পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ৩ জানুয়ারী, ২০২১

তুষ্টি ভট্টাচার্য

                                             


    

 চতুর্থ পর্বের পর

সাইকেল 

৫) 

  ভোরবেলা ওঠা অভ্যেস সামুয়েলের। এখানে সূর্যও সকাল সকাল উঠে পড়ে। এবাড়িরও ঘুম ভেঙে গেছে, ধোওয়া মোছার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মানুষের শব্দ। ঘরকন্নার শব্দ। ঠিক যেমন ওদের বাড়িতে এই সব রোজকার খুঁটিনাটি শব্দে ঘুম ভাঙে ওর। প্রথমে ভেবেছিল বাড়িতেই আছে বুঝি। জানলার বাইরে চোখ গেলে খেয়াল হল, এ এক অন্য দেশ। আলস্য কাটিয়ে বাইরে এলো সামুয়েল। সাইকেলের কাছে গিয়ে ওর ঘুম ভাঙাল। এবার তাদের মেলামেশার সময়। সাইকেল নিয়ে বেরোতে যাবে, এমন সময় বুলবুল এক কাপ কফি নিয়ে এলো ওর জন্য। এরা যদিও চা খায়। সকালে লিকার চা, পরে ঘন দুধ, চিনি দিয়ে কড়া আসাম চা। একবার, দুবার চেষ্টা করে দেখেছিল সামুয়েল, খেতে পারেনি। এত মিষ্টি চা কী করে খায় এরা? মেয়েটা কফি দিয়ে চলে যাচ্ছিল। ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করল সামুয়েল, তোমার চা খাওয়া হয়েছে? ঘাড় নাড়ল ও। একটু যেন গম্ভীর মেয়েটা বয়সের তুলনায়। নাকি বিদেশি কাউকে দেখে অমন হয়ে আছে? যাই হোক না কেন, ওকে আর রাগিয়ে দেওয়া চলবে না। ভাব জমানোর উদ্দেশ্যে ও আবার বলল, পড়াশুনো হচ্ছে তো ঠিকমতো? কজন বন্ধু তোমার? বেস্ট ফ্রেন্ড কে? তিনটে প্রশ্নের উত্তরে বুলবুল একটাও শব্দ করল না। জ্বলন্ত চোখে ওর দিকে তাকাল শুধু। তারপর চলে গেল। সামুয়েল সাইকেল নিয়ে ঘুরে আসার পর দেখল, ওর ঘরের সামনে টানা বারান্দায় দুজন বাচ্চা ছেলেমেয়ের সঙ্গে বুলবুল বসে বসে খুব গল্প করছে। ও এলে নিজেই যেচে বলল, এই যে! এদের চিনে নাও। এরাই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আর কোনো বন্ধু নেই আমার। স্কুলের সঙ্গীরা সবাই আমাকে হিংসে করে। 

  এখন এই মেয়েকে দেখলে কে বলবে, এই সেই রাগী মেয়েটা! দিব্যি হাসিখুশিতে ঝলমল করছে। সেই থেকে রুবাই আর মুনিয়া ওরফে মাদাম সামুয়েলেরও সঙ্গী হয়ে গেল। বুলবুল বড় হয়েছে বলে, ওকে বাড়ি থেকে সব সময়ে বেরতে দেয় না। যেখানে সেখানে যাওয়াও তার মানা। তাই সামুয়েলের সর্বক্ষণের সঙ্গী ওরাই। তিন/চারদিন গ্রাম ঘুরে ঘুরেই কাটিয়ে দিল সামুয়েল। সবার সঙ্গে ওর আলাপ করতেই হবে। এর বাড়ি, ওর বাড়িতে ডাল পেলেই গিয়ে দুটো বাতাসা জল খেয়ে আসতে হবে, নয়ত মুড়ি চিবিয়ে কয়েক মুঠো। পাঁচদিনের মাথায় এমন হল সামুয়েলকে গ্রামের সবাই চিনে গেল নাম ধরে। ও যেন এ গ্রামেরই বাসিন্দা। বিকেল হলেই একটা গাছতলায়, যে বটগাছের ঝুরি নামা আয়তন দেখে সামুয়েল মুগ্ধ, সে গাছের নিচে জমায়েত হয় অনেকে। সেখানে সামুয়েল গান শোনায়, ওদের গান শুনে সুর তুলতে চেষ্টা করে, সাইকেল নিয়ে কিভাবে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ায় ও, সেই সব গপ্প বলে। সূর্য অস্ত গেলে একটা মেয়ের মুখ মনে পড়ে সামুয়েলের। তার এক্স প্রেমিকা। কবে যেন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে ওদের…ওর নিজেরই দোষে। সে স্বভাব বাউন্ডুলে, সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লে সব ভুলে যায়। সে আর কতদিন অপেক্ষা করবে! মেয়েদের মনোযোগ চাই, আর কোনো নির্দিষ্ট মানুষের দিকে মন দিতে পারে না সামুয়েল। একমাত্র মা আর দিদা ছাড়া কারুর ওপর সেভাবে টান নেই ওর। আকর্ষণ জাগলেও সে সাময়িক, কেটে যায় দুদিনে। উঠে পড়ল ও সাইকেল নিয়ে। নিজের ঘরে ঢুকেই একটা তাজা ফুলের গন্ধ পেল। টেবিলের ওপর একটা কাঁসার বাটিতে জল দিয়ে তার মধ্যে বেল, জুঁই, গন্ধরাজ ফুল রেখে গেছে কেউ। টেবিলে, বিছানা পরিপাটি করে গুছনোও হয়েছে। সে একটু এলোমেলো স্বভাবের, গুছিয়ে রাখতে পারে না বা ইচ্ছে করে না। এ নিয়ে মায়ের বকুনি খেতে এক সময়ে রোজ। তারপর মাও আর বিরক্ত হয়ে বলে না কিছু। 

   গিটারটা সন্তর্পনে ঝুলিয়ে রাখল ও। নাহ! এখানে এমন অসভ্যের মতো থাকা চলে না। হাজার হোক, অন্যের বাড়ি। হাত, পা ধুয়ে এল ও। সঙ্গে সঙ্গে কাঁসার বড় বাটিতে মুড়ি, নারকেল মাখা নিয়ে হাজির হল বুলবুলি। অভিজিৎ আজ কোথায় যেন বেরিয়েছে। ও হ্যাঁ, কী একটা সরকারি কাজে সদরে গেছে। ফিরতে হয়ত একটু দেরিই হবে ওর। মুড়ির বাটিটা টেবিলে ঠক করে নামিয়ে রাখল বুলবুল। তারপর ওর চোখের দিকে সরাসরি তাকাল। সামুয়েল কি কেঁপে উঠল একটু? ওর ধুসর মণিতে ছায়া পড়ল কালো হ্রদের? তারপর গিটার ছাড়াই খালি গলায় গেয়ে উঠল-

Te necesito como

 a luz del sol

en este invierno frío

pa' darme tu calor

te necesito como a luz del sol

tus ojos el abismo

donde muere mi razón.

( সূর্যের আলোর মতো আমি তোমাকে চাই/ এই ঠান্ডা শীতে তোমার উষ্ণতা পেতে চাই/ সূর্যের আলোর মতো তোমাকে পেতে চাই/ তোমার চোখ, মৃত্যুকূপ, যেখানে কোনো কারণ ছাড়াই আমি মরে যেতে চাই)


বুলবুল সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, মানে কী বল…এই গানের ভেতরে কী এক আর্তি রয়েছে…আমার মন কেমন করে উঠল কেন? ওর দিকে তাকিয়ে গভীর গলায় সামুয়েল বলে উঠল, এ গানের কোনো মানে নেই, থাকতে পারে না। তুমি ভাল মেয়ে, তাই মন কেমন করেছে তোমার। এবার আমাকে কিছু কাজ করতে হবে যে… 

ধীরে ধীরে বুলবুল চলে যাচ্ছে বারান্দা বেয়ে…যেন এক তিতির পাখি সহসা শান্ত হয়ে উঠেছে আর উড়তে ভুলে গেছে আচমকাই। মনের ভেতরে একটা মায়া টনটন করে উঠল সামুয়েলের।          

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন