মৃত্যু অথবা ( সপ্তম পর্ব)
ল্যান্সডাউনের বাড়িটি বাইরে থেকে এখনও সেই পুরনো ঐতিহ্য আঁকড়ে রয়েছে। ভিতরে ঢুকলে আধুনিকতা চোখে পড়ে। তবে, সে ভারি মানানসই। এখনও লাল সিমেন্টের মেঝে, ঝুলবারান্দার জাফরি-কাটা রেলিং আর খড়খড়ি দেওয়া জানলায় খসখসের পর্দা দেখে অবাক হল রাণা। গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে পকেটে রেকর্ডার নিয়ে অল-ইন-ওয়ান হয়ে রাণা ঢুকে পড়ল ডাক্তার রায়চৌধুরীর বাড়িতে।
সকাল সাড়ে আটটা। আগে বিতান কথা বলবেন। তারপর তাঁর বাবার কাছে যাওয়া হবে। তিনি শারীরিকভাবে কেমন অবস্থায় আছেন, সেই বুঝে রেকর্ডিং। রাণা ঘড়ি দেখল একবার।
কিরণমালা আসতে চায়নি প্রথমে। কিন্তু দীপুর অনুপস্থিতিতে একটু সমস্যা হবে জানিয়েছিল রাণা।
“তুমি প্রোফেশনাল প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর, তোমার কোনও ফুলটাইম অ্যাসিস্ট্যান্ট নেই? আমি ওখানে গিয়ে কী করব?” কিরণমালার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু রাণা কথার মোড় ঘুরিয়ে দিল।
“আমি আপনাকে চাইছি অন্য কারণে। আপনি আপনার মায়ের মৃত্যু নিয়ে সন্দেহ করছেন, আর যিনি ডেথ সার্টিফিকেট দিলেন, তাঁর মুখোমুখি একবার দাঁড়াবেন না? যদিও বিতানবাবু ইরাবতী সান্যালের তেমন ক্লোজ ছিলেন না বলেই দাবি করছিলেন, কিন্তু... আচ্ছা, আপনার মায়ের মৃত্যুসংবাদ আপনাকে কে প্রথম জানান?” রাণার কথায় ফোনের ওপ্রান্তে কিছুক্ষণ নীরবতা। কিরণমালা নিজেই নীরবতা ভেঙে বলে, “বিতানদার ফোনে জানতে পারি। আচ্ছা বেশ, আমি আসব।” তারপর চট করে ফোন কেটে দেয়।
বিতান রায়চৌধুরী ঝকঝকে ফিটফাট চেহারায় নেমে আসেন ড্রয়িং রুমে। হালকা পারফিউমের গন্ধ ছড়িয়ে যায় ঘরে।
“আপনি একা?” প্রশ্ন করেই বিতান সামলে নেন নিজেকে।
“হ্যাঁ, মানে, শুধু তো কিছু প্রশ্ন উত্তর, ক্যামেরা অন করে কথা বলব, বেশিক্ষণ লাগবে না।”
বিতান বলেন, “বেশ বলুন।”
রাণা ঘড়ি দেখে একবার। কিরণমালা আসেনি এখনও। কিন্তু আর সময় নষ্ট করা যাবে না।
একেবারেই নীরস রুটিন কথা হল কিছু। একজন সাহিত্যিকের জীবন প্রসঙ্গে তথ্যচিত্রে সেসব কথা থাকার কোনও মানেই হয় না। ইরাবতী সান্যাল অত্যন্ত গম্ভীর, চুপচাপ প্রকৃতির মানুষ। বরাবর নিজের জগতে থাকতেন। একটা দীর্ঘ সময় অবধি তিনি ডাক্তার বিশ্বেশ্বর রায়চৌধুরীর কাছে নিয়মিত আসা-যাওয়া করতেন। বিতান শুনেছেন, ইরাবতী এই বাড়িতে বিয়ের আগেও আসতেন। ইরাবতীর সঙ্গে বিশ্বেশ্বরের পরিবারের যথেষ্ট অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। দুজনের মধ্যে বইপত্রের আদান-প্রদান হত। ইরাবতীর দাদু কবিরাজি করতেন বলে বিশ্বেশ্বর ঠাট্টা করে তাঁর নাম দিয়েছিলেন ‘কবিরাজি’। লেখার জগতে ব্যস্ত হবার পর ইরাবতীর যাতায়াত কমে যায়। গত বছর দেড়-দুয়েক তো একেবারেই যোগাযোগ ছিল না। বিতান বরং অনেকবার বললেন কিংশুক রায়ের কথা। কিংশুক রায়ের সঙ্গে পার্টনারশিপে তাঁর একটি নতুন নার্সিংহোমের কাজের কথাও বললেন। সেই কাজ নিয়ে অনেক বেশি উত্তেজিত তিনি।
রাণা হঠাৎ জিগ্যেস করে, “আচ্ছা বিশ্বেশ্ববাবু কোন সময়ে বহরমপুরে ছিলেন?”
বিতান হাঁ করে তাকায়। “বহরমপুর? বাবা কলকাতার বাইরে তো অন্য কোথাও প্র্যাকটিস করতেন না! কেন বলুন তো?”
“না এমনিই।” রাণা আর বাড়তি প্রশ্ন করল না কিছু। কিরণমালা কথা দিয়েও সময়মতো না আসায় মেজাজ খিঁচড়ে আছে।
যথাসম্ভব হাসিমুখে পুরোটা শেষ করে বলল, “আপনার বাবার কাছে একবার যেতেই হবে। কথা না-ই বা বললেন... একটা রিসেন্ট ছবি অন্ততঃ...”
“নো প্রবলেম অ্যাট অল। আমি বাবার অ্যাটেনডেন্টকে বলে দিচ্ছি। আপনি ফরচুনেট এনাফ, বাবা আজ একটু ফিট। দেখুন, যদি কথা বলাতে পারেন। বাবা তো ওনাকে খুবই পছন্দ করতেন... তবে মৃত্যুসংবাদ দেওয়া হয়নি। দিয়ে কী লাভ? মনখারাপ করবেন, হয়ত সবটা বুঝতেও পারবেন না...” বিতানের কথা শেষ হতে না হতেই হুড়মুড় করে ঘরে ঢোকে কিরণমালা।
“এক্সট্রিমলি স্যরি...”, কিরণমালার কথায় রাণা কিছু বলার আগেই বিতান একটু বেশিই ব্যস্ত হয়ে পড়ে যেন।
“কেমন আছ মালা? স্যরি, আমার তাড়া আছে একটু। এক কাজ করা যাক, মালা, তুমি যখন এসেই পড়েছ প্লিজ তুমিই ওঁকে গাইড করে নিয়ে যাও বাবার কাছে... কার্তিকদা, মীনুদি সবাইকে বলা আছে। আই হোপ, তোমার আমাদের বাড়ির ভেতরের ঘরগুলো সব মনে আছে...।”
বিতানের দিকে তাকিয়ে কিরণমালা বলে, “ইটস ওকে, উই ক্যান ম্যানেজ... রাণা আমার একটু দেরি হয়ে গেল। তোমার কাজ হয়েছে তো?”
রাণা হাসে।
বিতান একটু তাড়াহুড়ো করে, “আমি তাহলে... মালা, বাবা তোমাকে চিনতে পারবেন কিনা আই ডাউট... দেখো গিয়ে। বহুকাল পরে এলে... আচ্ছা বাই। সী ইউ”, বলতে বলতেই যেন একটু দ্রুতই বেরিয়ে যায়।
কিরণমালা রাণার দিকে তাকিয়ে বলে, “এই বাড়িটা কাজের লোকেদের কন্ট্রোলে। জেঠিমা মারা যাওয়ার পর থেকেই... কার্তিকদা, মিনুদি সকলেই আমাকে ছোটবেলা থেকেই চেনে। চলো, আমরা দোতলায় যাই। জেঠুর ঘরে।”
বিশ্বেশ্বর রায়চৌধুরী জানলার দিকে তাকিয়ে বসে রইলেন। সব কথার উত্তর দিলেন না। কথাগুলো ওঁর কাছে পৌঁছচ্ছিল না। আনমনা দৃষ্টি। ইরাবতীর নাম শুনে চিনতে পারলেন না।
রাণা বলল, “কবিরাজিকে মনে পড়ে আপনার?”
বিশ্বেশ্বর বললেন, “কবিরাজি কী কবিতা লিখত? লিখত না তো!”
কিরণমালা ঘরে ঢুকে গিয়ে চুপ করে বসেছিল ওনার পায়ের কাছে, মাটিতে। বিশ্বেশ্বর তার দিকেও দু-একবারের বেশি তাকালেন বলে মনে হল না।
কিরণমালা একবার অস্ফুটে বলল, “জেঠু মায়ের কথা মনে আছে তোমার?”
বিশ্বেশ্বর খিল খিল করে হেসে উঠলেন, “প্রসব করলে হয় না মাতা, মা হওয়া কি মুখের কথা?”
রাণা ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখল। দু’চারটে অ্যাঙ্গেল থেকে স্টিল ছবি নিল। হঠাৎ কাচের আলমারিতে একটা ছবির দিকে চোখ পড়ে ওর। বিশ্বেশ্বর, দুজন মহিলা, তাদের একজন ইরাবতী। আরেকজন সুপুরুষ ভদ্রলোক রয়েছেন ছবিতে।
“এই ছবিটাতে...।” কিরণমালা তাকিয়ে বলে, “ওটাতে মা জেঠু আর জেঠিমা। সঙ্গে আমার দাদু। কল্যাণ রায়।”
“এই জায়গাটা তো কলকাতা বলে মনে হচ্ছে না। পিছনে কেমন একটা রাজপ্রাসাদ...”
“ওটা বহরমপুরে তোলা। মা সেখানে চাকরি করতেন। জেঠুর বিয়ের পর বেড়াতে গিয়েছিলেন। ওরা চারজন খুব ক্লোজ ছিলেন।”
রাণা ছবিটার একটা ছবি তুলে নেয়। “এই বাড়ির পারিবারিক অ্যালবাম কোথায় থাকে জানেন? একবার দেখলে ভালো হয়।”
কিরণমালা মাথা নাড়ল। “আমি জানি না। মিনুদিকে বললে হয়ত এনে দেবে। দেখছি দাঁড়াও।”
ঘর থেকে বেরোনোর মুখে বিশ্বেশ্বর বলে উঠলেন, “আচ্ছা বউমা, কল্যাণী কোথায়? কল্যাণী আসেনি? তোমরা কাকে নিয়ে এলে? কল্যাণীর শরীরটা খারাপ। এই সময় সাবধানে রেখো।”
রাণা তাকিয়ে দেখে কিরণমালার চোখ ছলছল করছে।
বিশ্বেশ্বর আবার যেন অন্য রাজ্যে চলে গেছেন।
দুজনে বেরিয়ে আসে বড় রাস্তায়।
“কল্যাণী কে?”
“আমি জানি না। জেঠু যে কখন কোন কথা বলেন...।”
রাতে খাবার সময়ে দীপু অস্থির হয়ে উঠছিল। গত দু’দিন ধরে রাণার সঙ্গে সেভাবে কথা হয়নি তার।
“কিছু বলবি?”
রাণার প্রশ্নে রেগে যেতে গিয়েও হেসে ফেলে দীপু। “নাঃ, কী আর বলব! খুনি ধরতে পারলি কিনা তা’ই জানতে চাইছি...”
“সারাদিন প্রচুর খাটাখাটনি যাচ্ছে ভাই। শান্তিতে খেতে দে প্লিজ।”
খাওয়াদাওয়া শেষ করে জমিয়ে বসে দুজনে।
“আজ কোথায় কোথায় গেলি শুনি...”
“প্রথমে গেলাম অনমিত্রর পৈতৃক বাড়িতে। যে বাড়ির মালিকানা ঠাকুরদা থেকে ইরাবতী হয়ে এখন কিরণমালার। তবে তা’ নিয়ে অনমিত্রর সাদাসিধে বউয়ের বিশেষ মাথাব্যথা আছে বলে মনে হল না। সে একটু বোকাসোকা। গরিবের মেয়ে। ছেলেমেয়ে নিয়ে মোটামুটি খেয়েপরে থাকতে পারলেই খুশি। মালতীকে আমার খুব দরকার। আর দরকার বহরমপুরে পোস্টেড ছিল এমন এই কোম্পানির পুরনো স্টাফ কাউকে। কোম্পানির পুরনো স্টাফদের খুঁজে বের করা বেশ কঠিন। ইরাবতীর সময়কার স্টাফেরা কে কোথায় আছেন...। আর একটা অস্বস্তি ওই জীবনী নিয়ে, যেটা কিরণমালার মতে মারাত্মক বিতর্কিত। কী সেই বিতর্ক?”
“কিংশুক রায়ের সঙ্গে কথা হল?”
“সেভাবে নয়। পিএ জানাল, উনি ব্যস্ত। সাংবাদিক শুনে স্মরণসভায় আসার জন্য নেমন্তন্ন করল। ইরাবতী সান্যালকে নিয়ে কিংশুক রায় সেদিনই যা বলার বলবেন। অতএব...”
“ডাক্তারের বাড়ি গিয়ে কী বুঝলি?”
“বুঝলাম, ডাক্তার জীবনে উন্নতি করতে চায়, তার নিজস্ব নার্সিংহোমের জন্য সে কিংশুক রায়ের মতো একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর সাহায্য নিচ্ছে। পারিবারিক পরিচিতিটাও খুব বড় ফ্যাকটর। শুধু কিরণমালার সঙ্গে বিতান রায়চৌধুরীর বিয়েটা কেন হল না, এটাই প্রশ্ন।”
“সে কি রে! বিয়ে হওয়ার কথা ছিল নাকি?”
“ডাক্তারের বাড়ির কাজের লোকেরা তো সেইরকমই আভাস দিল। বহু পুরনো লোক তারা। ইরাবতীকে বিয়ের আগে থেকে চেনে। কিরণমালাকে ছেলেবেলা থেকে বাড়িতে আসতে দেখেছে। বিশ্বেশ্বর কিরণমালাকে ‘বউমা’ বলেই ডাকতেন। বিতানেরও দুর্বলতা ছিল না, এমন বলা যায় না। কৃতী সুপুরুষ ডাক্তার। এখনও বিয়ে-থা করেনি। অবশ্য দেবারও কেউ নেই। বাবা-ছেলের সংসার চলে কাজের লোকেদের ভরসায়। বিতান একেবারে বিরহী দেবদাস সেজে বিয়ে করেনি, এমন ভাবার কারণ নেই, কিন্তু তার উৎসাহ ছিল ভরপুর ষোলোআনা। তাহলে কিংশুক রায়ের জামাই হিসেবে সে বাই ডিফল্ট কিছু সুযোগ-সুবিধে পেতেই পারত।”
“তাহলে বিয়েতে বাগড়া দিল কে?”
“বলা মুশকিল।”
রাণা সিগারেটের ধোঁয়ার প্যাঁচ দেখতে দেখতে গম্ভীর হয়ে যায়। দীপু অবাক হয়ে জিগ্যেস করে, “এই বিয়েটা হলে তো ইরাবতীরও সুবিধেই হত। মেয়ে ঘরের কাছেই থাকত।”
“গত দুদিন ঘোরাঘুরি করে যা বুঝলাম ইরাবতী তাঁর পালিতা কন্যাটিকে ওভার প্রোটেক্ট করতেন। একটু বেশিই আগলে রাখতেন।”
কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোন বেজে ওঠে। রাণা ফোনটা ধরেই লাফিয়ে ওঠে এক মুহূর্তে।
“পাওয়া গেছে? ভেরি গুড। এক্ষুনি গিয়ে কথা বলা যাবে?”
ফোন রেখে রাণা তাকায় দীপুর দিকে।
“মালতী কলকাতাতে আছে। পুলিশ খোঁজ পেয়েছে। চ’ শিগগিরই।”
(ক্রমশঃ)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন