পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০

মৃত্তিকা মুখোপাধ্যায়


মা 


সদ্যোজাত'র তীক্ষ্ণ কান্নার শব্দে ঘোর কাটিয়ে আবছা চোখে কষ্ট করে তাকানোর চেষ্টা করল উপালী।ওকে একবার দেখতে ভীষণ ইচ্ছে করছে।কিন্তু চোখ খুলছেনা যে কিছুতেই!জ্ঞান হতেই শরীরে প্রচন্ড ব্যথা আর ক্লান্তি অনুভব করল সে।ঘোলাটে চোখে কাকে যেন খুঁজছিল সে।বাড়ির লোকেরা কোথায় ?অভিমানে চোখ ভরে আসে উপালীর।এত কষ্ট হচ্ছে তার,মা-ও একবার তার কাছে এলোনা?হয়তো বাচ্চাটাকে নিয়েই ব্যস্ত সবাই!আর ভাবতে পারেনা উপালী।অসহ্য যণ্ত্রণা মাথা,ঘাড় আর না জানি কোথায় কোথায় ।আস্তে আস্তে আবার অচেতন হয়ে পড়ে সে।
মেটারনিটি ওয়ার্ডে একটা মিষ্টি গন্ধ ঘোরাফেরা করে সবসময়।আর কচি গলার তীব্র কান্না ভেসে আসে মাঝে মাঝেই।অরুণাংশু রিশেপসন কাউন্টারে বসে আছে মাথা নীচু করে।ওরা কাগজপত্র তৈরী করছে।পাশে দাঁড়িয়ে উপালী আর অরুণাংশুর বাবা দুজনে যাবতীয় ফর্মালিটির খোঁজখবর নিচ্ছেন।ওরা জানাচ্ছে পেশেন্ট এর কন্ডিশন খুব সেন্সিটিভ।একটু রিকভার করলে ডাক্তার রিলিজ্ করবে।সেসব নিয়েও ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলতে হবে।কিন্তু অরুণাংশুকে দেখে মনে হচ্ছে সে এসব থেকে অনেক দূরে রয়েছে।যা পারবে বাবা আর শ্বশুরমশাইকেই ব্যবস্হা করতে হবে।ছেলেকে বিরক্ত না করে তাই তার বাবাই গেলেন ডাক্তার সেন এর কেবিনে।
ওষুধের সময় হয়ে এসেছে উপালীর।মাঝবয়সী সিস্টার এসে হালকা করে হাত বোলান উপালীর মাথায়।খুব ধীরে অত্যন্ত কষ্টে করে চোখ খুলে উপালী বাচ্চাকে দেখতে চায়।হাত নেড়ে তাকে আশ্বস্ত করেন নমিতা দি।গত তিনদিনে বেশ ভালোবেসে ফেলেছেন নরমসরম মিষ্টি স্বভাবের উপালীকে।আজ সকাল থেকে নমিতা দিও এই প্রথম এল উপালীর কাছে ।গতকাল বিকেল থেকে ঘোরের মধ্যেই কেটেছে উপালীর।এখনও সে অস্পষ্ট দৃষ্টিতে কিছু অভিযোগ জানায় নমিতা দি'কে।মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় নমিতা দি অন্যমনস্কভাবে।উপালী নমিতাদির হাতে চাপ দিলে হঠাৎই সম্বিৎ ফেরে নমিতার।বুকের দুধে উপালীর হসপিটালের ইউনিফর্মটা ভিজে গেছে একদম।একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে নমিতা দি নতুন জামা আনার জন্য উঠে যান।
উপালীর মা আর অরুণাংশু ছাড়া বাকিরা বাড়ি ফিরে গেছে।শেষ বিকেলের এক চিলতে আলো এসে পড়েছে কেবিনের মেঝেতে।উপালী পাথরের মতো বসে আছে মুখ নামিয়ে।তার চোখে জল না আগুন-ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা।তার হাত দুটো ধরে বসে আছেন মা।দূরে আকাশের দিকে চোখ রেখে জানলায় দাঁড়িয়ে আছে অরুণাংশু।মেয়ের মাথায় হাত বোলান উপালীর মা।"আমায় ক্ষমা করে দিও অংশু।তোমাকে এই আনন্দটা দিতে পারলামনা"।দুদিন পরে কথা বলল উপালী।"আমরা নিজেদের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নেব পলি।যার যাবার,সে তো যাবেই!আর ডাক্তার সেন বলেছেন আমরা আর একটা চান্স নিতেই পারি।"অনেক ঝড় কাটিয়ে এটুকুই বলতে পারে অরুণাংশু।
চুপ করে ব্যাগ গোছুচ্ছে উপালী।বাড়ি থেকে আনা কয়েকটা ছোট ছোট জামা আলাদা একটা প্যাকেটে ভরতে ভরতে বুকের ঢেউ চোখে আছড়ে পড়ল।এমন সময় ছোট্ট তোয়ালে জড়ানো একটা পুতুলকে নিয়ে কেবিনে ঢুকলো নমিতা দি।উপালীর জিজ্ঞাসু চোখের প্রত্যুত্তরে বাচ্চাটাকে উপালীর কোলে দিয়ে নমিতা দি স্বাভাবিক গলায় বলে উঠল"দুধ খাওয়াতে নিয়ে এলাম।ওর মায়ের দুধই হয়নি তেমন।পেট ভরেনা বেচারার।খালি কাঁদে।তাই ভাবলাম,এত দুধ তোমার!ওর মা'কে বলে নিয়ে এলাম"।দুই হাতে ছোট্ট প্রাণটাকে নিয়ে কেঁদে ফেলে উপালী।আর ওর সঞ্চিত সমস্ত মাতৃস্নেহ যেন স্তন্যধারা হয়ে ভিজিয়ে দিতে থাকে পৃথিবীর সমস্ত তৃষ্ণার্ত সন্তানের শরীর।অনির্বচনীয় এক আলো ছড়িয়ে যায় উপালীর সারা মুখে,বুকে,অন্তরাত্মায়।

২টি মন্তব্য: