পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

শনিবার, ২৪ জুলাই, ২০২১

সোনালী চক্রবর্তী

                                           


 

উত্তরাধিকার


কেন ভ্রমের ব্যাখ্যা মাত্রেই কুয়াশার ইমেজারি আসে, বেনারসী মাঘী পূর্ণিমার চবুতরায় বসে ভাবছিলেন কমলিনী। সেই ষোলোতে বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার বাবার বুক থেকে নিজের শিবিরের সর্বময়ী কর্ত্রী হতে চলে আসতে হয়েছিলো পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবিত এই নগরীতে, আর ফিরে যাওয়া হয়নি কমলা গালর্স স্কুলের মেধাবী ছাত্রীটির। সংষ্কৃতে অসামান্য ব্যুৎপত্তি ছিলো, অথচ মেয়েমানুষ কিনা, দামী পাত্র যেচে এসেছে, ফিরিয়ে দেওয়ার মূর্খামিটা স্বাধীনতাপূর্ব মহানগরীতে বসেও তার প্রগতীশীল পিতা ঠিক করে উঠতে পারেন নি। কমলের মত রূপ তাই নাম পেয়েছিলেন কমলিনী অথচ ব্যাক্তিগতভাবে তার মনে হয়েছে বরাবর, নালের অধিক অনমনীয় জেদই নিয়তিতে এই নাম লিখেছিলো। নাহলে জন্মদাতার শেষকৃত্যেও উপস্থিত না থাকার সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারলেন কী করে? কেনই বা বত্রিশ বছরের পর থেকে আজ আঠারো বছরের উপর তিনি স্বেচ্ছায় একা? তার মন কি এই দুর্গ, প্রাসাদ আর একশ আট ঘাটের সম উপাদানে নির্মিত? ব্রাহ্মমুহূর্ত সমাগত। পাথরঅবশ শীতে নির্লিপ্ত কমলিনী কেদারের সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকলেন। ডুব দেবেন তিনবার। উঠে চক্রবর্তী উপাধিধারী শৈব শ্বশুর বংশের প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে জল ঢেলে পীতাম্বরপুরায় ফিরবেন। এ তার বারো মাসের নিয়ম, প্রলয়ের দিন অবধি হয়তো আর নড়চড় হবে না। তবে আজ বিশেষ দিন। রক্তপ্রবাহে আজকের মত অদ্ভুত রোমাঞ্চ তিনি দীর্ঘ, দীর্ঘদিন টের পাননি। গঙ্গোদক স্পর্শ করলেন। প্রবাহ পৌঁছালো মধ্যগতি পেরিয়ে আরেক আদি জনপদ, হালিশহরে।


জীর্ণ ধাপ বেয়ে পিতলের কলস ভরে উঠে আসছেন সিংহ রাশির জাতিকা আরেক নারী। মধ্য চল্লিশেও যার গড়ন ভাস্কর্য আর নীল চোখ দর্শককে বিব্রত করে বিস্ময়ে, কোনোদিন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া প্রগাঢ় যুক্তিবোধ অবনত হতে বাধ্য করে তার্কিকদের, আর অন্তরমহলে বিপরীত ও সম লিঙ্গের যাবতীয় প্রতিনিধিদের করে তোলে ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত। কুমারী চতুর্দশীকে রাতের অন্ধকারে বিশালাক্ষ্যা পেরিয়ে কলকাতায় পৌঁছে দিয়ে পাত্রস্থ করে ফিরতে পেরেছিলেন বিক্রমপুর মৌজার নায়েব, কুলদেবতা কালাচাঁদের পায়ে শেষ নিশ্বাস ফেলার সময় এই ছিলো তার একমাত্র স্বস্তি। পাড় থেকে বহুবার ডাক শুনেছিলেন,

-- "ও মাঝি, নৌকায় কী?"

ধাতব ফলার উজ্জ্বলতা রাতের অন্ধকারে অতি মূল্যবান রত্নের চেয়েও বেশি হয়। শিহরিত অথচ অকম্পিত কণ্ঠে রসিকতা মিশিয়ে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন প্রতিবার,

-- "কুমড়া গো কত্তা, কুমড়া, মাচায় হইসে, দিয়া আসি"

আড়াই টাকার একখানা শাড়ি, দুইহাতে একগাছি করে শাঁখা পরিয়ে দুর্দম এক ঢাকাইয়া পোলা, পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো বিপ্লবীর হাতে সম্প্রদান করে ফিরে গিয়েছিলেন পরের দিনই। তার পরের সূর্য তাকে আর গ্লানিবৃদ্ধির অবসর দেয়নি। এসব স্মৃতি ডাহুক ডাকা দুপুরে শৈবলিনীকে বড় আনমনা করে দিয়ে যায় তবে আজ সে সময়ও তিনি পাবেন না। প্রথমবার এই নিয়ে তার কোনো দীর্ঘশ্বাস এলো না।


কমলিনী ও শৈবলিনী, দুই নারী। জন্ম ও যাপনের দুই মেরুতে বসবাসকারী তাদের পোষাকী আত্মীয়তার চেয়েও গভীর এক সূত্র পরস্পরের সঙ্গে জুড়েছে, তারা বন্ধু। সম্ভবত যে প্রথম ফোঁড়টি এই বিন্যাসের সূচনা করেছিল তার নাম আত্মমর্যাদা। যে সময়ে তাদের জন্ম, বাঙালী পরিবারগুলির দেওয়ালে "পতি পরম গুরু", "পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য" রঙিন সুতো দিয়ে সেলাই করে করে লিখে বাঁধিয়ে টাঙিয়ে রাখাই আদর্শ ও ন্যায়সম্মত শ্লীল শিল্পচর্চার উদাহরণ হিসাবে স্বীকৃত হতো। অথচ তারা তেমনটি করে উঠতে পারেন নি। 'স্বামী' শব্দের 'প্রভু' অর্থ তাদের ব্যক্তিত্ব বিনা বিচারে কোনোদিন মেনে নিতে পারেনি। কন্যা ও পুত্রসন্তানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষার পাঠে তারা অনুমোদন দেন নি কখনোই। যদি রান্না শিখতেই হয়, সন্তান মাত্রেই শিখবে, আউটডোর গেমসে অংশ নিতে হলে লিঙ্গ নির্বিশেষেই নেবে, এই ছিলো তাদের মা হিসাবে কঠোর ও অলঙ্ঘনীয় নীতি। বহু বাঁকা কথা, ব্যঙ্গ, অপমান, বিদ্রুপ সয়েছেন, সন্তানরাও যে খুব প্রীত হয়েছে সর্বদা, এমনটি তো নয়ই তবু অবিচলই থেকেছেন। এহেন স্ত্রী ধনের কথা রেঁনেসা যুগের নভেলে পড়তে যতটা তৎকালীন বঙ্গসমাজ ভালোবাসতেন, ততটাই অশালিন অনুভব করতেন নিজের পরিবারে পেলে। কিন্তু ব্যক্তিত্ব যদি অভেদ্য হয় তবে তা এক বলয় নির্মাণ করে, শনি গ্রহের মতই। সেই অদৃশ্য গণ্ডী ধীরে, অতি ধীরে পরিখা খনন করে পারিপার্শ্বিকতা ও পরিজনেদের মধ্যে। সলিটারি সেই ব্যূহকে আক্রমণ করা যায়, অধিগ্রহণ কখনোই না। কমলিনী ও শৈবলিনীর অন্ত:স্থিত কাছি এখানেই বাঁধা। তারা বুঝতেন তাদের আঁচল আছে, সেই আঁচলে চাবির গোছাও আছে অথচ মানসিক কাঠামো এই দরদালান পেরিয়ে এগিয়ে গেছে বহুদূর, যেমনটি বেদী ফেলে রেখে দেবী বিসর্জনে চলে যান। একটু আগে জন্মে গেছেন তারা যেখানে তাদের পরিচয় থেমে থাকল কারোর কন্যা, কারোর স্ত্রী, কারোর মা হিসাবেই অথচ এমনটি তো তারা চাননি। তবে কি আত্মীয়রাই ঠিক বলে?

-- "অমন সন্নিসী সন্নিসী ভাবসাব নিয়ে কি বাপু সংসারে মায়া বসে না ছেলেপিলে ন্যাওটা হয়?"

কী করবেন তারা? কর্তব্য তো সবই সামলেছেন একান্নবর্তী পরিবারের, সন্তান ধারণ করেছেন একাধিক। অথচ কী যেন খুঁজে বেড়ালেন সমস্তটা জীবন। দুজনেরই মনের ভিতর, ফ্রকে অভিমান গিঁট দিয়ে রাখা এক কাঙাল কিশোরী বেঁচে থাকল এতটা বয়স অবধি। পরের ইংল্যান্ড লেটারের কবিতাটায় বলবেন সে কথা, দুজনেই ভাবলেন সে কথা স্নান সেরে ফিরতে ফিরতে। 


আর ঠিক নয় বছর পর পৃথিবী নতুন সহস্রাব্দে পা রাখবে, ২০০০, আজ যার আসার কথা সে কি তাদের সত্যিই বুঝতে পারবে কোনোদিন? জানতে পারবে ভিতর ঝড়ের দাস্তান? খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান ছাড়াও শুধুমাত্র 'মানুষ' স্বীকৃতি পেতে মেয়েদের প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দেবে? যে গভীর বোধের অসুখ তাড়া করে নিয়ে নিয়ে বেড়ায় তাদের উপলব্ধি করবে? অনুধাবন করবে চিন্তাতরঙ্গ? 


সন্তানেরা তাদের শারীরিক কোড পেয়েছে, মেধার দায়ভারও কিন্তু তারা তাদের আত্মার উত্তরাধিকার যাকে দিয়ে যাবেন সে এখনো আসেনি। তাদের মানসপুত্তলি... বহু বছর ধরে চিঠির পর চিঠিতে তারা যে নারীকে গড়েছেন কল্পনায়, যে তাদের কথা বলতেই আসবে। যে বিশ্বাস করবে নারী এতদূর শক্তি ধারণ করে যে তার আভাস মাত্রই ভয়ে অবদমন করতে পুরুষতন্ত্রের জন্ম। যে নারী শরীর নিয়ে জন্মে নারীত্বকে উদযাপন করবে গর্বে। পৃথিবীর যাবতীয় ধর্মের সমস্ত অনুশাসন সুকৌশলে গড়া হয়েছে নারীর বেড়িকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করতে, শ্বাসজ স্বাধীনতার পরিসর সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর করতে, এই সত্য সম্যক জেনেও কমলিনী ও শৈবলিনী লোকনিন্দার বিরক্তি এড়াতে আজীবন নিষ্ঠাবান হিন্দু ব্রাহ্মণ বধূর যাবতীয় সারহীন অযৌক্তিক আচার পালন করে গেছেন বহিরঙ্গে, ফলত অন্তরঙ্গে তীব্রতর হয়েছে বিতৃষ্ণা। তারা সমগ্র আয়ু দিয়ে নিবিড় অধ্যয়নে আয়ত্ব করেছেন ঈশ্বরহীন অধ্যাত্মবাদের নিগূঢ় ধ্যান। সবই আমানত, সঞ্জাত হবে তাদের মানসপুত্তলির ভেতর, এমনটাই আশা। নারীকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে পুরুষের মুখাপেক্ষি অথবা বিদ্বেষী হতে হয় না। 'কাম' ধাতু থেকে 'কন্যা' শব্দের উৎপত্তি। অর্থাৎ কামনা করা মাত্রেই যে তার প্রাপ্তব্য লাভের যোগ্য, সেই ই 'কন্যা'। 'শ্রী' ও 'পরাবিদ্যা' সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান যাদের আছে তারা জানেন শারীরিক সামর্থ্য আর অধিগত তেজ নিয়েও প্রকৃতপক্ষে পুরুষ বড়ই অসহায়। তার প্রয়োজন হয় নারী আধারের। শক্তিরূপ ছাড়া যাবতীয় ক্ষমতা নির্বীর্য। দুই নারী এই কারণেই আজ কামনা রাখছেন নতুন সহস্রাব্দে তাদের নশ্বর শরীর থাকুক বা না থাকুক, প্রাচীন এই মিথের সিস্টেম খানখান হয়ে যাক। পুরুষের প্রয়োজনার্থে আরোপিত শক্তির সেবাদাসী হিসাবে নয়, নারী তার নিজের আধারকেই আলো দিক, অধিকার দিক পূর্ণতার। এই বোধের উত্তরাধিকার তারা দিয়ে যাবেন তাদের মানসীকে। তাদের ত্যাগ, তিতিক্ষা, তপশ্চর্যা সব একটিই উদ্দেশ্যে, সে এসে তাদের হয়ে ভেঙেচুরে দিক সব আর্কিটাইপ, শীতল আগুনের চোখ নিয়ে প্রশ্ন রাখুক ইতিহাস ও বিনির্মাণে, সে ধর্ম হোক বা শিল্প, প্রতিটি রণক্ষেত্রে।

আজ কমলিনীর পৌত্রী আর শৈবলিনীর দৌহিত্রীর ভূমিষ্ঠ হওয়ার কথা। মেয়েই হবে তো? ফলিত জ্যোতিষে চর্চা রাখেন কমলিনী। উৎকণ্ঠা তাকে আরেকবার গণনায় বসালো। নক্ষত্র ইঙ্গিতে ইশারা অভ্রান্ত... রোহিণী। তিনি আশ্বস্ত হলেন। শৈবলিনী স্থির করে রেখেছেন নাম...স্বধা...যে নিজেতেই নিজে সম্পূর্ণ।

"ॐ স্বাহায়ই, স্বধায়ই, নিত্যমেব তবস্থিতি"
( ক্রমশঃ) 

চিত্রঋণ: পারমিতা চক্রবর্ত্তী

৪টি মন্তব্য:

  1. গদ্য গমগম করছে আত্মমর্যাদার পদক্ষেপ কাহিনীর স্তরে স্তরে।

    উত্তরমুছুন
  2. গদ্যে তুমি চমকে দিচ্ছো। তোমার কবিতা পড়ে ভালোলাগা তৈরি হয়েছে, কিন্তু গদ্যের এই চলন তো মগ্ন করে রাখছে... খুব ভালো, খুবই

    উত্তরমুছুন