কাটা ঘুড়ি
যুগান্তর মিত্র
একটা ঘুড়ি এসে লাট খেয়ে পড়ল ছাদে। আমার ছেলে বুচাই ঘুড়িটা দৌড়ে তুলে নিল হাতে। এক টুকরো সুতো ঝুলছে ঘুড়ির সঙ্গে। বুচাই বলল, বাবা, আমাদের ছাদে ঘুড়ি পড়েছে। এটা এখন আমাদের ঘুড়ি।
আমি নিজেও দেখেছি ঘুড়িটাকে নেমে আসতে। তবু ও ভাবছে ঘুড়িটার লাট খেয়ে পড়া ওর আবিষ্কার। আমি হাসিমুখেই ওর আবিষ্কারকে স্বীকৃতি দিলাম।
হুহ্, আমাদের ছাদ! হোটেলের ছাদকে আমাদের ছাদ বলিস না তো! মিলি হিসহিস করে উঠল। কথাটা ঠিকই বলেছে। এটা আমাদের ছাদ নয়। হোটেলেরই ছাদ। তবু ছোট্ট ছেলেটার কথার পৃষ্ঠে মিলির ছুঁড়ে-দেওয়া কথায় আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। আমরা বেড়াতে এসেছি দিঘায়। নিউ দিঘায় ‘সমুদ্রনীড়’ নামের একটা মাঝারিয়ানার হোটেলে এসে উঠেছি। আগেই বুক করা ছিল। সকালে এসে সমুদ্রের ধারে চলে গিয়েছিলাম। অনেকক্ষণ কাটিয়ে ফিরেছি দুপুরে। হোটেলের নীচতলায় রেস্টুরেন্ট। সেখানে দুপুরের খাবার খেয়ে ঘরে এসে একটু গড়িয়ে নিলাম। দুপুরে ঘুমোনো মিলির অভ্যেস। বুচাইকেও ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। আমিও এপাশ-ওপাশ করে একসময় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সবার আগে মিলির ঘুম ভেঙেছে। আর আমাকে ডেকে তুলে দিয়েছে।
ইস দেখো, আজকের বিকেলটাই মাটি হয়ে গেল। আকাশ কেমন কালো হয়ে গেছে!
সে তো হবেই। বর্ষার সময় এসেছি। এইসময় সমুদ্রের রূপ অসাধারণ হয়। চলো চলো, বেরিয়ে পড়ি।
না না। বুচাইয়ের ঠান্ডা লেগে যাবে।
রেন কোট আছে তো। চলো। দেখবে এইসময় সমুদ্র দেখতে দারুণ লাগে!
যেতে হলে তুমি যাও। আমি আর বুচাই যাব না। ওর ঠান্ডা লেগে গেলে তোমার আর কি? জ্বরজারি হলে সারারাত জ্বালাবে। তুমি তো ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোবে।
বুচাইয়ের জ্বরটর হলে আমি ঘুমোই ওভাবে, কথাটা ঠিক নয়। তবে মিলি একটুও ঘুমোয় না, সারারাত জেগে থাকে। আমার নামে যা বলল মিলি, তা পুরোপুরি ঠিক নয়। বেড়াতে এসে এই নিয়ে কিছু বললেই কুরুক্ষেত্র বেঁধে যাবে। বেড়ানোটাই মাটি হয়ে যাবে। তাই চুপ করে গেলাম। বেরোলামও না আর। অথচ ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মেঘ উধাও। আকাশ ফরসা হয়ে গেছে। মিলি বলল, বেরোনোর মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল। এখন না, সন্ধের পরেই বেরোব। একবারে ডিনার সেরে ফিরব। এসব ব্যাপারে মিলির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। ওর ইচ্ছেতেই ছাদে উঠে এসেছি আমরা।
ছাদ থেকে দূরের সমুদ্র দেখছিলাম। সমুদ্রজলের মুহুর্মুহু ঝাঁপিয়ে পড়ার শব্দ কানে আসছে। হু হু করে সামুদ্রিক হাওয়া এসে ভাসিয়ে দিচ্ছে ছাদ। কিছুক্ষণ পরেই একটা ঘুড়ি লাট খেয়ে ছাদে এসে পড়ল। ওটা যখন ভাসতে ভাসতে আসছে, তখনই আমার চোখে পড়েছিল। দূরের ঘোলাটে সমুদ্রের থেকে চোখ সরিয়ে আমি এদিক-ওদিক দেখছিলাম। কত হোটেল হয়ে গেছে। বিশ বছর আগে যখন প্রথম আসি, তখন এত হোটেল ছিল না নিউ দিঘায়। কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগত। এরপরেও একবার এসেছিলাম। তখনও এত হোটেল বা গেস্ট হাউস ছিল না। এখন একেবারে জমজমাট। এসব দেখতে গিয়েই কাটা ঘুড়িটা চোখে পড়েছিল। এটা যে আমাদের কাছাকাছিই পড়বে ভাবিনি। হাওয়ায় ভেসে যাবে ভেবেছিলাম।
ও বাবা। হোটেলটা তো আমাদের। ছাদও আমাদের। তাই না বাবা?
আমি হেসে মাথা নেড়ে বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ আমাদেরই। বুচাইয়ের কথায় আমার বেশ মজা লাগছিল। ছয় বছরের ছেলে। এর মধ্যেই যুক্তি দিতে শিখে গেছে। আমাদের হোটেল হলে ছাদও আমাদের হওয়ারই কথা। তার মানে ঘুড়িটাও আমাদের, এমন একটা যুক্তি খুঁজে নিয়েছে ও। মিলি ততক্ষণে ছাদের অন্যপ্রান্তে চলে গেছে।
আমাদের ঘুড়ি যখন, তাহলে রেখে দে। বাড়ি নিয়ে যাবি। দূর থেকে মিলির কথা ভেসে এল। ঘুড়ির মতোই লাট খেতে খেতে কথাটা এসে পড়ল বুচাই আর আমার কাছে। বুচাই চুপ করে গেল। মিলির ঘুড়ি নিয়ে যাবার কথাটা যে রাগ করে বলা, ও বুঝতে পেরেছে। কিছুক্ষণ থমকে থাকার পরে ধীরে ধীরে বুচাই ঘুড়িটার কাছে গেল। ঝুঁকে পড়ে তুলে নিল হাতে। আমি চুপ করে দেখে যাচ্ছিলাম ছেলের কাণ্ড। একটু এগিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে দেখল, তিন-চারটে ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে হোটেলের পেছনদিকের একচিলতে মাঠে। ওরা কাটা ঘুড়ি লক্ষ্য করে এসে বুঝে গেছে, এই ছাদের ওপরেই পড়েছে। ছেলেগুলো চিৎকার করে কিছু-একটা বলল ওকে। বুচাই ওদের দেখতে পেয়ে দু-হাতে ঘুড়িটা তুলে ধরল। অনেকটা ঘুড়ি ওড়ানোর ভঙ্গিতে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল ঘুড়িটা। দেখলাম, পাক খেতে খেতে খানিকটা ওপরে উঠে নামতে শুরু দিয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে ধরে ফেললাম ছেলেকে। এখনই ঝুঁকে পড়ে দেখবে জানি। ঠিক তাই হল।
আমরা দুজনে দেখছিলাম ঘুড়ির গতিবিধি। কিছুটা নেমে সোঁ করে গোঁত্তা খেল ঘুড়িটা। যেন স্বাধীনভাবে উড়তে চাইছে। সুতোর টানে উড়বে না আর। কিন্তু ঘুড়ির স্বাধীনতা বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না, যেমন আমাদের কারও স্বাধীনতাই বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। নীচের ইলেকট্রিক তারে আটকে গেল ঘুড়িটা।
জানো মাম্মাম, আমাদের ঘুড়িটা ছেড়ে দিলাম। কিন্তু তারে আটকে গেল। উড়ন্ত পায়রার ডানা ঝাপটানোর শব্দ বুচাইয়ের গলায়। তবে ‘আমাদের’ শব্দটা জুড়ে দিতে ভোলেনি দেখলাম।
আমাদের ঘুড়ি আবার কী? মিলি আবার বিরক্ত। আমাদের ঘুড়ি যখন, উড়িয়ে দিলি কেন? জাপটে ধরে রাখতে পারলি না বাপ-ছেলে মিলে? যত্তসব!
আহ্, ওভাবে বলছ কেন? আমরা বলি না আমাদের অফিস, আমাদের বাজার! সেইরকমই বলেছে ও। বুচাইয়ের মনখারাপে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করি আমি।
চুপ করো। আমাদের ছাদ! আমাদের ঘুড়ি! আমাদের আছেটা কি শুনি? না আছে বাড়ি, না আছে নিজের কিছু। মিলি আবার হিসহিস করে সাপের চেরা জিভে কথা ভাসাল।
মিলির রাগ যেন কিছুতেই যাচ্ছে না। এইসময় ও দিঘায় আসতে চাইছিল না। বলেছিল, বর্ষায় বেড়াতে গিয়ে কী লাভ? হয়তো হোটেলেই কাটাতে হবে। অন্য সময় চলো। আমিই জোর করেছিলাম। আসলে এইসময় চারদিন ছুটি ম্যানেজ করা সহজ। এখন অফিসে কাজের চাপ কম। তাছাড়া এইসময় আসার আরও একটা কারণ হল, বিষ্ণুদা হোটেল বুক করেছিল আসবে বলে। কিন্তু শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পড়ায় বেড়ানো ক্যানসেল করেছে। এদিকে হোটেলওলা টাকা ফেরত দেবে না। সাতদিনের আগে নাকি ক্যানসেল হয় না। তখনই আমাকে জিজ্ঞাসা করল যেতে রাজি কিনা। বসকে বলাতে ছুটিও মঞ্জুর হয়ে গেল। চলে এলাম এখানে। আমি শ্যামল দত্ত। হোটেলে আমার নাম বিপ্রদাস দত্ত। টাইটেল একই আছে, শুধু নামটাই বদলে গেছে। দত্তদার ছেলে আট বছরের। আমার ছেলের ছয়। ভাগ্যিস হোটেলের ম্যানেজার দত্তবাবু বলে সম্বোধন করছিলেন। বিপ্রদাসবাবু বলে ডাকলে আমি হয়তো ম্যানেজ করে নিতাম, কিন্তু বুচাই নিশ্চিতভাবেই গুবলেট করে দিত সব।
আমি একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করি। সেলস ওরিয়েন্টেড অফিস। তবে আমার কাজ অবশ্য ইন-হাউস, সেলসে নয়। অনেক অফিসের মতোই আমাদের অফিসে ক্যান্টিন ছিল না। টিফিন টাইমে বাইরে গিয়ে খেতে হত। কিংবা রামাশ্রয়কে বললে খাবার এনে দিত। সল্ট লেকের চার নম্বর ট্যাঙ্কের কাছে অফিস। এখানকার খাবারদাবারের দাম বড্ড বেশি। খাবার আনিয়ে নিলে অনেক খরচ পড়ে যায়। তাই নিজেই চলে যেতাম টিফিন খেতে। মুড়িমাখা বা একটু হেঁটে গিয়ে সস্তার হোটেলের কচুরি খেয়ে নিতাম। এইরকমই একদিন খেতে গিয়ে আলাপ হল মিলির সঙ্গে। আমাদের পাশের অফিসেই ও চাকরি করত। ওরটাও বেসরকারি। সেই আলাপ থেকে প্রেম। তারপর একসময় বিয়ের সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। আমি তখন সেই অফিস ছেড়ে অন্য একটা অফিসে জয়েন করেছি। বেতন অনেকটাই বেশি। আমার এখনকার অফিসেও ক্যান্টিন নেই, তবে মিলি টিফিন করে দেয়, তাই বাড়তি খরচের বোঝা টানতে হয় না।
ছোটবেলায় মা-বাবাকে হারিয়েছি আমি। মামাবাড়িতে মানুষ। মানুষ কতটা হয়েছি জানি না, তবে জীবনযন্ত্রণা বুঝেছি অনেক। গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার পরই মামা-মামি নিজের পথ দেখতে বলে দিলেন। আমিও চাকরির চেষ্টা করতে করতে পেয়ে গেলাম একটা। তারপর থেকেই ভাড়াবাড়িতে থাকি। মিলির বাড়ি থেকে আমার বৃত্তান্ত শুনে রাজি হয়ে গিয়েছিল। শাশুড়ি নেই, ননদ নেই। এমন ঝাড়া হাত-পা সংসারে মেয়ের বিয়ে দিতে আপত্তি করেননি ওঁরা। মিলির সামনের দাঁত উঁচু। পড়াশোনাও খুব বেশি করেনি। ঘরে বসে থাকলে মন অন্যদিকে চলে যেতে পারে, তাই একটা প্রাইভেট ফার্মে টেবিল ঝাড়ামোছা করা, চা করে দেওয়ার কাজে ঢুকে পড়েছিল। ফলে আমার মতো জামাই ওদের প্রত্যাশার থেকে একটু বেশিই।
বিয়ের দু-বছর পরেই আমি বলেছিলাম, এবার একটা ইস্যু নিয়ে নিই মিলি। কিন্তু কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। এত তাড়া কিসের? আরও বছর তিনেক চাকরি করলে আমি হয়তো একটা ভালো পজিশন পেতে পারি। মিলি জোর দিয়ে বলেছিল। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি তেমন সম্ভাবনা প্রায় নেইই। কেননা মিলি এগারো ক্লাশে উঠে মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিয়েছে। মিনিমাম গ্রাজুয়েট না-হলে প্রোমোশন পাওয়ার চান্স নেই। মিলি তবু কিছুতেই মানতে চাইল না। একসময় ওকে রাজি করানো গেল। ছেলে হওয়ার পরে অবশ্য আর চাকরিতে জয়েন করল না ও। বলল, কাজের লোক রেখে ছেলে মানুষ করা যাবে না। তাছাড়া কাজের লোক রাখার খরচ যেমন আছে, ঝক্কিও কম নেই। ডানকুনির ভাড়াবাড়িতে কাজের লোকের ওপর ঐটুকু ছেলেকে রেখে অফিস করার ভরসাও ছিল না। আমিও চাইছিলাম মিলি আর চাকরি না-করুক। একভাবে ঠিক চলে যাবে আমাদের। কিন্তু ছেলেই যদি মানুষ না-হয়, তাহলে চাকরি, সংসার এসবের মানে কী? মিলিরই যুক্তি ছিল এসব।
সংসার আমাদের মোটামুটি চলে যায়। স্কুলেও ভর্তি হয়েছে ছেলে। ওর পিছনে খরচা কম নয়। সবমিলিয়ে বেড়ানোর সুযোগ আমাদের কপালে নেই সেভাবে। মিলি বলেছিল, বাচ্চাকাচ্চা নেওয়ার আগে একটু ঘুরেটুরে নিই। পরে আর হবে কিনা কে জানে! আমি তখন ওর কথা শুনিনি। পরে অনুভব করেছি, মিলি ঠিকই বুঝেছিল। আমাদের আর বেড়ানোই হল না! এইজন্যই মিলি বলেছিল, একটা বেড়ানোর সুযোগ পেলাম। তাও বৃষ্টিতে ভেস্তে গেলে কী হবে বলো? মেঘ দেখে তাই মিলির রাগ হওয়াটা স্বাভাবিকই।
সন্ধ্যায় সমুদ্রের ধারে বেড়িয়ে এলাম। বৃষ্টির নামগন্ধ নেই বলে মিলির মেজাজ বেশ ফুরফুরে। ফুচকা খেলাম, মাছভাজা খেলাম, সমুদ্রের ধারে বসে থাকলাম। হাত ধরাধরি করে হাঁটলামও কিছুটা। বুচাইয়ের মুখে এমনিতেই খই ফোটে সারাক্ষণ। সমুদ্রের কালো জলে একের পর এক ঢেউ আছড়ে পড়া দেখে ওর মুখেও ফেনার মতো কথা ভেসে উঠছিল।
আশ্চর্য ব্যাপার হল, সেই যে মেঘ এসে ভয় দেখিয়ে উড়ে গেল, আর আমাদের দেখা দেয়নি। আমি বহু আগে একবার বর্ষার সমুদ্র দেখেছিলাম। ভয়ংকর সুন্দর সেই রূপ। কালো মেঘের ছায়া পড়ে সমুদ্রের জলও কালো। উত্তাল সমুদ্রের কালচে জলের মধ্যে সাদা সাদা ফেনা। প্রবল জলের শব্দ। অসাধারণ সেই দৃশ্য। এতদিন আগে দেখা, তবু চোখ বুজলেই আমি সেই দৃশ্য দেখতে পাই। এবার আর সমুদ্রের সেই রূপ দেখার সুযোগ হল না। তবু আমার মনখারাপ হয়নি, কেননা আমার প্রত্যাশা মিটলে মিলি আর ছেলের মন ভেঙে যেত।
দুদিনের জন্য ঘর বুক করা ছিল। একবার শঙ্করপুর আর মন্দারমণি ছুঁয়ে এলাম অটোয় চেপে। পরদিন ফেরার পালা। বাসের সিট বুক করে নিয়েছি আগেই। একটায় বাস ছাড়বে। রাতের খাওয়া সেরে হোটেলে আসার পরে বুচাই ঘুমিয়ে পড়ল দ্রুত। আসলে সমুদ্রের ধার দিয়ে অনেকটা পথ আমরা হেঁটেছি। খুব আনন্দ করেছে বুচাই। এতেই ক্লান্ত হয়ে গেছে। আমাদের রুম চারতলায়। মাথার ওপরে শুধু ছাদ। এই ছাদটা যেন আমাদেরই।
ছেলে ঘুমোচ্ছে। ও একবার ঘুমোলে আর ওঠে না। সকাল পর্যন্ত একটানা ঘুমোয়। মিলি বলল, চলো ছাদে ঘুরে আসি কিছুক্ষণ। কাল তো চলেই যাব।
সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার হাতে নিয়ে আমি মিলির সঙ্গে ছাদে চলে গেলাম। দূরে আলোর বিন্দু দেখতে পেলাম সমুদ্রের জলরাশির ওপর। মাছ ধরার ট্রলার। মিলি সেদিকে না-দেখে পেছন দিকে চলে গেল। আমাকে ডাকতে আমিও সেদিকে গেলাম। আঙুল তুলে দেখাল নীচের তারের দিকে।
ঐ দেখো ঘুড়িটা ঝুলছে।
দেখলাম কাটা ঘুড়ি হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে।
একদম আমাদের মতো, তাই না? আটকে গেলাম পুরোপুরি! মিলি দার্শনিকের মতো বলল।
যখন প্রেম করতাম, প্রায়ই অফিসের পরে বাবুঘাটে চলে যেতাম। কিংবা মিলেনিয়াম পার্কে। কখনও দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে। বিয়ের পরেও বার কয়েক গেছি। পরের দিকে আর যেতাম না। সারা সপ্তাহ অফিস করে ছুটির দিন বেরোতে ইচ্ছে করত না আর। বুচাই জন্মানোর পর বেরোনোর প্রশ্নই রইল না আর। একবার মাত্র ওকে নিয়ে আমরা চিড়িয়াখানায় যেতে পেরেছিলাম। ওর তখন বছর তিনেক বয়স।
আমরা চুপ করে দেখে যাচ্ছিলাম কাটা ঘুড়ির ওড়াওড়ি। মনে মনে দুজনেই কথা বলে যাচ্ছিলাম অজস্র। আমি যেমন প্রেমপর্বের কথা ভেবে গেছি, মামাবাড়ির অনাদরের কথাও। মিলি নিশ্চয়ই তেমনই ফেলে-আসা দিনে মশগুল ছিল। একসময় মিলিই বলল, চলো নীচে নামি। বুচাই একা আছে ঘরে।
পরদিন চেক-আউট করে বেরিয়ে আসব আমরা। খাতায় সইসাবুদ করছি আমি। হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে আসার মুখে হঠাৎ মিলি বলল, একটু দাঁড়াও। আমি একবার ছাদ থেকে ঘুরে আসি।
এখন ছাদে? এই রোদে?
হ্যাঁ, যাব আর আসব। ঘুড়িটা একবার দেখে আসি প্লিজ।
আমি আর বুচাই মিলির জন্য গেটের বাইরে অপেক্ষা করতে থাকলাম। অনেকক্ষণ।
বাহ।চমৎকার লাগল। কাটা ঘুড়ির জীবন।
উত্তরমুছুন