মা----
“খোকা মাকে শুধায় ডেকে–
‘এলেম আমি কোথা থেকে,
কোন্খানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে।’
মা শুনে কয় হেসে কেঁদে
খোকারে তার বুক বেঁধে–
‘ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে’।……
…………………
…………………
যৌবনেতে যখন হিয়া
উঠেছিল প্রস্ফুটিয়া,
তুই ছিলি সৌরভের মতো মিলায়ে,
আমার তরুণ অঙ্গে অঙ্গে
জড়িয়ে ছিলি সঙ্গে সঙ্গে
তোর লাবণ্য কোমলতা বিলায়ে।……” - “জন্মকথা” – রবীন্দ্রনাথ।
এই পংক্তিগুলো যেসময় প্রথম পড়েছি বা আবৃত্তি করে শুনিয়েছি কাছের মানুষদের, তখন আমার ছেলেবেলা। এমন একটা দার্শনিক কবিতার অর্থ বোঝার বয়স তখন নয়। ছন্দে সুরে অকারণেই উচ্চারণ করেছি বারংবার।
অনেক পরে, যখন স্কুল পেরিয়ে কলেজে……যখন হাল্কা চটুল রসের গল্পে আস্তে আস্তে বুঝছি প্রকৃতির সৃষ্টি রহস্য। ফুল থেকে ফল। অঙ্কুরিত মুকুলের বৃক্ষ হ’য়ে ওঠা। যৌবনে ক্রমশঃ পেকে উঠছিলাম এক নিষিদ্ধ রহস্যময়তায়, নারীদেহের অদৃশ্য কল্পিত বর্ণনায়— হয়তো তার কিছু আগেপিছে হঠাৎ করেই আবৃত্তি করতে গিয়ে চেতনায় লাগল ধাক্কা ! “যৌবনেতে যখন হিয়া / উঠেছিল প্রস্ফুটিয়া, / তুই ছিলি সৌরভের মতো মিলায়ে,” এই পংক্তিগুলো বয়ে আনলো আলো… জীবনের, সৃষ্টির।
“আঠাশ দিনের মাথায় আমার
রক্তকলস পূর্ণতা পায়
আঠাশ দিনের মাথায় গাছের
ডগায় ফুটছে রুদ্রপলাশ
এখন আমার সানুদেশ জুড়ে
কুয়াশা জমছে নীরক্ত শ্বেত
রক্ত নামছে ঊষর মাটিতে
মাভূমি গুল্মগর্ভা হবেন।” - “মা-ভূমি” – মল্লিকা সেনগুপ্ত
জানলাম, কেমন ক’রে এলাম এ জগতে। কার দৌলতে ? অনুভব করতে পারলাম, কেন একজনের গায়ের গন্ধ না পেলে ঘুম আসতো না দু-চোখে—সেই আমার মা’কে। অন্দরমহলে মা’ই ছিল সবকিছু। বাইরে বাবা। আমার কিছু একটা বিপদ-আপদ হলেই যে উদ্বিগ্নতার ছায়া পড়তো তাঁদের দু-চোখে সেটা আবার অনুভব করেছি অনেক পরে। নিজে যখন বাবা হলাম।
ছোট্ট থেকে তিল তিল ক’রে আঁকড়ে যে মানুষটা আমাদের বড় করে দিল সে আমাদের মা। মা-এর আরেক অর্থ জন্মভূমি। আমাদের দেশ।
“………
নমোনমো নম সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি!
গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি।
অবারিত মাঠ, গগনললাট চুমে তব পদধূলি,
ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছোটো ছোটো গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের খেলাগেহ,
স্তব্ধ অতল দিঘি কালোজল-- নিশীথশীতল স্নেহ।
বুকভরা মধু বঙ্গের বধূ জল লয়ে যায় ঘরে--
মা বলিতে প্রাণ করে আনচান, চোখে আসে জল ভরে।……” - “দুই বিঘা জমি” – রবীন্দ্রনাথ।
আরো অনেক পরে, যখন চন্দ্রগুপ্ত নাটকে চাণক্যে’র সেই সংলাপ শুনেছি তা মর্মে মর্মে ধাক্কা দেয় এখনো এই বুড়ো বয়সে এসেও—রাজা চন্দ্রগুপ্তকে যখন তাঁর মা বলছেন যে পালিত ভাই নন্দ’কে শাস্তি দিতে, মায়ের কেশ আকর্ষণ করে মা’কে শূদ্রাণী বলার জন্য, চন্দ্রগুপ্ত কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না ভাইয়ের প্রতি বিরূপ হ’তে। মা চন্দ্রগুপ্তকে বলছেন যে ভাই আজ তার কাছে বড় হলো মা’র চেয়ে ! সে সময়ে মন্ত্রী চাণক্য উপস্থিত চন্দ্রগুপ্ত’কে বলছেন—“এক মাতৃগর্ভে জন্ম ব’লেই ভাইয়ের সঙ্গে সম্বন্ধ না ? মায়ের চেয়ে ভাই বড় ? জগতে এই প্রথম হ’ল যে, সন্তান মায়ের অপমানের প্রতিশোধ নেয় না !” এর পরে মা মুরা’র দিকে চোখ ফেলে চাণক্য বলছেন—
“কাঁদো অভাগিনী নারী ! এই তোমার পুত্র ! মা চিনে না !— জানে না যে জগতের যত পবিত্র
জিনিষ আছে, মায়ের কাছে কেউ নয় !
চন্দ্রগুপ্ত। তা জানি গুরুদেব।
চাণক্য। না, জানো না ! নইলে মায়ের অপমানের প্রতিশোধ নিতে সন্তান দ্বিধা করে ?—”
এর পরেই চাণক্যের সেই বিখ্যাত সংলাপ যা পড়লে কেমন যেন ঘোর লাগে এখনো……
“মা—যার সঙ্গে একদিন এক অঙ্গ ছিলে—এক প্রাণ, এক মন, এক নিশ্বাস, এক আত্মা--যেমন
সৃষ্টি একদিন বিষ্ণুর যোগনিদ্রায় অভিভূত ছিল, তারপর পৃথক হ’য়ে এলে—অগ্নির স্ফুলিঙ্গের মত, সঙ্গীতের মূর্চ্ছনার মত, চিরন্তন প্রহেলিকার প্রশ্নের মত ! মা--যে তার দেহের রক্ত নিংড়ে, নিভৃতে বক্ষের কটাহে চড়িয়ে স্নেহের উত্তাপে জল দিয়ে সুধা তৈরী ক’রে তোমায় পান করিয়েছিল--যে, তোমার অধরে হাস্য দিয়েছিল, রসনার ভাষা দিয়েছিল, ললাটে আশিস-চুম্বন দিয়ে সংসারে পাঠিয়েছিল ; মা--রোগে, শোকে, দৈন্যে, দুর্দ্দিনে তোমার দুঃখ যে নিজের বক্ষ পেতে নিতে পারে, তোমার ম্লান মূখখানি উজ্জ্বল দেখবার জন্য যে প্রাণ দিতে পারে, যার স্বচ্ছ স্নেহমন্দাকিনী এই শুষ্ক তপ্ত মরুভূমিতে শতধারায় উচ্ছ্বসিত হ’য়ে যাচ্ছে। মা--যার অপার শুভ্র করুণা মানবজীবনে প্রভাত-সূর্য্যের মত কিরণ দেয়--বিতরণে কার্পণ্য করে না, বিচার করে না, প্রতিদান চায় না--উম্মুক্ত, উদার কম্পিত আগ্রহে দুহাতে আপনাকে বিলাতে চায় !—এ সেই মা !”
মা’কে নিয়ে এই কটা শব্দের মধ্যে যে ঝংকার, যা ডি. এল. রায় লিখেছিলেন সেইই ১৯১১ সালে, তা আজো কতো বাঙ্ময়, কতোই না জীবন্ত !
এভাবেই বেড়ে ওঠা আমাদের। পায়ে পায়ে মা’কে জড়িয়ে জড়িয়ে। যাঁর কাছে সমস্ত ঐশ্বর্য্য তাঁর সন্তান। গোটা জীবজগতেই। মনুষ্যজন্ম এদিক থেকে ভাগ্যবান যে আমরা ‘মা’ বলে ডাকতে পারি যা অন্যন্য প্রাণীরা হয়তো সংকেতে বা অন্য উপায়ে ডেকে থাকে।
“আমি ভীষণ ভালবাসতাম আমার মা-কে
-কখনও মুখ ফুটে বলি নি।
টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে
কখনও কখনও কিনে আনতাম কমলালেবু
-শুয়ে শুয়ে মা-র চোখ জলে ভ’রে উঠত
আমার ভালাবাসার কথা
মা-কে কখনও আমি মুখ ফুটে বলতে পারি নি। !….” - “জননী জন্মভূমি” – সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
আমাদের ভারতীয় সমাজে মা’র ভূমিকা অনেক সময় বৌদি’রাও নিয়ে থাকেন। যা আমরা দেখতে পাই শরৎচন্দ্রের ‘রামের সুমতি’ গল্পে। বৌদি নারায়ণী তাঁর মা-মরা দেওর রাম’কে ঘিরে রাখেন পরম মমতায়। মা’য়ের মত অপার স্নেহে, যত্নেই। তবে এ সম্পর্ক আর কোনো দেশে আছে কিনা আমার জানা নেই।
ভারতীয় বিশেষ করে বাঙালীর মা বলতেই চোখে ভাসে সেই লাল পেড়ে মিল কিংবা গরদের শাড়ী, সিঁথিতে সিঁদূর, কপালে কুঙ্কুম টিপ, পিঠে ফেলা শাড়ির আঁচলে চাবির গোছা। যাঁদের অধিকাংশ সময়ই কাটে রান্নাঘরের চৌহদ্দিতে। পিঠে-পুলি-পার্বণে তৈরি হয় নাড়ু-মোয়া-পরমান্নের অপূর্ব সমন্বয়। যদিও আধুনিক সময়ে এ ছবি ক্রমশঃ ধুসর হয়ে যাচ্ছে। তবুও তো মা। শান্তির এক হাতের পরশ। মাথায় হাত রাখা সাদা হাত।
“…… হেরিলে মায়ের মুখ
দূরে যায় সব দুখ,
মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,
মায়ের শীতল কোলে
সকল যাতনা ভোলে
কত না সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।…” - “মা” – কাজী নজরুল ইসলাম।
আরেক মা বাঙালীর প্রতি ঘরেই আসেন শরতের মেঘে চরে। ছেলে-বুড়ো-কচি-জোয়ান-মাসী-পিসি-জেঠা-খুড়ো সব্বাইকার বচ্ছরকার মা। মা গৌরী। ছানাপোনা নিয়ে সেই সুদূর কৈলাশ পর্বতের শ্বশুরগৃহ ছেড়ে মাত্তর চারটে দিনের জন্য পিতৃ-গৃহে বেড়াতে আসেন।
“আশ্বিনের মাঝামাঝি উঠিল বাজনা বাজি,
পূজার সময় এল কাছে।
মধু বিধু দুই ভাই ছুটাছুটি করে তাই,
আনন্দে দু-হাত তুলি নাচে।…” - “পূজার সাজ” – রবীন্দ্রনাথ।
ষষ্ঠি সপ্তমী অষ্টমী পেরিয়ে আসে নবমীর রাত। ঘরে ঘরে বিষাদের শুরু। ঘরে ঘরে নীরব প্রার্থনা—
"যেয়ো না, রজনি, আজি লয়ে তারাদলে !
গেলে তুমি, দয়াময়ি, এ পরাণ যাবে !—
উদিলে নির্দ্দয় রবি উদয়-অচলে,
নয়নের মণি মোর নয়ন হারাবে !
বার মাস তিতি, সতি, নিত্য অশ্রুজলে,
পেয়েছি উমায় আমি ! কি সান্ত্বনা-ভাবে—
তিনটি দিনেতে, কহ, লো তারা-কুন্তলে,
এ দীর্ঘ বিরহ-জ্বালা এ মন জুড়াবে ?
তিন দিন স্বর্ণদীপ জ্বলিতেছে ঘরে
দূর করি অন্ধকার; শুনিতেছি বাণী—
মিষ্টতম এ সৃষ্টিতে এ কর্ণ-কুহরে !
দ্বিগুণ আঁধার ঘর হবে, আমি জানি,
নিবাও এ দীপ যদি !" —কহিলা কাতরে।
নবমীর নিশা-শেষে গিরীশের রাণী। - “বিজয়া দশমী” - মাইকেল মধুসূদন দত্ত।
পৃথিবীতে একটিমাত্র মানুষ যার কাছে আমাদের সকল আব্দার। সমস্তক্ষণ জুড়েই। ‘বৃদ্ধাশ্রমে’ গিয়েও মা পায়েস বানিয়ে রাখে যদি সন্তান আসে সেদিন…; যত কিছু সেই মায়ের অন্তরেই। আমাদের হাসি-কান্নায় মা’র সুখ-দুঃখ। পৃথিবীর সমস্ত ‘সর্বজয়া’-র কাছে তাঁদের ‘দুর্গা-অপু’ চিরটাকাল শিশু হয়েই বেঁচে থাকে।
“………
“শোন মা! আমার লাটাই কিন্তু রাখিও যতন করে,
রাখিও ঢ্যাঁপের মোয়া বেঁধে তুমি সাত-নরি শিকা পরে।
খেজুরে-গুড়ের নয়া পাটালিতে হুড়ুমের কোলা ভরে,
ফুলঝুরি সিকা সাজাইয়া রেখো আমার সমুখ পরে।”
ছেলে চুপ করে, মাও ধীরে ধীরে মাথায় বুলায় হাত,
বাহিরেতে নাচে জোনাকী আলোয় থম থম কাল রাত।
…… …… …… …… …… …… ……
রুগ্ন ছেলের শিয়রে বসিয়া একেলা জাগিছে মাতা।
সম্মুখে তার ঘোর কুজঝটি মহা-কাল-রাত পাতা।……” - “পল্লী জননী”- জসীম উদ্দীন।
ক্ষুদ্র পরিসরে এ ব্যাখ্যান শেষ হবার নয় ! এতো বছরের এতো এতো মায়েদের হাসিকান্না-হীরাপান্না’র রঙ্ কি কম ! প্রত্যহ একখানি অনুচ্ছেদ লিখে গেলেও ফুরোবে না কোনোদিনই। মা’কে নিয়ে যেমন শুরুতেই চাণক্যের সংলাপ মনে আছে বলেছি, তেমনই আরেকটি নাটকের আরেকটি দৃশ্যের সংলাপ স্মৃতিতে আনাগোনায়। বাহাত্তর কি তিয়াত্তর সাল ! প্রায় অর্দ্ধশতাব্দী অতীত। তাও সেই রঙ্গনা মঞ্চে ‘নান্দীকার’ দলের ‘তিন পয়সার পালা’-র একটি খণ্ড স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বলে। ব্রেখট এর ‘দ্য থ্রি পেনি অপেরা’-র অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত সেই রূপান্তরিত নাটকে পারুল বলে এক ব্যবসায়ী কন্যা ভালবেসে বিয়ে করে ফেলে এক ডাকাতসর্দার মহীন্দ্রকে। বিয়ে মিটে যাবার পরে পারুল বাপের বাড়ি এলে তার মা মালতী ঝাঁঝিয়ে উঠে পারুলকে লক্ষ্য করে বলে—“ অ্যাদ্দিন ধরে খাওয়ালুম, পড়ালুম, বড়ো করলুম, আর মা-বাপের মুখে চুন-কালি মাখিয়ে তুই পালিয়ে গিয়ে একটা ডাকাইতেরে বিয়ে করে বসলি ? ছি ছি !”
ফাঁকা মঞ্চে তিনজন কুশীলব। মা, বাবা আর মেয়ে। মা’র ভূমিকায় লতিকা বসু। আর পারুলবালা’র চরিত্রে বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের এক দাপুটে অভিনেত্রী কেয়া চক্রবর্তী। মঞ্চের ডানদিকে এগিয়ে আসে পারুল। মায়ের কথার উত্তর দিতে। মঞ্চ ক্রমশ অন্ধকার হতে থাকে। একটা ছোট্ট স্পট লাইট সবুজ শাড়ি পড়া পারুলের মুখ ধ’রে। পারুল শুরু করে কৈফিয়ত…
পারুল ॥ মা গো, ছেলেবেলায় যখন আমি খুব ছোট্ট ছিলুম, তখন মনের দিক থেকে কী আশ্চর্য সরল
ছিলুম মাগো। মনে আছে, আমার মাথাভর্তি কোকড়ানো চুল ছিল, ছোট্ট রঙিন ডুরে শাড়ি পরতুম, পায়ে ছোট্ট রূপোর ঝুমুর, নাকে মিষ্টি তেঁতুলপাতা, তখন সবার কোলে উঠতুম, সবাই আদর করত। ছেলেবেলায় সবাই এমনি থাকে। তোমারও ছেলেবেলায়, তুমিও নিশ্চয়ই এমনিই ছিলে মা ; হায়রে আমাদের সেই সংশয়হীন সরল দিনগুলি। দূর সিন্ধুর পাখি সেই দিনগুলি সময়ের অনন্ত আকাশে ! আমি বড়ো হলুম। তুমি বলেছিলে, “এখন তোমার জীবনে অনেক ছেলে আসবে, তাদের অগ্রাহ্য কোরো। হতে পারে তারা গুণী, তারা জ্ঞানী, তারা ভদ্র; হতে পারে তাদের গায়ের চামড়া ফর্সা, তারা লেখাপড়া জানে, তারা গুছিয়ে কথা বলতে পারে, তবু কিছুতেই তাদের ফাদে পোড়োনা কক্ষণে। কেন না, এতেই মেয়েদের চরিত্র, এতেই মেয়েদের শক্তি, এই সতীত্ব। অনেক ছেলে এল। সত্যি সত্যিই তারা গুণী, তার জ্ঞানী, তারা ভদ্র ; যেহেতু তাদের গায়ের চামড়া ফর্সা, তারা লেখাপড়া জানে, তারা গুছিয়ে কথা বলতে পারে—আমি তাদের সবাইকে দৃঢ় অহংকারে দূরে সরিয়ে দিয়েছি মা ! তারা ছলোছলো চোখে ফিরে গেছে ! হায়, হতাশায় দুঃখে ক্ষোভে মাথা হেঁট করে চলে গেছে সেই সব নির্মল ছেলেরা। [দীর্ঘশ্বাস] কিন্তু হঠাৎ একদিন, বিশ্বাস করো মা, হঠাৎই একদিন, আমার ঘরে এলো এক উদ্দাম অতিথি ! আশ্চর্য! সে গুনী নয়, জ্ঞানী নয়, ভদ্র নয়, তার গায়ের রং কালো, সে লেখাপড়া জানে না, সে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না কিছুতেই।••• এমন তো আমি কখনও দেখিনি মা। সে হতাশা জানে না, দুঃখ না, ক্ষোভ না, ভিক্ষে না, ভয় না। সে জোরে হাসতে জানে, সে চিৎকার করে কথা বলে, সে উদ্দাম, সে অদ্ভুত, সে সবল, সে পুরুষ ! কোনদিন তো বলো নি মা, এমন ছেলেও থাকতে পারে, এরা এলে কী বলব ?•••ও আমার সমস্ত শক্তি, অহংকার সমস্ত শিক্ষা তেজ ভাসিয়ে নিয়ে গেল, আমি অসহায় ঝাঁপ দিলুম।
আবার মঞ্চ আলোকিত হয়। বাবা সংলাপ ধরেন। এগিয়ে চলে নাটক। নানান ঘাত প্রতিঘাতে এক সময় নাটক শেষ হয় ! কিন্তু এই নাটকের ওই দৃশ্য আর সংলাপ এখনো ঘাই মারে অসময়ে একলা বসে ভাবতে থাকলে। এত কিছুর মধ্যেও মা সেই সন্তানকে তো দূর করে দিতে পারে না। জীবন এভাবেই চলে। পৃথিবী ঘোরে। দিনের পরে রাত আসে।
পাকিস্থানের বালুচিস্তান প্রদেশের মাকরান মরুভূমিতে রয়েছেন "হিঙ্গুলা" বা ‘হিংলাজ’ মা। এখানে নাকি সতীর সিঁদুর বা হিংগুল মাখা মাথা পড়েছিল। তাই এ শক্তিপীঠ মরুতীর্থ হিংলাজ বলেই খ্যাত। এখানে হিন্দু দেবীকে পুজো করেন বালুচ মুসলিমরাও। নিজেদের সাংসারিক সুরক্ষা ও মঙ্গল কামনায় এই দেবীর দরবারে আসেন মুসলিমরা। এই মন্দির দর্শন যাত্রাকে কেন্দ্র করে ১৯৫৯ সালে নির্ম্মিত হয় ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ চলচ্চিত্র। হিংলাজ মা-এর উদ্দেশ্যে যাত্রার পথে যাত্রীরা গলা মেলায় মা’র উদ্দেশ্যে…
“পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব / মাগো, বলো কবে শীতল হবো / কত দূর আর কত দূর বল মা ||
আঁধারের ভ্রূকুটিতে ভয় নাই, / মাগো তোমার চরণে জানি পাবো ঠাঁই, / আর আঁধারের ভ্রূকুটিতে ভয় নাই, / মাগো তোমার চরণে জানি পাবো ঠাঁই, / যদি এ পথ চলিতে কাঁটা বেঁধে পায় / হাসিমুখে সে বেদনা সবো। কত দূর আর কত দূর বল মা ||
চিরদিনই মাগো তব করুণায় / ঘর ছাড়া প্রেম দিশা খুঁজে পায় / ঐ আকাশে যদি মা কভু ওঠে ঝড় / সে আঘাত বুকে পেতে লবো। / কত দূর আর কত দূর বল মা ||
যতই দুঃখ তুমি দেবে দাও / তবু জানি কোলে শেষে তুমি টেনে নাও, / মাগো যতই দুঃখ তুমি দেবে দাও / তবু জানি কোলে শেষে তুমি টেনে নাও, / মাগো তুমি ছাড়া এ আঁধারে গতি নাই / তোমায় কেমনে ভুলে রবো / কত দূর আর কত দূর বল মা ||”
পৃথিবীর সকল মা’কে স্মরণ করে ইতি টানি এ লেখার। শেষ করি আমাদের ছোটোবেলার সেই বিখাত গানখানি দিয়ে। প্রণব রায় রচিত এ গানের সুরকার এবং শিল্পী (প্রথম রেকর্ডিং) – বাংলাদেশের ফরিদপুরের সুধীরলাল চক্রবর্তী। মা’কে নিয়ে এ গান বাঙালির অন্তরে গাঁথা হয়ে আছে।
মধুর আমার মায়ের হাসি
চাঁদের মুখে ঝরে
মাকে মনে পড়ে আমার
মাকে মনে পড়ে॥
তার মায়ায় ভরা সজল বীথি
সেকি কভু হারায়
সে যে জড়িয়ে আছে
ছড়িয়ে আচ্ছে
সন্ধ্যা রাতের তারায়
সেই যে আমার মা।
বিশ্ব ভূবন মাঝে তাহার নেই কো তুলনা॥
মধুর আমার মায়ের হাসি
চাঁদের মুখে ঝরে
মাকে মনে পড়ে আমার
মাকে মনে পড়ে ॥
তার ললাটের সিঁদুর দিয়ে
ভোরের রবি উঠে
আলতা পড়া পায়ের ছোয়ায়
রক্ত কমল ফোটে ॥
প্রদীপ হয়ে মোর শিয়রে
কে জেগে রয় দুখের ঘরে
সেই যে আমার মা।
বিশ্ব ভূবন মাঝে তাহার নেই কো তুলনা॥
মধুর আমার মায়ের হাসি
চাঁদের মুখে ঝরে
মাকে মনে পড়ে আমার
মাকে মনে পড়ে॥
কৃতজ্ঞতা—
কবিতা – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর / মল্লিকা সেনগুপ্ত / সুভাষ মুখোপাধ্যায় / কাজী নজরুল
ইসলাম / জসীম উদ্দীন / মধুসূদন দত্ত।
নাটক - ‘চন্দ্রগুপ্ত’ – দ্বিজেন্দ্রলাল রায় / ‘তিন পয়সার পালা’ – অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।
গান - ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’ – প্রণব রায় /
‘পথের ক্লান্তি ভুলে’ – গৌরীপ্রসন্ন মুখোপাধ্যায়।