পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ২০ জুন, ২০২১

জয়তী রায় মুনিয়া 

                                                       




বৃষ্টি ও সিগারেট

-------------------- -   -----
      রামানুজের মতো সর্বগুণ সম্পন্ন একখানি পুরুষ মানুষ আর হয় না। চেহারাতে কার্তিক, বিদ্যায় গণেশ, অর্থে কুবের বলা না গেলেও, বেশ মোটা মাইনের চাকরী, স্বভাবে অতীব সুশীল-- পান সিগারেট ছোঁয় না-- এবং অফিস ছুটির পরে সোজা বাড়িতে মায়ের কোলে। 
       নিজ গুণে বিখ্যাত এমন একজনের কথা বিগলিত হয়ে বলছি  দেখে   পুরুষরা ইতিমধ্যে চোখ মটকে কি সব লিখবে তাই ভাবতে বসেছে, তবু ও ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়।  যাক, অবগতির জন্য জানাই, রামানুজের বয়স সাকুল্যে আঠাশ এবং সে বিবাহযোগ্য। এবং সেটাই বিপদের কারণ। 
       রামানুজ বিয়ে করতে চায়। আপ্রাণ ইচ্ছে তার। আঠাশ বছর বয়সে পড়ার থেকেই সে আকারে ইঙ্গিতে জানিয়ে চলেছে বাড়িতে, কিন্তু ,ফল হচ্ছে না তেমন। তার বন্ধু বলতে নিজের ছোট মাসীর ছেলে শুভদীপ। তাকেই ধরে বসলো--
:ফ্রী আছিস শুভ?
---আমি কি তোমার মত সোনার চাঁদ, যে, দিন তারিখ দেখে ফ্রী হবো? ভ্যবাগন্ড, সব সময় খালি। 
---বাজে বকিসনি। শোন, দেখা করবি বিকেলে। ধর্মতলায়, কাফে ডে কাফে তে।
--যথা আজ্ঞা ব্র। ভালো খাইও কিন্তু।
        জবাব না দিয়ে মোবাইল রেখে দিল রামানুজ। কোনদিন না খেয়ে ছেড়েছে তাকে, যে আজ বলছে? 
****
   স্যান্ডুইচে কামড় আর কফিতে চুমুক দিয়ে শুভ বললো-- ঝেড়ে কেশো দাদা। আমার তাড়া আছে।
----তাড়া কিসের? এই তো বললি ফ্রী? আর করিস তো নিজের বাড়ি বসে উকিলগিরি। তার আবার এত কথা?
--- আহা! রেগো না। রেগো না। আরে, হঠাৎ করে মাধুরী এমন করে ফোন করলো!
--- মাধুরী?
---সে যাকগে যাক। তুমি বলো, সেই বিয়ের সমস্যা তো? আচ্ছা! সত্যি তোমার কাউকে ভালো লাগে না? 
---শুভ , সমস্যা হলো মা।  মায়ের পছন্দ হয়না। কোনো মেয়েই পছন্দ হয়না। মেয়ে দেখেই বাড়ি এসে এমন মুখ করবেন, যেন শোক সভা থেকে ফিরলেন। কি করি বল!
---তুমি বা এত ভালো ছেলে কেন বলো দেখি? ভালো ছেলেকে মায়েরা সবসময় পাকড়ে রাখার চেষ্টা করে। আর একটা স্যান্ডুইচ বলো, আমি ভাবছি।
  রামানুজ শঙ্কিত হয়ে বললো--আবার স্যান্ডুইচ? তোর সেই মাধুরী না কি যেন, সে আসবে বললি যে?
---আরে মারো গুলি মাধুরী। দাদার বিয়ে আগে না মাধুরী সঙ্গে ইয়ে আগে? ভাবতে দাও ভাবতে দাও।’
 ভাবতে ভাবতে তুমুল বৃষ্টি এসে গেল। সঙ্গে সঙ্গে এক দল কলেজের ছেলে মেয়ে ঢুকে পড়লো কফি শপে। হৈ হৈ চিৎকার কথাতে কান পাতা দায়। এর মধ্যে এক ঝাপটা জল এসে রামানুজের মুখে লাগলো। চমকে, বিরক্ত হয়ে তাকিয়ে দেখে নীল জিন্স হলুদ  টপ, শরীরময় টুপটুপ জল এক মেয়ে লম্বা সোজা চুল এদিক থেকে ওদিকে ফেরালো, তার ফলে ভেজাচুলের ঝাপটা রামানুজের মুখে। মেয়েটা কাঁচু মাচু হয়ে বললো--সরি সরি। আসলে,বৃষ্টি ভিজে ফট করে ঢুকে পড়লাম। ভীড় এত! দেখতে পাইনি।
 শুভ ফট করে বললো-- আমাদের টেবিলে বসতে পারেন। যদি বন্ধুদের আপত্তি না থাকে।
---বন্ধু? না না। আমি তো একলাই। অফিস থেকে ফেরার পথে বৃষ্টি। বসতেই পারি।
 --কফি বলি?  শুভ বললো। 
-- আরে আমি বলে দেব  আমার কফি। আপনি কেন? দাঁড়ান গুছিয়ে বসি একটু। 
 শুভ নাছোড়বান্দা--
 -- তাতে কি? আমি শুভ। এ আমার দাদা রামানুজ। কফি কি ক্যাপাচুন না ল্যাতে?
---খাওয়াবে কে? দাদা না ভাই?
---দাদা। অম্লান বদনে বললো শুভ। 
শুনে মেয়েটি ফিক করে হেসে ফেলে রামানুজের দিকে তাকালো। এবং সর্বনাশ ঘটে গেল, রামানুজের হৃদয় একেবারে ভূমিকম্পে ধসে গেল। 
শুভ মহা ফিচেল। সে  দাদার অবস্থা বুঝে, মেয়েটিকে লাইনে আনার চেষ্টা চালিয়ে গেলে হবে কি, তিনিও মহা ঘোড়েল। শুধু নিজের নামটি বললেন , রিমা মৈত্র। সেক্টর ফাইভে চাকরি করে । মোবাইল নাম্বার নয় কিছু নয়, এবং বৃষ্টি থামলে আবার চুলের ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে গেল, সিগারেট ধরাতে ধরাতে। 
-- সিগারেট! কি সাংঘাতিক। এর পরে আর ওই মেয়ের দিকে না এগোনোই ভালো। ইস। শেষ পর্যন্ত সিগারেট? ওমন মিষ্টি হরিণ চোখের মেয়ে! ওমন সপ্রতিভ। মাত্র আধঘন্টা কি পোনে ঘন্টা, কথা বলার স্টাইলে রামানুজ হেসে ফেললো দু বার। কিন্তু সিগারেট? ওমন সুন্দর কমলা রঙের ঠোঁটে সিগারেট? 
রামানুজের তোমবা মুখের দিকে তাকিয়ে শুভ বললো-- তোমার হলো কি বলো তো? আরে মেয়েটা দেখতে হবে এনগেজড কিনা। আর তো সব ফার্স্টক্লাস।’ 
 --চুপ কর গাধা। এনগেজড ফেনগেজড বাদ দে। ওই মেয়ে সিগারেট খায়।’
-- দাদা। ওটা কোনো সমস্যা হলো? তোমার মা দিনে দশটা পান খায় না? তোমার ঠাকুমা দোক্তা খেত না? তার আগে হুঁকো টানতো কিনা ভগা জানে? আমার মা তো জর্দা খাবার মাষ্টার! তব্বে?
  বলে বিজয়ীর মতো কাঁধ হেলিয়ে শুভ বললো--
-- যেটা দেখার সেটা হলো, তোমাকে বিয়ে করতে রাজি কি না?
---’মানে? ‘ খুব আঁতে ঘা লাগলো রামানুজের--
 আমার মধ্যে কি আছে অপছন্দের?
---হে হে দাদা। ওই ভালোমানুষ ভাবটাই মেয়েদের পছন্দ নয়। তারা চায় রাফ এন্ড টাফ পুরুষ। তোমার ঐ ফর্সা লাল লাল গাল-- চলবে না।
--- শুভ।’ ধমকে ওঠে রামানুজ--

কোথায় রিমা মৈত্রকে খুঁজে তার সিগারেট ছাড়াবি, না পড়লি আমার গাল নিয়ে।
---দুটোই দরকার দাদা। তোমায় জিম যেতে হবে, নিজেকে বেশ হান্ডু বানাতে হবে, আর ওই মেয়ে যদি রাজি হয়, দেখছি কি করা যায়। 
এই বলে সংকোটমোচন দেবতার মতো উঠে দাঁড়ালো শুভ।
****
রিমা মৈত্রকে ফেসবুকে পাকড়াও করলো শুভ। তাকে খোলাখুলি সব মেসেজে লিখতে  সে তো হাসির স্টিকার দিতে দিতে আর বাঁচে না। হাসতে হাসতেই লিখলো
  -- কারো সঙ্গে চক্কর নেই এটা ঠিক। কিন্তু বিয়ে? ওরে বাবা। ভাবতেই পারি না।
--ভেবেই বলো। প্রচুর সময় নাও। দাদা জিম শুরু করেছে। লাল লাল গাল ভাঙছে,। আর মোবাইল নম্বর টা দাও দেখি। আমরা ভদ্রলোক। ঠকবে না। বেশ দার্শনিকের কায়দায় সব লিখলেও, সিগারেট নিয়ে কিছু বলতে সাহস করলো না।
সেদিন রাতে টুং আওয়াজে রিমার বুকে কে যেন এক বাঁশি বাজালো। অচেনা এক মুখচোরা ছেলে, বলিষ্ঠ সুঠাম চেহারা। মুখে তার ভেজা চুলের ঝাপটা, তার থেকে এত কিছু? 
 মেসেজ খুলে দেখে লেখা --আমি রামানুজ। ঘুমিয়ে পড়েছেন?’
   সেক্টর ফাইভ বা ছোট থেকে যেসব পুরুষ মানুষ দেখছে রিমা, তারা এমন নয়। বড্ড স্মার্ট, বড্ড হামবড়াই, বড্ড খোলা মেলা। শরীর নিয়ে  , সম্পর্ক নিয়ে  কোনো রাখ ঢাক নেই। রামানুজ কেমন আলাদা? তার অকালে চলে যাওয়া বাবার মতো! সে লিখলো-- না না। ঘুমোবো কেন?’
 একটু পরে আবার মেসেজ--ফোন করবো?
 ---করুন’। 
  ফোনে রাজ্যের আবোল তাবোল কথা হলো। রিমার বাবা আর রামানুজের মায়ের সম্পর্কে গল্প হলো এক ঘন্টা।  পরের দিন, তারও পরের দিন-- সব জানা হলো দুজনের। রিমার বাবার মতো রামানুজ পুঁটি মাছ খেতে ভালোবাসে, ফলের মধ্যে তরমুজ খায়--সব জানা হলো রিমার। রামানুজ জানলো , রিমা খুব সুন্দর আলপনা দিতে পারে, রবীন্দ্রসংগীত গায়। রাত বাড়ে, কথা ফুরোয় না। 
    বেশ কয়েক দিন পরে উৎকন্ঠিত শুভ নিজেই ফোন করলো ---’ কি ব্যাপার দাদা? খবর কি?’
----ঘটক বিদায় ভালোই পাবি , নিশ্চিন্ত থাক।’
---’ উররেব্বাস। এত দূর? তা বড়মাসীকে বলতে পারবে তো?’ 
---’ ভালোবাসলে কি না পারে মানুষ? তুই নিশ্চিন্ত থাক।’
---’ কিন্তু দাদা? ওই সিগারেট? ওটার কি হলো? কিছু বললে ওটা নিয়ে?
--- কিছুই বলিনি। বিশ্বাস আছে। ভালোবাসলে কি না পারে মানুষ!
❤❤❤❤❤❤❤❤
      বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর

1 টি মন্তব্য: