প্রথম পর্বের পর
আহমেদ ফরাজের জীবন ও কবিতা
.............................. .............................. .............................. .......
‘অব কে বিছড়ে হ্যায় তো শায়দ কভি খ্বাবোঁ মে মিলে
‘ জিস তরহ সুখে হুয়ে ফুল কিতাবোঁ মিলে
আহমেদ ফরাজ, একদিকে যেমন পাকিস্তানের শ্রেণীবৈষম্য, একের পর এক সামরিক অভ্যুত্থানে নষ্ট হতে থাকা গণতন্ত্রের জন্য ‘আওয়াজ বুলন্দ’ করেছিলেন, অন্যদিকে একইভাবে লিখে গেছেন তাঁর বিখ্যাত গজলগুলি। লিখেছেন অজস্র ‘নজ্ম’ যা গদ্যকবিতার কাছাকাছি একধরণের আঙ্গিক। কখনো দেশবাসীর উদ্দেশ্যে লিখছেনঃ
‘খ্বাব মরতে নহি
খ্বাব দিল হ্যায়, না আখেঁ, না শ্বাসেঁ যো
রেজা রেজা হুয়ে তো বিখর জায়েঙ্গে
জিস্ম কে মৌত সে ইয়ে ভি মর জায়েঙ্গে..’
(স্বপ্ন মরেনা
স্বপ্ন তো হৃদয়, সপ্ন চোখ নয় অথবা নিশ্বাস
যে টুকরো টুকরো যদি হয় তো ছড়িয়ে পড়বে
মরে যাবে মৃতদেহের সঙ্গে )
কখনো সেই মৃত্যুর আরেক চেহারা দেখছেন বিষাদের অপরিমেয় স্তব্ধতা নিয়েঃ
‘গম-এ-হায়াৎ কা ঝগড়া মিটা রহা হ্যায় কোই
চলে ভি আও কে দুনিয়া সে যা রহা কোই
#
আজল সে কহে দো কে রুক যায়ে দো ঘড়ি
শুনা হ্যায় আনেকা ওয়াদা নিভা রহা হ্যায় কোই
#
ও ইস নাজ সে বয়ঠা হ্যায় লাশ কে পাস
জ্যায়সে রোতে হুয়ে কো মনা রহা হ্যায় কোই
#
পলট কর না আ যায়ে ফির সানা নব্জোঁ মে ‘ফরাজ’
ইতনে হাসীন হাথোঁ সে মইয়ত সজা রহা কোই’
#
(দুঃখ এবং জীবন নিয়ে করেই যাচ্ছ ঝগড়া তুমুল
কেউ যে এদিকে মরতে বসেছে, ফেরৎ এসো, আসছো ফেরৎ?
#
সময়, আরো একটু দাঁড়াও, অল্প সময় চাইছি তোমার
শুনেছি সে ফিরেই আসছে, চেষ্টা করছে কথা রাখবার
#
এসেছে, আর কি অপূর্বতায় বসেছে শান্ত লাশের পাশে
মনে হচ্ছে, কান্না মুছিয়ে অভিমানগুলো সরিয়ে দিচ্ছে
#
এমন ছোঁয়া! আবার ফরাজ ফিরে যেওনা ফালতু লেখায়
সাজিয়ে তুলছে মৃত তোমাকেই যখন মিষ্টি হাতের মায়া)
#
প্রেম আর সামাজিক সংলগ্নতা, বিষাদ আর দ্রোহের মিশ্রণে গড়ে উঠেছে ফরাজের কবিতাজগৎ!জিয়াউল হকের সময় বাংলাদেশে পাক বাহিনির অত্যাচার এবং সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়ে ওঠায় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার করার কারণ হিসেবে দেখানো হয় কোন একটি মুশায়রায়(কবিতাপাঠের আসর)তিনি ‘হুকুমত’-এর বিরুদ্ধে ‘শের’ পড়েছেন।ওইসময় ছ’বছর তিনি দেশান্তরে থাকেন।ব্রিটেন,কানাডা এবং ইওরোপের বিভিন্ন জায়গায় ভ্রাম্যমান ফরাজ কবিতাকে আশ্রয় ক’রে তোপ দাগতে থাকেন সামরিক একনায়ক জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে।তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘মুহাসারা’(অবরোধ)এই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতেই লেখা।তিনি স্বৈরাচারী শাসকের পরোয়া না ক’রে লেখেনঃ
ম্যায় কাট গিরুঁ কে সলামত রহুঁ ইয়াকিন হ্যায় মুঝে
কি ইয়ে হিসারে সিতম কোই তো গিরায়ে গা
তমাম উম্র কি ইজা-নসিবিয়োঁকি কসম
মেরে কলাম কা সফর রহেগা না জায়েগা
#
সরিস্ত-এ-ইশ্ক নে উফ্তাদগি নহি পাই
তো কদ-এ-সারভ নে বিনি ও সায়া পায়মায়ি
(ভাল থাকি বা খুন হয়ে যাই, বিশ্বাস শুধু আছে
এই অত্যাচারীর দুর্গ কেউ ভেঙে দেবে একদিন
জীবন, আমি শপথ নিচ্ছি যাবতীয় দুর্ভাগ্যের
আমার লেখা থামবে না আর ঝুঁকবে না কোনদিন
#
মর্ষকামীর ইচ্ছে কখনো টিঁকবেনা দুনিয়ায়
গাছের ছায়ায় হেঁটে চলে যাবে ভালবাসা দৃঢ় পায়..)
#
ফরাজের রাজনৈতিক অবস্থান বামপন্থী ছিল।কিন্তু অফিসিয়াল বামদলগুলি পাকিস্তানে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে এবং বিলীন হতে থাকে স্বৈরাচার বিরোধী পাকিস্তান পিপলস পার্টির সঙ্গে। জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে থাকা ফরাজ জুলফিকার আলি ভূট্টো’র ঘনিষ্ঠ হলেও বাংলাদেশের ঘটনায় ভূট্টোর বিরোধীতা করতে পিছপাও হননি।আহমেদ ফরাজ ‘ইকবাল’ আর ‘ফয়েজ আহমেদ ফয়েজে’র পরে পাকিস্তানে প্রায় ‘কাল্ট ফিগার’ হয়ে ওঠেন।পাকিস্তানের নানাবিধ সাংস্কৃতিক পদ তিনি অলঙ্কৃত করেছেন, আবার ছেড়েও দিয়েছেন। ১৯৭৬ সালে ফরাজকে পাকিস্তানের একাডেমি অফ লেটারসের প্রথম ডিরেক্টর হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৯৮৯-৯০ সালে এখানেই চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব সামলেছেন। তাঁর শেষ সরকারী পদ ছিল পাকিস্তানের ন্যাশনাল বুক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানশিপ, তবে তাঁকে নিয়ে মাথাব্যথা লেগেই থাকতো সরকারের। পারভেজ মুশারফের বিরোধীতা ক’রে ফরাজ ২০০৬ সালে পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ সিভিলিয়ান সম্মান ‘হিলাল-এ-ইমতিয়াজ’ ফিরিয়ে দেন। প্রত্যাখানের পরে দেওয়া তাঁর বিবৃতি এখনকার ভাষায় ‘ভাইরাল’ হয়ে যায়ঃ
‘My conscience will not forgive me if I remained a silent spectator of the sad happenings around us,...the last I can do is to let the dictatorship know where it stands in the eyes of the concerned citizens, whose fundamental rights have been usurped’
#
আহমেদ ফরাজ তাঁর অসাধারণ গজলের জন্য ভারতেও সুপরিচিত ছিলেন।মেহেদি হাসান। গুলাম আলি যেমন তাঁর গজল গেয়েছেন,লতা মঙ্গেশকর, জগজিৎ সিং-এর কণ্ঠেও তাঁর লেখা গজল উঠে এসেছে। ফরাজের বোহেমিয়ান জীবনযাপন বিখ্যাত ছিল পেশোয়ারে। তিনি পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়েই লেকচারার হিসেবে যোগ দেন। তাঁর একটি প্রবল গর্জনওয়ালা বাইক ছিল।পেশোয়ার খাইবার পর্বতমালার ফুটহিল শহর হওয়ায় সৌন্দর্যে কোন খামতি ছিলনা। ফরাজের নেশা ছিল পান আর সিগারেটের।চেন স্মোকার ছিলেন। তো, ওঁর স্থায়ী দোকান থেকে পান মুখে দিয়ে, সিগারেট ঠোঁটের কোনে ঝুলিয়ে ফরাজকে দেখা যেত প্রবল বেগে কোথাও যাচ্ছেন, যেন খুব জরুরী কাজ আছে তাঁর। অন্যমনস্ক ছিলেন পুরোদস্তুর।মৃত্যুর কয়েকবছর আগে ফরাজ ওয়াশিংটন ডি.সি. তে একটি অনুষ্ঠানে বিনা সিগারেটে প্রায় সারারাত মুশায়েরা ক’রে সিগারেটে খাওয়ার টানে নিজের ঘরের দিকে দৌড় দেন। ঘর আর চিনতে পারেন না। যে রুম নাম্বার বলেন, সেখানে চাবি ঢোকেনা। পরে দেখা যায় তিনি অন্য একটি হোটেলে এসে এসব ক’রে যাচ্ছেন। সারাজীবন ধরেই ভারত পাকিস্তানের বন্ধুত্বের জন্য কাজ করে গেছেন। তাঁর লেখা এই বিখ্যাত ‘শের’ এই দুই প্রতিবেশী দেশের জন্যই নিবেদিতঃ
‘অব কে বিছড়ে হ্যায় তো শায়দ কভি খ্বাবোঁ মে মিলে / জিস তরহ সুখে হুয়ে ফুল কিতাবোঁ মিলে..’ আহমেদ ফরাজের জীবনাবসান হয় ২৫ শে অগাস্ট, ২০০৮ সালে। কবির অবসানে কবিতা অবসৃত হয়না। থেকে যায়, থেকেই যায়, আহমেদ ফরাজের মত সংবেদনশীল মানতাবাদী কবিরা!তো, পড়ে ফেলা যাক, আহমেদ ফরাজের কিছু নজম এবং গজলের ভাবানুবাদ।
#
১.
বুঝি নজর তো করিশ্মে ভি রোজো শব কে গয়ে
কে অব তলক নহি পলটে হ্যায় লোগ কবকে গয়ে
করেগা কৌন তেরি বেওয়াফাইয়োঁ কা গিলা
এহি হ্যায় রশমে জমানা তো হম ভি কবকে গয়ে
মগর কিসিনে হমে হমসফর নহি জানা
ইয়ে আউর বাত কে হম সাথ সাথ সবকে গয়ে
অব আয়ে হো তো ইহাঁ কেয়া হ্যায় দেখনে কে লিয়ে
ইয়ে শহর কবসে হ্যায় বিরান উও লোগ কবকে গয়ে
গিরফ্তা দিল থে মগর হৌসলা নহি হারা
গিরফ্তা দিল থে মগর হৌসলে ভি অবকে গয়ে
তুম আপনি শমে-তমান্না কো রো রহে হো ‘ফরাজ’
ইন আঁধিয়োঁ মে তো প্যারে চিরাগ সবকে গয়ে
.............................. .............................. .....
ভাবনুবাদঃ
চোখ বুঁজলেই অবাকহারা ভাবনা যাচ্ছে দিন ও রাতের
পাল্টে যায়নি মুখচ্ছবি সেই কবেকার আয়না পেয়েও
#
বিশ্বাসঘাতী তোমার সঙ্গে হারিয়ে গেছে ভরসা আমার
এটাই যখন নিয়ম তখন আমিও চলে যাচ্ছি তবে
#
চেয়েছি আমিও সঙ্গী হতে কিন্তু পাইনি সঙ্গী কোনও
অথচ সবার সঙ্গে ছিলাম, যেমন তেমন সব যাওয়াতেই
#
আবার এসেছো, কি আছে এখন, কি আর তোমায় দেখাবো বলো
এ শহরে আর থাকেনা কেউই, সব ফাঁকা ফাঁকা সব নির্জন
#
স্তব্ধ হৃদয়, হারিনি শধু ভরসা রেখেছি কিভাবে যেন
স্তব্ধ আমার হৃদয় কিন্তু হারিয়ে গেল নির্জনতায়
#
কাঁদছো ফরাজ , নিভে গেছে ব’লে নিজস্ব এক আলোর শিখা
আঁধি আর ঝড়ে সব নিভে গেছে সমস্ত আলো, কেন দেখলে না..
#
২.
ফরাজ, অব কোই সৌদা কোই জুনুন ভি নহি
মগর করার সে দিন কট রহে হো ইয়ুঁ ভি নহি
লব-ও-দহন ভি মিলা গুফ্তগুকা ফন ভি মিলা
মগর জো দিল পে গুজরতি হ্যায় কহে সকুঁ ভি নহি
মেরি জুবাঁকি লুক্নত সে বদগুমা না হো
যো তু কহে তো তুঝে ওম্র ভর মিলুঁ ভি নহি
‘ফরাজ’ জ্যায়সে কোই দিয়া তুর্বত-এ-হাওয়া চাহে হ্যায়
তু পাস আয়ে তো মুমকিন হ্যায় ম্যায় রহুঁ ভি নহি
.............................. .............................. .........
ভাবানুবাদঃ
ফরাজ, কেনাবেচা শেষ, ইচ্ছেও গেছে ফুরিয়ে
ভাল আছি খুব, এ কথাও বলা যাবেনা
ভাষা আছে, আছে প্রকাশের যত বাহানা
আমি ভাল নেই বোঝাবো কিভাবে কি দিয়ে
#
আমার কথায় কিবা আসে যায়, যদি
তুমি না বলো, দূরে চলে যাবো ঠিকই
#
আমি কথা বলি সে কথার দোষে যেন
একটি আঁচড়ও না লাগে অধরা তোমার
#
যদি এসে পড়ো এমনিই কোনদিন
দেখবে যেভাবে মোমের আলো গায়ে ঢেলে নেয় নিজেই মৃত্যু-হাওয়া
আর নিভে যায় একা একা
ফরাজও কোন আসন্ন হাওয়ায় নিভে গেছে তেমনই
সে কি ডেকেছিল, সে কি তোমাকেই ডেকেছিল...
#
৩.
উস সখ্স সে বস ইতনা সা তাল্লুক হ্যায় ফরাজ
ও পরেশাঁ হো তো হমেঁ নিঁদ নহি আতি
.............................. .....................
ভাবানুবাদঃ
ওর সঙ্গে এভাবেই জুড়ে আছি, ‘ফরাজ’
ওর কষ্ট হলে আমার ঘুম আসেনা
#
৪.
বরবাদ করনে কে আউর ভি রাস্তে থে ‘ফরাজ’
না জানে ওনহে মুহব্বত কা হি খয়াল কিঁউ আয়া
.............................. .............................. ..
ভাবানুবাদঃ
আমায় বরবাদ করার তো অনেক রাস্তাই খোলা ছিল, ‘ফরাজ’
কেন কে জানে ওর মনে পড়েছিল ভালবাসার কথা
#
৫.
তু ভি তো আইনে কি তরহ বেওয়াফা নিকলা ‘ফরাজ’
যো সামনে আয়া ওসি কা হো গয়া
.............................. .............................. .....
ভাবানুবাদঃ
তুমিও তো আয়নার মত অবিশ্বস্ত, ‘ফরাজ’
যে সামনে এল, তারই হয়ে গেলে
#
৬.
ওসনে মুঝে ছোড় দিয়া তো কেয়া হুয়া ‘ফরাজ’
ম্যায়নে ভি তো ছোড়া থা সারা জমানা উসকে লিয়ে
.............................. .............................. .........
ভাবানুবাদঃ
ও আমায় ছেড়ে চলে গেছে তাতে কী ‘ফরাজ’
আমিও তো পুরো দুনিয়া ছেড়ে এসেছিলাম ওর জন্য
#
৭.
অকেলে তো হম ভি জী রহে থে ‘ফরাজ’
কিউঁ তন্হা সে হো গয়ে তেরে জানে কে বাদ
.............................. .............................. ............
ভাবানুবাদঃ
একা তো আমি আগেও ছিলাম, ‘ফরাজ’
কেন একাকী হয়ে গেলাম তুমি চলে যাওয়ার পরেই
#
৮.
কুছ এয়সে হাদসে ভি জিন্দেগি মে হোতে হ্যায় ‘ফরাজ’
কে ইনসান তো বচ যাতা হ্যায় মগর জিন্দা নহি রহতা
.............................. .............................. ..............
ভাবানুবাদঃ
এমন কিছু দুর্ঘটনাও জীবনে হয়ে থাকে, ‘ফরাজ’
মানুষ বেঁচে থাকে কিন্তু জীবিত থাকেনা
.............................. .............................. ..............................