পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ৩১ অক্টোবর, ২০২১

উজান উপাধ্যায়

              




ঠাকুমার বুকের ভিতরে ঠাকুরদা একটা ফুলের বাগান করেছিল। সেখানে দুবেলা ঢুকে জল, মাটি, সার আর কীটনাশক দিয়ে মনের মতো কিছু ফুল ফুটিয়ে গেছে। সেসব ফুলেরা ঠাকুরদার ইচ্ছে মতন রঙে সেজেও নিত যখনতখন।

বাবা কিন্তু মায়ের বুকের ভিতরে ফুলের পাশাপাশি কিছু সবজি আর ভেষজ উদ্ভিদও বুনেছিল। বাবা সোজাসুজি নদী থেকে জল আনবার ব্যবস্থা করেছিল। পাখিদের সঙ্গে তার বোঝাপড়া ছিল, পরাগরেণু আদানপ্রদানের। তারপর অন্ধকার হলে পরাগমিলন... বাবার হাতের ফুল, ফল, সবজিরা রঙ পেত মায়ের ইচ্ছে মতো। সে তো আহ্লাদে আটখানা, রঙের টালবাহানা। সে তো ইচ্ছে আর অনিচ্ছে- দুয়েরই রঙ, এ বলে আমায় দ্যাখ। ও বলে আমায় দ্যাখ।

আমিও শুকপাখিকে প্রথম সাক্ষাতেই আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর বংশানুসরণের কথা জানিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর আমিও গিয়েছি, ফুল ফোটাতে। এমনকি চা বাগান, সবজি ও আরও সব কৃষিকাজ। পাহাড়ের গায়ে গায়ে বুনোফুল, জংলী বাহারি গাছ। বুকের ভিতরে পাহাড়েরা জড়ো হয়েছিল‌।

এইবার জলসেচ নেহাতই সহজ।

আমাদের দুঃখ জমে যে শিশির, আমাদের বিষণ্ণতা থেকে যে কুয়াশা, আমাদের অপ্রাপ্তি থেকে জন্ম নিয়েছে যে অখন্ড মেঘ, আমাদের ভালবাসা থেকে যে বৃষ্টি...

তাতেই তো নদী ও দীঘি, খাল বিল ঝরনা ও আরও সব জলাশয়।

আমাদের জলসেচে ব্যস্ত হৃদয়। সেখানেই জটিলতা আসে। যেকোনো সহজ ঠিক যতটা জটিল।

ফুলের রঙ নিয়ে অতঃপর আমাদের গবেষণা শুরু হয়। এ ফুলেরা ঠাকুরদার ইচ্ছে বা মায়ের খুশির মতো রঙ নির্বিবাদে অনায়াসে বেছে নেওয়ার মতো সরল আয়েশে ফুলেদের উত্তরসূরি হতেই পারে না।

এ ফলেরা, এসব উদ্ভিদ বা তাদের পাতারাও গোপন বৈঠকে ঠিক করে, কেমন হবে তাদের রূপ রঙ রস ও গন্ধ।

সে গোপন বৈঠকে পৃথিবীর অসুখের কথা ওঠে, নর ও নারীর যত রূপোলি অসুখ আর শূন্য শূন্য ফাঁকা ভিতরের গান...

এখন যেসব রঙ নিয়ে ওরা সব বাজারে বিক্রি হয়, সে নেহাতই অর্থ-রসায়ন, কৃত্রিম আয়োজন, হাইব্রিড-ক্রোম।
আমাদের পিতা ও পিতামহের সময়, মা ও ঠাকুমার সময়ে ভিতরে ও বাইরে একটাই রঙ হতো ফুলেদের।
এখন যতই ঝলমল করে উঠুক না বিজ্ঞাপিত মুখ, ভিতরে বিবর্ণ সাদাকালো বিরঞ্জিত সুখ...

আমি বা  আমার শুকপাখি ভিতরে রোপণ করি রঙিন অসুখ। তাই বাইরে বেরিয়ে আসে পার্লার চর্চিত মালঞ্চ মুখ।
তাইতো হঠাৎ অনেকক্ষণ খোঁজ না পেলে, ডেকে উঠি- 
কোথায় তুমি? 
সে এক আশ্চর্য উদাসীনতায় উত্তর দেয়-
জাহান্নামে।

আমি তার বুকের ভিতরে পাগলের মতো ঢুকে পড়তে চেষ্টা করি।
আমাদের তো এমনই ঐতিহ্য ছিল, প্রেমিকা জাহান্নামে পৌঁছে গেলে সেখানেও পারিজাতে ভরে উঠবে পুরো তল্লাট।

আমরা তো আলোর ভিতরে মিলনের নহবৎ চাই...
তাইতো মালঞ্চ বাগানে ফুলেরা রঙিন কর্পোরেট রসায়ন মেনে, বুকের ভিতরে শুধু নিঃস্ব ভায়োলিন।

"ফুল ফুটুক না ফুটুক"| বসন্তের চাকরি নাই।

বিরঞ্জিত 
উজান উপাধ্যায়

(ঋণ - সুভাষ মুখোপাধ্যায়)



কবিতা লিখতে লিখতে আমি ঝকঝকে চকমকে এলিট আলোয় ঠাসা শহরের সবচেয়ে নামকরা  ফাইভ স্টার হোটেলের করিডোর থেকে লিফট চেপে একদম ভিতরে সটান পৌঁছে গেছি। এইখানে লবি থেকে একটু ঝুঁকেই,  শহরগুলোকে খুব ছোট্টো দেখায়। ক্যান্ডল ডিনারের  ওপেন এন্ড ওয়াইড টপ ফ্লোরে স্টারস এন্ড সেলেবরা রঙিন ঝলমলে গ্লাসে নেচে নেচে হাসে আর রসেবশে ভাসে। আকাশের তারারা বেশ জড়োসড়ো। এখানে নামার মত সাহস পায় না আর। বৃষ্টি কাচের গায়ে। ভিতরে আসে না।  কবিতা লিখতে লিখতে আমি ক্রমাগত  বদলেছি জামা।   উদাসীন ব্যাগ, অগোছালো চুল,  অবিচল ভুল দেখা বদলেছি রোজ‌। কাগজের খসখসে দাগ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে মসৃণ মনিটরে ওয়ার্ড বা ডক ফাইল আপলোড করে,  ধেনো মদ ছেড়ে সরিয়েছি সস্তা চোলাই। বিড়ি আর ফ্লেক ছেড়ে এখন কিং সাইজ। সবচেয়ে দামী ব্যান্ড। কবিতারও তেমন ফ্লেভার। ক্যাপুচিনো কফি, সুইডিস কাপ। ইতালির পাথরে টিপটিপ হাঁটা। সাঁওতালি মেয়ে ছেড়ে হাই প্রোফাইল লেডি। মহুলবনীর নেশা ছেড়ে, মহুয়ার গান ছেড়ে সিম্ফনি- প্রিলিউড, মোৎসার্ট বিটোফেন। কবিতা এখন রোজ নাইট গাউন পরে একটু গভীর রাতে দখিনের জানালায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্যারিসের ছবিগুলো ভাবে। ওখানে ঘুরতে গিয়ে যেকটা ছবিই তোলা, সবকটা ব্রিলিয়ান্ট। সবকটা মাস্টারপিস। এ শহরে ফুটপাত নিরাপদ নয়। বেশিরাতে বাড়ি ফেরা মেয়েরা 'রাবিশ'। কবিতা লিখতে এসে এগুলো বুঝেছি। এখন পার্টি হোলে, অনুবাদ কবিতাই বেশি পাঠ করি। প্রতিটি কবিতা পড়ে তর্জমা করি। বুঝিয়ে বলতে হয়, কোনটা স্যুররিয়াল, কোনটা এবসার্ড। কবিতা লিখতে এসে স্পষ্ট বুঝেছি, প্যাচানো সিঁড়ির মতো মিস্ট্রির ভাঁজে মৌতাতে বুঁদ করে দিতে হবে ফ্যান্টাসি, ফিকশন। আর যত ডিকশন এবং সেনসর - লুকিয়ে রাখতে হবে চুরুটের ফাঁদে। দুঃখ বানাতে হবে, বিষাদ ঘনাতে হবে। নির্জন সংকেতে বিরহের বাঁশি, ডিজিটাল ফর্মাটে নিও-বানভাসি। কবিতা ঝাউপাতায় আর তত কমফোর্ট নয়। কবিতা মেঘলা দিনে টেকনো-গ্রাফিক্স দিয়ে এখন ঢেউ কেনে, ক্রেডিট কার্ডে আর অনলাইন পে তে। কতজন বুঝবে, কতটা ট্যালেন্ট লাগে এত পথ যেতে। এখন আমাকে ছাড়া ম্যাগাজিন ফ্লপ। এখন আমাকে ছাড়া বইমেলা ঢপ। কবিতা-নায়ক আমি। কবিতা-গায়ক। যেকোনো এঙ্গেল থেকে বর্ণমালাকে দেখো-যেকোনো দিকেই বেঁকে চোখ তুলে রেখো- আমি টপ। আমি টপ। পান্থনিবাসে নেই, ঘামে ভেজা ঘাসে নেই। ইন্টেরিয়র ডেকে ফ্রেঞ্চ ডিজাইনে আঁকা আমার মলাট। কবিতা লিখতে এসে এটুকু বুঝেছি-

জীবনানন্দকে ভালবাসলে তার কবিতাকে ভালবাসা যায় না। এবং ঠিক বিপরীতে জীবননান্দের কবিতাকে ভালবাসলে ওনাকে ভালবাসা যায় না।

দু দুটো মায়াবী চোখে ভেসে নিঃস্ব ভিখারি হবো। আমি কি পাগল নাকি।

রূপবতী নারী আর রূপবান পুরুষকে মুখোমুখি করে আমার তাদের যে কোনও একজনকেই ভালবাসতে পারি।

তা না হলে ওদের পারস্পরিক সঙ্গমে বাধা পড়ে যায়।

একজন পাঠকের কাছ থেকে এমনটা শুনে হাড়েহাড়ে বুঝে গেছি, কবিতার ষোলোআনা চাল।

চিনেগেছি 

জীবন তো মহাকাশ মহাকালে বদলায়,  মৃত্যু উলটোমুখে  মহাকাশ বদলিয়ে গড়ে মহাকাল।

অতএব, রূপ ছেড়ে রূপো, হৃদ ছেড়ে দরদাম। বিক্রি করতে হবে কবিতার বাড়ি। 

আমি পারি। আমি সব পারি। আমি এই পৃথিবীর জাস্ট এক নম্বর-

কবিতা ব্যাপারী।

পিং পং
উজান উপাধ্যায়

ঋণ - অনন্য রায়

( " In Life, the Space becomes Time.  In Death, the Time becomes Space. " )


এই পাথরের নিচে শস্য উড়ে যায়। এই পাথরের নিচে গ্রহণের দিব্যি করে ধান। এই রাত্রে পাত্র ভরে মেঘে।

এই দিনে এই সন্ধ্যায়  এই মঞ্চে হৃদি ভাসমান
পূণ্য শ্লোকে নিঃস্ব অভিমান 
চিৎকার করে ওঠে - 

বলো।

এই জন্মে এই যে হিরন্ময় আলো...

তুমি ছাড়া তাকে কে ছড়ালো?

এই জন্ম অক্ষয় হোক। মৃত্যুর ভিতরের পথে তোমার অনিন্দিতা চোখে

পাথরেরা পাখি হয়ে গেলো।

এই জন্মঋণ, এই জন্মদিন
উজান উপাধ্যায়


জলে ডোবা কাঠামোগুলোকে খুঁজি‌। এই দেহে জ্বলেছিল আলো। চকমক করে উঠেছিল সংহার ও অপার। 

রঙ সব মিলিয়ে গেছে জলে। সমস্ত উজ্বল ধ্বনি গলে গেছে রাত্রির ভাঙা তলপেটে। 

ঢাকী ফিরে গেছে। পুরোহিত ফিরিয়ে নিয়েছে সব পুঁথি, শাস্ত্র, যজ্ঞের অবশিষ্ট ছাই ও অদাহ্য যা কিছু জিনিস।

ফিরে গেছে আলোর ব্যাপারী। 

এই ব্যাখ্যা আর কতদিন? এইসব ফিরে যাওয়া মৃত্যুর মতো কেন জ্বলে যায়, ভেসে যায়।

এই যে মাটির দেহ, খড় ও বিচুলি দিয়ে গড়ে তোলা নাক কান চোখ...

এই যে নশ্বর প্রতিমাকে মা বলে ডাকা... কেন তাকে চারদিন পর আর খুঁজেও দেখিনা। এই রিসাইকেল, এই যে পুনরুত্থান... এই তত্ত্বে ঢেকে যায় সসীমের জৈব আখ্যান। নিরাসক্ত ? উদাসীন? নাকি তাকে ভুলে থাকা নেহাতই অর্থনীতি! যদি গড়ো, তবে তাকে ছলনায় কেন? রূপ রঙ রস গন্ধ চলে যাক। তবুও সে কাঠামোতে আমার মাতৃঋণ। 

বিসর্জনের পর



সিনেমার ঘরে

সিনেমার ভিতরে পাহাড় দাঁড়িয়ে গেলে পপকর্ন ফিরে যায় ভুট্টা বাগানে। সেখানে যে মেয়েদের বিবাহযোগ্যা করে তুলেছিল ঝর্ণার জল, ধাপে ধাপে আগুন বেগুনি রঙে নেমে এল নদীর মতন।

সিনেমার ভিতরে স্বপ্নের বিছানা পেতে ঘুমিয়েছে আকাশলীনারা। বৈদ্যুতিক তারের মতো ছড়িয়েছে পাহাড়ি কন্যাদের চুল। 

গাছেদের ভিতরে পাহাড়, মেয়েদের ভিতরে পাহাড়- সিনেমার ভিতরে কুয়াশা। রঙ মেখে নেচে যাচ্ছে হরিণী, ভ্রমর আর নীল শতদল।

জরুরি ঘোষণা নিয়ে আমি যাই অরণ্যের ফাঁকে। আমাকে তোমাকে নিয়ে উড়ে যায় ছায়াচ্ছন্ন ছাই। এইভাবে পাহাড়ের সাথে চুক্তি মাফিক আমাদের যৌথ বয়ানে বেজে মায়াবী হয়ে ওঠে নিষিদ্ধ রোশনাই।

সিনেমার ভিতরে নিয়ন্ত্রিত অন্ধকারে রঙিন ছেলেরা আগুনমেয়েরা হেঁটে আসে গলিতে গলিতে, বুনোগন্ধ দেশোয়ালি সাজ খুলে যায় জলীয় খোঁপায়- 

এইখানে প্লেব্যাক সাউন্ড, আমরা দুজন একে অপরের বিষাদের স্বাদ নিই- উল্লাসে গেঁথে ফেলি কান্নার মালা- পর্দায় জমে যায় মেঘ। সিনেমার ঘরে জানালা রাখেনি কেউ, ঘুলঘুলি নেই- পায়রা ওড়েনা- মাঝেমধ্যে চোখ জ্বলে ওঠে শিশিরের গায়ে- সিলভার স্ক্রিনে নির্জন মেঘ। 

মৃত্যু শাঁসালো- সিনেমার আলো এইভাবে পাহাড়ের কোলে তোমাকে আমাকে হ্যালুসিনেশনের ছলে কোমায় পাঠালো।




যখন কবিতা লিখি, কেমন দেখতে লাগে আমাকে তখন? ঘুমন্ত প্রজাপতি? বৃষ্টিভেজা হরিণীর সলজ্জ দৃষ্টি যেমন? যখন কবিতা লিখি, কেমন দেখতে হয় আমার দু ঠোঁট? কৃষক- রমণী তার কোলে নিয়ে মাটির কলস, প্রথম ভোরের আলো মেখে জল ভেঙে নামছে নদীতে? যখন কবিতা লিখি, শাদামেঘ ডানা হয়ে আসে? চা দোকানী ঘুমচোখে রেডিও চালালে, প্রথম যে গান বাজে শহরের আলসেমি ভেঙে? যে করবী প্রতি ভোরে লাল, যে পাখিটি বাঁশির মতন গেয়ে ওঠে সুদূরের বাঁকে! যখন কবিতা লিখি, পারিজাত আলো ফুটে ওঠে? নাকি এক বিষাদের অভিজাত পোশাকেরা আলগোছে সরে, নাকি এক এসরাজে দুঃখেরা এলোচুল মেলে? যখন কবিতা লিখি, দগ্ধ তারার মতো নিঃস্বতা রঙিন ভাস্বর? বৃক্ষের কমনীয় শরীরেরা নারী হয়ে যায়? কেমন আমার গ্রীবা, যে ঘোড়াটা শেষ রাতে ফেলে আসে ঠিকানা-চিরকুট? যখন কবিতা লিখি, সর্ষের ক্ষেত জুড়ে নীলাম্বরী আঁচলের ঢেউ? মালঞ্চ সাঁকো জুড়ে গোলাপের অমেয় কথন? আমার আঙুল বুঝি পলাশের নিখোঁজ আদর? আমার চোখের নিচে আঁধারের মিহি-অনুরাগ? যখন কবিতা লিখি, আমি বুঝি অন্তসত্ত্বা মা? ভিতরে যখন নড়ে নবজাতকের দেহ, সহজ উৎসায়...যখন কবিতা লিখি, জাদুকর দেখায় আমাকে? লাল নীল হলুদের ভাষা জানা কোনও জলপরী? অথবা ঘাতক লাগে? একশো আট খুনে যার হাত? অথবা মেষ পালক, যে চিনেছে মেঘেদের চিঠি? নতুবা কি মনে হয়, পলাতক বিপ্লবী একা, চোরাগলি ধরে খোঁজে নিরাপদ ছায়ার প্রহরা? কেমন দেখতে লাগে, প্রতিটি পঙক্তির আমি পিতা? যার পিঞ্জরে আঁকা লালনের উদাসীন সাড়া? আমাকে কি মনে হয়, নর ও নারীর সংগমসাজে বেজে ওঠা ভিজে একতারা? আমাকে কি মনে হয় অনন্তে উড়ে যাওয়া মৃত্যুর জীবিত ইশারা?

প্রসবকালীন




ব্যস্ত রাস্তায় বাঘ বেরুলে স্কুটার চোখে হরিদ্রাভ ফাঁদ পাতে। বাঘের তখন প্রেমের নরম শোক। গামছা কাঁধে একটা লোক ডোরাকাটা ঠোঁটে, জাপটে ধরলো ঘরফুরনো মেঘ। মেঘ কুড়নোর প্রাচীন শখে আদিম শিকার আয়েশ করে বসে। স্কুটার নামে নদীর দেহে। বাঘের এখন দারুণ জ্বর। বুকের ভিতর প্রেমের ঝড়। একটি মেয়েও এই পাড়াতে নেই। এসব ভেবেই ছয় ঋতু, আঁচল খুলে চুল মেলে। হরেক রঙের পাহাড় নাচ। একটি নোলক একটি পালক স্কুটার বালক আর বাঁশি। অন্ধ একটি বন্য ফুল। ওদের সঙ্গে মিল বিপুল। জানেই না সে আয়না কাকে বলে। এসব রোজই চলে। দুপুর অলস, বিজন রোদ‌। নানান ঋতুর ধারের শোধ। কোথাও কোনও পাওনা বাকি নেই। বাঘ বুঝেছে, প্রেমের মালিক সেই। যেই না বোঝা, হঠাৎ ছুট। এ গল্পটার সবটা ঝুট- শুধু একাই বাঘ ঘুমিয়ে ভাবে। স্কুটার কেন ভয় পেলনা তাকে? ঘুমের ভিতর বৃষ্টি ঝাঁকে ঝাঁকে।

বাঘ স্কুটারের 'ঝুটা' গল্প




কাল রাতে এক মৃত সৈনিক এক কৃষকের বাড়িতে এসেছিল। তার মনে একটা খটকা থেকে গেছে। যুদ্ধের মাঠ আর কৃষকের জমির মধ্যে কে বেশি সূর্যের কাছাকাছি! আকাশের মাঝখানে সবুজ রঙের এক গর্ত দেখতে পেয়ে মৃত সৈনিক ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে তার হাত কৃষকের উঠোনে একটি পিস্তল খুঁজে পেল। 

কৃষকের কলকের ভিতরে জল বেড়ে যাওয়ায় বহুদিন তার আর নেশা হয়না।

এলবেট্রস পাখির জন্য সৈনিকটি গোটা জীবন ধরে রোদ জমিয়েছিল। 

কৃষকটি আজ ভোরেই একটি জাহাজের পাল দেখতে পেল। ওর এক ঘোড়ারোগ। ওই সবুজ গর্তের গন্ধ নাকে এলেই ও সমুদ্রে পাড়ি দেয়।

কৃষকের রমণীটি বেলা বাড়তেই কোমর পর্যন্ত ভিজে চুল ফেলে মৃত সৈনিকটিকে স্নান করাতে এলো।

কিন্তু অবাক হল। সৈনিকটি জানালায় বসে বসে সূর্যের সাথে তাকে নিয়েই গল্প করছে।

আলো আর অন্ধকার চিরকাল কেন এত দূরে। ভালোবাসে বলে?

কৃষকটি তখন মাঝ সমুদ্রে। আশ্চর্য, সেখানে এতটুকু জল নেই। তার বাড়িতে ঢেউ আর ঢেউ।

রমণীকে বলে আসা হয়নি। তার কোমরের ভাঁজে সে অনেকদিন আগেই তার সমস্ত নেশা লুকিয়ে রেখেছে।

রমণী ঝলসে গেল। সূর্য তাকে খেল। মৃত সৈনিক বসে বসে দেখল।

যুদ্ধ ছাড়াই এত প্রেম এখানে। শুধু শুধুই সে প্রাণ দিয়েছিল।

ভালোবাসে বলেই কি সে কৃষকের থেকে এত দূরে? 

দূরে দূরে আরও কত মৃতজন, ভালবাসার গর্ভে বিচ্ছেদের শর্ত পালন করে।

যুদ্ধ ছাড়াই


প্রযত্নে রবীন্দ্রনাথ, একেবারে প্রান্তিক গ্রাম... যেখানেই পিনকোড গেঁথে ভদ্রলোক পা রাখবেন, সেইখানে হুড়মুড় করে ছলকে ওঠে খঞ্জনা অঞ্জনা। কোপাই শ্রাবণী। ওইখানে গেছো? বিকেল গড়ালো? বাউলরা ভালো? আজ শুক্রবার। হাট বসেছে নিশ্চয়ই? পদ্মাপাড় তো নয় জানিই। খোয়াই, সোনাঝুরি। কী পরেছো? নিশ্চয়ই শান্তিনিকেতনী। তোমার হাতে একগুচ্ছ কাশফুল, কখনও দেখিনি। পলাশ পেয়েছো? কৃষ্ণচূড়া লাল? মালঞ্চ কখন যাবে? কাল? দেখা পেলে? লম্বা দোহারা সেই প্রেমিক লোকটার? কথা হলো? বৃষ্টি হচ্ছে বুঝি?  তোমাদের চোখাচোখি মেঘের ভিতর? কেমন লেগেছে ওর? তোমাকে এত কাছে পেয়ে! গীতবিতানের মেয়ে। প্রযত্নে যার নাম। তাকে এত কাছে পেলে, বর্ষা তো আসবেই ধেয়ে।

গীতবিতানের মেয়ে-১
উজান উপাধ্যায়


১০

(১)

স্নানাগারে বন্দী করলাম। অবশিষ্ট আমাকে। বাইরে হালুম হুলুম আপাতত থমকে গেছে। বাইরের আলো আপাতত নিজেদের লুকিয়ে ফেলেছে। বন্দীশালার নিজস্ব শব্দের অভ্যাসে ফেনা মাখছে  সারাদিনের আহত ফরমান।

(২)

হাসপাতালের চেহারা এখন বিসর্জনের পরের ঘাটের মতো। কাঠামো খানিকটা ডুবে খানিকটা ভেসে আছে জলে। চতুর্দিকে সিরিঞ্জ, মৃত পতঙ্গ, অচেনা লাশ। একেকটি দেবতার একেকটি ছিন্ন অঙ্গ একেকদিকে।

(৩)

এইসব দৃশ্যে আগ্রহ নেই কোনওদিন। এগুলো ছিল, আছে, থাকবে। নানারকম ঝলমলে পোশাক পরিয়ে খামখেয়ালীপনা আর উন্মত্ত ফড়িং নিয়ে চুটিয়ে নেশা করেছি আনন্দের। বেলুন, পটকা, হেভ্ভি দেখতে প্রেমিকা, চূড়ান্ত সঙ্গম, দারুচিনি বনানীর দ্বীপ, শঙ্খচিল, সাতনরী হার, জলপিয়ানো, রাতপরিদের তুমুল উচ্ছলতা...

(৪)
জন্ম মৃত্যু বিষণ্ণতা দুঃখ নিহত গাছ অবসাদগ্রস্ত পাখি আর লুন্ঠিত মায়ের আঁচল...


(৫)

নো ইয়ার....আমার পৃথিবীতে  শুধু হাজার রঙের ফূর্তি...


(৬)

বন্দীশালায় বসে সর্বোচ্চ মুক্তির স্বাদ আসে...খুলে রাখা পৃথিবীর জিভে শুধু গিঁট গিঁট আর গিঁট।

ছিঁড়ে ফেলছি গিলে ফেলা হাইওয়ে আর উঁচু উঁচু পাহাড়গুলোকে। 

(৭)

গত সাতশো বছর আমি পোশাক পরিনি। তবুও আমার উল্লাস দেখে কারও সাহস হয়নি আমাকে উলঙ্গ বলার।

(৮)


হাসপাতালের চেয়ে বড় কোনও দেবালয় আজও বানাতে পারেনি মানুষ।

(৯)


আমি ওখানে বসে আরও নয় হাজার বছর লালনের গান করব।

(১০)

আমার নাম রবীন্দ্রনাথ। আমি মোনালিসা। আমার নাম পিকাসো। 

(১১)

হিম্মত আছে তো..

হাসো।

প্যারাডাইস@হাসপাতাল_দেবালয়.কম
উজান উপাধ্যায়




সুবীর সরকার

                



গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়া
সুবীর সরকার

১৫.
"গঙ্গাধরের পারে পারে রে
কাশিয়া ঝোপা ঝোপা
তারি তলে সোনার বন্ধু ডাঙায় দোতরা"

বিকেল আর সন্ধ্যের ফাঁকে এই গান গাইতে গাইতে নদী গঙ্গাধরের বিস্তীর্ণ চরের উপর দিয়ে হাঁটতে থাকেন বসন্ত মালি।বসন্তের কাঁধে মস্ত এক ঢোল। কাঠি ঢোল।এই জনপদের সকলেই এই ঢোল আর ঢোল কাঁধে হেঁটে যাওয়া বসন্ত মালিকে প্রায় সমার্থক ভাবেন।প্রায় তিন কুড়ি বছর জুড়ে এই ভূগোল পরিধী জুড়ে ঢোল নিয়েই কাটিয়ে দিলেন।তার ঢোল কথা বলে।গানের জুলুস জুড়ে এক তীব্র মাদকতা নির্মিত করতে থাকে বসন্তের ঢোল।
আজ বসন্ত যাচ্ছে কইমারির চরে।সেখানে "রাজার বেটির" গানের আসর।সারারাত ধরেই গানের জলসা চলে এই অঞ্চলে। গানবাড়ি জুড়ে মস্ত মেলা বসে যায়।আবার গান শুনে গঞ্জ গ্রামের বউ বিটিদের চোখ ভিজে যায়।আবার গানের মাঝে শরীরে পুলক জাগিয়ে দু চার পাক নেচেই ওঠেন শশীকান্ত,তারামোহন,চন্দ্রধরেরা।গান বুঝি তাদের জীবনের মস্ত উৎসব!অদ্ভুত যৌথতায় বেঁচে থাকা।
বসন্ত মালি যেমন ছাড়তে পারলেন না এই গানের মায়া।গান আর ঢোল তার জীবনকে কিভাবে পাল্টে দিল!
পুরোন দিনের স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে বসন্ত গঙ্গাধরের চর পেরোতে থাকে।স্মৃতি তাকে বিমনা করে।এত সবের মাঝে প্রায় সন্ধ্যের রহস্যময় পরিসর জুড়ে বসন্ত তার চোখের মায়াজল সামলাতে না পেরে পুনর্বার গেয়ে ওঠে গান_
"এপার থাকি না যায় দেখা রে
নদীর ওই পরের কিনার"
১৬.
জীবন খুব সুন্দর।জীবন আশ্চর্যরকম সুন্দর।ভরা সভায় যখন বসন্ত মালি ঢোল বাজায়, ঢোলে ঝড় তোলেন তখন জীবনের প্রতি মায়া বেড়ে যায়।
গঙ্গাধরের চর অতিক্রম করতে করতে কিংবা কইমারীর চরে প্রবেশ করতে করতে বসন্তের একটা প্রস্থানভূমির কথা মনে পড়ে যায়।কার্তিকের চর জুড়ে তখন দুধের সরের মতন হালকা কুয়াশায় পর্দা।আকাশে কুয়াশা মাখা অনবদ্য চাঁদ।বসন্তের অন্যমনস্কতা কাটে না! সে বুঝি অন্যমনস্কতার মধ্যে আবার গান টেনে এনে তার শরীরের পেশিসমগ্রতায়
কিরকম দূরাগত হয়ে পড়তে থাকে।আর চরের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে পরে গানের সুর_
"হামার দ্যাশত বড় বাঘের ভয়
রে সোনা রায়"
জীবনের পর জীবন এভাবেই বাঁচা। বেচেঁ থাকা।
জীবন আদর করে।জীবন নিয়ে যায় ভরা হেমন্তের খেত মাঠে শূন্যতায়।বসন্ত প্রবেশ করেন কইমারির
চরে।আর এই প্রবেশের অনুষঙ্গে অন্তরীক্ষে ঘুরে বেড়ায়,উড়ে বেড়ায় গান_
"তুই জীবন ছাড়িয়া গেইলে
আদর করিবে কায় জীবন রে"


রবিবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২১

পিয়াংকী

                               


  


বাতাসে বিষাদের সুর।মায়ামায়া আকাঙ্ক্ষা, কোথায় যেন একটা নেই-নেই আহুতি। মনের ভেতরঘরে জল,বাইরের শরীরে কচুপাতার আবরণ। কিভাবে যেন দশমীও পেরিয়ে গেল।হুস করে ছুটে গেল ট্রেন।আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম প্ল্যাটফর্মে, জানি আবার ফিরবে আসছে বছর। এখন লক্ষ্মীঘট কচুপাতায় পুঁটিমাছ আর ইঁদুরের মাটি দিয়ে নিয়মকানুন, এখন কাঁসার থালায় বাটি সাজিয়ে দশব্যঞ্জনে খাওয়াদাওয়া পর্ব।


আসলে এ সব আয়োজনই, কিছু ভুলিয়ে রাখা কিছু  ভুলে থাকার পদ্ধতি। মরসুম উৎসবের,মহল্লায় আহার বাহারের তোড়জোড় 





এসব নিয়েই গরম বাহার এসে পৌঁছল ষোলতম পর্বে।দশমীর দিন বাড়িতে এলেন নন্দাজামাই।শাশুড়ী মা গত হয়েছেন প্রায় এগারো বছর। কিন্তু জামাই আদরে ভাটা পড়তে দিই নি কোনদিন। আজ যাদের জন্য এই থালা সাজালাম তারা অক্ষয় হোন জামাইবাবু ডাকে,জামাই-আদরে



 দশমীর থালায়...


১.গোবিন্দভোগ ভাত ধোঁয়া ওঠা

২.কাঁচালঙ্কা ঘি লবণ 

৩.মাছ ভাজা 

৪.রাঁধুনি মুসুর 

৫.মুসুরপেঁয়াজি

৬.কাতলা কালিয়া

৭.চিকেনকষা

৮.ড্রাইফ্রুট চাটনি

৯.রসগোল্লা 

১০.মিষ্টি দই




গরম বাহার।আজ ষষ্ঠদশ পর্ব।

সোনালী চক্রবর্তী

 

                     


আঞ্জুমান ২





"সাংকাশ্য নগরীর এখন কী নাম আর্নেস্তো?"



-- "প্রবারণার তো এখনো অনেক দেরী তথাগত, আজ হঠাৎ ?"



" 'বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়' যদি শ্রমণদের কোনো একদিন বলে এসে থাকি 'চরত্থ্বে ভিক্ষবে চারিকং', নিজে আজ তার ব্যতিক্রম হবো? নিজেই না বললে খানিক আগে আদর্শকে হত্যা করেছে আমার আর তোমার শরীরকে? তোমায় প্রত্যক্ষ করতে হবে না তোমার আদর্শের পরিণতি? অন্ততঃ আমি মহাপরিনির্বাণ নিয়েছিলাম ব্যক্তিগত নির্ধারণে আর তা প্রথম বৌদ্ধ সঙ্গীতির আগেই। কিন্তু আর্নেস্তো, তুমি তো আজও সমাজতন্ত্র নিয়ে কিছু ভ্রমে। সব পেরিয়ে তোমায় আমি কবিই তো দেখি। আর কোন উন্মাদ বিপ্লব আনতে এমন প্রেমিক হতে পারে? চাই না আঁশটুকুও থাকুক, তাই আজই। তাকাও... স্বধাকে দেখতে পাচ্ছ?"




-- " পাচ্ছি। ভূতগ্রস্তের মতো ভাঙা ঘুম হাতে করে বসে আছে। প্রথমটা কিছু বোঝেনি। ধীরে আতঙ্ক তার ডানার মধ্যে মুড়ে নিচ্ছে, সংজ্ঞা মুচড়ে উঠছে "




মহকুমা মফস্বলটি যেহেতু পশ্চিমবঙ্গে এবং পশ্চিমবঙ্গ যেহেতু ভারতরাষ্ট্রে, সুতরাং কিছুমাত্র বিস্ময়ের নয় তার সর্বাপেক্ষা নিকটবর্তী অক্সিজেন প্ল্যান্টটির দূরত্ব চুরাশি পূর্ণ আট কিলোমিটার। একটি মাত্র জাতীয় সড়ক (এন এইচ চৌত্রিশ, বর্তমানে বারো) যা দিয়ে দুটি অঞ্চল যুক্ত, সেটিই উত্তরবঙ্গে পৌঁছানোরও একমাত্র স্থলমাধ্যম প্রায়শই অতি বর্ষায় যার অন্তর্গত কিছু ব্রীজ ভেসে ও ভেঙে যায় এবং জলস্রোতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে বাকি ভূ-খণ্ড থেকে। বর্ষা ব্যতীত তাকে ব্যবহার করতে বাধ্য হওয়া প্রতিদিনের কোটি খানেক যান কল্পনা করে মেঠো পথের গোরুর গাড়ি তাদের তুলনায় কতটা সৌভাগ্য পোষণ করে আর অবশ্যই প্রার্থনায় থাকে কবে পুরোপুরি এই স্থলজ অসভ্যতা থেকে নদীমাতৃক সভ্যতায় ফিরে যাওয়া যেতে পারে। এ নরক থেকে ত্রাণ দেবে এমন পুত্রাণের আশা "দেহি দেবী" মন্ত্রেও উচ্চারণ করা পাপ, এমত স্বধারও বিশ্বাস। ট্র‌্যাফিক আইন যারা রক্ষণাবেক্ষন করেন তারা জানাতে ত্রুটি রাখেন না ইমার্জেন্সি সার্ভিসগুলির জন্য সড়কে সর্বদাই অগ্রাধিকার থাকবে যেমন এম্বুলেন্স, বেবিফুড, লাইফ সেভিং ড্রাগস ইত্যাদি কিন্তু এই আইনের নির্দেশিকায় যে 'সড়ক' শব্দটির অস্তিত্ব আছে "ইতি গজ"র মতো করে যা সমগ্র আইনটিকেই প্রহসনে পরিণত করেছে তা জানার বা জানানোর কোনো দায় তাদের থাকে না। এ রাজ্যে তুখোড় আন্তর্জাতিকতায় ক্ষমতার পায়ের নিচে লাল কার্পেট পাতা, দামী মৃতদেহের সদগতিতে হাজির গ্রিন করিডোর, দফতরের দেওয়ালদের পরানো থাকে নীল জার্সি... আর যাদের মুখে রক্ত উঠিয়ে রোজগারের অংশ থেকে কেটে নেওয়া ট্যাক্সে এই লাল সবুজ নীল আতসবাজি তাদের জন্য 'পূর্ত দফতর' নিতান্তই ডাইনোসর বা ডোডো পাখি। মাত্র দেড়শ কিলোমিটার দূরের মহানগরীতে পৌঁছতে বা ফিরতে দিনের সিংহভাগ সময়কাল কাটিয়ে দেওয়া স্বধার কাছে জন্মইস্তক এই অভিজ্ঞতা নিত্যকর্ম পদ্ধতির মতোই সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু কিছুক্ষণ আগের ফোন তাকে যে খবর দিলো তাতে সে ফুটন্ত তেল আর জ্যান্ত আগুনের মধ্যের পার্থক্য স্পষ্ট বুঝতে পারল। রিফিলড অক্সিজেন সিলিন্ডারের যে ট্রাকটি প্রতিদিন সন্ধ্যায় সদরে ঢোকে, ডিফারেন্সিয়াল ভেঙে যাওয়ায় আজ কতক্ষণ পর আসবে সংবাদ নেই। নার্সিংহোমের মজুদ থেকে নীলাদ্রি আর মাত্র ঘন্টা দুয়েক সরবরাহ পাবেন তার ক্যনুলায়, বাকিটা ঈশ্বর।



" কিন্তু তথাগত, আপনি এই পরিস্থিতি দেখিয়ে আমায় কী বোঝাতে চাইছেন? আমার আদর্শ এখানে আঘাত পাচ্ছে কোথায়? "



-- " বড় অধৈর্য হয়ে পড়ো তুমি আর্নেস্তো, বালক স্বভাব। যা দেখাতে চাইছি তা আমায় প্রশ্ন করে জানতে হবে না। প্রসববেদনা উঠলে কি ধাইমাকে জাগিয়ে তুলতে হয় আসন্নপ্রসবাকে? "





প্রতিটি ভাষার নিজস্ব ব্যাকরণ আছে যেমন প্রতিটি ক্রীড়ার নিজস্ব অনুশাসন, প্রতিটি সমাজের নিজস্ব বিধান আর প্রতিটি সম্পর্কের নিজস্ব ব্যবধান। সোশ্যাল মিডিয়া কোনো ব্যতিক্রম কি? যারা এটিকে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান বলে স্বীকার করে নেয় তারা মানবে এরও নিজস্ব ব্যাকরণ, অনুশাসন, বিধান, ব্যবধান সবই বর্তমান। নিজস্ব গণ্ডিতে ব্যক্তিগত প্রাপ্তি অপ্রাপ্তিকে তাহলে কেন প্রকাশ করা যাবে না নির্দ্বিধায়? অন্ততঃ স্বধা এমনই জানত। সে যেমন নীলাদ্রির নার্সিংহোমে এডমিটের খবর জানিয়েছিলো ঠিক তেমনভাবেই তার সঙ্কটও। একটি সিলিন্ডারের অভাবে যে তার বাবা তার চোখের সামনে ডাঙায় তোলা মাছ হয়ে যাবে এই সাদা ও সরল সত্যকে সে ভিক্ষার আবেদনে পোস্ট করেছিলো স্নায়ু সামান্য নিয়ন্ত্রণে আসতেই। 




স্বধার প্রত্যাশা ব্যর্থ হয়নি। তার অতি সংক্ষিপ্ত বৃত্তও প্রায় হাজার দুয়েক শেয়ারে তার আবেদন পৌঁছে দিয়েছিলো সেলেব, সাহিত্যিক প্রশাসক মহলে। প্রত্যেকেই পূর্ণোদ্যমে তাকে সাহায্যের চেষ্টা করেছিলেন। ফল এসেছিলো মন্ত্রবৎ। আধ ঘন্টার মধ্যে সায়রের ফোন তাকে জানিয়েছিলো প্রশাসন সহ বিভিন্ন মহল থেকে ইডেনের কেবিন ওয়ানকে নিয়ে এত উৎকণ্ঠার কৈফিয়ত তাকে দিতে হচ্ছে যে সে সমস্যায় পড়ছে। সায়রের মালিকানার অন্য নার্সিংহোমগুলিতে ক্যারিয়ার পাঠিয়ে সিলিন্ডার আনানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্বধাকে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে ভবিষ্যতে সোশ্যাল মিডিয়ায় সে কোনো সাহায্য চাইবে না, এর বিনিময়ে সায়র ব্যক্তিগতভাবে দায়বদ্ধ থাকলেন নীলাদ্রিকে পরিষেবা সংক্রান্ত কোনো অভাবে না পড়তে দেওয়ার। অতি সহজ চুক্তি। একপক্ষে নীলাদ্রির আয়ু, বিপরীতে ইডেনের নিরাপত্তা। যে পরিমাণ আলোড়ন এই মুহূর্তে স্বধার পোস্টকে ঘিরে শুরু হয়েছে, কেন নার্সিংহোমের অধীনে থাকা সত্ত্বেও পেশেন্ট পার্টির ফরেন হেল্প লাগবে এই ইস্যু তুলে, তাতে ইডেন ঘোরতর বিপদে। চরম স্বার্থপর স্বধা, নীলাদ্রির মুখ স্মরণ করে চোখ বুজে কথা দিয়েছিলো- ভবিষ্যতে ইডেনে তার চোখে যাইই পড়ুক, যাইই ঘটুক যে কারোর সঙ্গে, একমাত্র নীলাদ্রির প্রসঙ্গ ব্যতীত সে প্রত্যেককে এবং সবাইকেই অগ্রাহ্য করবে-  "মাস্টারমশাই, আপনি কিছু দেখেন নি"। কতো যে ডিল হয় প্রতিটি পলে এই সংসারে, কতো শতরঞ্জ... তবুও দ্যূতক্রীড়ার প্রসঙ্গ উঠলেই গান্ধার যুবরাজকে স্মরণ করে ইতিহাস... এ বড়ো দুর্ভাগ্যের। 




"আর্নেস্তো, যেটুকু দেখলে তা এক রোপণ উপাখ্যান মাত্র। সব বীজের নিয়তিতে মহিরুহ থাকে না, কিছু বিষজ হাহাকারও ধারণ করে। পোখরান মনে পড়ে? আমি হাসছিলাম তাই না? ভারতরাষ্ট্র তার কূটনৈতিক তুরুপে পৃথিবীর ষষ্ঠতম শক্তিশালী হিসাবে নিজেকে প্রমাণ করলো, তার দায় কার - স্মাইলিং বুদ্ধ - আমারই না? আজও দেখবে। তাকিয়ে থাকো..."



--" তাকিয়েই তো আছি তথাগত কিন্তু এখানে কী করে আমার ভ্রম ভাঙার কাঠামো গড়া হবে সে চালচিত্র এখনো অব্দি পেলাম না। আমি অনুমান করছিলাম আপনি মৌলবাদ কীভাবে মহামারী হয়ে উঠছে এই অতিমারি পীড়িত উপমহাদেশেও সেই নিয়ে কিছু বলবেন। আচ্ছা খেয়াল করেছেন, জাত নির্বিশেষে মৌলবাদীদের নিজেদের মধ্যে কী প্রগাঢ় মিল? অন্ধত্ব ভিন্ন এদের দ্বিতীয় ধর্ম থাকে না, পৈশাচিকতা ভিন্ন দ্বিতীয় ধর্মাচরণও নয় অথচ এদের চামড়ার নাম 'ধার্মিক'। কী পরিহাস না? আমি এও ধারণা করছিলাম তথাগত আপনি মার্কস নিয়ে হয়তো বলবেন। "রিলিজিয়ন ইজ দ্যা ওপিয়াম অব দ্যা পিপল"- এই বিকৃত, খণ্ডিত কোটেশনের মূল ও পূর্ণাঙ্গ বাক্যটি তুলে হয়তো স্বচ্ছ করে দেবেন কেন মৃত্যুমুহূর্ত অবধি মার্কসের গলায় ক্রুশের চেনটি ছিল। এও বলবেন পশ্চিমবঙ্গের রক্তাভ জারজেরা জনগণকে এতটাই অশিক্ষিত ভেবেছিলেন যে তারা ধরেই নিয়েছিলেন কেউ মার্কস পড়ে না, বোঝে না, জানে না। ফলে হাতের যাবতীয় মাদুলি ও তাবিজদের যত্ন করে সাদা পাঞ্জাবির হাতায় ঢেকে, তিন দশকেরও বেশি সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক আচরণ অনুষ্ঠানকে অবজ্ঞা করে তখ্ত অধিকারে রেখেছিলেন "



--"যা তুমি নিজেই বোঝো তা যদি নতুন করে তোমাকে দেখাতে যাই তবে যে 'বোধি' শব্দের অর্থ 'নির্বোধ' হয়ে যায় আর্নেস্তো। নীরবতা পৃথিবীর ভয়ংকরতম শীতল মারণাস্ত্রের নাম। কিছুক্ষণ না হয় তারই অনুশীলন করলাম আমরা? এসো... বেশী নয়, বুদ্ধের আত্মার নাম পরিমিতি... নিপ্পন আলো হয়ে ওঠা অবধি, এসো"





"Religion is the sigh of the oppressed creature, the heart of a heartless world, and the soul of soulless conditions. It is the opium of the people."

রবিবার, ১০ অক্টোবর, ২০২১

পিয়াংকী

                               



আজ তেইশে আশ্বিন, আপামর বাঙালির প্রিয়তমা শারদোৎসবের সূচনা হয়ে গেল বিরাট এক আনন্দযজ্ঞের মধ্য দিয়ে,  আজ শুভ মহাপঞ্চমী,যদিও পঞ্জিকা তিথি নক্ষত্র অনুযায়ী হিসেব বা হিসেবের গরমিল ভুলচুক, শাস্ত্রমত অথবা জনজোয়ার। তবু আমাদের প্রাত্যহিক দিনগোনা আর  যাপনে পঞ্চমী-আলো।


আজ রবিবার, যথারীতি আমি চলে এসেছি সৃ প্রকাশনের সাপ্তাহিক রান্নাব্লগ নিয়ে। তবে এই উৎসব আবহাওয়ায়  আজ কোনো রেসিপি নয়।আজ ঘরোয়া উদযাপনে পঞ্চমীর দুপুরভোজ


কাঁসার থালায় রয়েছে


বাসমতী ভাত

কাঁচালঙ্কা ঘি

উচ্ছেভাজা

ইলিশ মাছের মাথা ভাজা

ইলিশ ভাজা

মাছের তেলের বড়া

লাউখোসা ঝিরি

লাউউচ্ছে তিতো ডাল

আলুসেদ্ধ 

বেগুনভাজা 

পাঁপড়ভাজা

বেগুন কালোজিরেবাটা ইলিশঝোল

ইলিশভাঁপা

চাটনি 


সকলে ভালো থাকুন।শারদীয়া শুভ হোক

তিস্তা

                      




বনমালী তুমি পরজনমে হইয়ো রাধা...



৬/
বেঁচে থাকাও এক দক্ষতা লতিফা। আমি আগাছার কাছে শিখেছি, প্রতিবার ছেঁটে ফেলবার পরেও কতটা জেদে আরো বৃহৎ জায়গা জুড়ে  ভরিয়ে ফেলতে পারা যায় নিজেকে!


কী কারণে বিলুপ্ত হয়ে গেছিলো আমার চোখের পাতা, আজ আর কিছুতেই মনে করতে পারি না। পুরনো একটা কাঠের দরজার পিছনে ফেলে এসেছি আমার গতজন্ম। এমব্রয়ডারি করা কুশন, পেল্লাই এক জানলা আমার শোয়ার ঘরের, আরমকেদারা, কিছু সাবেকি আসবাব এবাং জল রঙে আঁকা একটা ফ্যামিলি অ্যালবাম। কাউকেই চিনতে পারি না। শুধু দাউ দাউ একটা শিখা মনে পড়ে। একটা বিস্মৃত ছায়া এবং একটা শৈশব!

পেঁচার চোখের মতো অন্ধকার প্রিয়তা নিয়ে আমি পৃথিবীতে ফিরে এসেছি আবার। একে অপরের উদ্বিগ্ন এবং অধৈর্য হাতের তালুর ওপর জ্বলন্ত মোমের ড্রপলেট ফেলছি গোটা গোটা রাত!  এ এক অদ্ভুত উন্মাদনা! তুমুল প্রশান্তি! যৌনতার বিপরীতে আর এক অপার যৌনতা! রাতকে তো আটকে রাখা যায় না! জাদুকরী ছায়ার মতো সে জেগে ওঠে। তুমি অপরিহার্য হয়ে ওঠো আমার ভিতর এবং তোমার ভিতরে আমি। অথচ কী আশ্চর্য দেখো, আমরা মিথ্যে বলি। প্রতারণা করি। বিভ্রান্ত করি একে অপরকে। কারণ আমরা আড়াল খুঁজি। কারণ আমরা জানি– " আমি"-টুকু ছাড়া আমাদের কাছে আসলে আর কিছুই অপরিহার্য নয়।

বিশ্বাসঘাতকতা মানে কী, জানো লতিফা? বিশ্বাসঘাতকতা হলো– প্রতিশ্রুতিময় শান্ত একটা হত্যাকাণ্ড। ব্রতের বন্ধ চোখে বোহেমিয়ান অন্ধ নদী! আজকাল চাঁদ সহ্য করতে পারছি না কিছুতেই।

অপরিমেয়তা ভেঙে যাচ্ছে ক্রমে...


( ক্রমশ)


শনিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২১

সোনালী চক্রবর্তী

         


ইলুশিও



তুমি দেখো অকালমৃত্যু, আমি জানি বিচ্ছেদের আতঙ্ক কতদূর তীব্র হলে প্রেমিকের করতলে হত্যারেখা জাগ্রত হয়- আমাদের এক অদ্ভুত সংস্কার, যে কোনো শব্দের বহুমুখীনতাকে আমরা জেদে অস্বীকার করি অথবা যে উপেক্ষার প্রয়োজন ছিলো বন্দিত্ব আরোপের প্রক্রিয়ায়, তা বরাদ্দ হয় ঝাঁকের কৈ হতে গিয়ে, লালন ভাসেন লালনের জলে, আবাদহীন জমি পড়ে থাকে রামপ্রসাদী খরায়। কমলিনী নিজের সঙ্গেই কথা বলছেন বহুক্ষণ ধরে (এই ইথারে কাউকে স্মরণ না করা অব্দি সে এসে অনধিকার চর্চা করে না) । যদি শরীরে প্রাণের অভাবের পরিভাষা 'মৃত্যু' হয় তবে হৃদে নয় কেন? কালরেখা প্রতিটি আয়ুতে ভিন্ন হলে অকালের সংজ্ঞা কী? যদি আত্মরক্ষার্থে হত্যা আইনসিদ্ধ হতে পারে তাহলে আজও ইউথেনেশিয়া অস্বীকৃত কেন? এত প্রশ্নের ক্ষত যে উদ্ধারণ পালার বিবেক পলাতক। আজ দেখতে যাবেন স্বধাকে, এই স্ফুরণে এখন লেডি ম্যাকবেথও যদি তার সঙ্গে কফিতে আসে, খুব ক্ষতি? কার ক্ষতি?


"মরলে ভাই? বেশ... এ রাসের ঘোর ভাঙাবো না আজ, ভাঙবেও না"


কমলিনীর তো সুখের কথা হবেই, স্বধার গ্রীবায় অভ্রান্ত স্কারলেট, চলনে গর্ভিণী কাছিম। তাকে সমাজ যারপরনাই ভৎর্সনা তো করতোই নাগালে পেলে এই মুহূর্তে রাবাবের যে তারে তার আঙ্গুল ছুঁয়ে আছে পাপ সাব্যস্তে, কিন্তু তিনি তো কমলিনী, একশো আট তার সংস্কারে। তার মানসী আজ এমন আশ্লেষে যা পেতে প্রতিটি অবতার শরীরে, ঔরস-যোনির চক্রে, কোটি কোটি জন্ম ধরে মাথা ঠোকে শ্রী ভগবান।


নাড়িতে যে নৌকা ছিঁড়ে ভঙ্গুর পদ্ম কিছু রসস্থ থেকে গেলো, ঘাতক রাজহাঁস সে ঘুণ বিস্মৃত হলো না- তত্ত্বগত অভিজ্ঞান আর প্রকৃত উপলব্ধিতে যে ফারাক তাকে আসমান জমিন বলে নিতান্তই লঘু করে ফেলা হয়, আসলেই তারা দুই মেরুর। প্রতিলিপি বা ছবি কল্পনায় অরোরা বেরিয়ালিস ভাবাতে পারে কিন্তু তা বিশ্বরূপের বিদ্যুত সঞ্চালনে ব্যর্থ। অদ্ভুত ঘোরের ভিতর ঘাড় গুঁজে ভাবছিলো স্বধা। তাকে শীতল রক্তের সরীসৃপ বলে ব্যঙ্গ শুনতে হয় বিস্তর, একেবারেই তাপ সহ্য করতে পারে না বলে অথচ গত কয়েক ঘন্টা সে প্রায় ফার্নেসের ভিতর ছিলো বলা যায়। অব্যবহার্য-পরিত্যক্ত জিনিস বোঝাই একটা ঘর যাকে গুদাম বললে বিন্দুমাত্র নামকরণ বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা থাকবে না। স্বেদবিন্দুর স্রোত ছাড়া চন্দন পালঙ্কের থেকে ব্যবধান বোঝেনি তো অথচ এই প্রলয়, প্রবল প্রার্থিত হলেও তার প্রস্তুতি ছিলো না কোনো, পরবর্তী ধারণাও, ঠিক এইখান থেকেই তার বিস্ময়যাত্রা। 


কোথাও একবারের জন্যেও স্বধার দ্বন্দ্ব আসেনি এতোদিন শৈবলিনী-কমলিনীর আধ্যাত্মিকতা আর ট্যাঙ্গো সালসার উন্মাদ আবেগের মধ্যে। দুইই ছান্দ্যোগ্য, দুইই এক সত্যের কথা বলে, শকট ভিন্ন, পথ এক। প্রথমটি মূলাধার-স্বাধিষ্ঠান-নাভি-হৃদ-বিশুদ্ধ-আজ্ঞা-সহস্রারকে জাগ্রত করে সূক্ষ্মতায় বিলীনে বিশ্বাসী। দ্বিতীয়টি নির্মেদ আধারকে ভেঙেচুরে মিলন ও মুক্তি বিন্যাসে শরীরকেই অতিক্রম করে চলে। কোথায় বিরোধ? বাউলাঙ্গে রজ-রক্তও তো সেই দিকই নির্দেশ করে। সবই 'ইত্থুসে ব্রহ্ম'। এই মতবাদ স্বধার স্নায়ুতে বিশ্বস্ত আশ্রয়ে ছিলো ফলত সে শরীরকে কোনোদিন অস্বীকারের চেষ্টামাত্র করেনি, অবদমন এক আত্মঘাত মাত্র জেনে অপেক্ষা করেছে। অথচ তবুও আজ মনে হলো সে কিছুই জানতো না এতদিন, একে চন্দ্র থেকে চন্দ্রবিন্দু, কিছুই নয়।


শ্বেতপাথরকে জড়িয়ে থাকো আগুনের সাপ, দেখো নাভি থেকে কিছু ব্যথা ফ্লেমিংগো হয়ে উড়ে যাচ্ছে শেষ সন্তের খোঁজে- নিশ্ছিদ্র যন্ত্রণা স্বধার সর্বশরীরে। সেই অনুভূতিকে ছাপিয়ে যাচ্ছে যে পশমে মাথা রেখে সে ঘুমিয়ে পড়েছিলো কয়েক মুহূর্তের জন্য ইন্টারলিউড শ্রান্তিতে, এই ক্ষণে তার অনুপস্থিতি। দংশন... এতো নিষ্ঠুর হয়? বজ্রের শক্তিতে বেঁধে রাখা উর্দ্ধবাহুদ্বয়ের ভিতর মাথা থাকলে, শ্বাসরোধী চিৎকারটিও কি নিস্তেল প্রাপ্তির? তার অতলে প্রোথিত হচ্ছিলো যার নৃশংস স্তম্ভ, উপসংহারী তন্দ্রায় তাকেই অসহায় পেয়ে এতো আদরের আলপনা কীভাবে আঁকলো সে? শরীরে এভাবে মায়ামেঘ ঘনায়? এইই কি সেই বিশালাক্ষীর থান শৈবলিনী যাকে নির্দেশ করতেন পঞ্চভূতের ফাঁদ নামে? কাঁদছে স্বধা আপাতত... শৈবলিনী দেখছেন কুয়াশার আলোয়... ভাঙছে, নামছে, অঘোর বর্ষা...


যখন শারীরিকভাবে পুরুষ নারীকে চায় অথবা নারী পুরুষকে, সেই আকর্ষণে বহু স্তরবিন্যাস থাকে, শ্রেণীভেদও, কোনোটিই বিচারাধীন নয় কারণ যে কোনো শরীর আসলেই এক আশ্চর্য আলাদিন। জাদু কি প্রদীপে থাকে? সম্ভব? প্রতিটি মানুষের ভিতর বসত করে যে দুর্দম শক্তি সেই তো রূপকে চিরাগ। যে বোঝে সে খোঁজে, যে বিশ্বাস করেনা, পায় না, এতো জলবৎ অঙ্ক মাত্র। শরীর নিয়ে এতো শুচিবায়ুগ্রস্ত যারা, একবারও যে কেন তারা ভাবেনা- "যদৃচ্ছা লাভ"। তেষ্টাকে প্যারামিটার ধরলে আরও সহজ হয় ধারণের আদল। জলের সন্ধানে কেউ পুকুরে অভ্যস্ত, কেউ খোঁজে নদী, যার তৃষ্ণা মেটেনা সে ডোবে, তলিয়ে যেতে যেতে এল ডোরাডো। আর বাকি অংশের কিছুই লাগেনা, বন্ধ বোতল থেকে প্রয়োজন মিটিয়ে নেওয়া, সুতরাং বিচার খাটে না, খাটতে পারে না। অযথা উৎকর্ষ অপকর্ষ ন্যায় অন্যায় নিয়ম নীতির খাপ। 


কিন্তু আজ একথা স্বধা নিশ্চিতভাবেই বলবে যেহেতু শরীরের দূরত্ব শেষ হওয়ার ঠিক পর থেকে টান বিদ্ধংসী হতে শুরু করলো সুতরাং গন্তব্য "দ্যা থার্ড শিপ"। যুক্তি সাজাচ্ছিলো সে সাদা কালো চৌষট্টি খোপে। এখানে ভিজে যাওয়া তালুতে চুমু রাখতে তোলপাড় এসেছে, তুরপুন নখে তৈরী হওয়া আঁচড়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে সাধ গেছে, বরাবরের সম্বোধন 'তুই' অতর্কিতে বার কয়েক 'তুমি' হয়ে গেছে। মানুষের ভিতরের মানুষটা বীজতলার পরেই যেন পাতাল ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। ছিন্নভিন্ন করে চলে যাওয়ার পর বার্তা এসেছে "বুকে আয়, এবার ঘুমো, ঘুমিয়ে পড়, মাথায় হাত দিয়ে রেখেছি"। বারবার প্রশ্নেরা এসেছে "শরীর ঠিক আছে? ঠিক করে কথা বল, শরীর কি ঠিক আছে?" সে উত্তর দেয়নি কারণ এই উৎকণ্ঠায় শরীর যতটুকু থাকে তার থেকে অযুত মাত্রায় বেশী থাকে শরীরের অপ্রাসঙ্গিকতা। 


এখন মণিমালা'কাল। বারিধারা শঙ্খ শরীরের হাঁসুলি বাঁক ছুঁলে অনুপ্রবেশ বোধ হচ্ছে। স্পর্শের স্মৃতি- যারে হেরিলে এ দেহলতা তাবিজ বোধ হয় যেমত। হাওয়ায় বৃন্দাবনী সারং উড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছেন সেই অনন্ত লম্পট। অজস্র ময়ূরের পালক উড়ে বেড়াচ্ছে দিগন্ত বিস্তারে। স্বধার মনে করতে ইচ্ছে করলো তার নাম যিনি লিখেছিলেন "নারী নরকের দ্বার"। তিনি কি কৃষ্ণভক্ত ছিলেন? জানা নেই তার। তিনি সম্ভবত ময়ূরও দেখেননি। স্বধা হেসে উঠল। পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম রাজনীতিবিদটি প্রতারকই তো ছিলেন। ফেরেননি গোকুলে না? কেনই বা ফিরবেন? অথচ নশ্বর শেষ মুহূর্ত তক স্বর্ণমুকুটে শিখিপাখা যে কেন গুঁজে রাখলেন? স্টাইল স্টেটমেন্ট? যেভাবে ক্রাইস্টের ট্যাটুর ভিতর দিয়ে ইদানীং নিপুণ শৈল্পীতে আঁকা থাকে বিলাভেডের নাম, আপাত অদৃশ্য। "বুঝে লহো মন যে জানো সন্ধান"। শ্রীমতির যোনিচিহ্ন আজীবন মস্তকে ধারণ করে মহাভারত সৃষ্টি আর দ্বাপর ধ্বংসের লীলা করে গেলেন যাদবকুলপতি অথচ কেউ টেরটিও পেলো না। স্বধাকে যে নীল নীল দহনে আজ ছেড়ে গেলো সে তবে কে? কেদার মনে পড়ছে তার। ব্রহ্মরন্ধ্র থেকে উত্থিত ব্যপনে কস্তুরীঘ্রাণ। শুভ্র পাথরে আছাড় খেয়ে ভেঙেচুরে যাচ্ছে অজস্র পিতলের ঘন্টাধ্বনি। কৃষ্ণসর্পটি কাকে আঁকড়ে আজ প্রস্তরীভূত হলো?

সুবীর সরকার

            


গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়া


১৩.
তামারহাটের ভেঙে যাওয়া হাটের বাইরে আসতে আসতে সিকান্দার মিস্তিরি তার ঝাঁকড়া চুল নাড়াতে নাড়াতে বেশ মজাদার এক ভঙ্গি তার দীঘল শরীরে বহন করে আনতে থাকে আর কিঞ্চিৎ অন্যমনস্ক হয়েই গানের দু এক কলি কিংবা গেয়েই ওঠে_
"ও কি মাহুত রে
মোক ছাড়িয়া কেমনে যাইবেন
তোমরা হস্তির শিকারে"
এই গানের হাহাকারের মতন সুর বাতাসে ছড়িয়ে পড়তে থাকে দ্রুত লয়ে।গঞ্জ বাজার খেত খামার আর মানুষের ঘরবাড়ি পেরিয়ে এই গান তার সুরসমেত মিশে যেতে থাকে গঙ্গাধর নদীর মস্ত বালার চরে।
সিকান্দারের চোখ ভিজে ওঠে।এই জীবন এই জীবন মায়া নিয়েই তো আবহমান বেঁচে থাকা মানুষের।
সিকান্দার হাঁটতেই থাকে।লিলুয়া বাতাসে দোল খায় সিকান্দারের মাথার বাবরি চুল।
ফাঁকা প্রান্তরে সে আচমকা দু তিন পাক নেচেই ওঠে আর ঝুঁকে পড়ে নুতন গানের ওপর_
"বিনা বাতাসে ভাসা
ঢোলে রে"
সিকান্দার সিকান্দার হয়েই থেকে যায়।দূরে ক্রমে আবছা হয়ে আসে তামারহাটের ভরসন্ধ্যাবেলা।
১৪.
গঙ্গাধরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সিকান্দার মিস্তিরির
শরীরের পুলক সহসা ভেঙে যায়।তার প্রাচীন কালের কালো পাথরের মত কপালে গভীর ভাঁজ পড়ে। সে কি তবে কিঞ্চিৎ বিচলিত হয়!
সিকান্দার আসলে নৌকো বানানোর দক্ষ এক কারিগর।আর এই জল ও জলার দেশে ধনী বল জোতদার বল জমিদার বলো বা গৌরীপুরের রাজাই বলো,নৌকো বানাবার কাজে প্রায় সারা বছরই ডাক পড়ে সিকান্দারের।প্রায় পঞ্চাশ বছর জুড়ে এই কাজ করে চলেছে সে।এই জনপদ তাকে সিকান্দার    মিস্তিরি বলেই জানে।চেনে।একসময় সিকান্দার কালু বয়াতির দলে সারিন্দা বাজাতো।তার সারিন্দা কত কত ভরযুবতী নারীকে উন্মনা করেছে!কত নারীকে এক সংসার থেকে অন্য সংসারে ঠেলে দিয়েছে!কত চেংড়া কে বাউদিয়া করেছে!তার কোন ঠায় ঠিকানা নাই।
তাকে দেখলে এখনও কত মানুষ মজা করে গেয়ে ওঠে_
"কি ডাং ডাঙ্গালু বাপই রে
নাঠির গুতা দিয়া"
তবে কি সিকান্দার তার সারিন্দার জীবনের কথা ভাবছিল!না কি গয়েশ্বর ধনীর জোতজমি আর বাইচের নাও তাকে আরো আরো এক ভাবনার জটিলতায় ঠেলে দিচ্ছিল!

সোমবার, ৪ অক্টোবর, ২০২১

পিয়াংকী

                      



ঝটপট চিকেন 




আজ রবিবার, চলে এলাম রান্নাবান্না নিয়ে। আসলে প্রতিদিনের মেনু ঠিক করে সেটাকে রূপদান করাটা সবচেয়ে কঠিন কাজ একজন রাঁধুনির পক্ষে,তিনি পুরুষ হতে পারেন তিনি একজন মহিলা হতে পারেন,কিন্তু যিনি এই কাজটা করেন একমাত্র তিনিই জানেন এর কীইইই মহিমা।একই রান্না রোজ যেমন ভালো লাগে না ঠিক সেভাবেই রান্নায় প্রতিদিন ফিউশন ক্রিয়েট করলে  নস্টালজিয়ায় আঘাত আসে।এই ধরুন, ছোট থেকে আপনি পছন্দ করেন মৌরলা মাছের টক খেতে অথচ নতুনত্ব কিছু করার নামে রোজই আপনার রান্নাঘরে সজ্জিত হচ্ছেন সাহেব মেম।


তাই একদিন চলুন সব রেসিপিবই বন্ধ করে দিই,অফলাইন হয়ে যাই ইউটিউব থেকে।রাতে চুপচাপ শুয়ে ভাবি ছোটবেলায় কোন খাবার কিভাবে আমাদের মা ঠাম্মা বা পিসি জ্যেঠিরা করে করে খাওয়াতেন


আজ আমি তেমনই একটা চিকেন প্রিপারেশন করেছি যেটা একসময় আমার মেজো মাসীর শ্বশুর রান্না করতেন,আজ দুপুরে সকলে যখন খাচ্ছিল আমি ভেসে যাচ্ছিলাম ফেলে আসা নব্বইয়ের দশকে 


এক কেজি মুরগির মাংস চার চামচ পেঁয়াজ বাটা এক চামচ রসুনবাটা আধ চামচ আদা বাটা, কাঁচালঙ্কাবাটা  সাদাতিল পোস্ত চারমগজ কাজুবাদাম কিসমিস  একসাথে অল্প দুধ দিয়ে বাটা...এই সমস্ত উপকরণ একসাথে মেখে ঘন্টা দুয়েক ম্যারিনেট করে রেখে এরপর কড়াইয়ে রিফাইন্ড অয়েল আর বাটার দিয়ে গরম হলে এলাচ দারচিনি লবঙ্গ তেজপাতা ফোড়ন দিয়ে মেখে রাখা মাংস দিয়ে অল্প আঁচে কষাতে থাকলেই মাত্র কুড়ি মিনিটে তৈরি হয়ে যায় ঝটপট চিকেন


গরম ভাত বা রুটি পরোটা লাচ্ছা... সবকিছুর  সাথে দুপুর বা রাতে পারফেক্ট জুটি এই ঝটপট চিকেন


করে দেখতে পারেন কিন্তু একবার 🙂




রবিবার, ৩ অক্টোবর, ২০২১

বিতস্তা ঘোষাল

                   


একা হওয়ার যুদ্ধ 


একটা ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ চলছে
এ যুদ্ধে রক্তক্ষরণ নেই, নেই বন্দুক
কামান গোলাগুলি
এখানে শুধু নির্জনতা
গাঢ় অন্ধকার চাদর বিছিয়ে 
অপেক্ষা করছে 
অপেক্ষা করছে 
কখন পাশের ছায়াটা বলবে
এসো নির্জন থেকে আরও একা হই

সুবীর সরকার

                              


১১।
'ধওলি রে মোর মাই
সুন্দরী মোর মাই
দোনো জনে যুক্তি করি চল পলেয়া যাই'

গঙ্গাধরের পাড়ে পাড়ে চরে চরে সেই কত কত যুগ ধরে গোয়ালপাড়ার মেয়েরা এই গান তাদের কণ্ঠে তুলে নিয়ে কি এক হাহাকারের সুরে সুরে তাদের শরীরে নাচ জাগাতে জাগাতে জীবনের আবহমান এক আর্তি ছড়িয়ে দেয়।দূরের মাঠপ্রান্তরে তখন বিকেলশেষের  মায়া।মায়ায় মায়ায় বুঝি আস্ত এক জীবনের ঘোর।গানের দেশে নাচের দেশে হেমন্তের হিমের দেশে গানভরা এক জীবনের গল্প প্রখরতার উত্তাপ ছড়াতে থাকলে আবার ঘুরে ঘুরে গান নেমে আসে মরণ ও জন্মের এই দুনিয়াদারির ভিতর-
'নাল টিয়া নাল টিয়া রে তোর ভাসা নলের আগালে/বিনা বাতাসে ভাসা ঢোলে রে'
১২।
এইসব চলতে থাকে।ভরা হাটের ভেতর থেকে এক পেশীবহুল দীর্ঘ শরীর নিয়ে বেরিয়ে আসে নাজিমুদ্দিন ওস্তাদ।সে তার জীবনের গল্পের দিকে একপর্বে আমাদেরকে প্রবল টেনে আনবে।আমরা নুতন করে শুনে নেব চর দখলের লড়াই আর হাতিক্যাম্পের গল্প।বিষ্ময় নিয়ে শুনতে থাকবো কিভাবে গান আর বাজনা আর নাচ দিয়ে বুনো হাতিদের পোষ মানানো হত কুমারসাহেবের জঙ্গলবাড়ির সেই ক্যাম্পে।
নাজিমুদ্দিন তখন গাবুর বয়সের চেংড়া।আব্বার সাথে রূপসীর জমিদারের লেঠেলবাহিনীর হুকাতামাকের দায়িত্ব তার উপর।পাশাপাশি মুন্সি চাচার কাছে লাঠি চালনার তালিম নিচ্ছে।আর ফাঁক পেলেই গঙ্গাধরের কাছারে কাছারে জল ভরতে আসা সুন্দরী কইন্যাদের সাথে রঙ্গরস করা আর খোসা নাচের মত গেয়েও ওঠা-
'আন্ধ্যারে ধান্দারে নাচবা নাকি দুলাভাই
দুলা তুই হ্যাচাকের বায়না দে'
এইসব দেখে জরিনা আবেদা হাসিনা ফুলেশ্বরীদের কি খলখল হেসে ওঠা।তারাও কখনো গানে গানে প্রতি উত্তর দিত-
'ফাতেরা রে ফাতেরা
বগরিবাড়ির ফাতেরা
এত্তি ক্যানে আসিলু"

কি অন্যরকম জীবন ছিল তখন।আলো ছিল।স্বপ্নের ভেতর খেলে বেড়াতো হলখল মরিচের খেত।আর সেই নদীপাড়ের জীবন থেকেই তো সে তার জীবনে টেনে এনেছিল জরিনাকে।
হায়রে জীবন!সে বারবার তাকে ডুবিয়েই মারলো এই ধানপাটকামলাকিষান আর ভরা সব হাট পাচালির ভিতর!