা টাও হয়ে যায় ! হ্যাঁ মাস গেলে কিছু টাকা ওর হাতে তুলে দিলেই হোলো ! আর্থিক সমস্যা তো আমাদের নেই --বরং যথেষ্ট স্বচ্ছল পরিবার আমাদের !
                                          সুযোগ বুঝে কথাটা রাতে খাবার টেবিলে পেশ করলাম ! শাশুড়ী মা শুনেই হাঁ হাঁ করে উঠলেন --বোলো কি কার না কার ছেলে --একেবারে বাড়ির মধ্যে তুলে আনবে বলছো ! আবার কিনা তার পড়াশোনার দায়িত্ব ! এসব বস্তির ছেলেদের সঙ্গে আমাদের ডোডো টাও মিশে ওদের মতো হোক আর কি ! 
শ্বশুর মশাই গম্ভীর গলায় বললেন --'আজকাল তুমি তো দেখছি বেশ বড় বড় ডিসিশন নিয়ে ফেলছো -আমাদের পারমিশন ছাড়াই ! '
প্রদীপ্ত তো বেশ ব্যঙ্গের সুরেই বললো --'তা হঠাৎ এই সমাজ সেবা করার ভূত টা তোমার ঘাড়ে চাপলো কেন !  --এ বাড়ি বাবার -উনি যা বলবেন তাই-ই হবে ! '
                                       এই প্রথম আমি উপলব্ধি করলাম --এ বাড়ি আমার নয় --এখানে আমার সিদ্ধান্তের কোন দাম নেই ! 
        তবু রাতে শুতে যাবার আগে কথাটা আবার প্রদীপ্তর সামনে পাড়লাম ---আচ্ছা তোমরা কি ! একটা ছোট্ট অসহায় ছেলে পড়াশোনা করে বড় হতে চাইছে --এটুকু সুযোগ তাকে দেওয়া যায় না ?  আর সে তো এমনি এমনি এখানে থাকবে না --বাগানের কাজে ডমরু দাদা কে সাহায্যও করবে ! ---আর মা --আমি অবাক হয়ে যাই --যিনি কিনা এই শহরের নারী -শিশুকল্যাণ সমিতির প্রেসিডেন্ট --বিভিন্ন সভায় শিশুশ্রম , শিশুবিকাশ , নারী মুক্তি ইত্যাদি নিয়ে গুরুগম্ভীর বক্তৃতা দিয়ে হাততালি কুড়ান --তিনিও কি না এই মেণ্টালিটির ! 
                                আমার কথায় ঝাঁজ ছিলো --প্রদীপ্ত হিস হিস করে উঠলো ---মুখ সামলে অহনা --তোমাকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে মানে এই না যে তুমি মা -এরও সমালোচনা করবে ! 
                               হায়রে --এরা আমাকে স্বাধীনতা দিয়েছে ! --এইসব শোনার পর আর এদের সাথে তর্ক করার রুচি ও রইলো না ! তবে মনে জেদ টা আরও চেপে বসলো --বাচ্চু টার জন্য কিছু একটা করতেই হবে ! ছেলেটা আশায় বুক বেঁধেছে !
আমার বস যথেষ্ট সহৃদয় ! আমার প্রতি স্নেহশীল ! তাঁর কাছেই কথাটা পাড়লাম --আর্জি জানালাম --স্যার যদি ছেলেটার জন্য কিছু একটা করা যায় --আপনার তো অত বড় বাড়ি , কত শত কাজের লোক --এই ছেলেটাকেও যদি ঘরের কোন হালকা কাজে লাগিয়ে লেখাপড়ায় একটু সাহায্য করা যায় ! বস অত্যন্ত নম্র ভাবেই বললেন দেখুন মিসেস বসু মল্লিক --করতে তো পারাই যায় --কিন্তু আমার স্ত্রী আবার বড় শুচিবায়ু গ্রস্ত --সে ঠিক একে রাখতে রাজি হবে না ! আর আপনার এই প্রচেষ্টা কে যথেষ্ট সম্মান দিয়েই বলছি --এরকম কত শত বাচ্চা আছে -যাদের সাহায্যের প্রয়োজন --আপনি কত জনের করতে পারবেন বলুন ! 

                                                  আজও বাচ্চু টা চা দিতে এসে জুলু জুলু করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ! লজ্জায় ওর দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারলাম না --কথা রাখতে পারছিনা যে ! 
                     অন্যমনস্ক ভাবেই সেদিন গেট পেরিয়ে বাড়িতে ঢুকছি --ডমরু দাদা বোধহয় গাছগুলো তে জল দিচ্ছিল --খেয়ালই করিনি --সম্বিৎ ফিরলো ডমরু দাদার ডাকে --কি ছোট মেমসাহেব -মন খারাপ নাকি ? 
ডমরু দাদা --বড় ভালো মানুষ ! আমিও দেখা হলেই হেসে হেসে কথা বলি --ওর বাড়ির খবর জানতে চাই --আজ তার ব্যতিক্রম দেখেই হয়তো ------
সঙ্গে সঙ্গে মাথায় একটা প্ল্যান খেলে গেলো --আর এ ডমরু দাদা ই তো আমার মুশকিল আসান ! 

*  *  *  *  *  *  *  *
                            কয়দিন পর ডমরু দাদা এসে বাবা -মায়ের  হাতে পায়ে ধরলো --এই ছেলে টা ওর বন্ধু দাশুর নাকি সম্পর্কে নাতি হয় --বাপ কে হারিয়েছে --গেরামে কাজ জুটছে না --তাই যদি ডমরু দাদা ওকে ওর সঙ্গে রেখে নেয় --ওর কাজও হালকা হয় আর ছেলেটাও বেঁচে যায় ! মাইনে দিতে হবেনি --দুটো খেতি পরতি পারলেই হোলো ! 
                                         কাকুতিমিনতি তে শাশুড়ি মা -র মন গললো --ডমরু অত পুরোনো লোক ওর কথা ফেলা যায় না ! তবে এক শর্ত আছে --এ ছেলে যেন এ বাড়ির ভিতর না ঢোকে --ঐ আউটহাউসেই যেন থাকে ! 

                                   ডমরু দাদা কে কি বলে ধন্যবাদ দেবো ভেবে পেলাম না ! 
বাচ্চুর মাস মাইনে টা আমিই দিয়ে দিই । আর স্কুলেও ভর্তি করিয়ে দিলাম । 

*  *  *  *  *  *  *  *  *  *  *
ছয় বছর বাদে ---------
          
                      আজ আমাদের বাড়ির সামনে হৈ চৈ --প্রেস -মিডিয়ায় ছয়লাপ ! 
শাশুড়ি মা আমাকে বললেন ---অহনা দেখো তো কি ব্যাপার ! আজকাল ওনার শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছে না --তার ওপর কদিন ধরে হাঁটুর ব্যাথা টা বেড়েছে ! নাহলে তিনিই তো ওদের সম্মুখীন হতেন ! 

                                           আজ মাধ্যমিকের রেজাল্ট আউট হয়েছে । বাচ্চু টা নাকি এবার রাজ্যে প্রথম হয়েছে ! 
                                   শাশুড়ি মা অবাক ! কাগজের লোকেরা বলছে --সত্যিই সার্থক আপনার শিশু কল্যাণ সমিতি ---প্রণতি দেবী ! আপনাদের সাহচর্য পেয়েছে বলেই না --ছেলেটা আজ এখানে ! শাশুড়ি মা প্রথম টা থতমত খেলেও -বেশ হাসি দিয়ে ব্যাপার টা ম্যানেজ করে নিলেন ! 
                                        
                               বাচ্চু একদম ঘাবড়ে গেছে ! ডমরু দাদার চোখে জল ! আড়াল থেকেই লক্ষ্য করলাম প্রেস -মিডিয়া সব সামলে বাচ্চুর দুটো চোখ কাকে যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে ! 
                আমারও দু চোখের কূল ছাপিয়ে জল এলো ! এ অবস্থায় কি সবার সামনে যাওয়া যায় !  আড়ালেই রইলাম ! 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন