পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ৩০ মে, ২০২১

শর্মিষ্ঠা দত্ত

                                                                  



খোঁজ 


(৬)

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি কিছু বিত্তবান মানুষের বাড়ির ছাদে টেলিভিশনের অ্যান্টেনা দেখা যেতে শুরু করল l শর্মিলাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত পাড়ায় টেলিভিশন নামক বস্তুটি তখনও  বিরল l শর্মিলা প্রথম টেলিভিশন  দেখেছিল সাগরিকাদের বাড়িতে l এক শনিবার বিকেলে গানের ক্লাসে যেতেই সাগরিকা ফিসফিস করে বলল, 

 --জানিস তো আমাদের বাড়িতে আজ টিভি এসেছে l কি  মজা ! এখন থেকে আমরা বাড়িতেই সিনেমা দেখতে পারব l আজ গানের ক্লাসের পর বাড়ি যাস না কিন্তু  l সন্ধ্যেবেলা বাংলা বই আছে l সৌমিত্র -অপর্ণা সেনের বই l


সেদিন গানের ক্লাসে ইমনের বোলতানে বারবার তালে ভুল করল শর্মিলা l এই প্রথম অন্যমনস্কতার জন্য মাস্টারমশাইয়ের কাছে বকুনি খেল l  মাস্টারমশাই চলে যাওয়ার পর সাগরিকাদের হলঘরে এসে দেখে সেখানে থিকথিকে ভিড় l ওদের বাড়ির লোকজন তো বটেই, পাড়ার ঠাকুমা -জেঠিমারাও হাজির l তারই মধ্যে এক কোণে জড়সড় হয়ে দাঁড়াল শর্মিলা l সামনে দরজাওয়ালা একটা কাঠের আয়তাকার বাক্স l সাগরিকার জেঠু দরজাটা খুলে দিতেই একটা নীলচে কাচের আয়না l তার পাশে রেডিওর মত নব রয়েছে l জেঠু নবগুলো ঘোরানোর পরে কাচের ওপর সিনেমার মত সাদাকালো ছবি ফুটে উঠল l কিন্তু শর্মিলার আর সিনেমা দেখা হল না l প্রতিদিনের মত পিসি এসে ডাকতেই প্রবল অনিচ্ছা নিয়ে তার সঙ্গে বাড়ি ফিরতে হল ওকে l এমনিতেই মাস্টারমশাইয়ের কাছে বকুনি খেয়ে মেজাজটা খারাপ ছিল, তারওপর সিনেমাটাও দেখা হল না l মুখ গোঁজ  করে পিসির হাত ধরে হাঁটছিল শর্মিলা l বিকেলে সাগরিকাদের পাশের বাড়িতে রাজশ্রী টিউশন পড়াতে আসেন, ফেরার সময় শর্মিলাকে সঙ্গে নিয়েই ফেরেন l কিছুটা যেতে না যেতেই শর্মিলা বলল 

--এর পরেরদিন থেকে আর তোমার সঙ্গে ফিরব না, সিনেমা দেখে রাত্তিরে ফিরব l ছোটকা এসে আমায় নিয়ে যাবে l 

রাজশ্রী গম্ভীরমুখে শুনলেন l বাড়িতে এসে মাকে ডেকে বললেন, 

-- বৌদি, তোমার মেয়ের আর লেখাপড়া, গানবাজনা কিচ্ছু  হবে না l মাথায় এখন সিনেমার ভুত ঢুকেছে l

--কি হয়েছে রাজু?  

পিসি বলল ব্যাপারটা l

--শোনো ওবাড়ির গানের ক্লাসে আর মুন্নিকে পাঠানো যাবে না l বড়রাস্তার ওপারে নতুন একটা গানের স্কুল খুলেছে l ওখানে ভর্তি করে দেব l ওরা সবধরণের গান শেখায়, ডিপ্লোমাও দেয় l ভালো ভালো শিল্পীরাও আসেন শেখাতে l আমার স্কুলের শিউলি বলছিল ওর মেয়েকেও ভর্তি করেছে l ওর মেয়েও তো মুন্নিরই বয়েসী l 


--সেটাই ভালো হবে, তুমি খোঁজখবর নাও l তবে কেয়াদি বলছিল টেলিভিশনে শুধু সিনেমাই দেখায় না, অনেক ভালো অনুষ্ঠানও হয় l গান, আবৃত্তি, নাটক, এমনকি বাচ্চাদের অনুষ্ঠানও হয় l রেডিওর মত খবরও বলে রোজ l কেয়াদিও শিগগিরই টিভি কিনবে l 

পিসি আর কিছু বলল না l তখনকার মত কথাটা ওখানেই চাপা পড়ে গেল l 


সোমবার স্কুলে টিফিনের সময় মাঠে বেশ গুছিয়ে  বসে সাগরিকা ওদের বসন্তবিলাপ সিনেমার গল্পটা বলছিল l হঠাৎ মেঘনা বলল 

--এই সিনেমার একটা গান আমি জানি l বলেই  উঠে দাঁড়িয়ে হাত - পা নেড়ে "আমি মিস ক্যালকাটা নাইনটিন সেভেন্টিসিক্স" গেয়ে উঠল l ওরা সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ল l মেঘনা যে এত ভালো গান গাইতে পারে সেটা জানতই না ওরা l 

--কি দারুণ ! তুই কি করে শিখলি? 

সোমালি মুখ বেঁকিয়ে বলল 

--পড়ার সময় রোজ বিবিধভারতী শুনলে সবাই ওরকম গাইতে পারে l

--শুনবই তো ! তোর তাতে কি? তুই মন দিয়ে পড়  না...ফার্স্ট হ l কে বারণ করেছে? আমি বাজে মেয়ে... বাজেই থাকব l

গজগজ করে উঠল মেঘনা l এরপর রোজ ফিসফিস করে সিনেমার গল্প, আর্টিস্টদের জীবনের গল্প করত সাগরিকা আর মেঘনা l সাগরিকাদের বাড়িতে ফিল্ম ম্যাগাজিন কেনা হত এবং বড়দের মধ্যেও এই বিষয়ে বেশ চর্চা হত l মেঘনা বলত ও বড় হয়ে সিনেমায় অভিনয় করবে l ওকে এমনিই সুন্দর দেখতে l তার মধ্যে ওই বয়েসেই বেশ নায়িকাসুলভ আচরণ দেখা যেতে লাগল l বন্ধুরাও ওকে বেশ উৎসাহ দিতে শুরু করল l কিন্তু ধারাবাহিকভাবে রেজাল্ট খারাপ হতে শুরু করল মেঘনার l ক্লাস সেভেনে ফেল করে ওদের নীচের ক্লাসে চলে গেল ও l

এভাবেই পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই একটু একটু করে বড় হয়ে উঠছিল ওরা l

 

ততদিনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা স্থিতিশীল l সাতাত্তরের ইলেকশনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে  সরকার গঠন করেছে বামফ্রন্ট l শর্মিলার ছোটকা অলোক একটা আধাসরকারি ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যে হঠাৎই একদিন রেজিস্ট্রি বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে এল কলেজের বন্ধু শবনমপিসিকে l শবনমপিসি আগেও ওদের বাড়ি এসেছে দু একবার, কিন্তু সে যে ওর কাকিমা হবে ভাবতেও পারেনি শর্মিলা l তারমানে ছোটকার সঙ্গে শবনমপিসির প্রেম ছিল ! অবশ্য ও তো ছোট, বড়দের মনেও একটা প্রবল ধাক্কা লাগল এ বিয়েতে l ছোট হলেও শর্মিলা  বাড়ির অশান্তিটা ও টের পাচ্ছিল ঠিকই l ঠাম্মা প্রথমে চিৎকার করে কিছুক্ষণ বিলাপ করলেন তারপর  সাফ বলে দিলেন ছোটকা যেন বৌ নিয়ে বাড়ি থেকে চলে যায় l হিন্দু অসবর্ণ মেয়ে হলেও তিনি মেনে নিতেন কিন্তু মুসলিম বৌ নিয়ে তিনি কিছুতেই ঘর করবেন না l অরুণ রেগে বললেন 

--- সবে চাকরি পেলি, এখনও দিদির বিয়ে হল না এর মধ্যেই নিজে বিয়ে করে নিলি ! সারাজীবন শুধু আমাকেই সব দায়িত্ব নিতে হবে নাকি ! 


রাজশ্রী বললেন, 

--আমার বিয়ে নিয়ে তোদের ভাবতে হবে না l আমি বিয়ে করব না রে দাদা l কিন্তু তুই এত স্বার্থপর কি করে হলি রে অলোক ! সংসারটা একটু গুছিয়ে দিয়ে তো বিয়েটা করতে পারতিস ! 

ছোটকা মাথা চুলকে বলল, 

-- আসলে শবনমের বাড়ি থেকে অন্যজায়গায় বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল তো, তাই বাধ্য হয়ে হুট্ করেই বিয়েটা করতে হল l

অবস্থা সামাল দিতে আসরে নামলেন অপর্ণা l একমাত্র অপর্ণাই বোধহয় আগে থেকে একটু আঁচ করতে পেরেছিলেন ব্যাপারটা l 

--বিয়েটা যখন হয়েই গেছে তখন অশান্তি করে লাভ কি ! এখন কিছুদিন ওরা এখানেই থাকুক l একটা ভাড়া বাড়ি দেখে নিয়ে পরে ওরা না হয় চলে যাবে l তাছাড়া ঐটুকু ঘরে ওরা থাকবেই বা কেমনকরে ! শবনম কিন্তু  এখন আমাদেরই একজন, এটা মনে রেখো l 

মায়ের কথা ফেলতে পারল না বাড়ির কেউই l 


মাসখানেকের মধ্যেই তিলজলা এলাকায়  একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে গেল ছোটকারা l এই একমাসে শবনমপিসিকে কাম্মা বলা প্র্যাক্টিস করে ফেলল শর্মিলা l এই একমাস দুর্বিসহ জীবন কাটিয়েছিল কাম্মা l মা আর শর্মিলা ছাড়া আর কেউ কথা বলত না তার সঙ্গে l রান্নাঘরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না l হিন্দু ছেলে বিয়ে করার অপরাধে বাপের বাড়িও যাওয়ার পথও বন্ধ ছিল কাম্মার l ওদের যাওয়ার দিন দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে শর্মিলাকে নিয়ে অপর্ণাও ট্যাক্সিতে উঠলেন ওদের সঙ্গে l একটা খাট একটা বড় ট্রাঙ্ক আর টুকটাক কিছু বাসনপত্র ছোটকা কিনে রেখেছিল l সেসব গুছিয়ে ওদের সঙ্গে বাজার থেকে আরো কিছু দরকারি জিনিস কিনে গুছিয়ে দিয়ে সে রাতে ওখানেই থেকে গেলেন l এই জায়গাটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা l গাছপালা, পুকুর রয়েছে l কাঁচা রাস্তার ধারে একটা ছিমছাম দোতলা বাড়ি l তার একতলার একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে ছোটকা l কেরোসিন স্টোভ জ্বেলে সেদিন রাতে খিচুড়ি আর ডিমভাজা করেছিল কাম্মা l বেশ একটা পিকনিকের মত ব্যাপার l সবাই মিলে একসাথে খেতে বসে খুব মজা লাগছিল l  চন্দননগরে দাদুর বাড়ি ছাড়া এই প্রথম শর্মিলা মাকে অন্য কারুর রান্না করা খাবার খেতে দেখল শর্মিলা l এই নতুন বাড়িতে এসে মাকে একদম অন্যরকম লাগছিল l ওদের বাড়িতে কোনোদিন মাকে এমন উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত মনে হয় নি l পরেরদিন ভোরবেলা ট্যাক্সিতে ছোটকা ওদের বাড়ি পৌঁছে দিল l সেদিন রবিবার l স্কুল বা অফিসের তাড়া  নেই তবু মুখে আবার সেই একঘেয়েমির রুপটান মেখে  সংসারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অপর্ণা l শর্মিলা স্কুলের হোমওয়ার্ক করতে করতে ঠিক করল বড় হয়ে মাকে ওই অন্যরকম জীবনটা উপহার দেবে ও l


(চলবে)


                                  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন