পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০

যুগান্তর মিত্র

                                     

খোকন রে তুই ঘরে আয়


খোকন সামন্ত পুলিশে চাকরি করতেন। আমরা বলতাম খোকনকাকু। তাঁর ছেলে সুব্রত আমাদের বন্ধু। আমরা এক ক্লাবে ফুটবল, ক্রিকেট খেলতাম। ক্যারাম পেটাতাম। 

পুলিশে চাকরি করলে কী হবে, এমন নিপাট গোবেচারা মানুষ আগে দেখিনি। আসলে পুলিশে চাকরি করা মানেই রাশভারী মানুষ হবেন, এমনটাই আমাদের ধারণা ছিল। তাঁর মতো এমন সরল-সাধাসিধে লোক আমাদের এলাকায় ছিলেন না, এমনকি এইরকম পুলিশ অথচ ঠান্ডা মানুষ আছেন কিনা, আমাদের সন্দেহ ছিল। আমরা অবশ্য কোনওদিনই খোকনকাকুকে পুলিশের পোশাকে দেখিনি। বেশি বয়সে বিয়ে করেছেন। তাই সুব্রতরা যখন আমাদের এলাকায় এসেছিল, ক্লাশ নাইনে ভর্তি হয়েছিল আমাদের স্কুলে, তখন ওর বাবা রিটায়ার করে গেছেন। আগে ওরা বরানগরের দিকে ভাড়া থাকত। রিটায়ারমেন্টের পর আমাদের নৈহাটিতে এসে ফ্ল্যাট কিনেছেন খোকনকাকু।  

সুব্রত প্রথমদিকে খুব রাগ রাগ ভাব দেখাত। ধুর ধুর, বরানগরের মতো জায়গায় থাকার পর কেউ এই ধ্যাড়ধ্যাড়ে গোবিন্দপুরে এসে ওঠে? ওর কথায় আমরা খুব রেগে যেতাম। আমাদের অঞ্চল মোটেও ধ্যাড়ধ্যাড়ে বলার মতো নয়। নিজেদের এলাকার অবমাননা ঠিক মেনে নিতে পারিনি। এই নিয়ে অনেক তর্কও করেছি একসময়। পরের দিকে সুব্রত নিজেই জায়গাটাকে ভালোবেসে ফেলল। ক্লাশ টেনে ওঠার পরে মৃত্তিকার সঙ্গে ওর প্রেম হয়ে গিয়েছিল। হয়তো সেই কারণেই মৃত্তিকার জন্মস্থানের মাটিকে ও ভালোবেসে ফেলেছিল। যদিও সেই প্রেম বেশিদিন টেকেনি। 

খোকনকাকু ছিলেন ছয় ফুটের ওপর লম্বা। দশাশই চেহারা। কিন্তু মুখটা দেখলে বয়স বোঝা যেত না। যেন কৈশোর কাটেনি। গায়ের রঙ কালো। মুখ থ্যাবড়া। নাক বোঁচা। চোখের মণিদুটো ঘন কালো। ঠোঁট ফাঁক হলেই সাদা ধবধবে দাঁতগুলো দেখা যেত। অনেকটা দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার ভিলেনের মতো বড়সড় চেহারা। অথচ একেবারে মাটির মানুষ। এই লোকটাই একসময় পুলিশ ছিলেন! মেলাতে পারতাম না ঠিক। তবে ভিলেনের মতো মোটা মোটা গোঁফ ছিল না খোকনকাকুর। একেবারে ক্লিন সেভ। প্রতিদিনই মনে হয় সেভ করতেন। কালো মুখে ক্লিন সেভ থাকলে কেমন যেন দাড়িগোঁফের জায়গাটা সাদাটে লাগে। ঠিক সাদা নয়, অনেকটা ছাই-ছাই রঙের। আগে কখনও এইরকম মুখ দেখিনি। তাই বুঝতে পারতাম না ক্লিন সেভের কালো মুখ কেমন লাগে। 

খোকনকাকু যখন সাইকেল চালাতেন, তখন তাঁকে দেখেই আমাদের হাসি পেয়ে যেত। অনেক দূরে লোক আছে। তবু টিং টিং করে বেল বাজাতেন তিনি। সাইকেল চালাতেনও খুব আস্তে। যেন রাস্তার ব্যথা লাগবে। যেন সাইকেল জোরে চালালে সাইকেলটার কষ্ট হবে। 

ওনাকে আমাদের জেঠু ডাকাই উচিত ছিল। কিন্তু সুব্রত চাইত না ওর বাবাকে জেঠু ডাকি। বন্ধুত্বের শুরুর দিকে পলাশ একদিন বলেছিল, জেঠুকে দেখলাম সাইকেলে করে কোথায় যাচ্ছেন। বাজারে যাচ্ছিলেন নাকি?  

সুব্রত অবাক হয়ে বলল, জেঠু কে? কার কথা বলছিস? 

তোর বাবার কথা বলছি। 

মুখ গম্ভীর করে সুব্রত বলেছিল, আর কক্ষনও আমার বাবাকে জেঠু বলবি না। কাকু বলবি। কাকাবাবুও বলতে পারিস। কিন্তু জেঠু নয় কিছুতেই। জেঠু ব্যাপারটাই আমার কাছে খারাপ লাগে। 

কেন কেন? আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম। 

সে অন্য একদিন শুনিস। পরে কখনও বলব। 

আর সেই অন্য একদিন আসেনি। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম, ওর কোনও জেঠু আছেন বা ছিলেন। তাঁর সঙ্গে ওদের সদ্ভাব নেই। বা তিনি অত্যন্ত খারাপ লোক। নিজেদের মতো করে বুঝে নিয়ে এই ব্যাপারে আর প্রশ্ন করিনি। কাকিমা, মানে সুব্রতর মা অসাধারণ সুন্দরী ছিলেন। গায়ের রঙ যেন ফেটে পড়ছে। আমরা সুব্রতর আড়ালে ওর বাবা-মাকে নিয়ে মজা করতাম। আসলে আগে পুলিশ ছিল আমাদের কাছে ভয়ের ব্যাপার। কিন্তু খোকনকাকুকে দেখার পর সেই ভয় কেটে গিয়েছিল। শুধু ভয় কাটাই নয়, আমরা সুব্রতর আড়ালে ‘খোকন খোকন করে মায়…’ ছড়াটাও বলতাম মজা করে। তবে ‘মায়’-এর জায়গায় বলতাম ‘কাকিমায়’। ফলে খোকন খোকন করে কাকিমায় উচ্চারণে ছড়ার ছন্দ একটু টাল খেয়ে যেত। তাতে আবশ্য আমাদের তেমন যেত-আসত না। 

পুলিশের ছেলে আমাদের বন্ধু, এও ছিল আমাদের গর্বের বিষয়। ঐ বয়সে সুব্রতর মতো কেউ আমাদের ছয়-সাতজনকে ডেকে আলুকাবলি খাওয়াচ্ছে, শীতের সন্ধ্যায় ব্যাডমিন্টন খেলার সময় কর্ক কিনে আনছে দৌড়ে গিয়ে, এমন বন্ধুকে মনে মনে হিরো ভেবে নিয়েছিলাম। তাছাড়া সেইসময় আমাদের সবারই ঘরবাড়ি ছিল। চেনা কারও মধ্যে শুধু সুব্রতরাই ফ্ল্যাটে থাকত। সেই কারণেই ওদের নিয়ে আলোচনা হত আমাদের মধ্যে। ওর বাবা ও মায়ের মধ্যে চেহারার বৈপরীত্যও ছিল আমাদের আলোচনার বিষয়। 

কেউ হয়তো বলত, খোকন সামন্তকে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট কী দেখে নিয়েছিল রে? চেহারা দেখে? পুলিশের কাজটা কি শুধু শরীর দিয়ে হয়? তার মেজাজ থাকবে না? তখনও ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়া যায় এমন কথা আমরা শুনিনি। হয়তো পাল্টা কেউ বলে উঠত, কী দেখে কাকিমা এইরকম কুৎসিত লোকটাকে বিয়ে করলেন কে জানে! কেউ জবাব দিত, টাকা দেখে। তাছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। আমরা সবাই হেসে উঠতাম। তবে কাকুর প্রতি কাকিমার ভালোবাসা দেখে আমাদের সেই হাসি দীর্ঘস্থায়ী হত না। এমন স্বামী-অন্ত মহিলাও আমরা তখন দেখিনি। সবসময়ই কাকুর দিকে খেয়াল রাখতেন, ছেলেকে আগলে রাখতেন, এমনকি ছেলের বন্ধুরা গেলেও ভালোবাসা ঝরে পড়ত তাঁর থেকে। এমন কেউ টাকার লোভে বিয়ে করতে পারেন, আমাদের বিশ্বাস হত না। 

কয়েক বছর পরে খোকনকাকু মারা গেলেন। আমরা তখন গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে কেউ চাকরি খুঁজছি, কেউ মাস্টার্সের জন্য দৌড়ঝাঁপ করছি। এমন একটা সময় বচা এসে আমাদের জনে জনে বলে গেল সুব্রতর বাবা মারা গেছেন, আমাদের এক্ষুনি যেতে হবে। বচা আমাদের বন্ধু আর সুব্রতদের ফ্ল্যাটের কাছাকাছিই ওদের বাড়ি। ফলে সবার আগে ও খোকনকাকুর মারা যাওয়ার খবর পেয়েছে। 

শীতের সন্ধ্যায় আমরা মন ভার করে চলে গিয়েছিলাম সুব্রতদের ফ্ল্যাটে। গিয়ে দেখি লম্বা মানুষটা শুয়ে আছেন, যেন ঘুমিয়ে আছেন। সাদা চাদরে সারা শরীর ঢাকা। শুধু নির্বিকার মুখটা আঢাকা। সেই প্রথম খোকনকাকুকে শুয়ে থাকতে দেখেছিলাম আমরা। ফ্ল্যাটের দু-একজন দাঁড়িয়েছিলেন ইতস্তত, স্পষ্ট মনে আছে। আর কাকিমা কেঁদে চলেছেন নীরবে কাকুর পায়ের কাছে বসে। আমাদের দেখেই সুব্রত ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ওর চোখেমুখে শোকের ছায়া। ভীষণ বিমর্ষ দেখাচ্ছিল ওকে। আমরাও বিমর্ষ ছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের সবার মধ্যে একটা আলাদা উত্তেজনা চলে এল। এর আগে মরা পোড়াতে শশ্মানে গিয়েছিলাম বার কয়েক। কিন্তু তখন ছিল শুধু সঙ্গ দেওয়া। সেই প্রথম মরা পোড়ানোর যাবতীয় দায়িত্ব আমাদের ওপর দিয়েছিল সুব্রত। পুলক জিজ্ঞাসা করেছিল, তোদের কোনও আত্মীয়স্বজন নেই? আসলে আমাদের সেই দায়িত্ব পাওয়া নিয়ে সংশয় ছিল। আত্মীয়স্বজনেরা চলে এলে দায়িত্ব থেকে সরে যেতে হতে পারে। পুলকের প্রশ্নটা তাই আমাদের সবারই ছিল। 

আরে না না, আমাদের তেমন কেউ নেই। মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলেছিল সুব্রত। থাকলেও আমাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ রাখে না। আমরাও কাউকে পুঁছি না। এই কথাটা বলার সময় সুব্রতর মুখে বিরক্তির চিহ্ন ফুটে উঠেছিল। আমরা ক্রমশ নিশ্চিন্ত হচ্ছিলাম দায়িত্বটার ব্যাপারে। সেই সময় সুব্রত আরও স্পষ্ট করে বলে দিল, যা করার তোদেরই করতে হবে। আমি আর কতদিক সামলাব, বল? 

সুব্রত কীভাবে যেন এর মধ্যেই ম্যাটাডোর জোগাড় করে ফেলেছিল। সেইসময় কাঁধে করে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হত। তাই ম্যাটাডোরের ব্যবস্থা করায় আমরা অবাক হয়ে সুব্রতর দিকে বার কয়েক দেখেছিলাম। মরা নিয়ে ম্যাটাডোরে যাওয়ার ব্যাপারটাও আমাদের উত্তেজনা দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। আমরা সেদিন দলবেঁধে শ্মশানে গিয়েছিলাম। আমরা বন্ধুরা ছাড়াও ফ্ল্যাট ও আশেপাশের আরও কয়েকজন ছিল। ভালো মানুষ, ঠাণ্ডা মানুষ খোকনকাকুর চেহারা চিরকালের জন্য আমাদের থেকে হারিয়ে যাবে ভেবে খারাপ লাগছিল আমাদের। গরিফার রামঘাট শ্মশানের পাশে গঙ্গার ধারে দাঁড়িয়ে সুব্রত বলেছিল, ঠিক সন্ধ্যায় ছটা ছাপ্পান্ন মিনিটে বাবা চলে গেলেন। ছটা ছাপ্পান্ন। 

সুব্রত কেন যে মৃত্যুর সময়টা দুবার করে বলেছিল জানি না। তবে বিল্টু বলে উঠেছিল, সময়টা একটা ফ্যাক্টর জানিস? আমার ঠাকুরদা মারা গেছেন শুক্লা পঞ্চমীতে, সকাল সাতটা তেরো মিনিটে। সেই সময়টা ছিল খুব ভালো। প্রিয়জন মরার সময় আবার ভালো হয় কী করে, আমরা কেউ বুঝিনি। গঙ্গার দিক থেকে বিল্টুর দিকে চোখ সরিয়ে সুব্রত বলেছিল, তাই? ছটা ছাপ্পান্ন সময়টা কেমন জানি না, তবে আমার বাবা খারাপ সময়ে মরতে পারেন না। বরং আমাদেরই খারাপ সময় আসছে হয়তো। 

আমরা সুব্রতর কথা শুনে সবাই চুপ করেছিলাম। ওর কথার অর্থ বোঝার চেষ্টা করছিলাম। তবে কথা আর এগোয়নি। কিছুক্ষণ পরেই আমাদের ডাক এল। তারপর শ্মশ্মানের পুরোহিতের কাজ, ডোমেদের তৎপরতা, খোকনকাকুর শরীর ছাই হয়ে যাওয়া, সব একে একে ঘটে গেল আমাদের চোখের সামনেই। শুধু শেষকৃত্যই নয়, বাবার শ্রাদ্ধের কাজেও আমাদের দায়িত্ব ছিল পুরোটাই। জান লড়িয়ে আমরা সব কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম আমরা। 

সুব্রত আর মাস্টার্স করতে চাইল না। কীভাবে যেন ও পুলিশে চাকরি পেয়ে গেল। আমরা নিজেদের বৃত্তে ঘুরপাক খেতে থাকলাম যে-যার মতো। অনেক বন্ধুর মধ্যে শেষপর্যন্ত আমরা পাঁচজন আর সুব্রত, এই ছ-জনের মধ্যে যোগাযোগ থেকে গেল। শান্তনু, অঞ্জন, আমি আর পুলকও একে একে চাকরি পেয়ে গেলাম সরকারি বা বেসরকারি। একমাত্র শেখর পারিবারিক বইয়ের ব্যবসায় যোগ দিয়েছিল।  

খোকনকাকুর মৃত্যুর প্রথম বছরে আমাদের ডেকেছিল সুব্রত। বলেছিল, বাৎসরিক নামে কিছু করছি না। এসবের কোনও মানেও নেই, বুঝলি? পুরোহিত গুচ্ছের টাকা নেবে। আমি ভাবছি, বাবার একটা স্মরণসভা করব। মানে আমার মা আর ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা থাকবে। বাবার ছবি সামনে রেখে বাবা সম্পর্কে যে যেমন জানি বলব। তোরা আসবি তো? 

এইরকম আহ্বানে না-যাওয়ার কোনও কারণ নেই। সবাই রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। সুব্রত বলেছিল, তোরা কিন্তু ঠিক সন্ধ্যা ছটা ছাপ্পান্ন মিনিটের মধ্যেই চলে আসবি। ঐ সময়ই ধূপকাঠি জ্বেলে বাবার স্মরণসভা শুরু করব। সময়টা একটা ফ্যাক্টর, মনে রাখিস। অবিকল পুলকের মতো শেষ কথাটা বলেছিল সুব্রত। 

ছটা ছাপ্পান্নর আগেই আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম সবাই। চন্দন দিয়ে সাজানো সাদা-কালো খোকনকাকুর ছবির সামনে গোল হয়ে বসেছিলাম সকলে। সুব্রত ঘড়ি দেখে ঠিক ছটা ছাপ্পান্নতে ধূপকাঠি জ্বালিয়েছিল আর কাকিমা দেশলাই কাঠি দিয়ে মোমবাতিতে আগুন দিয়েছিলেন। সেদিনই আমরা জানতে পারলাম, কাকিমার গলায় গান শুনতে ভালোবাসতেন কাকু। কাকিমাও যে এত ভালো গাইতে পারতেন, আমাদের জানা ছিল না। কাকুর একটা প্রিয় রবীন্দ্র সংগীত যন্ত্রণার কথামালা হয়ে বেরিয়ে এসেছিল কাকিমার গলা থেকে। আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহদহন লাগে…। কাকিমা যখন গাইছিলেন, নাহি ক্ষয়, নাহি শেষ, নাহি নাহি দৈন্য লেশ,… তখন ঘরের মধ্যে বাতাস যেন গুমরে উঠছিল। 

এরপর থেকে প্রতিবছর ঐদিনে আমরা ছ-জন আর কাকিমা চলে-যাওয়া মানুষটার ছবির সামনে বসতাম। এক মিনিট নীরবতা পালন করতাম। এছাড়া নানা কথা হত। কাকিমা মধুর কণ্ঠে কাকুর প্রিয় নানা গান গাইতেন। তবে কাকিমা মারা যাওয়ার পরে আর আমাদের বসা হয়নি। কিন্তু প্রতিবছর ছটা ছাপ্পান্ন মিনিটে ঘড়ির দিকে ঠিক চোখ পড়ে যায় আমাদের, হাতের কাজ থেমে যায়, কাকুর মুখ ভেসে ওঠে মনে। 

একবছর আমার উদ্যোগেই কাকুর মৃত্যুদিনে আমরা বন্ধুরা মিলিত হয়েছিলাম সুব্রতর বাড়িতে। কেননা ততদিনে সুব্রত বাবার স্মরণসভা করার ব্যাপারে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। কাকিমার স্মরণেও কোনও সভা করতে চাইত না। সেবার আমিই জোর করলাম। সুব্রত রাজি হল। আসলে কেন যেন প্রায়ই খোকনকাকুকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতাম। খারাপ স্বপ্ন নয়, কিন্তু একটা অস্বস্তি ঘিরে থাকত সারাদিন ধরে। তখনও আমরা কেউ বিয়ে করিনি, সংসারে জড়িয়ে পড়িনি। 

ঠিক ছটা ছাপ্পান্ন মিনিটে ধূপকাঠি জ্বালিয়েছিল সুব্রত। তারপর মোমবাতি। কাকিমা নেই বলে এই কাজটা ওকেই করতে হয়েছিল। একটা চেয়ারে কাকুর ছবিটা রেখেছিল সুব্রত। ঠিক পাশেই ছিল কাকিমারও ছবি। আমরা দাঁড়িয়ে নীরবতা পালনের পর দেখলাম, সুব্রত সামনে দুহাত প্রসারিত করে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছে। ওর দেখাদেখি আমরাও সামনে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। সবাই চোখও বন্ধ করে রেখেছিলাম সুব্রতর মতো। আচমকা আমার কানে ভেসে এল সুরেলা কণ্ঠের আওয়াজ, “সাতটা কাকে দাঁড় বায়,/খোকন রে তুই ঘরে আয়।” চোখ খুলে কাউকেই দেখতে পাইনি। তবে আমাদের হাত বাড়িয়ে রাখার ভঙ্গিটা ছিল অনেকটা মাঝির মতোই। যেন আমাদের সাতজনের হাতেই আছে একটা করে দাঁড়। 

আমার ঠাকুমা বলতেন, বিমলের কথা খুব মনে পড়ে রে। কী তরতাজা পোলা ছিল। লেখাপড়ায়ও ভালো ছিল। কী যে মাথায় চাপল পোলাটার! সব ছাইড়া বনেজঙ্গলে ঘুইরা বেড়াইত নাকি। সমাজ বদলাইব হ্যারা! গুলি-বন্দুক নিয়া কি বদল হয়? একই তো আছে সব। ঘরের খোকা একবার বাইর হইলে আর ফেরে না। 

সেদিন দাঁড় হাতে দাঁড়িয়ে আমার মনে হচ্ছিল, খোকনকাকু আর ফিরবেন না। মৃত্যুই নয় শুধু, ঘর ছেড়ে একবার বেরিয়ে গেলে খোকারা আর ফেরে না। আমাদের দাঁড় বাওয়ার কোনও মানে নেই তাই। তবু আমরা দাঁড় বেয়েই চলেছি। আর কে যেন অলক্ষে ডেকে চলেছে, খোকন রে তুই ঘরে আয়...।  

১৩টি মন্তব্য:

  1. বাহ! নতুন ধরনের লেখা- ভাল লাগল।

    উত্তরমুছুন
  2. বাহ! নতুন ধরনের লেখা- ভাল লাগল।

    উত্তরমুছুন
  3. নতুন আঙ্গিকে লেখা। ভালো লাগল।

    উত্তরমুছুন
  4. অসম্ভব মন খারাপ করে এলো। মৃত্যু কাছ থেকে দেখেছি। মনে সেটাই ভেসে উঠ

    উত্তরমুছুন
  5. ঘরের খুকুরাও ঘর ছেড়ে বেরোলে আর ঘরে ফেরে না। ফিরতে পারে না। খুকুদের তো নিজস্ব ঘরই থাকে না কোনও।

    উত্তরমুছুন
  6. অন্যরকম সমাপ্তি। এক ঘোর বিষণ্ণতা।

    উত্তরমুছুন
  7. অদ্ভুত একটা ভালোলাগার পাশাপাশি মনকেমন চাড়িয়ে গেল !

    উত্তরমুছুন
  8. অদ্ভুত একটা ভালোলাগার পাশাপাশি মনকেমন চাড়িয়ে গেল !

    উত্তরমুছুন
  9. অদ্ভুত একটা ভালোলাগার পাশাপাশি মনকেমন চাড়িয়ে গেল !

    উত্তরমুছুন
  10. সাংঘাতিক একটা ঘোর গল্পের মধ্যে।

    উত্তরমুছুন