পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯

সম্পাদকীয়


চারিদিকে শুধু শীত শীত ভাব ৷ কুয়াশা ঘেরা সকালে এক কাপ চায়ে চুমুক দিতে দিতে মনে পড়ে তোমার কথা ।শীতের পরশ প্রথম যখন গায়ে মাখি তখন মনে পড়ে তোমার কথা ৷জানলায় গাছের শিশিরের দিকে যখন তাকাই তখন মনে পড়ে  তোমার চুলের জলের কথা ৷কমলালেবুর খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে মনে পড়ে তোমার গায়ের গন্ধের কথা ।ঠোঁটের কোণে লিপবাম লাগাতে লাগাতে মনে পড়ে তোমার প্রথম চুম্বনের কথা ...

ইদানিং সবকিছুতেই শুধু তোমাকে মনে পড়ে ...

হে পরম  পৌষ
আলিঙ্গন করো  সারা শরীর
মেতে উঠুক পরম উষ্ণতা

ধুলো মেখে থাকে অতৃপ্ত চাহিদা
আরো আরো কাছে এসো
জড়িয়ে ধরো হাতখানি
চোখে চোখ কথা হোক

পশম ছড়িয়ে দিক উর্বর স্তনে
আজ না হয় এটুকুই ...


  • না ! সৃজনকে ভুললে আপনাদের  কোন  মতেই চলবে না ৷দেখতে দেখতে "সৃজন ". চার বছর অতিক্রান্ত হতে চলল ৷আপনাদের ভালবাসা, আপনাদের চাহিদায় সৃজন আজ এতটা পথ হেঁটে এসেছে ৷ আরো অনেকটা পথ হাঁটা বাকি ।তার জন্য চাই আপনাদের আরো আরো বেশি ভালোবাসা আরো বেশি দায়বদ্ধতা ৷" সৃজন "  আপনাদের কাছের  হয়ে উঠুক ৷ইংরেজি নতুন বর্ষ আপনাদের ভালোবাসা ছড়িয়ে দিক এই কামনা করি ৷



পারমিতা  চক্রবর্ত্তী
সম্পাদক

আমাদের লেখা পাঠান এই আইডিতে srijanblog10@gmail.com 

স্বপন রায়




আব্বাস  কিয়ারোস্তামির কবিতা   
.....
আব্বাস কিয়ারোস্তামি  স্বনামধন্য চিত্র পরিচালক(১৯৪০-২০১৬)। তবে তিনি কবিতাও লিখেছেন। তাঁর কবিতাগুলি ছোট, অনেকটা ‘হাইকু’ যেন। যেন হাফেজই লিখছেন সমস্ত সাঙ্গীতিক  মূর্ছনা বাদ দিয়ে, আবেগ বিসর্জন দিয়ে। পড়া যাক কিয়ারোস্তামির তেমনই কিছু কবিতার অনুবাদ। ফার্সি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ আরিয়া ফানি। আমি বাংলায় রূপ দেওয়ার চেষ্টা করলাম।
.....
১.
একটা লাল বিন্দুর লাইন শাদা বরফের ওপরে
আহত খেলা
খুঁড়িয়ে চলে যাচ্ছে
২.
পূর্ণিমা
জলে প্রতিফলিত
জল
একটি পাত্রে রাখা
এবং তৃষ্ণার্ত মানুষটি
গভীর ঘুমে
৩.
চাঁদের আলো
চকচক করছে সরু রাস্তাটায়
ওটা আমার রাস্তা নয়
৪.
শাদা অশ্বশাবক
হাঁটু অব্দি লাল
পপির মাঠে
খেলাধুলোর পরে
৫.
সকাল
শাদা
সন্ধ্যা
আঁধারকালো
একফালি দুঃখ
মাঝখানে
ধূসর
৬.
নেকড়ে
শুয়ে আছে
অপেক্ষায়
৭.
ধোঁয়ার গন্ধ
জ্বলন্ত অনুতাপের গন্ধ
বাচ্চার কান্নার শব্দ
রোদঝলসানো ইঁটের
কুঁড়েঘর


যুগান্তর মিত্র




*ঈশ্বর বিষয়ক সনেট*




সপ্তাশ্ব নামের এক ঈশ্বর আমার বাড়ি থাকে।
তার কাছে জমা রাখি নিজস্ব স্বপ্ন আর ভ্রম।
সকাল সন্ধ্যায় দেখি নম্র হাওয়ার মতো তাকে,
ঘিরে রাখে চারিদিকে তথাগত আলোর আশ্রম।
আমি তাকে পুত্র বলি, সে আমাকে পিতা বলে ডাকে।
কখনো বিপ্রতীপে উল্টে যায় সে ডাক মোক্ষম।
বিশ্বচরাচর জুড়ে আলোর গুঁড়োর ফাঁকে ফাঁকে,
ঝুলে থাকে অন্ধকার, গলে পড়ে ভালোবাসা-মোম।

কখনো সে পিতা হয়, আমাকেই পুত্রসম বোধে
দুহাতে আগলে রাখে, সে যেন একাই সব্যসাচী ;
ঘিরে রাখে রাত্রিদিন, নিরন্তর আপদে বিপদে।
পিতাপুত্র পুত্রপিতা নির্ভার হয়ে আমরা বাঁচি।
পুত্র আর পিতা যদি এক ব্যক্তি, এক আত্মগত,

জগতে আনন্দযজ্ঞে গ্রহতারা জ্বলে শত শত।

তুষ্টি ভট্টাচার্য


শিরিষের স্মৃতি

বরফে পা গেঁথে গেলে লতাটি টান দেয়
চেয়ারের পায়া কেঁপে উঠে ভাবে-
এখনও অনেকগুলো দিন এই সাদা প্রান্তরে
শিরিষের স্মৃতি নিয়ে কেটে যাবে

কে কাকে বহন করছে, এই দ্বিধার সামনে
নতজানু হয়েছে শীতরাত
নিজেকে বিছিয়ে দিয়েছে আজানু সম্ভবে

আজ যদি এইখানে সমস্ত বরফ গলে যায়
চেয়ারের দুঃখ থেকে অন্তত কিছু ভার কমে যেত
লতার কোমলে সবুজের সমারোহ দেখে
হেসে উঠত না কি তারা?

অসম্ভব দৃশ্য থেকে সরে এসে
এইবার তবে কিছু বসা যাক।  
 #
বসে থাকার কালে সারবত্তা বলে কিছু নেই
দুদিকে অলস চোখ বুলিয়ে শুধু দেখে নেওয়া
শুধু সময়ের বিস্তৃত নিভৃত সংলাপ

লতাটিও প্রায় বসে আছে
সিরাজের কথা মনে পড়ে তার
খানিক হুঁকোর ধোঁয়া এলো কোথা থেকে  
কুণ্ডুলি পাকিয়ে তারা এই বুঝি মেঘ হবে, ভাণ করে

বরফের স্তরে স্তরে লুকনো আগুন থেকে
আজও ধোঁয়া ওঠে
ধোঁয়ার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ ক’র না!

 ছবি - আশীষ পাইন

কৌশিক চক্রবর্ত্তী


মল্লভূমের মাটি
_____________


মল্লভূম। বাংলার উর্বর অঞ্চলের রাজারাজড়াদের নাগালের বাইরে সে এক বিশাল অরন্য অধ্যুষিত স্বাধীন রাজ্য। রাজা আছে, সিপাই আছে, আছে অস্ত্র-শস্ত্র, পাইক, বরকন্দাজ। এমনকি বিখ্যাত কারিগর জগন্নাথ কর্মকারের নিজে হাতে তৈরি কামান। মুর্শিদাবাদের নবাবী নজরের বাইরে সে এক হিন্দুরাজাদের বিচরণভূমি। ভৌগলিক সীমানায় নবাবের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও বিস্তীর্ণ জঙ্গলের কারণে নবাব কখনোই ফিরে তাকাননি এই অঞ্চলের ত্রিসীমানায়। এমনকি নিয়মিত নবাবকে কর দিলেও মুর্শিদাবাদের দরবারে কখনো হাজিরা দিতে হয়নি মল্লভূমের রাজাদের। যদিও একজন প্রতিনিধি রাখা থাকতো নবাবের দরবারে। 
যাই হোক, ফেরা যাক ঘটনায়, ৬৯৪ খ্রীস্টাব্দে রাজা আদিমল্লের নিজেহাতে প্রতিষ্ঠিত রাজপাট। সেযুগের দুর্ধর্ষ মল্লযোদ্ধা হিসাবে তাঁর দিগ্বিদিক খ্যাতির কারণে মল্লরাজ নামেই লোকে বেশি চিনতে শুরু করে তাঁকে। আর এই মল্লরাজদের হাতেই সযত্নে গড়ে উঠতে থাকে মল্লভূম, আজকের বিষ্ণুপুর। সমগ্র রাজত্বকালের সবচেয়ে বাড়বাড়ন্ত দেখা যায় ৪৯ তম রাজা হাম্বীর মল্ল দেবের সময়ে। রাজা হাম্বীর মল্ল ছিলেন পরম বৈষ্ণব। সে কথা না হয় পরে কখনো বলা যাবে। শহরের সমস্ত মন্দির ও স্থাপত্যই প্রায় এই হাম্বীর মল্লের সময় ও তার পরে পরে তৈরি। সম্রাট আকবরের সমসাময়িক রাজা হাম্বীর মল্লের শক্তিশালী রাজ্যপাটের কারণে বীর হাম্বীর নামেই লোকে ডাকতো তাঁকে। বাদশা আকবরের সাথে ছিল তাঁর সুসম্পর্ক। বর্তমানে ওয়াল্ড হেরিটেজ সাইট বিষ্ণুপুর রাসমঞ্চ তাঁর হাতেই নির্মিত। তবে রাজা বীর সিংহ, দুর্জন সিংহ (মদনমোহন মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা), চৈতন্য সিংহ, রঘুনাথ সিংহের হাতেও তৈরি হয় বিভিন্ন চোখ ধাঁধানো পোড়ামাটির স্থাপত্য ও মন্দির৷ তৎকালীন আশপাশের ঘন জঙ্গল ও দুর্গম রাস্তা পেরিয়ে বহুদূর থেকে পাথর আমদানি ছিল নিতান্তই খরচাসাপেক্ষ। তাই স্থানীয় লালমাটিতে কারুকাজ করে তা পুড়িয়ে মুর্তি নির্মাণ। এটিই হল টেরাকোটা। শ্যামরায় মন্দির, মদনমোহন মন্দির, কালাচাঁদ মন্দির, জোড়বাংলো, লালজি মন্দির আরো আনাচেকানাচে অজস্র টেরাকোটার স্থাপত্য এর মধ্যে অন্যতম। মন্দিরের গায়ে সুক্ষ্ম রামায়ন মহাভারত এবং মধ্যযুগীয় শিল্পকলা। তাকিয়ে থাকতে হয় অবাক বিস্ময়ে। কোনো যান্ত্রিক পদ্ধতি ছাড়াই শুধুমাত্র হাতের কাজে দেয়ালগাত্রে পাতলা বাংলা ইটের ভিতের ওপর পোড়ামাটির কাজ। প্রতিটা ইটের ফাঁকে যেন লুকিয়ে আছে কত শত বীরত্ব আর শৌর্যের আখ্যান। কান পাতলে আজও অবিকল শোনা যায় কারিগরদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর শৈল্পিক আঙুলে নকসা বোনার শব্দ। 
রাজধানী প্রদ্যুম্নপুর থেকে বিষ্ণুপুরে স্থাপিত হবার পর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। তখন আটচল্লিশতম মল্লরাজ ধাড়ীমল্ল বয়সের ভারে ন্যুব্জ। যুবরাজ হাম্বীর শৌর্য বীর্যে বেশ উজ্জ্বল। আশেপাশের রাজ্যেও লোকের মুখে মুখে ফেরে তাঁর বীরত্বের কথা। রাজা হবার পর তাঁর বিচক্ষণ রাজনৈতিক বুদ্ধি আর অসীম বীরত্বের গল্প আজও বিষ্ণুপুরের অন্দরে কান পাতলে শোনা যায়। তবে সে অনেক পরের কথা। ধীরে ধীরে আমরা আলোচনা করব তাঁর সেইসব অমর কাহিনী। এখন আবার ফিরে আসি সেই যুবরাজ হাম্বীরের কথায়। হঠাৎ মোঘলদের চিরশত্রু উড়িষ্যার পাঠান নবাব সুলেমান কররাণির পুত্র দাউদ খাঁ বিষ্ণুপুর আক্রমণ করে বসেন। যুবরাজ হাম্বীর তাঁর দক্ষ সেনাদল নিয়ে এগিয়ে যান শত্রুদের আটকাতে। প্রথমে দায়ুদ খাঁয়ের নেতৃত্বে লক্ষাধিক সৈন্য দেখে একটু পিছিয়ে যেতে বাধ্য হন বীর যুবরাজ। কিন্তু তারপর নিজেকে গুছিয়ে কৌশলে আছড়ে পড়েন শত্রুদের ওপর এবং দুইপক্ষের প্রচুর প্রাণের বিনিময়ে তিনি পাঠান দায়ুদ খাঁকে পরাস্ত করেন। সেইদিন যুদ্ধের মাঠে জমে যায় মৃতদেহের স্তুপ আর কথিত আছে যুবরাজ হাম্বীর শত্রুদের মুণ্ড থেকে মালা বানিয়ে অর্পণ করেন কূলদেবী মৃন্ময়ী মাকে। শত্রুদমনের সেই জায়গা আজও বিষ্ণুপুরে মুণ্ডমালার ঘাট নামে বহু পরিচিত। এতো গেলো যুবরাজ তরুণ হাম্বীরের কথা। আর রাজা ধাড়ীমল্লের মৃত্যুর পর যখন তিনি সিংহাসনে বসেন তখন তাঁর বীরত্বের কাহিনী যেন শেষই হয় না। তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক বুদ্ধি আর দূরদর্শীতায় তিনি মোঘল - পাঠান যুদ্ধে মোঘল পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। সম্রাট আকবরের সাথে সুসম্পর্ক তাঁকে অনেকটা শক্তিশালী করেছিল সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহও নেই। সম্রাট আকবর শাসনের সুবিধের কথা ভেবে তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যকে মোট ১৬ টি জায়গীরে ভাগ করেন। তার মধ্যে বাংলার দায়িত্ব পান স্ময়ং রাজপুত সেনাপতি মানসিংহ। একবার সন্ধি করার ফাঁদে ফেলে তৎকালীন পাঠান নবাব কতলু খাঁ মানসিংহের পুত্র জগৎসিংহকে তুলে নিয়ে যান উড়িষ্যায়। স্বাভাবিক ভাবেই বিচলিত হয়ে পড়েন রাজা মানসিংহ। বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে বর্তমান আরামবাগের কাছে ছাউনি ফেলেন তিনি। সেই সুযোগে নিজের রাজ্যের মধ্যে মোঘল পাঠান দ্বন্ধে তিনি সেনাসমেত সরাসরি সাহায্য করেন মানসিংহকে এবং প্রায় একক বিক্রমে যুদ্ধ করে ছাড়িয়ে আনেন জগৎসিংহকে এবং বন্দী অবস্থায় হত্যা করে সমাধিস্থ করেন কতলু খাঁকে। সেই স্থানটিই আজ কতলু খাঁয়ের নাম অনুযায়ী বর্তমান বাঁকুড়ায় কোতুলপুর নামে খ্যাত। যুদ্ধের পরে স্বাভাবিক ভাবেই মোঘলদের সুনজরে পড়ে যায় সেযুগের বন-বিষ্ণুপুর (বিষ্ণুপুরের তৎকালীন নাম)। এমনকি সেদিন বাদশার দরবারেও হাম্বীরের হয়ে বহু প্রশংসা করেছিলেন রাজা মানসিংহ। কৃতজ্ঞতাবশত বিষ্ণুপুরের ওপর থেকে করের বোঝা পর্যন্ত তুলে নিয়েছিলেন বাদশা আকবর। প্রায় ৫০০ বছর আগেও মল্লভূমের মত জঙ্গল অঞ্চলে তাঁর দক্ষ শাসনব্যবস্থার সুবিধার জন্য এক একটি দৃঢ় পদক্ষেপ আজকের মানুষকেও অবাক করে। দ্রুত যোগাযোগব্যবস্থার সুবিধার জন্য তিনি সমগ্র মল্লভূম জুড়েই উঁচু উঁচু স্তম্ভ তৈরি করেছিলেন। শত্রু আক্রমণের খবর এতে তাঁর কাছে অনেক আগেই খুব সহজে পৌঁছে যেত। এই স্তম্ভগুলোকে তখন বলা হত 'মাচান'। আজও বাঁকুড়ায় কোনো কোনো জায়গায় এইসব স্তম্ভের ভাঙা অংশ দেখা যায়। বাঁকুড়া স্টেশনের কাছে 'মাচানতলা' অঞ্চলের নামকরণের কারণও এটিই। যদিও নাম থাকলেও এই অঞ্চলের মাচানটি বহুকাল আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে। 
এ এক সফল রাজার কাহিনী। এক দোর্দন্ডপ্রতাপ অথচ প্রজাবৎসল শাসকের গল্প। তাঁর গল্প যত বলা যায় ততই কম হয়ে যায়। অথচ এই বীর রাজাকে আজও কতজন বাঙালি ঠিকমতো চিনে উঠতে পেরেছেন! ঘুরতে ঘুরতেও দেখেছি বিষ্ণুপুরের বেশিরভাগ ভ্রমণপ্রিয় বাঙালিই মন্দির দেখেন, বালুচরি কেনেন। কিন্তু বাংলার গর্ব রাজা বীর হাম্বীরের নাম পর্যন্ত জানেননা অনেকেই।
বিষ্ণুপুর বাংলার এমন এক অংশ যার কোনো অঞ্চলই মুসলিম শাসনে কোনোভাবেই প্রভাবিত হয়নি। অরণ্য ও মালভূমি আবৃত মল্লভূমকে কোনো সুবেদারই কখনো পুরোপুরি হস্তগত করতে পারেনি। তবে মুর্শিদাবাদকে মল্লরাজারা রাজস্ব দিয়ে দিত বলেই জানা যায়। কিন্তু অভ্যন্তরীণ শাসনে এঁরা ছিলেন স্বাধীন। চিরাচরিত হিন্দু প্রশাসিত অঞ্চল হিসাবে বাংলার মল্লভূমি, বীরভূম ও বর্ধমান বেশ উল্লেখ্য। যদিও বর্ধমান রাজবংশের শক্তি বাড়তে শুরু করলে বিষ্ণুপুরের রাজাদের নিয়ন্ত্রণ কমতে শুরু করে। বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচাঁদ বিষ্ণুপুর আক্রমণ করে অনেকটা মল্ল প্রশাসিত অঞ্চল নিজের জমিদারির আওতায় আনেন। পরের দিকে বাংলায় মুহুর্মুহু বর্গী আক্রমণের ফলে মল্ল রাজারা বড় বেকায়দায় পড়ে যান ও বিষ্ণুপুর মল্লরাজত্বের পতন শুরু হয়। যদিও সেসব অনেক পরের কথা। ততদিনে এই অঞ্চলের রাজাদের বহু কীর্তি বাংলার মানুষের মুখে মুখে ফিরছে। ৬৯৪ খীষ্টাব্দে যখন আদি মল্লরাজের হাতে প্রতিষ্ঠা পায় এই রাজবংশের তখন এদেশের মানুষ মুসলমান সম্প্রদায়ের নামও শোনেনি। এর অনেককাল পরে (প্রায় ৫০০ বছর পরে) বকতিয়ার খিলজী বাংলার হিন্দু শাসকদের থেকে বাংলা হস্তগত করেন। তবে মল্ল সাম্রাজ্যের কাহিনী অসম্পূর্ণ থেকে যায় রাজা হাম্বীর মল্ল দেবের কথা ছাড়া। তাঁর সুশাসন ও প্রজাবৎসল রাজত্বের সময়কাল আজও বিষ্ণুপুরের ইতিহাসে সোনার অক্ষরে লেখা আছে। বাংলার বারো ভুঁইয়াদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। এই বারো ভুঁইয়াদের ক্ষমতার সেযুগে সর্বজনবিদিত। বলে রাখি বাংলার অসীম ক্ষমতাধর এই শাসকদের ভাবগতিক মুঘল শাসকদেরও কখনোই শান্তি দেয়নি। সম্রাট শাহজাহানের আগে কোনো বাদশাই বাংলা থেকে সম্পূর্ণ রাজস্ব আদায়ে সক্ষম হন নি শুধুমাত্র এঁদের কারণে। এমনকি প্রথম মুঘল সম্রাট বাবর বিব্রত হয়ে বাবরনামায় লিখছেন "...এই বাঙালিদের আমি দেখে নেব"। রাজা বীর হাম্বীরও সেই তালিকায় অন্যতম এক শাসক। তাঁর বীরত্ব ও শৌর্য বোঝাতে হয়ত আর কোনো উপমারই প্রয়োজন পড়বে না। শৈব বংশজাত হয়েও রাজার বৈষ্ণব জীবনযাপনের কথা না বললেই নয়। এই বিষয়ে একটি কাহিনী ঘোরে লোকের মুখে মুখে। চৈতন্য মহাপ্রভুর পার্ষদ শ্রীনিবাস আচার্য ও অন্যান্য ভক্তরা বৃন্দাবন থেকে ফিরছিলেন বাংলায়। তখন পথে বিষ্ণুপুরের সৈন্যরা তাঁদের লুঠ করেন এবং বন্দী করেন। পরে আচার্যের ভাগবত পাঠ শুনে মল্লরাজ হাম্বীর বৈষ্ণব মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েন ও দীক্ষা গ্রহণ করেন। তিনিই প্রথম মল্লরাজ যাঁর পর থেকে বিষ্ণুপুরে গৌড়ীয় বৈষ্ণবমতের ব্যাপক প্রচার ঘটে। এরপর বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত রাসমঞ্চ তাঁর হাতেই তৈরি হয়। রোদে পোড়ানো ইটের ওপর টেরাকোটার কারুকাজ করা এই মন্দিরটি আজ ইউনেস্কো সুরক্ষাবলয়ের অন্তর্ভুক্ত একটি জাতীয় স্থাপত্য। 
বলা হয় দীক্ষা গ্রহণের পর রাজা হাম্বীর বৃন্দাবন যাওয়া মনস্থির করেন। এরপর বৃন্দাবন থেকে একটি যুগলমূর্তিও নিয়ে আসেন। ভাবা হয়, আজও বিষ্ণুপুর মদনমোহন মন্দিরে সেই মূর্তিই পূজিত হয়ে আসছে। মতান্তরে বলা হয় প্রাচীন  মূর্তিটি বর্তমানে কলকাতায় আছে। যদিও বিশ্ববন্দিত টেরাকোটা শিল্পের এই মন্দিরটি রাজা বীর হাম্বীরের মৃত্যুর প্রায় ৭৪ বছর পরে মল্লরাজ দুর্জন সিংহের হাতে নির্মিত হয়। পরে
রাজা বীর হাম্বীরের মধ্যে আমরা এক উচ্চমানের বৈষ্ণব পদকর্তাকেও দেখতে পাই। গৌরপ্রেমে মাতোয়ারা কবি বীর হাম্বীরের লিখিত পদ আজও গবেষকদের কাছে এক সম্পদ।
আজ তাঁর একটি বৈষ্ণব পদ দিয়ে বিষ্ণুপুরের পর্ব শেষ করব। ঘুরতে ঘুরতে এই পদটি রাসমঞ্চের পাশে রাজার গোশালার পাঁচিলের গায়ে চোখে পড়লো। এই পদ থেকে আমরা রাজধর্মের পাশাপাশি তাঁর বৈষ্ণব সত্ত্বায় নিজেকে সমর্পণ ও সাদামাটা জীবন সহজেই লক্ষ্য করতে পারব।

প্রভু মোর শ্রীনিবাস     পুরাইলা মনে আশ
তুয়া পদে কি বলিব আর।।
আছিলুঁ বিষয়-কীট      বড়ই লাগিত মীঠ
ঘুচাইলা রাজ অহংকার।।
করিথু গরল পান         রহিল ডাহিন বাম
দেখাইলা অমিয়ার ধার।।
পিব পিব করে মন       সব লাগে উচাটন
গোরা পদে বান্ধি দিলা চিত।।
শ্রীরাধা রমন সহ        দেখাইলা কুঞ্জ গেহ
জানাইলা দুহুঁ-প্রেম-রীত।।
কালিন্দীর কূলে যাই       সখীগণে ধাওয়া ধাই
রাই কানু বিহরই সুখে।।
এ বীর হাম্বীর হিয়া         ব্রজ ভূমি সদা ধেয়া
যাহাঁ অলি উড়ে লাখে লাখে।।

মেঘাশ্রী ব্যানার্জী

ঠিকানা

তোর ঠিকানা এখন মনে নেই
অণু পল সঙ্গে ছিলাম তোর,
বেলাশেষে ছুটির টিকিয় হাতে
অস্ত পানে ঝুঁকে ছিলিস তুই।।

ফিরে দেখার সময় কোথায় তোর?
অপেক্ষাটা আমার ভাগেই জমে
তুই তখন গোলক পারের দেশে
জাদু ছোঁওয়ায় জাগাস নতুন ভোর!

ওই পারেতে আছে আমার ঘর
যেথায় তোর নিত্য যাতায়াত;
নাড়ি ছেঁড়ার যন্ত্রণা তোর নেই
দুই আকাশেই বিলাস রবিকর।

ভারসাম্য

হাতে একটা লাঠি নিয়ে দড়ির উপর ছোট্ট ছোট্ট পা রেখে ব্যালান্স করে এগিয়ে চলে যে মেয়েটা তার অভ্যাস হয়ে গেছে ভারসাম্য।
সে জানে পদচ্যুতির খেসারতের চেয়ে অনেক দামি মোটা চালের গরম ভাত।

বম্ব স্কোয়াডের যে কর্মচারী সঠিক তারটা কেটে আজ নিশ্চিন্ত চওড়া হাসিতে ঢাকা দেয় আশঙ্কা  --
সে জানে আগামী কালের বিস্ফোরকে হয়তো তার মৃত্যুবাণ লুকিয়ে।

কে.সি. নাগের তেল মাখানো বাঁশের খুঁটিতে নিয়ত ওঠানামা আমার। পাটিগণিতের সূত্রে সন্তোষজনক উত্তর মিললে লাঠির শীর্ষে বাঁদরের পৌঁছনো শক্ত নয়।
আমি জানি আসলে মঞ্জিল অধরা!

আলো-আঁধার

ছায়াপাতে আলোর রূপে লাগে চাঁদের কলঙ্ক।
কেউ কি ভাবে ছায়ার উৎস আসলে আলোই?
পতঙ্গরা যুগে যুগে পুড়েছে আগুনের মুগ্ধতায়
তবু গনগনে সে আলোক শিখার ঔদ্ধত্যের জয় জয়কার।
প্রদীপের নিচের অন্ধকার আর আগুন মরা ছাই দুইই কলুষিত ভস্ম।
অন্ধকারের এই কলুষটুকুই আমার থাক


চুমকি ভট্টাচার্য

#কেক

তোজোর জন্মদিনে আজ সারা বাড়ি সেজে উঠেছে ফুল, রঙিন কাগজ আর বেলুন দিয়ে। সন্ধ্যেবেলা অতিথিরা এক এক করে আসতে শুরু করলেন। এত্ত বড় কেক কাটে তোজো।বন্ধুরা সেই কেক একটু খায়,আর বেশিরভাগটাই একে অপরের মুখে মাখিয়ে দেয়। খাবার ও কত রকমের- যার বেশিরভাগ ফেলা গেল। কমলামাসি সেইসব ফেলে  দেওয়া খাবার ইয়া বড় বিনব্যাগে পুড়ে ফেলে দিয়ে আসল রাস্তার ডাস্টবিনে।এখন অনেক রাত, তাও তোজো জেগে- জন্মদিনে পাওয়া উপহারগুলো একে একে দেখে সে। হঠাৎই কতগুলো কুকুরের ভয়ানক চিৎকার ও একটা আর্তনাদ শুনতে পেয়েই জানালার ধারে গিয়ে দেখে , নিচে রাস্তার ডাস্টবিনের পাশে তারই বয়সী একটা ছেলে কেকের টুকরো হাতে ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছে। তাকে ঘিরে রয়েছে হিংস্র কুকুরের দল।এরইমধ্যে পাপা গিয়ে ছেলেটাকে উপরে আনেন।রোগা ছেলেটাকে দেখে তোজোর বড় মায়া হয়।তোজো মনেমনে ঠিক করে, এরপরের জন্মদিনে এই ছেলেটার মতই সব বাচ্চাদের নিমন্ত্রণ করবে শুধু।

পিয়ালী বসু



আশ্রয়

১)
বাড়ি ফিরেই বোমাটা ফাটালো অত্রি , … তখন সন্ধে সাত’টা , বাইরের ঘরের টিভিতে গাঁকগাঁক করে চড়া দাগের সিরিয়ালটা চলছে , একঘেয়ে সন্ধেটাকে আরও এক পোঁচ একঘেয়ে করে ।

১ নং রাজবল্লভ স্ট্রিটের এই ঠিকানাটায় , টিপিক্যাল উত্তর কলকাতা হবার জন্য যা যা দরকার তার প্রায় সবটাই আছে । সদর দরজা পেরিয়ে ভিতরে আসা উঠোনের মাঝখানে কলতলা , তাকে ঘিরে দোতলায় যাবার শ্যাওলা পড়া চলতা ওঠা সিঁড়ি , আর তারও উপরে আগাছায় মোড়া ছাদ ।
একতলার ডানদিকের ঘরটার নিয়মমাফিক ভাড়াটে অত্রি , পুরো নাম অত্রি সেনগুপ্ত … লাইফ ইন্সিওরেন্সের দালাল । কমন দেওয়ালের ঠিক পাশের ঘরটায় একঘর ভাড়াটে ঘেঁষাঘেঁষি করে। কবে থেকে রয়েছে তারা কেউ জানেনা। বোধহয় দেশভাগের সময় থেকে ।

আজ সকালেই খবরটা পেয়েছে অত্রি , শোনার পর থেকে দুপুরের টিফিন গলা দিয়ে প্রায় নামেনি তার , তক্কেতক্কে ছিল , কখন বাড়ি গিয়ে খবরটা আহেরি কে দেবে । আহেরি … অত্রির তিন মাসের বিবাহিতা বউ । হেব্বি দেখতে ! ভরন্ত ফিগার … রাস্তায় বেরোলেই পাড়ার রকের গুলতানি করা দলটাও নড়েচড়ে বসে ।

(২)
—-
সকাল থেকেই ঝিরঝিরে বৃষ্টি । আকাশ অংশত মেঘলা … ছাদের কাপড়গুলি তুলে নিচে আসছিলো আহেরি । তখন বেলা প্রায় দুটো , শাশুড়িমা নিজের ঘরে আয়েশ করে দিবানিদ্রা দিচ্ছেন , হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো ।
এক – দুই – তিন … চতুর্থবার বাজার আগেই হুড়মুড় করে দৌড়ে যায় আহেরি ।

মিনিট পাঁচেক পর ফোন রেখে নিজের ঘরে যায় সে । কপালে আড়াআড়ি তিনটে ভাঁজ এতটাই স্পষ্ট যে , পাশের রাঙা কাকিমাদের বাড়ি থেকেও স্পষ্ট দেখা যাবে ।

বাবাদের জেনারেশানে একমাত্র সেজোকাকুই বেঁচে আছেন এখনো। বাকিরা সবাই মরে হেজে গেছে কবেই। সেজোকাকু অল্পবয়েসে সাঁতার কাটতেন , বাবার মুখেই শোনা আহেরির । এক ডুবে হেদুয়া এপার ওপার করতেন । তারা তখন বউবাজারের বাড়িতে , দুই শরিক ঘর , একসাথে ।

ভাবনার অতলে ডুব দেয় আহেরি । ‘কি করা উচিৎ এখন তার ? অত্রি কে বলবে কি ? ‘
.

(৩)
——
‘শালা ! সকাল থেকেই মেজাজটা খিচড়ে আছে । গত তিনরাত ধরে ঘষটানোর পরও একটা সুর বেরোয় নি । কোন মুখে যে পলাশ দা’র কাছে যাবে ? … ‘ এবারের পার্টির পেমেন্টটা বেশ হাই ছিল , অনেক বলেকয়ে রাজি করিয়েছিলো পলাশ দা কে অর্পণ , কিন্তু …

ধুস শালা ! নিজের উপরই বিরক্তি আসছে । এক ঝটকায় উঠে বারান্দায় আসে সে । সিগারেটে দু চারটে টান দিতে দিতে দৃষ্টি মেলে দেয় সামনে … ‘আহ ! যদি এমনই ভেসে বেড়ানো যেতো ! এমনই ইচ্ছেঘুড়ি হয়ে । ‘
.
এসআরএফটিআইতে সাউন্ড এঞ্জিনিয়ারিং পড়া শেষ করে কলকাতার মাটিতে পা রাখা তার বছর দুয়েক আগে । তারপর থেকে জুতোর শুকতলা খসিয়েও বলার মতো একটা কাজ জোটাতে পারে নি সে । এই অবস্থায় কি করেই বা ওকে আনা যায় বাড়িতে ? …
.
ডিপ্রেশনের আলগা ছায়াটা গেঁথে বসার আগেই গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে অর্পণ । স্টুডিওতে ঢুকে পড়ে । একবার আবার শুরু করা যাক । ভিকি বলতো , সকালে একটা নরম নরম ব্যাপার থাকে গলায় , যেটা বেলা বাড়ার সাথে সাথে থিতিয়ে পড়ে শেষ বিকেলে জাস্ট নুনের মতো ঝুরঝুরে হয়ে যায় । ভিকি সিং এসআরএফটিআইতে তাদের তিন বছরের সিনিয়ার ছিল । তুখোড় ছেলে ! তাইতো আজ কেমন গুছিয়ে বসেছে … একটা দীর্ঘশ্বাস আপনা আপনিই বেরিয়ে আসে অর্পণের বুক চিরে ।


ক্রমশঃ 

সঞ্জয় ঋষি

রবিবারের কবিতা


ভালো থাকার হলুদ পোষ্ট কার্ড নেই/
ঠিকানাও নেই...
#
বিষাদ ইনবক্স...



মা


বাবার মৃত্যুর পর মাকে একা থাকতে দেখি। দেখি চুপচাপ হয়ে গেছে ব্যর্থ প্রেমিকার মতো। দেখি সব ভুলে যায় ইদানীং। বাবার ছবি মায়ের ঘরে টানানো। ফুল দিয়ে রাখেন চরনের কাছে,সাথে ধূপকাঠি...নকুলদানা।
#
মায়েরা মূলত সেবা করতে ভালোবাসেন।
#
মায়েদের সেবায় ছবিও
জীবন্ত হয়ে ওঠে...


ধর্ম


পাখি উড়তে থাকলে সুন্দর লাগে
আর উড়তে উড়তে অদৃশ্য হয়ে গেলে
তাকেই কেউ কেউ শূন্যতা বলে।
#
আসলে এ তো শূন্যতা নয়
আবার হারিয়ে যাওয়াও নয়
#
এ হলো পাখি ওড়ার ধর্ম।


চিত্র - জয়ন্ত চক্রবর্তী 

সবুজ বাসিন্দা (সুপম রায়)


মেকলোনি



একটি ছেলে
মেঘেদের ভেতর গলি দিয়ে
খবরের কাগজ নিয়ে ছোটে

একটি মেয়ে
বুকে তার ওড়না খেলা করে
চুলে তার রজনীগন্ধা ফোটে

একটি ছেলে
হাওয়াতে স্তব্ধ রাখে গতি
আকাশে উড়ায় প্রজাপতি

একটি মেয়ে
কপালে সূর্য-আলো জ্বালায়
দুচোখে রঙীন স্বপ্ন বানায়


রেড মুন



সূর্যাস্তের শেষ আলোটাই সঙ্গী তখন ।
পাহাড়ের বাঁ পাশের কাঁধ জড়িয়ে
আমি যখন মুসৌরি'র ঘন জঙ্গল ভেদ করে
ব্যোমকেশ চরিত্রে পৌঁছালাম,
দেখি, তোমার শরীরে কলঙ্কের
শেষ পেয়ালার চুমুক শেষ ।
তোমার লাল পোশাকি ঠোঁটে
ঠুমরির বিনয়ী মেজাজ নেই আর ...

আমার মধ্যবিত্ত আঙুলের ফাঁকে
হাই-ক্লাসিক সিগারেট,
মুখ থেকে বেরিয়ে আসে অভিজাত ধোঁয়া ---
এবং চাদর মোড়ানো কন্ঠের ভিতর-পথ বেয়ে
বিদেশী ওয়াইনের নিম্নগামী মিছিল বিস্মিত তখন ।

মোমের মৃদু আলোতে সুসজ্জিত
সুগন্ধময় ছায়ার বৃত্তে যে মানসীকে
জন্ম দিয়েছিলে প্রিয়া,
তাকে আমি আমার আকাশে
'রেড মুন' নামে চিহ্নিত করলাম ।
এখন আর খাদের ধারে দাঁড়াতে একা ভয় লাগে না ।


চিঠি


তোমার জন্য এমন একটা চিঠি লিখব
যার ইতি থাকবে না কোনও দিন ।
লেখাতে শ্যামল শস্যের দেশ উঠে আসবে ।
কৃষকের হাতের লাঙল,  গরুর গাড়ি,
মেয়েদের সুতোর কাজ, উনুনের ধোঁয়া উঠে আসবে ।
সন্ধ্যারতি, শাঁখের আওয়াজ, তেলের প্রদীপে পড়তে বসা কচিকাঁচাদের শব্দ উঠে আসবে ।
আম চুরি, যাত্রার নাটক, কাশফুল, পাখির ডাক
আর ফুটবল খেলার কথা ফিরে আসবে ।

আজকাল এমনও মনে হয় সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরাটা
তোমার দিকেই ঘোরানো আছে ---
আর আমি পর্দার পিছন থেকে এখন
                     সাদা-কালো ছবিগুলো দেখছি ।

ভাবছি, সংক্ষেপে কি লিখব!

মানসী গাঙ্গুলী



#অপেক্ষায়

     হেমন্তের পড়ন্ত এই বিকেলগুলো বড় মনখারাপ করা,কেমন নিঝুম নিঝুম ভাব।মনে হয় যেন জনশূন্য চারিধার,অন্ধকার নামে বড্ড তাড়াতাড়ি বিকালকে ক্ষণস্থায়ী করে।
     এই বিকালের সাথে কত সুখস্মৃতি তবু খেলা করে মধুর মনের মাঝে।প্রথম ভালবাসার পরশের রোমাঞ্চটুকু যে এই হেমন্তের হাত ধরেই এসেছিল তার জীবনে।ছাদে আকাশপ্রদীপ জ্বালতে গিয়ে নাগাল পাচ্ছিল না যখন,সুমন্ত এগিয়ে এসেছিল সাহায্য করতে।তার হাতের ওপর হাতদুটো রেখে প্রদীপ ধরেছিল যখন,বুকের ভেতর দিয়ে শিরশির করে একটা কাঁপুনি বয়ে গিয়েছিল মধুর।সেই শুরু।তারপর কত সন্ধ্যে কাটিয়েছিল তারা আকাশপ্রদীপের দিকে তাকিয়ে,হাতে হাত রেখে।হালকা শীতের আমেজটুকু কেটে গিয়েছিল সুমন্তর উত্তাপে।
      গ্রামের বাড়ীতে নবান্নর উৎসবে দাদার বন্ধু হওয়ায় সুমন্তরও নিমন্ত্রণ ছিল।ভোরের আলো আঁধারিতে গ্রামের পথে পাকা ধানের শীষের দোলা দেখতে দেখতে মধুও সুমন্তর গায়ে আহ্লাদে ঢলে পড়েছিল সেদিন।হেমন্তের প্রথম শিশির পায়ে মেখে,হালকা ঠান্ডার আমেজে, নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছিল মধু সুমন্তর দুটি চোখের ছায়ায়।সুমন্ত ঘাসের ডগা থেকে শিশির ধার করে দু'হাত ভরে নিয়ে মধুর দু'গালে মাখিয়ে তার গালে গাল রেখেছিল সেদিন দু'হাত দিয়ে আদর করে জড়িয়ে ধরে।
     ঠিকানা না রেখে হারিয়ে গেছে সুমন্ত।কত হেমন্ত পার হল তার পর।মধু আজও তার অপেক্ষায়।

রীনা রায়



তিস্তারা স্বপ্নটুকু অন্ততঃ দেখার স্বাধীনতা যদি পেতো

''তিস্তা''
*******
পুতুলটা দেখ মা, কত সুন্দর বটেক.... মা, দেখ কেনে না....
উসব ঐ বাবুদের বিটিছেলেদের লগে--তুয়ার লগে অন্য কিনে আনবক রে মা......
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখে তিস্তা.....
তার মা সাধ করে তার নাম রেখেছিলো 'তিস্তা'।
ভারী পছন্দ তার নিজের নামখানা, ঠিক বাবুদের বাড়ীর মতো!
বাবুদের বাড়ীর মতো নামটো তার হইত্যে পারে, আর পুতুলটা কেন হবেক লাই?
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সে স্বপ্ন দেখে পুতুলটাকে, তার সেই স্বপ্নের কথা বস্তির অনেকেই শোনে আর হাসে।  উয়ার বড়ঘরের বিটি হইবার সাধ হইনছ্যে রে তিতার মা...(তিস্তা, তাদের মুখে তিতা-ই হয়ে গেছে)

সেদিন, স্বাধীনতা দিবসে, গলির মোড়ে এলাকার বিধায়ক পতাকা তুলতে এসেছিলেন। বস্তিবাসী সকলকে নিজে লাড্ডু বিলি করেছিলেন, তারপর তার দীর্ঘ বক্তৃতা গোল হয়ে বসে সবাই শুনেছিলো..... দেশের,দশের কত কথা তিনি বলে গেলেন, মাথায় না ঢুকলেও সবাই বসে ছিলো, রান্নার ঝামেলা কারুর ছিলোনা, কারণ বিধায়কের সৌজন্যে দুপুরে সবাই পেটপুরে খিচুড়ি খাবে এমনটাই আশ্বাস পেয়েছে তারা। সবাই খুশীতে মশগুল ছিলো।

রাজুদা তিস্তাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো নির্মীয়মান ফ্ল্যাটবাড়ীতে, তার প্রিয় পুতুলটা তাকে দেবে বলে...
---------------
এখন আর সে তাকায় না কোনো পুতুলের দিকে, কেউ পুতুলের কথা বললে আতঙ্কে সে নীল হয়ে যায়, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে ওঠে......

শুভশ্রী সাহা



পিকনিক--

ইউক্যালিপ্টাস গেট, বটলব্রাশ হাসি,  আর  জ্যাকরান্ডার আভা  নিয়ে আদুরে বাগান বাড়ি টা আজ  পিকনিক রোদে মাখামাখি।। পুট্টুস ঝোপের পাশে বসেছে মস্ত উনুন। হাজারীবাগের লাল ধুলো আর পর্ণমোচী পাতা পেরিয়ে চার চাকা অভিজাত আম্বাসাডার ভারী পায়ে ঢুকে এলো  বাংলোর হাতায়।

-- কিহে,  আমার সুন্দরী শ্যালিকাটি কই ! জরি পাড় লুটোনো ধুতি আর তসরের খসখস ভাঁজের খৈয়াম পাঞ্জাবি! লপেটা ভাজের চোখ!  গুণগুনে আখতারি গজল
অমল কান্তি চোখ তুলে দেখলো  মাইকা কিং  সমরেন্দ্র নাথ সিংহ কে। অমলের পরমা সুন্দরী স্ত্রী  মঞ্জুলিকার জামাই বাবু।
-- আসলে আমি তো এদিক টায় ব্যস্ত বলে আর--
--বেনারসী পানের তবতবে জরির  খিলি মুখে পুরলো সিংহি মশাই,
--ওহে, শুধু ভাব জগতে বিচরণ করলেই হবে! বউ এর খবর সবরও রাকো! মঞ্জুলিকে না সামলাতে পারলে তো   আমাকেই দায় নিতে হয়!   হে হে হে! কচি শালী বলে কতা!  কি বলো!

-- অমল কান্তি চোখ নামিয়ে নিলো! ছি! ছি! রুপ বা অর্থ  থাকলেই কি রুচি হয়! সে এখন বুঝে গেছে মঞ্জুলিকা তার পাত্রের পানীয় নয়।  গেটের দিকে ফিরলো সে , অভ্যাগত রা আসা শুরু করেছেন একে একে! আজ রাঁচী আর হাজারীবাগের তাবত লোকজন অভ্র খনির গুলির একছত্র মালিক সমরেন্দ্র সিংহের অতিথি!

--শোনো ভাই, কাল যে শিকার করে বগারি গুনো মারলুম, সেগুনো কি কচ্চ শুনি! দাও, একটু স্কচ ফচ হোক! বুইলে ভায়রা,আজ রাতে গান শোনাতে যে আসবে না! আহা!  যমুনা রাই শেখাবত! কি চ্যায়রা মাইরি! নাজুক! অশ্লীল ভাবে চোখ মারল মাইকা কিং!
 আরেরর! কেয়া বাত! মহেন্দর সিং জী! আপ আ গয়ে, মেরা লাইফ ই বন গয়ে জনাব!!  এগিয়ে গেলো সমরেন্দ্র  হাজারীবাগের এস পির দিকে!

---- আহ! বগারি  পাখির বুক টা কি নরম! যখন মঞ্জুলিকা নবোঢা ছিল এমন ই ছিল তার কবুতরী বুক! সে সব তো কবেকার জ্যোৎস্না ময়  দিন--,শ্বাস ফেলল অমলকান্তি!

বারান্দা পেরিয়ে  সে রান্নার জায়গায় এলো। কেজি কেজি মাংস, শোন নদীর মাছ,  ফুলকপি, রাঁচির ক্ষীরের মিষ্টি, খান্দেলাল  চিৎকার করে বকছে,
-----  -----আরে ক্যা রে শালে লোগ! সোমর সিন বাবুয়া কা পিকনিক! থোড়িসি তো আলগ হোনা চাহিয়ে কি নহি রে!

আজ দিনটাই অন্য রকম!  ভোরের ভৈরবীর মত সাধন মার্গের। শীতের শুকনো খসখসে ভাব পেরিয়ে পিলুর মতো দরদিয়া কোমল নিষাদের বিস্তার। ঘুমিয়ে থাকা শৈশবের গায়ে এস্রাজের ছড়ের টান পড়ছে তার! মা বাবা কাকারা ফুল পিসি,  নায়েব কাকু,    বড় পাহারিয়া ঝোরার নিচের সেই সাদা কালো পিকনিক, পিসতুতো বোন  দীপাঞ্জলিকে  নিষিদ্ধ চুমু! 
 কি দরকার ছিল দীপাকে তার বোন হয়ে জন্মানোর!   পিসি বুঝতে পেরেছিলেন আর পিসেমশাই দিয়েছিলেন শাস্তি। বিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন দীপাকে দূর বহু দূর! সামান্য এক মুহূর্তের দুর্বলতার জন্য দীপা ভেসে গেছিল!  আর অমলকান্তি জীবনভর  থিতু হতেও পারেনি কোথাও। পিকনিকের এই  বিষাদের  সিপিয়া এফেক্ট সারা জীবন তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে!
 অমলকান্তি যে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল তার স্পর্শে।

আজ ও সেই আলোই! যে যাই বলুক,আবার এমন দিনেই যে রিক্ত নি:স্ব হতে হতে পূর্ণতা আসে! অমলকান্তিরা হাত পাতে দীপাঞ্জলিদের কাছে!  ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছা  করে সবাই কে। এমন কি মঞ্জুলিকাকেও!!

হাওয়াতে ভাসছে  ঘি আর গরম মশলার বাস! চার্চের দিক থেকে আসছে ক্যারলের ওয়েলকাম সং

সময় পালটে যায় নিয়মেই। তবু প্রত্যেক শীতেই  ফেরে বনভোজন, বোরোলিন দিন বুকে নিয়ে।


ছবি জয়ন্ত চক্রবর্তী 

ঝুমা চৌধুরী

#বৃষ্টি যখন (অনুভবে)

কি ভীষন শীত করছে।চোখ জ্বলছে খুব।বাইরে অবিরাম ঝমঝম।হ্যাংলা উঠান ভিজে যাচ্ছে।ভিজে যাচ্ছে কলতলার এক পাশে উল্টে রাখা বালতি টা।আর এক কোণে একা একা পড়ে থাকা তুলসী মঞ্চ।
আজ সন্ধ্যায় ওখানে প্রদীপ পড়েনি,শাখ বাজেনি।দুটো হাত বারান্দার গ্রিল ধরে উঠানের ধৈর্য মাপছে।জলের ফোঁটা তীরের মতো হাতে বিঁধছে।শরীরের তাপমাত্রা আরো কয়েক ডিগ্রি বাড়লো বুঝি!!!
ক্যালপলের পাতাটা নিয়ে নাড়াচাড়া করে যাচ্ছে হাত।নাঃ,নো মেডিসিন।বাড়তে থাকুক,আরো বাড়তে থাকুক।জ্বোরো গায়ের বেশ একটা আদুরে গন্ধ থাকে,মনে একটা ঘোর থাকে।আবোলতাবোল কথা জিভ ছুঁয়ে ফেলতে পারে সহজেই।
     মাঝে মাঝে একটা জলজ্যান্ত অসুখ খোঁজে মন।এমন অসুখ যেখান থেকে আর সুখি মানুষদের ছোঁয়া যাবে না।কতো মানুষের বাড়তি ভালোবাসার দাম দিতে হবে না!অধিকার হারানো অভিমান গুলো আর হারাবার ভয় পাবে না।অবজ্ঞা ছুঁতে পারবে না।উপেক্ষা মনবল ভাঙ্গতে পারবে না।হঠাৎ করে সামনে আসা ভয়ঙ্কর মানুষগুলো একগাদা অপমানের কালি ছিটিয়ে দিতে পারবে না।প্রতিদিন ঋণ শোধ করে যেতে হবে না কোনো এক ভোর ওঠা প্রসব যন্ত্রনার।এক ধাক্কায় দরজার ওপারে ছুঁড়ে ফেলা হাত গুলো আর  চেনা চেনা লাগবে না।লোভে মাখামাখি চাহিদার কাছে ওরা হেরে গেছে হয়তো!!তাতে কি?কোনো এক বাঁকে এসে স্রোতে হারিয়েছে খুচরো কিছু প্রেম,পরিত্যক্ত হয়েছে মান অপমানের নিত্তি মেপে। তাতে কি?তাই বলে কি বাঁচতে নেই!!তাই বলে কি খুশি থাকতে নেই!!তাই বলে কি ঠোঁটকে কেটে ছিঁড়ে রক্তাক্ত করে হাসি টুকু কেড়ে নিতেই হবে!!
জলের সাথে মিলে গলা দিয়ে নেমে চলেছে ট্যাবলেট।নরমাল টেম্পারেচার আর কিছুক্ষণের মধ্যেইইই।আবার একটা কবিতা নেবে আসবে আঙ্গুল বেয়ে,আবার একটা সেল্ফি আমার পিঠ চাপড়ে বলবে আমিইইই পারি।আমার বোকামো গাল টিপে দিয়ে বলবে "যার এক ফোঁটা রক্ত এতটাই মূল্যবান যে মাটি ছুঁলেই শরীর রক্তশূন্য হয়ে যায় তাকে বাঁচার জন্য অন্য কোনো হাত, অন্য কোনো বর্ণ,অন্য কোনো শব্দ খুঁজতে হয় নাকি!!"

ঠান্ডা হয়ে যাওয়া শরীরটা আবার আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।চোখের কোল ঘেঁসে কালি।তাতে কি!!!এখনো লালচে একটা ভালোবাসা আমার মন জুড়ে।শুধু অনুভুতিটুকু থাক!!

শব্দ গুলো নাইবা করুক দেখা,
বুকের ভিতর জমতে থাকুক ভীষণ ভালোবাসা.........

পিয়ালী বসু ঘোষ

জানালা _______
_______

ছোট্ট একটা জানলা ছিল তোমার
ছদ্মবেশী অতিথি  আমি
চোখ রাখতাম মাঝে সাঝে ...

তোমাদের জ্যোৎস্নার মতো প্রেম আমার লাগোয়া ঘরে আলো হয়ে ফুটতো
তুমি বললে সে নাকি আমার দিনগত সাফল্যের ব্যর্থ সাশ্রয় ....

আলোর ডুবসাঁতারে ঝলসে গেলো চোখ
আমার খেলার পুতুল টা বললো " মা,নিভিয়ে দেব আলো.....?"

আমি দুহাতে জানলাটা বন্ধ করে দিলাম
যেভাবে আমার মৃত বাবার স্থির চোখের পাতা দুটো আমার তির তির করে কাঁপা আঙুলে বন্ধ করে দিয়েছিলাম ....

একটা গোটা দুপুর দাঁড়িয়ে রইলো ঠায় গত জন্মের ওপারে
বৃষ্টি এসে বললো"  সহমরণে যাবে ?"
বললাম ,আমার তো হিমঘরেই বাস
চৌকাঠ মাড়িয়ে চিতায় উঠব কি করে ....

তার'চে শূন্যতায় কান পেতে আমার হৈমন্তী স্মৃতিকথার পান্ডুলিপিটা
ওই ফ্রেমবিহীন জানলায় রেখে
পুড়িয়ে দিলাম অনন্ত সর্বনাশ

চুপিসারে নিভে গেলো জমানো দীর্ঘশ্বাস ....


#চেনা_শব্দের_এসরাজ______


সেই যে একদিন আমি করমচা আলোয়
টুকটুকে লাল শাড়ি আর ভারী গয়নায় সাজিয়ে নিজেকে রোদ্দুর বানিয়ে ফেলেছিলাম

তুমি দেখে বলেছিলে "কাদম্বরী দেবী "

সেই রোদে এখন এসরাজ রেখেছি শুইয়ে ....
নির্জনে বেজে ওঠে ওর ব্যক্তিগত গূঢ় কামনা
আমি বড় অকারণে নীল অমৃতের মত রোদমেখলা পরি
প্রতারক বুলিরা পরাক্রান্ত স্বপ্ন প্রসব করে

অহংকারে টান লাগলে সলমাজরি সুজন ছায়া দেবে বলেছিলো
এখন তীব্র আলোতে মাখামাখি হয়ে আছে তার  'বেশ 'আর 'ছদ্মবেশ '
 ইন্দ্রিয়ে ইন্দ্রিয়ে ,অভিলাষী বর্ষণে যাবতীয় স্বরলিপি প্রতিবেদনায় গাঢ় হলে
সোনার নূপুর খানি ভেসে থাকে মায়াকাজলে

তুমি কেমন শিল্পী হয়ে উঠলে ধীরে
আলো ছায়া শিলুয়েটে বন্দী করলে ছাইভস্ম দিন
পরাঙ্মুখ নদীজলে ভেসে বেড়ালো তোমার বাসনাকুসুম
আর আমাদের অবহেলার আখ্যানমঞ্জরী

#সেইগল্প
_________
আজন্মের সেই গল্প পাঠ শেষ
নাকি হঠাৎ আঁধারে ডুব দিয়েছে বাউল দোতারা
এ গল্পের একমাত্র পাঠক শুধু তুমি
চরিত্রের ভিতরে ঢুকে কখন নিজেই মেঘপিয়ন হয়েছ
শরীরে জড়িয়ে নিয়েছ বিষ,নদী- অশ্রুধারা
কঠিন মাটির ফুটিফাটা বুকে,তখন বাটিকছাপ রোদ
গল্প ছিলনা বেশী বাকি আর . . .
অনিশ্চয়তার " সবুজ" জন্ম দেবে বলে,
সন্তানসম্ভবা মেঘ এসেছে তখন প্রসবের নিরিবিলি জায়গা খুঁজতে এক !

সম্বৃতা দাশরায়

#অসুর_উপাখ্যান
# সম্বৃতা দাশরায়

আকাশটা দেখেছেন ? কি দুর্দান্ত একটা ঝকঝকে লুক! দেখেই মন ভালো হয়ে যায় । সাদা তুলোর মতো মেঘেরা ভেসে যাচ্ছে । চারদিকে পুজো পুজো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে । থিমপুজো হোক বা সাবেকি , মন্ডপ শিল্পী,  প্রতিমা শিল্পীদের ব্যস্ততা তুঙ্গে । দুগ্গা মা আর তার ছানাপোনাদের ফাইনাল টাচ-আপ চলছে। পুজো সমিতির হোমরাচোমরা কর্তাদের নাওয়া খাওয়ার সময় নেই।   কাউন্টডাউনও শুরু হয়ে গেছে ঠিক আর কতদিন বাকি । ওদিকে   মা দুগ্গা বাপের বাড়ি আসবেন বলে প্যাকিং -এ  ব্যস্ত, এদিকে  অসুরবাহিনী ঠিক এসে পৌঁছে গেছে আগেভাগেই । না না মহিষাসুরকে তো মা নিজেই ধরে আনবেন  কিন্তু তার দলবল ? এই যেমন  ধরুন হঠাৎ হঠাৎ  কালো মেঘের দল হুঙ্কার ছাড়তে ছাড়তে আসছে আর তুমুল বৃষ্টির তান্ডবে সব  লন্ডভন্ড করে পালিয়ে যাচ্ছে ।এদিকে আপনি  ঝকঝকে ফটফটে আকাশ দেখে ছাতাটি সঙ্গে না নেবার কারণে ভিজে চড়ুইপাখিটি হয়ে বাড়ি ফিরছেন আর তেড়ে গাল পাড়ছেন বৃষ্টিকে। একে কি অসুর বলব না ? তান্ডবাসুর বলাই যায় অনায়াসে ।
               তারপর ধরুন আপনি যে রাস্তায় বাড়ি ফেরেন মানে যে রাস্তায় ফিরতে সুবিধা হয়,  পুজোর মাস পড়তে না পড়তেই সেখানে বাঁশেরা হাজির ! আহা অন্যভাবে নেবেন না , বলতে চাইছি যাতায়াতের রাস্তাটি বন্ধ করে প্যান্ডেল বাঁধা হচ্ছে তাই আপনাকে ঘুরপথে  ঘুরপাক খেয়ে আপিস যেতে এবং বাড়িতে ফিরতে হচ্ছে । এই পজ্জন্ত শুনে অনেকেই বলবেন আহা তা পুজোর জন্য এট্টুক কষ্ট তো করতেই হবে কিন্তু যদি আপনাকে জিগ্যেস করা হয় দেঁতো হাসি হাসলেও আপনি যে  এই সমস্ত বংশদন্ডদের  বংশাসুর ভাবেন এ আমি হলফ করে বলতে পারি। তাপ্পর আরেকটি ভয়াবহ অসুর হচ্ছে গিয়ে পুজো শপিং ,যার ফলে গিন্নির শাড়ি, খোকাখুকুর জামা ফ্রক, তদুপরি মাসি মেসো কাকা জ্যাঠা কাকিমা পিসিমা সবার পুজোর গিফ্ট কিনতে গিয়ে আপনার তো নাভিশ্বাস ওঠে বচ্ছর বচ্ছর।আজ্ঞে হ্যাঁ মশাইরা, এখনও বাঙালি বাড়িতে  দেওয়া থোওয়ার রেওয়াজ বহাল তবিয়তে বিরাজমান। প্রতিবার বাজেটে কাটছাঁট করার কথা ভাবেন আর হিসেব কষেন ,তারপরও কোন ম্যাজিকে যে  মগডালে খরচের খাতাটাএক লম্ফে উঠে পড়ে আপনি কিছুতেই ভেবে পান না। এই অসুরের নাম কি দেওয়া যায় সে আপনারাই ভেবে দেখুন।
আরও ছোটবড় অসুর আশেপাশে ঘুরে বেড়ায় এইসময় বুঝলেন। তা এরকম নানাবিধ অসুরের মধ্যে সবথেকে বিচ্ছিরি অসুর কোনটা বলুন তো ?  বলতে পারলেন না তো? জানতাম পারবেন না । যান একবার গিন্নিকে গিয়ে শুধোলেই বুঝবেন সে অসুরের নাম হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষাসুর !! এর  জ্বালা সবথেকে বেশি বোঝেন আপনার বেটার -হাফ ।  কারণ তাকেই ফুল রেস্পন্সিবিলিটি ঘাড়ে নিতে হয় কিনা। মহিলাকুল ঘরের চাকরি বা পরের চাকরি যাই করুন না কেন , এই অসুরের হাত থেকে তাদের নিস্তার নেই।  আহা গো, বেশ ছিল পাতি খুকুর দল , ছোটবেলায়  কালী পুজোর পর স্কুল খুললে হাফ-ইয়ার্লি পরীক্ষা দিত।দূর্গা পুজোর আগে নাচতে নাচতে মার্কেটিং  (তখন শপিং বলত না কেউ এবং কেনাকাটার পর মোগলাই, কবিরাজী মাস্ট  ) , নৃত্যনাট্যের রিহার্সাল (পাতি খোকাদেরও ছিল নাটক ), ফুচকা চুরমুরে পুজো আসার আনন্দ কাকে বলে তারাই বুঝেছিল আর এখন ? সন্ধি সমাস , পানিপথের যুদ্ধ,  এনার্জি ,অ্যালার্জি উফফফ ! দয়াও হয় না ইশকুলগুলোর একটু। সারাটা মাস পরীক্ষাসুরের মোকাবিলা করতে করতে  কত ঢাকাই,বমকাই, গাদোয়াল, ঘিচা হাত ফসকে গেল  । ডিজাইনার কুর্তি, মানানসই কানের দুল , গলার ফুল,  সব একে একে সেইসব সৌভাগ্যবতীদের ব্যাগজাত হয়ে চলেছে যারা কিনা ছেলেপুলেগুলোকে কলেজে পুরে দিয়েছে নাইলে আপিসে । জানালা দিয়ে প্রতিদিন তাদের যাওয়া আর নানান সাইজের পোঁটলা নিয়ে ফেরা (বিধ্বস্ত অথচ স্বর্গীয় হাসি মুখে ) দেখেই বোঝা যায় কত  সরেস জিনিসপত্তর ঐ ঝোলার ভিতরে ! এ দুঃখু রাখি কোথায় বলেন তো।
  জানি জানি অতীতের পাতি খোকাদেরও এসব মনে হয় । কারণ কিছুটা হলেও এ অসুরকে সামাল দিতে তাদেরও ফিল্ডে নামতে হয় বৈকি । ভিড়েঠাসা মেট্রো বা বাদুড়ঝোলা মিনি , গলদঘর্ম হয়ে নীড়ে সব পাখিকেই ফিরতে হয় । তেমন তাবড় তাবড় সাবজেক্ট যদি পরদিনই আসন পাতেন তবে কোনও কোনও গিন্নি ঠিক কর্তাকে ভজিয়ে ভাজিয়ে কাজে লাগিয়ে দেবেন। প্রশ্নোত্তরের জটে ধরে যাওয়া মাথা ছাড়াতে টুক করে ঘুরে আসবেন ফেসবুকে। গিয়ে যখন দেখবেন কাশফুলের মাঝমধ্যিখানে পরীক্ষা সমাপ্তির আনন্দে মশগুল মা , শপিং করার ফাঁকে আড্ডা মারা  , ফিস্টি করা বন্ধুবর্গকে   তখন তার মনের অবস্থাটা ভেবে দেখেছেন কখনও? যাগ্গে যাক্ , ভেবে আর কি হবে। এ দুষ্টু অসুরগুলো আসবে যাবে , অস্তর শস্তর নিয়ে যুদ্ধুও করতে হবে।
 ভালো থাকবেন সকলে , আজ আকাশ ঝলমল করছে , যান বেরিয়ে পড়ুন । কাশফুলের বনে হারান অথবা শপিং মলের ভিড়ে।। পুজো ভালো কাটুক সক্কলের ।।💖💞

                           

শমিতা ওঝা

#বোধন

অনুগল্পঃ বোধন

শমিতা ওঝা


"ঠাম্মা! ও আমার বন্ধু!" বেশ চেঁচিয়ে উঠল নীল। এত জোরে যে ঠাকুর দালানে ঢাকের আওয়াজ, কাঁসর ঘন্টা আচমকা থেমে গেল সব। আলপনার চালবাটা হাতে মুখে লেপ্টে গেছে সোফিয়ার।ফর্সা মুখটা যেন অপমানের সিঁদুররাঙা হয়ে গেছে । ওড়নাটা বুকের ওপর আঁকড়ে,  মাথা নিচু করে পায়ের বুড়ো আঙুল ঘষছে মাটিতে।

নীলের বাবা পঞ্চপ্রদীপ হাতে কাঠ হয়ে আছে। কি অমঙ্গলের কান্ড হয়ে গেল ভেবে বুক ধড়পড় করছে মেজ কাকিমণির।
ছোট পিসি তো বলেই বসল, "মুসলমান বন্ধু তো, পুজোর আল্পনা দেবার শখ যে কেন বুঝি না!" আজ ষষ্ঠী। মায়ের বোধন। এসময় এমন অনাসৃষ্টি!  বাড়ির ছেলেরা উশখুশ করছে, সোফিয়ার দুগাল বেয়ে চোখের জলের ধারা।.... ঠাম্মার হাতে কেড়ে নেওয়া চালবাটার বাটি।....  সবটাই যেন স্থিরচিত্র!

কয়েকটা মুহূর্ত কেটে যায়। লাল পাড়ে শাড়ির ঘোমটাটা মাথার উপর টেনে এগিয়ে আসে এবাড়ির সবচেয়ে আচারনিষ্ঠ, ধর্মপ্রাণ মানুষ, নীলের মা। সবাইকে অবাক করে দিয়ে, সোফিয়ার হাতে  মুখে লেগে থাকা আলপনার  চালবাটা, চোখের জল নিজের আঁচলে মুছিয়ে দিয়ে, শান্তভাবে বলে, "আয় মা, আমার ঘরের চৌকাঠে আলপনা দেওয়া বাকি,  তুই ছাড়া সে আলপনা এবছর কেউ দেবে না!"

এই প্রথম নীলের মা, বাড়ির বড়দের কথা লঙ্ঘন করল, এই প্রথম মায়ের ঘরে অহিন্দু মানুষ চৌকাঠ পার হল।
নীল চেয়ে দেখে মায়ের চোখে নতুন আলো, বোধনের ঢাক বেজে ওঠে। ঢ্যাম কুড় কুড়...  শব্দে ওর বুকে খুশির রেশ ছড়িয়ে পড়ে।.... বোধনের মন্ত্র আরম্ভ হয়... – “উত্তিষ্ঠ মাতঃ স্বগুণৈর্মহিন্না পুত্রান প্রবুদ্ধান কুরু নিজশব্জা।”....  মা তুমি এবার উঠ ইত্যাদি... দুর্গা মায়ের মুখটা এখন কি একটু বেশি উজ্জ্বল....!




ঋষেণ ভট্টাচার্য্য

#মনের_জানলা_ও_স্বপ্ন

#মনের_জানলা_ও_স্বপ্ন



স্বপ্নেরা রঙিন না সাদা কালো? প্রায়ই ভাবি, চোখের সামনে ছবি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি কিন্তু তা ঝাপসা স্বপ্নের মতোই মিলিয়ে যায় - বুঝতে পারিনা।

তিনটে স্বপ্ন আমি প্রায়ই দেখি৷ বহু বছর ধরে দেখে আসছি। একই স্বপ্ন, আমার মুখস্ত হয়ে গেছে স্বপ্নগুলো, তবু দেখি। কী জানি, কার্য কারণ হয়তো মনোবিদরা বিশ্লেষণ করতে পারবেন।

রাজস্থান বা মধ্যপ্রদেশে কিম্বা দক্ষিণ ভারতের কিছু জায়গায় যেমন বিশাল ধাপে ধাপে সিঁড়ি বাঁধানো চারচৌকো পুকুর দেখা যায় - মানে, চারধার থেকে ধাপ ধাপ সিঁড়ি নেমে গেছে একদম তলা পর্যন্ত, চারদিকই বাঁধানো, চারচৌকো আয়তাকার বা বর্গাকার পুকুর। সিঁড়ির একদম ওপরের ধাপের কোনো এক ধারে একপাশে একটা পাকুড় গাছ। অবশ্য পাকুড় গাছ আমি কখনো দেখিনি। জানিনা পাকুড় গাছ কেমন দেখতে, তবু পেয়ারা গাছের মতো দেখতে ওই গাছকে দেখলেই আমার মনে হয় পাকুড় গাছ।

ফাঁকা মাঠ কিম্বা ফুটিফাটা ন্যাড়া চাষ-জমি... আমি ধু-ধু প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছি... বেশ অনেকটা দূরে ওই পুকুর ধারে পাকুড় গাছ... ঘাঘরা চোলি কিম্বা লং স্কার্ট আর কুর্তি জাতীয় টপ পরে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাকুড় গাছতলায়... ওড়না কিম্বা বড় স্কার্ফে মাথায় ঘোমটা... মেয়েটি তাকিয়ে আছে পুকুরের দিকে... অ্যাতো দূর থেকেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ওর পায়ের কাছে একটা ছোটো ছোটো ফুলের ছাপ দেওয়া রুমাল পড়ে আছে... ওই রুমালটা আমি চিনি... আমি এগিয়ে যাচ্ছি পুকুরের কাছে আর মেয়েটি একধাপ একধাপ করে সিড়ি দিয়ে নামছে... পা কোমর কাঁধ মাথা একটু একটু করে অদৃশ্য হচ্ছে তার...

এতে ভূত প্রেতের কোনো ব্যাপার নেই। আমি সমতলভূমিতে থাকলে কেউ যদি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে, আস্তে আস্তে সে আমার চোখে অদৃশ্য হবেই। খুবই স্বাভাবিক।

আমি পুকুর পাড়ে পৌঁছে দেখি গাছ তলায় রুমালটা পড়ে আছে... মেয়েটি জলের কাছাকাছি শেষ ধাপে। গভীর পুকুরে অনেক নীচে জল... রুমালটা আমার বড্ড চেনা... কোথাও যেন দেখেছি... কিছুতেই মনে পড়ে না... আমি নিচু হয়ে রুমালটা কুড়োলাম... বেশ মিষ্টি গন্ধ... মাথা তুলে দেখি মেয়েটি অদৃশ্য... আমার অবাক লাগে... আদিগন্ত বিস্তৃত ফুটিফাটা ধু ধু চাষজমির মাঝে আমি একা... কেউ কোথাও নেই... আমি পাকুড় গাছতলায় বসলাম... মনে হচ্ছে একটু পরেই আবার দেখতে পাবো মেয়েটিকে...

এ স্বপ্ন আমি ক্লাস নাইন-টেন থেকে মাঝে সাঝেই দেখি। এখনো দেখি, প্রায়শই। জানিনা আর কত দিন দেখবো!

আমার দ্বিতীয় স্বপ্নটি নিয়ে এখনো ঘুমের ঘোরে আতঙ্কিত হই আর ঘুম ভাঙ্গলেই হাসি পায়।

আজ মাধ্যমিকের বাংলা পরীক্ষা... প্রশ্নপত্র দেখছি... কী সহজ সমস্ত প্রশ্ন... সবই তো আমার জানা... ভীষণ আনন্দ হচ্ছে... দারুণ নম্বর পাবো... খাতায় রোলনাম্বার টাম্বার লেখা হয়ে গেছে... হঠাৎ ঘরে ঢুকলেন যে স্কুলে পরীক্ষা দিতে গেছি, সেখানকার অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডস্যর... একটানে আমার হাত থেকে খাতা কেড়ে নিয়ে যিনি গার্ড দিচ্ছিলেন তাঁকে বললেন, এই ছেলেটার রোল নম্বর মার্ক করে রাখুন... এ ছেলে মেয়েদের স্কুলে সরস্বতী পুজোর কার্ড দিতে গিয়ে আমার মেয়েকে চোখ মেরেছিলো...  শেষ ঘন্টা পড়ার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে একে খাতা দেবেন... পাঁচ মিনিটই লিখুক... দেখি ছোঁড়া কেমন করে পাশ করে... এটাই ওর শাস্তি...
সবাই হুহু করে লিখছে... অনেকে পাতা নিচ্ছে... অনেকে কী সব ভেবে খাতায় কাটাকুটি করে আবার লিখছে... ঘর ভর্তি ছেলের মাঝে আমি প্রশ্নপত্র হাতে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছি... সবাই লেখার মাঝে করুণার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছে... আমি ফেল করবো... বাংলায় ফেল... আমার দরদর করে ঘাম হচ্ছে....
চূড়ান্ত আতঙ্ক, কিন্তু ঘুম ভাঙ্গলেই হাসি পায়। আজ এতো বছর পরও কেন মাধ্যমিকে ফেল করার ভয়ে স্বপ্ন দেখি, জানিনা!

তৃতীয় যে স্বপ্নটা প্রায়ই দেখি সেটা বড়ই করুণ।
আমার ক্লাস থ্রি কী ফোর... আমি স্কুলে যাচ্ছি... বাড়ি থেকে বেরোলেই রাস্তায় শুয়ে থাকা লাল্টু ছুটে আসে আমার দিকে... আমিও বিস্কিট ছুঁড়ে দিই... আজও ছুঁড়লাম... লাল্টু মাথা ঘুরিয়ে ছুটতেই ধাক্কা খেলো বাসের সাথে। দমাশ করে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লো উল্টো দিকের ফুটে... ওর শরীরটা থর থর করে কাঁপছে আর শুয়ে শুয়েই আমার দিকে তাকিয়ে আছে... আমার বাবা রাস্তার ওপারে ছুটলো... এখনো লাল্টু আমার দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়ছে... ও একটু বাদেই মারা যাবে... আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে... আমার বাবা বাড়ির ভেতর ছুটলো কাকাকে ডাকতে...  লাল্টুর জন্য ডাক্তার ডাকতে হবে...
সন্ধ্যে বেলা লাল্টুর শরীরটা ফুলে বেঢপ হয়ে গেছে... কিন্তু বাসের ধাক্কা খেয়েও একটুও রক্ত বেরোয়নি লাল্টুর... বড়রা সবাই বলছে হ্যামারেজ... ইন্টার্নাল হ্যামারেজ... আমি ভীষণ কাঁদছি আর আমার ঠাম্মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে...

যেদিন এ স্বপ্নটা দেখি, সারাটা দিন মনটা বিষণ্ণ হয়ে থাকে...

এছাড়াও কতো স্বপ্ন দেখি, কিছু ভুলে যাই, কিছু মনে পড়ে ঝাপসা ছবির মতো কোনো স্বপ্ন আবার মনে থাকে হুবহু। তেমনই এক স্বপ্ন দেখে একটি গল্প লিখেছিলাম একবার।
কিন্তু কোনো স্বপ্নই আর দ্বিতীয়বার দেখিনি কিম্বা দেখলেও মনে থাকেনা সেভাবে। কেবল এই তিনটি স্বপ্ন ছাড়া।

অবশ্য শুনেছি মানুষের মন যেমন কোনো কিছু চিন্তা না করে একদম ফাঁকা থাকতে পারেনা, তেমন কোনো রাতই নাকি বিনা স্বপ্নে কাটেনা। অবচেতন মনের চিন্তারা স্বপ্নে ফিরে আসবেই। একই স্বপ্ন কি সত্যিই আমরা দেখি? নাকি তাতে সামান্য হলেও পরিবর্তন থাকে? জানিনা, তবে সত্যিই অবাক হই একেকদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে!

ধন্যবাদ জানাই মেঘাকে (Megha Shree), এমন সুন্দর একটি বিষয় দেওয়ার জন্য।

স্বপ্নেরা রঙিন না সাদা কালো? প্রায়ই ভাবি, চোখের সামনে ছবি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি কিন্তু তা ঝাপসা স্বপ্নের মতোই মিলিয়ে যায় - বুঝতে পারিনা।

তিনটে স্বপ্ন আমি প্রায়ই দেখি৷ বহু বছর ধরে দেখে আসছি। একই স্বপ্ন, আমার মুখস্ত হয়ে গেছে স্বপ্নগুলো, তবু দেখি। কী জানি, কার্য কারণ হয়তো মনোবিদরা বিশ্লেষণ করতে পারবেন।

রাজস্থান বা মধ্যপ্রদেশে কিম্বা দক্ষিণ ভারতের কিছু জায়গায় যেমন বিশাল ধাপে ধাপে সিঁড়ি বাঁধানো চারচৌকো পুকুর দেখা যায় - মানে, চারধার থেকে ধাপ ধাপ সিঁড়ি নেমে গেছে একদম তলা পর্যন্ত, চারদিকই বাঁধানো, চারচৌকো আয়তাকার বা বর্গাকার পুকুর। সিঁড়ির একদম ওপরের ধাপের কোনো এক ধারে একপাশে একটা পাকুড় গাছ। অবশ্য পাকুড় গাছ আমি কখনো দেখিনি। জানিনা পাকুড় গাছ কেমন দেখতে, তবু পেয়ারা গাছের মতো দেখতে ওই গাছকে দেখলেই আমার মনে হয় পাকুড় গাছ।

ফাঁকা মাঠ কিম্বা ফুটিফাটা ন্যাড়া চাষ-জমি... আমি ধু-ধু প্রান্তরে দাঁড়িয়ে আছি... বেশ অনেকটা দূরে ওই পুকুর ধারে পাকুড় গাছ... ঘাঘরা চোলি কিম্বা লং স্কার্ট আর কুর্তি জাতীয় টপ পরে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাকুড় গাছতলায়... ওড়না কিম্বা বড় স্কার্ফে মাথায় ঘোমটা... মেয়েটি তাকিয়ে আছে পুকুরের দিকে... অ্যাতো দূর থেকেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ওর পায়ের কাছে একটা ছোটো ছোটো ফুলের ছাপ দেওয়া রুমাল পড়ে আছে... ওই রুমালটা আমি চিনি... আমি এগিয়ে যাচ্ছি পুকুরের কাছে আর মেয়েটি একধাপ একধাপ করে সিড়ি দিয়ে নামছে... পা কোমর কাঁধ মাথা একটু একটু করে অদৃশ্য হচ্ছে তার...

এতে ভূত প্রেতের কোনো ব্যাপার নেই। আমি সমতলভূমিতে থাকলে কেউ যদি সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামে, আস্তে আস্তে সে আমার চোখে অদৃশ্য হবেই। খুবই স্বাভাবিক।

আমি পুকুর পাড়ে পৌঁছে দেখি গাছ তলায় রুমালটা পড়ে আছে... মেয়েটি জলের কাছাকাছি শেষ ধাপে। গভীর পুকুরে অনেক নীচে জল... রুমালটা আমার বড্ড চেনা... কোথাও যেন দেখেছি... কিছুতেই মনে পড়ে না... আমি নিচু হয়ে রুমালটা কুড়োলাম... বেশ মিষ্টি গন্ধ... মাথা তুলে দেখি মেয়েটি অদৃশ্য... আমার অবাক লাগে... আদিগন্ত বিস্তৃত ফুটিফাটা ধু ধু চাষজমির মাঝে আমি একা... কেউ কোথাও নেই... আমি পাকুড় গাছতলায় বসলাম... মনে হচ্ছে একটু পরেই আবার দেখতে পাবো মেয়েটিকে...

এ স্বপ্ন আমি ক্লাস নাইন-টেন থেকে মাঝে সাঝেই দেখি। এখনো দেখি, প্রায়শই। জানিনা আর কত দিন দেখবো!

আমার দ্বিতীয় স্বপ্নটি নিয়ে এখনো ঘুমের ঘোরে আতঙ্কিত হই আর ঘুম ভাঙ্গলেই হাসি পায়।

আজ মাধ্যমিকের বাংলা পরীক্ষা... প্রশ্নপত্র দেখছি... কী সহজ সমস্ত প্রশ্ন... সবই তো আমার জানা... ভীষণ আনন্দ হচ্ছে... দারুণ নম্বর পাবো... খাতায় রোলনাম্বার টাম্বার লেখা হয়ে গেছে... হঠাৎ ঘরে ঢুকলেন যে স্কুলে পরীক্ষা দিতে গেছি, সেখানকার অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডস্যর... একটানে আমার হাত থেকে খাতা কেড়ে নিয়ে যিনি গার্ড দিচ্ছিলেন তাঁকে বললেন, এই ছেলেটার রোল নম্বর মার্ক করে রাখুন... এ ছেলে মেয়েদের স্কুলে সরস্বতী পুজোর কার্ড দিতে গিয়ে আমার মেয়েকে চোখ মেরেছিলো...  শেষ ঘন্টা পড়ার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে একে খাতা দেবেন... পাঁচ মিনিটই লিখুক... দেখি ছোঁড়া কেমন করে পাশ করে... এটাই ওর শাস্তি...
সবাই হুহু করে লিখছে... অনেকে পাতা নিচ্ছে... অনেকে কী সব ভেবে খাতায় কাটাকুটি করে আবার লিখছে... ঘর ভর্তি ছেলের মাঝে আমি প্রশ্নপত্র হাতে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছি... সবাই লেখার মাঝে করুণার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাচ্ছে... আমি ফেল করবো... বাংলায় ফেল... আমার দরদর করে ঘাম হচ্ছে....
চূড়ান্ত আতঙ্ক, কিন্তু ঘুম ভাঙ্গলেই হাসি পায়। আজ এতো বছর পরও কেন মাধ্যমিকে ফেল করার ভয়ে স্বপ্ন দেখি, জানিনা!

তৃতীয় যে স্বপ্নটা প্রায়ই দেখি সেটা বড়ই করুণ।
আমার ক্লাস থ্রি কী ফোর... আমি স্কুলে যাচ্ছি... বাড়ি থেকে বেরোলেই রাস্তায় শুয়ে থাকা লাল্টু ছুটে আসে আমার দিকে... আমিও বিস্কিট ছুঁড়ে দিই... আজও ছুঁড়লাম... লাল্টু মাথা ঘুরিয়ে ছুটতেই ধাক্কা খেলো বাসের সাথে। দমাশ করে ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লো উল্টো দিকের ফুটে... ওর শরীরটা থর থর করে কাঁপছে আর শুয়ে শুয়েই আমার দিকে তাকিয়ে আছে... আমার বাবা রাস্তার ওপারে ছুটলো... এখনো লাল্টু আমার দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়ছে... ও একটু বাদেই মারা যাবে... আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে... আমার বাবা বাড়ির ভেতর ছুটলো কাকাকে ডাকতে...  লাল্টুর জন্য ডাক্তার ডাকতে হবে...
সন্ধ্যে বেলা লাল্টুর শরীরটা ফুলে বেঢপ হয়ে গেছে... কিন্তু বাসের ধাক্কা খেয়েও একটুও রক্ত বেরোয়নি লাল্টুর... বড়রা সবাই বলছে হ্যামারেজ... ইন্টার্নাল হ্যামারেজ... আমি ভীষণ কাঁদছি আর আমার ঠাম্মা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে...

যেদিন এ স্বপ্নটা দেখি, সারাটা দিন মনটা বিষণ্ণ হয়ে থাকে...

এছাড়াও কতো স্বপ্ন দেখি, কিছু ভুলে যাই, কিছু মনে পড়ে ঝাপসা ছবির মতো কোনো স্বপ্ন আবার মনে থাকে হুবহু। তেমনই এক স্বপ্ন দেখে একটি গল্প লিখেছিলাম একবার।
কিন্তু কোনো স্বপ্নই আর দ্বিতীয়বার দেখিনি কিম্বা দেখলেও মনে থাকেনা সেভাবে। কেবল এই তিনটি স্বপ্ন ছাড়া।

অবশ্য শুনেছি মানুষের মন যেমন কোনো কিছু চিন্তা না করে একদম ফাঁকা থাকতে পারেনা, তেমন কোনো রাতই নাকি বিনা স্বপ্নে কাটেনা। অবচেতন মনের চিন্তারা স্বপ্নে ফিরে আসবেই। একই স্বপ্ন কি সত্যিই আমরা দেখি? নাকি তাতে সামান্য হলেও পরিবর্তন থাকে? জানিনা, তবে সত্যিই অবাক হই একেকদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে!

ধন্যবাদ জানাই মেঘাকে (Megha Shree), এমন সুন্দর একটি বিষয় দেওয়ার জন্য।

শৈবাল চক্রবর্তী

।। উচাটন ।।

                          শৈবাল চক্রবর্তী

(এক)

সিঁড়ির নীচে,  অন্ধকার কোনা থেকে,  ছোটো ছেলেটার প্রায় নিরুচ্চার কান্নার শব্দটুকুও এখন থেমে গেছে। সদর দরজার বাইরে তখন আগত সন্ধ্যার বিবিধ চাঞ্চল্য। বাতিস্তম্ভের ডুমো ডুমো লালচে আলোগুলো একে একে সব জ্বলে উঠেছে। বাড়ির সদরের মুখোমুখি ফুটপাথে, টাইমকলের সিংহমুখ থেকে জল তখনো তোড়ে পড়ছে। পাড়ার ছেলেরা রবারের ফুটবল পেটানো সাঙ্গ করে একে একে  হাত মুখ ধুয়ে জল খেয়ে নানা কথার ফোয়ারা ছোটাচ্ছে। সামনে পথে ঠুন ঠুন করে দু'চারটে রিকশাওলা সওয়ারি নিয়ে যাতায়াত করছে। শোনা যাচ্ছে কুলপি - মালাই গাড়ির বড় ঘন্টার ঠং ঠং শব্দ। গৃহস্থের ঘরে ঘরে বেজে উঠছে সন্ধ্যারতির শাঁখ।
দিনের অবসানে, আলো আর আঁধারের এই সন্ধিক্ষণে, সিঁড়ির নীচের সেই কোনে, নিরাবরন ছেলেটি তখন গুটিশুটি মেরে বসে, মশার কামড় উপেক্ষা করে, শুধু তার শ্রবণেন্দ্রিয়ে ভর দিয়ে পথে পৌঁছে গেছে। সাময়িক কষ্ট ভুলে মন তার ভেসে গেছে বাইরের শব্দ কল্পনায়।
এমন একটা সময়ে তাকে খুঁজতে খুঁজতে গুপির আগমন। সঙ্গে তার নিজের একটা প্যান্টুল আর গেঞ্জি। তাই দিয়ে অবশেষে ছেলেটির লজ্জা নিবারণ। তারপর গুপির সঙ্গে তিনতলায় ওদের ঘরে গিয়ে সাময়িক সুস্থিতি আর রাতে গুপির মা খাইয়ে দাইয়ে যখন নিজে সঙ্গে করে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসলেন, সেদিনের মত দু:স্বপ্নের যবনিকা পতন।

মারাত্মক অপরাধ কিছু করেনি সে। দিনটা ছিল রবিবার। বাবা সকালে কোথাও বেরিয়ে যেতে যেতে বলে গিয়েছিল -- " পূজো পূজো করে অনেক ফাঁকি হয়েছে। এবার মন দিয়ে পড়াশোনা কর। একদম চৌকাঠের বাইরে পা দেবে না "
ছেলেটা বোঝেনি।  বাইরে বেরোনো নিষেধ তাই দোতলায় ওদের ঘরের সামনে এক ফালি যাতায়াত পথ জুড়ে সে আর গুপি বিকেলে বল নিয়ে খেলছিল। সন্ধ্যার মুখোমুখি বাবা ফিরতেই সামনে পড়ে গেল। নিষেধের আক্ষরিক অর্থ না মানায় যে লাঞ্ছনা শুরু হল, তা শেষ হল তাকে পোষাকহীন অবস্থায় ঘরের বাইরে বার করে দিয়ে। মায়ের আটকানোর কোনো চেষ্টা ফলপ্রসু হল না। অগত্যা চুপিচুপি সিঁড়ির নিচের অন্ধকার কোনায় তার আশ্রয়।

দাদু অনেক আহ্লাদে তার নাম রেখেছিলেন সৌম্যসুন্দর। সকলের ডাকখোঁজের সমু। হাতিবাগানের ডালিমতলায় মামার বাড়িতে ছোটোবেলাটা বেশ কাটছিল। দাদু, দুই মামা, ছোটোমাসী সকলের মাঝে ছোটো বলতে ও  একাই তাই আদরের। মা চাকরি করত। বাবা থাকত না, মাঝে মাঝে আসত আর গম্ভীর মুখে মন দিয়ে পড়াশোনার কথা বলত। সমু তার মামা, দাদুর স্নেহে, প্রশ্রয়ে দিব্যি ছিল। কিন্তু  কোথা থেকে যে কি হল, তার বাবা এক দিন  মা ছেলেকে নিয়ে ডালিমতলা ছেড়ে এই বাড়িতে ভাড়া নিয়ে চলে এল। এই ব্যবস্থা নাকি খুব জরুরী, না হলে ছেলে মানুষ হবে না। আসার সময় দাদু নাতির চোখের জল মিলেমিশে একাকার। ছোটোমামা তখন শহরের বাইরে আর মেজমামা সে'দিন অভিমানে ইচ্ছে করে সামনে থেকে সরে রইল।

এলাকাটা উত্তর কলকাতার মানিকতলা অঞ্চলে। রাস্তাটার নাম-- ওয়ার্ডস ইন্সটিটিউশন স্ট্রীট। বাসা বাড়িটা পাড়ার মাঝামাঝি অংশে। তিন শরিকের বাড়ি। সমুরা ভাড়া থাকে ছোটো ভাই-এর ভাগে, দোতলার একটা ঘরে। আরো দুই ঘর ভাড়াটের সঙ্গে একসাথে পায়খানা, স্নানঘর ব্যবহার করতে হয়।
এবার আমূল পাল্টে গেল সমুর জগত। পালটে গেল রোজকার জীবন। এখন সক্কাল বেলা, লোকজন সবে মোটা পাইপ দিয়ে চাপাকলের গঙ্গাজলে রাস্তা ধুয়ে যেতে না যেতেই স্কুলে বেরিয়ে পড়তে হয় তাকে। সঙ্গে যায় নস্কর কাকু, বাবার ঠিক করে দেওয়া লোক। সে ছুটির পর দুপুরে নিয়েও আসে। ঘরে পৌঁছে দিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে রেখে যায় তাকে। সেই রকমই ব্যবস্থা। মা তো অফিসে। বাবাও কাজে বাইরে। মা বুঝিয়েছে, এই ছোটো বয়সে বাইরে এলোমেলো ঘুরে বেড়ালে শরীর খারাপ হয়, দুষ্টু লোক ভুলিয়ে নিয়ে যেতে পারে।  তাই সমুর জন্য থাকে ওই একটা  ঘরের চারটে দেওয়াল, তার একদিকে একটা জানালা, যে'খান থেকে শুধ বাড়ির অভ্যন্তরীণ সিঁড়িপথ দেখা যায়। আর একদিকে একটা ছোটো ভিতর বাড়ির বারান্দা, যার সামনে ডাইনে বাঁয়ে শুধু বার-বাড়ির দে'য়াল আর  উপরে এক চিলতে আকাশ।
মাঝে মাঝে বিকেলের দিকে দাদু দেখা করতে আসেন। সমু সিঁড়ি দিয়ে লম্বা মানুষটাকে দেখলেই ঘরের দরজার কাছে লাফিয়ে চলে যায়। অনেক কথা আছে দাদার সঙ্গে। অনেক অনেক প্রশ্ন জমে আছে।  তর যে আর সয়না। দেওয়াল ও   দরজার এপার ওপারে  দাদু আর নাতির  আলাপচারিতা দীর্ঘায়িত হয়েও হয়না বেশী লোক জানাজানির ভয়ে।
সমু ছোটো, তাই বোধহয় এই প্রাচীর  লঙ্ঘন করতে না পারার অক্ষমতাকে উজিয়ে নিজের মত করে বেঁচে থাকে কংক্রিটের খাঁচায়। স্কুলের দিনে তবু একরকম। ফিরে, খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে কিন্তু বড় ছুটি পড়লেই সমস্যা। তখন  নিজের সঙ্গী সে নিজেই। খেলা চলে ডান হাতের সাথে বাম হাতের, ডান পায়ের সাথে বাম পায়ের নিজের তোমার সাথে নিজের আমার। আর সঙ্গী আকাশবাণী -- একটা রেডিও, সঙ্গে একটা জলচৌকি, যেটাকে সে ঘরের একটা মাত্র জানালার ধাপিতে বসিয়ে রাখে।  বাড়ির সদর দিয়ে ভিতরে ঢুকেই সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি বেয়ে  যত লোক আসা যাওয়া, সবার সঙ্গে সমুর ওই চৌকিতে বসে যত কথা।
 শুধু সন্ধ্যা নেমে এলে অস্থির হয়ে উঠত ছেলে। মায়ের কোনোদিন ফিরতে দেরী হলে কখনো জানালায় লেপ্টে  সিঁড়ির গোড়ায় ঘোলাটে আলোয় ছায়া পড়ার অপেক্ষা, কখনো বিছানায় বসে বসে চোখ বুঁজে, দুটো হাত এক জোটে  মুঠো করে,  একশ, দু'শ, পাঁচশ গোনা। নাফুরন্ত সময় তখন উগরে দিত অশনি আতঙ্ক।
অথচ সমুর জীবন তো ঝরনার ঝোরা জলের মত  কলকল ছলছল ধারে বয়ে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু তা তো হল না। সময়ও থেমে থাকেনি। দিন, মাস, বছর ঘুরে ঘুরে যায়। শুধু পলি পড়ার মত জমা হতে থাকে বাবার ওপর অন্ধ রাগ, মায়ের ওপর অবুঝ অভিমান।
তারপর,এক দিন সমুর সব আগল ভাঙ্গে। সে ঘর ছেড়ে পালায়। মায়ের আলমারি থেকে দরজার বাড়তি চাবিটা সুযোগ মত সরিয়ে গুপিকে জানালা দিয়ে চাবিটা ফেলে দেয়। সঙ্গে নেয় আলমারি থেকে সরানো কিছু টাকা। তারপর নিরুদ্দেশ যাত্রা। বাসে করে শিয়ালদা স্টেশন। বিনা টিকিটেই হাতের সামনে নৈহাটি লোকালে চেপে তার শিকল ছেঁড়ার হাতেখড়ি।
এরপর সে বহুবার ঘর ছেড়েছে। বাবাও শেষে হাল ছেড়েছে, সব বাঁধন আপনিই গেছে খসে। শুধু সমুর মায়ের জীবন যন্ত্রনা বাড়তে থেকেছে। সময় সময় শরীর বিদ্রোহ করেছে। গোঁয়াড় স্বামী, অবুঝ ছেলে। এক অনিশ্চয়তার বাতাবরনে শরীর আর মন, একে অপরকে যেন পালা করে ভাঙ্গতে থেকেছে।

(দুই)

এরপর বয়ে গেছে কালের স্রোতস্বিনী। সমু আজ আর প্রায় নেই মানে ও নামে ডাকার লোক আর বিশেষ নেই। এখন সৌম্যসুন্দর বসু অফিসে কারো স্যার, কারো সৌম্যদা। নিজের বাড়ি করে চলে গেছে গড়িয়ায়, তাও বছর কুড়ি হল। সেখানে পাড়ায় সে সকলের বোসদা।

আজ পয়লা নভেম্বর। মায়ের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। সারাদিনের পারলৌকিক ক্রিয়াকলাপ মিটিয়ে  চুপ করে অন্ধকারে বারান্দায় বসে আছেন। ছেলে তার নিজের ঘরে কারো সাথে ফোনে ব্যাস্ত। স্ত্রী সুধন্যা স্বামীর পাশে বসে।                               আস্তে বললেন -- " একটু চা দেব?"
সাড়া না পেয়ে স্বামীর পায়ে ধীরে একটা হাত রাখলেন। অনুভুতিপ্রবণ মানুষটা গভীরে ডুব দিয়েছেন তাই চুপসাড়ে তাকে ছুঁয়ে বসে রইলেন।
অনেকটা সময় বয়ে গেলে সৌম্য ধরা গলায় বললেন -- " জানো সুধা, মাকে শেষে আর আমার বলা হলনা "
-- " কি? "
" কতবার ভেবেছি বলব তবু বলে উঠতে পারিনি। সেই যে'বার, বলেকয়ে চলে যাচ্ছি বাড়ি থেকে, মা আমায় কিছুতেই যেতে দেবেনা। আমার ক্লাস নাইনের ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। আমি হাত ছাড়িয়ে বেরিয়ে এলাম। "
-- " থাক, আমি জানিতো। অনেকবার বলেছ। তখন তোমার কিবা বয়েস "
-- " কিন্তু সুধা, আমার সে'দিনও  ভীষণ  কষ্ট হয়েছিল। আমি যাচ্ছি, মা পিছনে আসছে। আরো, আরো জোরে হেঁটে চলে গেছি। পাড়ার মোড় ঘুরে বাড়ির আড়াল থেকে দেখেছি, মা বহু দূরে হালছেড়ে নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে। ভীষণ কষ্ট সুধা, ছুটে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরতে চাইছিলাম কিন্তু আমার পা দুটো কিছুতেই ফিরল না সুধা.....কিছুতেই ফিরল না ! "
সুধার চোখ ভিজে ওঠে। মানুষটার এতটা বয়স হল, তবু শিশুর মত........ 
-- " নিজেকে ধ্বংস করে প্রতিশোধ নাকি ভেঙ্গে চলার নেশা, আজও বুঝে পাইনা।" সৌম্য বিড়বিড় করে বলতে থাকেন।  " কত দিন, কতবার ভেবেছি বলব মাগো, আমি চাইনি তোমায় কষ্ট দিতে, আমায় ক্ষমা কর অথচ দেখ, কিছুতেই আমার মুখ ফুটলো না। এই কথাটুকু এতদিনেও বলে উঠতে পারলাম না। "
সুধা নি:শব্দে ছুঁয়ে রইলেন পাশের মানুষটাকে।

বড় উচাটন মন নিয়ে রাতে শুতে গেলেন সৌম্য। ঘুম যেন আজ মহার্ঘ।  স্মৃতিরা ভিড় করে এসে তার অস্তিত্বের দখল নিতে চায়। সেইসব মেদুর আলোছায়া মায়াবী স্বপ্ন ছড়ায় গহীন চেতনে। একে একে ভীড় করে আসে আরো অনেক ভালবাসার জন। ভোর রাতে সবার শেষে মায়ের সাথে সৌম্যর দেখা হয়। মা এসে মাথার  কাছে বসে। চুলে বিলি কেটে দেয়। তার দু'চোখ টলটল করে।
-- " বাপ আমার, তোর কোনো দোষ নেই!  কিছু কথা থাকে যা বলা হয়ে ওঠেনা বাবা......কিন্তু আমি বুঝেছি, তুই না বলতে পারলেও তোর চোখ বলে দিয়েছে। " সৌম্যর মাথাটা কোলে নেন তিনি। কপালে, মুখে হাত বুলিয়ে দেন, ফিসফিসিয়ে বলেন --- " তোর ছেলেবেলাটা আমরা নষ্ট করে দিয়েছি। তোকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতে চেয়েছি মাপ কর, তোর অপরাধী আমি। মা হয়ে তোকে ঝড়ঝাপটা থেকে  আগলে রাখতে পারিনি বাবা!"
সমুর মা সৌম্যর চোখের জল মুছিয়ে দেয়। সৌম্য সমুর মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দেন।

এরপর, ভোরের স্নিগ্ধতা মেখে পরম সুখ ও শান্তিতে, সৌম্যসুন্দর তার মায়ের কোলে মাথা দিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেন।

তিমিরণ দত্তগুপ্ত




***ছাতা****
বাবা এই ঘর,সেই ঘর খুঁজেই চলেছেন।কিছুতেই পাচ্ছেন না।মুখে অস্থিরতা,একটা যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট।বারবার হাত উল্টে ঘড়ি দেখছেন।অফিস যাওয়ার সময় গড়িয়ে চলেছে।অথচ,জিনিষটাই পাওয়া যাচ্ছে না।আলমারির মাথা,জুতো রাখার তাক….কোথাও নেই।মা,আমি,দিদি আর পিসি হাঁ করে তাকিয়ে আছি।কারুর মুখে কোন কথা ফুটছে না।মা একবার মৃদুস্বরে বলেই ফেললেন,“থাক না এখন।বাইরে তো তেমন রোদ নেই।আজ না হয় না নিয়ে গেলে।কোথাও একটা আছে,আমি খুঁজে রাখবোখন”।

বাবা হাঁটু মুড়ে খাটের নিচে দেখছিলেন।ওইভাবেই ঘুরে মা’র দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে বললেন,“না নিয়ে যাবো?অসম্ভব,এতদিনের অভ্যেস পাল্টাবো কীভাবে”?

ধমক খেয়ে মা পিসির দিকে আড়চোখে তাকালেন,“দিদি আপনিই বলুন না”।

পিসি বার দু’য়েক বাবার দিকে তাকালেন।কিছু বলতে ভয় পেলেন বোধহয়।আন্দাজ করেই বাবা বললেন,“দিদি তুমি দয়া করে আর কথা বাড়িও না।জানই তো সব।ছাতা শুধু রোদ,জল আটকানোর জন্য নয়।একটা আশ্রয় বুঝলে।হাতে ছাতা না থাকলে কনফিডেন্স লেভেলটাই নষ্ট হয়ে যায়”।

বাবার একটা আদ্যিকালের কালো রঙের ঢাউশ ছাতা ছিল।আমার ধারণা ওটা কয়েক পুরুষের।দু’এক জায়গায় তাপ্পি মারা।অফিস,বাজার,এমন কি দিনের বেলায় অনুষ্ঠান বাড়িতেও বাবার সাথী।বেশ কয়েকবার দেখেছি ছাতাটা মাটিতে ভর দিয়ে বাবা বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন আত্মবিশ্বাসী মুখে।

আমি কোনকালেই ছাতা ব্যবহার করিনা।ছাতা নিয়ে বেরোলে হারানোর সম্ভবনা একশো ভাগ নিশ্চিত।এই নিয়ে বাবার অভিযোগের শেষ ছিল না।তবুও বলতেন,“খোকা বাইরে কড়া রোদ।ছাতা নিয়ে যাও।খোকা,

বৃষ্টি পড়ছে।জল মাথায় পড়লেই আর দেখতে হবে না”।

যথারীতি আমি শুনতাম না।আর,আমার ছাতা হারানোর বহর দেখে ধীরে ধীরে বকাবকিও বন্ধ হয়ে গেল।

গতকাল ছিল রবিবার।বাবা বাজার থেকে ফিরলেন এক হাতে ব্যাগ,অন্যহাতে ছাতা ঝুলিয়ে।ঘরের বাইরে একচিলতে জমিতে অন্য কয়েকটা গাছের সাথে অযত্নে বেড়ে ওঠা একটা কদম ফুলের গাছ।ছুটির দিন বাবা ওখানেই একটা নিচু ডালে ছাতা ঝুলিয়ে রাখতেন।স্নানের সময় ওটা পরিষ্কার হতো।মাথার উপর মেঘলা আকাশ।থেকে থেকে একটা দমকা হাওয়া দিচ্ছে।গাছের ডালে মলিন কালো ছাতাটা দেখে মনে হল,অনেক রোদ-বৃষ্টির গল্প নিয়ে এখন ঘুমোবে।

আমি ক্লাবে আড্ডা দিতে যাচ্ছিলাম।হাত বাড়িয়ে বাজারের ব্যাগ নিতে যেতেই বাবা আঙুল দিয়ে ছাতাটা দেখিয়ে বললেন,“তুমি বরং ওটা নিয়ে যাও।বৃষ্টি আসতে পারে”।

আমি ব্যাজার মুখে ছাতাটা বগলে চেপে বেরোতে বেরোতে শুনলাম বাবা সহাস্যে বলছেন,“কোথাও ফেলে এসো না যেন”।

আমার স্বভাব যাবে কোথায়!সন্ধেবেলা ক্লাবঘর,বন্ধুর বাড়ি ঘুরেও সেই আদ্যিকালের ছাতা পাওয়া গেল না।বাবার ভুলো মন।কখন আমাকে দিয়েছেন সে কথাও মনে নেই।

বাবা ব্যাজার মুখ করে খালি হাতে অফিসে বেরোনোর পর দিদি আমার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,“এটা নির্ঘাত তোর কাজ।”

সন্ধেবেলা বাবা থমথমে মুখে ঘর ঢুকলেন।চা নিয়ে এসে মা জিজ্ঞেস করলেন,“কী হয়েছে?”

“এই প্রথম অ্যাটেন্ডেন্সে লাল দাগ খেলাম”,বাবা সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন।

বাবার চোখে সবসময় একটা হাসি দেখতাম।আত্মবিশ্বাসী হাসি।দরজার আড়াল থেকে আজ সেই হাসিটা খুঁজে পেলাম না।ভীষণ এক অন্যমনস্কতা এবং বিষণ্ণতা মাখানো মুখ।বেশিক্ষণ সেদিকে তাকানো যায় না।একটা ছাতা হারালে মানুষ এত সর্বশান্ত হয় জানতাম না।মা দরজার দিকে ফিরে আমায় ডাকলেন,“আয় না।”

আমি দোকান থেকে বাবার জন্য একটা নতুন ছাতা এনেছিলাম।রঙ্গীন,বাহারি ফোল্ডিং ছাতা।ভয়ে ভয়ে বাবার দিকে এগিয়ে দিতে নির্লিপ্তভাবে দেখলেন।তারপর আমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললেন,“তোমার দিদিকে দিও।ওর কাজে লাগবে।”

মা মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন,“তোমার সবেতেই বাড়াবাড়ি।ছেলেটা নিজে পছন্দ করে কিনে এনেছে।ব্যবহার করলেই হয়।”

বাবা দীর্ঘ করে নিঃশ্বাস ফেললেন।সামনের জানালা দিয়ে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন।তারপর একটা করুণ হাসি ঠোঁটের গোড়ায় ঝুলিয়ে বললেন,“এতদিন সংসার করলে।আর এইটুকু বুঝলে না?”

পরেরদিন অনেক খুঁজে কলেজস্ট্রীট থেকে ওইরকম একটা ঢাউশ,কালো,বাকানো কাঠের হাতলের ছাতা পেলাম।বাবা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন।বারকয়েক খুললেন,বন্ধ করলেন।আমরা দমবন্ধ করে বাবার মুখের দিকে চেয়ে রয়েছি।ছাতাটা বন্ধ করে আমার হাতে দিয়ে একটু হাসলেন,“টেবিলে রেখে দাও।কাল নিয়ে যাবো।”

পরের দিন খেয়েদেয়ে ছাতা হাতে নিয়ে অফিসে বেরোলেন।মা,দিদি হাসি হাসি মুখ করে দেখছে।পিসি হাতজোড় করে প্রণাম করে বললেন,“ঠাকুর,ঠাকুর।”

আমিও বাবার চলে যাওয়া দেখলাম।সেই ছাতা দোলাতে দোলাতে চকচকে জুতো পায়ে মশমশ করে আত্মবিশ্বাসী হাঁটা নয়।বগলে ছাতা নিয়ে সামনের দিকে একটু ঝুঁকে গলির মুখে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।

বাবার দুর্ঘটনার খবর পেলাম সন্ধের মুখে।রাস্তা পেরোতে গিয়ে গাড়ির ধাক্কা খেয়েছেন।ভিড় সরিয়ে সামনে গিয়ে দেখলাম উপুড় হয়ে পড়ে আছেন।থ্যাঁতলানো মাথা,হাঁ মুখের ফাঁক দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে।ডান হাতের মুঠোয় তখনও সদ্য কেনা ছাতার হাতল।

দিন কয়েক পরে শ্রাদ্ধের নিমন্ত্রণ করে ফিরছি।বেশ রাত হয়েছে।হবিষাণ্ণ খেয়ে খেয়ে শরীর দূর্বল।সকাল থেকেই মেঘলা আকাশ।কখনও সখনও এক-আধ পশলা বৃষ্টিও হয়েছে।বড় রাস্তার মুখ থেকে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরতে মিনিট পনেরো লাগে।রাস্তার বাতির ম্লান আলোয় ভাল করে কিছু দেখা যায় না।হঠাৎ করেই তুমুল বৃষ্টি নামলো।কাছাকাছি কোন রিক্সাও দেখতে পেলাম না।দৌড়ে সামনের বন্ধ দোকানের শেডের তলায় পৌঁছনোর আগেই ভিজে একসা।পরনের কোরা কাপড় ভিজে জবজবে,মাথা দিয়ে জল গড়াচ্ছে।ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতেই ঘাড়ের কাছে একটা তপ্ত নিঃশ্বাসের ছোঁয়া পেলাম।চমকে মুখ ঘোরাতেই দেখি কাঁচা-পাকা দাড়ি মুখে এক বৃদ্ধ।লম্বা,ঢাউশ এক ছাতা মাথার উপর মেলে বললেন,“এমন বৃষ্টিতে ছাতা ছাড়া কেউ বেরোয়।”

আমি কিছুক্ষণ হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম।এখানে আশ্রয় নেওয়ার সময় কাউকে দেখিনি।বললাম,“বৃষ্টি হবে বুঝতে পারিনি।”

হালকা অন্ধকারেও বুঝলাম ভদ্রলোক হাসলেন।বললেন,“কোন কিছুই কী আগে ঠিক করা থাকে।তবু প্রস্তুত থাকা ভাল।কখন কী হয়ে যায় কে জানে।ছাতা একটা আশ্রয়,হাতে থাকলেও বল ভরসা।চলো,তোমাকে এগিয়ে দেই।”

আমি বাধা দিয়ে বললাম,“না,না।তার দরকার নেই।বৃষ্টি থামলেই চলে যাবো।”

বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমার হাত ধরে টান দিলেন,“এই বৃষ্টি থামবার নয়।তোমার অশৌচ চলছে।বৃষ্টির জল মাথায় পড়লেই হলো।এখন একটু সাবধানে থাকতে হয়।”

বাড়ির সামনে আসতেই বৃষ্টি থেমে গেল।কদম গাছের তলায় একটা কাঠের বেঞ্চি।গাছের কয়েকটি পাতা পড়ে আছে।বাবা ওখানে বসে চা খেতেন।মেঘ কেটে গিয়ে চাঁদ উঠেছে।চাঁদের আলো ছেঁড়া মেঘের ফাঁকে মলিন হল সামান্য।কদম গাছের ছায়া যেন সামান্য হেলে বেঞ্চির উপর এসে পড়েছে।একটা কাঠবেড়ালি কদম গাছের ডাল বেয়ে উঠতে উঠতে একবার থমকে দাঁড়ালো।বৃদ্ধ ভদ্রলোক সেইদিকে তাকিয়ে ছাতা বন্ধ করে ভেজা কাঠের বেঞ্চিতে বসে অস্ফুটে বললেন,“বড় মায়া হে।ছেড়ে যেতে মন চায় না ।”

বললাম,“কিছু বললেন?”

“একটু জল খাওয়াতে পারো খোকা?”

‘খোকা’ ডাক শুনে একটু অবাক হলাম।বললাম,“ভিতরে আসুন না।”

ভদ্রলোক হাত তুলে মানা করলেন,“আগে মায়ের সাথে দেখা করে এসো।সদ্য বিধবা মা,তোমার পথ চেয়ে বসে আছেন।তুমিই তো এখন আশ্রয়।জল খেয়েই চলে যাবো,অনেকটা দূর যেতে হবে।”

ঘরে ঢুকে মাথা মুছে জল আনতে সামান্য দেরী হলো।বাইরে বেরিয়ে দেখলাম কেউ কোথাও নেই।কিছুক্ষণ আগেও বৃদ্ধ ভদ্রলোক এখানে এই কাঠের বেঞ্চিতে বসেছিলেন।ভেজা মাটিতে এখনও স্পষ্ট পায়ের ছাপ।অথচ,মানুষটিই নেই।আমার আসতে দেরী হওয়ায় বোধহয় অভিমান করে চলে গেলেন।ফিরে আসছিলাম।হঠাৎ চোখ গেলো কদম গাছের নিচু ডালের দিকে।দেখি একটা কালো,মলিন,ভেজা ঢাউশ ছাতা সেখানে ঝুলছে।ছাতাটা হাতে নিয়ে ঘরে এলাম।যদি ভদ্রলোক ফিরে আসেন কখনো।

আমার ছেলে ছাতা পছন্দ করে না।ওর সুন্দর রেইন কোট আছে।আমি এখন একটা লম্বা,কালো ছাতা নিয়ে বাজারে যাই,অফিসে যাই।বেশ আত্মবিশ্বাসী লাগে।মনে হয়,বাবার হাত ধরে হাঁটছি।

জয়তী রায়

মন এবং আমি
_______________________
             
___________________________
     মন এবং আমির দ্বন্দ্ব চিরকালের।
           প্রচলিত কথা আছে__আমার মন খারাপ।
                  আমার মন, ভালো। আমার মন, বেড়াতে চায়। আমার মন, ঝগড়া করতে চায়। ইত্যাদি ইত্যাদি।
  এমন নানাতর ব্যাপারে ___নিয়ে মানুষ খুব ব্যস্ত। আমি নিজেও কলকাতায় ফিরে আসার পরে, বেশ মন খারাপ করে থাকতাম। মনে হত, কিছুই যেন বুঝতে পারছিনা। কাউকে তেমন ভাবে আগে চিনতাম না, আর যাদের চিনতাম__তাদের ব্যবহার অচেনা ঠেকত। মজার কথা হল__যারা আমার কাছে কাউন্সিলিং করতে আসত, তারাই তখন স্বান্তনা দিচ্ছে __মন খারাপ করো না। সব ঠিক হবে।
    ডাক্তারের কি রোগ হবে না? মন নিয়ে পরামর্শ দিয়ে থাকি বলে, আমার মন , খারাপ হতে পারে না?
     এই হল সূত্রপাত। খুব রাগ হল নিজের উপরে। এই " মন " ব্যাটাকে ধরত চেপে। তার এত সাহস? নিজে খারাপ হয়, আবার শরীরকে খারাপ করে ? রাগ করতে গিয়ে দেখলাম, ___মন তো আমার হাতে নেই! মন আমার কথা শুনছে না! উল্টে আমি শুনছি মনের কথা। অর্থাৎ মন চালিত রোবট একজন আমি। রিমোট হাতে মন , প্রভুত্ব করছে, শরীরের উপর, দেহের অণু পরমাণুর উপর ।
       দুঃখ কষ্ট জীবনের অঙ্গ। সুখ দুঃখ__আলো আর অন্ধকার। মানুষ জৈবিক চাহিদা পূরণে সক্ষম হলে পরে শুরু হয় আবেগের চাহিদা। অন্তহীন সে চাহিদা।
   প্রেম করার, ঘুড়ি ওড়ানোর, মিথ্যা বলার, প্রতারণা করার, লেখার, আঁকার ___সহস্র আবেগ। এই আবেগের স্রোত বাধা পায় মাঝে মাঝে। কষ্ট হয়। আপনজন আঘাত করে__কষ্ট হয়। অফিসে, বন্ধুদের আড্ডায়__সব জায়গায়__কষ্ট লুকিয়ে থাকে বিষধর সাপের মত।
  ছোবলে ছোবলে রক্তাত্ব মন , বার্তা পৌঁছে দিতে থাকে মস্তিষ্কে। ব্রেনের হাইপোথ্যালামাসে সেই কষ্টের বার্তার আঘাতে, কিছু রাসায়নিক অনু , ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ে শরীরের বিভিন্ন অংশে।  আক্রান্ত করে হৃদপিন্ডকে। যার অবধারিত ফল __করোনারি হৃদরোগ।
      ডাক্তারী কচ্কচি র মধ্যে না গিয়ে, সহজ কথায় বলি, স্ট্রেস শব্দটা পৌঁছে গেছে মানুষের নিত্য জীবনে। খুব স্বাভাবিক। প্রতিদিনের জীবন কদর্য। বাস অটো খোলা রাস্তা নিজের গৃহকোণ__সদা শঙ্কিত মানুষ। সেইসঙ্গে রয়েছে, সম্পর্ককে নিয়ে দায়। তার থেকে চাপ। সোশ্যাল মিডিয়া খুলে দিচ্ছে হাজার জানালা। সেই জানালা দিয়ে আলো যেমন আসছে, তেমনি আসছে ঝড় বৃষ্টি তুফান। মোকাবিলা করতে করতে ক্লান্ত মানুষ।

    মন না মস্তিষ্ক __মানুষকে কে চালায়__এই কচকচির ঝামেলা অনেক। মন নিয়ে কথা বলি বরং। সোজা কথা হল, সাধারণ মানুষকে চালায় মন। আর এই বেয়াদপ মনকে লাগাম পরাতে পারেন যারা , তারা হলেন নমস্য ব্যক্তি। মহামানব।
   মনকে খুশি রাখো, আনন্দে রাখো__তবে শরীর ভালো থাকবে__হামেশাই বলে থাকে ডাক্তার। কিন্তু, খুশি থাকার উপায় আমরা খুঁজি বাইরে থেকে। ফেসবুক , বন্ধু, বেড়ান__এগুলোর উপর নির্ভরশীলতা বাড়তে থাকে। কোনো একজন প্রিয় মানুষের মুখ মনে করলে দিন বদলে যায়। মন ভালো থাকে।
  তাই কি? ভালো থাকবে কি? বাইরের বস্তুর উপর নির্ভর যদি করে আমার মনের ভালো থাকা__তবে সেই _মন__আমার রইল কি?
   একদম সেটা সঠিক উপায় না। ফেসবুক, প্রকৃতি, বন্ধু __সব থাকুক জানালা হয়ে কেবল। দরকার মত খুলব, দরকার মত বন্ধ করব। তাদের ছাড়া মন খারাপ করা চলবে না।
  সেটা কি সম্ভব? অবশ্যই সম্ভব। শুধু কতগুলো পরিবর্তন আনতে হবে যাপনে। সঙ্গী হতে হবে পজিটিভ। জীবনে লক্ষ্য থাকবে, লোভ না।
  জীবন এক রঙ্গমঞ্চ। কোটিপতি ফিল্মস্টারদের জীবনে ঝড় আসছে । কেউ নিরাপদ না। কেউ জানেনা পরবর্তী দৃশ্য কি হবে? জীবন শুধু মুহূর্তের মধ্যেই সীমিত। কাজেই কালকের কথা ভেবে লাভ আছে কিছু? যখন আমার হাতেই নেই কিছু।
  মন কে হাতের মুঠোয় আনা যাবে না। কিন্তু তাকে বোঝানো যাবে। অবুঝ মন , ওরে অবুঝ মন__শান্ত থাক। সুন্দর থাক। এত বায়না করিসনি বাপ। বেশি বাড়াবাড়ি করলে, দেব অন্ধকার ঘরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে।
তুই ঐখানে বসে ঘ্যানর ঘ্যানর করে যা। আমরা ভালো আছি। ভালো থাকব।

দেবাশিস মুখোপাধ্যায়

#বুধবারের_প্রবন্ধ_বিষয়_দেশভাগ

খণ্ডিত দেশ- কাদের জন্য?


নাড়ি ছেঁড়ার তীব্র যন্ত্রণা, ছুঁয়ে যায় জন্মান্তর,
ভাবী প্রজন্মে ঘনায় ছায়া, না চাওয়া জন্মদাগ।
দীর্ঘ্যশ্বাস আর চোখের জলে স্বাদ নোনতা রক্তের
কে চায় খন্ডিত দেশ? কাদের জন্য এই দেশভাগ?

বিষয়টাই এমন যে বের করে আনলো বহুদিন ভেতরে জমে থাকা, কবিতার কয়েকটি লাইন। দেশভাগটা আসলে কি? সেটাই আজ আলোচনার বিষয়। একটা এমন বিতর্কিত বিষয়, যা নিয়ে হাজার ঘণ্টা ডিবেট করা যায়, যায় নাট্যমঞ্চে দাঁড়িয়ে দর্শকের চোখে বন্যা নিয়ে আসা, বা রাজনৈতিক মঞ্চে দাঁড়িয়ে আব্রাহাম লিঙ্কনের দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করা “that these dead shall not have died in vain — that this nation, under God, shall have a new birth of freedom — and that government of the people, by the people, for the people, shall not perish from the earth.” Gettysburg’ 19th Nov’1863.

পিছিয়ে যাওয়া দরকার, অনেক অনেকগুলো বছর, একদুটো নয় প্রায় ৩০/৪০ লক্ষ বছর আগে যখন আফ্রিকা মহাদেশে অস্ট্রালোপিথেকাসরা বাস করত, দুপায়ে ভর দিয়ে হাঁটত তারা। আরো বেশকিছু পরে উদ্ভব হয় হোমো হাবিলিসদের। এরা প্রকৃত অর্থে মানবই ছিল, গাছের ডাল, পাথর দিয়ে বানাতো অস্ত্র, শিকার করত। তারও দশ লক্ষ বছর পরে মানে ১৫ লক্ষ বছর আগে আসে হোমো ইরেক্টাস। এইবার শুরু হয় তাদের এগিয়ে চলার পালা। অনেক উন্নত অস্ত্রের ব্যবহার, আগুনের ব্যবহার, আশ্রয়স্থল বানানোতে সক্ষম এই জাতিই প্রথম আফ্রিকা ছেড়ে ইউরোপ ও এশিয়া মহাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

এরও অনেক পরে বিবর্তনের মাধ্যমে আসে হোমো স্যাপিয়েন্স বা বুদ্ধিমান মানব। তাদের একটি উপজাতি নিয়ানডার্থালেরা ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়াতে বাস করত, এড়াই প্রথম নিজেদের জাতের মৃতদের কবর দেওয়া শুরু করে, কিন্তু আজ থেকে কুড়ি হাজার বছর আগে এরা বিলুপ্ত হয়ে যায়। আরেকটি উপজাতি বা বর্তমান মানুষেরা জন্ম নেয় ৪০ হাজার বছর আগে। এরা হল হোমো সেপিয়েন্স সেপিয়েন্স। এরাই আফ্রিকা, ইউরোপ, এশিয়ার সাথে সাথে, এশিয়া ছেড়ে আমেরিকা মহাদেশেও পৌঁছে যায়। এরা দীর্ঘ্যকায় ছিল, পায়ের তুলনায় হাত অনেক বেশি লম্বা ছিল। অস্ত্র ব্যবহারেও পটু ছিল এরা।

ধান ভাঙতে শিবের গীত গাইতে হচ্ছে এই কারণে যে, এই মানবেরা একদেশ ছেড়ে আরেক দেশে পা ফেলেছিল নিজেদের প্রয়োজনে। শিকারে স্বল্পতা, আবহাওয়ার পরিবর্তন, নিজেদের সংখ্যা বৃদ্ধি ইত্যাদি নানা কারণে এরা দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়াত। নব্যপ্রস্তর যুগের পরে, ধীরে ধীরে মানুষেরা গড়ে তোলে নিজেদের স্থায়ী বাসস্থান, গ্রাম, শহর, ভাগ হয় শ্রম। এই সময়কালেই জেরিকো ও চাতাল হুইউক সভ্যতা গড়ে ওঠে। মানুষ নির্ভর করতে শুরু করে কৃষি ব্যবস্থার ওপরে। 
এর পরে অনেক জল বয়ে যায় তাইগ্রীস ও ইউফ্রেতিসের অববাহিকায় (এখনকার ইরাক), মিশরের নীল নদের অববাহিকায়, অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমাংশে, সিন্ধু নদের অববাহিকায় একের পর এক গড়ে উঠতে থাকে মেসোপটেমিয়া, মিশরীয় ও সিন্ধু সভ্যতা আজ থেকে পাঁচ ছয় হাজার বছর আগে। কালের নিয়মে একে একে সেগুলি হারিয়েও যায়। মুছতে শুরু করে এইসব এবং আরো অনেক এমন সভ্যতার, যেমন, ইনকা, অ্যাজটেক, বাইজেন্টাইন, গ্রীস, রোমান ইত্যাদির সীমারেখাও। মানুষেরাই ধীরে ধীরে বিশ্বের বিশালতাকে টুকরো টুকরো করে তৈরি করতে থাকে একেকটি, আলাদা আলাদা দেশের উঠোন। যা আজকের প্রবন্ধের মূল আলোচ্য বিষয়।

শুধুমাত্র ঔপনিবেশিক মতবাদকে তোল্লা দেওয়ার জন্য, স্বীয় সম্মান খানিকটা হলেও বজায় রাখার খাতিরে, ১৭৭৬ সালের চৌঠা জুলাই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সাক্ষর হওয়ার পরও ব্রিটিশ সরকার তা গ্রহণ করতে অস্বীকার করায় আমেরিকায় লেগে থাকা গৃহযুদ্ধ চলতেই থাকে, দীর্ঘ্য ছয় বছর স্থায়ী হওয়ার পর ১৭৮৩ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র স্বাধীনতার স্বীকৃতি পায়। কিন্তু ভাঙনের খেলা চলতেই থাকে। আজ আমেরিকা কতগুলো খণ্ডে বিভক্ত তা হয়তো অনেকেই মনেও করতে পারেননা। আর একেকটা অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষেরা। তারা কি এই বিভেদের পক্ষে ছিলেন? গ্যাটিসবার্গের কবরখানায় মাটির নীচে শুয়ে থাকা সৈনিকরা, কি আজো জানে যে সে যেখানে শুয়ে আছে সেটা তার নিজের অঞ্চলই নয়।

একটা বড় দেশকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দেওয়ার আরো উদাহরণ আছে। স্পেন ও পর্তুগালের ঔপনিবেশিক থাবা থেকে মুক্ত হয়ে দক্ষিণ আমেরিকায় ভেনেজুয়েলা, কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, চিলি, পানামা, পেরু, বলিভিয়া, উরুগুয়ে প্রভৃতি দেশগুলো সবাই তাদের খানিকটা অংশ খুইয়েছে অন্য দেশের কাছে। সেই ভাগাভাগির ফল আজও দক্ষিণ আমেরিকার জনগণ ভোগ করছেন। প্রবল অনাবৃষ্টি, খরা, ইত্যাদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে কাতারে কাতারে মানুষ দেশ ছাড়ছেন।

আফ্রিকা মহাদেশে এই ভাঙনের ফলে এক দেশের খানিকটা জুড়েছে আরেকদেশে, কোথাও বা ভাগই হয়ে গেছে দেশ। অতীতের রোডেশিয়া ব্রিটিশরা ভেঙে উত্তর আর দক্ষিণে ভাগ করে দিয়েছিল ১৯১১ সালে, আজ যা জাম্বিয়া ও জিম্বাবুয়ে নামে পরিচিত, ভাঙ্গা হয়েছিল মরক্কোকেও পরের বছর, খানিকটা স্পেন খানিকটা নিয়েছে ফ্রান্স। এই ভাগাভাগির রাজনীতিতে, কেনিয়া, আলজেরিয়া, মালি, উগান্ডার ভাগ, দখল, ১৮৯৯ সাল থেকে শুরু হওয়া বু’ওর যুদ্ধে, শুধু ব্রিটিশ বা স্থানীয় শ্বেতাঙ্গরাই নয়, প্রাণ হারিয়ে ছিল হাজারো সাধারণ আফ্রিকান নাগরিক। কোনরকমে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর জীবন ধারনের প্রাচীন পদ্ধতি এমন ভাবে ধ্বংস হয়েছিল যে না খেতে পেয়ে মারা গেছিল আরো বহু লোক। যারা টিকে ছিল তাদের দিয়ে শ্রমিকের কাজ করানো হত, সেই ব্যবস্থাও ক্রীতদাস প্রথার চেয়ে খুব একটা ভালো ছিল না। আজো অ্যাঙ্গোলা, ইথিওপিয়া, সোমালিয়া, বারবার রক্তাক্ত হচ্ছে। মরছে মানুষ, ঝরছে লাল রক্ত, হ্যাঁ ওই কালো মানুষগুলোর শরীর থেকেও। আর একই রঙের রক্তের কিছু ঔপনিবেশিক দেশ আজো শ্বদন্তে খড়কে কাঠি দিয়ে ক্ষমতার লালসা খোঁচাচ্ছে।

ইউরোপের কথাই যদি ধরা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ও পরে ক্ষমতার লড়াই এমন একটা জায়গায় পৌঁছে যায় যে, পৃথিবীর তাবড় শক্তিগুলো নিজেদের পেশী বাড়ানোর কাজে ব্যবহার করে ছোট ছোট দেশগুলোকে। তাদের দখল করে, ভাগ করে, এক দলের সাথে আরেক দলের লড়াই লাগিয়ে দিয়ে, আখের গোছানোর কাজ করে যাওয়া বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলো যে অবস্থার সৃষ্ঠি করেছিল তার থেকে বেরোনোর রাস্তা আজো হয়নি। আজও তাই বসনিয়া, সার্বিয়াতে রাস্তায় আলপনা দেয় সেই লাল রক্তই। রাতারাতি এক বৃহৎ ক্ষমতাধর দেশ হয়ে উঠেছিল সোভিয়েত রাশিয়া। সারা পৃথিবী জুড়ে আগ্রাসনে পিছিয়ে ছিলনা তারাও। বিংশ শতকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটলে তার অধীনে থাকা ছোট ছোট দেশগুলো স্বাধীনতা ফিরে পায়। কিন্তু একই সাথে গৃহযুদ্ধের আবহ ঘিরে ধরে গোটা সোভিয়েত ইউনিয়নকে। সেই রক্তক্ষয়ী লড়াই আজো মাথা চাড়া দেয় মাঝে মাঝেই।

মধ্যপ্রাচ্যে বহু সহস্র বছর ধরে বসবাসকারী হিব্রুভাষী ইহুদীদের বাসভূমিতে কব্জা জমিয়ে রেখেছিল সম্মিলিত আরবদেশগুলি। ফিলিস্থিন নাম দিয়ে সেখানে উসমানীয় সাম্রাজ্য তৈরি করার পর বিতাড়িত ইহুদীরা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ও তার অনেক আগে থেকেই ইহুদী নিধনকে একটা মহৎ কর্ম হিসেবে মেনে নেওয়া তথাকথিত সভ্য জগতের কিছু অসভ্য মানুষ যে হত্যালীলা চালিয়েছিল তা আজ ইতিহাসের পাতায় কালো কালিতে লেখা আছে। ইহুদীরা জন্মায় এই প্রতিজ্ঞা নিয়ে যে তাদের প্রমিশড ল্যান্ডে তারা ফিরে যাবেই। সেইমতো ফিলিস্থিনে ফিরে যাওয়া শুরু করে বহু ইহুদী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘে বিষয়টি উত্থাপন করায় ১৯৪৭ সালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ফিলিস্থিনকে ভেঙে দুটুকরো করে আরব ও ইহুদিদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র গঠন করা হবে। এর মধ্যে থাকা জেরিজালেম নগরকে আন্তর্জাতিক শহরের মর্যাদা দেওয়া হবে কেননা, খ্রীস্টান ও মুসলমান, এই দুই ধর্মের মানুষদের কাছেই এটি পবিত্র নগরী।

আরবরা এই জাতিসংঘের এই প্রস্তাবে রাজী না থাকলেও, যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে নিয়ন্ত্রণ উঠিয়ে নেওয়ার সাথে সাথে, একই দিনে ডেভিড বেন গুরিয়ন, ইস্রায়েলের জাতির জনক তথা প্রথম প্রধানমন্ত্রী, স্বাধীন ইস্রায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা করেন। সম্মিলিত আরবশক্তি ইস্রায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে, কিন্তু দ্রুত ইস্রায়েল সেই সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করে, দখল করে নেয় আগের চেয়ে বেশি অঞ্চলও। জেরুজালেম শহরের কিছু অংশও তারা দখলে নিয়ে নেয়। ১৯৪৯ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্ততায় যুদ্ধের বিরাম ঘটে এবং ইস্রায়েল স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৬৭ সালে আবারো যুদ্ধের মেঘ ঘনিয়ে আসে। এবার ইস্রায়েল সম্পূর্ন জেরুজালেম দখল করে নেয় এবং ইস্রায়েলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে। আজো ফিলিস্থিনিদের সাথে, গাজা ভুখন্ডে বসবাসকারী নিরীহ মানুষদের প্রাণ যাচ্ছে এই দেশ দখলের খেলায়। ধর্মভিত্তিক স্থান নিয়ে বা ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাঙ্গাগড়ার রাজনীতি, পৃথিবীতে এই একটাই নয়, আসছি সে প্রসঙ্গে।

আরেক বৃহৎ শক্তিধর দেশ, আমেরিকা, তার মিত্র ফ্রান্সের তৈরি লাওস, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনাম এই তিন দেশের সম্মিলিতরূপ ইন্দোচীন, ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান দ্বারা দখল হয়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েছিল। সাম্যবাদী নেতা হও চই মিনের নেতৃত্বে ফ্রান্স থেকে ভিয়েতনাম স্বাধীন হিসেবে নিজেদের ঘোষণা করে। ফ্রান্স স্বীকৃতি না দেওয়ায় ১১৯৪৬ শাল থেকে ফ্রান্সের সাথে ভিয়েতনামীদের যুদ্ধ বাধে। দীর্ঘ্যস্থায়ি এই যুদ্ধের পর দিয়েন বিয়েন ফুর লড়াইতে ফরাসীরা পরাজিত হয়। স্বাধীন ভিয়েতনামকে উত্তর ও দক্ষিণ এই দুই ভাগে ভাগ করে দেওয়া হয়। উত্তরে সাম্যবাদীরা আর দক্ষিণে অ-সাম্যবাদীরা দেশ গড়ে তোলে। এরপরই শুরু হয়ে যায় গৃহযুদ্ধ। দক্ষিণ ভিয়েতনামের সাম্যবাদী গেরিলাদের সাথে যুদ্ধে আমেরিকাও জড়িয়ে পড়ে। ১৯৬৫ সালে আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার সম্মিলিত বাহিনীর সাথে গেরিলাদের যুদ্ধ শুরু হয়, কিন্তু গেরিলাদের যুদ্ধকৌশলের কাছে আমেরিকাকে পর্যুদস্ত হতে হয়। ১৯৭৩ সালে আমেরিকা তাদের দেশের জনগণের চাপে ও বাকি বিশ্বের চাপে সেনাপ্রত্যাহারে বাধ্য হয়। যুদ্ধ তবুও চলতে থাকে। শেষে ১১৯৭ সালে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হয়। দুই ভিয়েতনাম সাম্যবাদী সরকারের অধীনে একটি রাষ্ট্র হিসেবে জুড়ে যায়। অসংখ্য মানুষের মৃত্যু, শস্যক্ষেত্র ধ্বংস হয়ে চরম খাদ্যাভাব ইত্যাদির মধ্যেও অটুট থেকে ভিয়েতনামের এই কৃতিত্ব আজো অনেক দেশের কাছেই গ্রহণযোগ্য ইতিহাস।

এবার আসা যাক আমাদের নিজের দেশের কথায়। ভারত ভুখন্ড চিরকালই নানা জাতির আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়েছে। পাঁচহাজার বছরের বেশি পুরোনো এই সভ্যতাকে খন্ড খন্ড করে দেবার, লুন্ঠনের অভিপ্রায় নিয়ে শক, হূণ, পাঠান, মোগল, বিদেশি আরো নানা দেশের আক্রমণের ঢেউ একের পর এক আছড়ে পড়েছে এই ভুখন্ডে। তারা কেউ ফিরে গেছে স্বভূমিতে, কেউবা, এই দেশের মাটিকেই নিজের দেশ হিসেবে বেছে নিয়ে থেকে গেছে। বিভিন্ন সভ্যতা মিশেছে, গড়ে উঠেছে ধর্ম, রীতিনীতি, সংস্কৃতির এক মহা মিলনমেলা। কিন্তু তবুও সেইভাবে ভারতকে ভাগ করে দেবার কথা তেমন ভাবে ওঠেনি। প্রবল পরাক্রান্ত মুসলমান ধর্মের মোগল বাদশাহরাও হিন্দু মুসলমানকে পাশাপাশি মিলেমিশে থাকার ব্যাপারেই মত জানিয়েছিলেন।

এরপর, ইংরেজরা ব্যবসার কথা বলে এদেশে এসে, যখন ভারতবর্ষে তাদের অধিকার কায়েম করে বসল, তৈরি করল এক নতুন উপনিবেশ, তখন থেকেই বদলানো শুরু হল অনেক কিছুর। ভাগাভাগির মাধ্যমে বিপক্ষের শক্তি হ্রাস করার নীতিতে বিশ্বাসী ইংরেজরা, এইদেশের কিছু ক্ষমতালোভী মানুষের সাহায্যে দেশের সার্বভৌমত্বকে ভাগ করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। বেনিয়ার চাদর গা থেকে ফেলে দিয়ে গায়ে জড়িয়ে নিল ঔপনিবেশিকের নামাবলী। এই ব্যাপারটা নতুন নয়। পৃথিবীর ইতিহাস বলে, বেনিয়ার জাত ইংরেজরা এইভাবেই সারা পৃথিবীতে নিজেদের অধিকার কায়েম করেছে।

একে একে স্বাধীন রাজাদের, মোগল সাম্রাজ্যের দেউলে নিভতে শুরু করল প্রদীপ। নানা টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে, বিভিন্নভাবে প্রতিরোধ, গণআন্দোলনের রূপে নিজেদের অনীহা জানালেও, ঠিক সেঅর্থে বিপ্লব সংঘটিত হয়নি এই বিদেশি শাসনকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে। যথাযথ নেতৃত্বের অভাব, মানুষের মধ্যে তৈরি হওয়া ভীতি, সমস্ত ধ্যানধারণা সরিয়ে রেখে, নিজেদের ভারতবাসী ভেবে এগিয়ে পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে স্বাধীনতার দাবি সেভাবে জানানোই হয়নি। একের পর এক ভাইসরয়রা এসে তাদের মতো করে শাসন চালিয়েছেন ভারতভূমিতে।

এল, ১৯০৫ সাল, ভাইসরয় হিসেবে তার দ্বিতীয় কার্যকালে লর্ড কার্জন, ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে বড় প্রশাসনিক বিভাগ, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সীকে দ্বিখণ্ডিত করার আদেশ দিলেন। এই আদেশে তৈরি হল মুসলমান প্রধান পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশ, ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের জলপাইগুড়ি বিভাগ, এবং হিন্দুপ্রধান বঙ্গদেশ মানে সেকালের পশ্চিমবঙ্গের প্রেসিডেন্সী ও বর্ধমান বিভাগ, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও ওড়িশা রাজ্য। এবার অনেকদিন বাদে সেই ঝড় উঠল যা তদানিন্তন ব্রিটিশ শাসকেরা ভাবতেও পারেননি। পূর্ববঙ্গে যে সব জমিদারি ছিল তার বেশির ভাগের মালিক ছিলেন বাঙালি হিন্দুরা। তাদের প্রজা ছিল কৃষিকাজে নিযুক্ত মুসলমানেরা। এই ব্যবস্থাপনার ফলে হিন্দু উচ্চবিত্ত শ্রেণীকে বিহারী ও ওড়িয়াদের মাধ্যমে সংখ্যালঘু করে দেবার চক্রান্তের বিরুদ্ধে তীব্র রোষে ফেটে পড়েন সবাই। শুধুমাত্র জাতীয় কংগ্রেসের নেতৃত্বে সাধারণ অন্দোলনই নয়, এদিক সেদিকে সহিংস আন্দোলনেরও সূত্রপাত হতে লাগল। কলকাতা তখনো ভারতের রাজধানী ফলে সেখান থেকেই আন্দোলন সংঘটিত হতে লাগল। সরকারী অফিসে ডাকাতি, আধিকারিকদের হত্যা ইত্যাদিও চলতে লাগল একই সাথে।

ব্রিটিশদের উদ্দেশ্য যে ব্যর্থ হয়েছিল তা নয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গের আদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়ার মধ্যেই, হিন্দু নেতাদের এই বাড় বাড়ন্তে ভীত সন্ত্রস্ত ভারতের মুসলমান উচ্চবিত্ত সম্প্রদায় তাদের ভীতির কথা নতুন ভাইসরয় লর্ড মিন্টোকে জানায়। নানান নথীর সাহায্যে তারা বোঝাতে সক্ষম হন যে মুসলমানদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা দরকার। ১৯০৬ সালে ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ স্থাপিত হয়। ভারতীয় আর্যসমাজ সেসময় শুধু উত্তরভারতে গোরক্ষাকারী গোষ্ঠিগুলোকে সমর্থন করেনি, বরং মুসলমানদের ধর্মান্তরিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ব্রিটিশদের কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছিল। গোহত্যার প্রতিবাদে ও হিন্দি-উর্দু বিতর্ক নিয়ে এর আগেও ১৮৯৩ সালে জাতিদাঙ্গা লেগে যায়। বহু সাধারণ মানুষ হতাহত হয় সেই দাঙ্গায়। একদেশ ছেড়ে ভীত সন্ত্রস্ত মানুষেরা অন্য জায়গায় পাড়ি দিতে থাকেন শেষ সহায় সম্বলটুকু সাথে নিয়ে, সাথে নিয়ে দাঙ্গা, সম্ভ্রমহানির লজ্জা, সন্ত্রাসের তিক্ত অভিজ্ঞতা আর নাড়ির বাঁধন ছেঁড়া সুতীব্র যন্ত্রণা।

১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সময়, পুর্ববঙ্গের পক্ষে জোরালো সমর্থন ছিল সেখানকার মুসলমানদের, কেননা তারা ছিলেন সংখ্যাগুরু এবং রাজনৈতিক সুবিধালাভের সুযোগ তাদের সামনে এসেছিল, অন্যদিকে হিন্দুরা সেখানে সংখ্যালঘু হলেও বিরোধিতা করেছিলেন তাদের সম্পত্তি, ক্ষমতা ইত্যাদির কথা ভেবে। ব্রিটিশদের এই দাবার চাল নানা আন্দোলনের জন্য ভেস্তে গেলেও, ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করলেও, দেশ ভাগের একটা জমি কিন্তু তখন থেকেই তৈরি হয়ে গেছিল। ১৯৪৭ সালে বারবার ভোট নেওয়া হয়েছে, নানাস্তরে, প্রতিবারই বঙ্গভঙ্গের ব্যাপারেই সবাই সায় দিয়েছিলেন। ১৯৪৬ সালে কলকাতা, নোয়াখালি ইত্যাদি জায়গায় মারাত্মক জাতিগত দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার লোকের প্রাণ যায় সেই দাঙ্গায়। হিন্দু মুসলমান দুই জাতির মধ্যে বিভেদের দেওয়াল আরো শক্ত হয়।

বাংলার মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এই দেশভাগ যে শুধুমাত্র ধর্মীয় কারণেই হচ্ছে, এবং যেহেতু কল কারখানা, বিভিন্ন শিল্প ইত্যাদি পশ্চিমবঙ্গেই অবস্থিত, পূর্ববঙ্গ সেক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়বে, উপলব্ধি করে একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন, পূর্ব ও পশ্চিম বাংলা ভারত বা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত না করে একটি স্বতন্ত্র রাজ্য হিসেবে দেখা হোক। ভারতীয় মুসলিম লীগের জাতীয় নেতারা যারা একটি মুসলিম দেশের স্বপ্নে বিভোর ছিলেন তাদের অনেকেই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। যদিও মহম্মদ আলী জিন্নাহ এই প্রস্তাবের সুফল বুঝতে পেরে একে সমর্থন করেছিলেন। সেইসাথে বাংলা প্রদেশের প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতারা, নেজাজি সুভাষ চন্দ্র বোস, তার দাদা শরৎ চন্দর বোস, কিরণ শংকর রায় প্রমুখেরাও এই প্রস্থাবের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় বাধা আসে জাতীয় কংগ্রেসের নেতা জওহরলাল নেহরু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ইত্যাদির কাছ থেকে। বাংলার হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর নেতৃত্বে এই প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। এরপরে সোহরাওয়ার্দী তার প্রস্তাব ফিরিয়ে নেন। অবিভক্ত বাংলার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয় কিন্তু দেশভাগ এড়ানো এবং হিন্দু মুসলমানের একসাথে বসবাস করার ইচ্ছের শেষ চেষ্টা যে সোহরাওয়ার্দী এবং বাংলার কয়েকজন কংগ্রেস নেতা করেছিলেন ইতিহাস তার সাক্ষী থেকে যায়।

ইংরেজরা তাদের শাসনকালের শেষ পর্যায়ে, জাতিগত বৈষম্যের শেষ পেরেকটি পুঁতে দেয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট ভারত স্বাধীন হয়। সৃষ্ঠি হয় আরেকটি নতুন দেশ পাকিস্তান, ভারতের পশ্চিম অংশের খানিকটা এবং পূর্ববঙ্গ মিলে। উভয় দেশের মধ্যে এক বিরাট জনগোষ্ঠি এক জায়গা ছেড়ে আরেক জায়গায় যাওয়া শুরু করেন। বিভক্তিকরণের আগেই পাঞ্জাবে লেগে যায় বিশাল দাঙ্গা, তবুও একবছরের মধ্যে পূর্ব ও পশ্চিম পাঞ্জাবের অভিবাসন প্রক্রিয়া শেষ হয়। কিন্তু বাংলার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এত সহজ হয়নি। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে চলা অভিবাসন প্রক্রিয়ায়, ঘরবাড়ি, জমি জায়গা, সবকিছু ছেড়ে দেশ ছেড়ে অন্যদেশে পাড়ি দিতে হয় পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘু হিন্দুদের। চলে চরম অত্যাচার, খুনোখুনি, লুটপাট। সব হারিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ চলে আসে পশ্চিমবঙ্গে। শুরু হয় আরেক লড়াই। বেঁচে থাকার লড়াই।

ইংরেজরা যে সুযোগটা খুঁজছিল তা তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল তৎকালীন নেতারা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রাণ গেছে মুসলমান, হিন্দুর কিন্তু ব্রিটিশরা ছিল সুরক্ষিত। তারা মজা দেখেছে, কখনো মুসলিম লীগ কখনো কংগ্রেস দুদিকেই হাওয়া দিয়ে গেছে। এই সাম্প্রদায়িকতার আবহ যেন অটুট থাকে, সেই দিকে সবসময় নজর থাকতো তাদের। একের পর এক দাঙ্গায় প্রাণ গেছে হিন্দু মুসলমান উভয়েরই কিন্তু তখনো শাসনভার নিজেদের কাছে থাকলেও সঙ্গে সঙ্গে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়নি ব্রিটিশেরা, বরং উত্তেজনার পারদ আরো ওপরে উঠতে দিয়েছে।

মুসলিম লীগের নেতারা বা জাতীয় কংগ্রেসের নেতারা তখন যোগ বিয়োগ গুণ ভাগের খেলায় মত্ত। কে কতখানি ক্ষমতার অধিকারী হবে, কে কোন পদ নেবে সেই নিয়েই আলোচনায় বিভোর ছিল তারা। এই ভাগাভাগির খেলায় মত্ত থাকতে থাকতেই এল সেই দিন ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট। ভারত ভেঙে টুকরো হল। নেপাল ভুটান ইংরেজ শাসনের আওতায় আসেনি বলেই তাদের সীমা অবিকৃত থাকল। শুরু হল এক সীমাহীন অনাচার, অত্যাচারের দিনলিপি। সব হারিয়ে, সযত্নে সাজানো ঘরবাড়ি জমি জায়গাত পিছনে ফেলে কাতারে কাতারে মানুষ এক দেশের বেড়া টপকে শুধু একটু মাথা গোঁজার আশ্রয়ের সন্ধানে চলে আস্তে লাগল। নিরন্ন, নির্বসন, গৃহহীন মানুষগুলোর বুকে তখনো পদ্মার ঢেউ ছলাত ছলাত শব্দ করে চলেছে। চোখে ভাসে সন্ধ্যে বেলায় তুলসীতলায় জ্বালানো প্রদীপের আলো।

এতেই শেষ নয়। দিল্লী, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, কাশ্মীর, গুজরাত, রাজস্থান সবজায়গাতেই তখন শরণার্থীদের ভিড় উপচে পরছে। কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সমস্ত জেলা, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় আছড়ে পড়েছে সেই সবহারানো জনসমুদ্র। ধীরে ধীরে সেই অবস্থা কাটতে শুরু করল, কিন্তু আবারো পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ লাগল ১৯৭১ সালে। অজুহাত সেই একই। ধর্মের নামে হানাহানি তখনো ছিল, যা আজও আমরা প্রতিনিয়ত দেখে যাই আমাদের দেশে, বিদেশে, নানা জায়গায়।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ, গভীর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলাদেশের ওপরে। ঢাকা শহরে ও অন্যান জায়গায় হিন্দু মুসলমানদের এবং পূর্ববঙ্গে তখনো থাকা হিন্দুদের ওপরে তুমুল জঘন্য অত্যাচার শুরু করা হয়। বাংলাদেশের সদ্য রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে। প্রথমত নিজেদের সামান্য সম্বল নিয়ে লড়াই শুরু করলেও, ভারতের কাছ থেকে সাহায্য পেতে থাকে গেরিলা বাহিনী। একসময় পাকিস্তানী বাহিনী ঢাকা শহর দখল করে নিলেও ক্রমশ তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল। গৃহযুদ্ধের ফলাফল এভাবে বিরুদ্ধে যাবে তা ভাবতে না পেরে, এই যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই পাকিস্তান ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বিমান হানা শুরু করে দেয় ডিসেম্বর মাসে।

১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর, গভীর রাতে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যুদ্ধ ঘোষণা করেন। সুসজ্জিত ভারতীয় বাহিনী এই অপেক্ষাতেই ছিল। সর্বশক্তি নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভারতীয় বাহিনী চারদিক থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে আক্রমণ করে, পূর্বে ত্রিপুরা থেকে সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, উত্তরে কোচবিহার দিনাজপুর ইত্যাদি সীমান্ত থেকে দিনাজপুর, রংপুরের দিকে, পশ্চিম দিক থেকে বাহিনী যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর অভিমুখে আর আরেকটি বাহিনী মেঘালয় হয়ে ময়মনসিং ও জামালপুর অভিমুখে রওনা দেয়। এত দ্রুত ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তানী বাহিনী ও তাদের সাকরেদ বাংলাদেশী রাজাকারদের পরাস্ত করে যে তা কল্পনাতীত ছিল।

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর, নব্বুই হাজারের বেশি সৈন্য নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের কম্যান্ডার ইন চীফ নিয়াজী ভারতের কাছে আত্ম সমর্পন করতে বাধ্য হয়। যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়া যে মানুষের মনকে আটকাতে পারেনা, তা আজো দুদেশের সাহিত্য, আলোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে বারবার সামনে চলে আসে। অন্যদিকে পাকিস্তান সারা পৃথিবীতে আতংকবাদীদের পীঠস্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে এরই মধ্যে। ব্রিটিশদের দখলে থাকা বার্মা স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীন হয়েছে সিলোন বা বর্তমান শ্রীলঙ্কা। স্বাধীন হয়েছে মালদ্বীপ। কিন্তু এত কিছুর পরও কাঁটাতারের বেড়া মানুষের মনকে বেঁধে রাখতে পারেনি।

রাজনীতিবিদরা আসে, চলে যায়, যে যার নিজের আখের গুছিয়ে নেয়, সেই খেলা আজো চলেছে। পারলে আজো দেশটাকে আরো কয়েকটা ভাগে ভাগ করে দেয় তারা, দিয়েছেও। রাজ্যের সংখ্যা বেড়েছে বৈ কমেনি। দেশভাগ নামক কদর্য শব্দটা, আজো সেই আতঙ্কের বাতাবরণ সৃষ্ঠি করে। সকলের মধ্যে না হলেও অন্তত কিছু মানুষের মনে যারা সেদিনগুলো দেখেছিলেন। শুধু আমাদের দেশেই নয়, সারা পৃথিবীতেই একই অনুভূতি ছুঁয়ে যায় মানুষকে। আজো দেশভাগের নামে ক্ষমতালোভীদের পাশা খেলা চলছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে। ভুগছে, মরছে সাধারণ মানুষ।

আমরা সাধারণ মানুষরা শুধু প্রার্থনা করতে পারি যেন আর কোন দেশ এভাবে ভাগ না হয়। যেন মানুষকে নিয়ে রাজনৈতিক খেলা আর কেউ না খেলে। যেন কোন মায়ের কোল, স্ত্রীর স্বামী, শিশুদের বাবা মা যেন প্রাণ না হারায়।