পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৭

সম্পাদকীয় , ৮ম সংখ্যা



আসছে আগামী ৷ চলছে হাজার ক্ষত ।চারিদিকে শুধু ভিড় আর ভিড়৷ আসন্ন শীত ৷ খেজুরের রস আর পশম নিয়ে তৈরী থাকে আমাদের শীতকাল I থেমে যাচ্ছে না৷ থামছে না হারিয়ে যাচ্ছে এই ঋতু ৷ হারিয়ে যাওয়াটাই যেন নিয়ম ৷ না "সৃজন " হারাবে না ৷ "সৃজন " জেগে উঠবে নতুন নতুন প্রাণ নিয়ে ৷দেখতে দেখতে অষ্টম সংখ্যার প্রকাশ হল ৷ সামনেই বইমেলা , লিটিল ম্যাগাজিন মেলা ৷ "আমার সৃজন " থাকবে এবার বইমেলাতে । আপনাদের ভালোবাসার হাত ধরে" আমার সৃজন " এগিয়ে চলছে ৷ ভালো মন্দোয় কাটল ১ টা বছর ৷ আর মাত্র ১ মাস পর " সৃজন " জন্মদিন ৷ হ্যাঁ ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ "সৃজন " এসেছিল সাহিত্যের আঙিনায় ৷ সেই জন্মদিনে সামিল আপনিও ৷



"সৃজন " পেয়েছে অনেক নবীন , প্রবীণ লেখকদের গত ১ বছরে । চারিদিকে এত প্রতিবন্ধকতা , লিটিল ম্যাগাজিনের কণ্ঠরোধ , বাণিজ্যিক পত্রিকার রমরমা ৷তারিমধ্যে হেঁটে যেতে যে পারছে " সৃজন " তা আপনাদের সহযোগিতায় ৷ "আমার সৃজন " আত্মপ্রকাশ সংখ্যায় যেমন পেয়েছি অনেক মানুষের সান্নিধ্য তেমন পেয়েছি বেশ কিছু মানুষের অচেনা মুখ ৷ বিজ্ঞাপন ছাড়া একটি পত্রিকাকে দাঁড় করাতে গেলে কত যে কঠরতার সম্মুখীন হতে হয় তা "আমার সৃজন" বুঝতে পেরেছে ৷ তবুও আশাবাদী হতে দোষ কি ৷" আমার সৃজন " দ্বিতীয় সংখ্যা আসছে শীঘ্রই ৷ 



যেমন ভাবে আপনারা "সৃজন " এগিয়ে নিয়ে চলেছেন তাতে তৃপ্তির জায়গা নেই বিশেষ ৷ নতুন বছরে "সৃজন " অাসছে নতুন মোড়কে ৷ অপেক্ষায় থাকুন ৷ সৃজনে থাকুন I

পারমিতা চক্রবর্ত্তী
"আমার সৃজন"

ছবি কৃতজ্ঞতা স্বীকার: Cesar Legaspi

মনোনীতা চক্রবর্তী


ডাক

এক ক্লান্ত মুহুর্তে এসে বললাম 'আমায় নাও'
সেই মানুষটাকে যে সবটুকু দিয়ে আমার সবটুকু সুখ শান্তি বাঁচাতে পুড়েছে ও পুড়ছে ধূপের মত!
কত মানুষের চোখে তুলে দিলাম আঁচল
কত কত মানুষের জন্য চানঘরে চোখ ভাসালাম

কিন্তু যে আমার একটু হাসি মুখ দেখবে বলে কত অন্ধকার রাত বিছানায় চোখভাসালো
তাকেই শুধু দেখা হলনা!

স্নায়ুর ক্ষত সারাতে যে মানুষটা 

হাসিমুখে তুলে দিতে পেরেছিল সবটুকু
শুধু তাকে দেখা হয়নি!

চরম পূর্ণিমা গুলো যে অমাবস্যায় কাটিয়েছে
দেখার সময়টুকুও,
চোখ রেখেছি আমারই ছায়ায়!

অথচ ছায়া কী শিলেপ মিলিয়ে গেল 

আর সেই মানুষটা?
যাকে দেখার ফুরসৎ ও তাগিদ কখোনই ছিলনা সেই থেকে গেল ছায়া হয়ে...

আমার ছয় বন্ধুকে যে আমারই মত 

প্রশ্রয় করে গ্যাছে, 

তার ছয় বন্ধুকে নির্বাসন দিয়ে..

আজ যখন আমার চিতায় 

আমি সামগান গাইছিলাম, 

ঠিক তখনই সব ছায়াছবির মত ভেসে উঠছিল

ছবিটাও আজ ছায়া হয়েই থেকে গেছে!
অথচ, বিজ্ঞানের নিয়ম তোয়াক্কা না করেই আমার পেছনেইথেকে গেছে আমার ছায়া!
আমায় প্রতিবারের মত জোরকরে জিতিয়েদিয়ে
আমি এখন অনেক অনেক ওপরে
সব্বাইকে ছাপিয়ে..

একদম স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি 

ওই মানুষটাকে...
আমি চিৎকার করে চোখ ভাসিয়ে বলছি "আমায় নাও".."আমায় নাও"

শব্দটা কোথায় হারিয়ে গেল
মানুষটা আর শুনতেই পেল না!

মনোনীতা চক্রবর্তী

গল্পের মতো অথবা...


" নিশি না পোহাতে কার ডাকে ঘুম ভেঙে যায়...! "
এই 'ডাক' শুধু রেখে যায় 'দাগ'
দাগের গল্পে মনে পড়ে যায় কুহকিনী কথা
মনে পড়ে যায় বিরহ টপকে টপকে
ভেজা আলো কড়াইয়ে ভেজে নেওয়ার কথা..
"তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙ ঝিলমিল.. "! আসলে আলোর গল্পে জোনাই অনিবার্য! অনিবার্য আশ্বাসের জলকথা! কথার পর কথা সাজানো বাড়িঘর, আসলে মেঘলা দিন যেন! যেখানে আয়োজন যেন জীবনের! আয়োজন এক পা -দু'পা -তিন পা'র, পার ভাঙার কৌশল! সন্ধানে সন্ধানী চোখের ভেতর শাল-মহুয়ার যাপন...অনন্ত জোছনা হয়ে থাকার চিরচাওয়া গান! অদ্ভুত এক মেলোডি... আমার চিবুকে জোছনাগান! সম্মোহনের নেশা কাটা শুদ্ধতা! অপার বিস্ময়ে জেগে থাকি! ছুঁয়ে দেখি, ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি চিবুক... ঠোঁট... গলার ভাঁজ.. বুক! কী আশ্চর্য, আমাদের সকলের বয়স বাড়ছে! দিনের বয়স-রাতের বয়স, বাড়ছে হু হু করে..... অথচ বাড়ছেনা শুধু জোছনার বয়স! জলের বয়স! দিলমায়ায় ভরপুর জোছনাগান ক্লান্তিহীন বেজে চলে! ম্যাপলপাতার অরণ্যে আমি গান্ধারী, হেঁটে চলি জলের গল্প শুনবো বলে...হেঁটে চলি গা এলিয়ে গুনগুন করা পাতাদের ছোঁবো বলে! এভাবে চলতে চলতে, চলতে আমি ঠিক ছুঁয়ে ফেলবো তোমাকে! তুমি আমার চোখের বাঁধন খুলে দেবে.... আমার স্পর্শগুলো 'দেখা' হবে! আপোষগুলো 'স্পর্ধা ' হবে! আলোগুলো আমার আয়না হবে.. গাছেদের পাড়াই হবে আমার শব্দস্বপ্নের ঘরবাড়ি...আমার অন্তহীন চলাচল... চারুকলার বিস্তৃত স্বভূমি...! আর কোনোই গোপন নয়,সবুজের মেখলা- জোছনার গয়না পরে গলা ছেড়ে গেয়ে উঠবো 

"....কত ভালোবাসি!"

ছবি কৃতজ্ঞতা স্বীকার: Cesar Legaspi

যুগান্তর মিত্র


রামদীন কাকা 

সেলসের চাকরি করি। ফলে মাঝে মাঝেই এরিয়া বদলে যায়। আমি যেমন সদ্য বদলি হয়ে এলাম ঝাড়খণ্ডের ছাতরায়। বর্ধমানে পোস্টিং থাকাকালীন আমাদের কোম্পানির বিস্কুটের বিক্রি বাড়াতে পেরেছি প্রত্যন্ত গ্রামেও। ইনসেন্টিভও জুটেছে অনেক। কোম্পানি এবার বেশকিছু মাইনে বাড়িয়ে দিয়ে ছাতরায় পাঠিয়েছে আমাকে। এখানকার গাঁওতে আমাদের কোম্পানির নতুন এজেন্সি দেওয়া, ভালো ব্যবসা এইসব সাতপাঁচ দায়িত্ব বর্তেছে আমার উপর। এককথায় ‘সুইট অ্যান্ড টেস্টি বিস্কুট’ কোম্পানির বিস্কুট ছড়িয়ে দিতে হবে গ্রামেগঞ্জেও। 
হিন্দিটা চলনসই বলতে পারি। যখন যে এলাকায় থাকি, সেখানকার আঞ্চলিক ভাষা আয়ত্ত্ব করে ফেলি, তাই কপাল ঠুকে চলেও এলাম। দেখাই যাক না কী হয় ! আসলে আপাতত আমার পাখির চোখ এরিয়া সেলস ম্যানেজার। তাই পারফরম্যান্স আর দক্ষতা দেখানোর কোনো সুযোগই ছাড়ি না। গত সাত-দশদিনের গতিবিধি খুব-একটা খারাপও বলা যাচ্ছে না।
বিদ্যাধর সাউকে এজেন্ট হিসাবে ফাইনালি সেটল করে গ্রামের নদীপথে হেঁটেই ফিরছিলাম ট্রেকার ধরব বলে। এখান থেকে ট্রেকারেই ফিরতে হবে ডরমেটরিতে। এমন সময় খুব চেনা নুয়ে পড়া এক বৃদ্ধের দিকে চোখ আটকে গেল। নদীর পাড়ে ঘাসের উপর বসে আপনমনে খৈনি বানাচ্ছে। চকিতে মনে পড়ে গেল রামদীন কাকার কথা। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম।
~ রামদীন কাকা !
ঘোলাটে চোখে একবার দেখল। তারপর চোখ সরু করে অনেকক্ষণ আমার হাসি হাসি মুখ দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। 
~ ছোটো খোকা ?
~ তাহলে চিনতে পেরেছ ? কতদিন পরে দেখা। 
আমাকে জড়িয়ে ধরল কাকা। পিঠে হাত বুলিয়ে দিল বেশ খানিকক্ষণ। তারপর বলল, চ বেটা, আমার ঘর চল।
~ কোথায় তোমার বাড়ি ?
~ আয় বেটা, আয়।
দু-পা এগোতেই রামদীন কাকার ভাঙাচোরা বাড়িতে এলাম। খাটিয়ায় বসে অনেক কথা হল। চা-মুড়ি খেলাম। তারপর কাকার পীড়াপীড়িতে সেই রাতে থেকেও গেলাম সেখানে। আমি একা থাকি। আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করেও থাকে না। তাই থেকে যেতে কোনো অসুবিধাই হয়নি। চাঁদের আলোয় দরমার বেড়া আর টালির চালের ঘরে খাটিয়ায় শুয়ে অনেক রাত পর্যন্ত কাকার সঙ্গে নানা গল্প হল। আমার বাবা-কাকাদের কথা জিজ্ঞাসা করল না একবারও। বুঝলাম এখনো অভিমান রয়ে গেছে রামদীন কাকার। এবং এটাই স্বাভাবিক। আমি তাই আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে চাইনি বাড়ির কারও কথা। একবার আমার মায়ের কথা জানতে চাইল।
~ হ্যাঁরে বেটা, কেমন আছে পুষ্পা বউ ?
~ মা ভালোই আছে কাকা। শুধু সাইটিকার ব্যথাটা মাঝে মাঝে বাড়ে।
মাকে এই নামেই ডাকত কাকা। আমার বাবার থেকে মাস ছয়েকের ছোটো রামদীন কাকা। বাবাকে মেজদাদা, জ্যেঠামশাইকে বড়োবাবু আর কাকাকে প্রশান্ত ভাই বলে ডাকত। জ্যেঠিমাকে বলত বড়ো বউদি, মাকে পুষ্পা বউ, কাকিমাকে মণি বউ এইসব নামে ডাকত। 
~ তোর মায়ের কি আমার কথা মনে আছে বেটা ?
~ কী বলছ কাকা ? মনে থাকবে না ? আমাদের সবাই তোমাকে মনে রেখেছে।
কথাটা বললাম বটে, কিন্তু নিজেই জানি এর সবটা সত্যি নয়। আমরা কেউই সেভাবে রামদীন কাকাকে মনে রাখিনি। আমার কথা শুনেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না কাকার। চোখটা উপরের দিকে তুলে কী যেন খুঁজছে এমনভাবে টালির চালার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ।
তবে আশেপাশের লোকজনদের কথা আর আমার ছোটোবেলার ডানপিটে স্বভাবের গল্প বলে গেল নানা কথার ফাঁকে ফাঁকে। নিজেই বলছে আর জোরে হেসে উঠছে। মাঝে মাঝে সেই হাসির দমকে হাঁফ ধরে যাচ্ছে। একটু থেমে আবার পুরনো দিনের গল্পের ঝাঁপি খুলে বসছে কাকা। 
ঘোমটার আড়ালে থাকা চাচি একটাও কথা বলেনি। দু-একবার সামান্য হাসির শব্দ শুনতে পেরেছি শুধু। কাকার স্ত্রীকে কেন যেন কাকিমা নয়, চাচি বলেই সম্বোধন করতাম আমরা। যদিও কখনো দেখিনি তাকে, তবে তার প্রসঙ্গ এলে এইভাবেই বলতাম। আসলে কাকা ছিল একেবারে বাঙালি ঘরের লোকের মতো। কিন্তু চাচি বা তার ছেলেরা তো তা ছিল না !
কাকার কাছে শুনলাম ছেলেরা বহুদিন হল কলকাতায় থাকে। এখানে শুধু এরা দুজনই থাকে। সামান্য জমিজিরেতে চাষাবাদ করে দিনগুজরান হয়। আর কোন এক বাবু নাকি মাসে মাসে টাকা পাঠায়। সেই বাবুটির সম্পর্কে অবশ্য আমি কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। কী দরকার ব্যক্তিগত সাহায্যের কথা জিজ্ঞাসা করে, আমি যখন নিজেই সাহায্য করার কথা ভাবতে পারছি না।
রামদীন কাকার পরিচয়টা এখনো দেওয়াই হয়নি। আমাদের যখন একান্নবর্তী পরিবার ছিল, বিরাট বাড়ি, বিরাট সংসার, সেই সংসারে ছিল সাত-আটটা গোরু। রামদীন কাকা সেই গোরুর দেখভাল করত। আমার জন্মের কয়েকবছর আগে থেকেই রামদীন কাকা আমাদের বাড়িতে থাকে। ঠাকুরদার ব্যবসার সূত্রে আমাদের বাড়িতে তার আগমন। ছোটোবেলা থেকেই রামদীন কাকাকে দেখেছি অতি যত্নে দুধ দোয়ানো, গোরুগুলিকে স্নান করানো, বিচালি কাটা, খাওয়ানো, গোবর জড়ো করে ঘুঁটে দেওয়া এইসব করতে। বাজারহাটও করত বাড়ির। শুধুমাত্র ছট পুজোয় ‘দেশের বাড়ি’ যেতে দেখেছি কয়েকদিনের জন্য। 
আমরা একে একে খুড়তুতো, জেঠতুতো ভাইবোনেরা বড় হলাম। একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে দেওয়াল উঠতে লাগল ছোটো ছোটো। একসময় ভাগাভাগিও হল। জমিজমা, বাড়ি, বিষয়সম্পত্তি। ভাগ হল না গোরুগুলো। সেগুলো বিক্রিবাটা করে টাকাপয়সা ভাগবাটোয়ারা হয়ে গেল। স্বভাবতই রামদীন কাকার আর প্রয়োজন রইল না। 
বাবা-কাকারা আর আমরা সাধ্যমতো কিছু টাকাপয়সা একসাথে করে রামদীন কাকার হাতে তুলে দিলাম। ছাতরার কোনো একটা জায়গায় ‘দেশের বাড়ি’ জানতাম। কিন্তু কোথায় তার বাড়ি সেই ঠিকানা বা খোঁজখবর নেওয়ার প্রয়োজন হয়তো মনে করিনি কেউ। প্রায় ভুলেই গেলাম রামদীন কাকার কথা। আজ প্রায় বারো-তেরো বছর পর কাকাকে দেখে বুকের মধ্যে রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেলাম। কত কথা, কত গল্পগাছা সেই বৃষ্টির সঙ্গে মিশে যেতে লাগল।
(২)
কোম্পানি আমাকে সম্প্রতি একটা বাইক দিয়েছে কাজের জন্য। বাইকের ধুলো উড়িয়ে কয়েকবার এখান দিয়ে যাতায়াত করেছি, কিন্তু কাকার বাড়িতে মাত্র আর-একবারের বেশি ঢোকা হয়নি। কেননা আমি এখানে এলেই সময় নষ্ট হয়। এখন আমার অনেক উঁচুতে উঠতে হবে যে ! 
আমাদের কোম্পানি বিস্কুটের পাশাপাশি প্যাকেট কেক, স্ন্যাক্সের ভ্যারাইটি ইত্যাদি লঞ্চ করবে ঠিক করেছে। তাই জরুরি তলব পেয়ে কলকাতার হেড অফিসে যাওয়ার আগে একবার দেখা করতে এলাম। দেখলাম শয্যাশায়ী কাকা বিছানার সঙ্গে প্রায় মিশে গেছে। 
চোখের ঘোলাটে দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর হালকা হাসির ঝিলিক খুঁজে পেলাম অজস্র আঁকিবুঁকি কাটা সেই মুখের রেখায়। সংক্ষেপে জানালাম অফিসের কাজে কলকাতায় যাচ্ছি। সেইসঙ্গেই বললাম, নিজেদের বাড়িতেও যাব একরাতের জন্য। অল্পই কথা বলল কাকা। যেটুকু বলতে পারল, তাতেই যেন কষ্ট হচ্ছিল খুব। 
~ তোমার কী খেতে ইচ্ছে করে কাকা ?
~ ছাতু। তোদের বাড়ির পাশের নকুলবাবুর দোকানের ছাতু আনবি আমার জন্য ?
~ নিশ্চয়ই আনব। আর কী ইচ্ছে করছে বলো ?   
~ আর কিছু না। 
প্রথমে হেড অফিস, তারপর পুরনো জায়গা বর্ধমানে কিছু কেক আর স্ন্যাক্সের স্যাম্পেল বিলি করে প্রায় দিন কুড়ি পরে ফিরলাম ঝাড়খন্ডের বর্তমান ঠিকানায়। তারও ক’দিন বাদে রামদীন কাকার বাড়ি এলাম। 
~ রামদীন কাকা, ও রামদীন কাকা ?
কোনো সাড়া নেই। ঘোমটার আড়ালে থাকা চাচি খানিক বাদে বেরিয়ে এলো। মুখে কোনো শব্দ নেই। বিরাট ঘোমটার ফাঁক দিয়ে একবার আমাকে দেখল। তারপর পিছন ফিরে দাঁড়াল আর চাচির পিঠটা কেঁপে কেঁপে উঠছে দেখলাম। 
একটা আধময়লা প্যান্ট পরা খালি গায়ে ছোট্ট ছেলে পাশের বাড়ি থেকে ছুটে এসে আমার বাইকের পাশে দাঁড়াল। তাকেই জিজ্ঞাসা করলাম, রামদীন কাকা কাহাঁ রে বাবুয়া ? 
আকাশের দিকে আঙুল তুলে বলল, “উঁহা।” কাকার বর্তমান ঠিকানা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। চাচির থেকে কোনো সাড়া না-পেয়ে ছেলেটা আর তার বাবার থেকে খবর নিলাম দিন পনেরো আগেই কাকা মারা গেছে। 
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম লাল রঙের সূর্যটা ক্রমশ ঢলে পড়ছে। কয়েকটা কেকের প্যাকেট এনেছিলাম সঙ্গে। একটা ছেলেটার হাতে দিলাম আর বাকি কেকগুলো উঠোনে পাতা খাটিয়ায় রেখে এলাম নিঃশব্দে। তার পাশে রাখলাম ছাতুর ঠোঙা। তারপর ধুলো উড়িয়ে বাইক নিয়ে ফিরে এলাম নিজের আস্তানায়। ফিরেই বাবাকে জানালাম কাকার মৃত্যুসংবাদ। ফোনের ওপারে খানিক নিস্তব্ধতার পর বাবা বলল, তোর মাকে কিছু বলার দরকার নেই, যা বলার আমিই জানাব ধীরেসুস্থে। আমি একথার কোনো মানে খুঁজে পেলাম না। এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহও দেখালাম না আর। 
(৩) 
বাড়ির প্রতি আমার টান বরাবরই একটু কম। সেলসে চাকরি নেওয়ার পরে তো আরোই কমে গেল। নিজের কাজ আর ক্যারিয়ার নিয়েই ব্যস্ত থাকতে ভালো লাগে আমার। আসলে আমাদের একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই কেমন যেন সব ছাড়া ছাড়া ভাব। বাউন্ডুলে স্বভাবের আমার তো আরোই বেশি হল।
মা বারবার ফোন করে বলে বাড়িতে আয়, খুব দরকারি কথা আছে তোর সঙ্গে। আমি এড়িয়ে যাই। কেননা আমি জানি মায়ের বিশেষ দরকারটা কী। কখনো বলে বকুলতলায় একটা ভালো মেয়ের সন্ধান পেয়েছি। একবার দেখে আয়। আর কতদিন এভাবে কাটাবি ? কিংবা বলবে তোর পিসির দেওরের এক বন্ধুর মেয়েটাকে দেখলাম রূপ। তোর সঙ্গে খুব মানাবে। আমি আপাতত বিয়ে করতে রাজি নই। আমার পাখির চোখ এখন এরিয়া ম্যানেজার হওয়া। 
কিন্তু কত আর কাটানো যায় ? অবশেষে মাস ছয়েক বাদে বাড়িতে এলাম। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে বিছানায় গড়িয়ে নিয়ে বিকেলের চা খেয়ে আড্ডার ঠেকে যাই এখানে থাকলে। আমি তখন বিছানায় শুয়ে। মা চা দিয়ে আমার পাশে বসল। তারপর খুব ধীর গলায় বলল, একটা কথা রাখবি রূপ ? আমি জানি এবারই বিয়ের প্রসঙ্গ তুলবে। তাই চুপ করে রইলাম।
~ একবার গয়ায় যাবি ?
~ কেন ?
~ রামদীনের পিণ্ডটা দিয়ে আয় তুই। ওর আত্মার শান্তি হোক। বাবা জবাব দিল।
~ আমি ? ওর ছেলেরা থাকতে আমি কেন দেবো ? কী বলছ বাবা এসব ? 
~ ছেলের কর্তব্য করবি তুই।
কথাটা বলেই বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মা তার আগেই বেরিয়ে গেল দেখলাম। আমার মাথাটা কেমন যেন জট পাকিয়ে গেল। রামদীন কাকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী ? ছেলের কর্তব্য বলতে বাবা কী বোঝাল ? তবে কি যাকে আমি বাবা ডাকি সে আমার আসল বাবা নয় ? রামদীন কাকাই আমার... । আর কিছু ভাবতে পারছি না আমি, সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আমার। 
সন্ধ্যার খানিকটা পরে তারায় ভরা ছাদে উঠে এলাম একা একা। ছোটোবেলা থেকে রামদীন কাকা আর বাবার আচরণের মিল-অমিল খুঁজতে থাকলাম মনে মনে। কখন যে বাবা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি।
~ যদি পারিস এই অক্ষম বাপটাকে ক্ষমা করিস রূপ। অনেক ডাক্তারি পরামর্শের পর যখন বুঝলাম আমিই অক্ষম, তোর মায়ের কোনো দোষ নেই, তখন এ ছাড়া আমার সামনে আর কোনো পথ ছিল না বাবা। একটা কোল আলো করা ছেলের সুখ পেতে চেয়েছিলাম আমরা দুজনে। বল তুই, খুব কি বেশি ছিল সেই চাওয়া ? 
অন্ধকারে বাবার মুখ দেখতে পারছিলাম না আমি। কিন্তু গলার শব্দ শুনে উথালপাথাল সমুদ্রের ঢেউ দেখতে পাচ্ছিলাম। বাবাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে ফেললাম আমি।
আকাশ থেকে তখন রাশি রাশি নক্ষত্রমালা সারা ছাদে ঝরে পড়তে থাকল, অবিরাম।  

ছবি কৃতজ্ঞতা স্বীকার: Cesar Legaspi

অনিন্দ্য রায়



ছায়াবীথিতলে


ভ্রুণের সংহিতা, তাকে নৈঃশব্দ্য ফাটায়
আমরা রক্তের ধর্মে গণিত রেখেছি
             আর যে কাহিনী উত্তরে মেলে না তাকে বলি মোহনবাঁশরী
তা থেকে বেরোয় না
বলি ব্রহ্ম
       বলি অণ্ডত্রয়ী
একটি তো দেখতে পাই না
ভাবি দুই
এই বিশ্ব দ্বন্দ্বময় ভাবি
অথচ অন্য আছে সর্বত্র
 তা-ই ফলাফল
অথচ দোকান আছে পাওয়া যায়  ধুতুরার ফুল
বাইরে পুরুষ আর অন্তরে স্ত্রীরূপ গহ্বর
এবং যে বীজ হয় জিভে নিলে সংজ্ঞা টলে যায়
               তোমাকে বিখণ্ড করে
আবার একত্রে রাখে
সুবর্ণগোলক
তা দিয়ে বানানো গয়না অঙ্গ হয়ে শরীর বানাল
তা দিয়ে বানানো অঙ্গ তুলে ধরল নিজের পতাকা
এবং ছায়ার ঘাসে খসে পড়ল সকল পোষাক
এবং ত্বকও খসল
       মাংস-অস্থি-ঘিলু গলে গেল
 রক্তের ফোঁটা হয়ে, নীরক্ত কুসুম হয়ে
       প্রবল ঘুর্ণিতে পড়ে টুকরো হল প্রাণ ও পরাগ
আবার জুড়তে তাকে ডাক দিই
কাছে এলে আলিঙ্গন করি
বানাই মোক্ষম ক্বাথ
সে আঠা বুলিয়ে রাখি সর্বান্তকরণে
   আহা জোড়ে, জুড়ে যায় যেভাবে অশ্ব লাগে নিষ্প্রাণ শকটে
ছোটে সব সামাজিক পথে
ঘাস খেতে কদাচিৎ নেমে আসে অসামাজিকতায়
নামায় বুভুক্ষু মুখ
ওষ্ঠে ঘষা লাগে পাপপুণ্যের বিছুটি
ফুলে ওঠে,
   এত এত এত স্থূল হয় ঢাকা পড়ে মহাকাশ
বৃষ্টি সব ওধারে আটকায়
এই পাড়ে জল ভাঙে
জলের গভীরে ভাঙে জৈবইতিহাস
সেখানে যুদ্ধের কথা পুঙ্খানুপুঙ্খ লেখা
সনমাসতারিখে হিসেব
উপাসনাগৃহ আর স্মৃতিস্তম্ভে ভরে যায় দেহ
ঘন্টা বাজে
লালায় মুখের থালা ভরে যায়
তাকে বলে খিদে
এতবছরের রীতি রুটিকে গোলই রেখে দিল
যেকোনো প্রান্তের থেকে ছেড়া শুরু করা যায়
         ঘুরিয়ে নেওয়া যায়
এবং কামড় দিলে স্বাদ থাকে একইরকম
যেন গম সব ক্ষেতে একই আদর পেয়েছিল
একই তাপ, মাত্রাও অনন্য
প্রতিটি চাষীর চোখে চাষীবৌ দেখে এক চন্দ্রোদয়ঘোর
কিন্তু পলক পড়ে বিভিন্ন সময়ে
তাই নুনের মাত্রা ভিন্ন মনে হয়
চুম্বনে
       ও উৎপাদনেও

আমরা শস্যের গায়ে হাত বোলাই আভ্যেসবশে
চাপ দিই
         খোসাটি ছাড়াই

নগ্নতা ছাড়া যেন পরিচয় সম্ভবই নয়    

ছবি কৃতজ্ঞতা স্বীকার : অরিণ রায় 

শুভশ্রী সাহা





 ফেসবুকের পেজ / কবিতার কবি/ লেখক ও তাদের সার্বজনীন  গ্রহণ যোগ্যতা---- 
আজ আমরা এমন এক সন্ধিক্ষনে এসে পৌছেছি যেখানে মিডিয়া ও অনলাইনের ভূমিকা সর্বোত্তম হয়ত। আগে পূজা বার্ষিকী বা বইমেলায় পাব্লিশ হওয়া কবি / লেখক ছাড়া আমরা কাদের কথাই বা জানতে পারতাম। সেই সময় কি লেখা হত না না কবির সংখ্যা কম ছিল তা নয়-- তখন প্রচার বা কবিরাও হয়ত প্রচারবিমুখ ছিলেন। ৯১/ ৯২এর বই মেলায় প্রচুর তরুন কবি এবং লিটিল ম্যাগ পেতাম যারা কোন স্টল পেতেন না সবুজ মাঠে বসে বই বিছিয়ে বই বিক্রি করতেন। ব্যক্তিগত যে সব কবিতার বই বিক্রি হত তা একান্ত ভাবেই নিজেদের করতে হত রোদে জলে ঘাম ফেলে-- তাদের লেখার মান কি খারাপ ছিল--- বহু পরবর্তী কবি উঠে এসেছেন। হর্ষ দত্ত আবুল বাশার গৌতম ঘোষদস্তিদার এমন অনেকে এসেছেন। 
সে তুলনায় এই মুহুর্তে অন লাইন এবং ফেবুকের সুবাদে আমরা সবাই কবির দলের সংখ্যা অনেক বেশি। এরা প্রত্যেকেই প্রচারের সুযোগ পান বা পাচ্ছেন নিজস্ব বা অন্য কোন পেজের অনলাইন পত্রিকার সদস্য হয়ে-- এক্ষেত্রে নিজের টাইম লাইনের বন্ধু এবং পেজের বহু সংখ্যক সদস্যের সন্মিলিত লাইকিং এবং কমেন্টের জোরে তারা খুব সহজেই কবির আসনে চলে যান। কবি তো কবি ই-- স্বঘোষিত হন বা পাঠক ঘোষিত হন--- তাদের লেখা কতটা সর্বজনগ্রাহ্য হল তাও কে দেখে বা বোঝে-- বহু জন ই তো সখের কবি--- কবিত্ব তাদের অংশত আসলেও আপত্তি কি! তাই কে পড়ল কতজনের কাছে পৌছল সেটা নগন্য--- কবি শিরোনামধারী হলেই হোল-- আগে যেমন অঘোষিত নিয়ম ছিল যে কোন কুলীন কাগজে  লেখা বের হলে তবেই তুমি কবি বা লেখক। দেশের ঘরে জন্ম নেওয়া কবি ই সুনীল শক্তি নীরেন্দ্র বা সমরেন্দ্র শরৎ  পুর্নেন্দু এনারা--- তার আগেও ছিল অমৃতবাজার শ্যামল,  বুদ্ধদেব বরেন প্রফুল্ল এনারা ছিলেন অগ্রগন্য-- এখনকার কবিরা এই সব থেকে বহু  দূরে থাকেন তাদের জুতো ছিঁড়ে কবি হবার দায় কই! তারা আগেই এলিট কবি / সম্পাদক হয়ে বসে থাকেন পেজে পেজে নিজের টাইম লাইন আলো করে এবং কবি তৈরী করেন বা চাটুকার দের দল যারা নিরন্তর আহা রে! বাহা রে! করে যায়। কোন কাগজে লেখেন কথাটি এখন ব্রাত্য- বরং প্রশ্ন রাখবেন-- আপনার কটা বই বেরোল-- -- প্রত্যেক বছর বইমেলার সুবাদে অসংখ্য বই এখন পাব্লিশ হয় তার কাটতি কেমন জানতে চাইবেন না----- কাটতি নিয়ে এখন কবিদের তো সংসার চালাতে হয় না আর!! তাই কবির কোনো দায় পাঠিকদের কাঁধে নিতে হয়না -- প্রিয়কবি,  প্রিয় লেখক তাদের বই কেনা এমন কি বহু সদস্যের চালানো একটি পেজ যখন পত্রিকার আকারে বের হয় তার একটি কপি কেনার ও ব্যক্তিগত দায়  কোন সদস্যের থাকে না। সব দায় দায়িত্ব নেয় সম্পাদক মশাই----
তাহলে কি সত্যিই কোন কবি উঠে আসছেন না--- ফেসবুকের বা ই ম্যাগাজিন বা লিটিল ম্যাগাজিন
  থেকে-- আসছে নিশ্চয় তাদের সংখ্যা নগন্য -- তারা খাটিয়ে তারা তরুন-- তারা কবিতার পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কিন্তু যে সহজ পথে পাঠক মন প্রবেশ করে সেই নরম মাঠের ঘাসের গালচে ত্যাগ করেনা। শিক্ষা সাহিত্য  নিয়ে অনর্থক জ্ঞান বিতরন বা কচাকচি কোনটাই নেই----- শুধুই কবিতা আছে-----আছে কবিতার প্রতি ভালোলাগানোর আকর্ষণ --- এরাই কবির পাঠক তৈরী করছে দায় বহন করছে কবিতার-- জমিতে নেমে--- বাকি রা বেশির ভাগ নিজের কবিতা কবি তার ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্যস্ত---- কারা থাকবেন কারা যাবেন--- সময় এবং পাঠক কুল ঠিক করবেন--- বছরে একটি দুটি ম্যাগাজিন নিজের সম্পাদনায়  প্রকাশ করা বা নিজের বই বের করলে ফেসবুকে ফ্যান ফলোয়িং বাড়লেও  বৃহত্তর পাঠক কে সংযুক্তিকরণ  করানো যায় না।



ছবি কৃতজ্ঞতা স্বীকার: Cesar Legaspi

ভজন দত্ত



হামদের '' (ছো) 

বিশ্বায়ণের ধাক্কায় যখন সারা পৃথিবীর লোকসংস্কৃতি প্রায় বিপন্ন,বহুজাতিক কোম্পানীগুলি
  যখন বিজ্ঞাপনব্যয় কম করার জন্য পৃথিবীজুড়ে গড়ে তুলতে চাইছেন তাদের পছন্দমত একটাই সংস্কৃতি।  আরো নাফার ধান্দায় মগ্ন হয়ে গলা টিপে শেষ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যকে, সেখানে একটি লোকসংস্কৃতির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা, বেশ অবাক করার মতোই সংবাদ বই কি! প্রিয় পাঠক , একটু অনুধাবন করলেই জানতে পারবেন সত্যতা। হ্যাঁ,আমি 'ছো' করবো বলে কথটা বলছি না, ' ছো ' সম্পর্কে আমার জানা কিছু কথা লিখবো বলেই এমনতর অবতারণা। 

বরফি সিনেমাটা মনে আছে ! মনে আছে সেই বধির হিরোটিকে! ২০১২তে রিলিজ এই সিনেমাটিতে নানাভাবে ছৌ নৃত্য ও তার মুখোশকে
  ব্যবহার  করেছেন চিত্রপরিচালক অনুরাগ বসু! যা সিনেমাটোগ্রাফিতে এক অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল।এর আগে ও পরবর্তীকালে আরো অনেক সিনেমায় ব্যবহার করা হয়েছে এই নৃত্যশৈলী ও তার উপকরণকে। এই নাচ মানভূম সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। 



বিখ্যাত "মুকাবিলা হো মুকাবিলা " গানের সঙ্গে প্রভুদেবার নাচটি মনে আছে! শুধু দুটি পা বা হাত বা মাথার ছন্দময় সেই আন্দোলনের কথা। " Chou Dance of Purulia " গ্রন্থে ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য এই নাচের অঙ্গ-সঞ্চালনাকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন। ১/ ছৌ নাচে সমস্ত শরীর স্থির রেখে মাথার মুকুটখানি নড়ানো - মস্তক সঞ্চালন ; ২/ সারা শরীর স্থির রেখে কাঁধটিকে শুধু নড়ানো। মাথা নড়বে না,শরীরের নীচের অংশটিও নড়বে না।শুধু কাঁধ দুটি নড়বে।এটি এই নাচের একটি গুরুত্বপূর্ণ
  মুদ্রা- কাঁধ সঞ্চালন; ৩/ গতিতে নাচতে নাচতে লাফিয়ে উঠে পা দুটি জোড় করে এক বা একাধিকবার তালে তালে বসে পড়া বা সামনে পিছনে চলা।এটি এই নাচের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ।স্থানীয় ভাষায় এটিকে বলা হয় ' উলফা' যা উল্লম্ফনের অপভ্রংশ রূপ। - উল্লম্ফন ; ৪/ সমস্ত শরীর স্থির রেখে শুধুমাত্র বক্ষদেশ নড়ানো। বাজনার তালে তালে চরিত্রের ঝলমলে পোষাকও নড়ে।- বক্ষ সঞ্চালন। ৫/ সানাই ও ঢোলের তালে তালে পদসঞ্চার বা পদক্ষেপ। এটি নানা রকম হয়। যেমন দেবতাদের চলা - দেবচাল,বীরের মত চলা - বীরচাল, রাক্ষসের মত চলা - রাক্ষসচাল বা পশুর মত চলা - পশুচাল প্রভৃতি।
এই চালগুলির মধ্যেও আবার নানা ভাগ আছে। যেমন - ডেগা,ফন্দি,উড়ামালট, উলফা,বাঁহি মলকা বা বাহু নড়ানো, মাটি দলখা।
সানাইয়ের সুর, ঢোলের সূক্ষ্ম তাল, মাত্রা ও কাড়া নাকড়ার আওয়াজে এই নাচের চরিত্ররা নূপুরধ্বনির সঙ্গে প্রয়োজন মত অঙ্গ সঞ্চালন করে থাকেন। অদ্ভূত নিয়ন্ত্রণ নূপুরের! তারা প্রয়োজন মতন নূপুরধ্বনি করে থাকেন। বর্তমানে ক্যাসিও,গীটার,ক্যাবাকাশ ও অন্যান্য আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার দেখা যাচ্ছে।


মানভূমের মানুষ এই নাচকে বলেন " ছো "। কেউ কেউ আবার বলেন " ছ"। ভারতে যেকটি নৃত্যের মধ্যে বীররস পাওয়া যায় তারমধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থানটি এই ছৌ নৃত্য দাবি করে থাকে। পৌরুষদৃপ্ত এই নাচটির বাংলা, বিহার,ওড়িশা -- কোথায়
  উৎপত্তি তা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে মতপার্থক্য আজও বর্তমান।
বর্তমানে এই নৃত্যের যেসব ঘরাণা দেখা যায় তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১/ ঝাড়খন্ড-সেরাইকেলা, ২/ পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া ও চিলকিগড় ( ঝাড়গ্রামের কাছে), ৩/ ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলার।আবার ইন্দোনেশিয়া ও বালির ফ্রিশ ও বরং নৃত্যের সঙ্গেও এর সাদৃশ্য আছে।কেরালার কথাকলি নাচের সঙ্গেও কিছুটা মিল আছে। মাথায় মুকুট ও চিত্রিত মুখ যেন মুখোশকে মনে করায়। পুরুলিয়াতেও প্রথমে কথাকলি নাচের মত রং মেখে 'একুড়া ছো ' নাচা হত।পরে কাগজের আবরণ তার অনেক পরে এসেছে আজকের মুখোশ। মাটির ছাঁচে বিভিন্ন আকৃতির মুখ তৈরী করে তার উপর কাগজ,কাপড়,মাটির আস্তরণ দিয়ে ভেতরের অংশ বের করে কাগজ ও কাপড়ের অংশটি নিয়ে হালকা ও নৃত্যের উপযোগী মজবুত মুখোশটি তৈরী হয়। চরিত্র অনুযায়ী
  নানা রঙে রাঙিয়ে শিল্পীরা মুখোশগুলিকে জীবন্ত করে তোলেন । আবার নানান রকম পুঁতি,কাঠি, মালা, চুমকি, টিকলি,চুল, অলংকার,  ময়ূরপালক দিয়ে চারপাশে সাজানো হয় চরিত্র মতন।সাজ অনুযায়ী একেকটি মুখোশের ওজন ২০০- ৫০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়। বেশ কয়েকটি গ্রামে মুখোশ তৈরী হলেও মুখোশ তৈরীতে পুরুলিয়ার চড়িদা গ্রামটির খ্যাতি আন্তর্জাতিক। 

ছৌ নাচের মধ্যে সবদিক থেকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে পুরুলিয়ার ছৌ নৃত্য, একথা প্রায় সকলেই স্বীকার করে থাকেন।বর্তমানেও এই খ্যাতি অব্যাহত রয়েছে।
পুরুলিয়ার এই খ্যাতির পিছনে আছে ছৌ নৃত্যের মুখোশ ও পোষাক।কথায় আছে, " জমিদারও ভিকারি হয় ছো নাচে "। কারণ এই নৃত্যের জন্য ব্যবহৃত মুখোশ ও পোষাক নির্মাণব্যয় বেশ বেশী।

পুরুলিয়া জেলার মধ্যে বাগমুন্ডিতেই এই নাচের উৎপত্তি তা গবেষকগণ একবাক্যে স্বীকার করেছেন।আর ছৌ নৃত্যের মহাগুরু হিসাবে যাঁর নাম সকলে একবাক্যে স্মরণ করেন তিনি হলেন গম্ভীর সিং মুড়া। জেলায় তাঁর পিতা চিপা সিং ও বাবুলাল মিস্ত্রিকে এই নাচের পথ প্রদর্শনকারী বলে মনে করা হয়।
পুরুলিয়া জেলার বাগমুন্ডি ছাড়াও ঝালদা, বলরামপুর,
  বরাবাজার, বান্দোয়ান, হুড়া, পুঞ্চাতেও এই নাচ দেখা যায়।তাদের নৃত্যশৈলীর মধ্যে সুক্ষ্ম পার্থক্যও বিদ্যমান। তবে ছৌ বিশারদ যাঁরা, তাঁরা মনে করেন ঠাটে এবং ভাবে বাগমুন্ডি ও ঝালদার ছৌ অনবদ্য। 

(পরবর্তী অংশ দ্বিতীয় পর্বে)
 
চিত্রঋণ : উজ্জ্বল দাস


বাসব মন্ডল

পাপ পাঁচালী 
......,..............
বাসব মন্ডল

লিপ্সা(lust) 
..,....... 
শরীরের খাঁজে খাঁজে 
জমে থাকা বৈরাগ্যের বল্কল 
খসে পড়ে 
নৈকট্যের অযাচিত ইস্তাহারে 
অভ্যাস মিস করা ইন্দ্রিয়র 
সম্ভোগ ক্রিয়ায় 
রচিত হয় উল্লাসের মানস সরোবর 
চরিত্র এখন হিমবাহ হয়ে 
জাহাজ ডোবার অপেক্ষায়

ক্রোধ(wrath) 
............... 
দাবানল চুঁইয়ে নেমে আসা 
বিভাজিত সত্যের এপিটাফে 
লিখে রাখব ঘৃনার আলফাজ 
আকুতির গজল বুকের পাঁজরে 
আটকে গিয়ে 
বেজে উঠবে প্রতিবাদের কোরাস হয়ে

গর্ব(pride) 
........... 
সম্ভোগের পূর্ণ বৃত্তে 
স্বার্থের সালোক সংশ্লেষ 
সাফল্যের হরিৎ ক্ষেত্র জুড়ে 
স্ফিত বুকের নির্বাক উচ্চারন 
আজও অস্তিত্বের ট্রাপিজে দাঁড়িয়ে 
খুঁজে চলি উন্নতির স্কাইক্রেপার 
কলারের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে 
শ্রেষ্ঠত্বের জারজ দাবি

লোভ(gluttony) 
........... 
না,উদর ভর্ত্তি ভাত নয় 
শুধু মন জুড়ে যার স্বপ্ন দেখি 
তাকে নৈঋত আলোকে 
নির্বিষ চুমু খেতে চাই 
নিভৃতে 
বারান্দার সারশি জুড়ে 
অনিশ্চিয়তার ত্রিকোনমিতিকে 
বুড়ো আঙুল দেখিয়ে 
মেখে নিতে চাই সম্ভোগের আতর

আলস্য(sloth) 
............ 
খরগোসের ঘুম ভাঙবে নিশ্চই 
তখন 
হয়ত জিতে গেছে কচ্ছপ 
কিন্তু 
হারের অটোপ্সি রিপোর্টে লেখা থাকবে না 
সুখের পাটিগণিত

হিংসা(envy) 
........... 
দাঁত কোনে আটকে থাকা মাংসের টুকরো 
মদের গ্লাসে ভাসতে থাকা বরফ টুকরো 
গোলাপ পাতায় চিক্-চিক্ করা শিশির বিন্দু 
মোম দানিতে লেগে থাকা গলা মোমের দিব্যি 
আমি ওদের মত হতে চাই 
সব সুখের সাক্ষী হয়েও 
থেকে যাব অপরাজিত

ছবি কৃতজ্ঞতা স্বীকার: Cesar Legaspi

মানসী গাঙ্গুলী

#পরাজয়

      দুটি মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার সুমিত ও রত্নার।ভালবেসে বিয়ে করেছিল দু'জন,দু'বাড়ীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও। ভাড়া বাড়ীতে সংসার পেতেছিল দু'জনে।বাড়ীওয়ালি মাসিমাই ছিলেন তখন অভিভাবক, রত্নার শাশুড়ীর মত।রান্না শেখানো থেকে সর্ব খুঁটিনাটি ব্যাপারে পরামর্শ দেওয়া,খুব ভাল বাসতেন ওদের দু'জনকে।নিজের সন্তান না থাকায় ওদের নিয়েই ছেলে বউয়ের সাধ মেটাতেন।রত্নাও নিজের শ্বশুর -শাশুড়ীর মতই শ্রদ্ধা ভক্তি করত ওনাদের।সুমিত ব্যাঙ্কের অফিসার,তাই আর্থিক অসুবিধা ছিল না কিন্তু বিয়েতে বাড়ীর বড়রা না থাকায় দু'জনেই খুব কষ্ট পেয়েছিল তবে স্নেহময়ী মাসীমাকে পেয়ে কষ্টের কিছুটা লাঘব হয়েছিল।
      বছর দুই পরে সুমিত একটা 2BHK নেয় যদিও একটু interior এ কারণ এর বেশী তখন সুমিতের ক্ষমতায় কুলায় নি।কত আনন্দ করে দু'জনে মিলে সংসার গোছায় সেখানে।মাসীমাও ক'দিন এসে থেকে সাহায্য করেছিলেন।মাঝেমধ্যে মাসীমা-মেসোমশাইকে আসতে বলত রত্না ও সুমিত।ওনারা ক'দিন করে থেকে যেতেন তখন।রত্না যথাসম্ভব আদর যত্ন করত।কিন্তু কিছুটা দূরত্ব হওয়ায় আর বয়সজনিত কারণে আসাযাওয়া সম্ভব হত না তাঁদের।এরপর ক্রমে দুই সন্তান এলো ওদের ঘর আলো করে।ফুটফুটে দুটি মিষ্টি মেয়ে।সুখের সংসার।সুমিত মেয়েদের বড় স্কুলে ভর্তি করেছে,গাড়ী কিনেছে।হাসিখুশি আনন্দের জোয়ারে ভাসছে যখন,দুর্যোগ নেমে এল ওদের জীবনে।ব্যাঙ্কে কাজের সময় ব্যস্ত অবস্থায় একটা কাগজ ভাল করে না দেখে, না পড়ে সই করে দেওয়ায় প্রচুর টাকা তছরূপের কেসে ফেঁসে যায় সুমিত,যা থেকে মুক্তি পাবার মত কোনো প্রমাণ যোগাড় করতে না পেরে চাকরীটা খোয়াতে হয় এবং জেলও হয়।যদিও কিছু শুভানুধ্যায়ী ছিলেন যারা বিশ্বাস করতেন সুমিত এমন কাজ করতে পারে না কিন্তু প্রমাণাভাবে তাদের পক্ষেও কিছু করা সম্ভব হয় না।খবরের কাগজে এই সংবাদটি পড়ে মেসোমশাই এসেছিলেন দেখা করতে,কিছু আর্থিক সাহায্যও করতে চেয়েছিলেন কিন্তু রত্না জানে ওনাদের ভাড়ার টাকায় ও পেনশনের সামান্য কিছু টাকায় সংসার চলে,তাই বলে প্রয়োজন নেই,প্রয়োজন পড়লে নিশ্চই জানাবে তাও বলে।এ হল কথার কথা,মেসোমশাইও বুঝলেন কিন্তু ওনার আর কিই বা করার ছিল।
       একটা সুন্দর, সুখের সংসার তছনছ হয়ে যায়।বড় মেয়েটা তখন ক্লাস 9 ছোট 3।রত্নার পক্ষে তাদের আর বড় স্কুলে পড়ানো সম্ভব হয় না,তাছাড়া পথেঘাটে চলাফেরা দায় হয়ে উঠেছে,চেনা পরিচিতের মাঝে ওরা তখন আলোচনার বিষয়বস্তু, মুখ লুকিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়।খুবই অভাবের মধ্যে পড়তে হয় ওদের।রত্না খুব গুণী মেয়ে,নানারকম কাজ জানে,তাই এটাসেটা করে কোনোরকমে সংসার চালায় আর জেলে গিয়ে সুমিতের সাথে দেখা করে।সুমিত রোজ রোজ ওকে জেলে যেতে বারণ করে,মেয়েদের সামলে নিয়ে থাকতে বলে আর তাছাড়া রোজ যাতায়াতে যে গাড়ীভাড়া লাগবে সেটাই বা জুটবে কোথা থেকে তাই।নিজে সে ক্ষয়ে ক্ষয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে।নিজের ক্যালাসনেসের জন্য নিজেকে ওর শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে কিন্তু রত্নার কথা ভেবে অসহায় মেয়েদুটোর মুখ মনে করে সংযত থাকে।
      বড় মেয়ে মণি টিউশন খোঁজে কিন্তু ওদের কাছে কেউ বাচ্চাকে পড়াতে দিতে চায় না।এত প্রতিবন্ধকতা মাথায় করে মণি ভাল স্টুডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও কোনোরকমে খুবই নিম্নমানের result নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে।হাসিখুশি মেয়েটা কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে।কেবল চেষ্টা করে মায়ের পাশে দাঁড়াতে আর বোনের গায়ে যেন আঁচ না পড়ে।মাত্র ১৮ বছর বয়সে মণি একজন পরিণত মহিলায় পরিণত হল।
        কোনোরকমে কলেজে ভর্তি হতে পারল কিন্তু আর যে চলে না,নুন ভাত,ফ্যান ভাত খেয়ে,পায়ে হেঁটে যাতায়াত করে।রত্নাও ঘরের সব কাজ একাই করে যা ওর কোনোদিন অভ্যেস ছিল না।এই সুযোগে অল্পপরিচিত এক মহিলা কদিন ধরে ওর সাথে খুব আলাপ জমায় আর বুঝিয়েসুঝিয়ে ওকে নোংরা পথে নিয়ে যায়।মণি প্রথমে রাজী হয় না কিন্ত মহিলা বোঝায়,কলেজের পরে অনেক মেয়েই এভাবে রোজগার করে সংসার চালায়।মণিও আর বাঁঁচার আর পথ খুঁজে না পেয়ে একপ্রকার রাজী হয়ে যায়।মহিলাই সঙ্গে করে ওকে নিয়ে যায়।মণি বুঝতে পারে মহিলাটি দালাল, এভাবেই মেয়েদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের কুপথে নামিয়ে এরা রোজগার করে।প্রথমদিন বাড়ী ফিরে বাথরুমে ঢুকে খুব কেঁদেছিল মণি,সারাশরীর জল ঢেলে ধুয়ে পবিত্র করার বৃথা চেষ্টা করেছিল।পরে এটাই দস্তুর হয়ে গেলো। মা জিজ্ঞেস করলে বলে কলেজের পরে টিউশন করে আস্তে রাত হয়ে যায়।সংসার একটু সচ্ছলতার মুখ দেখে আর চোখের জল মণির নিত্য সঙ্গী হয়।এরই মাঝে সুমিত ছাড়া পায় জেল থেকে।এই ক'বছরে যেন কত বুড়ো হয়ে গেছে,মাথা ভর্তি কাঁচাপাকা চুল,খোঁচা খোঁচা দাড়ি,গোঁফ পাকা,বিধ্বস্ত চেহারা।
      বাড়ী ফিরে সুমিত চারিদিকে চেষ্টা করে যদি কিছু কাজ পায়,কিন্তু না, কোথাও কিছু জোগাড় করতে পারে না।রত্না একবার বলেছিল,পরিচিতদের সাথে যোগাযোগ করতে কিন্তু সুমিত কোনো কথার উত্তর দেয় না,কেমন যেন হয়ে গেছে সুমিত,বাড়ীতে কারো সাথে কথা বলে না।বউ মেয়ে কারো মুখের দিকে তাকায় না,ওদের ধারেকাছেও ঘেঁসে না।ওদের কাছে সুমিতের নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়।দিনে দিনে সুমিত অবসাদের শিকার হয়ে উঠছে।মনের দুঃখে যেখান সেখান চলে যায়,নদীর ধারে বসে থাকে।এভাবে চলতে চলতে একজনের সাথে আলাপ হয় যে তাকে বাড়ী থেকে বেশ দূরে একটা দোকানে সামান্য মাইনের বিনিময়ে খাতা লেখার কাজ দেখে দেয়।এতই সামান্য যে সুমিতের বাড়ীতে বলতে লজ্জা করে।দেখে,বউ মেয়ে উদয়াস্ত এত পরিশ্রম করছে,সুমিত সর্বদা নিজেকে দায়ী করে আর তাই ওদের মুখের দিকে তাকাতে পারে না।এভাবে অবসাদে ক্ষয়ে যেতে যেতে মদ খেয়ে দুঃখ ভোলার চেষ্টা করে।প্রথ যেদিন মদ খেয়ে বাড়ী এল,রত্না চমকে উঠল,না জানি আরো কত কি অপেক্ষা করছে তার জন্য।আগে সুমিত কখনো মদ ছুঁতো না,পছন্দই করত না।বন্ধুবান্ধব কখনো একসাথে আনন্দ করার সময়,সবাই একটু আধটু মদ খেলেও সুমিত মোটে ছুঁতো না।রত্না সব দেখছে,সব বুঝছে তবু মুখ বুজে সব শ্য করে চলেছে,সহ্য করাটা এখন তার অভ্যেস হয়ে গেছে।কেবল আশায় আশায় থাকে যদি ওর সুমতি হয়।
      ক্রমে সুমিত প্রায়ই নেশা করে বাড়ী ফিরত,বাড়ীতে কিছু বলত না সারাদিন কোথায় থাকে,কি করে।রত্নাও ওর মানসিক অবস্থা দেখে ওকে বিশেষ ঘাঁটায় না।মানুষটা বাড়ী এসেছে এটাই যথেষ্ট। দুটো মেয়ে নিয়ে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিল বড়,তাই সুমিত ফিরে আসায় রত্না খানিকটা নিশ্চিন্ত। ও তো আর জানে না,মেয়েরা বড় হচ্ছে বলে যে এত চিন্তা,সেই বড় মেয়ে মণি কোন পথে চলাফেরা করছে।সুমিতের বাড়ী ফিরতে রাত হয় আজকাল,বাড়ীতে খায়ও না,রত্না তাও কিছু জিজ্ঞেস করে না।কোনোভাবেই বাড়ীতে যেন কোনো অশান্তি না হয় তাই সব হজম করে মুখ বুজে,কিন্তু এ যে আর বাড়ী নেই শ্মশানপুরী হয়ে গেছে,নিস্তব্ধ, হাসি নেই হুল্লোড় নেই,গল্পগুজব নেই।ছোট মেয়ে রিনি বড় হয়ে উঠছে,মণি যথাসাধ্য চেষ্টা করে বোনের পড়াশুনোটা যাতে ভাল হয়।বোনকে টিউশন দিয়েছে যা ও পায়নি।মনেপ্রাণে চায় বোনটা ভালভাবে মানুষ হোক,নিজে তো ধ্বংস হয়েই গেছে।কচি মনটা ওর কঠোর হয়ে গেছে,ভাবে নিজের যা হয় হোক,মা-বাবা-বোন যেন ভাল থাকে।
        কিন্তু ভাল থাকাটাও যে ভাগ্যে থাকা চাই,চাইলেই ভাল থাকা যায় না,বেচারী মণি তা আর জানবে কি করে,হাজার হোক ছেলেমানুষ। জীবনযুদ্ধে তার এতবড় লড়াই,নিজেকে তিলেতিলে শেষ করে দিয়েও বুঝি হেরে যায় জীবনের কাছে।কলেজ শেষে রোজের মত বেরিয়ে পড়ে মণি রোজগারের ধান্দায়।অন্ধকার ঘরে অপেক্ষায় থাকে খদ্দেরের,রোজ যেমন থাকে।আজকের মানুষটাকে তার মনে হয় যেন অতিমাত্রায় কামুক, কিছুতেই যেন তার আশ মেটে না।বহুকাল খেতে না পেলে মানুষ যেভাবে খায়,এ যেন সেইরকম। তৃপ্তি যেন আর হয় না তার,ছাড়তেই চায় না কিছুতে।মণি ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠছে,রাত বাড়ছে,অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে,মা চিন্তা করবে।অবশেষে নিজেকে নিংড়ে শেষ করে দেবার পর যখন টাকার লেনদেন হয়, রোজের মত ঘরের আলো জ্বালিয়েই মণি আর্তনাদ করে ওঠে দু'হাতে মুখ ঢেকে "নাআআআআ" করে।আর লোকটি দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
          যে মহিলা মেয়েদের দিয়ে এইসব কাজ করাত সে শুনতে পায় এই আওয়াজ কিন্তু অন্য ঘরে লোক পাঠানোয় ব্যস্ত থাকায় আসতে একটু দেরী হয়ে যায়।মণির ঘরের দরজা ঠেসানো ছিল।দরজা ঠেলতেই খুলে যায়,দেখে মণি ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলছে ফ্যান থেকে।ততক্ষণে শেষ,তার জিভ বেরিয়ে আছে।
       আর কিছুদূরে রেললাইনে পাওয়া যায় সুমিতের মৃতদেহ।অনুতাপে,অবসাদে ক্ষয়ে ক্ষয়ে সুমিত ক্রমে তলিয়ে যাচ্ছিল অন্ধকারে আর সেদিনই প্রথমদিন, যেদিন ওর যৌনক্ষুধা তীব্র হয়ে উঠেছিল,ও কোনো মেয়ের সংস্পর্শ ভোগ করতে চেয়েছিল কারণ রত্নার কাছে এগোতে ওর লজ্জা করে।কিন্তু দীর্ঘদিনের বুভুক্ষু শরীর যেন কিছুতে বাধ মানছিল না,পেতে চাইছিল নারী সঙ্গ।তার জন্য যে এমন মূল্য দিতে হবে, ভাবেনি সুমিত।
     ভাবে নি মণিও,জীবনযুদ্ধে এমন চূড়ান্ত পরাজয় তার হবে।

ছবি কৃতজ্ঞতা স্বীকার: Cesar Legaspi

ঈশানী বসাক

শুদ্ধতা

এক

ঠিক করে কাঁটাচামচে বিঁধে ফেলা মাংসের টুকরো টা একটা যুদ্ধক্ষেত্র হতে পারে। প্লেটটা এসব বহুদিন দেখে কিন্তু রোজকার এই খাদ্যাভ্যাসের দৃশ্য সতত তার ক্ষুধার জ্বালা কে এড়াতে শিখিয়েছে। যতটা সম্ভব রাসায়6নিক সারযুক্ত তারিখ লিখে যে খাবার সুসজ্জিত সুস্থতা নিয়ে বসে তাকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয় রক্তচাপের মাপ কত ? থ্রিলারের মত খাবার সরে যেতে যেতে মন্ডপে পড়ে থাকে পায়ের ছাপ , বসে থাকা মানুষের চাপে কুঁচকে যাওয়া চেয়ারের কাপড়। এসব একটু ঠিক করে নিলেই বুঝবে যে আর কেউ জানতে পারবে না এখানে পুজো হয়েছিল। একটা খুনের মত নিঁখুত উধাও হয়ে যাওয়াটা কার্যপ্রসাধনী।
 

দুই

যারা ঘরময় টেলিফোনকে অপেক্ষা করিয়ে বসিয়ে রেখেছে তাদের পুজোর সময় নেই। রাতদিন মনে রাখতেই হিমসিম হতে হতে একটা ফোন আসে এবং শেষটা ঠিক বিরক্ত কোরোনা মা ভারতে আসছি না এটা বলেই চুপ। আবার অপেক্ষা করতে করতে যে বেড়ালটাকে খাবার দিচ্ছেন ওনারা তারা জানেন যে পাশের বাড়িতে খাবার বলতে টকে যাওয়া ভাত। যেদিন আত্মহত্যার গল্প ঘরের মেঝেতে ভেসে আসলো সেদিন চেঁচিয়ে পাশের বাড়িতে বিড়ালটা চলে গেলেই ওরা খাবার দিলো ভালোই। ওদের সেদিন অনুষ্ঠান। চুপ করে খেতে খেতে বিড়ালটা তাকালো। মৃত্যুটা ও সাথে করে নিয়ে বসেছিলো।
 

তিন

পা থেকে প্রণাম চলে যাচ্ছে ছোটো ছোটো ছোঁয়ায়। আর না করতে করতে কোথায় না বলার আশাতেই বিজয়া করতে চলেছে কতজন। একটা ছোটো কবর থেকে যে নমাজ পাঠ হচ্ছে তাকে দেখতে দেখতে মনে হয় কেউ চলে যেতে চায় বলেই চিৎকার ফেরায়।শুদ্ধতা লুকিয়ে থাকছে বিষাদেই।

ঈশানী বসাক
 



রঙ


এক

ছোট থেকে এক একটা রঙের প্রতি আমাদের এক একটা ধারণা জন্মায়। অক্ষরজ্ঞান পূর্বেই সে সব রঙের প্রতি পচ্ছন্দ অপচ্ছন্দের দাবি বসতি গড়ে তোলে। শৈশবে হাসি , রাগ, ঝগড়া সবেরই এক ভঙ্গিমা ছিল , তার নাম কান্না। অত পরিমাণ কান্না জমেছে বলেই হয়তো বয়স বাড়লে দুঃখ পেলেও জল আসে না, ক্লান্তি বাড়লেও ঘুম আসে না। দিন রাতের ঘূর্ণণের হিসেব সঠিক সবসময়। মানুষ ছাড়া বাকি সমস্ত জীবন এমনকি এ বাসভূমির কখনো অঙ্কে ভুল হয়নি।

দুই

এই রঙের সঙ্গে আশৈশব ধারণা নামক একটি শব্দের সম্যক সম্পর্ক। গোলাপী রঙ বলতে যে বিষ এটা কেমন করে জানি বদ্ধমূল শিকড়ের সন্ধান দিচ্ছিল। নীল বড় ভয়ঙ্কর নীরব। নীল দেখলেই কেন জানি আমার বনের মধ্যে হারিয়ে যাবার দৃশ্য ভেসে উঠত। অথচ গাছের তো সবুজ রঙের। এই ঠিক এখানেই ধারণার অবতরণ। জেনেশুনে অভিমান আর জ্ঞানপাপী হওয়ার হাতেখড়ি।

তিন

প্রতিমা সেজেগুজে মন্ডপে আসলে বড় খুঁতখুঁত করে মন। শিল্পীর কাছে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিই প্রতিমার মুখে রাগ , হাসি কিভাবে ফুটিয়ে তোলেন ? উত্তর আসে অনুভব তো হাতে নেই বাবা। তবে মানুষ সবকিছুই সৃষ্টি করতে ভালবাসে। তাই খানিক অহংকার , হাসি , কান্না দিলাম মূর্তিকে। মাংস কে জীবনভর রক্ত জমা দেওয়ার ঋণ বুঝি একেই বলে।

চার

তোমাকে যখন জিজ্ঞাসা করলাম ভেবে বলো দেখি ঠিক কাকে প্রথম নগ্ন দেখেছিলে নিজেকে ছাড়া। তুমি বলেছিলে এক বালিকার কথা ঘাটের কাছে বহুদূর থেকে। আমি বলেছিলাম মিথ্যা। কেন জানো ? এই মন্ডপে যে তিন মাস নগ্ন দেহে মা দাঁড়িয়ে থাকেন রঙহীন হয়ে তখন দিনের পরদিন তাকে দেখেছি। কই মাকে দেখে তো কখনো লজ্জা হয়নি ?
 

পাঁচ
 

ছোটো থেকেই ছোটো গাছ দেখলে তার ঝাঁকড়া পাতা দেখলেই ভয় করে। মনে হয় এ শরীরে প্রথম ধুরন্ধর ছোঁয়া তার ই। এসব পাগলামো বললে বাড়িতে আমি বড় গাছের গুঁড়িতে বসতাম। সেখানে যে কোল আঁকা তাকে মানতের মতো এক গভীর আত্মবিশ্বাস বহন করতে দেখতাম। এইসব সুতোর প্যাঁচে যুঝতো ভবিষ্যত। আর সর্বক্ষণ সবুজ দেখলেই মনে হয় পরম মমতায় প্রত্যাখ্যান করে জঙ্গল অথচ তবু অভদ্র এক লোভ নিয়ে আমরা ছুটে তার মধ্যে প্রবেশ করি। একে কি ধর্ষণ বলে না ?

ছবি কৃতজ্ঞতা স্বীকার: Cesar Legaspi