পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ২৬ জুন, ২০২১

অমিতাভ সরকার

                                     



বেজন্মা (ষষ্ঠ পর্বের পর)


লজের দোরগোড়ায় এসে রাবেয়া বিদায় নিল। কৃষাণও জোর করলো না তাকে, করার কথাও নয়। যাওয়ার আগে একটা কাগজে তার মোবাইল নম্বরটা লিখে হাতে দিল। আগামীকাল যদি ভুলে যায়, সেই কথা ভেবে।        

“এই নম্বরটা রেখে দাও, যদি কখনও প্রয়োজন হয় ফোন করো আমাকে। অবশ্য বিনা প্রয়োজনেও ফোন করতে পারো। পিসিমাকে বলো, কাল যাওয়ার আগে দেখা করে যাব”। হঠাৎ রাবেয়া প্রণাম করে কৃষাণকে। হকচকিয়ে যায় কৃষাণ। জীবনে প্রথম  কেউ  প্রণাম করল তাকে। তাও আবার রাবেয়ার মতো মেয়ে!     

“বললেন যখন, ঠিক ফোন করব। আমাদের তো কোনও ফোন নেই। সামনের মাসে মাইনা পেলে একটা মোবাইল কিনবো ইন্সটলমেন্টে, দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে রেখেছি। কিনেই আপনাকে প্রথমে ফোন করবো…”। কৃষাণের চোখের দিকে তাকায় রাবেয়া। কৃষাণ তার দিকে তাকাতেই চোখ ফিরিয়ে সাইকেল ঘুরিয়ে প্যাডেলে পা দেয় রাবেয়া। চলে যাওয়ার পথের দিকে কিছুক্ষণ থাকিয়ে থাকে কৃষাণ। একটা বেলায় তাকে কেমন করে যেন বেঁধে ফেললো এঁরা…!             

অভ্যাস বশতঃ সকাল পাঁচটা ঘুম ভেঙ্গে যায় কৃষাণের। হাতমুখ ধুয়ে সিকুরিটির ভদ্রলোককে ঘুম থেকে ডেকে দরজা খুলে রওনা দিল লাঘাটার দিকে। সকালের আঁধো অন্ধকারে কুয়াশার চাদরে ঢাকা আদুরে ঠাণ্ডায় হাঁটতে হাঁটতে লাঘাটা ব্রীজের ওপরে দাঁড়াল। এই ব্রীজের নীচ দিয়েই প্রবাহিত হয়েছে ক্ষীণকায়া কোপাই নদী। বাঁদিকে দূর থেকে দেখা যায় লাল কাঁকুরে মাটির ওপর অঙ্গনবাড়ি ট্রেনিং সেন্টার, আর একটু দূরে তাল, খেজুর আর অন্যান্য সবুজ গাছপালায় ঢাকা মনাচিতোর গ্রাম।    

ব্রীজের ডানদিক দিয়ে নীচে নেমে পড়ে কৃষাণ। চারপাশের সবুজ ক্ষেতের মাঝে ঝকঝকে সোনালী বালুকণার ওপর দিয়ে কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে স্বচ্ছ চঞ্চলা কোপাই। দু’হাতের আঁজলায় হিমেল জল নিয়ে সারা মুখ ধুয়ে নেয়। এক অনাবিল সুখানুভূতি ছেয়ে গেল কৃষাণের সারা শরীর। তারপর নদীর পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা উঁচু ঢিপির ওপর এসে দাঁড়াল। যেখান থেকে দেখা যায় ক্ষীণতোয়া কোপাই আর বক্রেশ্বরের কাছাকাছি আসার অপূর্ব যাত্রাপথ। দিনের প্রথম সোনালী পরশে কোপাই যেন সোনার হাঁসুলি নেকলেস দিয়ে সাজিয়েছে চরাচর।             

কেমন করে যেন সময় বয়ে যায়…। কতক্ষণ…, জানা নেই তার। রোদ্দুরের আঁচ বাড়তেই উঠে পড়ে কৃষাণ। হাঁটতে হাঁটতে স্টেশনের দিকে এগোয়। স্টেশনমাস্টার ভদ্রলোক বলেছিলেন, একবার লাভপুর স্টেশন ঘুরে আসতে। এমন স্টেশন নাকি খুব কম দেখা যায় এখন।   

সুরকীর গেরুয়া পথ দিয়ে যেতেই দেখা গেল ছবির মতো প্রাচীন বটের ছায়ায় লাল টুকটুকে স্টেশন, ‘লাভপুর’। আমোদপুর-কাটোয়া ন্যারো গেজের ছোট্ট লাইন। আদ্দিকালের গ্যাসবাতির মতো ল্যম্পপোস্ট। বসার জন্য ছোট ছোট বেঞ্চ। যেন শতাব্দী আগের এক টুকরো ছবি। ইচ্ছে করে জিরিয়ে নেই কিছুক্ষণ…। কিন্তু সময় নেই কৃষাণের, ফিরতে হবে আজই। যাওয়ার আগে পিসি’মার সঙ্গে দেখা করা দরকার।    

লজে পৌঁছে স্নান করে রুটি, তরকারি খেয়ে ইচ্ছে করেই সামরিক পোষাকটা পরে নেয় কৃষাণ। ফোর্সে একজন বলেছিল, এই জলপাই রঙের পোষাক সিভিল লাইফে খুব কাজ করে। নিজেকে আলাদা করে পরিচয় দিতে হয় না। কাছের একটা দোকান থেকে মোবাইলটা রিচার্জ করে নেয়, একবার শামসুদ্দিনের সঙ্গে কথা বলা দরকার। যদি শামসুদ্দিনের আব্বার ফোন নম্বর পাওয়া যায়, তাহলে পিসি’মার সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়া যাবে। শামসুদ্দিনের বলেছিল, এক সপ্তাহ নাইট ডিউটিতে থাকবে…। বেশ কয়েকবার ডায়াল করার পর শামসুদ্দিনকে পেয়ে যায় কৃষাণ।          

“হ্যালো…শামসুদ্দিন… হ্যাঁ কৃষাণ বলছি”। গতকালের শামসুদ্দিনের ফুফুআম্মার সঙ্গে দেখা হওয়া বিস্তারে বর্ণনা করে তাকে। সেই সঙ্গে শামসুদ্দিবের আব্বার ফোন নাম্বার নিয়ে নেয়। কাছাকাছি মিষ্টির দোকানের নিয়ে একবাক্স মিষ্টি কিনে লজের হিসাব মিটিয়ে রওনা দেয় মনাচিতোরের পথে।    


“গুড মর্নিং ফৌজি ভাই”। ফিরে তাকাতেই দেখা হয় গ্রামের মেম্বারের সাথে।

“ও আপনি !” কৃষাণ এগিয়ে যায় তার দিকে।   

“আজকেই ফিরছেন বুঝি? না, মানে আপনার পোষাক দেখে মনে হল”।  

“হ্যাঁ, দাদা, আজকেই ফিরবো। আপনি তো আবার স্যার বললে রাগ করেন, তাই দাদাই বললাম”। ভদ্রলোকও হাসিমুখে এগিয়ে যায় কৃষাণের দিকে।  

“আপনার সঙ্গে তো ভালো করে আলাপই হয় নি। আমার নাম কালীপ্রসন্ন চক্রবর্তী, এখানকার পঞ্চায়েত মেম্বার। আসুন এখানে বসি…। চালাঘরে বাঁধানো উঁচু মেঝেতে পা ঝুলিয়ে বসে কৃষাণ। ভদ্রলোক ফোর্সের নানা প্রসঙ্গ জিজ্ঞাসা করে। আলাপ করে দেয় উপস্থিত লোকজনদের সঙ্গে।   

“একটু চা খাবেন নাকি? এখানে তো দোকান নেই, আশেপাশের বাড়িতেই বলতে হবে”। না…, বলতে না বলতেই মাঠে খেলতে থাকা একজন কিশোরকে হাঁক দেয়। যদিও এখানে সময় নষ্ট করার ইচ্ছে ছিল না মোটেই। তবু বাধ্য হয়ে… । কথা বলার মধ্যেই দুটি কাপে লিকার চা আর বিস্কুট দিয়ে যায় ছেলেটি।   

“এবারে উঠি দাদা, পিসিমার সঙ্গে দেখা করে ফিরতে হবে”।   

“দু’একদিন থেকে যান, কিছুই তো দেখলেন না এখানে। পরেরবার কয়েকদিন ছুটি নিয়ে আসুন…। আর একটা কথা, বন্ধুকে বলুন এঁদের এখান থেকে নিয়ে যেতে, মেয়ে বড় হচ্ছে, পরিস্থিতি ভালো নয়…”। ভদ্রলোক কৃষাণের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলেন। চমকে তাঁর দিকে তাকায় কৃষাণ…। কী বলতে চাইছেন উনি…?        

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন