পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

বুধবার, ১৫ নভেম্বর, ২০১৭

যুগান্তর মিত্র


রামদীন কাকা 

সেলসের চাকরি করি। ফলে মাঝে মাঝেই এরিয়া বদলে যায়। আমি যেমন সদ্য বদলি হয়ে এলাম ঝাড়খণ্ডের ছাতরায়। বর্ধমানে পোস্টিং থাকাকালীন আমাদের কোম্পানির বিস্কুটের বিক্রি বাড়াতে পেরেছি প্রত্যন্ত গ্রামেও। ইনসেন্টিভও জুটেছে অনেক। কোম্পানি এবার বেশকিছু মাইনে বাড়িয়ে দিয়ে ছাতরায় পাঠিয়েছে আমাকে। এখানকার গাঁওতে আমাদের কোম্পানির নতুন এজেন্সি দেওয়া, ভালো ব্যবসা এইসব সাতপাঁচ দায়িত্ব বর্তেছে আমার উপর। এককথায় ‘সুইট অ্যান্ড টেস্টি বিস্কুট’ কোম্পানির বিস্কুট ছড়িয়ে দিতে হবে গ্রামেগঞ্জেও। 
হিন্দিটা চলনসই বলতে পারি। যখন যে এলাকায় থাকি, সেখানকার আঞ্চলিক ভাষা আয়ত্ত্ব করে ফেলি, তাই কপাল ঠুকে চলেও এলাম। দেখাই যাক না কী হয় ! আসলে আপাতত আমার পাখির চোখ এরিয়া সেলস ম্যানেজার। তাই পারফরম্যান্স আর দক্ষতা দেখানোর কোনো সুযোগই ছাড়ি না। গত সাত-দশদিনের গতিবিধি খুব-একটা খারাপও বলা যাচ্ছে না।
বিদ্যাধর সাউকে এজেন্ট হিসাবে ফাইনালি সেটল করে গ্রামের নদীপথে হেঁটেই ফিরছিলাম ট্রেকার ধরব বলে। এখান থেকে ট্রেকারেই ফিরতে হবে ডরমেটরিতে। এমন সময় খুব চেনা নুয়ে পড়া এক বৃদ্ধের দিকে চোখ আটকে গেল। নদীর পাড়ে ঘাসের উপর বসে আপনমনে খৈনি বানাচ্ছে। চকিতে মনে পড়ে গেল রামদীন কাকার কথা। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম।
~ রামদীন কাকা !
ঘোলাটে চোখে একবার দেখল। তারপর চোখ সরু করে অনেকক্ষণ আমার হাসি হাসি মুখ দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। 
~ ছোটো খোকা ?
~ তাহলে চিনতে পেরেছ ? কতদিন পরে দেখা। 
আমাকে জড়িয়ে ধরল কাকা। পিঠে হাত বুলিয়ে দিল বেশ খানিকক্ষণ। তারপর বলল, চ বেটা, আমার ঘর চল।
~ কোথায় তোমার বাড়ি ?
~ আয় বেটা, আয়।
দু-পা এগোতেই রামদীন কাকার ভাঙাচোরা বাড়িতে এলাম। খাটিয়ায় বসে অনেক কথা হল। চা-মুড়ি খেলাম। তারপর কাকার পীড়াপীড়িতে সেই রাতে থেকেও গেলাম সেখানে। আমি একা থাকি। আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করেও থাকে না। তাই থেকে যেতে কোনো অসুবিধাই হয়নি। চাঁদের আলোয় দরমার বেড়া আর টালির চালের ঘরে খাটিয়ায় শুয়ে অনেক রাত পর্যন্ত কাকার সঙ্গে নানা গল্প হল। আমার বাবা-কাকাদের কথা জিজ্ঞাসা করল না একবারও। বুঝলাম এখনো অভিমান রয়ে গেছে রামদীন কাকার। এবং এটাই স্বাভাবিক। আমি তাই আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে চাইনি বাড়ির কারও কথা। একবার আমার মায়ের কথা জানতে চাইল।
~ হ্যাঁরে বেটা, কেমন আছে পুষ্পা বউ ?
~ মা ভালোই আছে কাকা। শুধু সাইটিকার ব্যথাটা মাঝে মাঝে বাড়ে।
মাকে এই নামেই ডাকত কাকা। আমার বাবার থেকে মাস ছয়েকের ছোটো রামদীন কাকা। বাবাকে মেজদাদা, জ্যেঠামশাইকে বড়োবাবু আর কাকাকে প্রশান্ত ভাই বলে ডাকত। জ্যেঠিমাকে বলত বড়ো বউদি, মাকে পুষ্পা বউ, কাকিমাকে মণি বউ এইসব নামে ডাকত। 
~ তোর মায়ের কি আমার কথা মনে আছে বেটা ?
~ কী বলছ কাকা ? মনে থাকবে না ? আমাদের সবাই তোমাকে মনে রেখেছে।
কথাটা বললাম বটে, কিন্তু নিজেই জানি এর সবটা সত্যি নয়। আমরা কেউই সেভাবে রামদীন কাকাকে মনে রাখিনি। আমার কথা শুনেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না কাকার। চোখটা উপরের দিকে তুলে কী যেন খুঁজছে এমনভাবে টালির চালার দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ।
তবে আশেপাশের লোকজনদের কথা আর আমার ছোটোবেলার ডানপিটে স্বভাবের গল্প বলে গেল নানা কথার ফাঁকে ফাঁকে। নিজেই বলছে আর জোরে হেসে উঠছে। মাঝে মাঝে সেই হাসির দমকে হাঁফ ধরে যাচ্ছে। একটু থেমে আবার পুরনো দিনের গল্পের ঝাঁপি খুলে বসছে কাকা। 
ঘোমটার আড়ালে থাকা চাচি একটাও কথা বলেনি। দু-একবার সামান্য হাসির শব্দ শুনতে পেরেছি শুধু। কাকার স্ত্রীকে কেন যেন কাকিমা নয়, চাচি বলেই সম্বোধন করতাম আমরা। যদিও কখনো দেখিনি তাকে, তবে তার প্রসঙ্গ এলে এইভাবেই বলতাম। আসলে কাকা ছিল একেবারে বাঙালি ঘরের লোকের মতো। কিন্তু চাচি বা তার ছেলেরা তো তা ছিল না !
কাকার কাছে শুনলাম ছেলেরা বহুদিন হল কলকাতায় থাকে। এখানে শুধু এরা দুজনই থাকে। সামান্য জমিজিরেতে চাষাবাদ করে দিনগুজরান হয়। আর কোন এক বাবু নাকি মাসে মাসে টাকা পাঠায়। সেই বাবুটির সম্পর্কে অবশ্য আমি কিছু জিজ্ঞাসা করিনি। কী দরকার ব্যক্তিগত সাহায্যের কথা জিজ্ঞাসা করে, আমি যখন নিজেই সাহায্য করার কথা ভাবতে পারছি না।
রামদীন কাকার পরিচয়টা এখনো দেওয়াই হয়নি। আমাদের যখন একান্নবর্তী পরিবার ছিল, বিরাট বাড়ি, বিরাট সংসার, সেই সংসারে ছিল সাত-আটটা গোরু। রামদীন কাকা সেই গোরুর দেখভাল করত। আমার জন্মের কয়েকবছর আগে থেকেই রামদীন কাকা আমাদের বাড়িতে থাকে। ঠাকুরদার ব্যবসার সূত্রে আমাদের বাড়িতে তার আগমন। ছোটোবেলা থেকেই রামদীন কাকাকে দেখেছি অতি যত্নে দুধ দোয়ানো, গোরুগুলিকে স্নান করানো, বিচালি কাটা, খাওয়ানো, গোবর জড়ো করে ঘুঁটে দেওয়া এইসব করতে। বাজারহাটও করত বাড়ির। শুধুমাত্র ছট পুজোয় ‘দেশের বাড়ি’ যেতে দেখেছি কয়েকদিনের জন্য। 
আমরা একে একে খুড়তুতো, জেঠতুতো ভাইবোনেরা বড় হলাম। একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যে দেওয়াল উঠতে লাগল ছোটো ছোটো। একসময় ভাগাভাগিও হল। জমিজমা, বাড়ি, বিষয়সম্পত্তি। ভাগ হল না গোরুগুলো। সেগুলো বিক্রিবাটা করে টাকাপয়সা ভাগবাটোয়ারা হয়ে গেল। স্বভাবতই রামদীন কাকার আর প্রয়োজন রইল না। 
বাবা-কাকারা আর আমরা সাধ্যমতো কিছু টাকাপয়সা একসাথে করে রামদীন কাকার হাতে তুলে দিলাম। ছাতরার কোনো একটা জায়গায় ‘দেশের বাড়ি’ জানতাম। কিন্তু কোথায় তার বাড়ি সেই ঠিকানা বা খোঁজখবর নেওয়ার প্রয়োজন হয়তো মনে করিনি কেউ। প্রায় ভুলেই গেলাম রামদীন কাকার কথা। আজ প্রায় বারো-তেরো বছর পর কাকাকে দেখে বুকের মধ্যে রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ শুনতে পেলাম। কত কথা, কত গল্পগাছা সেই বৃষ্টির সঙ্গে মিশে যেতে লাগল।
(২)
কোম্পানি আমাকে সম্প্রতি একটা বাইক দিয়েছে কাজের জন্য। বাইকের ধুলো উড়িয়ে কয়েকবার এখান দিয়ে যাতায়াত করেছি, কিন্তু কাকার বাড়িতে মাত্র আর-একবারের বেশি ঢোকা হয়নি। কেননা আমি এখানে এলেই সময় নষ্ট হয়। এখন আমার অনেক উঁচুতে উঠতে হবে যে ! 
আমাদের কোম্পানি বিস্কুটের পাশাপাশি প্যাকেট কেক, স্ন্যাক্সের ভ্যারাইটি ইত্যাদি লঞ্চ করবে ঠিক করেছে। তাই জরুরি তলব পেয়ে কলকাতার হেড অফিসে যাওয়ার আগে একবার দেখা করতে এলাম। দেখলাম শয্যাশায়ী কাকা বিছানার সঙ্গে প্রায় মিশে গেছে। 
চোখের ঘোলাটে দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর হালকা হাসির ঝিলিক খুঁজে পেলাম অজস্র আঁকিবুঁকি কাটা সেই মুখের রেখায়। সংক্ষেপে জানালাম অফিসের কাজে কলকাতায় যাচ্ছি। সেইসঙ্গেই বললাম, নিজেদের বাড়িতেও যাব একরাতের জন্য। অল্পই কথা বলল কাকা। যেটুকু বলতে পারল, তাতেই যেন কষ্ট হচ্ছিল খুব। 
~ তোমার কী খেতে ইচ্ছে করে কাকা ?
~ ছাতু। তোদের বাড়ির পাশের নকুলবাবুর দোকানের ছাতু আনবি আমার জন্য ?
~ নিশ্চয়ই আনব। আর কী ইচ্ছে করছে বলো ?   
~ আর কিছু না। 
প্রথমে হেড অফিস, তারপর পুরনো জায়গা বর্ধমানে কিছু কেক আর স্ন্যাক্সের স্যাম্পেল বিলি করে প্রায় দিন কুড়ি পরে ফিরলাম ঝাড়খন্ডের বর্তমান ঠিকানায়। তারও ক’দিন বাদে রামদীন কাকার বাড়ি এলাম। 
~ রামদীন কাকা, ও রামদীন কাকা ?
কোনো সাড়া নেই। ঘোমটার আড়ালে থাকা চাচি খানিক বাদে বেরিয়ে এলো। মুখে কোনো শব্দ নেই। বিরাট ঘোমটার ফাঁক দিয়ে একবার আমাকে দেখল। তারপর পিছন ফিরে দাঁড়াল আর চাচির পিঠটা কেঁপে কেঁপে উঠছে দেখলাম। 
একটা আধময়লা প্যান্ট পরা খালি গায়ে ছোট্ট ছেলে পাশের বাড়ি থেকে ছুটে এসে আমার বাইকের পাশে দাঁড়াল। তাকেই জিজ্ঞাসা করলাম, রামদীন কাকা কাহাঁ রে বাবুয়া ? 
আকাশের দিকে আঙুল তুলে বলল, “উঁহা।” কাকার বর্তমান ঠিকানা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। চাচির থেকে কোনো সাড়া না-পেয়ে ছেলেটা আর তার বাবার থেকে খবর নিলাম দিন পনেরো আগেই কাকা মারা গেছে। 
আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম লাল রঙের সূর্যটা ক্রমশ ঢলে পড়ছে। কয়েকটা কেকের প্যাকেট এনেছিলাম সঙ্গে। একটা ছেলেটার হাতে দিলাম আর বাকি কেকগুলো উঠোনে পাতা খাটিয়ায় রেখে এলাম নিঃশব্দে। তার পাশে রাখলাম ছাতুর ঠোঙা। তারপর ধুলো উড়িয়ে বাইক নিয়ে ফিরে এলাম নিজের আস্তানায়। ফিরেই বাবাকে জানালাম কাকার মৃত্যুসংবাদ। ফোনের ওপারে খানিক নিস্তব্ধতার পর বাবা বলল, তোর মাকে কিছু বলার দরকার নেই, যা বলার আমিই জানাব ধীরেসুস্থে। আমি একথার কোনো মানে খুঁজে পেলাম না। এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহও দেখালাম না আর। 
(৩) 
বাড়ির প্রতি আমার টান বরাবরই একটু কম। সেলসে চাকরি নেওয়ার পরে তো আরোই কমে গেল। নিজের কাজ আর ক্যারিয়ার নিয়েই ব্যস্ত থাকতে ভালো লাগে আমার। আসলে আমাদের একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাওয়ার পর থেকেই কেমন যেন সব ছাড়া ছাড়া ভাব। বাউন্ডুলে স্বভাবের আমার তো আরোই বেশি হল।
মা বারবার ফোন করে বলে বাড়িতে আয়, খুব দরকারি কথা আছে তোর সঙ্গে। আমি এড়িয়ে যাই। কেননা আমি জানি মায়ের বিশেষ দরকারটা কী। কখনো বলে বকুলতলায় একটা ভালো মেয়ের সন্ধান পেয়েছি। একবার দেখে আয়। আর কতদিন এভাবে কাটাবি ? কিংবা বলবে তোর পিসির দেওরের এক বন্ধুর মেয়েটাকে দেখলাম রূপ। তোর সঙ্গে খুব মানাবে। আমি আপাতত বিয়ে করতে রাজি নই। আমার পাখির চোখ এখন এরিয়া ম্যানেজার হওয়া। 
কিন্তু কত আর কাটানো যায় ? অবশেষে মাস ছয়েক বাদে বাড়িতে এলাম। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে বিছানায় গড়িয়ে নিয়ে বিকেলের চা খেয়ে আড্ডার ঠেকে যাই এখানে থাকলে। আমি তখন বিছানায় শুয়ে। মা চা দিয়ে আমার পাশে বসল। তারপর খুব ধীর গলায় বলল, একটা কথা রাখবি রূপ ? আমি জানি এবারই বিয়ের প্রসঙ্গ তুলবে। তাই চুপ করে রইলাম।
~ একবার গয়ায় যাবি ?
~ কেন ?
~ রামদীনের পিণ্ডটা দিয়ে আয় তুই। ওর আত্মার শান্তি হোক। বাবা জবাব দিল।
~ আমি ? ওর ছেলেরা থাকতে আমি কেন দেবো ? কী বলছ বাবা এসব ? 
~ ছেলের কর্তব্য করবি তুই।
কথাটা বলেই বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মা তার আগেই বেরিয়ে গেল দেখলাম। আমার মাথাটা কেমন যেন জট পাকিয়ে গেল। রামদীন কাকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী ? ছেলের কর্তব্য বলতে বাবা কী বোঝাল ? তবে কি যাকে আমি বাবা ডাকি সে আমার আসল বাবা নয় ? রামদীন কাকাই আমার... । আর কিছু ভাবতে পারছি না আমি, সব কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আমার। 
সন্ধ্যার খানিকটা পরে তারায় ভরা ছাদে উঠে এলাম একা একা। ছোটোবেলা থেকে রামদীন কাকা আর বাবার আচরণের মিল-অমিল খুঁজতে থাকলাম মনে মনে। কখন যে বাবা আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি।
~ যদি পারিস এই অক্ষম বাপটাকে ক্ষমা করিস রূপ। অনেক ডাক্তারি পরামর্শের পর যখন বুঝলাম আমিই অক্ষম, তোর মায়ের কোনো দোষ নেই, তখন এ ছাড়া আমার সামনে আর কোনো পথ ছিল না বাবা। একটা কোল আলো করা ছেলের সুখ পেতে চেয়েছিলাম আমরা দুজনে। বল তুই, খুব কি বেশি ছিল সেই চাওয়া ? 
অন্ধকারে বাবার মুখ দেখতে পারছিলাম না আমি। কিন্তু গলার শব্দ শুনে উথালপাথাল সমুদ্রের ঢেউ দেখতে পাচ্ছিলাম। বাবাকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে ফেললাম আমি।
আকাশ থেকে তখন রাশি রাশি নক্ষত্রমালা সারা ছাদে ঝরে পড়তে থাকল, অবিরাম।  

ছবি কৃতজ্ঞতা স্বীকার: Cesar Legaspi

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন