পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০

আলো বসু

                           

রবীন্দ্রনাথ, মৃত্যু ও আমি। 
"শেষ কহে একদিন সব শেষ হবে, 
হে আরম্ভ, বৃথা তব অহঙ্কার তবে। 
আরম্ভ কহিল,ভাই, যেথা শেষ হয় 
সেইখানে পুনরায় আরম্ভ উদয় । 
মাসের নাম বৈশাখ। সূর্য করোজ্বল। মাসের নাম শ্রাবণ আড়ালের আবেদন।  এই মেঘলা শ্রাবণ  আলো আলো দিনগুলিকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। মনে হয় একটি  আরেকটির দূর সম্পর্কের বিশেষণ। তাই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যিনি ঋতুচক্রের এককটি দাগ  ধরে ধরে জীবনকে বিশ্লেষণ করেছেন তিনি জন্মদিনে মৃত্যুর কবিতা লিখতে বসেন। বলেন -----"ইচ্ছে করে জীবনের প্রত্যেক সূর্যোদয়কে

সজ্ঞান ভাবে অভিবাদন করি এবং প্রত্যেক সূর্যাস্তকে পরিচিত বন্ধুর মতো বিদায় দিই। " 
মৃত্যুকে কে না ভয় পায়? গবেষকরা বলেন  রবীন্দ্রনাথেরও মৃত্যু ভয় ছিল।  সঙ্গে ছিল ভয় ভাঙাবার তাগিদ। তাই নানাভাবে মৃত্যুকে এনেছেন ভাবনায়, ভাষায়। লিখেছেন ------"কেন রে এই দুয়ার টুকু পার হতে সংশয়?পরক্ষণেই গেয়ে  উঠেছেন ----"জয় অজানার জয় "। জীবন ওঁকে এই বিষয়ে প্রভূত সাহায্য  করেছে । বাল্যকালে মা, এবং তারপর বন্ধুপ্রতিম বৌদি থেকে শুরু করে স্ত্রী, সন্তান,  দৌহিত্রের অকাল প্রয়াণ এক অতল অন্ধকারের সন্ধান যেমন দিল

 তেমনিই তিনি ওই অন্ধকারেই তাঁর চতুর্দিকে  আলোর বিন্দুগুলি ছড়িয়ে পড়তে দেখলেন ।  জীবন যে  একেবারে অবিচলিত নিশ্চিত  নয়  এই সংবাদে তাঁর মনোভার হালকা হলো। মনের ভাব প্রকাশ করে বললেন ----" আমরা যে নিশ্চল সত্যের পাথরে গাঁথা কয়েদি নই, এই চিন্তায় আমি ভিতরে ভিতরে উল্লাস বোধ করিতে লাগিলাম। জগতকে সম্পূর্ণ করিয়া এবং সুন্দর করিয়া দেখিবার জন্য যে দূরত্ব
 
প্রয়োজন, মৃত্যু দূরত্ব ঘটাইয়া দিয়াছিল। আমি নির্লিপ্ত হইয়া 
দাঁড়াইয়া  মরণের বৃহৎ পটভূমিকার ওপর সংসারের ছবিটি দেখিলাম। "।  

" এইমাত্র? আর কিছু নয়? ভেঙে গেল ভয় 
আমি মৃত্যুর চেয়ে বড় 
এই কথা বলে যাব আমি চলে "।
বিদায় তাঁকে নিতেই হবে এই সত্য জেনেও ভালোবাসার কাছে দাঁড়িয়ে লিখেছেন -----" এ বিশ্বেরে ভালোবাসিয়াছি। এ ভালোবাসাই সত্য , এ জন্মের দান। বিদায় নেবার কালে এ সত্য অম্লান হয়ে মৃত্যুকে করিবে অস্বীকার। "
রবির আলো এভাবেই জীবনের জয় ঘোষণা করেছেন মৃত্যুকে পাশে বসিয়ে। 

বোধকে যে জায়গায় নিয়ে গেলে এই আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে আমাদের মত সাধারণ মানুষের বোধ কী সে জায়গায় পৌছতে পারে?  বর্তমান সময়ে এই মহামারীর আয়নায় এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক। আমাদের ভেতরে ঘরে রবির আলো ততটা পৌছতে পারে না তাই আমাদের ছোটবেলায় মৃত্যু এত স্পষ্ট ছিল না। শুধু মাঝে মাঝে দু -একজন কাছের মানুষ নেই হয়ে যায়। পাশের বাড়ির অসুস্থ দাদু , রোজ বিকেলে মা যার কাছে গিয়ে বসতেন, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন, গল্প করতেন, একদিন তাঁকে তুলসি তলায় নামিয়ে দেওয়া হলো।  বাড়ির সবাই হৈচৈ করে কাঁদল। মা নীরবে অশ্রুপাত করলেন,  আমি বুঝলাম কোথায় যেন কী এক ছন্দপতন। একটা অন্য স্বাদের মনকেমন । দিন দুয়েক যেতে  না যেতেই এই মৃত্যু উপলক্ষে লোক সমাগম, পুজোপাঠ,নাম কীর্তন, প্যান্ডেল, কেমন যেন একটা  উত্সবের ভাবে সেই মনকেমন আবছা হতে হতে একেবারে মুছে গেল। পাশের বাড়ির  পূর্ণিমা দি যখন মারা গেল জ্যেঠিমা অনেকদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারতেন না ।  তারপর একদিন তাকে ছাদে কাপড় মেলতে দেখলাম । এইভাবে প্রতিবার   ছোট ছোট মৃত্যু আমাকে জীবনমুখী থাকার সহবত শেখালো। এমনকি জন্মদাতা পিতার মৃত্যুও  কত ছোট মনে হলো আমার ব্যস্ত জীবনে। বুঝলাম ক্ষতি নয়, মৃত্যু মানে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। 

এই অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার মধ্যে নিজেকে দেখতেই শুধু ভয় পাই । মৃত্যু ছাড়াও ছোট ছোট দুঃখ ক্রমশ আমাকে ঘিরে ধরছে, কষ্ট দিচ্ছে। কিন্তু সেই কষ্ট থেকে মুক্তির জন্য আমি জীবনকেই দ্বিগুণ শক্তিতে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছি। আজও মনে হয় যত দুঃখই আসুক এই জীবনই সত্য। শুধু তাই নয়, মৃত্যুর কথা ভাবলেই মানুষ 'আমি'কে, জীবন্ত 'আমি'কে আরও একটু ঔদার্যের দিকে এগিয়ে দিই। জীবন আনন্দময় মনে হয়। 

তবে সমাজ জীবন দ্রুত পালটে যাচ্ছে। মৃত্যু এখন বড় বেশি দৃশ্যমান, সহজ।  হিংসায়, মহামারীতে গণমৃত্যু আমাদের ভোগবাদী জীবনে শ্মশান বৈরাগ্য কথাটিকে নস্যাৎ করে শ্মশানকেই জীবনের কোলাহলের মধ্যে বসিয়ে দিয়েছে। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে জীবনের অপচয় দেখতে দেখতে আমাদের প্রজন্ম কী জীবনকে আর ভালোবাসতে শিখছে? মৃত্যুকে ভালোবেসে বলতে পারছে -----"ওগো মৃত্যু, তুমি যদি হতে শূন্যময় 
মুহূর্তে নিখিল বিশ্ব হয়ে যেত লয় 
তুমি পরিপূর্ণ রূপ , তব বক্ষে কোলে 
জগৎ শিশুর মতো নিত্যকাল দোলে।  "

সহজ স্বাভাবিক আকস্মিক মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আমরা জীবনকে নতুন আলোয় দেখতে পাই,জীবনের আকর্ষণ অনুভব করি।  কিন্তু মৃত্যুর ভয়াবহ মিছিল, মানুষের হিংসা, লোভ ইত্যাদি রিপুতাড়িত মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে কোথাও আমরা জীবন মৃত্যুর জায়গা বদল করে ফেলছি না তো? 
গেরুয়ার ঘেরাটোপে দাঁড়িয়ে এক গৃহী এবং সন্ন্যাসী একজনের মৃত্যু সংবাদ শুনে বলে ওঠেন ----" শুনে আমারই ভেতরটা গামছা নিংড়ানোর মতো মোচড় দিয়ে উঠল, তাহলে সংসারী মানুষের কী হয় গো! "
এই মোচড়ই তো সংসারী মানুষের জীবনের ভারসাম্য। অবিরাম সম্ভোগের মুখে ক্ষণিক সংযম। অহরহ মৃত্যু দৃশ্যের মধ্যে দাঁড়িয়ে  তার বিকলতা আমাদের প্রজন্মের ওপর কী প্রভাব ফেলবে?  চরম বৈরাগ্য না ভাবলেশহীন নিরেট ঔদাসিন্য ? প্রশ্ন রইল পাঠকের দরবারে।         


   

  







কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন