মৃত্যু অথবা
পর্ব - ৬
“পোস্ট-মর্টেম হয়নি, কারণ পুলিশ নিজে থেকে তদন্ত শুরু করতে পারেনি। অনেক চাপ ছিল। এত প্রভাবশালী পরিবার... বাড়ির ডাক্তার পরিষ্কার লিখছেন ন্যাচরাল ডেথ... ইরাবতী সান্যালের ডায়ালেটেড কার্ডিওমায়োপ্যাথি ছিল। ওষুধপত্র খেতেন না, অনিয়ম করতেন। ফলে রেজিস্টার্ড ডাক্তারের দেওয়া হার্ট অ্যাটাকের সার্টিফিকেটে আমাদের আর কিছু করার ছিল না। তাছাড়া কিংশুক রায় একেবারেই চাননি তাঁর স্ত্রীর শরীর নিয়ে অহেতুক কাটাছেঁড়া হোক।”
স্থানীয় থানার ওসি রক্তিম বেশ চটপটে। দীপু আর রাণাকে অনেকটাই সময় দিলেন।
“ইরাবতী সান্যাল মারা যাবার সময় কে কোথায় ছিলেন?”
“আমরা যদ্দূর জানি, কিংশুক রায় তার দিনকয়েক আগে থেকেই ব্যাঙ্ককে ছিলেন। সকালে খবর পেয়ে ফেরেন। মেয়ে বিদেশে। সে আসার আগেই দাহ হয়। বাড়িতে থাকার মধ্যে কয়েকটি কাজের লোক। ইরাবতী দেবীর ভাই। যিনি সেই রাতে এই বাড়িতেই ছিলেন না। তাদের আর আমরা কিছু জিগ্যেস করিনি। তদন্তের প্রয়োজন হয়নি।”
থানায় বসে রাণার সঙ্গে কথা বলতে বলতে রক্তিম অফিশিয়ালি তদন্ত করা সম্ভব নয় বলেও যথাসাধ্য সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিলেন।
থানা থেকে বেরিয়ে খোলা হাওয়ায় দাঁড়ায় দুজনে। শহরে আকাশ কম, হাইরাইজ বেশি। নিয়নের আলোয় ভেসে যাওয়া কলকাতার ব্যস্ত রাজপথে একটা সিগারেটের ধোঁওয়া উড়িয়ে দেয় দীপু। রাণার দিকে তাকিয়ে বলে, “এবার?”
রাণা লাইটপোস্টে ঝুলতে থাকা একটা বিজ্ঞাপন দেখছিল মন দিয়ে। বলে, “কাল তো তোর অফিস। তার আগে চল আজকেই ডাক্তার দেখিয়ে আসি।”
“ডাক্তার? সে কি রে! কী হল?” দীপুর আঁতকে ওঠা প্রশ্নে একগাল হেসে রাণা বলে, “অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে তুই কেন যে এত কাঁচা মন্তব্য করিস... বিতান রায়চৌধুরীকে একটু মেপে আসি চল।”
বিতান রায়চৌধুরীকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া দেখানো যায় না। তার ওপর রবিবারের সন্ধে। চেম্বারে গোনাগুনতি দশজন। সকলেরই মাসখানেক আগে থেকে ডেট ঠিক করা রয়েছে। রাণা তার এতক্ষণের সাংবাদিক পরিচয়টাই ব্যবহার করল। রিসেপশনিস্ট বেশি ঘাঁটালেন না। দশজন রোগীর শেষে মিনিট দশেকের ছাড়পত্র মিলল ভেতর থেকে।
ঝাঁ-চকচকে চেম্বার। দক্ষিণ কলকাতার পশ অঞ্চলে পসার ভালো না হলে এইরকম চেম্বার মেনটেন করা চাট্টিখানি কথা নয়। ডাক্তারবাবুর সুনাম রয়েছে বলতে হবে।
যথাসময়ে ডাক এল। ডাক্তার বিতান রায়চৌধুরী সুপুরুষ। নির্মেদ ঝকঝকে চেহারা। স্বচ্ছন্দে সিনেমার নায়ক হতে পারতেন। বিতানের জিজ্ঞাসু চোখের উত্তরে রাণা হাতজোড় করে বলে, “ইরাবতী সান্যালকে নিয়ে একটা তথ্যচিত্র করছি আমরা। ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনা। আপনাকে ছাড়া সবটাই অসম্পূর্ণ... বুঝতেই পারছেন।”
ভুরু কুঁচকে যায় বিতানের। “আমি ওনার সঙ্গে খুব অ্যাটাচড ছিলাম না যদিও, আমার বাবা ওনাকে খুব স্নেহ করতেন। কী বলতে হবে বলুন। তবে, আজ সম্ভব নয়...”
“না না, আজ আমরা জাস্ট পারমিশন নিতে এলাম। আমরা বাড়িতে গিয়েই শ্যুট করতে চাইছি। মানে, যদি সম্ভব হয়, আমরা বিশ্বেশ্বরবাবুর সঙ্গেও... বুঝতেই পারছেন, আমাদের প্রোডিউসার বাংলাদেশের, তিনি খুব তাড়া দিচ্ছেন...”।
খুব অনিচ্ছা আর বিরক্তি ছড়িয়ে পড়ল বিতান রায়চৌধুরীর চোখেমুখে।
“ওনাকে নিয়ে ঠিক কী বলব জানি না। হার্টের সমস্যা ছিল। ওষুধপত্র হয়ত খেতেন না রেগুলার। এই বয়সে চলে যাওয়ার কথা নয়... এনি ওয়ে, লেখিকা হিসেবে নাম-টাম হয়েছিল। তবে আমি কিন্তু খুব বেশি সময় দিতে পারব না, আগেই বলছি। ওনার সঙ্গে আমার তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না।”
“কিন্তু আপনিই তো বরাবর ওঁদের পরিবারের ফিজিশিয়ান...”
“কিংশুকবাবু আমাকে বেশি পছন্দ করতেন। ওনার সঙ্গে যোগাযোগ বেশি আমার। আপনারা বরং পরশু আর্লি মর্নিং আমাদের বাড়িতে আসুন। আমি মিনিট দশেকের বেশি সময় দিতে পারব না। আর, আমার বাবা নার্ভের রোগী। ডিমেনশিয়ায় ভোগেন। দেখুন তাঁর কাছে আপনারা কী পান... আজকাল এই হয়েছে ঝামেলা। সাংবাদিকদের কোনও কথায় না বলা যায় না। কোথায় যে কোন কথা লিখে ফাঁসিয়ে দেবেন...।”
বলতে বলতেই দাঁড়িয়ে পড়েন বিতান রায়চৌধুরী। প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতে বোঝাই যায়, তিনি আর কথা বাড়াতে চাইছেন না।
রাণা উঠে দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করে, “ডেথ সার্টিফিকেটে আপনার সই, এদিকে কিরণমালাও বারবার আপনার কথাই বললেন... তাই আপনার কাছে আসা।”
কিরণমালার নাম শুনে বিতানের চোখে একটা আলো জ্বলে উঠে এক পলকে নিভে যায়, আর সেটা দৃষ্টি এড়ায় না রাণার।
“অনেক ভোরে কিংশুকবাবুর বাড়ি থেকে ফোন আসে। আমি গিয়ে আর কিছু করার সুযোগ পাইনি। মালাকে খবরটা আমিই দিয়েছিলাম... ও প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি। তারপর... মালা কলকাতায় এসেছে শুনলাম। কথা হয়নি...”
বিতানের নরম কথার মধ্যে দিয়ে ঢুকে পড়ে রাণার মোক্ষম অস্ত্র, “পরশুর শ্যুটিঙে কিরণমালা থাকলে আপত্তি আছে আপনার?”
“অ্যাঁ...” কেমন স্তম্ভিত হতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেন বিতান, “ও যদি সময় পায়, নিশ্চয়ই আসবে... তবে আমি তো সকালে বেশিক্ষণ... বুঝতেই পারছেন চেম্বার আছে...।”
“ওকে ডক্টর। তাহলে পরশু সকালে। আমরা আসছি। তিনজন। ভয় নেই। একদম বেশি সময় নেব না আপনাদের।”
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরিয়ে হাঁটাপথে বেশ খানিকটা গেলে সামনে অটোস্ট্যাণ্ড। গম্ভীর হয়ে হাঁটছিল দুজনে। এত রাতে অটো প্রায় নেই বললেই চলে। দুপুর থেকে দুজনের কম ধকল যায়নি। দাঁড়াতে ইচ্ছে করছিল না। ফোন করে একটা ক্যাব বুক করে দীপু। শরীর ছেড়ে দিয়েছে। মাথার ভেতরটা একদম ফাঁকা।
ঘরে ফিরে খেতে বসে কথা বলতে শুরু করল রাণা।
“কিংশুক রায় নিজের ব্যবসার কাজে অত্যন্ত ব্যস্ত। ইরাবতী সান্যালের সাহিত্যজীবন বা ব্যক্তিজীবন নিয়ে তাঁর তেমন কিছু মাথাব্যথা ছিল না। দুজনে দুটি আলাদা বৃত্তের মধ্যে বাস করতেন। ইরাবতীকে খুন করে কিংশুক রায়ের কিছু পাওয়ার নেই। বাড়ি বা কোম্পানির শেয়ার বাই ডিফল্ট ওনার আর কিরণমালার মধ্যে ভাগ হবে। ইরাবতীর ভাই অনমিত্র দিব্যি আছেন খেয়ে-পরে। দিদি না থাকাতে তাঁর কোনও অসুবিধে হচ্ছে না, দিদি থাকাকালীনও তাঁর কোনও অসুবিধে হত বলে মনে হয় না। ডাক্তারকে সন্দেহ করারও সেই অর্থে কোনও জোরদার কারণ নেই। এখন রইল বাকি ওই মালতী। ইরাবতী মারা যাওয়ার পরেই সে কাজ ছেড়ে দেশে চলে গেল কেন, এটা জানা জরুরি.....”
দীপু বলে, “কাল মালতীকে খুঁজতে যাচ্ছিস?”
রাণা অন্যমনস্ক হয়ে বলে, “ডায়মণ্ডহারবার বিশাল জায়গা। শহরে এতকাল আরামের জীবন কাটিয়ে একদিনের মধ্যে কেউ গ্রামে ফিরে যায় না। অপরাধ করে থাকলে তো আরও যাবে না। আমার ধারণা, মালতী এই শহরেই আছে কোথাও। দেখি, পুলিশের সাহায্যে কতটা কি করা যায়...। অনমিত্রও কিছু চেপে যাচ্ছে। এই কোম্পানির পুরনো স্টাফদের সঙ্গে কথা বলা দরকার...। আর বাকি রইল ঐ ডেস্কটা। ওটা খুলতে পারলে...”
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন