পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০

শৌভিক চ্যাটার্জী



মৃত্যুঞ্জয়ী 
-------


আজকাল একদম ঘুম আসে না রনির।লকডাউনের  পর থেকেই ওর ঘুম আসে না ওর।মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমনো অভ্যাস।জন্মাবধি মা ছাড়া কিছুই যে চেনে না রনি।বন্ধু ঠিক কী,তার ব্যাখ্যা শুধুই যে মা।মা মানে একটা নরম অনুভূতি,এর বেশি ও কিছুই বোঝে না। রনি এখন দশ।প্রতিদিন মা কোলে করে,ঘুম থেকে তোলে,মা ই প্রতিদিন নানা আধুনিক সরঞ্জামে কথা বলতে শেখায়।মা ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।স্পিচ থেরাপিস্টের কাছেও নিয়ে যা মা।শুধু, শুধু মা ওকে বোঝে।মা ওকে বুঝতে শেখায়,মানুষ পড়তে শেখায়।একবার কোনো বিশেষ স্কুলে দিয়েছিল মা।রনির পোষায় নি।ওর খুব বাথরুম পেয়েছিল।বোঝাতে পারে নি সে কথা।অসাড়ে ভিজেছিল ইউনিফর্ম।আচমকা মেরেছিল,মিস্ট্রেস।ওর খুব কান্না এসেছিল।তারপর থেকে মা আর রনি কে একটি বারের জন্যও কাছ ছাড়া করেনি।রনি স্পেশাল চাইল্ড।রনি জানে না,ও শুধু জানে ও ওর মায়ের কাছে একটু বেশিই স্পেশাল। রনি বলতে পারে না,কিন্তু সবটা বুঝতে পারে।মা সব বুঝতে শিখিয়েছে;ইশারায় ইঙ্গিতেই পুরো বিশ্ব চিনিয়ে দেয় মা।ল্যাপটপে কার্টুন দেখায়,আমেরিকার কোভিড দেখায়,মোবাইলে ভারত দেখায়।আর রনি দেখে মা কে।শব্দে রনি অস্ফুট,কিন্তু অনুভূতিতে পুরোই বাঙ্ময়।একথা শুধু মা-ছেলেই জানে।বাকি রা কেমন দূরদেশী, অজানা,অচ্ছুত করে রাখে ওকে।রনি কে মাঝে মধ্যেই রক্ত দিতে হয়।মা নিয়ে যায় মেডিকেল কলেজ।রনির জ্বর আসে সেই রাত গুলোও।পেটের কাছ টা খালি ক'রে কান্না উঠে আসে।ঘুমিয়ে গিয়েও জেগে গেলে,ও দেখে মা ওর মুখের দিকে চেয়ে বসে আছে।রনি জানে মা কাঁদে,আড়ালে।মা কখনো বলেনি,কিন্তু ও বোঝে,ওর শরীরে আরও কিছু রোগ বাসা বেঁধে রেখেছে জন্ম থেকেই,কখনো সেরে উঠবে না রনি।ও স্বপ্নে দেখে,সাদা তুলোর মতো মেঘে ভেসে যাচ্ছে। মা হাত নাড়ছে নিচ থেকে,কিন্তু ও যে যেতে চায় না,এভাবেই মায়ের কাছে থাকতে চায়।রনির মায়ের গন্ধ না পেলে ঘুম আসে না।মার চুরির আওয়াজে যখন সকাল বেলার আলো এসে পড়ে মুখে,মা কে দেখে রনির ল্যাপটপের দুর্গা মনে হয়।  মা রোজ গল্প বলে শোবার সময়,মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ায়।গান গায়।রনির ভিতরে খুব ইচ্ছে একবার চিৎকার করে মা বলে ডাকে।মা বলছে একদিন ও সব কথা বলতে পারবে।।আসলে  মা রনির একমাত্র বন্ধু।'বাবা ঠিক মত গল্প বলতে পারেই না!'বাবা রনি কে একটু এড়িয়ে চলে,আদর করেনি কখনো। ওর বাবা কে দেখলে মনে হয়,বাবা যেন ওকে দেখে ভয় পায়।
----
এখন তো মা নেই,তাই বাবার পাশে শুয়েছে।
-'বাবা,মা কবে আসবে?'
বাবা নিরুত্তর, পাশ ফিরে শুয়ে!নিরুত্তর হওয়াই স্বাভাবিক। রনির অস্ফুট গোঙানির মত,আওয়াজ বোঝার চেষ্টা কখনো করেনি ওর বাবা।
'মায়ের তো কোভিড! মা বোধহয় আর ফিরবেই না!'দশ বছরের রনিও জানে,ভাবে সে।সেই যে সেদিন সাদা সাদা লোক গুলো মা কে নিয়ে গেল।তারপর থেকেই মা উধাও।'আচ্ছা মা কি ঘুমোচ্ছে?মা কি মরেই গেছে?'কিন্তু ওই সাদা মেঘের স্বপ্নদেশে রনিরই তো আগে যাওয়ার কথা,রনি জানে,ওর মনে হয় মা না থাকলে একটা বিরাট সাপ ওকে একদিন ঠিক ছোবল মারবে,রনিও মায়ের কাছে চলে যাবে নিমেষে।
-'বাবা,বলো না মা...'রনি আপ্রাণ চেষ্টা করে,বোঝাতে।
-'ঘুমিয়ে পর;আমি তো আছি!'কিছু একটা অনুমান করে উত্তর দিলো রনির বাবা।রনি কিছু একটা বুঝে বা না বুঝে চুপ করে গেলো।চোখ বন্ধ করলো।

'কোভিড কে হারিয়ে,কালই ফিরছে জয়ী, রনির জন্য দারুন সারপ্রাইজ!মা কে একমাস পর হঠাত পাবে! ওর রিয়্যাকশনটা দেখবার মতো হবে!'মনে মনে হাসলেন,কিছু বললেন না,বোঝালেন না রনির বাবা।

-----------------------


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন