ফিরেআসা
-" একটু বসো, কিছু কথা আছে। অবশ্য জানিনা সব কথাগুলো ঠিক মতো গুছিয়ে বলা হবে কিনা,তবে কথাগুলো..." বাকিটা আর কাশির দমকে শেষ করতে পারল না। কাশির সাথে সাথে অনিরূদ্ধের রোগা শরীরের বুকের খাঁচাটাও যেন হাপরের মতো ওঠানামা করতে লাগল। ওর দিকে জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিতে দিতে বললাম, "কি এমন কথা যে তুমি যে সবাইকে চলে যেতে বললে? সুস্থ হয়ে একেবারে বাড়ি চলো, তারপর না হয় কথা হবে।"
-"না, কাছে এসো। বড় দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছো যে, তোমাকে তো ভালো করে দেখতেই পাচ্ছি না।"
পিপিই কিট ও মাস্কের মধ্যে চেহারাটা সত্যিই মালুম হয় না। চেনা মানুষজনকেও অচেনা লাগে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললাম,"আমি কাছে গেলেও চিনতে পারবে না।" মনে মনে ভাবলাম এত দিন যখন কাছে থেকে বুঝতে পারোনি তাহলে আজ কি করে চিনবে? আমার কথাগুলো বোধহয় অনিরুদ্ধর কান অবধি পৌঁছায়নি। নিজের মনেই বিড়বিড় করে চলেছি কত কথা... বিড়বিড় করে চলেছি নাকি স্মৃতি রোমন্থন করছি সেটাই বুঝতে পারলাম না।
যেদিন অনিরুদ্ধের কাছ থেকে চলে আসব ঠিক করলাম সেদিনই দেশের সরকার ঘোষণা করল করোনা নামক এক অজানা ভাইরাসের কথা। এই ভাইরাস বিদেশের মাটি থেকে চলে এসেছে এদেশে। এখন দরকার প্রচুর পরিমাণে সর্তকতা। মানুষ এখন নাকি মানুষের সঙ্গে মিশতে পারবেনা। মুখ ঢেকে রাখতে হবে মাস্ক দিয়ে। সব থেকে বড় কথা হল লকডাউন নামক এক অচেনা শব্দের সাথে পরিচিত হলো সারা পৃথিবীর মানুষ। বন্ধ হয়ে গেল যানবাহন, দোকান-বাজার, মল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত। স্তব্ধ হলো জনজীবন। হঠাৎ করে সমস্ত মানুষ হল ঘরবন্দি, সব রকম কোলাহল থেমে গিয়ে এক আশ্চর্য নীরবতা চারিদিকে। শুধু শোনা যায় প্রকৃতির কলতান, যেন মানুষকে বন্দি করতে পেরে প্রকৃতি আজ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে, স্বাধীনতা পেয়েছে।
এই অবস্থায় আমার কলকাতা যাওয়াটাও বাতিল হয়ে গেল। সুদূর মুম্বাই থেকে কোনোভাবেই যাওয়া সহজ হলো না। অথচ দীর্ঘ এক বছর ধরে অনিরুদ্ধের সাথে নানান মতান্তরে মধ্য দিয়ে যেতে যেতে মনে হয়েছিল যে এটাই আমার শেষ উপায়, নিজেকে ওর থেকে সরিয়ে নেওয়া। তাহলে হয়তো সব ঠিক হবে। সেই মতনই ঠিক হয়েছিল যে মার্চ মাসের শেষদিকে আমি ফিরে যাবো নিজের বাড়ি কলকাতায়। সবথেকে আশ্চর্য লেগেছিল আমার এই সিদ্ধান্তে অনিরুদ্ধের কোনো হেলদোল ছিল না। বিমূঢ়ের মত কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে চেয়ে ছিল। তারপর বলল, "তোমার যা ইচ্ছা তুমি করতে পারো। আমি তোমাকে কোন বাধা দেবো না।" হ্যাঁ,সেও মেনে নিয়েছিল আমার চলে যাওয়াটা। আমার বুকের মধ্যে একটা ইস্পাত রাঙা মেঘের মতো ভয়, নাকি উদ্বেগ না অস্থিরতা ছেয়ে গেছিল সেটা নিজেও জানিনা। তবে এটা বুঝেছিলাম আজ থেকে আমি একা, ভীষণই একা। নিজেকে গোছানোর জন্য কিছুটা সময় দরকার ছিল আমার।
*********
আমার কলকাতা যাওয়া বাতিল হয়ে যাওয়ার খবরে অনিরুদ্ধ খুশি হল না দুঃখিত হল সেটা বুঝতে পারলাম না। তবে দু'জনের মধ্যে সরু ফাটলটা যে আস্তে আস্তে চওড়া হচ্ছে তা অনুভব করলাম।
মাসখানেক পরের কথা। একদিন সন্ধ্যাবেলায় অনিরুদ্ধ কে দেখলাম গুটিসুটি মেরে খাটের কোনটাতে শুয়ে আছে। ওর এইভাবে শোওয়াটা অস্বাভাবিক লাগলো আমার। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে কপালে হাত দিতেই হাত সরিয়ে নিলাম। মনে হল যেন সারা মাথা থেকে আগুনের হল্কা বেরোচ্ছে। থার্মোমিটার দিয়ে চেক করে দেখলাম 103 এর উপর জ্বর। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে উনি বললেন তাড়াতাড়ি নার্সিংহোমে ভর্তি করে দিতে। প্রতিবেশী কয়েকজনের সহায়তায় নার্সিংহোমে ভর্তি করলাম। দু'দিন পর করোনা টেস্ট রিপোর্ট এলো পজেটিভ। মনে হয়েছিল পায়ের পাতা বরফে পুঁতে দিয়েছে কেউ। প্রচন্ড নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম। আজ চারদিন হল অনি ভর্তি আছে। এই চারদিনে প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে, রোজই এসেছি আমি দেখতে, কিন্তু আজকে হঠাৎ অনি এইভাবে কেন বলে উঠলো, "তৃষা তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।"
-"বলো, কি বলবে? আর এত তাড়াহুড়ো কিসের? তুমি বাড়ি চলো তারপর না হয় আমরা কথা বলবো।"
-"না তৃষা আজ বলে নিতে দাও। আমার কোথায় কত টাকাপয়সা আছে তোমার জানা দরকার। আমি ভালো বোধ করছি না। এক এক সময় মনে হচ্ছে শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে, এত কষ্ট হচ্ছে। ভয় হচ্ছে যদি বেঁচে ফিরতে না পারি তাহলে তোমার কি হবে?"
পিপিই কিট,মাস্ক ভেদ করে আমার শরীরের কাঁপন আর চোখের জল অনিরূদ্ধ কেন, কারোরই নজরে আসার কথা নয়। কিন্তু কথা বলতে গিয়ে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক গলায় আমি বললাম," কেন ফিরবে না তুমি? তুমি আমি দুজনেই একসাথে ফিরে যাব আমাদের ফ্ল্যাটে।" ঈশ্বর মানুষকে মনের ভাব প্রকাশ করার জন্য ভাষা দিয়েছেন। সেই ভাষা অনেক সময় মনের মধ্যে যে কথা তোলপাড় হচ্ছে তাকে পরিপাটিভাবে ঢেকে অন্য কথা উচ্চারণ করার শক্তিও দিয়েছেন। তাই হয়তো আজ সকালেই ডক্টর মিত্র আমাকে যে কথাটা বলেছেন সেটা সকাল থেকে ওকে বলে উঠতে পারিনি। ক্রমাগত অন্য কথাই বলে চলেছি।
এতক্ষণ অনেক দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এবার অনিরুদ্ধর একদম কাছে এগিয়ে গেলাম। পিপিই কিট সরিয়ে, মাক্স খুলে নিজেকে নিয়ে গেলাম অনিরুদ্ধর একদম কাছে। দুজনের শ্বাস, হৃদয়ের স্পন্দন যেন অনুভব করতে পারলাম বহুযুগ পর। অনিরুদ্ধর মুখটা দুই হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম," তুমি কি জানো অনি, পজেটিভে পজেটিভে নেগেটিভ হয়?" তাই তোমার আমার দুজনেরই আর কোন ভয় নেই। আমরা নিশ্চয়ই ফিরে যাব আমাদের ফ্ল্যাটে। নিজেদের জীবনটা আবার নতুন করে ফিরে পাবো।"
-"তার মানে?' অনিরুদ্ধের অবাক কণ্ঠস্বর।
-" তার মানে এটাই যে আজ সকালে রিপোর্টে জানতে পেরেছি আমিও কোভিড পজেটিভ। ডক্টর আমায় আজ ভর্তি হতে বললেন।"
অনিরুদ্ধ এবার জোরে হা হা করে হেসে উঠে বললো, "সত্যিই তোমার যুক্তির কাছে সবকিছু হার মানে।"
অনিরুদ্ধর এই প্রাণখোলা হাসির সাথে মনে হল সে নিজের মধ্যে অনেকটা অক্সিজেন নতুন করে গ্রহণ করলো যা তাকে এবং আমাকে আগামী দিনে লড়ার অনেকটা শক্তি জুগিয়ে গেল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন