পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ৩১ জানুয়ারী, ২০২১

জয়তী রায় ( মুনিয়া)

                                           


                    

মনের জানলা

অধ্যায় __৪

 

    আজ বলব মনের ব্যাংকিংয়ের কথা। ব্যাংক শব্দটা জড়িয়ে আছে জীবনের প্রতিটি স্তরে। নিচুতলা থেকে উঁচুতলা ব্যাংকের দ্বারস্থ সবাই। কারণ, জমা থাক কিছু পুঁজি। অসময়ে কাজে লাগবে। বিপদে পড়লে কাজে লাগবে। 

জমা করা ,জড়ো করা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আরো নানান দিক আছে এই জমিয়ে রাখার ব্যাপারে। যেমন , কথায় কথায় আমরা বলি, এনার্জি বাঁচিয়ে রাখতে। একটু ঘুমিয়ে নিতে। শরীর ফ্রেশ হয়ে যাবে। পরে কাজ করার সময় বাঁচিয়ে রাখা এনার্জি সাহায্য করবে। ঠিকমত ঘুম, পুষ্টিকর খাবার, সঠিক ব্যায়াম করে শরীর ঝরঝর তাজা করে ফেলার উপদেশ সর্বক্ষণ শুনতে হয়। 

তাহলে মনের ব্যাংকিং কি? মনের ঘরের জমা খরচের হিসেব ঠিক কি রকম?

     ******

  মুশকিল হল, ব্যবহারিক জগৎ আর তার উপযোগিতা নিয়ে সর্বক্ষণ হিসেব নিকেশ করে চলেছি। নিজেদের খুব বুদ্ধিমান ভাবছি। চারিদিকে সবকিছু সামলে চলে নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ে বাহবা দিচ্ছি। আজ এমন দুজন মহিলার  গল্প করি। গল্প নয়। সত্য ঘটনা। 

 প্রথমজন  বাংলাদেশ হতে প্রচুর সংগ্রাম করে কলকাতা এসে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। জিরো থেকে একেবারে হিরো। ছেলেগুলো হীরের টুকরো বললেও কম বলা হয়। সেইসঙ্গে মা অন্ত প্রাণ। স্বামী অকালে স্বর্গে চলে গেলেও ওনার কোনও  সমস্যা হয় নি। উনি প্রচুর পুজো করতেন। উপোস করতেন। এবং কাউকে বিশ্বাস করতেন না। এককথায় চতুর যাকে বলে। চারিদিকে সতর্ক নজর। টাকা পয়সা অনেক। ছেলেরা হাতের মুঠোয়। ধন্য ধন্য করত লোক। 

  আজ তিনি বিছানায় শয্যাগত। ছেলেরা রাজকীয় চিকিৎসায় রেখেছে। তার স্মৃতি ক্রমশঃ লোপ পাচ্ছে। কথা বলেন। কথার বেশিরভাগ হল অশ্রাব্য গালি। নোংরা কথার তুবড়ি। নিজের মনেই বলে যান। আয়া নাকি ওনার গোপনাঙ্গে হাত দিয়েছে। একটার পর একটা আয়া বদল। ওনার গালি গালাজ চলতেই থাকে। 


       গল্প ২

____________

 আরেক মহিলার গল্প। সংগ্রামের ইতিহাস দুজনের প্রায় সমান। সাফল্যের বিচারে দ্বিতীয়মহিলা অনেক কম। অর্থভাগ্য ভালো নয়। সন্তান ভাগ্য ভালো নয়। দিনান্তে নিজের ভাত নিজের ফুটিয়ে খাওয়া ছিল তার ভবিতব্য। 

********

এই মহিলা দুজনকে তাদের মধ্যবয়স থেকে দেখেছি। খুব কাছের থেকে। তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ করতাম। দুজন মহিলা আমার কাছের মানুষ। দুজনেই বিধবা। দুজনেই পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। 

আমি লক্ষ্য করতাম ওদের চলাফেরা, কথাবার্তা। সফল মহিলার চলা ফেরার মধ্যে উগ্র অহঙ্কার ফেটে পড়ত। মুখে একফোঁটা হাসি নেই। সর্বদা অবিশ্বাস। ভুরু দুটি কুঁচকে আছে। নিরামিষ খেলেও প্রচুর ফল দুধ হরলিকস একেবারে সময় মেপে খান। বাড়িঘর নিয়ে ভীষন সচেতন। সিল্কের শাড়ী, গহনা।  অপর মহিলা একবেলা আহার করেন। যত অল্প খাওয়া যায়। নিরন্তর মুখে হাসি। সকলের সঙ্গে কুশল বিনিময়। যে সন্তান রোজ আঘাত করছে তার জন্য প্রার্থনা। অচেনা লোকের জন্যেও শুভ কামনা। সাদাথান ছাড়া কোনো কিছু নেই। এমনকি একটুকরো সোনা পযর্ন্ত নেই। আমি শুনেছি, সফল মহিলা ব্যঙ্গ করে বলতেন," তুমি ভাই ভীষন বোকা। 

উত্তরে মহিলা হাসতেন। বলতেন," আমি খুব শান্তিতে আছি। 

ব্যর্থ মহিলা সুস্থ থেকে সজ্ঞানে দেহত্যাগ করেছেন। এক ফোঁটা সেবা নেননি কারো কাছ হতে। সফল মহিলা বিছানায়। সাধের বাড়িতে রাজত্ব এখন আযাদের, ছেলেরা দেখাশোনা করে কিন্তু থাকে নিজেদের ফ্ল্যাটে। সিল্কের শাড়ির হিসাব নেই। গহনা মেয়ের হেফাজতে। কোনো জ্ঞানই নেই। গালাগালি কেন দেন, সেটা এখন আমি জানি। এ বিষয়ে পড়াশুনো করে বুঝেছি, মনের ব্যাংকে যা যা সঞ্চয় হয়ে থাকবে সেগুলো অবচেতনে বেরিয়ে আসে।ওই যে ওনার স্বভাব, যাকে উনি লালন করেছিলেন সযত্নে, মনে করতেন এটাই উচিত। সন্ধ্যে হলেই বাংলা সিরিয়াল দেখতেন। রাতে সেই সিরিয়ালের গল্প বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। দিনে রাতে চব্বিশ ঘণ্টা ওনার মন একটাই সংকেত দিত সেটা হল, কোথাও বিশ্বাস নেই। নিজের কাজ গুছিয়ে নিতে হবে। এটা হয়ত কোনো অন্যায় নয়। বেঁচে থাকার একটা উপায়। কিন্তু সে উপায় ঠিক না ভুল সেটার প্রমাণ দেয় সময়। উনি মারা গেলে কি হত জানি না তবে বেঁচে আছেন এবং নেগেটিভ স্মৃতির মধ্যে তলিয়ে আছেন। ওনার মনের ব্যাংকে জমা হয়ে আছে অবিশ্বাসের পুঁজি। অহঙ্কার। ক্ষমতা লিপ্সা। সেটাই এখন ফোয়ারার মত বেরিয়ে আসছে। 

 মন : ভীষণ শক্তিশালী যন্ত্র। সমস্ত রেখে দেয় নিজের ভিতর। মূল কথা হল আনন্দ এবং এনার্জি। ওই যে অসফল মহিলা , উনি ভিতরে কখনো ক্ষোভ পুষে রাখেন নি। যা পেয়েছেন যতটুকু পেয়েছেন আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। তৃপ্ত থেকেছেন। সন্তান ওনাকে আঘাত করলেও উনি তার জন্য প্রার্থনা করেছেন আর ওই সফল মহিলার সন্তান মাথায় করে রাখলেও উনি ভাবতেন যথেষ্ট করা হচ্ছে না। সুতরাং, সচেতন থাকতেই হবে। আমরা সবচেয়ে বেশি ছেলেখেলা করি মন নিয়ে। যা পারি, যেভাবে পারি ঢোকাতে থাকি। রাগ অভিমান দুঃখ ক্ষোভ ... যেন এটা আমার ডাস্টবিন। নাহ্। এই মন আমার বর্ম। আমার অস্ত্র। যা খুশি ভাবে তাকে ব্যবহার করার আগে ভাবতে হবে বইকি। এই ভাবনা আমাদের এনার্জি লেভেল বাড়িয়ে দেবে। শরীরের উপর কত নজর ! চুল এই করো, ত্বক ওই করো। কিন্তু, চিন্তন? মন? সারাদিন তাকে কি দিচ্ছি?

এই মুহূর্তে আমরা অনেকেই লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত। লেখালিখি কথাটা বলতে এবং শুনতে যত সুন্দর হোক না কেন, সে জগৎ কত ভয়ঙ্কর সে কথা সকলেই জানি। দিনরাত সেখানে অবিশ্বাস আর দুর্নামের খেলা চলছে। একে অপরের নামে বলছি আমরা। পোস্ট লিখছি। ঠকছি। ঠকাচ্ছি। সারাদিন এইভাবেই ভাবছি কি করে আরো আরো লাভবান হওয়া যায়। 

 ঈর্ষা হোক মহতের তরে... 

    কালজয়ী কবি এমন বলতে পারেন। সৃষ্টির মূল কথা ঈর্ষা। 

প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে কাজের আনন্দ কিসের? কিন্তু তার মানে এই নয় যে , চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আঠারো ঘণ্টা প্রতিদ্বন্দ্বী র কথা ভাবতে থাকব অথবা অপর কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে ক্ষোভ আর হতাশায় ডুবে থাকব। 

  যদি প্রশ্ন হয়, ব্যবসা করতে গেলে কিছু নিয়ম মানতে হবে, না হলে সফলতা আসবে না। সব সফল মানুষ কোনো না কোনো সময় অন্যায় করেছেন এবং করছেন। তবে? তারা কি ভালো নেই? সাধু আর বোকা হয়ে এই দুনিয়ায় কোনো লাভ নেই। 

 সমস্যা হল অন্য জায়গায়। জীবনে লাভ হচ্ছে না ক্ষতি সেটা বুঝতে যখন পারি তখন দেরি হয়ে যায় অনেক। মাটির যেমন ধারণ ক্ষমতা পরিমিত, তার উপর অযথা ভার চাপিয়ে গেলে এক সময় সে বিদ্রোহ করে, মনের জমির নেওয়ার কিছু সীমিত ক্ষমতা আছে। তাকে এনার্জি তে ভরপুর রাখতে হয়। নেগেটিভ কথা আর কাজের পাহাড় চাপিয়ে দিতে দিতে এক সময় বিদ্রোহ করে সে। 

 শেষের সে দিন কে দেখেছে? লোকে বলবে ভালো লোক কি কষ্ট পায় না? কষ্ট কখনো ভালো মন্দ বিচার করে না। যার পাওয়ার সে পাবেই। কথা হল, মনের ধারণ ক্ষমতা বা শক্তি যার বেশি সে কষ্ট নিয়েও ভালো থাকে। সুন্দর ভাবনা থাকার ফলে তার ভিতর তৈরি হয় পজিটিভ এনার্জি। ওই এনার্জি সাহায্য করে। বয়স হলে শরীরের যন্ত্রপাতির ক্ষয় হবে। কালের নিয়ম। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, মনের সঙ্গে বয়সের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রতিদিন এনার্জি যোগান দিলে মন সতেজ থাকবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। মন ব্যাংকিং। জমা করতে হবে ভালো ভাবনা। সুন্দর চিন্তা। সুন্দর সঙ্গ। সুদে আসলে ফেরত পাওয়া যাবে সময় হলে। 

 টাকা বাঁচিয়ে ব্যাংকে ফেলতে হয়। মন বাঁচিয়ে রাখতে হয় বইকি। সোশ্যাল মিডিয়ার কোন কোন দিক আমাকে বিরক্ত করছে, কোন বন্ধুর সঙ্গ আমাকে ক্লান্ত করে তুলছে ... এগুলো সুদূর ভবিষ্যতে  এনার্জি ব্যাংকের পুঁজি নষ্ট করে দেবে। সাবধান হতে হবে এখন থেকে। 

ভালো লেখক হওয়ার জন্য নামী পাবলিশার হওয়ার জন্য প্রতিদিন এই যে ধার করা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি, ভাবছি কি ভবিষ্যত কি নিয়ে আসছে? অকারণ এনার্জি ক্ষয় করে লাভ নেই। বাঁচিয়ে রাখতে শিখতে হবে। জীবন থাকলে কোনো না কোনো দিকে আমাদের পথ খুলেই যাবে। 

  নিজে আনন্দে থাকলে জগৎ আনন্দময়। এমন চিন্তাশক্তি সবল থাক যার ফলে ভালো হতে বাধ্য। মনের ব্যাংকে বেড়ে উঠুক মঙ্গলধ্বনি। একদিন সেটা কাজে লাগবে আমাদের।।

রবিবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০২১

জয়তী রায় মুনিয়া

                                       


মন – খোলা জানালা 

মনেরপুষ্টির জন্য কি কি করা প্রয়োজন।

 শিশুর জন্ম থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত পরিবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে শরীরের পুষ্টি কি করে বৃদ্ধি পাবে সেটা নিয়ে। শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে করুণ আর্জি চলে স্বাস্থ্যবান বাচ্চা চাই। কতরকম খাবার খাওয়ায় তাকে। আজকাল সকলেরই একটা কি দুটো বাচ্চা। পরিবারের পুরো মনোযোগ থাকে শিশুর উদর কতটা পূর্ণ হল অথবা হল না। শিশু কোলে মায়েদের নিরন্তর অনুযোগ চলতেই থাকে তার বাচ্চা কিছু খায় না! এখন কথা হল, জন্মের পরে দৈহিক পুষ্টি গুরুত্ব পায় আর মনের পুষ্টি? তার কথা কতটুকু ভাবে মানুষ? একজন শিশুর মনের গঠন ঠিক ভাবে গড়ে উঠছে কি না, সেটা দেখা পরিবারের কর্তব্য। খুব ছোট্ট থেকে এমনকি যখন মাত্র কয়েক মাস বয়স, তখন থেকেই শিশুটির মনের ভিতর নানারকম ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। সেইসময় কিভাবে শিশুর মন আনন্দে ভরপুর থাকবে, সেটা বোঝা উচিত। 

*****

আজ যে শিশু আগামীকাল সে একজন দায়িত্ব বান নাগরিক। মজবুত শরীরের সঙ্গে চাই একটি মজবুত মন। সে যেন সমস্ত রকম সমস্যার সামনে স্থির রাখতে পারে নিজেকে। প্রতিকূল পৃথিবীতে লড়াই করতে গেলে স্থিতিশীল মনের প্রয়োজন খুব। 

     ক্রমবর্ধমান স্ট্রেস সঙ্গে নিয়ে চলতে হয়। এর ফলে আমাদের ক্ষতি হয়। অনেকটা স্লোপয়জনিং এর মত। খুব ধীরে ধীরে চিন্তা গ্রাস করে আমাদের। 

  বিজ্ঞান বলে, দীর্ঘদিন চাপের মধ্যে দিয়ে গেলে মস্তিষ্ক প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষকে শান্ত করতে সাহায্য করে। সেইসময়, ডোপামাইন বা ডোপামিন ( dopamine)। বলে একপ্রকার হরমোন ক্ষরণ হয়। 

  এই হরমোনের কাজ হল , খুশি উৎপন্ন করা। অর্থাৎ চাপ মুক্ত করতে সাহায্য করা। কি সাংঘাতিক কাজ করে এই হরমোন। ( বলে রাখা ভালো, এই প্রবন্ধ কোনো নিউরো সার্জনের লেখা নয়। কিন্তু, আমার বক্তব্যের সঙ্গে শরীর যুক্ত। তাই এই কথা গুলো সংক্ষেপে হলেও আনতে হবে)। 

  খুশি উৎপন্ন করে এমন হরমোন, যা কিনা neurotransmitter হিসেবেও কাজ করে, তার এত গুরুত্ব কেন? 

 কথায় কথায় আমরা বলি, feel good, আনন্দে থাকো। খুশিতে থাকো। ডোপামাইন হরমোন ভালো থাকার প্রেরণা যোগায়। ভালো কাজ করার প্রেরণা যোগায়। ভালো ভাবে থাকার প্রেরণা যোগায়। আরো অনেক অনেক কাজ করে, অনেকেই হয়তো এ সম্পর্কে জানে। অর্থাৎ, ভালো থাকতে হলে ডোপামাইন নিঃসরণ সুন্দর ভাবে হওয়া বাঞ্ছনীয়। 


   ২


    মানুষ স্বাভাবিক ভাবে ভালো থাকতে চায়। সে কাজে তাকে সাহায্য করে তার মস্তিষ্ক। 

 আমরা ভাবতে পারি কি ? যে, আনন্দ দেওয়া এই হরমোনের উদ্দেশ্য। এবং, এই হরমোন সঠিক পরিমাণ নিঃসরণে মানুষ নানা ধরণের কাজে উৎসাহ পায়। শরীরের অন্যান্য ইন্দ্রিয় শক্তিশালী হয়। সে না হয় বোঝা গেল। কিন্তু যে স্ট্রেস প্রতিদিন উৎপন্ন হচ্ছে বাইরে থেকে, সে তো ছিনিয়ে নিচ্ছে আমাদের খুশি? তবে? উপায়?  বিভিন্ন কারণে চলে যাচ্ছে খুশির অনুভব। মহামারীর সংকট এই মুহূর্তে একটি বড় কারণ। সেটা মেনে নেওয়া যায়, যদিও স্নায়ুর উপর প্রবল চাপ ফেলছে এবং বহু মানুষ মনের রোগের শিকার হচ্ছেন। 

 এই বড় কারণ ছাড়াও, ছোট ছোট বহু করণের ফলে ক্ষয় হচ্ছে আনন্দের ভূমি। সৃষ্টি হচ্ছে ক্ষোভের। পার্থিব জগতে প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির মধ্যে টানা পোড়েন থাকে তীব্র। সর্বক্ষণ একটা ভয় কাজ করে। এই বুঝি হারিয়ে গেল! এই বুঝি অমুক পেল সম্মান , এই বুঝি ...! আমি পারলাম না। আমি হেরে গেলাম।  ভাবলে অবাক হতে হয়, ছোট বাচ্চাদের মনের মধ্যেও এরকম ক্ষোভ দুঃখ হতাশা জেগে ওঠে। অর্থাৎ, যে সুন্দর কাজ আমাদের খুশি দিতে পারে, সে কাজ যদি কোনো কারণে সাফল্য না পায়, তবে আমাদের মনের ব্যালান্স শূণ্য হয়ে যেতে পারে!

  অবসাদ আচ্ছন্ন করলে ডোপামাইন হরমোন নিঃসরণ ঠিক মত হয় না অথবা বেশি হয়। দুটোই ক্ষতিকর। কম মাত্রায় হলে, প্রচুর রোগ খুব ধীরে ধীরে আক্রমণ করে। এবার যেই মাত্র অবসাদ ঘিরে ধরছে, সহজ উপায় খুঁজে নিচ্ছি ভালো থাকার।  ভিডিও গেম, সিগারেট, নানারকম নেশা, বিকৃত পোস্ট,  ইত্যাদি বহুরকম কাজ করলে সাময়িক মন খারাপ ভুলে থাকা যায়।  খুব ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, যারা এই ধরণের নেগেটিভ কাজ করে, যে বাচ্চারা বেশি ট্যাব আসক্ত ... কোথাও না কোথাও তাদের মনের প্রবলেম আছে। তারা জানেও না, বাইরের থেকে আনন্দ নিয়ে ভিতরের কতখানি ক্ষতি হচ্ছে। খুশি যদি অযথা অকারণ অদরকারি হয়, তবে হরমোনের মাত্রা বেড়ে গেলেও শরীরে নানা উপসর্গ দেখা দেয়। প্রথম কথা, নেশা ছাড়া তখন আর খুশি থাকা যায় না। বাচ্চার থেকে ট্যাব নিলে সে হিংস্র হয়ে ওঠে। নানা রকম অপরাধ মূলক কাজ, অযথা অভিযোগ অভিমান ... এ সমস্তই ধীরে ধীরে অধিকার করে ফেলে আমাদের সমস্ত নিজস্বতা। 

   

 ৩

প্রাচীন কাল থেকেই, ভালো থাকার একটা উপায় বলা হয় শ্বাস নেওয়া, মেডিটেশন করা অথবা কিছুক্ষণ মৌন থাকা।  নাম জপ করা... ইত্যাদি ইত্যাদি। এই কাজগুলো মনের ব্যায়ামের অঙ্গ। সবচেয়ে বড় কথা, মনের ব্যায়াম ঠিক মতন করলে, ডোপামাইন হরমোন নিয়ন্ত্রণে থাকে। এটা আমার মনে হয়। সত্যি কথা বলতে কি, এই কিছুদিন আগে একজন কাউন্সিলিং করতে এসেছে,( হয়ত সে পড়ছে এই প্রবন্ধ,) তার বাচ্চাটি ট্যাব আসক্ত। আমি এটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে আবিষ্কার করি,শৈশব থেকেই ওর মধ্যে ছিল খুশির অভাব। এখন ও খুশি খুঁজে নিচ্ছে ট্যাব দেখে। আরো এক জায়গায় পড়লাম, যদি ডোপামাইন নিঃসরণ বেশি হয়, তবে সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ দেখা দিতে পারে। অর্থাৎ, নিজের এক দুনিয়া বানিয়ে নিয়ে সুখে থাকা। পারিপার্শ্বিক কারো সঙ্গ ভালো না লাগা। একলা থাকা। নিজের মত। 


আমি এত জটিল বিজ্ঞান বুঝি না। মনের জন্য ওষুধ খেতে হয়, সে বিশ্বাসও করি না। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন," সুখ দুখ সমভাব চ। 

  এই উপদেশ হল আবেগ নিয়ন্ত্রণের মূল কথা। সাফল্য আর ব্যর্থতা বলে কিছু হয় না। এক দরজা বন্ধ হোক। সুখী হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। আবেগ যেমন চালিকা শক্তি তেমনি অতি আবেগ ক্ষতিকর। মনে রাখতে হবে, বেঁচে থাকাই হল সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। একবার এক চাকর আর এক রাজা দুজনেই জলে ডুবে মারা যায়। জলে ডুবে চেহারা বিকৃত হওয়ায় কেউ বুঝতেই পারল না , কে চাকর আর কে রাজা? লোকজন অনেক ভেবে চিন্তে আন্দাজে দেহ দুটির একটিকে রানীর কাছে অপরটি চাকরদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিল।।

  এই তো জীবন! যতক্ষণ আছি ডিউটি করে যাই। ফল পাবার হলে পাবো, না হলে পাব না। সেটা আমার হাতে নেই। কিন্তু , ফল না পেলে দুঃখী হব কি না সেটা আমার হাতে আছে। 

 বাচ্চাকে আনন্দে রাখা আমাদের কর্তব্য। তবে ওর ভিতর খুশিতে ভরে উঠবে। অনেক কাজ ও আনন্দে করবে। না হলে ধীরে ধীরে মনের চারিদিকে জঞ্জাল জমতে থাকবে। 

  অবসাদ , আবেগ , ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের সেরা উপায়, 

  অ উ ম অথবা সো হ ম উচ্চারণ করা। প্রতিদিন।  আর প্রতিদিন নিজেকে বলা

  আমি ভালো আছি।





রবিবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০২১

জয়তী রায় মুনিয়া

                             



অতীত, একটু কম কথা বলো।

 মুডসুইং নিয়ে কথা বলছিলাম। মুড অথবা আবেগের ওঠা পড়া অনেকটা নির্ভর করে অতীত চারণার মধ্যে। অতীতের সুখময় দিন অথবা দুঃখের স্মৃতি মানুষকে নিঃস্ব করে তোলে। কত সুখে ছিলাম অথবা কত দুঃখে ছিলাম... এই বোধ থেকে আসে হতাশা। মন খারাপ। কিটকিট। ভালো না লাগার প্রকোপ বাড়তে থাকে। 

 আজকের আলোচনার বিষয় 

  অতীত। 

     অতীত নিয়ে আমার বাবা খুব  সতর্ক ছিলেন। মানসিক ভোগান্তির একটা মূল কারণ পিছন ফিরে দেখা সে বিষয়ে বারবার বলতেন। তখন আমার দশ / এগার বছর বয়স। বাবা একদিন নিয়ে গেলেন বাগানে। মাটিতে দুটো  গর্ত খুঁড়ে , একটিতে রাখলেন  ছোলাবীজ অপরটিতে তরকারির খোসা ডিমের খোলা ইত্যাদি। দিনচারেক পরে বললেন: চল, অতীতের ফলাফল দেখে আসি। যে গর্তে বীজ ছিল, তার উপরে ছোট ছোট সবুজ পাতা আর যেখানে আবর্জনা ছিল সেখানে দুর্গন্ধ। অমূল্য একটা শিক্ষা। অতীত থাকবে। কিন্তু, দুর্গন্ধ সৃষ্টি করতে পারে এমন কিছু পরিহার করাই ভালো। আজকে বহুমানুষ অতীতের করাল থাবার শিকার। অদ্ভুত ভাবে, মানুষ সুন্দরের চাইতে মনে রাখে খারাপ স্মৃতিগুলি।   যার ফলে মন খারাপ হয়। বরং, খারাপ স্মৃতি গুলি থেকে কিছু শিখে নেওয়া ভালো। সৃষ্টির সবুজ পাতা দুলবে। মেঘলা দুপুরে অতীত নিয়ে ভেবে কষ্ট না পেয়ে একটা বর্তমানের গান শুনে নিও। 

🔥🔥🔥বাবার শিক্ষা কতভাবে জীবনে কাজে লেগেছে, বলার মত না। মহিলা পুরুষ উভয়ের বিবাহের আগে এবং পরের জীবন সম্পূর্ন আলাদা। একেবারে অন্যরকম। সবদিক দিয়ে। নানা রকম ঝামেলা দায় দায়িত্ব ঘিরে ধরে চারিদিক থেকে। আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো ভয়ানক হয়েছিল বিদেশ চলে যাওয়ায়। এমন কিছু মানুষের সঙ্গে থাকতেই হত, যারা ভারতীয় কিন্তু বাঙালী বিদ্বেষী। আমি ছিলাম একমাত্র বঙ্গললনা। এ যেন ক্ষুধার্ত নেকড়ের সামনে সুস্বাদু খরগোশ। তাদের টাইম পাস ছিলাম আমি। এমন ব্যবস্থা তারা করেছিল, যাতে আমি ব্যাংকক ছেড়ে যেতে বাধ্য হই। বিজনবাবু সারাক্ষণ ট্রাভেল করছেন। সেইসুযোগে  দিনরাত্রি অপমান। বাচ্চাগুলোকে নানা ভাবে উৎপীড়ন। সেই সময় মনের কানে ভেসে এলো বাবার উপদেশ: রাস্তার নোংরা ঘরে আনবি না। রাস্তার ধাক্কা ওখানেই ফেলে রেখে, ঘরে বসে আরাম কর। তুই পরম সুখী। রোজ নিজেকে ভালোবেসে যা। 

ছোট্ট কথা। বাইরের পরিস্থিতি যেন কোনো ভাবেই মনের স্থিতি নষ্ট না করে। অদ্ভুত ম্যাজিক ঘটল এর পরে। যত অপমান করে ততো আমি উজ্জ্বল হই। বাচ্চারা দারুণ রেজাল্ট করে। আমার ঝকঝক চুল। চকচক ত্বক। স্বামী স্ত্রী বেড়াতে যাই। ওরা হার মেনে গেল। 

🙏  বাবা বলতেন: 

আমার মৃত্যুতে শোক করবে না। চেষ্টা করবে যে কাজে আমি খুশি হই, তাই করতে। 

সে কাজ হল, নিজের মনকে লাঠি বানাও। অবলম্বন করো। বাইরের আঘাতের সাধ্য কি, তোমাকে কষ্ট দেবে? 

এটাও অতীত চারণা বইকি! কিন্তু , সৃষ্টির সবুজপাতা দুলে ওঠে এতে। 

   অচেতনমন অনেক বেশি শক্তিশালী। অনেক বেশি জমিয়ে রাখতে পারে। অবচেতন মনে কোনো আইডিয়া ঢুকে গেলে , তা আমাদের সচেতন চিন্তাকে প্রভাবিত করে। অতীত বহু সময় ভয় দেখায়। আত্ম বিশ্বাস নষ্ট করতে উদ্যত হয়। 

সেজন্যে , অতীত থাকুক। কিন্তু তাকে বহন করতে হবে না। বর্জন নয়। বহন নয়। অতীত হোক একটা ঘটনা মাত্র। ক্যালেন্ডারের পুরনো পাতার মত। দরকার না হলে ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া যেতেই পারে। 

জীবন হল নৌকা। মন হল মাঝি। বিপদ সঙ্কুল নদীতে জীবন নৌকা সুন্দর করে বাইতে পারে দক্ষ মাঝি। যতই ঝড় আসুক, তুফান আসুক নাও নিয়ে মাঝি লড়ে যাবে শেষ পযর্ন্ত। কিন্তু অনভিজ্ঞ মাঝি? সে পারবে তীরে পৌঁছতে? লক্ষ্য স্থানে পৌঁছে যেতে ? পারবে না। তখন দোষ দিতে থাকবে পারিপার্শ্বিক খারাপ আবহাওয়ার। মন মাঝি  নিজেই দুর্বল, তৈরি হয়ে হাল ধরতে হয়, সে কথা মনে থাকে না। 

 আজ বাবার কথা মনে করছি। তিনি যে দর্শনের কথা  বলতেন, এখন বুঝি, সেগুলি নতুন কিছু না। আমরা সবাই সব জানি। শুধু মেনে চলি না। 

ধনী কে? এক সুন্দর মনের অধিকারী হল প্রকৃত ধনী।




রবিবার, ১০ জানুয়ারী, ২০২১

জয়তী রায় মুনিয়া

                                



 মেজাজ হল আসল রাজা/ আমি রাজা নই। 



   মুডসুইং ... অতি পরিচিত শব্দ। যেহেতু, মানসিক সমস্যা সমাজের উচ্চ এবং মধ্যবিত্তের মধ্যে বেশি, তার  মানে এই নয় যে নিম্নমধ্যবিত্তের মধ্যে দেখা যায় না। মেজাজের পারদ ওঠা নামা করে। এটাই হল, জীবনের চালাকি। মানুষের ক্ষমতা এত বেশি যে তারা সহজেই সব পেতে পারে। হয়ে উঠতে পারে ঈশ্বরসম। এইখানে তারা অসহায়। এই নিজের কাছে। নিজের মেজাজের কাছে। ইচ্ছে অনিচ্ছের কাছে। মুড ভালো রাখা, মুড কিভাবে সন্তুষ্ট হবে তার চেষ্টা করা এই একটি সূত্রের উপর দাঁড়িয়ে আছে সমস্ত সৃষ্টি। পরিবার। সমাজ। বহু জঘন্য অপরাধ থেকে বহু সার্থক সৃষ্টি সম্পন্ন হচ্ছে মুড এর জন্যে। 

  কি এই মুড? কেন এর এত  দাপট? 

ডাক্তার বলবে এটা একটা অসুখ। এই ভালো আছি তো এই খারাপ। কেউ কেউ হালকা চালে বলে, আজকাল খুব মুডসুইং করছে। যেন এটা একটা খেলা। অনেকে বলে, ওগুলো বেশি হয় মেয়েদের মধ্যে। প্রচলিত কথা, ঋতুচক্রের সময়, প্রেগন্যান্ট অবস্থায় , লিখতে বসলে, একঘেঁয়ে রান্নার কাজ করলে আরো নানান ব্যাপারে মেয়েদের মধ্যে বেশি হয় বলে ধারণা করা হয়। 

   সন্দেহ নেই, ঋতুকালীন সময় এবং গর্ভবতী অবস্থায় হরমোনের ওঠা পড়া খুব বেশি মাত্রায় হয়, মেজাজ খিটখিট করে। আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা যায়। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, আজকাল পুরুষদের মধ্যেও এই মুড সুইং কথাটা খুব স্বাভাবিক ভাবে বলা হচ্ছে। 

মুড বা মেজাজ বা মন কেন দোল খাচ্ছে? কেন ব্যালান্স হারাচ্ছে? এর সুদূরপ্রসারী ফল নিয়ে কেউ চিন্তিত নয়। 

কি ভয়ঙ্কর ক্ষতি সাধন করেছে কেউ বুঝতে পারছে না। এ যেন , বালির উপর রাজপ্রাসাদ তৈরি করছি আমরা। ভিত শক্ত হল না, অথচ এই করছি, সেই করছি। 

     ভারতবর্ষ এমন এক দেশ, বলা যায় একমাত্র দেশ, যেখানে প্রাচীন কাল থেকে মনের বিভিন্ন অবস্থার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। আমার বাবা বলতেন," আমরা অনেক প্ল্যান করি। এবার প্ল্যান মত কাজ হল না। ব্যর্থ হলাম। তখন কি হয়? মন খারাপ হয়। লাগাতার বলতে থাকি, প্রবলেম। প্রবলেম। মন খারাপ , মন খারাপ। সেই মন, যে আমাদের পাশে দাঁড়াবে, যে আমাদের প্রবলেম থেকে বেরিয়ে আসার সন্ধান দেবে, সে মন না কি খারাপ? তবে? 

বাবা বলতেন, প্রথমেই বাদ দাও প্রবলেম শব্দটা। বলো পরিস্থিতি। এবার দেখো। পরিস্থিতি খারাপ। লড়তে হবে। প্রবলেম শব্দ বারবার ব্যবহার করলে,মনের  ভাইব্রেশন নষ্ট হয়ে যায়। লড়াই করার শক্তি নষ্ট হয়। 

প্রাচীনকাল মানে পুরাণের কতগুলি গল্প নয়। শিক্ষা। কিভাবে ভালো থাকব, তার শিক্ষা। সেটা আলোচনা করার আগে,

এবার দেখা যাক, মুডসুইং কি কি নষ্ট করছে? 

 প্রতিদিনের বেঁচে থাকার শক্তি ক্ষয় করছে। এনার্জিস্তর কমিয়ে দিচ্ছে। এনার্জি কিন্তু আমাদের বেঁচে থাকার রসদ। খুব ধীরে ধীরে কমিয়ে দিতে দিতে খিটখিট করে তুলছে।করে তুলছে  স্পর্শকাতর। চট করে দুঃখ পাচ্ছি। অমুকের একটা শব্দ একটা, তুচ্ছ তাকানো , একটু এদিক ওদিক ব্যবহার নষ্ট করে দিচ্ছে সারাটা দিন। রাগ হচ্ছে। অকারণ হতাশা আসছে। ভয় এবং কান্না। 

  আজকাল গুগল করলে সমাধান চলে আসবে নিমেষে। প্রায় সবগুলোই বাইরের প্রক্রিয়া। যেমন, ব্যায়াম করতে বলা হয়। কাজে ব্যস্ত , লোকের সঙ্গে মেলা মেশা,প্রাণায়াম ইত্যাদি। 

   মুশকিল হল, এগুলো করতে ইচ্ছেই তো করবে না। ইচ্ছের জমি না তৈরি করলে ফসল ফলবে কি করে? ধাপে ধাপে এগিয়ে চলতে হবে। মুডসুইং মোটেই একদিন হঠাৎ হয় না। 

কারণ থাকে। বেশির ভাগ কারণ লুকিয়ে থাকে অতীতের মধ্যে। আমাদের সতর্ক হতে হবে। কারণ খুঁজে বার করতে হবে। প্রবলেম বলে কিছু নেই। পরিস্থিতি খারাপ। লড়তে হবে পরিস্থিতির সঙ্গে। সেটা পারবে শক্ত সবল মন। 

   থেরাপি::

১.অউম প্রতিদিন ১০ বার। করতেই হবে। 

২.আয়না থেরাপি দিনে একবার। 

৩.মৌন দিনে ২ মিনিট। 

৪.খাতায় লেখা সমস্যার কথা। 

 

    কেন যেতে হবে নিজের সমস্যার জন্য অন্যের কাছে? কেন তোড়জোড় করে শুরু করতে হবে রুটিন মেনে ধ্যান ইত্যাদি? মন নিরন্তর ডুবে থাকবে নিজের চেতন শুদ্ধ করার জন্য। যেমন , aquaguard  জল পরিশুদ্ধ করছে, তেমনি আমার মন করুক চিন্তা শুদ্ধ। সকাল থেকে সারাদিন পাচ্ছি। দেখি, পরিস্থিতি কোনদিকে যায়। খারাপ না ভালো? আছে শক্ত মন। করবে মোকাবিলা। একটাই কথা, বাবা বলতেন, প্ল্যান করো। পরিকল্পনা করো। কিন্তু দিনের কখন কি ঘটে যাবে, কেউ জানে না। কাজেই , সেই সঙ্গে এটাও ভাবতে হবে যদি প্ল্যান মত কাজ না হয়, তখন কি হবে? তখন মেজাজ খারাপ করব? আনন্দ নষ্ট করব? এনার্জি স্তর নামিয়ে দিয়ে নিজের ক্ষতি করব? ডাক্তারের কাছে দৌড়ে যাব? 

মুড নামক মহারাজকে মাথায় তুলতে নেই। মুড বা মেজাজ একটু এদিক হবেই। উপরের থেরাপি গুলো সাহায্য করবে, নিজের ভিতর শক্তি জাগ্রত করার। ফলে, বাইরের পরিস্থিতি যত খারাপ হোক, ভিতরের স্থিতি ঠিক থাকলে, লড়াই করার শক্তি জন্ম নেবেই। 

মুডসুইং এর গালভরা গুগল ব্যাখ্যায় না গিয়ে নিজেই বরং  গুগল হই অথবা মনের ডাক্তার হয়ে যাই। মেজাজের উপর কন্ট্রোল থাক আমার নিজের। শুনতে কঠিন হলেও খুব সহজ কিন্তু। চেষ্টা করে যাওয়া যাক। মন শক্ত হবেই। মুড তো দূরের কথা , সমস্ত প্রবলেম সমাধান করার শক্তি জেগে উঠবে। মেজাজ হোক প্রজা, আমি হই রাজা।

চিত্রঋণ- Thomas .S.Andro 





রবিবার, ৩ জানুয়ারী, ২০২১

সৌমিতা চট্টরাজ

                                      


এই সপ্তাহের কবি সৌমিতা চট্টরাজ৷জন্মঃ- ১৯৯৪ ২৬ শে অক্টোবর। ইংরেজিতে স্নাতক। রূপনারায়নপুর, পশ্চিমবর্ধমান নিবাসী। 
অবান্তর... 



১. 
কথা হচ্ছিল মৃত্যু দৃশ্য নিয়ে।
দুই আঙুলের দূরত্ব বাড়িয়ে জুম করলাম ছবিটা।
বিলিতি ব্র‍্যান্ডের বোতল, একের অধিক পুরুষ আর টালমাটাল হরফ সাঁতরে  রবীন্দ্রনাথ উৎরোতে চাইছি আমি...
যথারীতি সাংস্কৃতিক শামুকে পা গেঁথেছে আমার।
অতএব
দৃশ্যটার বাইরে বেরোতে পারছি না...
দু'আঙুলের দূরত্ব কমাতেও পারছি না...

২.
ভাবমূর্তি নিয়ে প্রায়শই প্রশ্ন তোলেন যারা
পোশাক খুলে তাদের সামনে দাঁড়াতে লজ্জার কি আছে আর!
বরং ভয় পাও হাত পা জিভ খুলে দাঁড়াতে
বরং ভয় পাও সেই পায়রার ঝাঁকটা কে হারিয়ে ফেলার...
খুদ খেতে খেতে এখনো তোমাকে যারা মানুষ ভাবে।

৩.
ভেড়া টির সুবাদেই দেবতা কে চেনা হয়েছিল।
ছবিতে দেখেছি যাকে নরম কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। 
সেই থেকে ভেড়ার পিছনে ধাওয়া করছি আমি।
ভেঙে ফেলছি পাহাড়, উপত্যকা...
আর ভেড়াটি দিব্যি চোখ বুজে মুখ লুকোচ্ছে দেবতার লোমশ বুকে।
ভাবছে, পৃথিবী তাকে দেখতে পাচ্ছে না...
কিন্তু আমিও দেখছি, পৃথিবীও দেখছে,
কিভাবে দেবতার দাঁতের ফাঁক দিয়ে একটা জলজ্যান্ত দানব ঝরে পড়ছে।

৪.
যে পুরুষটি তার প্রেমিকা কে নক্ষত্রের সঙ্গে তুলনা করেছিল
অথবা যে নারীটি তার প্রেমিককে আকাশের সঙ্গে...  
দুজনেই বোকা, কেউ একা নয়।

৫.
বিপ্লবী দিনদিন অসহ্য হয়ে ওঠে সংসারে। 
সংসারও তার কাছে প্রথাগত হেমন্তের মাঠ...
হেমন্তের ছয় ঘর ছেড়ে ডাইনী ঋতু টি থাকে
সংসারের রক্ত চোষে 
আর শাঁস চুষে বীজ পুঁতে গোলাপ ফোটায়
তুমি বাঁচো হে বিপ্লব... 
ভালবাসা মরে যাক বিনা চিকিৎসায়।

তুষ্টি ভট্টাচার্য

                                             


    

 চতুর্থ পর্বের পর

সাইকেল 

৫) 

  ভোরবেলা ওঠা অভ্যেস সামুয়েলের। এখানে সূর্যও সকাল সকাল উঠে পড়ে। এবাড়িরও ঘুম ভেঙে গেছে, ধোওয়া মোছার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মানুষের শব্দ। ঘরকন্নার শব্দ। ঠিক যেমন ওদের বাড়িতে এই সব রোজকার খুঁটিনাটি শব্দে ঘুম ভাঙে ওর। প্রথমে ভেবেছিল বাড়িতেই আছে বুঝি। জানলার বাইরে চোখ গেলে খেয়াল হল, এ এক অন্য দেশ। আলস্য কাটিয়ে বাইরে এলো সামুয়েল। সাইকেলের কাছে গিয়ে ওর ঘুম ভাঙাল। এবার তাদের মেলামেশার সময়। সাইকেল নিয়ে বেরোতে যাবে, এমন সময় বুলবুল এক কাপ কফি নিয়ে এলো ওর জন্য। এরা যদিও চা খায়। সকালে লিকার চা, পরে ঘন দুধ, চিনি দিয়ে কড়া আসাম চা। একবার, দুবার চেষ্টা করে দেখেছিল সামুয়েল, খেতে পারেনি। এত মিষ্টি চা কী করে খায় এরা? মেয়েটা কফি দিয়ে চলে যাচ্ছিল। ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করল সামুয়েল, তোমার চা খাওয়া হয়েছে? ঘাড় নাড়ল ও। একটু যেন গম্ভীর মেয়েটা বয়সের তুলনায়। নাকি বিদেশি কাউকে দেখে অমন হয়ে আছে? যাই হোক না কেন, ওকে আর রাগিয়ে দেওয়া চলবে না। ভাব জমানোর উদ্দেশ্যে ও আবার বলল, পড়াশুনো হচ্ছে তো ঠিকমতো? কজন বন্ধু তোমার? বেস্ট ফ্রেন্ড কে? তিনটে প্রশ্নের উত্তরে বুলবুল একটাও শব্দ করল না। জ্বলন্ত চোখে ওর দিকে তাকাল শুধু। তারপর চলে গেল। সামুয়েল সাইকেল নিয়ে ঘুরে আসার পর দেখল, ওর ঘরের সামনে টানা বারান্দায় দুজন বাচ্চা ছেলেমেয়ের সঙ্গে বুলবুল বসে বসে খুব গল্প করছে। ও এলে নিজেই যেচে বলল, এই যে! এদের চিনে নাও। এরাই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। আর কোনো বন্ধু নেই আমার। স্কুলের সঙ্গীরা সবাই আমাকে হিংসে করে। 

  এখন এই মেয়েকে দেখলে কে বলবে, এই সেই রাগী মেয়েটা! দিব্যি হাসিখুশিতে ঝলমল করছে। সেই থেকে রুবাই আর মুনিয়া ওরফে মাদাম সামুয়েলেরও সঙ্গী হয়ে গেল। বুলবুল বড় হয়েছে বলে, ওকে বাড়ি থেকে সব সময়ে বেরতে দেয় না। যেখানে সেখানে যাওয়াও তার মানা। তাই সামুয়েলের সর্বক্ষণের সঙ্গী ওরাই। তিন/চারদিন গ্রাম ঘুরে ঘুরেই কাটিয়ে দিল সামুয়েল। সবার সঙ্গে ওর আলাপ করতেই হবে। এর বাড়ি, ওর বাড়িতে ডাল পেলেই গিয়ে দুটো বাতাসা জল খেয়ে আসতে হবে, নয়ত মুড়ি চিবিয়ে কয়েক মুঠো। পাঁচদিনের মাথায় এমন হল সামুয়েলকে গ্রামের সবাই চিনে গেল নাম ধরে। ও যেন এ গ্রামেরই বাসিন্দা। বিকেল হলেই একটা গাছতলায়, যে বটগাছের ঝুরি নামা আয়তন দেখে সামুয়েল মুগ্ধ, সে গাছের নিচে জমায়েত হয় অনেকে। সেখানে সামুয়েল গান শোনায়, ওদের গান শুনে সুর তুলতে চেষ্টা করে, সাইকেল নিয়ে কিভাবে দেশে বিদেশে ঘুরে বেড়ায় ও, সেই সব গপ্প বলে। সূর্য অস্ত গেলে একটা মেয়ের মুখ মনে পড়ে সামুয়েলের। তার এক্স প্রেমিকা। কবে যেন ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে ওদের…ওর নিজেরই দোষে। সে স্বভাব বাউন্ডুলে, সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লে সব ভুলে যায়। সে আর কতদিন অপেক্ষা করবে! মেয়েদের মনোযোগ চাই, আর কোনো নির্দিষ্ট মানুষের দিকে মন দিতে পারে না সামুয়েল। একমাত্র মা আর দিদা ছাড়া কারুর ওপর সেভাবে টান নেই ওর। আকর্ষণ জাগলেও সে সাময়িক, কেটে যায় দুদিনে। উঠে পড়ল ও সাইকেল নিয়ে। নিজের ঘরে ঢুকেই একটা তাজা ফুলের গন্ধ পেল। টেবিলের ওপর একটা কাঁসার বাটিতে জল দিয়ে তার মধ্যে বেল, জুঁই, গন্ধরাজ ফুল রেখে গেছে কেউ। টেবিলে, বিছানা পরিপাটি করে গুছনোও হয়েছে। সে একটু এলোমেলো স্বভাবের, গুছিয়ে রাখতে পারে না বা ইচ্ছে করে না। এ নিয়ে মায়ের বকুনি খেতে এক সময়ে রোজ। তারপর মাও আর বিরক্ত হয়ে বলে না কিছু। 

   গিটারটা সন্তর্পনে ঝুলিয়ে রাখল ও। নাহ! এখানে এমন অসভ্যের মতো থাকা চলে না। হাজার হোক, অন্যের বাড়ি। হাত, পা ধুয়ে এল ও। সঙ্গে সঙ্গে কাঁসার বড় বাটিতে মুড়ি, নারকেল মাখা নিয়ে হাজির হল বুলবুলি। অভিজিৎ আজ কোথায় যেন বেরিয়েছে। ও হ্যাঁ, কী একটা সরকারি কাজে সদরে গেছে। ফিরতে হয়ত একটু দেরিই হবে ওর। মুড়ির বাটিটা টেবিলে ঠক করে নামিয়ে রাখল বুলবুল। তারপর ওর চোখের দিকে সরাসরি তাকাল। সামুয়েল কি কেঁপে উঠল একটু? ওর ধুসর মণিতে ছায়া পড়ল কালো হ্রদের? তারপর গিটার ছাড়াই খালি গলায় গেয়ে উঠল-

Te necesito como

 a luz del sol

en este invierno frío

pa' darme tu calor

te necesito como a luz del sol

tus ojos el abismo

donde muere mi razón.

( সূর্যের আলোর মতো আমি তোমাকে চাই/ এই ঠান্ডা শীতে তোমার উষ্ণতা পেতে চাই/ সূর্যের আলোর মতো তোমাকে পেতে চাই/ তোমার চোখ, মৃত্যুকূপ, যেখানে কোনো কারণ ছাড়াই আমি মরে যেতে চাই)


বুলবুল সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, মানে কী বল…এই গানের ভেতরে কী এক আর্তি রয়েছে…আমার মন কেমন করে উঠল কেন? ওর দিকে তাকিয়ে গভীর গলায় সামুয়েল বলে উঠল, এ গানের কোনো মানে নেই, থাকতে পারে না। তুমি ভাল মেয়ে, তাই মন কেমন করেছে তোমার। এবার আমাকে কিছু কাজ করতে হবে যে… 

ধীরে ধীরে বুলবুল চলে যাচ্ছে বারান্দা বেয়ে…যেন এক তিতির পাখি সহসা শান্ত হয়ে উঠেছে আর উড়তে ভুলে গেছে আচমকাই। মনের ভেতরে একটা মায়া টনটন করে উঠল সামুয়েলের।