বেজন্মা ( নবম পর্বের পর)
রবিবার দুপুরে কৃষাণকে ফোন করে রাবেয়া। রাবেয়া জানায়, লাভপুরের এক ব্যবসায়ী লোকজনকে নিয়ে আবার এসেছিল। তার মাকে কয়েক লক্ষ টাকা দেওয়ার কথাও বলে গেছে। বলতে বলতে ভেঙ্গে পড়ে রাবেয়া। কৃষাণ অনেক কষ্টে রাবেয়াকে আশ্বস্ত করে বলে যে, মঙ্গল বা বুধবারের মধ্যে তারা আসছে। ফোন রেখেই সিংজী আর মানিক’দা জানায় কৃষাণ।
বিকেল নাগাদ সিংজী খবর দেয়, একটা টাটাসুমো জোগাড় করা গেছে। তাঁর এক আত্মীয়র গাড়ির ব্যবসা, সব কথা শুনে সে নিজেই ড্রাইভ করবে বলে জানিয়েছে। মঙ্গলবার সকলে যেন বিকেল পাঁচটার মধ্যে ধাবায় চলে আসে। সেখান থেকে সোজা বোলপুর। রাতটা বোলপুরে থেকে ভোর চারটে নাগাদ লাভপুর…।
বিকেলে স্টেশনে যাওয়ার পথে রাবেয়াকে ফোন করে কৃষাণ। জানিয়ে দেয় বুধবার ভোর পাঁচটার সময় দুজনে যেন রেডি থাকে, যাতে ফোন করা মাত্র বেরিয়ে পড়তে পারে। বাজারের রাস্তায় এটিএম বুথ থেকে বেরতেই দেখা হয়ে যায় শ্যাম আর নান্টার সাথে। পরবর্তী ট্রেনের জন্য ওয়েট করছিল ওরা। কৃষাণকে দেখেই তাদের মালপত্র ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে সঙ্গ নিল। তাদের এই ভাবে কাজকর্ম বাদ দেওয়ার জন্য বকাবকি করল কৃষাণ। যদিও তাদের উৎসাহ দেখে না করতে পারল না। মনে হল যেন, রোজকার গতানুগতিক ফেরি করা থেকে একটু অন্য কাজের স্বাদ পেয়েছে তারা। তাদেরই উৎসাহে আয়রণের খাট, গদি, তোষক, বালিস অর্ডার করে দেয়। ঠিক হয় মঙ্গলবার সকালে তারা নিয়ে যাবে। নান্টার কথামত, দেখেশুনে একটা আলমারিরও অর্ডার করে দেয় কৃষাণ। আসার সময় বাসনপত্রের দোকানও ঘুরে আসে। ধাবায় আসতেই সিংজী তাদেরকে কৃষাণদের জন্য বরাদ্দ ঘরটা একবার দেখে আসতে বললেন। দুজনকে নিয়ে সিংজীর বাসার দিকে এগোয়। তাছাড়া বিদ্যাভাবীর সঙ্গেও কথা বলা দরকার।
#
সোমবার দুপুরে রাবেয়ার সঙ্গে কথা বলে নেয় কৃষাণ। রাবেয়া জানায় শামসুদ্দিন তাদের ফোন করেছিল। রাবেয়ার মা’র সঙ্গেও কথা হয়েছে কিছুক্ষণ। ভদ্রমহিলা রাবেয়ার জন্য চিন্তায় রাতে ঘুম হচ্ছে না, অশুভ সংকেত পাচ্ছেন তিনি। এটা নাকি কৃষাণ যাওয়ার পরই শুরু হয়েছে। অনেকেই রাবেয়ার সঙ্গে কৃষাণকে লক্ষ্য করেছেন।
বিকেল সাড়ে তিনটের মধ্যে হাজির হয়ে যায় সকলে। আসন্ন ধর্মযুদ্ধে যাওয়ার উদ্দীপনা সবার চোখেমুখে। শ্যাম আর নান্টা মন খারাপ করে খাটিয়ার ওপরে বসে আছে দেখে কৃষাণ এগিয়ে যায়।
“তোরা আগামীকাল ফার্নিচারগুলো নিয়ে আসিস। আমি তোদেরকে মাঝে মাঝে ফোন করে পরিস্থিতি জানাবো, মন খারাপ করিস না। তোদেরকে রেখে আমারও কি যেতে ইচ্ছে করছে? তোরা এর মধ্যে ওঁনাদের জন্য বিদ্যাভাবীর সঙ্গে কথা বলে খাওয়ার ব্যবস্থা করে রাখিস। বিদ্যাভাবীর যদি কিছু দরকার হয়, নিয়ে আসিস”। কথা বলতে বলতে সিংজীর আত্মীয় মনজিৎ হাজির হয় সুমো নিয়ে। সিংজী ধাবার লোকজনদের কিছু নির্দেশ দিয়ে মনজিৎএর পাশে গিয়ে বসে।
রাত্রি আটটার সময় বোলপুরে খুঁজেপেতে একটা লজে গিয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নেয় সকলে। সেই ফাঁকে রাবেয়াকে ফোন করে কৃষাণ। রাবেয়া জানায়, তার মা স্বামীর বাড়ি-জমি ছেড়ে যেতে চাইছেন না। শুধু রাবেয়াকে চলে যেতে বলছেন। রাবেয়া আম্মুকে ফোন দিলে কৃষাণ ভদ্রমহিলাকে আপ্রাণ চেষ্টা করে বোঝাতে…। বলে যে, বিয়ে হয়ে গেলেই কৃষাণ তাঁকে দিয়ে আসবে। খাওয়া দাওয়ার পর নিজেদের মধ্যে প্ল্যানটা একবার ঝালিয়ে নেয়। ঠিক হয় চারটে নয়, একটু আগেই বেরবে। গ্রামে সবার ওঠার আগে, মানে অন্তত চারটের সময় লাভপুর পৌঁছে যেতে হবে।
কীর্ণাহার পৌঁছতেই আর একবার রাবেয়াকে ফোন করে কৃষাণ। লাঘাটা ব্রীজের সামনেই আসতেই মনজিৎ-কে সুমো থামাতে বলে। গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নামার সাথে সাথে বিল্লুকে ডেকে নেয় কৃষাণ।
“সিংজী এখানে ওয়েট করুন, ওদের নিয়ে আসছি”। বিল্লুকে সঙ্গে নিয়ে লাঘাটা ব্রীজের ধার দিয়ে নিচে নেমে যায়। একটু হেঁটে কোপাইয়ের সরু অংশটুকু এক লাফে পেরিয়ে বিল্লুকে হাত ধরে পার করায়। তারপর দু’জনে ওপরের অঙ্গনবাড়ি ট্রেনিং সেন্টারের পাশ দিয়ে দ্রুত হেঁটে পেছনের দিকে একটা খেজুর ঝোপের কাছে বিল্লুকে দাঁড়াতে বলে গ্রামে ঢোকে কৃষাণ। রাবেয়ারা প্রস্তুতই ছিল, কৃষাণ এসে তাঁদের বড় ট্রাঙ্কটা কাঁধে তুলে নেয়। তাই দেখে হায় হায় করে ওঠে রাবেয়ার আম্মু। কৃষাণ চাপা স্বরে চুপ করতে বলে। খেজুর ঝোপের কাছাকাছি আসতেই বিল্লু এগিয়ে যায়। তাকে দেখে চমকে ওঠেন ভদ্রমহিলা। কৃষাণ বিল্লুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। বিল্লু এগিয়ে এসে রাবেয়ার হাত থেকে জোর করেই ব্যাগটা নিয়ে নেয়। ট্রেনিং সেন্টারের পাশ দিয়ে নীচে এসে কোপাইয়ের সামনে দাঁড়াতে নজরে পড়ে মানিকদা আর মনজিতের দিকে। তাদের সাহায্যেই সকলে পার হয়ে যায় কোপাই। ওপড়ে উঠতেই বিল্লুর স্ত্রী রাবেয়াকে জড়িয়ে হাত ধরে রাবেয়ার আম্মাকে ডেকে নেয়।
“আমি মমতাজ, বিল্লুর বিবি। আসুন ফুফু আম্মা”। সিংজী কৃষাণের কাছ থেকে ট্রাঙ্ক নিয়ে গাড়ির ছাদে তুলে দেয়। মনজিৎ গাড়ি স্টার্ট দেয়। গাড়িতে উঠে কৃষাণ রাবেয়ার দিকে তাকায়…। রাবেয়া চোখ জলে ভরে উঠেছে। রাবেয়া আর আম্মু একদৃশ্যে তাকিয়ে আছে ফেলে আসে তাঁদের গ্রামের দিকে…।
“আম্মু, মন খারাপ করবেন না, আমরা আবার ফিরে আসবো”। ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় মনাচিতোর, রাবেয়া কৃষাণের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে। কীর্ণাহার ছাড়িয়ে সোজা এগোয় সুমো।
সিংজীর নির্দেশে ফুটিসাঁকো এসে একটা ধাবার দাঁড়ায় গাড়ি। অনেকের মধ্যেই একটা চাপা টেনশনে চুপ করে ছিল। সকলকে গাড়িতে বসতে বলে সিংজী আর মনজিতই গাড়ি থেকে নেমে বড় গ্লাসে চা আর বিস্কুট সকলের দিকে এগিয়ে দেয়। রাবেয়ার আম্মু খেতে চাইছিলেন না, সিংজীর অনুরোধে চায়ের গ্লাসটা হাতে নেন।
বর্ধমানের হাইরোডে ল্যংচার দোকানের এসে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সকলকে নেমে পড়তে বলে সিংজী। একবার হাত-পা ছাড়িয়ে নেওয়া দরকার। কৃষাণ ফোন করে শ্যামকে…। সিংজী সুমোর দরজা খুলে দিয়ে রাবেয়াদের বেরিয়ে আসতে বলে।
“বহেনজী উতরিয়ে…। আউর কিছু চিন্তা নাই। একদম চিন্তা করবেন না। কৃষাণ আমার বেটা, এবার বেটী ভি পাবো। আমার ঘরের বগলমেই থাকবেন…। ঘরে আমার জেনানা ভি আছে, ও ভি আপনার সাথি হবে। সব ঠিক হো জায়গা”।
সবাই একটা টেবিলের চারদিকে বসে পড়ে। কৃষাণ সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। বিল্লুর বৌ রাবেয়ার হাত ধরে নিয়ে বসে। ফিস ফিস করে কানে কানে কী যেন বলে বিল্লুর বৌ। চোখ মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যায় রাবেয়ার। তা দেখে বিল্লু চিৎকার করা ওঠে…।
“এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না, ওর সঙ্গে কানা কানে কথা বলা…। আমরাও তো শুনতে পারি, ঠিক না মানিক’দা?” বিল্লুর কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠে।
“এই চুপ কর। ওসব তুই বুঝবি না। ওসব মেয়েদের কথা। আমাদের বিল্লুটা একদম পাগল”। এবারে সকলের সঙ্গে রাবেয়া আর রাবেয়ার আম্মুও হেসে ওঠে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাবেয়ারা সহজ হয়ে যায় সকলের কাছে। পেমেন্ট করতে কাউন্টারের দিকে এগোয় কৃষাণ। আলাদা করে কয়েকটা ল্যাংচার প্যাকেট নিয়ে গাড়ীতে ওঠে।
সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ সিংজীর বাড়ির সামনে পৌঁছায় সকলে। শ্যাম, নান্টা হৈ হৈ করে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন বিদ্যাভাবি। তিনি রাবেয়া জড়িয়ে ধরে মমতাজকে রাবেয়ার আম্মুকে ভেতরে আসতে বলেন। কৃষাণ, শ্যাম আর নাণ্টার গলা ধরে সকলকে নিয়ে নতুন ঘরে ঢোকে। দুজন মিলে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে ঘরটাকে। একটা মাটির হাঁড়িতে রজনীগন্ধার স্টিকও রেখেছে এককোনে। সকলে দুজনের পছন্দের প্রশংসা করে।
“কৃষাণ, আমি যাই রে, স্নান করে কাজে যেতে হবে। বিল্লু তুই যাবি না?”
“তুমি এগোও মানিকদা। আমি আসছি…”।
“একটু দাঁড়াও মানিকদা…এটা নাও, বৌদিকে দিও। আর একবার আসতে বলো। রাবেয়ার সঙ্গে আলাপ করে দেব”। কৃষাণ একটা প্যাকেট মানিকদার হাতে দেয়। মানিকদা কোনও ভনিতা ছাড়াই খুশী মনেই প্যাকেটটা নেয়।
“বাব্বা, এই টেনশনে তোর মনেও আছে দেখছি ! এবার খরচ-টরচ একটু কম করে কর…। মনে রাখিস, তুই এবার সংসার করতে যাচ্ছিস…”। মানিকদা যাওয়ার একটু পরেই বিল্লুর বৌ তাদের জন্য কয়েকটা প্লেটে আলুর পরোটা আর রায়তা নিয়ে ঢোকে।
“মানিকদা কোথায় কৃষাণদা?”
“মানিকদাকে কাজে যেতে হবে তাই চলে গেল। সত্যি…, অনেক ক্ষতি হয়ে গেল আমার জন্য”।
“দূর ছাড় তো, তুই কি পর? আমিও তোর বৌদিকে বাড়ীতে পৌঁছে দিয়ে কাজে যাব। দে, আমার প্যাকেটটা দে”। বিল্লুর কথা শুনে সকলে হেসে ওঠে।
“ও, দাঁড়া সিংজীর ঘরে মিষ্টির প্যাকেটটা দিয়ে আসি”। সিংজীর ঘরে গিয়ে দেখে রাবেয়াদের স্নান হয়ে গেছে। সকলে মিলে টেবিল চেয়ারে বসে আলুর পরোটা খাচ্ছে। কৃষাণকে দেখে বিদ্যাভাবি হেসে এগিয়ে আসেন।
“বাবেয়া, মেরা বেটা আ গেয়া… তুমারে বিনা রহ নেহি সকতা”। সবাই হেসে ওঠে। শুন কৃষাণ, আজ কুছ পাকানেকা জরুরত নেহি। আজ তুমলোক রেস্ট লো, কাল সে বহুত টেনশন হুয়া। কাল দেখা জায়গা। রাবেয়া অউর বহেনজী ইখানেই থাকবে।
একটু পরে বাবেয়া আর আম্মা নতুন ঘরে ঢোকে। সবকিছু দেখে আম্মা চোখেমুখে নিশ্চিন্তের ভাব চোখে পড়ে কৃষাণের। রাবেয়াকে সঙ্গে নিয়ে বাজারে যায় কৃষাণ। রাবেয়া আর আম্মির জন্য কিছু জামাকাপড়, রাবেয়ার কথা মত চাল, ডাল, মশলা আর রান্নার কাঁচা মালের সাথে একটা ছোট সিলিন্ডার আর ওভেন কিনে একটা রিকশায় উঠে। রিকশায় উঠে রাবেয়া কৃষাণের একটা হাত জড়িয়ে ধরে। কৃষাণ মনে করিয়ে দেয়, আজ সন্ধ্যায় রেজিস্টার আসার কথা।
সন্ধ্যা সাতটায় মানিকদা রেজিস্টারকে নিয়ে হাজির হয় সিংজীর বাড়িতে। মনজিৎও চলে আসে ঠিক সময়ে। কৃষাণ অনেকবার ফোন করেছিল আসার জন্য। মানিকদা স্ত্রী তার বছর দশেক ছেলেকে নিয়ে একটু পরে আসে। বিল্লুর বিবি আর বিদ্যাভাবি সুন্দর করে সাজায় রাবেয়াকে। সকলের প্রশংসায় লজ্জায় মাথা নিচু করে বিল্লুর বিবিকে আঁকড়ে ধরে থাকে রাবেয়া। কৃষাণ মুগ্ধচোখে তাকায় রাবেয়ার দিকে। কৃষাণকে দেখে সকলে হাসাহাসি শুরু করে দেয়। মানিকদা কনুইয়ের ঠেলা দিয়ে সতর্ক করে কৃষাণকে। কৃষাণ অপ্রস্তুত হয়ে চারদিক দেখে লজ্জায় হেসে ফেলে। হঠাৎ কাঁধের ওপর ভারি হাতের স্পর্শে ফিরে তাকায়।
“এটা পরে লে…। শাদিমে তেরা এ প্যান্ট আচ্ছা নেহি লাগতা…” একটা নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবীর সেট এগিয়ে দেয় সিংজী। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না কৃষাণ। সকলের সামনেই কেঁদে ফেলে…। সিংজী দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে কৃষাণকে। তা দেখে সকলে এসে কৃষাণের পাশে এসে দাঁড়ায়।
পায়জামা, পাঞ্জাবী পরে এসে সিংজী আর বিদ্যাভাবিকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে কৃষাণ। সিংজী কৃষাণকে নিয়ে রাবেয়ার আম্মুর কাছে নিয়ে যায়। তাঁকে প্রণাম করে কৃষাণ। রাবেয়াও প্রণাম করে সিংজী ও বিদ্যাভাবিকে। সিংজী দুজনকে রেজিস্টারের সামনে এসে বসায় বাবেয়া আর কৃষাণকে। রেজিস্টার কাগজ এগিয়ে দেন।
“দাঁড়াও দাঁড়াও, সবচেয়ে জরুরী কাজটা এখনো বাকি যে…। কবুলনামা করতে হবে তো…”। বিল্লুর ভাব দেখে রাবেয়াও হেসে ফেলে।
কবুলনামার পর কৃষাণ, রাবেয়া কাগজে সই করে। সাক্ষী থাকে রাবেয়ার আম্মু, মানিকদা, আর সিংজী দম্পতি। মানিকদা তার ব্যাগ থেকে দুটি রজনীগন্ধার মালা এগিয়ে দেয় দুজনের দিকে। ধাবা থেকে সকলের জন্য খাবার আসে। গল্পগুজবের পর অনেক রাতে সকলে ফিরে যায়।
রোজকার অভ্যাসে ভোরে উঠে মোবাইলে একটা ম্যাসেজ দেখে কৃষাণ। গতকালই এসেছে, নানান কাজে খেয়াল হয় নি। ফোর্স থেকে জানিয়েছে, কৃষাণ যেন সাতদিনের মধ্যে জয়েন করে। খবরটা পেয়ে সকালেই মনটা ভারি হয়ে যায় কৃষাণের। খবরটা শুনলে নিশ্চয়ই মন খারাপ হয়ে যাবে রাবেয়ার। কত আশা করে রয়েছে মেয়েটা…।
সকালের নাস্তার টেবিলে সকলের সামনে কথাটা বলে কৃষাণ। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সকলে। রাবেয়ার দিকে তাকায় কৃষাণ। রাবেয়া ছলোছলো চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অনেক কষ্টে হাসে কৃষাণ।
“নিশ্চয়ই জরুরী দরকার হয়েছে…। সেই কাজ সেরেই আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবো”।
“ঠিক হ্যায় বেটা, কুছ চিন্তা নাই। বহিনজী আউর বেটী আমার কাছে থাকবে। কীরে বেটী থাকতে পারবি না? রাবেয়ার কাঁধে রাখে বিদ্যাভাবী। ওড়না দিয়ে চোখ মুছে সায় দেয় রাবেয়া।
“একদম মন খারাপ করবে না। আমরা আছি, চিন্তা কি আছে…। বুলায়া হ্যায়, জানে তো পরেগাই”। সিংজী সাহস দেয় কৃষাণকে।
“কবে ফিরবে বাবা? আমি জানি এখানে সবার সঙ্গে মেয়ে ভালো থাকিবে। এমন মানুষজন পাবে কোথায়? অনেক ভাগ্য মেয়ের, না হলে কী যে হতো। আমি বলছিলাম, আমাকে যদি মনাচিতোর রেখে আসতে…”
“এক্ষণি যাওয়া ঠিক হবে না আম্মি। ওদিকে হয়তো শোরগোল পড়ে গেছে…। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবো। এমনিতে আমার অনেক ছুটির পাওনাও আছে”। এখানে সকলে আছে, কোনও সমস্যা হবে না”।
সকাল দশটায় হাওড়া গিয়ে পাশ ভাঙ্গিয়ে যাওয়ার টিকিট কেটে নেয় কৃষাণ। বিকেলে রাবেয়াকে সঙ্গে নিয়ে বেরোয়। এটিএম বুথ থেকে কিছু টাকা তুলে একরকম জোর করেই রাবেয়ার হাতে দেয়। কৃষাণের চলে যাওয়ার খবর শোনার পর রাবেয়া চুপ হয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে রাবেয়ার হাত ধরে কৃষাণ।
“রাবেয়া, মন খারাপ করো না। তোমাকে তো বলেছি, এই আমাদের জীবন। ফেলে যেতে আমারও কি ভালো লাগছে? কিন্তু কী করব বলো? একটা কথা বলি, তোমাকে আমি শুধু আমার দুর্ভাগ্যের কথা বলে ছিলাম, কিন্তু আমার সৌভাগ্যের কথা বলিনি। আমার সৌভাগ্য, আমি সিংজী আর বিদ্যাভাবীর মতো অবিভাবক পেয়েছি, আর পেয়েছি আপন ভাইয়ের মতো বন্ধুরা। এখানে তোমার কোনও অসুবিধা হবে না। বিদ্যাভাবী তো আছেই, তাছাড়া মমতাজ বৌদি রোজ একবার করে আসবে। চলো বিল্লুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসি…”
বিল্লুর স্ত্রী মমতাজ তাদের দেখে রাবেয়াকে জড়িয়ে ধরে ভেতরে নিয়ে যায়। কৃষাণ তার যাওয়ার কথা বলে। মমতাজ অভয় দিল, সে রোজ একবার রাবেয়ার সঙ্গে দেখা করে আসবে। তাছাড়া মাঝে মধ্যে আশপাশটা ঘুরতেও যাবে দুজনে।
“কিরে…? দুই বন্ধু খুব মজা করবো। অবশ্য কৃষাণদা থাকলে যা হতো, সেটা অবশ্য হবে না…! মমতাজের কথা শুনে দুজনেই হেসে ফেলে।
রাবেয়াকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে কৃষাণ স্টেশনে আসে। সকলের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। যাওয়ার আগে রাবেয়ার নামে ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। সবচেয়ে বড় কাজ হলো, রাবেয়াকে স্কুলে ভর্তি করা। সেটা অবশ্য এর মধ্যে হবে কিনা কে জানে…।
স্টেশনের প্রান্তে তাদের পরিচিত আড্ডায় সকলে একে একে জড়ো হয়। খবর শুনে সকলেরই মন ভারি হয়ে যায়। মানিকদা জানায় স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে গ্রামের মেম্বারের সঙ্গে কথা বলবে।
রাত দশটায় শিয়ালদহে সবাই বিদায় জানাতে আসে, সিংজী, বিদ্যাভাবী, রাবেয়া আর আম্মু। জীবনের এক স্মরণীয় মূহুর্ত। স্টেশনে পৌঁছে সকলে মিলে কফি খেতে খেতে কৃষাণের বন্ধুরাও এসে যোগ দেয়। ট্রেন ছাড়তেই বিদ্যাভাবীকে ধরে কান্নায় ঢলে পড়ে রাবেয়া।