১
ঠাকুমার বুকের ভিতরে ঠাকুরদা একটা ফুলের বাগান করেছিল। সেখানে দুবেলা ঢুকে জল, মাটি, সার আর কীটনাশক দিয়ে মনের মতো কিছু ফুল ফুটিয়ে গেছে। সেসব ফুলেরা ঠাকুরদার ইচ্ছে মতন রঙে সেজেও নিত যখনতখন।
বাবা কিন্তু মায়ের বুকের ভিতরে ফুলের পাশাপাশি কিছু সবজি আর ভেষজ উদ্ভিদও বুনেছিল। বাবা সোজাসুজি নদী থেকে জল আনবার ব্যবস্থা করেছিল। পাখিদের সঙ্গে তার বোঝাপড়া ছিল, পরাগরেণু আদানপ্রদানের। তারপর অন্ধকার হলে পরাগমিলন... বাবার হাতের ফুল, ফল, সবজিরা রঙ পেত মায়ের ইচ্ছে মতো। সে তো আহ্লাদে আটখানা, রঙের টালবাহানা। সে তো ইচ্ছে আর অনিচ্ছে- দুয়েরই রঙ, এ বলে আমায় দ্যাখ। ও বলে আমায় দ্যাখ।
আমিও শুকপাখিকে প্রথম সাক্ষাতেই আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর বংশানুসরণের কথা জানিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর আমিও গিয়েছি, ফুল ফোটাতে। এমনকি চা বাগান, সবজি ও আরও সব কৃষিকাজ। পাহাড়ের গায়ে গায়ে বুনোফুল, জংলী বাহারি গাছ। বুকের ভিতরে পাহাড়েরা জড়ো হয়েছিল।
এইবার জলসেচ নেহাতই সহজ।
আমাদের দুঃখ জমে যে শিশির, আমাদের বিষণ্ণতা থেকে যে কুয়াশা, আমাদের অপ্রাপ্তি থেকে জন্ম নিয়েছে যে অখন্ড মেঘ, আমাদের ভালবাসা থেকে যে বৃষ্টি...
তাতেই তো নদী ও দীঘি, খাল বিল ঝরনা ও আরও সব জলাশয়।
আমাদের জলসেচে ব্যস্ত হৃদয়। সেখানেই জটিলতা আসে। যেকোনো সহজ ঠিক যতটা জটিল।
ফুলের রঙ নিয়ে অতঃপর আমাদের গবেষণা শুরু হয়। এ ফুলেরা ঠাকুরদার ইচ্ছে বা মায়ের খুশির মতো রঙ নির্বিবাদে অনায়াসে বেছে নেওয়ার মতো সরল আয়েশে ফুলেদের উত্তরসূরি হতেই পারে না।
এ ফলেরা, এসব উদ্ভিদ বা তাদের পাতারাও গোপন বৈঠকে ঠিক করে, কেমন হবে তাদের রূপ রঙ রস ও গন্ধ।
সে গোপন বৈঠকে পৃথিবীর অসুখের কথা ওঠে, নর ও নারীর যত রূপোলি অসুখ আর শূন্য শূন্য ফাঁকা ভিতরের গান...
এখন যেসব রঙ নিয়ে ওরা সব বাজারে বিক্রি হয়, সে নেহাতই অর্থ-রসায়ন, কৃত্রিম আয়োজন, হাইব্রিড-ক্রোম।
আমাদের পিতা ও পিতামহের সময়, মা ও ঠাকুমার সময়ে ভিতরে ও বাইরে একটাই রঙ হতো ফুলেদের।
এখন যতই ঝলমল করে উঠুক না বিজ্ঞাপিত মুখ, ভিতরে বিবর্ণ সাদাকালো বিরঞ্জিত সুখ...
আমি বা আমার শুকপাখি ভিতরে রোপণ করি রঙিন অসুখ। তাই বাইরে বেরিয়ে আসে পার্লার চর্চিত মালঞ্চ মুখ।
তাইতো হঠাৎ অনেকক্ষণ খোঁজ না পেলে, ডেকে উঠি-
কোথায় তুমি?
সে এক আশ্চর্য উদাসীনতায় উত্তর দেয়-
জাহান্নামে।
আমি তার বুকের ভিতরে পাগলের মতো ঢুকে পড়তে চেষ্টা করি।
আমাদের তো এমনই ঐতিহ্য ছিল, প্রেমিকা জাহান্নামে পৌঁছে গেলে সেখানেও পারিজাতে ভরে উঠবে পুরো তল্লাট।
আমরা তো আলোর ভিতরে মিলনের নহবৎ চাই...
তাইতো মালঞ্চ বাগানে ফুলেরা রঙিন কর্পোরেট রসায়ন মেনে, বুকের ভিতরে শুধু নিঃস্ব ভায়োলিন।
"ফুল ফুটুক না ফুটুক"| বসন্তের চাকরি নাই।
বিরঞ্জিত
উজান উপাধ্যায়
(ঋণ - সুভাষ মুখোপাধ্যায়)
২
কবিতা লিখতে লিখতে আমি ঝকঝকে চকমকে এলিট আলোয় ঠাসা শহরের সবচেয়ে নামকরা ফাইভ স্টার হোটেলের করিডোর থেকে লিফট চেপে একদম ভিতরে সটান পৌঁছে গেছি। এইখানে লবি থেকে একটু ঝুঁকেই, শহরগুলোকে খুব ছোট্টো দেখায়। ক্যান্ডল ডিনারের ওপেন এন্ড ওয়াইড টপ ফ্লোরে স্টারস এন্ড সেলেবরা রঙিন ঝলমলে গ্লাসে নেচে নেচে হাসে আর রসেবশে ভাসে। আকাশের তারারা বেশ জড়োসড়ো। এখানে নামার মত সাহস পায় না আর। বৃষ্টি কাচের গায়ে। ভিতরে আসে না। কবিতা লিখতে লিখতে আমি ক্রমাগত বদলেছি জামা। উদাসীন ব্যাগ, অগোছালো চুল, অবিচল ভুল দেখা বদলেছি রোজ। কাগজের খসখসে দাগ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে মসৃণ মনিটরে ওয়ার্ড বা ডক ফাইল আপলোড করে, ধেনো মদ ছেড়ে সরিয়েছি সস্তা চোলাই। বিড়ি আর ফ্লেক ছেড়ে এখন কিং সাইজ। সবচেয়ে দামী ব্যান্ড। কবিতারও তেমন ফ্লেভার। ক্যাপুচিনো কফি, সুইডিস কাপ। ইতালির পাথরে টিপটিপ হাঁটা। সাঁওতালি মেয়ে ছেড়ে হাই প্রোফাইল লেডি। মহুলবনীর নেশা ছেড়ে, মহুয়ার গান ছেড়ে সিম্ফনি- প্রিলিউড, মোৎসার্ট বিটোফেন। কবিতা এখন রোজ নাইট গাউন পরে একটু গভীর রাতে দখিনের জানালায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্যারিসের ছবিগুলো ভাবে। ওখানে ঘুরতে গিয়ে যেকটা ছবিই তোলা, সবকটা ব্রিলিয়ান্ট। সবকটা মাস্টারপিস। এ শহরে ফুটপাত নিরাপদ নয়। বেশিরাতে বাড়ি ফেরা মেয়েরা 'রাবিশ'। কবিতা লিখতে এসে এগুলো বুঝেছি। এখন পার্টি হোলে, অনুবাদ কবিতাই বেশি পাঠ করি। প্রতিটি কবিতা পড়ে তর্জমা করি। বুঝিয়ে বলতে হয়, কোনটা স্যুররিয়াল, কোনটা এবসার্ড। কবিতা লিখতে এসে স্পষ্ট বুঝেছি, প্যাচানো সিঁড়ির মতো মিস্ট্রির ভাঁজে মৌতাতে বুঁদ করে দিতে হবে ফ্যান্টাসি, ফিকশন। আর যত ডিকশন এবং সেনসর - লুকিয়ে রাখতে হবে চুরুটের ফাঁদে। দুঃখ বানাতে হবে, বিষাদ ঘনাতে হবে। নির্জন সংকেতে বিরহের বাঁশি, ডিজিটাল ফর্মাটে নিও-বানভাসি। কবিতা ঝাউপাতায় আর তত কমফোর্ট নয়। কবিতা মেঘলা দিনে টেকনো-গ্রাফিক্স দিয়ে এখন ঢেউ কেনে, ক্রেডিট কার্ডে আর অনলাইন পে তে। কতজন বুঝবে, কতটা ট্যালেন্ট লাগে এত পথ যেতে। এখন আমাকে ছাড়া ম্যাগাজিন ফ্লপ। এখন আমাকে ছাড়া বইমেলা ঢপ। কবিতা-নায়ক আমি। কবিতা-গায়ক। যেকোনো এঙ্গেল থেকে বর্ণমালাকে দেখো-যেকোনো দিকেই বেঁকে চোখ তুলে রেখো- আমি টপ। আমি টপ। পান্থনিবাসে নেই, ঘামে ভেজা ঘাসে নেই। ইন্টেরিয়র ডেকে ফ্রেঞ্চ ডিজাইনে আঁকা আমার মলাট। কবিতা লিখতে এসে এটুকু বুঝেছি-
জীবনানন্দকে ভালবাসলে তার কবিতাকে ভালবাসা যায় না। এবং ঠিক বিপরীতে জীবননান্দের কবিতাকে ভালবাসলে ওনাকে ভালবাসা যায় না।
দু দুটো মায়াবী চোখে ভেসে নিঃস্ব ভিখারি হবো। আমি কি পাগল নাকি।
রূপবতী নারী আর রূপবান পুরুষকে মুখোমুখি করে আমার তাদের যে কোনও একজনকেই ভালবাসতে পারি।
তা না হলে ওদের পারস্পরিক সঙ্গমে বাধা পড়ে যায়।
একজন পাঠকের কাছ থেকে এমনটা শুনে হাড়েহাড়ে বুঝে গেছি, কবিতার ষোলোআনা চাল।
চিনেগেছি
জীবন তো মহাকাশ মহাকালে বদলায়, মৃত্যু উলটোমুখে মহাকাশ বদলিয়ে গড়ে মহাকাল।
অতএব, রূপ ছেড়ে রূপো, হৃদ ছেড়ে দরদাম। বিক্রি করতে হবে কবিতার বাড়ি।
আমি পারি। আমি সব পারি। আমি এই পৃথিবীর জাস্ট এক নম্বর-
কবিতা ব্যাপারী।
পিং পং
উজান উপাধ্যায়
ঋণ - অনন্য রায়
( " In Life, the Space becomes Time. In Death, the Time becomes Space. " )
৩
এই পাথরের নিচে শস্য উড়ে যায়। এই পাথরের নিচে গ্রহণের দিব্যি করে ধান। এই রাত্রে পাত্র ভরে মেঘে।
এই দিনে এই সন্ধ্যায় এই মঞ্চে হৃদি ভাসমান
পূণ্য শ্লোকে নিঃস্ব অভিমান
চিৎকার করে ওঠে -
বলো।
এই জন্মে এই যে হিরন্ময় আলো...
তুমি ছাড়া তাকে কে ছড়ালো?
এই জন্ম অক্ষয় হোক। মৃত্যুর ভিতরের পথে তোমার অনিন্দিতা চোখে
পাথরেরা পাখি হয়ে গেলো।
এই জন্মঋণ, এই জন্মদিন
উজান উপাধ্যায়
৪
জলে ডোবা কাঠামোগুলোকে খুঁজি। এই দেহে জ্বলেছিল আলো। চকমক করে উঠেছিল সংহার ও অপার।
রঙ সব মিলিয়ে গেছে জলে। সমস্ত উজ্বল ধ্বনি গলে গেছে রাত্রির ভাঙা তলপেটে।
ঢাকী ফিরে গেছে। পুরোহিত ফিরিয়ে নিয়েছে সব পুঁথি, শাস্ত্র, যজ্ঞের অবশিষ্ট ছাই ও অদাহ্য যা কিছু জিনিস।
ফিরে গেছে আলোর ব্যাপারী।
এই ব্যাখ্যা আর কতদিন? এইসব ফিরে যাওয়া মৃত্যুর মতো কেন জ্বলে যায়, ভেসে যায়।
এই যে মাটির দেহ, খড় ও বিচুলি দিয়ে গড়ে তোলা নাক কান চোখ...
এই যে নশ্বর প্রতিমাকে মা বলে ডাকা... কেন তাকে চারদিন পর আর খুঁজেও দেখিনা। এই রিসাইকেল, এই যে পুনরুত্থান... এই তত্ত্বে ঢেকে যায় সসীমের জৈব আখ্যান। নিরাসক্ত ? উদাসীন? নাকি তাকে ভুলে থাকা নেহাতই অর্থনীতি! যদি গড়ো, তবে তাকে ছলনায় কেন? রূপ রঙ রস গন্ধ চলে যাক। তবুও সে কাঠামোতে আমার মাতৃঋণ।
বিসর্জনের পর
৫
সিনেমার ঘরে
সিনেমার ভিতরে পাহাড় দাঁড়িয়ে গেলে পপকর্ন ফিরে যায় ভুট্টা বাগানে। সেখানে যে মেয়েদের বিবাহযোগ্যা করে তুলেছিল ঝর্ণার জল, ধাপে ধাপে আগুন বেগুনি রঙে নেমে এল নদীর মতন।
সিনেমার ভিতরে স্বপ্নের বিছানা পেতে ঘুমিয়েছে আকাশলীনারা। বৈদ্যুতিক তারের মতো ছড়িয়েছে পাহাড়ি কন্যাদের চুল।
গাছেদের ভিতরে পাহাড়, মেয়েদের ভিতরে পাহাড়- সিনেমার ভিতরে কুয়াশা। রঙ মেখে নেচে যাচ্ছে হরিণী, ভ্রমর আর নীল শতদল।
জরুরি ঘোষণা নিয়ে আমি যাই অরণ্যের ফাঁকে। আমাকে তোমাকে নিয়ে উড়ে যায় ছায়াচ্ছন্ন ছাই। এইভাবে পাহাড়ের সাথে চুক্তি মাফিক আমাদের যৌথ বয়ানে বেজে মায়াবী হয়ে ওঠে নিষিদ্ধ রোশনাই।
সিনেমার ভিতরে নিয়ন্ত্রিত অন্ধকারে রঙিন ছেলেরা আগুনমেয়েরা হেঁটে আসে গলিতে গলিতে, বুনোগন্ধ দেশোয়ালি সাজ খুলে যায় জলীয় খোঁপায়-
এইখানে প্লেব্যাক সাউন্ড, আমরা দুজন একে অপরের বিষাদের স্বাদ নিই- উল্লাসে গেঁথে ফেলি কান্নার মালা- পর্দায় জমে যায় মেঘ। সিনেমার ঘরে জানালা রাখেনি কেউ, ঘুলঘুলি নেই- পায়রা ওড়েনা- মাঝেমধ্যে চোখ জ্বলে ওঠে শিশিরের গায়ে- সিলভার স্ক্রিনে নির্জন মেঘ।
মৃত্যু শাঁসালো- সিনেমার আলো এইভাবে পাহাড়ের কোলে তোমাকে আমাকে হ্যালুসিনেশনের ছলে কোমায় পাঠালো।
৬
যখন কবিতা লিখি, কেমন দেখতে লাগে আমাকে তখন? ঘুমন্ত প্রজাপতি? বৃষ্টিভেজা হরিণীর সলজ্জ দৃষ্টি যেমন? যখন কবিতা লিখি, কেমন দেখতে হয় আমার দু ঠোঁট? কৃষক- রমণী তার কোলে নিয়ে মাটির কলস, প্রথম ভোরের আলো মেখে জল ভেঙে নামছে নদীতে? যখন কবিতা লিখি, শাদামেঘ ডানা হয়ে আসে? চা দোকানী ঘুমচোখে রেডিও চালালে, প্রথম যে গান বাজে শহরের আলসেমি ভেঙে? যে করবী প্রতি ভোরে লাল, যে পাখিটি বাঁশির মতন গেয়ে ওঠে সুদূরের বাঁকে! যখন কবিতা লিখি, পারিজাত আলো ফুটে ওঠে? নাকি এক বিষাদের অভিজাত পোশাকেরা আলগোছে সরে, নাকি এক এসরাজে দুঃখেরা এলোচুল মেলে? যখন কবিতা লিখি, দগ্ধ তারার মতো নিঃস্বতা রঙিন ভাস্বর? বৃক্ষের কমনীয় শরীরেরা নারী হয়ে যায়? কেমন আমার গ্রীবা, যে ঘোড়াটা শেষ রাতে ফেলে আসে ঠিকানা-চিরকুট? যখন কবিতা লিখি, সর্ষের ক্ষেত জুড়ে নীলাম্বরী আঁচলের ঢেউ? মালঞ্চ সাঁকো জুড়ে গোলাপের অমেয় কথন? আমার আঙুল বুঝি পলাশের নিখোঁজ আদর? আমার চোখের নিচে আঁধারের মিহি-অনুরাগ? যখন কবিতা লিখি, আমি বুঝি অন্তসত্ত্বা মা? ভিতরে যখন নড়ে নবজাতকের দেহ, সহজ উৎসায়...যখন কবিতা লিখি, জাদুকর দেখায় আমাকে? লাল নীল হলুদের ভাষা জানা কোনও জলপরী? অথবা ঘাতক লাগে? একশো আট খুনে যার হাত? অথবা মেষ পালক, যে চিনেছে মেঘেদের চিঠি? নতুবা কি মনে হয়, পলাতক বিপ্লবী একা, চোরাগলি ধরে খোঁজে নিরাপদ ছায়ার প্রহরা? কেমন দেখতে লাগে, প্রতিটি পঙক্তির আমি পিতা? যার পিঞ্জরে আঁকা লালনের উদাসীন সাড়া? আমাকে কি মনে হয়, নর ও নারীর সংগমসাজে বেজে ওঠা ভিজে একতারা? আমাকে কি মনে হয় অনন্তে উড়ে যাওয়া মৃত্যুর জীবিত ইশারা?
প্রসবকালীন
৭
ব্যস্ত রাস্তায় বাঘ বেরুলে স্কুটার চোখে হরিদ্রাভ ফাঁদ পাতে। বাঘের তখন প্রেমের নরম শোক। গামছা কাঁধে একটা লোক ডোরাকাটা ঠোঁটে, জাপটে ধরলো ঘরফুরনো মেঘ। মেঘ কুড়নোর প্রাচীন শখে আদিম শিকার আয়েশ করে বসে। স্কুটার নামে নদীর দেহে। বাঘের এখন দারুণ জ্বর। বুকের ভিতর প্রেমের ঝড়। একটি মেয়েও এই পাড়াতে নেই। এসব ভেবেই ছয় ঋতু, আঁচল খুলে চুল মেলে। হরেক রঙের পাহাড় নাচ। একটি নোলক একটি পালক স্কুটার বালক আর বাঁশি। অন্ধ একটি বন্য ফুল। ওদের সঙ্গে মিল বিপুল। জানেই না সে আয়না কাকে বলে। এসব রোজই চলে। দুপুর অলস, বিজন রোদ। নানান ঋতুর ধারের শোধ। কোথাও কোনও পাওনা বাকি নেই। বাঘ বুঝেছে, প্রেমের মালিক সেই। যেই না বোঝা, হঠাৎ ছুট। এ গল্পটার সবটা ঝুট- শুধু একাই বাঘ ঘুমিয়ে ভাবে। স্কুটার কেন ভয় পেলনা তাকে? ঘুমের ভিতর বৃষ্টি ঝাঁকে ঝাঁকে।
বাঘ স্কুটারের 'ঝুটা' গল্প
৮
কাল রাতে এক মৃত সৈনিক এক কৃষকের বাড়িতে এসেছিল। তার মনে একটা খটকা থেকে গেছে। যুদ্ধের মাঠ আর কৃষকের জমির মধ্যে কে বেশি সূর্যের কাছাকাছি! আকাশের মাঝখানে সবুজ রঙের এক গর্ত দেখতে পেয়ে মৃত সৈনিক ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমের মধ্যে তার হাত কৃষকের উঠোনে একটি পিস্তল খুঁজে পেল।
কৃষকের কলকের ভিতরে জল বেড়ে যাওয়ায় বহুদিন তার আর নেশা হয়না।
এলবেট্রস পাখির জন্য সৈনিকটি গোটা জীবন ধরে রোদ জমিয়েছিল।
কৃষকটি আজ ভোরেই একটি জাহাজের পাল দেখতে পেল। ওর এক ঘোড়ারোগ। ওই সবুজ গর্তের গন্ধ নাকে এলেই ও সমুদ্রে পাড়ি দেয়।
কৃষকের রমণীটি বেলা বাড়তেই কোমর পর্যন্ত ভিজে চুল ফেলে মৃত সৈনিকটিকে স্নান করাতে এলো।
কিন্তু অবাক হল। সৈনিকটি জানালায় বসে বসে সূর্যের সাথে তাকে নিয়েই গল্প করছে।
আলো আর অন্ধকার চিরকাল কেন এত দূরে। ভালোবাসে বলে?
কৃষকটি তখন মাঝ সমুদ্রে। আশ্চর্য, সেখানে এতটুকু জল নেই। তার বাড়িতে ঢেউ আর ঢেউ।
রমণীকে বলে আসা হয়নি। তার কোমরের ভাঁজে সে অনেকদিন আগেই তার সমস্ত নেশা লুকিয়ে রেখেছে।
রমণী ঝলসে গেল। সূর্য তাকে খেল। মৃত সৈনিক বসে বসে দেখল।
যুদ্ধ ছাড়াই এত প্রেম এখানে। শুধু শুধুই সে প্রাণ দিয়েছিল।
ভালোবাসে বলেই কি সে কৃষকের থেকে এত দূরে?
দূরে দূরে আরও কত মৃতজন, ভালবাসার গর্ভে বিচ্ছেদের শর্ত পালন করে।
যুদ্ধ ছাড়াই
প্রযত্নে রবীন্দ্রনাথ, একেবারে প্রান্তিক গ্রাম... যেখানেই পিনকোড গেঁথে ভদ্রলোক পা রাখবেন, সেইখানে হুড়মুড় করে ছলকে ওঠে খঞ্জনা অঞ্জনা। কোপাই শ্রাবণী। ওইখানে গেছো? বিকেল গড়ালো? বাউলরা ভালো? আজ শুক্রবার। হাট বসেছে নিশ্চয়ই? পদ্মাপাড় তো নয় জানিই। খোয়াই, সোনাঝুরি। কী পরেছো? নিশ্চয়ই শান্তিনিকেতনী। তোমার হাতে একগুচ্ছ কাশফুল, কখনও দেখিনি। পলাশ পেয়েছো? কৃষ্ণচূড়া লাল? মালঞ্চ কখন যাবে? কাল? দেখা পেলে? লম্বা দোহারা সেই প্রেমিক লোকটার? কথা হলো? বৃষ্টি হচ্ছে বুঝি? তোমাদের চোখাচোখি মেঘের ভিতর? কেমন লেগেছে ওর? তোমাকে এত কাছে পেয়ে! গীতবিতানের মেয়ে। প্রযত্নে যার নাম। তাকে এত কাছে পেলে, বর্ষা তো আসবেই ধেয়ে।
গীতবিতানের মেয়ে-১
উজান উপাধ্যায়
১০
(১)
স্নানাগারে বন্দী করলাম। অবশিষ্ট আমাকে। বাইরে হালুম হুলুম আপাতত থমকে গেছে। বাইরের আলো আপাতত নিজেদের লুকিয়ে ফেলেছে। বন্দীশালার নিজস্ব শব্দের অভ্যাসে ফেনা মাখছে সারাদিনের আহত ফরমান।
(২)
হাসপাতালের চেহারা এখন বিসর্জনের পরের ঘাটের মতো। কাঠামো খানিকটা ডুবে খানিকটা ভেসে আছে জলে। চতুর্দিকে সিরিঞ্জ, মৃত পতঙ্গ, অচেনা লাশ। একেকটি দেবতার একেকটি ছিন্ন অঙ্গ একেকদিকে।
(৩)
এইসব দৃশ্যে আগ্রহ নেই কোনওদিন। এগুলো ছিল, আছে, থাকবে। নানারকম ঝলমলে পোশাক পরিয়ে খামখেয়ালীপনা আর উন্মত্ত ফড়িং নিয়ে চুটিয়ে নেশা করেছি আনন্দের। বেলুন, পটকা, হেভ্ভি দেখতে প্রেমিকা, চূড়ান্ত সঙ্গম, দারুচিনি বনানীর দ্বীপ, শঙ্খচিল, সাতনরী হার, জলপিয়ানো, রাতপরিদের তুমুল উচ্ছলতা...
(৪)
জন্ম মৃত্যু বিষণ্ণতা দুঃখ নিহত গাছ অবসাদগ্রস্ত পাখি আর লুন্ঠিত মায়ের আঁচল...
(৫)
নো ইয়ার....আমার পৃথিবীতে শুধু হাজার রঙের ফূর্তি...
(৬)
বন্দীশালায় বসে সর্বোচ্চ মুক্তির স্বাদ আসে...খুলে রাখা পৃথিবীর জিভে শুধু গিঁট গিঁট আর গিঁট।
ছিঁড়ে ফেলছি গিলে ফেলা হাইওয়ে আর উঁচু উঁচু পাহাড়গুলোকে।
(৭)
গত সাতশো বছর আমি পোশাক পরিনি। তবুও আমার উল্লাস দেখে কারও সাহস হয়নি আমাকে উলঙ্গ বলার।
(৮)
হাসপাতালের চেয়ে বড় কোনও দেবালয় আজও বানাতে পারেনি মানুষ।
(৯)
আমি ওখানে বসে আরও নয় হাজার বছর লালনের গান করব।
(১০)
আমার নাম রবীন্দ্রনাথ। আমি মোনালিসা। আমার নাম পিকাসো।
(১১)
হিম্মত আছে তো..
হাসো।
প্যারাডাইস@হাসপাতাল_দেবালয়.কম
উজান উপাধ্যায়