পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০

সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায়



উত্তরাধিকারী



চুপ করে বসে আছে স্মিতা।আজও অশান্তি। শাশুড়ি মা কোন কথাই শুনতে চান় না।এই বংশের একজন উত্তরাধিকারী তার চাইই। অথচ কি করে বোঝাবে তাকে সেটা কোনভাবেই সম্ভব নয়। প্রচন্ড দুঃখে, ক্ষোভে, এই কথাটা তাকে বলতে গিয়েও বলতে পারে না সে। কিংবা বললেও বিশ্বাস করবে না সন্তান ধারনের অক্ষমতা।অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়বে ।মানসিক নির্যাতন কতদূর কোন জায়গায় পৌঁছবে সেটা তার থেকে ভালো কেউ বুঝবে না।বাপেরবাড়ি যে একেবারে ফিরে যাবে সে উপায়ও নেই।কোনভাবে তার বিধবামায়ের দিন গুজরান হয়। তাকে আর কোন সমস্যায় জড়াতে ইচ্ছা হয় না।


অসামান্য সুন্দরী ছিল সে।হয়তো এই সৌন্দর্যই তার কাল হলো।কলেজের গন্ডি পেরনোর আগেই তার মতের তোয়াক্কা না করে তাকে বিবাহের নামে জুড়ে দেওয়া হলো এমন একজনের সাথে যার কাছে থেকে প্রাপ্য সম্মানটুকুও আশা করা যায় না।পয়সা দিয়ে বাজার থেকে যেন একটা সেক্সটয় কিনে এনেছে।স্বামী-সান্নিধ্যে দেহমন কিছুই ভেজে না তার।এক অদ্ভুত যান্ত্রিকতায় দিন কেটে যায় তার।রাতের পরিশ্রমে শরীর ভাঙে।তবুও স্বামীর কোন হুঁশ নেই।মায়ের অতিবাধ‍্য ছেলের সন্তান জন্মানোর উর্বর জমিতে চাষাবাদ চলে নিয়মিত।অসুস্থতায় এক অদ্ভুত বিরূপতা কাজ করে।নতুনমুখ আনার দায়বদ্ধতা কি তার একার?


বিয়ের তিনবছর অতিক্রম করতে না করতেই সে আজ বাজা তকমা পেতে শুরু করেছে।প্রায় প্রতিদিনই  তার মুখ দেখলে দিন কতটা খারাপ যায় তার ফর্দ শোনান শাশুমা।অথচ চিকিৎসা করাতে রাজী নয় নীল অর্থাৎ তার স্বামী।আবার বলতে শুরু করেছে, এইজন্যই আগের দিনে সন্তান না হলে আবার বিয়ে করার চল ছিল।সেটা হলে স্মিতার মা শোকে মরেই যাবে।হাল ছাড়ে না সে।

অবশেষে তার ধৈর্যের কাছে হার মানে নীল।ডাক্তার পাত্র মন দিয়ে সব শোনেন।দুজনের সঙ্গে কথা বলে নির্ধারিত দিনে প‍্যাথলজিক‍্যাল টেস্টও হয়।নীল বিরাট ব‍্যবসায়ী মানুষ।বারবার সময় নষ্ট করার মতো সময় নেই তার।অগত্যা রিপোর্ট হাতে হাজির স্মিতা।সমস্ত রিপোর্ট দেখে ডাক্তার পাত্র দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলেন, আপনার তো সবই ঠিক আছে।সমস্যাটি আপনার স্বামীর।নীলবাবুর azoospermiaর শিকার।সুতরাং artificial insemination ছাড়া তার পক্ষে মা হওয়া সম্ভব নয়।এবার এই কথাটি কাকে বোঝাবে স্মিতা?বরং বোঝাতে গেলে একজন সম্মাননীয় ডাক্তারকে তার সঙ্গে জড়িয়ে বদনাম দিতে এদের বিন্দুমাত্র সময় লাগবে না।

জানলার সামনে কৃষ্ণচূড়া গাছটা নিজেকে ফুলের সাজে সাজিয়েছে।তার পাশেই নিজেকে নিস্ফলা আগাছা ভাবতে তার মোটেও ভালো লাগছে না।দুটি শালিক ঝগড়া করতে করতে দুই দিকে চলে যায়।কোথায় যেন একলা কোকিল একনাগাড়ে ডেকে যাচ্ছে তার সঙ্গীকে।সেও ঐ বসন্তের নিঃসঙ্গ বিরহী কোকিলটার মতোই।পুরনো দিনগুলির কথা মনে পড়ে যায় মাঝে মাঝেই।মনকে সিক্ত করে ।কত বন্ধু ছিল তার।হৈ হৈ করে সময় কেটে যেত।কয়েকবছর পর দীপনদার কথা মনে পড়তেই তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যায়।শরীরের সব রক্ত যেন মুখে চোখে এসে জড়ো হয়।কত মজা করেছে তাদের নিয়ে বন্ধুরা।সত্যি বলতে কী সেই তো কত স্বপ্ন দেখেছিল তাকে নিয়ে।পাড়ার গর্ব ছিল দীপন।পড়াশোনা, সামাজিক, সব‍রকম খেলা সবকিছুতেই এগিয়ে ছিল সে।সময় পেলেই নির্জনে একসঙ্গে সময় কাটান।কত গল্প,কত মজা করেছে।কত মান-অভিমান, কত ভবিষ্যত পরিকল্পনা, সন্ধ্যার আঁধারে আরও কাছাকাছি আসা।সেকথা ভাবলেও আজ শরীরে শিহরণ খেলে।

তাদের এই স্বপ্নের জগত চুরমার হয়ে গেছিল তার এক নেশাখোর মামার জন্য।স্মিতার স্বঘোষিত অভিভাবক হয়ে তাদের কোন আপত্তি না শুনে একপ্রকার তাকে বিক্রি করে দিয়েছে।দীপনদার কোন অনুরোধ রক্ষা করা দূরে থাক প্রায় ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হয় তাকে।দীপনদার সাথে সাড়া পাড়াও মুষড়ে পড়েছিল সেদিন।তার বিয়েতে কোন প্রিয় বন্ধুও আসে নাই।নাহ্,তার চোখের জল আর শুকোবার নয়।বিছানার উপর বসে পড়ে।কে করবে তাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার?এলোমেলো চাদর ঠিক করতে করতে তার মুখে হাসির রেখা ছড়িয়ে পড়ে।খুব ভালো হয়েছে।একটা হাঙ্গরের বাচ্চা জন্মানোর কোন সম্ভাবনা নেই।কিন্তু তাকে এখানে টিকে থাকতে হলে,মাকে শান্তি দিতে হলে একটা বাচ্চার খুব দরকার-যে হবে তার প্রাথিত, কামনার, ভালোবাসার ফসল।যার মাধ্যমে তার উপর অত্যাচারের সমস্ত হিসাব চুকিয়ে নেবে সে।


মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফোন করে তার দীপনদাকে। হাসিমুখে নীচে নামে -শাশুড়িমাকে জানায় তার মা হওয়ার কথা। আর মানত পূর্ণ করার জন্য তাকে দুটো পূর্ণিমা গ্রামে তার মায়ের কাছে থাকতে হবে পুজো দেয়ার জন্য। তখনই অনুমোদিত হয় প্রার্থনা। বিদ্যুতের চমক খেলে যায় তার সারা অঙ্গে। বহুদিন আগে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া প্রসাধনী বাক্স টেনে নেয় কাছে। হাসিমুখে সাজতে বসে।



                                    


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন