পৃষ্ঠাসমূহ

পৃষ্ঠাসমূহ

রবিবার, ৩০ মে, ২০২১

জয়তী রায় ( মুনিয়া)

                                                    




অতীত, একটু কম কথা বলো।



        মুডসুইং নিয়ে কথা বলছিলাম। মুড অথবা আবেগের ওঠা পড়া অনেকটা নির্ভর করে অতীত চারণার মধ্যে। অতীতের সুখময় দিন অথবা দুঃখের স্মৃতি মানুষকে নিঃস্ব করে তোলে। কত সুখে ছিলাম অথবা কত দুঃখে ছিলাম... এই বোধ থেকে আসে হতাশা। মন খারাপ। কিটকিট। ভালো না লাগার প্রকোপ বাড়তে থাকে। 

 আজকের আলোচনার বিষয় 

  অতীত। 

     ❤️অতীত নিয়ে আমার বাবা খুব  সতর্ক ছিলেন। মানসিক ভোগান্তির একটা মূল কারণ পিছন ফিরে দেখা সে বিষয়ে বারবার বলতেন। তখন আমার দশ / এগার বছর বয়স। বাবা একদিন নিয়ে গেলেন বাগানে। মাটিতে দুটো  গর্ত খুঁড়ে , একটিতে রাখলেন  ছোলাবীজ অপরটিতে তরকারির খোসা ডিমের খোলা ইত্যাদি। দিনচারেক পরে বললেন: চল, অতীতের ফলাফল দেখে আসি। যে গর্তে বীজ ছিল, তার উপরে ছোট ছোট সবুজ পাতা আর যেখানে আবর্জনা ছিল সেখানে দুর্গন্ধ। অমূল্য একটা শিক্ষা। অতীত থাকবে। কিন্তু, দুর্গন্ধ সৃষ্টি করতে পারে এমন কিছু পরিহার করাই ভালো। আজকে বহুমানুষ অতীতের করাল থাবার শিকার। অদ্ভুত ভাবে, মানুষ সুন্দরের চাইতে মনে রাখে খারাপ স্মৃতিগুলি।   যার ফলে মন খারাপ হয়। বরং, খারাপ স্মৃতি গুলি থেকে কিছু শিখে নেওয়া ভালো। সৃষ্টির সবুজ পাতা দুলবে। মেঘলা দুপুরে অতীত নিয়ে ভেবে কষ্ট না পেয়ে একটা বর্তমানের গান শুনে নিও। 

🔥🔥🔥বাবার শিক্ষা কতভাবে জীবনে কাজে লেগেছে, বলার মত না। মহিলা পুরুষ উভয়ের বিবাহের আগে এবং পরের জীবন সম্পূর্ন আলাদা। একেবারে অন্যরকম। সবদিক দিয়ে। নানা রকম ঝামেলা দায় দায়িত্ব ঘিরে ধরে চারিদিক থেকে। আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরো ভয়ানক হয়েছিল বিদেশ চলে যাওয়ায়। এমন কিছু মানুষের সঙ্গে থাকতেই হত, যারা ভারতীয় কিন্তু বাঙালী বিদ্বেষী। আমি ছিলাম একমাত্র বঙ্গললনা। এ যেন ক্ষুধার্ত নেকড়ের সামনে সুস্বাদু খরগোশ। তাদের টাইম পাস ছিলাম আমি। এমন ব্যবস্থা তারা করেছিল, যাতে আমি ব্যাংকক ছেড়ে যেতে বাধ্য হই। বিজনবাবু সারাক্ষণ ট্রাভেল করছেন। সেইসুযোগে  দিনরাত্রি অপমান। বাচ্চাগুলোকে নানা ভাবে উৎপীড়ন। সেই সময় মনের কানে ভেসে এলো বাবার উপদেশ: রাস্তার নোংরা ঘরে আনবি না। রাস্তার ধাক্কা ওখানেই ফেলে রেখে, ঘরে বসে আরাম কর। তুই পরম সুখী। রোজ নিজেকে ভালোবেসে যা। 

ছোট্ট কথা। বাইরের পরিস্থিতি যেন কোনো ভাবেই মনের স্থিতি নষ্ট না করে। অদ্ভুত ম্যাজিক ঘটল এর পরে। যত অপমান করে ততো আমি উজ্জ্বল হই। বাচ্চারা দারুণ রেজাল্ট করে। আমার ঝকঝক চুল। চকচক ত্বক। স্বামী স্ত্রী বেড়াতে যাই। ওরা হার মেনে গেল। 

  বাবা বলতেন: আমার মৃত্যুতে শোক করবে না। চেষ্টা করবে যে কাজে আমি খুশি হই, তাই করতে। 

সে কাজ হল, নিজের মনকে লাঠি বানাও। অবলম্বন করো। বাইরের আঘাতের সাধ্য কি, তোমাকে কষ্ট দেবে? 

এটাও অতীত চারণা বইকি! কিন্তু , সৃষ্টির সবুজপাতা দুলে ওঠে এতে। 

   অচেতনমন অনেক বেশি শক্তিশালী। অনেক বেশি জমিয়ে রাখতে পারে। অবচেতন মনে কোনো আইডিয়া ঢুকে গেলে , তা আমাদের সচেতন চিন্তাকে প্রভাবিত করে। অতীত বহু সময় ভয় দেখায়। আত্ম বিশ্বাস নষ্ট করতে উদ্যত হয়। 

সেজন্যে , অতীত থাকুক। কিন্তু তাকে বহন করতে হবে না। বর্জন নয়। বহন নয়। অতীত হোক একটা ঘটনা মাত্র। ক্যালেন্ডারের পুরনো পাতার মত। দরকার না হলে ছিঁড়ে ফেলে দেওয়া যেতেই পারে। 

 জীবন হল নৌকা। মন হল মাঝি। বিপদ সঙ্কুল নদীতে জীবন নৌকা সুন্দর করে বাইতে পারে দক্ষ মাঝি। যতই ঝড় আসুক, তুফান আসুক নাও নিয়ে মাঝি লড়ে যাবে শেষ পযর্ন্ত। কিন্তু অনভিজ্ঞ মাঝি? সে পারবে তীরে পৌঁছতে? লক্ষ্য স্থানে পৌঁছে যেতে ? পারবে না। তখন দোষ দিতে থাকবে পারিপার্শ্বিক খারাপ আবহাওয়ার। মন মাঝি  নিজেই দুর্বল, তৈরি হয়ে হাল ধরতে হয়, সে কথা মনে থাকে না। 

  আজ বাবার কথা মনে করছি। তিনি যে দর্শনের কথা  বলতেন, এখন বুঝি, সেগুলি নতুন কিছু না। আমরা সবাই সব জানি। শুধু মেনে চলি না। 

ধনী কে? এক সুন্দর মনের অধিকারী হল প্রকৃত ধনী।



অমিভাভ সরকার

                                                    



বেজন্মা (তৃতীয় পর্ব)


ব্যাকপ্যাক পিঠে চাপিয়ে বেরবার আগে একবার স্টেশনমাস্টারের সঙ্গে দেখা করে। ভদ্রলোকের জারিজুরিতে আরও একবার চা খেতে হয়। ভদ্রলোক কৃষাণের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে গেট পর্যন্ত এগিয়ে আসেন। মনে করিয়ে দেন, বাসস্ট্যান্ডে না গিয়ে যেন সিনেমাতলা থেকে বাস ধরে…।          

সিনেমাতলায় কিছুক্ষণ দাঁড়াতেই লাভপুর যাওয়ার বাস পেয়ে যায়। সকালে ভীড় নেই একদমই। কয়েকটি পরিবার ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোথাও পুজো দিতে চলেছেন মনে হলো। মেয়েদের হাতে পুজোর থালাও দেখতে পেল কৃষাণ। বাস কিছুদূর এগিয়ে একটা মোড়ে থামতেই হুড়মুড় করে তারা নেমে যেতেই জানলার পাশের সিটের সরে বসে কৃষাণ। সামনের সিটে বসা একজন প্রবীণ সহযাত্রীকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে, তারা পুজো দিতে যাচ্ছেন কংকালীতলা'য়।

“সতীর একান্ন পীঠের একপীঠ। এখানে সতীর কটিদেশ বা কোমরের অংশটি পড়েছিল। এই শক্তিপীঠের দেবী ‘গর্ভাদেবী’ নামে পূজিত হন সেখানে। মন্দির সংলগ্ন একটি কুণ্ড রয়েছে। কুণ্ডের মধ্যে কয়েকটি প্রস্থর খণ্ড আছে, যেগুলিকে সাধকরা দেবীর দেহের অংশ মনে করেন। এই প্রস্থর খণ্ডগুলি কুড়ি বছর অন্তর কুণ্ড থেকে তোলা হয়, পুজোর পর সেগুলিকে পুনরায় কুন্ডের জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। অনেকে বলেন, কঙ্কালীতলার কুন্ডের সঙ্গে কাশীর মনিকর্ণিকা ঘাটের সরাসরি সংযোগ আছে”।

সামনের দিকে ঝুঁকে মনযোগ দিয়ে শুনছিল কৃষাণ। মনযোগী শ্রোতা পেয়ে প্রবীণ ভদ্রলোক কৃষাণের পাশে এসে বসেন…।

“বীরভূমের ভূমি, ‘পূণ্যভূমি’। জানেন, একমাত্র এই বীরভূমেই আছে সতীর পাঁচটি শক্তিপীঠ, তা ছাড়া আছে বামাক্ষেপার সাধনপীঠ, তারাপীঠ…, জয়দেব…। এই মাটির টানেইছুটে এসেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ”।

গল্প শুনতে শুনতে বাইরের দিকে তাকায় কৃষাণ। দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ধানক্ষেতের মাঝে মাঝেকাশফুল যেন বিদায়ী শরতের ছোট ছোট সাদা মেঘ যেন নেমে এসেছে মাটিতে। সকালের সোনার ছটায় ছবির মতো দোচালা বাড়ির ছোট ছোট গ্রাম..., সব কিছুই যেন নতুন করে আবিষ্কার করে কৃষাণ। হিমেল বাতাস ঝাপটায় চোখ বুজে আসে তার। হঠাৎ হকারদের চিৎকারে সম্বিত ফেরে কৃষাণের। একটা গঞ্জের মতো জায়গায় থেমে আছে বাস। ভদ্রলোক বিদায় নেওয়ার সময় বলে গেলেন, “এসেছেন যখন, দর্শন করে যান। বলা যায় না আর সুযোগ পাবেন কিনা!” বাইরের দোকানের সাইনবোর্ড দেখে বোঝা গেল, জায়গার নাম ‘কীর্ণাহার’।   

স্টেশনমাস্টার বলেছিলেন, এই কীর্ণাহারের পরেই পরবে 'লাঘাটা ব্রিজ', যাওয়ার সময় বাঁ পাশে কোপাই নদীর তারাশঙ্করের বন্দোপাধ্যায়ের উপন্যাসের খ্যাত 'হাঁসুলীবাঁক'। কোপাই আর বক্রেশ্বরের মিলনক্ষেত্রে এই জমিন। পরস্পরের কাছে আসতে বাঁক নিতে হয়েছে বেশ কয়েকবার। এক কিলোমিটার যাত্রাপথে শেষে কোপাইকে কন্ঠহার হাঁসুলীর মত বাঁক নিতে হয়েছে। ঠিক যেন উপন্যাসের কাহার করালীর আর পাখি। তাদের মিলনেও বাঁক নিতে হয়েছে অনেকবার।

লাঘাটা ব্রীজ আসতেই জানলা দিয়ে মাথাটা বার করে তাকায় সেদিকে। দূর থেকে দেখে হরিত ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে রাজহাঁস গ্রীবার মতো এঁকেবেঁকে চলেছে কোপাই। নেমে পরবে কিনা ভাবতে ভাবতে বাস এসে থামে ‘লাভপুর’।        

সকাল থেকে চা আর দুটো বিস্কুট ছাড়া কিছুই খাওয়া হয় নি কৃষাণের। বাসস্ট্যান্ডে নেমে কিছু খাওয়ার জন্য এদিক ওদিক তাকাতেই একটা মিষ্টির দোকানে কচুরি ভাজতে দেখে সেদিকে এগিয়ে যায় কৃষাণ। কচুরি খেতে খেতে দোকানীর সঙ্গে আলাপ করে জেনে নেয় 'মনাচিতোর' গ্রামে যাওয়ার পথ, সেই সঙ্গে হোটেল বা লজের খোঁজখবর।      

লজে চেক-ইন করে সামরিক পোষাক ছেড়ে স্নান করে নেয় কৃষাণ। ব্যাকপ্যাক খুলে সাধারণ শার্ট-প্যান্ট বের করে পরে ফেলে। শামসুদ্দিনের দেওয়া শাড়িটা নিয়ে রুমের চাবিটা রিসেপশনে জমা রেখে বাইরে আসে।

বাকুল মোড় থেকে তিন কিলোমিটার সারি সারি তালগাছ আর খেজুর ঝোপের মাঝে লাল সুরকির পথ, এঁকেবেঁকে চলে গেছে মনাচিতোরের দিকে। একটু এগোতেই কাঁকুরে ডাঙ্গা জমির ওপর বেমানান কয়েকটি পাকা বাড়ি দেখে পথ চলতি মানুষকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারে সেটা অঙ্গনবাড়ি ট্রেনিং সেন্টার, একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চালায়। একদল মেয়েদের দেখতে পায় সেখানে। আর একটু এগোতেই মনাচিতোর গ্রাম। গ্রামে ঢোকার মুখে একটা পুরনো বটগাছ। তার নীচে ছোট্ট একটা শিবমন্দির। দু’একটি বাদ দিলে সবই মাটির বাড়ী। মাটির একতলা আর দোতলা বাড়ির গঠন প্রমাণ দেয় পরিবারের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ। গ্রামে ঢুকে একটু এগিয়ে যেতেই চারমাথা মোড়, সেখানে টিনের চাল দেওয়া একটা গোল চালাঘর। বাঁধানো মেঝের ওপর কয়েকজন প্রবীণবসে তাস খেলছেন। তাদের মধ্যে থেকে একজন ডাক দেন কৃষাণকে।          

“মশাইকে নতুন দেখছি! তা কী মনে করে…?” ভদ্রলোকের সাদা ধপধপে ধুতি, পাঞ্জাবি আর কথা বলার ঢঙ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, গ্রামের কেউকেটা হবেন তিনি। একটু ভেবে নেয় কৃষাণ…। সত্যি কথা বলা বোধহয় ঠিক হবে না। অন্য রকম মনে হতে পারে…।


(চলবে)

কাজল সেন

                                                       



 পুজোর ছুটি 

ছেলে-বৌমা ফোন করে জানিয়েছে, এবছর পুজোয় তাদের বাড়িতে আসা সম্ভব হবে না, কেননা ছুটি পায়নি। লিচুবাবু জানেন, কথাটা আংশিক সত্য। হ্যাঁ, একথা ঠিক যে, ছেলে-বৌমা দুজনেই চাকরি করে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। ব্যাঙ্গালোরে থাকে। এসব কোম্পানিতে ছুটিছাটা খুবই কম। তাছাড়া দুজনে আলাদা আলাদা কোম্পানিতে কাজ করে। একজন ছুটি পেলেও যে আর একজনও সেইসময় ছুটি পাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবু প্রত্যেক মা-বাবাই আশা করেন যে, অন্তত পুজোর ক’টা দিন ছেলেমেয়েরা ঘরে আসবে। লিচুবাবু ও তাঁর স্ত্রী সীমাদেবীও আশা করেন। কিন্তু ছেলে-বৌমা স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছে যে, যেহেতু লিচুবাবু ও লিচুবাবুর বেয়াইমশাই এই দুটি কোম্পানির মালিক নয়, তাই তাদের ছুটি মঞ্জুর হয়নি। আর ঠিক এইখানেই লিচুবাবুর সন্দেহ ও সংশয়। ছেলে-বৌমা কি সত্যি সত্যিই আবেদন জানিয়েছিল ছুটির জন্য? নাকি তারা ছুটি জমিয়ে রেখেছে শীতকালে কোথাও বেড়াতে যাবার জন্য? 


গতবছরও ঠিক তাই হয়েছিল। বিয়ের পর সেটাই প্রথম শারদ উৎসব। লিচুবাবু ও সীমাদেবী এবং তাঁদের বেয়াই-বেয়ান আশা করেছিলেন, ছেলেমেয়ে নিশ্চয়ইছুটি নিয়ে আসবে পুজোর দিনগুলোতে। আসার কথা তারা জানিয়েও ছিল। কিন্তু তারপর কী যে হলো, পুজোর দিনকয়েক আগে জানালো, না যাওয়া হচ্ছে না। ছুটি ক্যান্সেল হয়ে গেছে। হতাশাটা মুখ বুজে গিলতে হয়েছিল লিচুবাবুদের। কী আর করা যায়! চাকরি বলে কথা! সেখানে তো আর নিজেদের মনমৌজি চলে না! কিন্তু তার মাস দুয়েক পরেই ছেলে-বৌমা জানালো যে, তারা দুজনে দিন দশেকের ছুটি পেয়েছে অফিস থেকে। আর এই ছুটিতে গোয়া বেড়াতে যাচ্ছে। 


সুতরাং এবছরও যখন লিচুবাবু জানতে পারলেন যে, অফিস থেকে দুজনেই ছুটি পায়নি, তিনি অনুমান করার চেষ্টা করলেন, এবার শীতকালে কোথায় বেড়াতে যেতে পারে তাঁর ছেলে-বৌমা! 


সেদিন কথায় কথায় লিচুবাবু পাড়ার বুড়োদের আড্ডায় তাঁর মনোবেদনা প্রকাশ করে ফেলেছিলেন। এই বুড়োরা সবাই চাকরি থেকে অবসরপ্রাপ্ত। এক বুড়োর কথায় আড্ডার কয়েকজন বুড়ো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, তাঁদেরও একই মনোবেদনা। বাকিরা অবশ্য জানালেন, না, এবছর ছেলেমেয়েরা তাঁদের দয়া করেছে, পুজোর দিনগুলোয় তাদের গায়ের গন্ধ তাঁরা শুঁকতে পাবেন। এইকথা শুনে, যাঁরা ছেলেমেয়ের গায়ের গন্ধ এবছর শুঁকতে পাবেন না, তাঁরা মুখে আনন্দ প্রকাশ করলেও মনে মনে বিষণ্ন হলেন। আর এই বিষণ্নতায় পরের দিন আড্ডায় বুড়োদের দুটো গ্রুপ তৈরি হলো। প্রথম গ্রুপ, যাঁরা এবছর পুজোয় ছেলেমেয়ের গায়ের গন্ধ শোঁকার সুযোগ পাবেন, তাঁরা নিজেদের মধ্যে মশগুল হয়ে পড়লেন নিজের নিজের ছেলেমেয়ের মাহাত্ম্য বর্ণনায়। আর দ্বিতীয় গ্রুপ, যাঁরা এবছর ছেলেমেয়ের গায়ের গন্ধ শোঁকা থেকে বঞ্চিত, তাঁরা নিচুস্বরে শলা পরামর্শ করতে লাগলেন, কীভাবে প্রথম গ্রুপের বুড়োদের টাইট দেওয়া যায়। এমন কিছু একটা করতে হবে, যাতে দ্বিতীয় গ্রুপের বুড়োরা দেখিয়ে দেবেন, ছেলেমেয়ে পুজোর ছুটিতে না এলেও কুছ পরোয়া নেই। তাঁরা নিজেরাই প্রত্যেকে একাই একশ। আর ঠিক তখনি লিচুবাবু প্রস্তাবটা দিলেন, চলুন না, আমরা সবাই দার্জিলিং বেড়াতে যাই!

শর্মিষ্ঠা দত্ত

                                                                  



খোঁজ 


(৬)

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি কিছু বিত্তবান মানুষের বাড়ির ছাদে টেলিভিশনের অ্যান্টেনা দেখা যেতে শুরু করল l শর্মিলাদের নিম্ন মধ্যবিত্ত পাড়ায় টেলিভিশন নামক বস্তুটি তখনও  বিরল l শর্মিলা প্রথম টেলিভিশন  দেখেছিল সাগরিকাদের বাড়িতে l এক শনিবার বিকেলে গানের ক্লাসে যেতেই সাগরিকা ফিসফিস করে বলল, 

 --জানিস তো আমাদের বাড়িতে আজ টিভি এসেছে l কি  মজা ! এখন থেকে আমরা বাড়িতেই সিনেমা দেখতে পারব l আজ গানের ক্লাসের পর বাড়ি যাস না কিন্তু  l সন্ধ্যেবেলা বাংলা বই আছে l সৌমিত্র -অপর্ণা সেনের বই l


সেদিন গানের ক্লাসে ইমনের বোলতানে বারবার তালে ভুল করল শর্মিলা l এই প্রথম অন্যমনস্কতার জন্য মাস্টারমশাইয়ের কাছে বকুনি খেল l  মাস্টারমশাই চলে যাওয়ার পর সাগরিকাদের হলঘরে এসে দেখে সেখানে থিকথিকে ভিড় l ওদের বাড়ির লোকজন তো বটেই, পাড়ার ঠাকুমা -জেঠিমারাও হাজির l তারই মধ্যে এক কোণে জড়সড় হয়ে দাঁড়াল শর্মিলা l সামনে দরজাওয়ালা একটা কাঠের আয়তাকার বাক্স l সাগরিকার জেঠু দরজাটা খুলে দিতেই একটা নীলচে কাচের আয়না l তার পাশে রেডিওর মত নব রয়েছে l জেঠু নবগুলো ঘোরানোর পরে কাচের ওপর সিনেমার মত সাদাকালো ছবি ফুটে উঠল l কিন্তু শর্মিলার আর সিনেমা দেখা হল না l প্রতিদিনের মত পিসি এসে ডাকতেই প্রবল অনিচ্ছা নিয়ে তার সঙ্গে বাড়ি ফিরতে হল ওকে l এমনিতেই মাস্টারমশাইয়ের কাছে বকুনি খেয়ে মেজাজটা খারাপ ছিল, তারওপর সিনেমাটাও দেখা হল না l মুখ গোঁজ  করে পিসির হাত ধরে হাঁটছিল শর্মিলা l বিকেলে সাগরিকাদের পাশের বাড়িতে রাজশ্রী টিউশন পড়াতে আসেন, ফেরার সময় শর্মিলাকে সঙ্গে নিয়েই ফেরেন l কিছুটা যেতে না যেতেই শর্মিলা বলল 

--এর পরেরদিন থেকে আর তোমার সঙ্গে ফিরব না, সিনেমা দেখে রাত্তিরে ফিরব l ছোটকা এসে আমায় নিয়ে যাবে l 

রাজশ্রী গম্ভীরমুখে শুনলেন l বাড়িতে এসে মাকে ডেকে বললেন, 

-- বৌদি, তোমার মেয়ের আর লেখাপড়া, গানবাজনা কিচ্ছু  হবে না l মাথায় এখন সিনেমার ভুত ঢুকেছে l

--কি হয়েছে রাজু?  

পিসি বলল ব্যাপারটা l

--শোনো ওবাড়ির গানের ক্লাসে আর মুন্নিকে পাঠানো যাবে না l বড়রাস্তার ওপারে নতুন একটা গানের স্কুল খুলেছে l ওখানে ভর্তি করে দেব l ওরা সবধরণের গান শেখায়, ডিপ্লোমাও দেয় l ভালো ভালো শিল্পীরাও আসেন শেখাতে l আমার স্কুলের শিউলি বলছিল ওর মেয়েকেও ভর্তি করেছে l ওর মেয়েও তো মুন্নিরই বয়েসী l 


--সেটাই ভালো হবে, তুমি খোঁজখবর নাও l তবে কেয়াদি বলছিল টেলিভিশনে শুধু সিনেমাই দেখায় না, অনেক ভালো অনুষ্ঠানও হয় l গান, আবৃত্তি, নাটক, এমনকি বাচ্চাদের অনুষ্ঠানও হয় l রেডিওর মত খবরও বলে রোজ l কেয়াদিও শিগগিরই টিভি কিনবে l 

পিসি আর কিছু বলল না l তখনকার মত কথাটা ওখানেই চাপা পড়ে গেল l 


সোমবার স্কুলে টিফিনের সময় মাঠে বেশ গুছিয়ে  বসে সাগরিকা ওদের বসন্তবিলাপ সিনেমার গল্পটা বলছিল l হঠাৎ মেঘনা বলল 

--এই সিনেমার একটা গান আমি জানি l বলেই  উঠে দাঁড়িয়ে হাত - পা নেড়ে "আমি মিস ক্যালকাটা নাইনটিন সেভেন্টিসিক্স" গেয়ে উঠল l ওরা সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ল l মেঘনা যে এত ভালো গান গাইতে পারে সেটা জানতই না ওরা l 

--কি দারুণ ! তুই কি করে শিখলি? 

সোমালি মুখ বেঁকিয়ে বলল 

--পড়ার সময় রোজ বিবিধভারতী শুনলে সবাই ওরকম গাইতে পারে l

--শুনবই তো ! তোর তাতে কি? তুই মন দিয়ে পড়  না...ফার্স্ট হ l কে বারণ করেছে? আমি বাজে মেয়ে... বাজেই থাকব l

গজগজ করে উঠল মেঘনা l এরপর রোজ ফিসফিস করে সিনেমার গল্প, আর্টিস্টদের জীবনের গল্প করত সাগরিকা আর মেঘনা l সাগরিকাদের বাড়িতে ফিল্ম ম্যাগাজিন কেনা হত এবং বড়দের মধ্যেও এই বিষয়ে বেশ চর্চা হত l মেঘনা বলত ও বড় হয়ে সিনেমায় অভিনয় করবে l ওকে এমনিই সুন্দর দেখতে l তার মধ্যে ওই বয়েসেই বেশ নায়িকাসুলভ আচরণ দেখা যেতে লাগল l বন্ধুরাও ওকে বেশ উৎসাহ দিতে শুরু করল l কিন্তু ধারাবাহিকভাবে রেজাল্ট খারাপ হতে শুরু করল মেঘনার l ক্লাস সেভেনে ফেল করে ওদের নীচের ক্লাসে চলে গেল ও l

এভাবেই পারিপার্শ্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েই একটু একটু করে বড় হয়ে উঠছিল ওরা l

 

ততদিনে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা স্থিতিশীল l সাতাত্তরের ইলেকশনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে  সরকার গঠন করেছে বামফ্রন্ট l শর্মিলার ছোটকা অলোক একটা আধাসরকারি ব্যাংকে চাকরি পাওয়ার মাস দুয়েকের মধ্যে হঠাৎই একদিন রেজিস্ট্রি বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে এল কলেজের বন্ধু শবনমপিসিকে l শবনমপিসি আগেও ওদের বাড়ি এসেছে দু একবার, কিন্তু সে যে ওর কাকিমা হবে ভাবতেও পারেনি শর্মিলা l তারমানে ছোটকার সঙ্গে শবনমপিসির প্রেম ছিল ! অবশ্য ও তো ছোট, বড়দের মনেও একটা প্রবল ধাক্কা লাগল এ বিয়েতে l ছোট হলেও শর্মিলা  বাড়ির অশান্তিটা ও টের পাচ্ছিল ঠিকই l ঠাম্মা প্রথমে চিৎকার করে কিছুক্ষণ বিলাপ করলেন তারপর  সাফ বলে দিলেন ছোটকা যেন বৌ নিয়ে বাড়ি থেকে চলে যায় l হিন্দু অসবর্ণ মেয়ে হলেও তিনি মেনে নিতেন কিন্তু মুসলিম বৌ নিয়ে তিনি কিছুতেই ঘর করবেন না l অরুণ রেগে বললেন 

--- সবে চাকরি পেলি, এখনও দিদির বিয়ে হল না এর মধ্যেই নিজে বিয়ে করে নিলি ! সারাজীবন শুধু আমাকেই সব দায়িত্ব নিতে হবে নাকি ! 


রাজশ্রী বললেন, 

--আমার বিয়ে নিয়ে তোদের ভাবতে হবে না l আমি বিয়ে করব না রে দাদা l কিন্তু তুই এত স্বার্থপর কি করে হলি রে অলোক ! সংসারটা একটু গুছিয়ে দিয়ে তো বিয়েটা করতে পারতিস ! 

ছোটকা মাথা চুলকে বলল, 

-- আসলে শবনমের বাড়ি থেকে অন্যজায়গায় বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিল তো, তাই বাধ্য হয়ে হুট্ করেই বিয়েটা করতে হল l

অবস্থা সামাল দিতে আসরে নামলেন অপর্ণা l একমাত্র অপর্ণাই বোধহয় আগে থেকে একটু আঁচ করতে পেরেছিলেন ব্যাপারটা l 

--বিয়েটা যখন হয়েই গেছে তখন অশান্তি করে লাভ কি ! এখন কিছুদিন ওরা এখানেই থাকুক l একটা ভাড়া বাড়ি দেখে নিয়ে পরে ওরা না হয় চলে যাবে l তাছাড়া ঐটুকু ঘরে ওরা থাকবেই বা কেমনকরে ! শবনম কিন্তু  এখন আমাদেরই একজন, এটা মনে রেখো l 

মায়ের কথা ফেলতে পারল না বাড়ির কেউই l 


মাসখানেকের মধ্যেই তিলজলা এলাকায়  একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে গেল ছোটকারা l এই একমাসে শবনমপিসিকে কাম্মা বলা প্র্যাক্টিস করে ফেলল শর্মিলা l এই একমাস দুর্বিসহ জীবন কাটিয়েছিল কাম্মা l মা আর শর্মিলা ছাড়া আর কেউ কথা বলত না তার সঙ্গে l রান্নাঘরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না l হিন্দু ছেলে বিয়ে করার অপরাধে বাপের বাড়িও যাওয়ার পথও বন্ধ ছিল কাম্মার l ওদের যাওয়ার দিন দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে শর্মিলাকে নিয়ে অপর্ণাও ট্যাক্সিতে উঠলেন ওদের সঙ্গে l একটা খাট একটা বড় ট্রাঙ্ক আর টুকটাক কিছু বাসনপত্র ছোটকা কিনে রেখেছিল l সেসব গুছিয়ে ওদের সঙ্গে বাজার থেকে আরো কিছু দরকারি জিনিস কিনে গুছিয়ে দিয়ে সে রাতে ওখানেই থেকে গেলেন l এই জায়গাটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা l গাছপালা, পুকুর রয়েছে l কাঁচা রাস্তার ধারে একটা ছিমছাম দোতলা বাড়ি l তার একতলার একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছে ছোটকা l কেরোসিন স্টোভ জ্বেলে সেদিন রাতে খিচুড়ি আর ডিমভাজা করেছিল কাম্মা l বেশ একটা পিকনিকের মত ব্যাপার l সবাই মিলে একসাথে খেতে বসে খুব মজা লাগছিল l  চন্দননগরে দাদুর বাড়ি ছাড়া এই প্রথম শর্মিলা মাকে অন্য কারুর রান্না করা খাবার খেতে দেখল শর্মিলা l এই নতুন বাড়িতে এসে মাকে একদম অন্যরকম লাগছিল l ওদের বাড়িতে কোনোদিন মাকে এমন উচ্ছ্বল, প্রাণবন্ত মনে হয় নি l পরেরদিন ভোরবেলা ট্যাক্সিতে ছোটকা ওদের বাড়ি পৌঁছে দিল l সেদিন রবিবার l স্কুল বা অফিসের তাড়া  নেই তবু মুখে আবার সেই একঘেয়েমির রুপটান মেখে  সংসারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন অপর্ণা l শর্মিলা স্কুলের হোমওয়ার্ক করতে করতে ঠিক করল বড় হয়ে মাকে ওই অন্যরকম জীবনটা উপহার দেবে ও l


(চলবে)


                                  

কৌশিক সেন

                                                      



এই সংখ্যার কবি কৌশিক সেনজন্ম ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭৬ বহরমপুর, মুর্শিদাবাদে। ছাত্রজীবন ও বেড়ে ওঠা বহরমপুর শহরেই। কলেজ উত্তীর্ণ হওয়ার পর কঠোর জীবন সংগ্রাম। সাতাশ বছর বয়সে দিল্লীতে আগমন।  কেন্দ্রীয় সরকারী কর্মচারী। সতেরো বছর ধরে দিল্লীর বাসিন্দা।  দিল্লী, কলকাতা ও বহির্বঙ্গে বেশ কিছু পত্র পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত ও প্রশংসিত।  প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ : রাই জাগো গো।


সফেদ ফুলের লেফাফা

 

 

-১-

 

সকালের ডাকে এসেছে

সফেদ ফুলের লেফাফা এক।

পাপড়ি খোলবার আগেই বৃষ্টি নামলো যখন,

ছাতাটা ফুটাইনি আর;

রাজ কাপুর সাজবো আজ, নার্গিস বাহারে...

 

-২-

 

আমি দরজা খুলে দেখেছি

মাথায় ফুলের মুকুট পরা মেয়েটি

এগিয়ে গেছে রোদ পার হয়ে...

তাকে পিছু ডাকিনি আর

যদি পথ ভুলে যায় ও!

 

-৩-

 

কালো ছাতার ভাঁজে ভাঁজে মুড়িয়ে রেখেছি

রঙিন ছাতাটি,

সাদা চশমার ভেতর রোদ চশমা;

গ্রীষ্মে, বর্ষায় কাজে আসবে

এইসব ছায়াময় ষড়যন্ত্র...

 


 

-৪-

 

রাত জড়ো করে রাখা ছিল বালিশের নীচে

ঘুম থেকে উঠে দেখি

বালিশ ডানা মেলেছে পূর্বদিগন্তে;

আমি চাঁপার গন্ধে

সকালের স্কেচ আঁকি...

 

-৫-

 

ডিটিপি তে বেঁধে রেখেছি দুষ্টু প্রজাপতি

ফুলে ফুলে আগুনের ফটোশপ;

টোনারে সিয়ান কমে গেলে

আকাশকে বোলো,

রামধনু লাগবেনা আর!

 

-৬-

 

ঝিঙে মাচায় ফিরে যেতে ইচ্ছে করে বড়

হলুদ মালঞ্চে দোলন লেগেছে কি লাগেনি,

ভেতর থেকে উঁকি মারে লাউডগা...

শহরে কুয়াশা নামলে

চেরাজিভ লুকানো থাকে শীতঘুমে।

 

-৭-

 

স্যানিটারি প্যাডের মঙ্গলছাপ আজ আকাশের লালিমায়।

এসো, প্রণাম করি এই গোধূলির নারীবেলা...

তুলসীমঞ্চে দীপ জ্বেলে দিই,

উত্তরনারীদের আসবার পথ

আলোকিত হোক আজ!

 

-৮-

 

প্রেমিকার ফিরিয়ে দেওয়া চিঠির থেকেও

বিষণ্ণ ছিল সে বিকেল

তবুও ঝরে যাওয়া বিবর্ণ তেঁতুলপাতায়

কান পেতেছি,

স্পষ্ট শুনেছি, বসন্তের কান্না!

-৯-

 

পৃথিবীর দূরতম নক্ষত্রকে ভালবেসেছিলাম, একদিন

তাই বোধহয় এত সুগন্ধ এ নাভিতে,

এত আশ্লেষ শরীরে নিয়ে ছুটে চলেছি

অনন্ত খাণ্ডব অরণ্যে!

এত দহন কেন দিলে আমায়, মাগো!

 

-১০-

 

নীল দীঘির ওপর সূর্য উঠবে একদিন।

জলের গর্ভে এইমাত্র বপন করলাম

শ্বেতপদ্মের বীজ,

অতলে ভাসিয়ে দিলাম নির্বিষ জলঢোড়া

আমিও মরাল হলাম আজ থেকে...

রবিবার, ২৩ মে, ২০২১

জয়তী রায় ( মুনিয়া)

                                                      





 আজকের আলোচনা করব মানবমন নিয়ে। এখন 2021 সাল। চলছে মহামারির তাণ্ডব। কি হবে তার মধ্যে এই মনের কচকচি কেন? 

প্রয়োজন বইকি! মন ঠিক না থাকলে শরীর নিয়ে লড়াই করা মুশকিল। মরণাপন্ন রুগী উঠে দাঁড়াতে পারে  মনের জোর থাকলে। আর শুধু রোগের কথা ই বা কেন? প্রতিদিনের জীবন চর্যায়  মনের ভুমিকা স্বীকার করতেই হবে। বিবাহিত জীবনে মন বড় ভুমিকা পালন করে। দাম্পত্য পুরনো হয়ে গেলেই পরকীয়া এসে হানা দেয়। কেন? মন কেন চায় অখণ্ড স্বাধীনতা? এটা কোনো দোষ নয়। ধর্ষণ বিদেশে এত বেশি হয় না। কারণ, মনের কোন জায়গা থেকে এইরকম ভযঙ্কর ইচ্ছের উত্পত্তি সে সম্বন্ধে ছোট থেকে বাচ্চাদের সচেতন করে দেওয়া হয়। এই দেশে বাচ্চারা যত মায়ের বেবি হয়ে থাকবে ততই ভারতীয় মা খুশি। শিশু কোনো অবোধ প্রাণী নয়। মাত্র তিন মাস থেকে যৌন আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে তার শরীরে। অথচ, মায়েরা ভাবে, শিশু অবোধ। আধো আলো  আধো অন্ধকারে থাকতে থাকতে একমাত্র sex  নিয়ে সারাজীবন কৌতূহলী থেকে যায়। 

মন খারাপে ভোগে। লেখাপড়া, সম্পর্ক সবকিছুতে ছাপ পড়ে। 

****



জন্ম নিয়েই কেঁদে ওঠে শিশু। 

  আগামী দিনের লড়াইয়ের কথা ভেবে হয়ত মন খারাপ হয়। পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হতে গিয়ে না জানি কত  লড়াই করতে হবে? শুধু  বাইরের জগতের সঙ্গে তো নয়, কঠিন লড়াই হল নিজের সঙ্গে। ভিতরের আমি আর বাইরের আমি র নিরন্তর সংগ্রাম শুরু হয়ে যায়।   তাই কেঁদে ওঠে শিশু। পারবে তো টিঁকে থাকতে? না কি , পরাজিত হতে হবে নিজের কাছে? নিজের অ- দেখা প্রবৃত্তির কাছে? 

    

*

  প্রবৃত্তি( Instinct) জন্মলগ্ন থেকে বহন করে আনতে বাধ্য হয় মানুষ। এই ব্যপারে তার কোনো  পছন্দ- অপছন্দ কাজ করেনা। বিষয়টিতে প্রথম আলোক পাত করেন বিখ্যাত মনো বিজ্ঞানী  সিগম্যানট ফ্রয়েড। এ একেবারে ধামকাধার আবিষ্কার। উপর দেখে নয় বিচার করতে হবে ভিতর দেখে! ভিতর মন। সেখান থেকে আরো আরো খুঁড়ে খুঁড়ে একেবারে শেষ পর্যন্ত। সেই শেষের ঘরে লুকিয়ে আছে যে মন,সে নাকি পশুর মত। কিম্বা তার চাইতেও আগ্রাসী। হিংস্র। লালসা পূর্ণ। 

ফ্রয়েড স্যারের এমন চমকপ্রদ আবিষ্কারের কথা ভালো করে জেনে চোখ কপালে উঠে গেল। মানুষ জন্ম হতেই হিংস্র? তবে সমাজ চলছে কি করে? 

   একটু গুছিয়ে বলা যাক। 

ফ্রয়েড স্যার বললেন যে, যাবতীয় মানসিক চিন্তা ভাবনা তিনটি পথ ধরে এগিয়ে চলে। ইড, ইগো , সুপার - ইগো। 

***

ইড , মানুষের অচেতন মন। শিশুর মত, পশুর মত...উচিত অনুচিত বোধ থাকে না। খিদে পেলে খাবার, রমণ ইচ্ছে জাগল তো রমণ...আনন্দ চাই।  যেভাবে হোক। চাই। চাই আর চাই। ইড হল মানব মনের মৌলিক স্তর। যেখানে মানব মনের সকল শক্তি নিহিত থাকে।  ইড মূলত মানুষের জৈবিক দিক। মানব মনের স্বভাবজ চাহিদা পূরণ করে ইড। মন যা চায় তাই করো। এর কোনো মানবিক দিক নেই। পুরোটাই লোভ লালসা কাম চিন্তায় ভরপুর। ইড এমন তীব্র ভাবে মানুষকে প্ররোচিত  করে যে, সে প্ররোচনায়  মানুষ যে কোনো অসামাজিক অপরাধ থেকে শুরু করে খুন ধর্ষণ অবধি করতে দ্বিধা বোধ করে না। এক কথায় ইড হচ্ছে আমাদের ভিতরের সুপ্ত পশু। ফ্রয়েড স্যার বলেছেন যে, এই প্রবৃত্তি দখল করে আছে মানব চরিত্রের বেশির ভাগ জায়গা। 

      পাশবিক প্রবৃত্তির ভূমিকা মানুষের জীবনে বেশ গুরুত্বপূর্ণ সেটা বোঝা গেল। 

   সুপার ইগোর কথায় আসি একটু।  এ হল আধা অচেতন বা অবচেতন মন।  সুপার ইগো হল মানুষের বিবেক। ইড যখন জৈবিক কামনা পূরণ করতে উদ্দীপ্ত হয়, সুপার ইগো একে বাধা দেয়। সুপার ইগো মানুষ কে সব সময় মানবিক দুর্বলতার উর্ধে উঠে ভালো কাজ করার জন্য মানুষকে উদ্দীপ্ত করে। অর্থাৎ, পশু প্রবৃত্তির সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে এর অবস্থান। একজন অতি খারাপ তো অপরজন অতি ভালো। এই দুই অতি অবস্থার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে ইগো বা চেতন মন। কি রকম?

যেমন, ইড বলবে পর্নোমুভি দেখো। দারুণ লাগবে। 

সুপার ইগো ওমনি  লাঠি উঁচিয়ে বলবে, খবর্দার। এটা নৈতিকতা বিরোধী। অতএব দেখা যাবে না। 

ইগো বলবে, পর্ণমুভি দেখো। তবে লুকিয়ে। কেউ যেন জানতে না পারে। 

ইগোর কাজের আরো একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। যেমন, ফাঁকা রাস্তা আর বাইক সহ কিশোর। এক্ষেত্রে, ইড প্রবৃত্তি উস্কানি দিয়ে বলবে তীব্র বেগে চালিয়ে যাও। যা হয় দেখা যাবে। হেসে নাও দুদিন বই তো নয়।  ফুর্তি করো। মজা লোটো। বাতাসের বেগে বাইক চলাও। সঙ্গে সঙ্গে তার অবচেতন মন বা সুপার ইগো বাধা দেবে। বহু অনিষ্ট হতে পারে সেটা বলবে। এই দোলাচলের মাঝে এসে পড়বে ইগো অর্থাৎ সচেতন সামাজিক মন।  মাঝামাঝি স্পিডে চালাতে নির্দেশ দেবে। 

***

   আমাদের যখন তিনবছর বয়স তখন থেকে উচিত- অনুচিত বোধ তৈরি হয়। শিখে যাই অনুভূতি চেপে রাখার কৌশল। মন আর মুখ আলাদা করে ফেলতে পারি অনায়াসে। রেসের মাঠে গেলে লোকের নিন্দে, তবে লুকিয়ে যাওয়া যায়। পরকীয়া করা উচিৎ নয়। গোপনে করলে কে জানবে? ইগো সর্বক্ষণ এই ভূমিকা  পালন করে যাচ্ছে। মানুষের আদিম প্রবৃত্তির সঙ্গে সামাজিক প্রবৃত্তির এমন একটা সহাবস্থান কাজ করছে। চেতন মন লুকিয়ে লুকিয়ে সেই কাজটাই করছে, যেটা গোপন মন করতে চায়। প্রকাশ্যে না হলে, চিন্তায় করছে। স্বপ্নের মধ্যে আসছে। অচেতন মন ঘুমের মধ্যেও জাগ্রত থাকে। তাই, সারাদিন যেমন যেমন চিন্তা করি ,অচেতন মনের মধ্যে জমা হতে থাকে সব। স্বপ্নে বহুসময় প্রতিফলিত হয় সেগুলো।

  ***

     কথায় বলে, প্রবৃত্তির হাতে অসহায় মানুষ। নির্মম সত্য। আজকের সভ্য মানুষ সৃষ্ট হয়েছে সমাজের প্রয়োজনে। প্রকৃতপক্ষে সে তো অরণ্যচারী স্বাধীন। জবাবদিহির কোনো প্রয়োজন ছিল না তার। শরীরের ক্ষুধা উদরের ক্ষুধা মেটানো ছিল জন্মগত অধিকার। নারী -পুরুষ জীবনে একজন হতে হবে, এমন মাথার দিব্যি ছিল না। অথবা আইনগত সম্পর্কের বাঁধনে মোটেই  বাঁধা ছিল না সে। যুগের সঙ্গে পরিবর্তন হল পৃথিবীর। পরিবর্তন হল না মানুষের গোপন মনের। সেখানে সে রয়ে গেল স্বেচ্ছাচারী  আদিম।   স্বপ্নদোষ  দেখা যায় বেশিরভাগ মানুষের। নিরীহ ভালমানুষ ব্যক্তি বহন করে চলে অবদমিত কাম। পতিব্রতা বৌটি  মনে মনে পরকীয়া করে। নিষ্ঠাবতী বিধবা  কান পেতে শোনে রসের গল্প। ধর্ষণের ভিডিও বিশেষ করে শিশু ধর্ষণের ভিডিও তারিয়ে তারিয়ে দেখে অনেকেই। আহা উহু করার মধ্যে দিয়ে সুখানুভূতি  চলকে পড়ে। খুন জখম দাঙ্গার খবর অনেক বেশি আগ্রহ জাগায় সাধারণ খবরের চাইতে। সরাসরি অপরাধ করছে না কিন্তু অপরাধ ঈর্ষা হিংসার ঘটনা শুনে তীব্র  আনন্দ পাওয়া নিজের পাশবিক প্রবৃত্তির  কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া  আর কিছু নয়। 

   

  **

   ফ্রয়েড স্যার অনেক উপকার করে দিয়েছেন আমাদের। তার কাছে  কৃতজ্ঞ থেকেও বলতে পারি এই পাশবিক মনের আক্রমণ সম্বন্ধে প্রাচীন শাস্ত্র ভালরকম চর্চা করে নানান উপদেশ দিয়ে গেছে। মন চাইছে অথচ পাচ্ছে না...চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যের ব্যবধান থেকে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় হতাশার।  দিনের পর দিন নিজেকে দোষ দিতে দিতে একসময় আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। পীড়িত মন দুর্বল মন বহনকারী মানুষকে আত্মহনন থেকে সরে এসে আত্মোপলব্ধি করার পথ দেখিয়েছেনভারতীয় ঋষি -মুনিগণ। 

   মানব চরিত্র সম্পর্কে প্রাচীন যুগের ঋষিকুল মানব চরিত্রের নাড়ি  গলি খুঁজে  ভালো রকম পর্যালোচনা করেছিলেন। প্রবৃত্তির হাতে বন্দী মানব মুক্তি কি করে পাবে? সুপার ইগো ( সুপার ego) অর্থাৎ মনের যে অংশে নীতিবোধ, মানবিকবোধ, নৈতিক চেতনা সুপ্ত থাকে--তাকে জাগিয়ে তুলতে হবে।

ভিতর হতে ইচ্ছে জেগে না উঠলে  পশুপ্রবৃত্তি রোধ করা যাবে না। নৈতিক বোধ জাগরণের জন্য নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই জরুরি। প্রকৃষ্টতম  উদাহরণ মহর্ষি বাল্মিকী। দস্যু রত্নাকর থেকে বাল্মিকী। রাম নাম করে একমনে তপস্যা বস্তুত এক্ধরণের কাউনসিলিং।   রত্নাকর অবস্থায় কিন্তু মানুষ হত্যা করতে হাত কাঁপেনি। অনুশোচনা হয় নি। স্বাভাবিক ভাবেই  নিয়েছিলেন দস্যুজীবন। তপস্যা শেষে ভিতর ঘরে জ্বলে উঠল আলো। স্পষ্ট অনুভব করলেন প্রাণ কত মহিমাময়। সামান্য পাখি হত্যা দেখে ঝরে পড়ল অশ্রু। উচ্চারিত হল কবিতা। এখানে সম্পূর্ণ ভাবে পরাজিত ইড প্রবৃত্তি। নিজের মনের সঙ্গে বসে ধ্যান করে ধীরে ধীরে উপলব্ধি করা যায় মানব জীবনের  উদ্দেশ্য রিপু বা প্রবৃত্তির হাতে হারিয়ে যাওয়া নয়। বরং, রিপুকে মহৎ কাজে নিয়োজিত করে জীবন সুন্দর করে তোলা। 





***

  মানব মনের, অন্ধকার পাশবিক দিক অনেক বেশি শক্তিশালী। তার  অভিঘাত প্রবল প্রচন্ড। সুনামির মত। ভাবনার কথা এই যে, কতখানি পশু আমরা হয়ে উঠতে পারি, সে সম্বন্ধে নিজেরাই জানি না। এমন শক্তিশালী পিশাচের সঙ্গে লড়াই সহজ নয়। নৈতিক বোধ দ্বারা পিশাচ কে হত্যা করতে হলে, কঠিন জীবনচর্যা প্রয়োজন। নিজের আয়নায় নিজেকে দেখে ধুলো ময়লা সরিয়ে দেওয়া প্রয়োজন। 

পিশাচ মনের কাজ হল তাৎক্ষণিক খুশির দিকে মনকে চালিত করা। সাধারণ মানুষের ভালো লাগে সেটাই। মদ্যপান, অকারণ হুল্লোড়,ঈর্ষা , আড্ডা , পরনিন্দা, ধর্ষণ, ইভ টিজিং উলঙ্গ শরীর দেখা ...আরো নানা কাজে পিশাচমন উৎসাহ দিতে থাকে। তাৎক্ষণিক খুশির জাল রঙিন সুন্দর। 

ইড ধীরে ধীরে অধিকার করে নেয় মানবমন। প্রবৃত্তির দাস বানিয়ে হরণ করে শান্তি। ভুরি ভুরি ঘটনা আছে উদাহরণ হিসেবে। 

এই পিশাচ মনের ভিতর নিহিত আছে প্রচন্ড শক্তি। ভেঙে যেমন ফেলতে পারে, গড়েও তুলতে পারে। রত্নাকর থেকে বাল্মিকী হতে গেলে অলৌকিক উপায় নয়, চাই নিরলস সাধনা। তবে, সেই প্রবৃত্তি ঘুরে যাবে সুন্দর দিকে, সৃষ্টি  করবে অতুলনীয় জীবন। আমাদের ভিতর ঘরের মন যেন উত্তাল নদী। বাঁধ দিয়ে উৎপদিত হবে বিদ্যুত। দূর করবে অন্ধকার। না হলে? ভাসিয়ে নিয়ে যাবে মৃত্যুর দিকে। মৃত্যু অর্থ শারীরিক কেবল নয়। মানসিক সুস্থতা  না থাকাও মৃত্যুর সমান। 

**

গভীর অজানা মন লাগাম ছাড়া  ঘোড়ার মত। তাকে  লাগাম পরিয়ে সঠিক পথে চালিত করে ফেলতে হবে। তাৎক্ষণিক সুখের জন্য বহু ক্ষতি করে দিতে পারে বেয়াড়া মন। বহু সমস্যা, দুশ্চিন্তা দুঃ স্বপ্ন ক্রমাগত বাড়তে থাকে। শরীর খারাপ হতে থাকে। অচেতন মন সাংঘাতিক শক্তিশালী একথা জেনেছি। এই শক্তি বা এনার্জি কিন্তু নেতিবাচক। ক্রমাগত নেতিবাচক ইঙ্গিত করে পথ চ্যুতি  ঘটতে থাকে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ কালে অর্জুনের অচেতন মনে এইরকম নেতিবাচক চিন্তার ঝড় উঠেছিল। ধৈর্য ধরে বুঝিয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। ইতিবাচক মনোভাব  অর্জন করতে হলে  শ্রীমদ্ভগবত গীতা পড়া জরুরি।  নিরন্তর চর্চার দ্বারা এই নেতিবাচক মন যদি ইতিবাচক দিকে পরিণত হয়, তবে মানুষ হয়ে উঠবে ঈশ্বর। বহুগুণ বেড়ে যাবে জীবনী শক্তি।

***

মানুষ ভালো - মন্দের ফারাক করতে পারবে। 

অচেতন মন( Id) সচেতন মন( ego) অবচেতন মন( super ego) --তিনটি এক সুতোয় গেঁথে ফেলে মানুষ হয়ে উঠুক নিজভূমে  রাজা। 



কাজল সেন

                                                   



হে মোর মরণ 
বিয়ের পরেই বর মানে উদ্ভাসের সঙ্গে নেদারল্যান্ড চলে গেছিল শ্যামলিমা। উদ্ভাস এখন নেদারল্যান্ডেই পাকাপাকিভাবে থাকে এবং সেখানেই একটি কোম্পানিতে চাকরি করে। তাদের বিয়েটা হয়েছিল রীতিমতো সম্বন্ধ করে। শ্যামলিমার মা-বাবাই পাত্র ঠিক করেছিলেন। শ্যামলিমার কোনো অভিমত বা আপত্তি গ্রাহ্য করা হয়নি।
বিয়ের ঠিক একবছর পরে শ্যামলিমা এলো মা-বাবার কাছে। উদ্ভাসেরও আসার কথা ছিল, কিন্তু জরুরি কাজের জন্য আসতে পারেনি। শ্যামলিমার আসার খবরটা যথাসময়েই পেয়েছিল শতদ্রু। সে গত একবছর শ্যামলিমার আসার অপেক্ষাতেই ছিল। ইতিমধ্যে তাকে বেশ কিছু প্রয়োজনীয় কাজ সেরে রাখতে হয়েছে। দুটো শক্তপোক্ত দড়ি যোগাড় করতে হয়েছে। এতটাই শক্তপোক্ত যে দুজনে নিজের নিজের গলায় এক একটা দড়ি ফাঁস লাগিয়ে সিলিং থেকে ঝুলে পড়লে যেন ছিঁড়ে না যায়। দুজনে একইসঙ্গে সেক্ষেত্রে মরে যেতে পারবে। যদি এভাবে মরতে আপত্তি থাকে শ্যামলিমার, তাহলে অবশ্য অন্য কোনো উপায় বেছে নিতে হবে, আর তাই শতদ্রু একটা খুব ভালো ব্র্যান্ডের ভোজালিও কিনে রেখেছে। ভোজালিতে অবশ্য একইসঙ্গে মরা সম্ভব নয়। একজন অপরজনকে খুন করে তারপর নিজে আত্মঘাতী হতে পারবে। আবার এই দুটো পদ্ধতিই যদি শ্যামলিমার পছন্দ না হয়, তাহলে শতদ্রুর সমস্যা বাড়বে। একটা রিভালবারের কথা ভেবেছিল শতদ্রু। কিন্তু এখনও কেনা হয়ে ওঠেনি। কেনার আগে শ্যামলিমাকে একবার জিজ্ঞেস করে নেওয়া দরকার। তবে বিষ খেয়ে মরতে যে শ্যামলিমা রাজী নয়, তা আগেই জানিয়ে রেখেছে। শতদ্রু একটা প্রস্তাব রেখেছিল, মরার জন্য এত ঝামেলা করে কী লাভ? তার থেকে দুজনে একসঙ্গে হাওড়াব্রিজ থেকে গঙ্গায় ঝাঁপ দিলেই তো হয়! শ্যামলিমা শতদ্রুকে বুঝিয়েছিল, তাতে রিস্ক আছে, একজন হয়তো ডুবে মরে গেল, কিন্তু অপরজন তো ভেসে বেঁচে যেতেও পারে!
এসব আলোচনা অবশ্য হয়েছিল শ্যামলিমার বিয়ের কিছুদিন আগে। শ্যামলিমা তার মা-বাবাকে বারবার বোঝাতে চেয়েছিল যে, সে শতদ্রুকে ভালোবাসে, শতদ্রুকেই বিয়ে করতে চায়। কে শতদ্রু? কী করে? কোথায় থাকে? মা-বাবা খোঁজ নিয়েছিলেন শতদ্রুর। পছন্দ হয়নি। নেহাৎই একটা সাদামাটা ছেলে।  টেনেটুনে বি কম পাশ করেছে। একটা শপিংমলে চাকরি করে। উপার্জন খুবই সামান্য। বংশেরও তেমন কোনো মর্যাদা নেই। অন্যদিকে শ্যামলিমা ফিলজফিতে এম এ পাশ। সুন্দরী। মা-বাবার একমাত্র মেয়ে। তাছাড়া যে পাত্রের সঙ্গে বিয়ের ঠিক করেছেন, সে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ, বিদেশি কোম্পানিতে উচ্চপদে চাকরি করে, প্রচুর উপার্জন। সুতরাং শতদ্রুর সঙ্গে শ্যামলিমার বিয়ে তাঁরা দিতে পারেন না, দেনওনি। বিয়ের পরে পরেই শ্যামলিমা উড়ে গেছিল নেদারল্যান্ড। 
নেদারল্যান্ড থেকেও শ্যামলিমা যোগাযোগ রেখেছিল শতদ্রুর সঙ্গে। শতদ্রুও ফোন করত শ্যামলিমাকে। শতদ্রু শ্যামলিমাকে জানিয়েছিল, শ্যামলিমা ফিরে এলেই তারা একদিন বসে ঠিক করবে, কবে তারা একইসঙ্গে আত্মহত্যা করবে এবং কীভাবে করবে। শ্যামলিমা অবশ্য শতদ্রুকে বলত, এত তাড়াতাড়ি মরে যাওয়াটা বোধহয় ঠিক হবে না। আরও কিছুদিন বেঁচে থাকলে মন্দ হয় না। তারপর না হয় মরবে। একসঙ্গেই মরবে। শতদ্রু অবশ্য শ্যামলিমার এই প্রস্তাবে এখনও রাজী হয়নি। দেখা হলে কথা হবে। 

অমিভাভ সরকার

                                                         




 বেজন্মা (দ্বিতীয় পর্ব)

 

বিকেলে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাওড়া থেকে বিশ্বভারতী ফাস্ট প্যাসেঞ্জারে চেপে বসে। রাত আটটা নাগাদ বোলপুরে পৌঁছে স্টেশন মাস্টারের কাছে তাঁর গন্তব্যের পথ জেনে নেয়। স্টেশনমাস্টার ভদ্রলোক সম্ভবত তার সামরিক পোষাকের জন্য বেশ আদর করে চেয়ারে বসালেন। চা খাওয়ানোর সাথে সাথে অনেকক্ষণ তার সামরিক জীবন নিয়ে গল্প করলেন কৃষাণের সাথে। স্টেশনমাস্টার তার রাতে থাকার জন্যওয়েটিং রুমটা ব্যবস্থা করে দিলেন।   

স্টেশনমাস্টারের পরামর্শে রাতের খাওয়া রেলওয়ে ক্যান্টীনে সেরে ওয়েটিং রুমে এসে শুয়ে পড়ল কৃষাণ। সত্যি, বড্ড ভালো মানুষ মাস্টারমশাই। কথা বলার সময় মনে হচ্ছিল, যেন কৃষাণ তাঁর কতদিনের চেনা। সরকারি হোমে ওয়ার্ডেনের রক্তচক্ষু, নানান বাধা নিষেধের মধ্যে হাইয়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছিল। স্কুলবেলায় সেই দিনের কথা ভুলতে পারে না। আজও মনের গভীরে দগদগে ক্ষতস্থান থেকে পুঁজ, রক্ত গড়িয়ে পড়ে। কত বয়েস হবে তখন…? ক্লাস এইটে পড়ে। স্কুলে ফুটবল খেলার মাঠে এক সহপাঠীর সঙ্গে কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতির রূপ নেয়। তাই দেখে খেলার স্যার ছুটে এসে সজোরে চড় মেরেছিলেন তাকে, “বেজন্মা কোথাকার, কার সঙ্গে ঝগড়া করছিস, জানিস?” অবাক হয়ে তাকিয়েছিল, মাস্টারমশাইয়ের দিকে। একজন তারই সহপাঠী, এত গুরুত্ব তার? সে তো কোনও অপরাধ করে নি! ধাক্কাধাক্কিতে পড়ে গিয়েছিল দুজনে, সেই থেকেই হাতাহাতি। স্যারের দেওয়া ‘বেজন্মা’ শব্দের মানেটা বুঝতে পারেনি সেদিন। জেনেছিল অনেক পরে…। জানার পর থেকেই নতুন পরিচয়ে সে বড় হয়ে ওঠে, ‘বেজন্মা’। সেঅনাথ নয়, ‘বেজন্মা’। সকলের মতো স্বাভাবিক মেলামেশা করার তার অধিকার নেই। অনাথআশ্রমে খোঁজ করে তার মত কাউকে পায় নি। তারা সব অনাথ, তার মত বেজন্মা নয় কেউ। 

আঠারো বছর বয়সের বেশী ছেলেদের নাকি আশ্রমে থাকার অনুমতি নেই, তাই বিতাড়িত হলো অনাথআশ্রম থেকে। তারপর যেখানেই গেছে অবহেলা আর অবজ্ঞা তার নিত্য সঙ্গী হয়েছে। অবশ্য ভালো মানুষেরা অনাথ জেনে দয়াপরবশ হয়ে খাবারের জন্য কিছু টাকা হাতে দিয়েছেন। কিন্তু মানুষ ভাবেন নি কোনোদিন। তারপর নানান জায়গায় ঠোক্কর খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত আশ্রয় মেলে আন্দুল স্টেশনে চায়ের দোকানে। সেখানেই আলাপ কয়েকজন হকারভাই আর ধাবার সিংজীর সঙ্গে। না, কোনও দয়া বা করুনা নয়, তাদেরই একজন হিসাবে আপন করে নেয় তারা, আর পুত্র স্নেহে কাছে টেনে নেন, সিংজী আর তাঁর স্ত্রী বিদ্যাভাবী। সিংজী কতবার বলেছেন ধাবায় তাঁর সঙ্গে কাজ করতে, কিন্তু নতুন করে করুণা নিতে চায় নি সে। আর তাছাড়া অসময়ে যিনি আশ্রয় দিয়েছেন, তাকে ছেড়ে আসতেও মন চায় নি। একদিন চায়ের দোকানে চায়ের জন্যে আসা নিত্যযাত্রীবোসবাবুর পরামর্শে ফোর্সের চাকরীটা হয়ে যায়। ফিরে গিয়ে বোসবাবুর খোঁজ করতে হবে… ভাবতে ভাবতে চোখ জড়িয়ে আসে কৃষাণের।                  

ট্রেনের আওয়াজ আর যাত্রীর শোরগোলে ঘুম ভেঙ্গে গেল। দরজা খুলে বাইরে আসে কৃষাণ। অন্ধকার তখনও  মুছে যায় নি।  প্ল্যাটফর্মের হকারের কাছ থেকে এককাপ চা নিয়েওয়েটিংরুমের সিঁড়িতেই বসে পড়ে। সকালে হেমন্তের ঠান্ডা বাতাস জুড়িয়ে দেয় তার শরীর। চায়ে চুমুক দিতে দিতে অন্ধকার মুছে যাওয়া প্রত্যক্ষ করে। সকালের নরম আলোয় নজর পড়ে ওপাশের প্ল্যাটফর্মে একটা গাছের দিকে। মনে হয় সাদা তুষারের ছোট ছোট কণা যেন লেগে আছে ঘন সবুজ গাছের পাতায় পাতায়। কৃষাণ এগিয়ে যায় সেই দিক লক্ষ্য করে...। কামিনীর শুভ্র ফুলে ভর্তি হয়ে আছে গাছ। মুগ্ধতায় তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। অথচ কামিনী গাছ তার কাছে নতুন নয়। কিন্তু এই ভাবে দেখেনি কোনোদিন। নিজের এই আচরণে নিজেই অবাক হয়ে যায় কৃষাণ।


(ক্রমশঃ) 



নিলয় নন্দী

                                                           


আজকের কবি নিলয় নন্দী জন্ম কলকাতা ৷বাস কল্যাণী। প্রাণীবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। সরকার পোষিত বিদ্যালয়ে জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক। কবিতা লেখার শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকেই। বর্তমানে বিখ্যাত অবিখ্যাত বহু পত্রিকা  লিটলম্যাগ, ব্লগজিনে নিয়মিত লেখেন। কবিতার আলো 'কবিসম্মান ২০২০' পুরস্কারে ভূষিত। কাব্যগ্রন্থ : বাসন্তিকা বাসস্টপ। 'বাতিঘর অনলাইন' ওয়েবজিনের সম্পাদক


সুপ্রভাত
-------------
দীর্ঘদিন সুপ্রভাত জানানো হয়নি

আসলে আজও ঘুম ভাঙেনি আমার। এদিক ওদিক করছি। পাশ ফিরছি। চিৎ হচ্ছি। সরিয়ে নিচ্ছি মাথার বালিশ। দুপায়ের ফাঁকে গোপন তারুণ্যে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেলছি তুলোর শরীর। রক্তমাংস নাকে ঘাম কপালে কাঁচটিপ আষ্ঠেপৃষ্ঠে, ভাবছো, কী বেহায়া লোক! সারা গায়ে তুলো ভোরের রোদ্দুর যামিনী নিরুপায়। নিরুপায় তুমিও তো বন্ধ শার্সি ঠুকঠুক ঠুকঠুক।  কলিংবেল বাজাতে শেখেনি সে। তাইতো এমন নিশ্চিন্তে থাকো। ঠুংঠাং কাপডিশে মেশাও অতিরিক্ত চিনি। আমিও তখন জোঁকমুখে নুন ছটফট ছটফট।
নিঃশ্বাসে মিশে যায় ভোরাই ভীমসেন। আহির ভৈরবে কাক ডাকে। তুমি কি ম্যাজিকে বিশ্বাস করো? 
 

সেনোরিটা
----------------
সেনোরিটা যেন কোনো স্প্যানিশ গাছের নাম। গাছের ডালে ডালে ওয়েবজিন। সূচীপত্রে প্রেমটেম বিরহটিরহ। অরণ্যে  পিয়ানো বেজে উঠলে আমি প্রার্থনা থেকে দূরে সরে আসি। জানালায় সমুদ্র এসে দেখা করে যায়। নীলজল হাবুডুবু বৃক্ষলতা কাম। উঁকিঝুঁকি ডিম্বথলি। এখন পরাগসময় নাকি মৃত্যু জবুথুবু, ভেবে পাইনা। হেঁকে যায় পোষ্টম্যান। কাঁচপোকা উড়ে গেলে কাঁটাতারে লেগে থাকে চিঠি। নীলখাম নীলকাম পিঠোপিঠি শুয়ে থাকে। পথভ্রষ্ট কবি খুঁজে পায় ধুলোর পাহাড়, ছেড়ে যায় ছাই। সারারাত ভারী ট্রাক বুটের দুরমুশ। অভিযোগে অভিযোগে নোংরা হয়ে থাকে বীজতলা। স্বভাবত, নদীও মৌন। কী যেন নেই শুধু ঝরাপাতা বুনোফুল নীলকণ্ঠ পাখি!

তবু তুমি এলে তোমাকেই সেনোরিটা বলে ডাকি। 


লাটাই
----------
এই যে মুখ গুঁজে বসে আছি শোকসভায়
এই যে চুমুক দিচ্ছি বিষাদের লেবুজলে
এই যে থরহরি ঠোঁটের বীর্যপাত
তোলপাড় তোলপাড়

যতদিন শ্বাসবায়ু ততদিন চিলেকোঠা ঘর 
মাল্টিডাইমেনশনাল স্তোকবাক্য বা 
সমস্ত রসাতলে যায় যাক 

এসো, নিভে যাওয়ার আগে শেষবার
লাটাইয়ের সুতো খুলে দিই... 


বৈবাহিক
-------------
এইমাত্র পাশ ফিরে শুলো সে... 
সন্ধি সাংসারিক। ওঠানামা ঢেউ। প্রহর নিরুদ্দেশ।
আমি পাশবালিশ হতে চেয়েছিলাম
প্রেমিক চাদর বা ভেজা জলপটি বড় অসময়ে
স্থিরতা ভাঙচুর। কাল্পনিক প্যারাসিটামল আর
নয় নয় করে বয়স তো কম হলো না...

জরিপ করি বিউটি স্পট
দামাল ইচ্ছে গোপনে চালান করি নিভৃতে 
যেন শব্দহীন সাঁতার, দুপুর গড়িয়ে যায় ঢালে
জানালায় ঠোঁটঠোকরা ডেকে যায় 'ওঠ ছেমড়ি'
নিমন্ত্রণ পত্র আসে, যদিদং হৃদয়ং...

এখন চৈত্রমাস
শরীর নির্মেদ, কামনা বাহুল্যবর্জিত


ভেড়া
-----------
বুকের পশমে মুখ ডুবিয়ে যেদিন আমায় ভেড়া বলেছিলে
নরম মেরুদন্ডে থুতু ছিটিয়ে যেদিন আমায় ভেড়া বলেছিলে
সৌজন্যকে দুর্বলতা ভেবে যেদিন আমায় ভেড়া বলেছিলে 
চতুষ্পদী ইচ্ছেতে চুমু খেয়ে যেদিন আমায় ভেড়া বলেছিলে

আমার আরো ভেড়া আছে সেসব এ পাহাড়ে নয়...



 নিলয় নন্দী। জন্ম : কলকাতা, বাস : কল্যাণী। প্রাণীবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। সরকার পোষিত বিদ্যালয়ে জীবন বিজ্ঞানের শিক্ষক। কবিতা লেখার শুরু স্কুল ম্যাগাজিন থেকেই। বর্তমানে বিখ্যাত অবিখ্যাত বহু পত্রিকা  লিটলম্যাগ, ব্লগজিনে নিয়মিত লেখেন। কবিতার আলো 'কবিসম্মান ২০২০' পুরস্কারে ভূষিত। কাব্যগ্রন্থ : বাসন্তিকা বাসস্টপ। 'বাতিঘর অনলাইন' ওয়েবজিনের সম্পাদক।

পূর্বা দাস

                                                                         


আজকের কবি পূর্বা দাস৷লেখালিখি শুরুর বয়স পাঁচ বছর। প্রথম ভালোবাসা কবিতা। অনুগল্প, ভ্রমণকাহিনী, ছোটগল্প এবং রম্যরচনাতেও অবাধ যাতায়াত। প্রকাশিত লেখা এখন পর্যন্ত লিটল ম্যাগাজিনেই সীমাবদ্ধ। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ' মেটামরফসিস 'I


বিবর্ণ

শপথের কথা মনে হয় নি কখনো
এতই স্বাভাবিক ছিল সেই উপগমন
প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্র আঁকার আনন্দে
দিনরাতের ছবি তৈরী হচ্ছিল
ভ্রান্ত ছায়া গাঢ় হলে
তিরস্কারের আঁখিতে ছিল সূর্যালোকের ভাষা

শপথের ভয় নেই, ছবি মুছে ফেলি
বিবর্ণ হয়েছে দেয়াল, তাই....

                               (২)

নিদান

ইদানিং কোন দেবতা নেই আমার
যেখানে দুদণ্ড নতজানু হব,
নির্লজ্জ হব
সব ক্ষোভ উগরে দেব অধৈর্য্যে
দাবী জানাব, দেবতা তুমি
এসো - আমার অপমানের বিপন্ন জমিতে।

ইদানিং রোজ দাঁড়াই আয়নার সামনে
ক্ষয়ে আসা জীবনীশক্তির চোখে চোখ রেখে বলি,
ঘুমিয়ে পরো না যেন,
শেষ অবধি এভাবেই হাত ধরে রেখো, তুমিই - 


                                (৩)

জন্মান্তর

ভালোবেসেই একদিন আকাশ ছেড়ে এলে
ডানা মুড়ে বসেছিলে 
শুকিয়ে আসা গাছটির ফুল পাতাহীন ডালে
তোমার ভালোবাসার কুহু গানে
বসন্ত এল
বসন্তের আরতি সাজাতে সাজাতে, বেহিসেবী!
ডানার পালক কমজোরী হল, বোঝনি -

এখন সরীসৃপ জীবন
বৃক্ষের আশ্রয়ে বড়জোর এ ডাল ও ডাল
ফাগুন উল্লাস শেষ হলে,
এখন বুঝি পরজীবি নাম তোমার! 

                               (৪)

ত্রাণ

পুকুরের জলে বিষ দিলে
খুব শ্বাসকষ্ট হয় মাছেদের
নীল হয়ে যায় আতঙ্কে, তবু মরণের ভয় থাকে না
জলের আস্তরণ বাঁচিয়ে রাখে ওদের।
রাঘব বোয়াল নেই এসব ছোট পুকুরে
ওদের আগেই সরিয়ে দিয়েছে।
এবার এই ভরা গ্রীষ্মের আটচল্লিশে
জলের ঢাকনা সরে গেছে, তখন
সরল মৃত্যুর ভার নেমে আসে
শুধু কিছু জিয়ল মাছ বুকে হেঁটে চলে যায়
একটু দূরে, অন্য পুকুরে। 

                             (৫)

পূর্বাভাস

একটা ঝড়ের আভাস
কোথাও ঠিক তৈরী হচ্ছে প্রকাণ্ড ঝড়
রীত চরিত তার জানে না কেউ এখনো
এখনো জানা নেই তার কৌশলী গতিপথ
অথচ, অনুভবে তার আগমবার্তা পৌঁছয়
আমাদের রোজকার হাঁটাচলা, দোকানবাজার
রাজনীতি, খেলাধুলা
রাতের গভীর সুষুপ্তিতেও 
জেগে থাকে ঝড়ের পূর্বাভাস
ঈশান, নৈঋৎ, বায়ু, অগ্নি
সবদিকে অনিমেষ চোখ রাখি 
কোথাও এক টুকরো লাল মেঘ দেখলেই
সতর্ক করতে হবে অন্যদের, কারণ - 
ঝড় আসছে, আসছেই....

                                  (৬)

মডিউলার

অনন্ত আবর্তে ঘুরে মরেছি বহুদিন ধরে
যেন কোন ইনফাইনাইট লুপ
সিস্টেম হল্ট করানোর আগে
অনেকবার এনকোডিং ডিকোডিং করে দেখেছি
সিনট্যাক্স এ ভুল ছিল না
ছিল সিম্যান্টিক এরর
বুঝেও ভিসিয়া সার্কল এড়াতে পারি নি
অথচ, ফল থ্রু বা এলসিভির মত ছোটখাট বিষয়ও
গুরুত্ব দিয়ে এসেছি বরাবর
স্ট্রাকচার সুঠাম ছিল, আর তাতে ছিল গভীর আস্থা।

ভুলটা আসলে সেখানেই। 
ঐ স্ট্রাকচার... লিনিয়ার... একধারায় বয়ে চলা
মডিউলার কনসেপ্টের ধারণা ছিল না তখনও
ভেঙ্গে ফেল, আরো ভাঙ্গো, আরো টুকরো করে ফেল নিজেকে
গাছ হয়ে যাও, প্রজাপতি, ভীমরুল বা কাঠবেড়ালি - 
কবিতার শরীর পাও, গান হয়ে ভাসিয়ে নাও চরাচর
সূর্যাস্ত হও, অথবা কালবৈশাখী
সবশেষে অনন্ত নক্ষত্র রাত্রির আশ্রয় তো আছেই
কোন ভয়ঙ্কর ঘূর্ণাবর্তের ভয় নেই আর
এক্সিট বাটনটা হাতের কাছেই আছে - সবসময়। 


                              (৭)


কাব্যজ

এ এক আশ্চর্য কবিতাজন্ম
নিশিডাকে ভোর হয় রাত
মউল দীঘিতে দ্যাখো, বর্ণিল শব্দেরা ভাসমান
ফুটে ওঠে শরৎ প্রভাত।
কামিনীর কস্তুরী গন্ধ স্নান সারা হলে
ঝরে যায়, ঝরে যায় সহস্র শিউলির ভিড়ে 

অসংখ্য জন্মের শেষে
কোরকের যন্ত্রনার স্বাদ
জেনেছিল একজন শুধু - তৃতীয়ার চাঁদ।

আর কোন চিঠি আসে না
জন্মের প্রত্যয় নিয়ে কবিতারা
স্বতঃই স্ববাক।
জন্মদাগ? সেসব কথা থাক। 

                             (৮)

ঘর

আমার ঘরের নাম কাশ
আমার ঘরেই রাজপথ
আমার শ্রান্তি উপহাস
দুয়ারে থামেনি কোন রথ।

                আমার ঘরের ছাদে মেঘ
                দেয়ালে বর্ষা ঝরে যায়
                জানালায় রোদের আবেগ
                নিঃশ্বাসে রেখে যেতে চায়।

আমার ঘরেই উৎসব
কত রাত জাগা অছিলায়
আঙিনায় ঝিঁঝিদের স্তব
ঘর আমার নদী হয়ে যায় - 
ঘর আমার নদী হয়ে যায় - 

                               (৯)

জৈবিক

সকাল, নাকি দুপুর ছিল
দুপুর নাকি সন্ধ্যে? 
শহর জুড়ে মায়ার আকাশ
বৃষ্টি চোয়ায় রন্ধ্রে।

একটি হাতে মুদ্রাতে সেই
অভয় নিষেধপানি
চোখের গভীর ছায়ায় কেন
মিথ্যে পরেশানি।

গোধূলি কোন সুরের ছিল
করুণ ছিল ঊষা - 
লতার মত বিজলী আলো
দীপক রাগে মেশা।

সকাল মরে দুপুর হলে, দুপুর ঢলে সন্ধ্যেয়
রাত্রির ট্রেন ঝমঝমিয়ে দূরের থেকে ডাক দেয়।

                             (১০)

বিদ্রোহী

নদীকে বাঁধতে চেও না; বরং ভালোবাসো
দুবেলা নদীর কাছে বসলে
প্রতিদিন বসন্ত, হোরিখেলা - 
দূর থেকে ভেসে আসা জলচর গুল্মের গায়ে
লেগে থাকে অজানা গঞ্জের সুবাস
চৈত্রের গভীর হাওয়ায় কান পাতলে, শুনবে
উৎস আর মোহনার কোমল-কঠিন কাহিনী
যদি না শোনো, না দেখো,
অথবা আঘ্রাণে অরুচি -
নদীও জেনো দিক বদলায়
তোমার অবগাহনের পরোয়া না করেই...

শর্মিষ্ঠা দত্ত

                                                              


 


খোঁজ (৫)


শর্মিলা যে গার্লস  স্কুলে পড়ত তার প্রাইমারি সেকশনটা ছিল মর্নিং শিফট l ঠিক সকাল ছটা কুড়িতে  প্রেয়ারের ঘণ্টা পড়ত l স্কুলের দোতলার করিডোরে প্রত্যেক ক্লাসের মেয়েদের  ক্লাস টিচাররা লাইন করে দাঁড় করিয়ে দিতেন l নার্সারি থেকে ক্লাস ফোর, পাঁচটা ক্লাসের দশটা সেকশন l করিডোরের দুদিকে পাঁচটা করে লাইন, প্রতি লাইনের শেষে দাঁড়াতেন সেই ক্লাসের ক্লাসটিচার l মাঝখানে দাঁড়াতেন প্রাইমারি সেকশনের টিচার-ইন-চার্জ এবং গানের দিদিভাই l তার সামনে একটা টেবিলে হারমোনিয়াম l প্রেয়ার শুরু হত "অসতো মা সদ্গময়, তমসো মা জ্যোতির্গময় " উপনিষদের এই শ্লোকটি দিয়ে l তারপর এক একদিন একেকটা প্রার্থনাসঙ্গীত গাওয়া হত l এটা শর্মিলার কাছে স্কুলে যাওয়ার প্রধান আকর্ষণ ছিল l তাছাড়া প্রেয়ারের লাইনে কেউ উপস্থিত না থাকলে ফার্স্ট পিরিয়ডে তাকে কান ধরে ক্লাসের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে হত l শাস্তি পাওয়ার ভয়ও ছিল  অবশ্য l তাই শীত বা বর্ষাতেও ভোর পাঁচটায়  ঘড়িতে অ্যালার্ম বাজলে মায়ের সঙ্গে সঙ্গে শর্মিলাও উঠে পড়ত l মা কেরোসিনের স্টোভ জ্বালিয়ে টিফিন বানিয়ে দিতেন l কোনোদিন আগেরদিনের মাখা আটা দিয়ে পরোটা আর আলুভাজা বা জ্যাম - পাঁউরুটি l মুখ ধুয়ে দুধ - বিস্কুট খেয়ে ইউনিফর্ম পরতে না পরতেই গলির মুখে রিকশা ঠুন ঠুন করে কাদের চাচা হাজির... ব্যাগ গুছিয়ে জুতোমোজা পরেই শর্মিলা তখন দে ছুট l 

ক্লাসে সাগরিকা ছাড়াও শম্পা, সোমালি আর মেঘনার সঙ্গেও বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল শর্মিলার l ওদের পাড়ার মোড়ের বাড়িটাই ছিল শম্পাদের, তাই স্কুলে যাওয়া -আসার সময় একই রিকশায়  যাতায়াত করত ওরা l শম্পার দিদি শর্বরী ওদের এক বছরের সিনিয়র l তিনজনেই যেত একই রিকশায়, ঠেসেঠুসে l শম্পার মায়ের সঙ্গেও শর্মিলার মায়ের বেশ ভাব হয়ে গেল l সাড়ে দশটায় স্কুল ছুটির সময় অবশ্য ওরা রিকশায় ফিরত না, হেঁটেই ফিরত l কেয়ামাসি আর মা একসঙ্গেই ওদের আনতে যেতেন l ক্লাসটিচারের সঙ্গে কথা বলে লেখাপড়ার খোঁজখবরও নিতেন l  মাঝে মাঝে রান্না শেষ না হলে অপর্ণা যেতে পারতেন না l সেদিন কেয়ামাসিই ওকে বাড়ি পৌঁছে দিতেন l অপর্ণা ততক্ষণে নিরামিষ রান্না শেষ করে আলাদা করে মিটসেফে  তুলে রেখে উনুনে হয়ত মাছের ঝোল বসিয়েছেন l স্টোভ জ্বালিয়ে  চা করে নিয়ে কেয়ামাসি আর আর মা গল্প করতে বসতেন l কেয়ামাসি বয়েসে খানিকটা বড় ছিলেন,  তাই অপর্ণা কেয়াদি বলে ডাকতেন l কেয়ামাসিও বই পড়তে ভালোবাসতেন, নিজেদের মধ্যে বই দেওয়া নেওয়াও চলত l কেউ কোনো ভালো বই পড়লে অন্যজনকে সেটা পড়তে দিতেন l তাছাড়া সাংসারিক গল্প তো হতই l ঠাম্মাও মাঝে মাঝে গল্প জুড়তেন ওদের সঙ্গে l সেই ফাঁকে শর্মিলারা উঠোনে কুমীরডাঙা বা চোর-চোর খেলা শুরু করে দিত l পাশের বাড়ির পিকলু, শেলীরা পড়ত নামীদামী ইংলিশ মিডিয়াম মিশনারি স্কুলে l স্কুলবাসে করে স্কুলে যেত l ওরা খ্রিষ্টান ছিল বলে মিশনারি স্কুলে মাইনে দিতে হত না l অবশ্য সরকারি স্কুল বলে শর্মিলাদের স্কুলেও মাইনে লাগত না l বছরে সামান্য অঙ্কের টাকা দিতে হত স্কুলের ফাণ্ডে l ছুটি থাকলে পিকলুরাও খেলতে  চলে আসত l তারপর হই হই করে খেলা হত বেলা বারোটা -সাড়ে বারোটা পর্যন্ত l কেয়ামাসির খুব একটা বাড়ি ফেরার তাড়া থাকত না l আসলে শম্পার বাবা মিলিটারিতে চাকরি করতেন l থাকতেন ভারত-বাংলাদেশ হিলি সীমান্তে মিলিটারি ক্যাম্পে l ন মাসে -ছ মাসে বাড়িতে আসতেন l দুই মেয়েকে নিয়ে কেয়ামাসি ভাড়াবাড়িতে থাকতেন l প্রায় একারই সংসার l রান্নাবান্না, কাজকর্মের চাপ ছিল না তেমন l কেয়ামাসির সিনেমা দেখার নেশা ছিল খুব l অপর্ণা আগে খুব একটা বেরোতেন না l সিনেমা দেখার আগ্রহ থাকলেও উপায় ছিল না l মফঃস্বলের মেয়ে, আর সঙ্গীসাথীও ছিল না তেমন l শর্মিলার বাবা অরুণবাবুর সময়ও ছিল না আর শুধুমাত্র  স্ত্রীকে নিয়ে বেড়াতে যেতে চক্ষুলজ্জায় বাধত তাঁর l দু একবার  খুব ভালো কোনো ছবি এলে ভাইবোনের সঙ্গে স্ত্রীকেও নিয়ে গিয়েছেন অবশ্য l বন্ধুত্ব হওয়ার পর মাঝেমধ্যে তাঁর কেয়াদির সঙ্গী হতেন অপর্ণা l ভালো লাগলেও নিজের শখে রাশ টানতে বাধ্য হতেন l শাশুড়ির মুখভার আর নিজের বিনোদনের জন্য টাকাপয়সা খরচ করার সাধ্য ছিল না বলে l প্রাচী, ছবিঘর বা পূরবী হলে উত্তম - সুচিত্রা, অথবা সৌমিত্র বা সুপ্রিয়ার সিনেমা এলে কেয়ামাসি ওঁদের বাড়িওয়ালার ছেলেকে দিয়ে টিকিট কাটিয়ে রাখতেন l মা সঙ্গে বেরোলে শর্বরী আর শম্পাকে শর্মিলাদের বাড়িতে ওর ঠাম্মার হেফাজতে রেখে ম্যাটিনি শো দেখতে যেতেন কেয়ামাসি l তবে বেরোবার আগে মা বারবার করে বলে যেতেন ওরা যেন ঠাম্মাকে বিরক্ত না করে l তাই সেদিন ঘরে বসে লক্ষ্মীমেয়ের মত  লুডো খেলত ওরা l ছোটদের ছবি এলে ওরাও যেত মায়েদের সঙ্গে l দুপুরবেলা সেজেগুজে দোতলাবাসে চেপে পৌঁছত শিয়ালদায় l প্রথম প্রথম বদ্ধঘরে অন্ধকারে কান্না পেত শর্মিলার l সিনেমার গল্পও বুঝতে পারত না l পরে শম্পার কাছ থেকে বুঝে নিত l কিন্তু বাসের দোতলায় চড়ার আকর্ষণটা ছিল অদম্য l শর্বরীদি আর শম্পা কেয়ামাসির সঙ্গে বড়দের সিনেমাও দেখতে যেত মাঝে মাঝে l আসলে ওদের রাখার ব্যবস্থা করতে না পারলে সঙ্গে করেই নিয়ে যেতেন কেয়ামাসি l ওরা পরে শর্মিলাকে সিনেমার গল্প বলত l নায়ক - নায়িকার প্রেমের গল্প শুনতে শুনতেই এভাবেই প্রেম সম্পর্কে একটা ভাসা ভাসা ধারণা তৈরী হল শর্মিলার l 

সোমালি ছিল ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল l শর্মিলা আর শম্পাও ভালো রেজাল্টই করত, সাধারণত ক্লাসে  প্রথম পাঁচজনের মধ্যেই থাকত l একই বেঞ্চে পাশাপাশি বসত সোমালি আর শর্মিলা l সোমালির খুড়তুতো বোন মেঘনা লেখাপড়ায় তেমন ভালো ছিল না l সাগরিকার পাশে বসত ও l দুজনেই ছটফটে আর দুষ্টুবুদ্ধিতে ভরপুর l মেঘনা প্রত্যেকবারই টেনেটুনে পাশ করত l এমনিতে যথেষ্ট বুদ্ধি, কথাবার্তায়ও চৌখস l কিন্তু অসম্ভব ফাঁকিবাজ ছিল মেঘনা l হোমওয়ার্ক করত না বলে প্রায়ই শাস্তি পেত l শর্মিলা, শম্পা ওকে বোঝাতে চেষ্টা করত, সাগরিকাও l যদিও মেঘনার  সমস্ত দুষ্টুমির দোসর ছিল সাগরিকা l তবু পড়াশোনাটা করত l সোমালি একেবারে পছন্দ করত না মেঘনাকে l নিজের কাকার মেয়ে হলেও সবসময় তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলত l ফার্স্ট গার্ল বলে ক্লাসে অন্য মেয়েরা সোমালিকে সমীহ করেই চলত l মেঘনা ওকে পাত্তাই দিত না l আসলে ঐটুকু বয়েসেই একটা সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স গ্রো করে গিয়েছিল সোমালির মধ্যে l বাড়িতে, স্কুলে সবসময় তুলনামূলক আলোচনার ফলে অজান্তেই দুজনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল l

(চলবে)

রবিবার, ১৬ মে, ২০২১

কাজল সেন

                                                                 




নির্জন সৈকত 


এর আগে পুরীতে কখনও বেড়াতে আসা হয়নি। জীবনের প্রায় চোদ্দআনা বয়স পার করে এই সত্তর বছর বয়সে স্ত্রী-মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে দিন কয়েকের জন্য পুরী দর্শনে এসেছেন বিমলাকর। শরীরে তেমন যুত নেই, বৃদ্ধ বয়সের যা কিছু শারীরিক উৎপাত, সবই আছে। ব্লাডপ্রেসার, ব্লাডসুগার, অস্টিও আর্থেরাইটিস, হাইপার থায়োরেড ইত্যাদি সবকিছুই। মনটাও তেমন উৎফুল্ল থাকে না অধিকাংশ সময়। মেয়ে-জামাই জোর করেছিল, চলো বাবা, সমুদ্রের হাওয়া খেলে তোমার শরীর ও মন দুইই চাঙ্গা হয়ে উঠবে।


সমুদ্রের হাওয়া গত দুদিন অনেক সহ্য করেছেন, কিন্তু তেমন কোনো পরিবর্তন তাঁর শরীর ও মনে অনুভূত হয়নি। তবে তৃতীয় দিনের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম ছিল। বিমলাকরের বহুদিনের অভ্যেস ভোরবেলা হাঁটতে বেরোনো। পুরীতে এসেও দুদিনই বেরিয়েছেন। স্ত্রী অনুভা অবশ্য ভোরের উপভোগ্য ঘুম ছেড়ে কোনোদিনই উঠতে রাজী হননি, আর তাই স্বামীর সঙ্গে কখনও প্রাতঃভ্রমণে সঙ্গীনিও হননি। তা সেদিনও বিমলাকর ভোররাতে বেরিয়ে  পড়েছিলেন সমুদ্রের বালিতে পা ডুবিয়ে হাঁটতে। হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে গেছিলেন। সেখানে মানুষজন কম, ফাঁকা ফাঁকা, এক কথায় নির্জন সৈকত। আর কী আশ্চর্য! সেখানেই আচমকা দেখা হয়ে গেল রত্ননীলার সঙ্গে। কতদিন  পর দেখা? ঠিক মনে পড়ে না। গতজন্মের বলে মনে হয়। এখন রত্ননীলার সেই রূপ নেই, সৌন্দর্য নেই, যৌবন নেই, শরীর নেই, কাঠামো নেই। বৃদ্ধ বয়সে পৌঁছে সব যেন উবে গেছে। তবু রত্ননীলাকে চিনতে পারলেন বিমলাকর। একদিন যে রূপ, সৌন্দর্য, যৌবন ও শরীরকে তিনি সারা শরীর ও মন দিয়ে কাছে পেয়েছেন, উপভোগ করেছেন, আত্মহারা হয়েছেন, তা সময় গড়িয়ে গেলেই কি বিস্মৃত হওয়া যায়? রত্ননীলার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বিমলাকরের সব কিছুই মনে পড়ে যায়। বিমলাকর একটা হাত বাড়িয়ে বলেন, কেমন আছ নীলা?

রত্ননীলা কিছুটা অবাক হয়ে এক পলক তাকিয়েছিলেন বিমলাকরের চোখে। তারপরই তাঁর চোখ হেসে উঠেছিল তিরতির করে। ঠোঁট দুটোও কেঁপে উঠেছিল। অস্ফূটে উচ্চারণ করেছিলেন, বিমল! তুমি! এখানে?  


নির্জন বালুকাবেলায় হাতে হাত জড়িয়ে গায়ে গা ঘেঁষে তাঁরা বসেছিলেন অক্লান্ত অস্থির সমুদ্রের চোখে চোখ রেখে। সমুদ্রের ঢেউ উজিয়ে এসে আছড়ে পড়ছিল  তাঁদের পায়ে, বলে যাচ্ছিল অনেক অনেক চুপকথা। কিন্তু তাঁদের মুখে কোনো কথা নেই। কে কাকে কী বলবেন, কিছু ভেবেই পাচ্ছিলেন না। প্রথম যৌবনে  তাঁরা দুজনে দুজনকে অনেক কথা বলেছেন। কিছু কথা বলা হয়তো বাকিও থেকে গেছে। কিন্তু আজ এই জীবনের পড়ন্ত বেলায় পৌঁছে সেসব কথা বলার  আর তো কোনো মানে নেই! প্রয়োজনও নেই। একজীবনে কি আর সব কথা বলে শেষ করা যায়?  


-নীলা, তুমি কি একা এসেছ?

-না, একা কোথায়! স্বামী-ছেলে-বৌমা-নাতি-নাতনি সবাই এসেছে। তুমি তো জানো ভোরবেলায় হাঁটা আমার অভ্যেস। তাই একাই বেরিয়ে পড়েছি। তোমারও  তো তাই!

-আমরা আর দিন চারেক পুরীতে থাকব। সম্ভব হলে এখানে এসো। দেখা হবে। 

-হ্যাঁ, আসব তো! আর আমরা প্রতি বছর এই সময়ে পুরীতে বেড়াতে আসি। তুমিও এসো। যতদিন বাঁচি।