শনিবার, ৩১ জুলাই, ২০২১

জয়তী রায় ( মুনিয়া)

                                   



 মনের হদিশ/ কিছু কথা

_______________________

   প্যারাসাইকোলজি ব্যাপারটা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। যেহেতু সার্টিফিকেট মেলেনি বিজ্ঞানের কাছ থেকে।কূটতর্কে একদিন হয়ত যাব। কোনো মঞ্চে অথবা দূরদর্শনের পর্দায়। আজ লিখতে হচ্ছে তাদের জন্য, যারা আমার কাছে ক্লাস করতে চায়।

  প্রথমেই বলে রাখি , প্রথাগত কাউন্সিলিং আমি করি না। কিছুটা অতীন্দ্রিয় ব্যাপার থাকে। এটা কোনো বড় ব্যাপার নয়। অনুমান করার ক্ষমতা , কুকুর থেকে পিঁপড়ে প্রত্যেকের কম বেশি থাকে। বিপদের গন্ধ পাওয়ার ইন্দ্রিয় আদিম যুগে মানুষের মধ্যে ছিল। যন্ত্র যতদিন কব্জা না করে ফেলেছে, মানুষের অনুমান ক্ষমতা ছিল প্রখর। পশু ইন্দ্রিয় আজো সজাগ। কারণ ? তাদের যন্ত্র নেই। মানুষের ইন্দ্রিয় লুপ্ত হয়নি। শুধু ক্ষমতা কমে গেছে। 

   আমার থেরাপির মূল কথা হল , নষ্ট হয়ে যাওয়া ইতিবাচক অনুভূতি ফিরিয়ে নিয়ে আনা। এটা সময় সাপেক্ষ। অনেকেই সেটা বুঝতে চায় না। চটজলদি সমাধান চায়। বিনাওষুধে , শুধুমাত্র নিজের সাহায্যে নিজেকে ভালো রাখতে পারার নিয়ম জেনে গেলে জীবন আসে ম্যাজিক। দুঃখ কব্জা করে ফেলতে পারলে দুঃখ হয়ে পড়ে অক্ষম। এটা এখন অনেকেই বুঝে গেছেন। অনেকেই ভালো আছেন। তাদের শুভেচ্ছা নিরন্তর ঝরে পড়ছে , এ আমার পরম সৌভাগ্য। 

 এই যে অনুমান করার ক্ষমতা( মোটেই বিরল নয়) অথবা কাউকে দেখে কিছু আঁচ করার, এমনকি তার বিপদ আসছে না সৌভাগ্য সেটাও বুঝে যাওয়া... এগুলো শেখানো মুশকিল। কেউ কেউ ভাবেন বুঝি, মন্ত্র তন্ত্র অং বং টং করতে হয়। কেন এমন ভাবনা আসে? মন্ত্র শক্তির ক্ষমতা আলাদা। সে ছাড়াও ত হয়। উদাহরণ দিয়ে বলছি, যেমন দৌড়তে সকলে পারে, কিন্তু দৌড় বীর হতে গেলে অভ্যাস জরুরি। অভ্যাস যোগ। ।প্রতিদিন বাড়িয়ে তুলতে হবে নিজের এনার্জি। এনার্জি বাড়ানো কি মুখের কথা? শারীরিক ফিটনেস তৈরি করতে প্রচুর পরিশ্রম। তেমনি , মন যাতে তীক্ষ্ণ হয়, বোধ যাতে সঠিক হয়, শান্ত থাকতে হয় তার জন্য। মৌন থাকতে হয়। সঙ্গী নির্বাচন ঠিক মত করতে হয়। সঙ্গী যেন বিরক্ত না করে। অযথা সময় নষ্ট না করে। আর যদি করেও, যদি সঙ্গী তেমন হয়েই যায়, খুব বেশি সময় তাকে না দেওয়াই ভালো। ভুল সঙ্গ দুঃখ তৈরির বড় কারণ। 

 নিয়মিত দর্শন আলোচনা করতে হয়। গভীরে পৌঁছতে হয় প্রতিদিন। প্রতিদিন। একদিন ও ফাঁকি দিলে চলবে না। দর্শন হল আলো। প্রথম প্রথম কঠিন মনে হয়, ধীরে ধীরে আত্মস্থ হয়ে যায়। কত কি ই তো আলোচনা করি কিন্তু হারিয়ে যাওয়া কিছু বোধ নিয়ে আলোচনা করি না। কেন? কেউ কেউ আবার দর্শন বলতে কিছু সংস্কৃত শ্লোক আউড়ে দেন 😀 আউড়ে দেন মানে নিজেই বোঝেন না। আমি বলি, কথামৃত পড়ো। সব আলো লুকিয়ে আছে ওখানে।❤️

     কাউন্সিলিং শেখানো যায়। কিন্তু অতীন্দ্রিয় বোধ শেখানোর বিষয় নয়। কেউ কেউ ভাবে😀 এইতো জয়তী দির মত ফোনে ভালো ভালো কথা বললেই তো হয়ে গেল। ওটাই তো জয়তীদি করে। 

ভালো শব্দের কোনো বিকল্প নেই, একথা সত্যি। বাতাবরণে ম্যাজিক তৈরি করতে জানে শব্দ। রাজনৈতিক নেতা কি করে? ধর্ম গুরু কি করে? শব্দের খেলাই তো করেন। কিন্তু, শব্দ দিয়ে মনের পরিস্থিতি বদল করতে চাইলে তার মধ্যে কিছু বস্তু থাকতে হবে। টেলিফোনে কথা বললেও মন পড়ে নিতে হবে। বুঝে নিতে হবে, অপর প্রান্তের মানুষের না বলা উদ্বেগ। আপাত স্বাভাবিক কথার মধ্যে হয়ত লুকিয়ে আছে বড় কোনো অসুখের ইঙ্গিত। ধরে ফেলতে হবে। এটা নিরলস চর্চার কাজ। অসুবিধার কি আছে?😀 কঠিন তো নয়। যদি রান্না করতে পারি যদি রূপচর্চা করতে পারি তবে নিজেকে নিয়ে বসতেও পারি। 

  মূল কথা হল, সময় সকলের জন্য আছে কেবল নিজের জন্য নেই! একটা দিন অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টা। আঠারো ঘণ্টা এনার্জি দিচ্ছি, অন্য লোক প্রশংসা করল না নিন্দে... এই ভেবে। 

 নিন্দে যে করার সে করবেই। সোনারথালায় খেতে দিয়ে,নিজেকে নিঃশেষ করে দিলেও তারিফ জুটবে না। তারচেয়ে একটু তাকাই আমার দিকে। ক্ষয়ে যাওয়া মনের দিকে। লুকিয়ে থাকা শক্তি বাড়িয়ে তুলি। তবে, হয়ে উঠব নিজের ভরসা সেইসঙ্গে অপরের বন্ধু। মনের বন্ধু।

সোনালী চক্রবর্তী

                      


নিজা 


মাউন্ট মৌনালোয়া, ফুজি না নিছক পোপো? বৃষ্টি কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক করে দিয়েছে সায়র সেনকে নাহলে এই সব অহৈতুকী দৃশ্যকল্পের তুলনা মাথায় আসার মতো অবসর কোনো মফস্বলের সরকারী হাসপাতাল তার ডক্টর অন ডিউটিকে দেয় না। সপ্তাহের সিংহভাগ এখানেই কাটাতে হয় তাকে। অন্যান্য অপ্রাপ্তি সেভাবে গুরুত্ব না পেলেও একমাত্র মেয়েকে ছেড়ে থাকাটা মনখারাপেই রাখে। যে আসার পর তার চরাচরে তিনি অন্য রংধনু দেখেছেন তার থেকে দূরত্ব বিষণ্ণতা তো দেয়ই তার মতো মানুষকেও যার জীবন ও তার যাপন সম্পর্কে ধারণাটা মেডিক্যাল ফ্রেটারনিটির বাকি পাঁচজন সমসাময়িকের সঙ্গে মেলেনা। হয়তো মেধা, দক্ষতা এইসব কোন'কে অনালোচিত রাখলে একমাত্র নিয়তি নির্ধারিত বলেই তাকে এই পেশায় আসতে হয়েছে, থাকতে হচ্ছে, হয়তো বা নিজেকেও ভুলতেই হচ্ছে। সদ্য তিরিশ পেরিয়েছেন অথচ তাকে দেখলে কেউ বলবেই না ক্যাম্পাসে বসে কিছুক্ষণ আগেও আড্ডা মারছিলেন না। হয়তো প্রাণশক্তি, হয়তো উদ্দাম স্বাতন্ত্র, সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না এক নজরে দেখে কী তাকে এতটা আলাদা করলো। তবে যদি কেউ তাকে লক্ষ্য করে নিপুণভাবে, বুঝতে ভুল হবে না আসলে এখনো তিনি তার আবেগ ও সংবেদনকে কাটিয়ে উঠতে পারেন নি, এর উল্টোটা ঘটলেই বরং স্বাভাবিক হতো, পেশার সঙ্গে মানানসইও বটে। অথচ সায়র বেহিসাবি সফল। অদ্ভুত শুনতে লাগলেও অত্যন্ত বিতর্কিতও। সেসব অন্য প্রসঙ্গ। এই মুহূর্তে বৃষ্টি বাড়ছে। অন্যমনস্ক থেকে অন্যমনস্কতর হতে হতে সায়রের মনে পড়ছে তার ব্যাক্তিগত মালিকানার নার্সিংহোমগুলোর মধ্যে বিশেষ একটিকে, আরও নির্দিষ্ট করতে গেলে ইডেনের কেবিন ওয়ানকে। কিছু সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে হয় নাহলে নিজেকে নৈর্ব্যক্তিক রাখা দুষ্কর হয়ে ওঠে। সায়র ফোন করে নির্দেশ দিলেন, আগামিকাল থেকে ইডেনে কোনো কোভিড পসিটিভ থাকবে না। প্রত্যেককে রেফার, প্রপার প্লেসমেন্ট দিয়ে ডিসচার্জ করে দিতে হবে। প্রয়োজন ছিলো না, কিছুটা স্বগতোক্তির মতো করে জুড়ে দিলেন,

--"গভর্নমেন্ট গাইডলাইন প্রোভাইড করতে গেলে যে অমানবিক আচরণ করতে হবে, পিপিই ইত্যাদি পরে ট্রিটমেন্ট, তা সম্ভব নয়। এতে পেশেন্ট মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। সাইটোকাইন তাকে সেখানেই শেষ করে দেয়। আমায় তো দেখেছেন, একটা মাস্ক ছাড়া কোনো গ্লাভসও আমি ব্যবহার করি না। সুতরাং সকলের স্বার্থে এই ডিসিশন নিতে আমি বাধ্য হলাম।"


জ্যা থেকে শরকে মুক্ত করার পর ব্যাধ ভিন্ন ধনুক নিয়ে ভাবিত হয় না বিশেষ কেউ অথচ ফোন রাখার পর থেকে এক বিচিত্র প্রশ্ন সায়রকে তাড়া করতে শুরু করলো। কেন এই স্টেপ? গতরাতে এডমিশন নিয়ে আজ বিকেলে একজন বলিষ্ঠ মধ্য তিরিশের যুবক স্যাচুরেশন শূন্যে পৌঁছে লাশ হয়ে গেছে বলে? চারঘন্টা যাবত এই আকস্মিকতা নিতে না পেরে তার স্ত্রীর আর্তনাদ ইডেনের সব কটা ফ্লোর জুড়ে ছড়িয়েছে বলে? নাকি সেই একই অলীক ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এডমিট হওয়া এক প্রৌঢ়ের একই পরিণতি কাল ঘটলে তিনি দায় নেওয়ার কথা ভাবতেও পারছেন না বলে? জন্ম ও মৃত্যু জনসাধারণের কাছে যতটা প্রবল উদযাপনীয়, ঠিক ততটা প্রেডিক্টেবল নয় অনুভব সাপেক্ষে। চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এত জন্ম এত মৃত্যু, সংখ্যাধিক্য অথবা প্রতিটিতেই অংশীদার হওয়ার কারণে সম্ভবত জীবনের থেকেও অত্যন্ত সহজ ঠেকে তাদের কাছে জীবনে প্রবেশ ও প্রস্থান। তবে কেন তিনি এত অস্বস্তিতে ভুগছেন?

নীলাদ্রি চক্রবর্তীকে ঠিক দুদিন আগে যারা প্রথম ইডেনে নিয়ে এসেছিলো, পরের দিন কথা বলতে এসেছিলো, তাদের কারোর মধ্যে সে ছিলো না। যে মুহূর্ত থেকে যাবতীয় রিপোর্টে অভ্রান্ত প্রমাণিত হলো আপাতত তার আর বাড়ি ফেরার সম্ভাবনা নেই, শরীরের ভিতরের যন্ত্রপাতি ভয়ংকর ক্ষতিগ্রস্ত যেহেতু একদম জ্ঞান হারানোর আগে কাউকে কিছু বুঝতেই দেননি সদাব্যস্ত ব্যক্তিটি, ছায়ার মত সে এসে দাঁড়ালো, নীলাদ্রির একমাত্র সন্তান। সায়র অসংখ্য সুন্দরী দেখেছেন জীবনে, রূপ তাকে আর প্রভাবিত করে না। আর সবচেয়ে বড় বিষয়, একজন প্রৌঢ় পেশেন্টের মেয়েকে কীরকম দেখতে সেই অনুসন্ধানের পর্যাপ্ত আগ্রহ, ইচ্ছে বা উদ্যোগ সবেরই বিপুল ঘাটতি ছিলো তার দিক থেকে। তিনি শুধু এড়াতে পারেন নি একজোড়া চোখকে। চোখও নয় ঠিক, দৃষ্টিকে। মুখের নব্বই শতাং মাস্কে ঢাকা অথচ সেই আয়নার উপর আলো পড়লে আর এক শতাংশেরও প্রয়োজন হয় না বুঝে নিতে মালিকানা পৃথিবীর তিনভাগের থেকে আলাদা। অসম্ভব অসহায় অথচ অন্তর্ভেদী। সায়র যতক্ষণ কেবিনে ছিলেন স্পষ্ট বুঝছিলেন, সেই নি:স্ব রকসলিড দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করছে। তার প্রতিটি কথা, মুভমেন্ট, শরীরী ভাষা সব কিছু স্ক্যান হচ্ছে। কথা হয়নি কোনো। কথার প্রয়োজন ছিলো না। একথা নির্মম সত্য পৃথিবীর যে কোনো ভাষা চতুর্থ ইন্দ্রিয়ের উচ্ছিষ্ট হলে অর্থহীন হয়ে যায়। সায়র অন্ধ নির্ভরতা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ফলত বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন অবশ্যই। উচ্চারণ করতে পারেন নি খুব বেশী আশা তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না কারণ তার মাথায় ভাসছিলো নিজের মেয়ের মুখ। বছর খানেক আগেও তিনি একথা জানতেন না এখন যা অনায়াসে বোঝেন, একমাত্র মেয়েদের কাছে তাদের বাবারা ঠিক কোন অবস্থানে থাকে। আঘাত করা যায়না সেই শক্তিস্থল অথবা দুর্বলতম বিন্দুতে, চিকিৎসক হিসেবেও নয়। তার চেয়ে এই ভালো, প্রফেসর অন্য কোথাও শিফট হয়ে যান।


নীলাদ্রি ঘুমোচ্ছেন, তাকে নিয়ে এত উথালপাথাল, অজ্ঞাত তিনি। চাঁদের বিন্দু বিসর্গ উদয়ের সম্ভাবনা আপাতত নেই অথচ তার অবচেতন জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। বিস্তীর্ন দিগন্তের একপ্রান্তে এক রাজপুত্তুর, মুকুট তরোয়াল পক্ষীরাজ কিছু নেই, সদ্য দেখেছেন অথচ মনে হচ্ছে বহু চেনা, আরও বহুবার বহু সময় ধরে তাকে দেখতে ইচ্ছে আসছে তার। আর বহুদূরে স্বধা, মেয়ে হিসাবেই তার পরিচয় অথচ নীলাদ্রি বিশ্বাস করেন তার প্রয়াত মায়ের প্রায় সমস্ত বৈশিষ্ট্য মননে বহন করা চলা আত্মজাটি প্রকৃতই তার আত্মারই পরিবর্ধিত রূপ। দৈর্ঘ্য, রঙ ইত্যাদি জাগতিক মাপকাঠিতে যতই স্বধা তার মায়ের জলছবি হোক না কেন, একটিমাত্র শব্দ উচ্চারণ করলে অথবা কাগজে হিজিবিজি কাটলেও জনকের সিলমোহর নিয়েই করে, এ তার অপ্রকাশিত অহং জীবনভোর যেদিন থেকে তিনি 'বাবা' ডাক শুনেছেন। রক্তের দোষেই তারা বংশপরম্পরায় গ্রন্থকীট। গণিতশাস্ত্রে যতটা ব্যুৎপত্তি তার ছিলো বা আছে, সাহিত্য তাকে সেভাবে টানেনি কখনো অথচ মেয়ে উল্টো হয়েছে। বিজ্ঞান স্বধার কাছে বিরক্তিকরই থেকে গেলো। ঘুমের মধ্যে স্মিত এক হাসি তার যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখে ফুটে উঠল। স্বধা দেখলো তাকিয়ে। এই এক্সপ্রেশন জন্মইস্তক তার আর বাবার ব্যাক্তিগত ও পারস্পরিক সংলাপ। সকলেই বলে সে আর তার বাবা দুই ভিন্ন গ্রহের অধিবাসী। কিছুতেই কোনো সামঞ্জস্য নেই, মতের মিল তো নৈব নৈব চ। অথচ সে আর তার বাবা'ই শুধু জানে কেন্দ্রাতীগ বলের সংজ্ঞা। সাধারণ চোখে তা অনুধাবনযোগ্য নয়, প্রমাণের তো নয়ই। সেই সূত্রে সে আজও জানতে পারলো তার বাবা এখন কী দেখছে। 

স্বধা চোখ বন্ধ করে ছায়াপথ ভাবল একবার। নিমেষে শহরতলীর যাবতীয় বারিষকে মেক্সিকোর রক্তাভ মাটির ধোঁয়া ঢেকে দিল। নীলাদ্রি আর ফুয়েন্তেসের গ্রিঙ্গো একাকার হয়ে গেলেন। লড়ছে তার বাবা। কর্তব্যের চাঁদমারিতে দাঁড়ালে কোন পুরুষ ভাড়াটে সৈনিক নয়? বিরোধে বিরোধে বাবাকে জর্জরিত করা সে দাঁড়িয়ে আছে সামনে আর অবাস্তব মায়া আগলে তার বাবা খুঁজে চলেছে সেই পুরুষ যে তার অবাধ্য আর অসামাজিক সন্তানটাকে ধারণ করতে পারবে পূর্ণ যোগ্যতায়, মর্যাদা দিতে পারবে আপাত পাথুরে স্তর পেরিয়ে অসম্ভব তরল সেই জলাভূমির যেখানে যখন তখন তুফান ওঠে বিনা সংকেতে। প্রতিপক্ষ মাত্রেই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় তার স্বধার সামনে এ তার কাছে বিষম যন্ত্রণার কারণ তিনি জানেন প্রতিটি আঘাত দেওয়ার আগে স্বধার নিজের ক্ষত হয় চতুর্গুণ, আত্মধ্বংসী নন্দিনী তার। কে বুঝবে তার এই মেয়েকে? 


ভোর হয়ে আসছে।
ইডেনের রিসেপশন স্টাফ কেবিন ওয়ানের পেশেন্ট পার্টিকে ডেকে পাঠালো, জরুরী ইনফরমেশন আছে, স্যার ফোন করেছিলেন...

চিত্রঋণ: অন্তর্জাল


শ্যামলী সেনগুপ্ত

                             


                    চোখ
                            মূল গল্প : ওড়িআ
                              লেখক  : গায়ত্রী সরাফ
                             অনুবাদ  : শ্যামলী সেনগুপ্ত

           সবকিছু দেখতে পাচ্ছি কিন্তু অস্পষ্ট।
            খুব ভালো করে তাকিয়ে দেখলেও বুঝতে পারছি না জিনিসটা কী?এমনকি আমার চারদিকে ঘিরে আছেন যারা,আমার দেখাশোনা করছেন,তাদের মুখগুলিও ঝাপসা লাগছে।ভুল,ওই মুখগুলিও নয়,ভুল,আমার চোখের।সময়ের বয়স্ক আদর আমার শরীরে বার্ধক্য এনে দিয়েছে। সারা শরীরের চামড়া কুঁচকে গেছে।শ্বাসপ্রশ্বাসের সময় বাতাস ঝড়ের মতো ঢোকে আর বেরোয়।বেরনোর সময়  সমগ্র সত্তাকে জোর ঝাঁকিয়ে দিয়ে যায়। শরীর বলতে এখন শুধুই যন্ত্রণা উপলব্ধি করি।যন্ত্রণা আর মৃত্যু  আমার কাছে এখন একটা রুপোর কয়েনের এ পিঠ আর ও পিঠ।ধুকপুক করতে থাকা প্রাণীটি এখনও স্বপ্ন দেখে।
        নিজের অজান্তেই চেঁচিয়ে উঠেছিলাম অসহ্য যন্ত্রণায়।হঠাৎ অস্পষ্ট দেখতে পেলাম সাদা পোশাক পরিহিত কেউ একজন আমাকে ইঞ্জেকশন দিচ্ছে। নিশ্চয়ই একজন নার্স।ইঞ্জেকশন দেওয়ার পরে তিনি জানতে চাইলেন,
      স্যার,এখন কেমন লাগছে?
      খুব কষ্ট হচ্ছে।
       ইঞ্জেকশন দিয়েছি তো,ভালো লাগবে।
       আমার সবকিছু ঝাপসা লাগছে।চশমাটা একটু এনে দেবে?
        দিচ্ছি স্যার,বলে সে চশমাটা  এনে আমার চোখে পরিয়ে দিল,হেসে জানতে চাইল,এখন দেখতে পাচ্ছেন ত?
        আচ্ছা, আমাকে দেখতে পাচ্ছেন?
         মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ বললাম। কিন্তু ওই মুখের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হলাম। বড়ো আপন ওই মুখ।স্মিত হাসি মাখানো মুখে উজ্জ্বল চোখ দুটি আমাকে টান মেরে ফেলে দিল কৈশোর বেলায়।কী দেখছি আমি?নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।সত্যিই কি এই সেই চোখ!যে চোখ দুটি নিয়ে দীর্ঘ দীর্ঘ বছর আমি বেঁচে আছি।আজ সেই চোখ চিনতে ভুল হবেই  না। বলেই তো যে আত্মার  সঙ্গে চোখের সংযোগ আছে। চোখ আত্মার প্রতিবিম্ব।
           ওই চোখ দুটি থেকে আমি দৃষ্টি সরাতে পারছিলাম না।হারিয়ে যাচ্ছিলাম ওই দুই চোখে।আমাকে ওই চোখ দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল জীবনের ওই অবিস্মরণীয় উপত্যকায়
        ⚫
              স্কুল থেকে ফিরে ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেলে ঘুড়ি-লাটাই নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সেদিন।আমাদের সুবর্ণমুণ্ডিয়ার দিকে দৌড়লাম।ততক্ষণে অখি,পপু,সানুরা পৌঁছে ঘুড়ি ছেড়ে দিয়েছে। ওদের দেখে আরও জোরে ছুটলাম।ঘুড়ি ওড়ানো শুরু হল।সকলেই জানে আমি ঘুড়ি ওড়ানোর মাস্টার। লাটাই ছেড়ে ঘুড়ি উড়তে লাগল উঁচুতে, অনেক উঁচুতে। অন্য অন্য ঘুড়ির থেকে তিন গুণ উঁচুতে উড়ছিল আমার ঘুড়ি।বাদল-মেঘ আর অস্তগামী সূর্যের তেরছা কিরণের স্বপ্নময় এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে।
              একটু পরে আমার চারদিকে ঘিরে থাকা হৈচৈ চিৎকার ধীরে ধীরে মিলিয়ে যেতে লাগল।লাল ঘুড়ির সঙ্গে কখন যে হারিয়ে ফেলেছিলাম মনটাকেও, বুঝতে পারিনি।পাশ দিয়ে ভেসে যাওয়া মেঘেরাও আমার চঞ্চল মনটাকে স্বপ্নে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল।নীচে থেকে যাওয়া জনবসতির ভিড়ে আমার মন খুঁজে চলেছিল ফ্রক পরিহিত এক অনামিকাকে।মনে হচ্ছিল কোনো এক অনন্ত দ্বীপের মাঝে হারিয়ে ফেলা মুক্তোটি খুঁজে চলেছি।সবই অস্পষ্ট অথচ অনন্ত যাত্রা।সমস্ত বাস্তব ও অবাস্তবের প্রহেলিকা অতিক্রম করে সাতপরত মনের নীচে সেই দুটি সরল,অকপট চোখ।মুক্তোর মতো উজ্জ্বল সেই চোখ দুটি বাদে আমার কাছে বাকি দুনিয়া হয়ে গেছিল অদৃশ্য।
            হঠাৎ মনে হল সুতোতে ঢিল পড়েছে। দেখলাম  পপু  আমার ঘুড়ি কেটে দিয়েছে।অন্যরা আনন্দে চিৎকার করছে।আমার স্বপ্নেও ঢিল পড়লো।আকাশ থেকে ধপাস করে পড়ে গেলাম নিজেরই উপরে,হুঁশ ফিরল কিন্তু তখনও স্বপ্ন চোখকে রঙিন করে রেখেছে।
            মন্দিরে সান্ধ্য ঘন্টা বেজে উঠতেই  মায়ের কথা মনে পড়লো,"ঘন্টা বাজার আগেই বাড়ি ঢুকবে।নয়তো বাবা খুব রেগে যাবে।" বাড়ি ফিরলাম। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে বইপত্র নিয়ে বসলাম কিন্তু মন তখন ছেঁড়া ঘুড়ির জট পাকানো সুতোর মতো। অথচ আমার চোখদুটিকে অধিকার করে আছে ওই নরম মুখ।মন থেকে মুছে ফেলতে কাগজের ওপরে পেনসিল দিয়ে দাগ কাটতে শুরু করলাম,যেন সেই মুখ ও চোখ এঁকে ফেলতে ছাইছি।আঁকা হল বটে কিন্তু তারা আমাকে তাচ্ছিল্য করতে লাগলো যেন।বিরক্তিতে আঁকিবুকি কাটা কাগজগুলো দলেমুচড়ে মায়ের রান্নাঘরের উনুনের মধ্যে ফেলে দিলাম। পুড়ে যেতে যেতে ওই অর্ধ সমাপ্ত চোখ দুটি যেন বলছিল,"তুমি যে চোখ খুঁজে চলেছ,তা সারা দুনিয়ায় ঈশ্বরের একটিমাত্র সৃষ্টি। পারলে খুঁজে নাও।তোমার ভিতরের অশান্ত প্রগলভতা নির্বাপিত হবে।"
             পরের দিন সকাল। স্কুল বসার অনেক আগেই বইয়ের ব্যাগ নিয়ে ঘাটের দিকে দৌড়লাম।ছোট ঘাট থেকেই নৌকা চেপে ছোট নদী পেরিয়ে ওপারের স্কুলে যাই রোজই।আমাকে সম্মোহনে ঘিরে রাখা ওই চোখদুটিও একই নৌকায় যায়। তাই আমি বেশ খানিকটা আগেই ঘাটে পৌঁছাই যাতে ও আগেই পেরিয়ে না যায়। যতক্ষণ ও না পৌঁছয়,আমি নানা বাহানায় এড়িয়ে যাই পরিচিত মাঝিকে।তবে সেদিন পৌঁছে দেখি ও বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে।নৌকো এসে ঘাটে লাগল।বাবার সঙ্গে বসল ও।আমিও সুযোগ করে ওর সামনে বসলাম। নৌকো ছেড়ে দিল।আমি ব্যাগটা ঠিক করে রাখতে রাখতে টের পেলাম ও আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।আমি চাইতেই কেমন যেন দু'জোড়া চোখ হারিয়ে গেল পরস্পরের ভিতরে।অপলক সেই দৃষ্টি। নৌকো দুলছে,সঙ্গে ঘাটও যেন দুলছে।দুলছে আকাশ কিন্তু দু'জোড়া চোখ স্থির।অপলক দৃষ্টির মাঝে দুটি স্বপ্নিল আত্মা আত্মস্থ।এর মধ্যেই শোনা গেল মাঝির হাঁকডাক,"ভাই ঘাটে লাগল, নামো,নেমে যাও সকলে।"
         নৌকো গিয়ে ঘাটে লাগলো আর তখনই ওই চোখ যেন বিদ্যুতের মতো ঝলমল করে উঠল।সকলে নেমে যাচ্ছে, আমার চোখ সরছে না।ওর বাবা ওর হাত ধরে নামিয়ে দিলেন,ও বারবার পেছন ফিরে দেখছিল।মাঝির হাতে পয়সা দিয়ে আমি দ্রুত ওর পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম। বাজার পেরিয়ে ওর প্রাইমারি স্কুল।ও স্কুলের গেট দিয়ে ভিতরে চলে গেল।ব্যাকুল হয়ে সামান্য সময়ের জন্য চোখ বন্ধ করলাম। মনের মধ্যে ওই চোখের প্রতিফলন।আর আমার অবাধ্য ঠোঁট দুটি প্রসারিত হয়ে স্মিত হাসিতে ভরে উঠছিল।ঘন্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে দারোয়ান গেট বন্ধ করে দিল।মনে হচ্ছিল, আমার মন ওই গেটের ও পারে আর ভারি পা নিয়ে নিজের স্কুলের দিকে এগিয়ে চলেছে আমার শরীর।গুম হয়ে বসেছিলাম ক্লাসে।অন্যমনস্ক, ভয়ংকর অন্যমনস্ক অথচ সারা ক্লাস জুড়ে হৈচৈ,হাসাহাসি, স্যারদের উঁচু গলায় পড়ানো।আমার কাছে তখন সবকিছুই বরফের মতো!সমস্ত দুনিয়া যেন নীরব!একসময় স্কুল ছুটি হল।ছুটির ঘন্টার প্রথম ঠং শুনতে শুনতেই গেট পেরিয়ে গেলাম।এক নিঃশ্বাসে পৌঁছে গেলাম ওর স্কুলের সামনে।দারোয়ান খুলে দিয়েছে ওদের গেট।
           ওহ্!যেন আমার মন ও শরীরের মাঝের তালাটা খুলে গেল।ঝিলমিল তারাদের মতো এখন অনেক চোখের ভিড়ে আমার স্বপ্নের চাঁদের উদয় হবে!কিন্তু এ কি!সব তারা চলে গেল,আমার চন্দ্রমালা কোথায়?আমার মনের আকাশ জুড়ে কালো মেঘ।স্কুল তো ফাঁকা হয়ে গেল!দৌড়লাম ঘাটের দিকে।সকলে বসে আছে নৌকোয়,ওকে পেলাম না।এদিক ওদিক তাকালাম,দেখতে পেলাম না।হঠাৎ দেখি নৌকোর এক কোণায় চাদর মুড়ি দিয়ে  বসে আছে বাবার পাশে।বাবা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।ঠেলেঠুলে কায়দা করে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম ওর কাছে।ওর চোখ বন্ধ, সারা শরীর কাঁপছে।আমার খুব কষ্ট হলো অথচ জিজ্ঞেস করতে পারছিলাম না কিছুই। ওদের পাশে বসে থাকা এক বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়ের শরীর খারাপ?
         হ্যাঁ।
          আমার বুক মুচড়ে উঠতে লাগল।অনুভব করলাম যেন ওর বন্ধ দুই চোখের পাতার ভেতরে আমার সব স্বপ্ন  ভালোবাসা ভাবনারা বন্দি হয়ে আছে।সূর্য পাটে নামছিল।ঘাটে এসে লাগল নৌকো।ওর বাবা  প্রথমে নেমে গেলেন।তারপর ওকে কাঁধে বসিয়ে  লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগলেন। আমি পাগলের মতো ওদের পেছনে পেছনে প্রায় দৌড়তে লাগলাম। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখি ও চোখ মেলে আমাকে দেখছে।চোখদুটি ছলছলে,লাল।মনে হল,অস্তগামী আকাশ থেকে লাল রং এনে আমাকে প্রেমের রঙ উপহার দিল।ওরা নদীর বাঁধ পেরিয়ে ক্ষেতের আলপথ দিয়ে দূরে চলে গেল।আমি স্থাণুর মতো সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।
         এর মধ্যে দশ দিন পেরিয়ে গেছে।
          সেদিন শরতের প্রাক্ সন্ধে।মলিন হয়ে আসা লোহিত সূর্যের আলোয় সারা আকাশ লাল,নদীর জলেও তার ছবি।নদীর তীরের ঢেউ খেলে যাওয়া কাশের ডাঁটায় লাল রঙ।যেন আমার অভিমানের সঙ্গী সমস্ত প্রকৃতি।কত যে বিকেল কেটে গেছে নদীর ঘাটে পারাপারের দিকে তাকিয়ে। যদি সে ফিরে আসে।ওকে দেখতে না পেয়ে মলিন সূর্যের মতো অবসন্ন মন নিয়ে আমিও বাড়ি ফিরতাম।
           নাঃ,আর পারছিলাম না।
           আমার এই অবস্থার জন্য সকলে দায়ী।
           এই নদী।এই নৌকো।এই কাশফুল।আর দায়ী ওই গভীর ক্ষেত।রোজ নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে আমি ওই আলপথের দিকে তাকিয়ে  দিগবলয় প্রকম্পিত করে  দিনের পর দিন চিৎকার করেছি,উত্তর পাইনি।আজ সকলের কাছ থেকে উত্তর চাই।বসে ছিলাম ঘাটের পাশে একটি পাথরের উপরে।ক্লান্ত শরীর,সারা শরীর কেমন অবশ।নদীর ঠাণ্ডা বাতাসে চোখ বুঁজে আসছিল।কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বুঝতে পারিনি। জ্ঞানশূন্য  হয়ে গেছিলাম ।মনে হলো সোনালি কাশের বনে একটা লাল ফ্রক পরে ও দৌড়চ্ছে।ফিরে ফিরে আমাকে দেখছে,ডাকছে,আবার দৌড়চ্ছে। আমিও ওর দিকে পাগলের মতো হাত বাড়িয়ে দৌড়চ্ছি।ও হারিয়ে যাচ্ছে কাশের বনে।
            দাঁড়াও...
           চিৎকারের সঙ্গে পড়ে গেলাম পাশের কাদাজলে। ঘুম ছুটে গেল। সারা শরীরে কাদা। নদীর জলে নামলাম। আর ঠিক তখনি ঝাঁকে ঝাঁকে চিল শকুন  ক্যাঁ ক্যাঁ  করতে করতে উড়ে গেল আমার মাথার উপর দিয়ে। কিছু দূরে গিয়ে  নদীর পৈঠায় নেমে কি সব ঠুকরে ঠুকরে ছিঁড়তে লাগল ।শিরশির করে উঠলো সমস্ত শরীর।বুক ফাটানো কান্না ছড়িয়ে পড়লো আমার সারা শরীরে।চোখ জলে ভেসে যাচ্ছে। বুকজলে দাঁড়িয়ে ডুব দিলাম।জলের ভিতরে সেই মোহিনী চোখ দুটো আমার দিকে তাকিয়ে। শ্বাসকষ্ট হতেই মাথা তুললাম জলের ভিতর থেকে আর আমার শ্বাসশব্দ ছাপিয়ে  শুনতে পেলাম কাঁসর ঘন্টা ঢাকের আওয়াজ। জয়জয়কার করতে করতে মা দুর্গার মূর্তি  বিসর্জন দিতে শোভাযাত্রা করে  লোকেরা আসছে।আমি স্থাণুবৎ তাকিয়ে ছিলাম।
          শোভাযাত্রা এসে পৌঁছলো একটু দূরে একটা সামান্য উঁচু জায়গায়। উলুউলু শঙ্খের শব্দে প্রতিমা নামানো হল।বিসর্জনের আরতি হল।এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে আমি সব দেখছিলাম। মাতৃমুখ যেন আমার দিকেই তাকিয়ে। এক নিমেষে পুরোহিত জল ছিটিয়ে বুঁজিয়ে দিলেন মাতৃদৃষ্টি।কাঁসর ঘন্টায় কেঁপে উঠলো চারদিক।জয় মা দুর্গা শব্দে সামান্য ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হল মায়ের মূর্তি জলের মধ্যে। জনে জনে ফিরে গেল।ফাঁকা হয়ে গেল নদীর তীর।আমার মনে হল,ঠিক ওই জায়গায় বুদ্বুদ উঠছে।ভেসে উঠল মূর্তির কিছু অংশ।দেখলাম মায়ের মুখ।আমি যেন কখন পৌঁছে গেছি ওইখানে, যেখানে প্রতিমা বিসর্জন হয়েছিল।দেখলাম, দেবী মায়ের মুখ যেন অবিকল তার মুখ।নির্বাপিত চোখ দুটি  দৃষ্টিতে পরিপূর্ণ। বড়ো বড়ো চোখ দুটি আমার দিকে তাকিয়ে ...ওহ্...সেই চোখ!
              সেই চাহনি!
    ⚫
               স্যার...!
       নার্সের ডাকে ফিরে তাকাই।একটু নুইয়ে পড়ে সে আমার চশমা খুলে দিল।আমি তখনও ঘোরের ভিতরে।কোন কালের সেই নদীর ঘাটে দাঁড়িয়ে সেই চোখের দৃষ্টিতে হারিয়ে গেছিলাম। ধীরে ধীরে ফিরে পেলাম নিজেকে।অতি পরিণত বয়সের মুমূর্ষু ফাটকে বন্দি ,শয্যাশায়ী আমি।
            ঝাপসা দৃষ্টি।
             নিষ্প্রভ মন।
            অক্সিজেন মাস্ক থেকে  অম্লজান নিয়ে  সংকোচন-প্রসারণের হৃৎপিণ্ড।আর তার ভেতরে সারা জীবনের সঞ্চয় অসংখ্য ভাবনা আর অনুভূতি ।আজ 'আমি' মানে কুড়িয়েবাড়িয়ে এইটুকুই।এটুকুই আমাকে জীবন্ত বলে প্রমাণ করছে নয়তো দাগের ওপারে আমার সঙ্গে জন্মে দীর্ঘ বাহাত্তর বছর ধরে অপেক্ষায় থাকা মৃত্যু। হঠাৎ বুক ধড়ফড় করে উঠল।শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে লাগল।সামান্য সক্রিয় হাত নেড়ে  সংকেত দিলাম।নার্স দৌড়ে এলেন।আমার অবস্থা দেখে ডাক্তারকে কল করলেন।
          ডাক্তার এলেন, সঙ্গে সেই নার্স,যার মুখটি আমার বড় আপন।ডাক্তারের নির্দেশ মতো তিনি আমাকে দুটো ইঞ্জেকশন দিলেন।আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।ডাক্তার চলে যাওয়ার পরেও তিনি পাশে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন।আমার প্রিয় চোখদুটির দিকে তাকিয়ে আমিও।
           অনুভব করছিলাম আমার সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে।নিষ্প্রভ হয়ে আসছে অনেকানেক সূক্ষ্মতম চেতনা।
            আমার চোখদুটি কিন্তু ওই দুটি চোখের  সঙ্গে এক হয়ে গেছে।
                                       *******

     লেখক পরিচিতি  : শ্রীমতি গায়ত্রী সরাফ,কথাশিল্পী,অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। ২০০৪ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড.আবদুল কালাম আজাদ-এর কাছ থেকে বেস্ট টিচার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।'ইটা ভাটির শিল্পী ' উপন্যাসের জন্য ২০১৭সালে সাহিত্য একাডেমী পুরস্কারে সম্মানিত। মোট ১৪টি গল্প গ্রন্থ রয়েছে।বর্তমানে ভূবনেশ্বরে থাকেন।
       
                       
ছবি - আন্তর্জাল
           
  

    
            
        

অমিতাভ সরকার

                 




বেজন্মা ( একাদশ পর্বের পর)

দেখতে দেখতে কেটে গেছে পাঁচ পাঁচটা বছর…। রাজ্যে ঘটে গেছে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে রাবেয়াদের বাড়ি পার্টি অফিসে পরিবর্তিত হয়েছে। কালীপ্রসন্ন চক্রবর্তী এখন পঞ্চায়েত প্রধান, তবে অন্য রঙের ছাতার তলে। সব শুনে কৃষাণ আর কোনও উদ্যোগ নেয় নি সম্পত্তি ফিরে পাবার আশায়। ইতিমধ্যে শামসুদ্দিনের আব্বা দেখা করে আশির্বাদ করে গেছে দুজনকে।


অপারেশনের পর কৃষাণের পা আর আগের জায়গায় ফিরে আসে নি। হাঁটার জন্য আজীবন সঙ্গী হয়েছে ‘ক্র্যাচ’। এই পাঁচটা বছরে পালটে গেছে অনেক কিছু। পুরনো আন্দুল স্টেশন নতুন চকচকে হয়েছে। অসুস্থ সিংজী খুব একটা ধাবায় আসতে পারেন না। রাবেয়ার মা গত হয়েছেন বছর দুয়েক হলো। এখন সিংজী-বিদ্যা, কৃষাণ-রাবেয়া মিলে এক সঙ্গেই থাকে। কৃষাণ কাশ্মীর থেকে ফিরতেই সিংজীর ধাবার দায়িত্ব দিয়েছেন। ফোর্স থেকে এককালীন টাকা পেয়ে ধাবাকে নতুন ভাবে সাজিয়েছে কৃষাণ। আগের মত দড়ির খাটিয়া পালটে চেয়ার-টেবিল এসেছে। কৃষাণের আগ্রহে বিল্লু, শ্যাম, নান্টা ধাবার কাজে যুক্ত হয়েছে। চেয়েছিল সকলে মিলে ধাবার দায়িত্ব নিতে। কিন্তু মানিকদাকে অনেক অনুরোধ করেও ধাবায় যুক্ত করা যায় নি। অবশ্য মানিকদা প্রতিদিন কাজ সেরে ফেরার সময় ধাবায় কিছুক্ষণ সকলের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে যায়। রাবেয়া বি.এ পাশ করে কাছেই একটা কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে বাচ্চাদের পড়ায়। বিল্লু আব্বা হয়েছে বছর তিনেক হলো। ছেলে রাবেয়ার স্কুলেই পড়ে। মানিকদার ছেলে হাইয়ার সেকেন্ডারীর পর আর পড়তে চাইলো না। তাই মানিকদা এক নিত্যযাত্রী ভদ্রলোককে অনেক অনুরোধ করে হাওড়ায় কারখানায় ঢুকিয়েছে।         

#        

‘কৃষাণ’দা… কৃষান’দা…’ ধাবার কাজকর্মে তদারকি করতে করতে ঘুরে তাকায় কৃষাণ। চীৎকার করতে করতে দৌড়চ্ছে শ্যাম। তাকে দৌড়তে দেখে কৃষাণ বাইরে বেরিয়ে রাস্তার সামনে এসে দাঁড়ায়। 

“কৃষাণ’দা…, স্টেশনের…, স্টেশনের…” উত্তেজনায় হাঁপায় শ্যাম। কৃষাণ গ্লাসে জল এগিয়ে দেয়। এক চুমুকে শেষ করে শ্যাম।

“এবার বল কী হয়েছে? স্টেশনের কাছে কী…”   

“বাজারে যাওয়ার সময় দেখলাম…! স্টেশনের বেঞ্চে একটা বাচ্চা…, কে যেন ফেলে দিয়ে গেছে…!!  

“সেকি!! বেঁচে আছে ?     

“এখনো বেঁচে আছে… দেখে এলাম”! কৃষাণের মনে পড়ে যায় তার নিজের কথা। এমনি করেই হয়তো তাকেও ফেলে দিয়ে গিয়েছিল কোনও এক কুন্তিমা। মূহুর্তে দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ডান হাতে ক্র্যাচ নিয়ে দু’দিক দিয়ে আসা বাস, লরি পেরিয়ে হাইরোড ধরে ছুটতে থাকে কৃষাণ। তাকে ওই ভাবে রাস্তা পার হতে দেখে চারপাশের লোকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সোরগোল শুনে ধাবার কর্মচারীরাও বেরিয়ে আসে। বিল্লু, নান্টা ছুটে যায় কৃষাণকে লক্ষ্য করে।           

চারপাশের জটলা সরিয়ে শিশুটির কাছে যায় কৃষাণ, একটা তোয়ালে মোড়া শিশুটি হাত-পা নাড়ছে তখনও। শ্যাম কাছের চায়ের দোকান থেকে একটা গ্লাসে দুধ আর চামচ নিয়ে আসে। সকলে মিলে পরম যত্নে আস্তে আস্তে দুধ খাওয়ায় শিশুটিকে। চোখবন্ধ অবস্থায় হেসে হাত বাড়িয়ে দেয় শিশুটি। কৃষাণ শিশুটির হাতে আলতো চুমু খেয়ে সাবধানে কোলে তুলে নেয় শিশুটিকে।       

সেখান থেকে জিআরপি, থানা-পুলিশ করে, অনেক রাতে শিশুটিকে নিজের করে পায় কৃষাণ। ডান হাতে ক্র্যাচটা নিয়ে বাঁহাত দিয়ে শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়। অদ্ভুত এক প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে কৃষাণের সারা মুখে। ইতিমধ্যে খবরটা চারপাশে চাউড় হয়ে যায়…। 

এদিকে রাত বারোটায় কৃষাণ ঘরে না ফেরায় রাবেয়া ধাবার সামনে এসে দাঁড়ায়। সব শুনে ধাবার একজনকে নিয়ে দ্রুত পায়ে নিয়ে স্টেশনের এগিয়ে যায়। স্টেশনের কাছাকাছি এসে দূর থেকে কৃষাণকে শ্যাম আর নান্টাকে সঙ্গে আসতে দেখতে পায়। কাছাকাছি আসতে রাবেয়াকে দেখে কৃষাণ শিশুর মতো হেসে ফেলে। মনে হলো যেন, বহুদিনের আকাঙ্ক্ষিত মহার্ঘ সম্পদ তার হাতে এসেছে। রাবেয়া কাছে আসতে এগিয়ে দেয় তার দিকে। ‘এই নাও, তোমার জন্য…। তোমার অনেক দিনের ইচ্ছে…’। তার কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠে সকলে। রাবেয়া দুহাত বাড়িয়ে বুকের কাছে সাপটে ধরে কপালে আলতো চুমু দিয়ে ফিসিফিয়ে বলে; “আমার ছোট্ট কৃষাণী”! 

কৃষাণ ক্র্যাচটা শ্যামের হাতে দিয়ে রাবেয়ার কাঁধ ধরে। কৃষাণীকে নিয়ে এগিয়ে যায় তাদের গন্তব্যের দিকে। ঘন কালো আকাশ একটু একটু করে পালটাচ্ছে নিজেকে। ভোর হতে আর নেই বাকী।।       

শুরু হলো ছোট্ট কৃষাণীকে নিয়ে আর এক গল্প ……… 


(সমাপ্ত) 

রবিবার, ২৫ জুলাই, ২০২১

জয়তী রায় ( মুনিয়া)

                             




ঘরোয়া খাদ্যে অমৃত পুষ্টি




  করোনা থাবা ঘরের দরোজা।  নিস্তার মিলবে কি না কেউ জানি না। প্রতিটিদিন মূল্যবান। এখন বোঝা গেছে, কেন বলা হয়, একটি সুস্থ দিন আশীর্বাদের মত। 

  কাল কিসনে দেখা... মহা মূল্যবান এই বাণী। কালকে কি অপেক্ষা করে আছে জানি না। আজ জানি। আজকের লড়াই জানি। নিজেদের কর্মফলের দিকে এগিয়ে চলেছি সেটাও জানি। কর্মফল কোনো আধি ভৌতিক ব্যাপার নয়। যে কাজ করছি তার ফল ভুগছি। সঙ্গে আরো দশজনকে টেনে নিচ্ছি।

পৃথিবীর অন্য দেশ পারছে আমরা পারছি না? মৃত্যুকে বরণ করে নিয়ে আসছি। লক ডাউন জরুরি। হচ্ছে না।

 তবু, কুর্নিশ তাদের যারা একটা অসহায় অবস্থায় লড়াই করে যাচ্ছেন। সেই আমাদের ডাক্তার ভগবানের দল। উপর থেকে কেউ নেমে আসেন না। ডাক্তার আসেন। নিজে নিরাপদ থাকবেন না হয়ত, জেনেও আসেন। 

  ***

আমরা লড়াই করছি। প্রতিদিন নিজের মত করে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি ভাইরাসের প্রবল কামড়। রোজ মেপে চলেছি অক্সিজেন। 

 সত্য যতই নির্মম হোক জারি থাক লড়াই। মন ভালো রাখুন ... বললেই তো মন ভালো হয় না। সেটাও যেমন সত্যি, তেমনি ভয় কিন্তু সৃষ্টি করে ক্ষতিকর হরমোন। তার ফলে লড়াই করার ক্ষমতা কমে যেতে থাকে। ফুসফুসের বাতাস কম হতে থাকে। 

এনার্জি ক্ষয় হয় বেশি কথা বললেও। এইসময় মনের মধ্যে সৃষ্টি হয় ত্রাস। ত্রাসের আক্রমণে মাথা ঠাণ্ডা রাখা খুব মুশকিল। বাড়ির লোকের সঙ্গে অশান্তি হয়ে চলে। মুখ ভার। ভিতরের ক্ষয় বৃদ্ধি পায়। অতীতের কথা মনে পড়ে। করোনা আগের পরিস্থিতি কত ভালো ছিল! মৃত্যু হচ্ছে কাছের মানুষের। ভয়ঙ্কর রকমের শূন্যতার সৃষ্টি হয়। অতল খাদের মধ্যে ডুবে যেতে ইচ্ছে করে। এনার্জি আর অবশিষ্ট থাকে না। 

   এনার্জি হল জ্বালানি।  বাঁচিয়ে রাখতে হলে ধ্যান জরুরি। ধ্যান না হোক, নিজেকে নিয়ে একটু বসতেই হবে। বিশেষ করে দুপুরবেলার সময়। ওই সময় সবচেয়ে ক্লান্ত থাকে মন। 

ভাইরাস এসে গেছে। অস্বীকার করার উপায় নেই। এই সময় নিজেকে চাঙ্গা রাখতে হবে। দুঃখ বোধ আক্রান্ত করবে। এটাও কিন্তু , মহামারীর প্রক্রিয়া। মানুষকে ভিতর হতে বিপর্যস্ত না করে দিতে পারলে, আক্রমণের কামড় সহজ হবে না। 

 দুঃখ বোধ থাকুক। তাকে নিয়ে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। বাজারে যেতে হবে। কাজ করতে হবে। মনের এনার্জি লেভেলের দিকে সতর্ক নজর রাখতে হবে। বিপদের সময় কাজে লাগবে এই মন। এমনকি বিপদের পরেও কাজে লাগবে। অনর্থক কথায় ভারাক্রান্ত হয়ে কি লাভ? 

****

নিজের রুটিন ঠিক করে নিন। এখনো লকডাউন হয় নি। অফিস যেতে হচ্ছে। ভয় নয়। যেতে হচ্ছে যখন যেতে হবে। 

সব রকম সতর্কতা সেই সঙ্গে নিজেকে উৎসাহ দেওয়া। পারব। আমি ই পারব। পারতেই হবে। 

  

  ব্যায়াম করা জরুরি। মহামারীর জন্য নয়। এমনিতেই প্রয়োজন। ব্যায়াম কথাটা শুনলেই আমাদের মত মধ্যবয়সী মহিলা পুরুষের কপাল কুঁচকে যায়। আমি বলি, চলতে ফিরতে ব্যায়াম করা যাক। 

১. দুই হাতে যেন ধরে আছি দুটো বালতি , এই ভাবে বালতি দুটো শ্বাস নিয়ে উপরে তুলে, নামিয়ে কোমরের কাছে রেখে , নিচে শ্বাস ছেড়ে নামাতে হবে। পাঁচ বার। শ্বাস নিয়ে উপরে। কোমরে ধরে রাখা। নিচে ছেড়ে দেওয়া। রান্না করতে করতে, অফিসে কাজ করতে করতে করাই যায়। 

২. পিছন দিকে হাঁটা। দশ পা গুণে গুণে। পাঁচ বার। 

৩. লিখতে লিখতে , একটু থেমে, মুখ দিয়ে বাতাস টেনে, মুখ ফুলিয়ে দম বন্ধ করে বাতাস ছেড়ে দেওয়া। যতবার খুশি। 

নিজেই  বুঝবে কতখানি আরাম পাচ্ছে ফুসফুস। 

*****

 বলো তো, কোন ইন্দ্রিয় মানুষের একাধারে বন্ধু ও শত্রু? সে হল জিভ। জিহ্বা। 

স্বাদবস্তু এখানেই অবস্থান করে। আজ ফাস্টফুডের এত রমরমা, সে কিন্তু আমাদের এই ইন্দ্রিয়ের কারণে। 

  মাঝে মাঝে পান্তাভাত খাই। 

লালচাল ভিজিয়ে রাখি। করোনা কাল চলছে। তার উপর গরম। প্রয়োজনীয় সমস্ত উপাদান যেমন পটাশিয়াম ক্যালসিয়াম প্রচুর পরিমাণে থাকে। পান্তাভাত থেকে ভিটামিন সি ভিটামিন বি ১২ পাওয়া যায়। দ্রুত যোগায় শক্তি। অনেকক্ষণ কাজ করা যায়। 

পান্তাভাতের জল/ তিন পুরুষের বল।।

 ৮ থেকে ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হবে। তৈরি হয় ফাইটিক অ্যাসিড। ল্যাকটিক অ্যাসিড। আয়রন ক্যালসিয়াম পটাশিয়াম এত বেশি যে , এই সময় শরীরকে লড়াকু করে তুলতে সাহায্য করে। 

*****

মানুষ চেষ্টা করে যায়। পরিস্থিতি প্রতিকূল। এমন ভয়াবহ মহামারীর কবল থেকে বাঁচার উপায় আমাদের খুঁজতে হবে। হঠাৎ ছোবল মারবে এই ভাইরাস। পরিচিত ডাক্তারের ফোন নম্বর থাক। অক্সিজেন মাপার মেশিন থাক। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়া থাক। শরীরে জোর থাক। সেইসঙ্গে মনের জোর থাক।

  যুদ্ধক্ষেত্রে এইগুলি সম্বল করে নেমেছি। তারপর? 

  কাল কিসনে দেখা?

শনিবার, ২৪ জুলাই, ২০২১

পিয়াংকী

                                 




সয়াসিরিজ






সময় কী ভীষণ অহংকারী। যেন কারোর কাছে এর কোন জবাবদিহি করার দায় নেই,অপেক্ষা নেই।এই তো সেদিন সৃজন ব্লগের রান্না বিভাগীয় গরম বাহার ঘরের দায়িত্ব তুলে দিল সম্পাদিকা বন্ধু পারমিতা।আজ লিখতে বসে দেখি একমাস কোথা দিয়ে কেটে গেছে চোখের পলকে,সকলে সাথে আছেন এটুকুই তো বড় পাওয়া জীবনের। 


আজ যে রান্নাটা করব,সেটা ভীষণই টাইমসেভার।এই ব্যস্ত পৃথিবীতে আমার মত ঘরে বসে দু'চার লাইন কবিতা লেখা অথবা হাবিজাবি রান্না নিয়ে গবেষণা ছাড়াও মেয়েদের এখন অনেক অনেক দায়িত্ব সাথে বাইরের জগৎ কর্মক্ষেত্র। এটা হয়তো তাদেরকে একটু হলেও উপকার করবে যারা বিকেলে ঘেমে-নেয়ে বাড়ি ফিরে দেখেন খাটের ওপর পা তুলে বসে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছেন ছোট মামাশ্বশুর অথবা জ্যেঠতুতো ননদনন্দাজামাই অথবা ছেলের রিইউনিয়ন ব্যাচ 


সয়াবিন।হাইপ্রোটিন ভিটামিন রিচড। কিন্তু সুন্দর করে মেকওভার করালে ইনিও হয়ে উঠতে পারেন রিসেপশন অ্যাট্রাকটিভ। 


পরিমাণ অনুযায়ী সয়াবিন ভিজিয়ে রাখুন গরম জলে দশ মিনিট, ছেঁকে জল ফেলে দিয়ে ঢেলে দিন মিক্সিং জারে।আন্দাজ মত লবণ আর সামান্য মৌরী দিয়ে পাঁচ সাত সেকেন্ড করে দুবার ঘোরান।একটু কচকচে একটু পেস্ট এরকম থাকতে হবে মিক্সচারটা। এরপর কুচিয়ে কাটা পেঁয়াজ রসুন আদা কাঁচাপাকা লংকা সামান্য জোয়ান কয়েকদানা চিনি দিয়ে হালকা হাতে মাখুন,জলের প্রয়োজন হবে না।মেখে নেবার পর দুচার চামচ ব্যাসন আর আন্দাজি নুন দিন।আরেকবার মেখে নিয়ে বলের আকারে গড়ে নিন।শেপ দেবার সময় হাতে জল বা সামান্য তেল লাগিয়ে নিলে চ্যাটচ্যাটে হয়ে আটকে যাবে না। গোল ছাড়া নিজের পছন্দসই অন্য যেকোনো শেপ দেয়া যায়। 


  এরপরের স্টেপ সকলেই বুঝতে পারছেন।সয়াবলগুলো বেশ করে ডুবিয়ে দিন তেলে। তাপ মাঝারি রেখে ভাজতে হবে। আগুনের আঁচ বাড়িয়ে ভাজলে ওপরে পুড়ে লাল হবে ভেতর থাকবে কাঁচা, তাই খুব যত্ন নিয়ে এগোতে হবে, এই ভাজাটা যত ভালো হবে রান্নাও জমবে তত।

এই পর্যায়ে এসে স্ন্যাকস হিসেবে অতিথিকে কিছুটা সার্ভ করে দিন অনিয়ন রিং আর রেড গ্রিন দুরকম সস দিয়ে।

বাকী কিছু 'বল' আছে তো এখনো। চলুন গ্রেভি বানিয়ে নিই।খুব সহজ। একটা পাত্রে টকদই নুন সামান্য চিনি গোলমরিচগুঁড়ো অল্প ময়দা আর একটু গলানো ঘি, ফেটিয়ে নিন ভালো করে। ননস্টিক প্যানে বাটার দিন, মেল্ট হবার পর দারচিনি এলাচ ফোড়ন। অ্যারোমা বেরোতে শুরু হলেই ফেটিয়ে রাখা মিশ্রণ। যাস্ট দুমিনিট নেড়েই আভেনের তাপ একদম কমিয়ে ঢেলে দিন দুধ।হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন। দুধ।তবে গরম দুধ নয় একেবারেই।সাথেই ভেজে রাখা বলগুলো।  এরপর অর্ধেক ঢাকা দিয়ে  মিনিট চারেক সময় নিয়ে পুরো বিষয়টা তাপে মজতে বসিয়ে  আপনি চলে যান প্লেট রেডি করতে।ফিরে এসে দেখবেন রান্না রেডি। ওপর থেকে কসৌরিমেথি বা ভাজাজিরেগুঁড়ো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়ে পরিবেশন করুন সয়াসিরিজ।


টিপস 

মিক্সচারে শুরুতেই নুন  দেবেন না, কারণ নুন যে জল রিলিস করবে সেটা মেকাপ করতে অনেক ব্যাসন লাগবে।ব্যাসন কিন্তু শুধু শেপের জন্য, বেশি হলে স্বাদ নষ্ট হবে


দুধ দেবার সময় আঁচ একদম লো থাকবে, সামলাতে না পারলে আগুন নিভিয়ে দেবেন


 যেহেতু এই রান্নাটা গা মাখা ধরণ তাই বলগুলোকে খুব সাবধানে ওলটপালট করে নিতে হবে নইলে সব বলে গ্রেভি টাচ নাও করতে পারে।

    



সোনালী চক্রবর্তী

                                           


 

উত্তরাধিকার


কেন ভ্রমের ব্যাখ্যা মাত্রেই কুয়াশার ইমেজারি আসে, বেনারসী মাঘী পূর্ণিমার চবুতরায় বসে ভাবছিলেন কমলিনী। সেই ষোলোতে বিলেত ফেরত ব্যারিস্টার বাবার বুক থেকে নিজের শিবিরের সর্বময়ী কর্ত্রী হতে চলে আসতে হয়েছিলো পৃথিবীর প্রাচীনতম জীবিত এই নগরীতে, আর ফিরে যাওয়া হয়নি কমলা গালর্স স্কুলের মেধাবী ছাত্রীটির। সংষ্কৃতে অসামান্য ব্যুৎপত্তি ছিলো, অথচ মেয়েমানুষ কিনা, দামী পাত্র যেচে এসেছে, ফিরিয়ে দেওয়ার মূর্খামিটা স্বাধীনতাপূর্ব মহানগরীতে বসেও তার প্রগতীশীল পিতা ঠিক করে উঠতে পারেন নি। কমলের মত রূপ তাই নাম পেয়েছিলেন কমলিনী অথচ ব্যাক্তিগতভাবে তার মনে হয়েছে বরাবর, নালের অধিক অনমনীয় জেদই নিয়তিতে এই নাম লিখেছিলো। নাহলে জন্মদাতার শেষকৃত্যেও উপস্থিত না থাকার সিদ্ধান্ত তিনি নিতে পারলেন কী করে? কেনই বা বত্রিশ বছরের পর থেকে আজ আঠারো বছরের উপর তিনি স্বেচ্ছায় একা? তার মন কি এই দুর্গ, প্রাসাদ আর একশ আট ঘাটের সম উপাদানে নির্মিত? ব্রাহ্মমুহূর্ত সমাগত। পাথরঅবশ শীতে নির্লিপ্ত কমলিনী কেদারের সিঁড়ি ভেঙে নামতে থাকলেন। ডুব দেবেন তিনবার। উঠে চক্রবর্তী উপাধিধারী শৈব শ্বশুর বংশের প্রতিষ্ঠিত মন্দিরে জল ঢেলে পীতাম্বরপুরায় ফিরবেন। এ তার বারো মাসের নিয়ম, প্রলয়ের দিন অবধি হয়তো আর নড়চড় হবে না। তবে আজ বিশেষ দিন। রক্তপ্রবাহে আজকের মত অদ্ভুত রোমাঞ্চ তিনি দীর্ঘ, দীর্ঘদিন টের পাননি। গঙ্গোদক স্পর্শ করলেন। প্রবাহ পৌঁছালো মধ্যগতি পেরিয়ে আরেক আদি জনপদ, হালিশহরে।


জীর্ণ ধাপ বেয়ে পিতলের কলস ভরে উঠে আসছেন সিংহ রাশির জাতিকা আরেক নারী। মধ্য চল্লিশেও যার গড়ন ভাস্কর্য আর নীল চোখ দর্শককে বিব্রত করে বিস্ময়ে, কোনোদিন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া প্রগাঢ় যুক্তিবোধ অবনত হতে বাধ্য করে তার্কিকদের, আর অন্তরমহলে বিপরীত ও সম লিঙ্গের যাবতীয় প্রতিনিধিদের করে তোলে ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত। কুমারী চতুর্দশীকে রাতের অন্ধকারে বিশালাক্ষ্যা পেরিয়ে কলকাতায় পৌঁছে দিয়ে পাত্রস্থ করে ফিরতে পেরেছিলেন বিক্রমপুর মৌজার নায়েব, কুলদেবতা কালাচাঁদের পায়ে শেষ নিশ্বাস ফেলার সময় এই ছিলো তার একমাত্র স্বস্তি। পাড় থেকে বহুবার ডাক শুনেছিলেন,

-- "ও মাঝি, নৌকায় কী?"

ধাতব ফলার উজ্জ্বলতা রাতের অন্ধকারে অতি মূল্যবান রত্নের চেয়েও বেশি হয়। শিহরিত অথচ অকম্পিত কণ্ঠে রসিকতা মিশিয়ে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন প্রতিবার,

-- "কুমড়া গো কত্তা, কুমড়া, মাচায় হইসে, দিয়া আসি"

আড়াই টাকার একখানা শাড়ি, দুইহাতে একগাছি করে শাঁখা পরিয়ে দুর্দম এক ঢাকাইয়া পোলা, পালিয়ে পালিয়ে বেড়ানো বিপ্লবীর হাতে সম্প্রদান করে ফিরে গিয়েছিলেন পরের দিনই। তার পরের সূর্য তাকে আর গ্লানিবৃদ্ধির অবসর দেয়নি। এসব স্মৃতি ডাহুক ডাকা দুপুরে শৈবলিনীকে বড় আনমনা করে দিয়ে যায় তবে আজ সে সময়ও তিনি পাবেন না। প্রথমবার এই নিয়ে তার কোনো দীর্ঘশ্বাস এলো না।


কমলিনী ও শৈবলিনী, দুই নারী। জন্ম ও যাপনের দুই মেরুতে বসবাসকারী তাদের পোষাকী আত্মীয়তার চেয়েও গভীর এক সূত্র পরস্পরের সঙ্গে জুড়েছে, তারা বন্ধু। সম্ভবত যে প্রথম ফোঁড়টি এই বিন্যাসের সূচনা করেছিল তার নাম আত্মমর্যাদা। যে সময়ে তাদের জন্ম, বাঙালী পরিবারগুলির দেওয়ালে "পতি পরম গুরু", "পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য" রঙিন সুতো দিয়ে সেলাই করে করে লিখে বাঁধিয়ে টাঙিয়ে রাখাই আদর্শ ও ন্যায়সম্মত শ্লীল শিল্পচর্চার উদাহরণ হিসাবে স্বীকৃত হতো। অথচ তারা তেমনটি করে উঠতে পারেন নি। 'স্বামী' শব্দের 'প্রভু' অর্থ তাদের ব্যক্তিত্ব বিনা বিচারে কোনোদিন মেনে নিতে পারেনি। কন্যা ও পুত্রসন্তানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষার পাঠে তারা অনুমোদন দেন নি কখনোই। যদি রান্না শিখতেই হয়, সন্তান মাত্রেই শিখবে, আউটডোর গেমসে অংশ নিতে হলে লিঙ্গ নির্বিশেষেই নেবে, এই ছিলো তাদের মা হিসাবে কঠোর ও অলঙ্ঘনীয় নীতি। বহু বাঁকা কথা, ব্যঙ্গ, অপমান, বিদ্রুপ সয়েছেন, সন্তানরাও যে খুব প্রীত হয়েছে সর্বদা, এমনটি তো নয়ই তবু অবিচলই থেকেছেন। এহেন স্ত্রী ধনের কথা রেঁনেসা যুগের নভেলে পড়তে যতটা তৎকালীন বঙ্গসমাজ ভালোবাসতেন, ততটাই অশালিন অনুভব করতেন নিজের পরিবারে পেলে। কিন্তু ব্যক্তিত্ব যদি অভেদ্য হয় তবে তা এক বলয় নির্মাণ করে, শনি গ্রহের মতই। সেই অদৃশ্য গণ্ডী ধীরে, অতি ধীরে পরিখা খনন করে পারিপার্শ্বিকতা ও পরিজনেদের মধ্যে। সলিটারি সেই ব্যূহকে আক্রমণ করা যায়, অধিগ্রহণ কখনোই না। কমলিনী ও শৈবলিনীর অন্ত:স্থিত কাছি এখানেই বাঁধা। তারা বুঝতেন তাদের আঁচল আছে, সেই আঁচলে চাবির গোছাও আছে অথচ মানসিক কাঠামো এই দরদালান পেরিয়ে এগিয়ে গেছে বহুদূর, যেমনটি বেদী ফেলে রেখে দেবী বিসর্জনে চলে যান। একটু আগে জন্মে গেছেন তারা যেখানে তাদের পরিচয় থেমে থাকল কারোর কন্যা, কারোর স্ত্রী, কারোর মা হিসাবেই অথচ এমনটি তো তারা চাননি। তবে কি আত্মীয়রাই ঠিক বলে?

-- "অমন সন্নিসী সন্নিসী ভাবসাব নিয়ে কি বাপু সংসারে মায়া বসে না ছেলেপিলে ন্যাওটা হয়?"

কী করবেন তারা? কর্তব্য তো সবই সামলেছেন একান্নবর্তী পরিবারের, সন্তান ধারণ করেছেন একাধিক। অথচ কী যেন খুঁজে বেড়ালেন সমস্তটা জীবন। দুজনেরই মনের ভিতর, ফ্রকে অভিমান গিঁট দিয়ে রাখা এক কাঙাল কিশোরী বেঁচে থাকল এতটা বয়স অবধি। পরের ইংল্যান্ড লেটারের কবিতাটায় বলবেন সে কথা, দুজনেই ভাবলেন সে কথা স্নান সেরে ফিরতে ফিরতে। 


আর ঠিক নয় বছর পর পৃথিবী নতুন সহস্রাব্দে পা রাখবে, ২০০০, আজ যার আসার কথা সে কি তাদের সত্যিই বুঝতে পারবে কোনোদিন? জানতে পারবে ভিতর ঝড়ের দাস্তান? খাদ্য বস্ত্র বাসস্থান ছাড়াও শুধুমাত্র 'মানুষ' স্বীকৃতি পেতে মেয়েদের প্রত্যাশাকে গুরুত্ব দেবে? যে গভীর বোধের অসুখ তাড়া করে নিয়ে নিয়ে বেড়ায় তাদের উপলব্ধি করবে? অনুধাবন করবে চিন্তাতরঙ্গ? 


সন্তানেরা তাদের শারীরিক কোড পেয়েছে, মেধার দায়ভারও কিন্তু তারা তাদের আত্মার উত্তরাধিকার যাকে দিয়ে যাবেন সে এখনো আসেনি। তাদের মানসপুত্তলি... বহু বছর ধরে চিঠির পর চিঠিতে তারা যে নারীকে গড়েছেন কল্পনায়, যে তাদের কথা বলতেই আসবে। যে বিশ্বাস করবে নারী এতদূর শক্তি ধারণ করে যে তার আভাস মাত্রই ভয়ে অবদমন করতে পুরুষতন্ত্রের জন্ম। যে নারী শরীর নিয়ে জন্মে নারীত্বকে উদযাপন করবে গর্বে। পৃথিবীর যাবতীয় ধর্মের সমস্ত অনুশাসন সুকৌশলে গড়া হয়েছে নারীর বেড়িকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করতে, শ্বাসজ স্বাধীনতার পরিসর সংকীর্ণ থেকে সংকীর্ণতর করতে, এই সত্য সম্যক জেনেও কমলিনী ও শৈবলিনী লোকনিন্দার বিরক্তি এড়াতে আজীবন নিষ্ঠাবান হিন্দু ব্রাহ্মণ বধূর যাবতীয় সারহীন অযৌক্তিক আচার পালন করে গেছেন বহিরঙ্গে, ফলত অন্তরঙ্গে তীব্রতর হয়েছে বিতৃষ্ণা। তারা সমগ্র আয়ু দিয়ে নিবিড় অধ্যয়নে আয়ত্ব করেছেন ঈশ্বরহীন অধ্যাত্মবাদের নিগূঢ় ধ্যান। সবই আমানত, সঞ্জাত হবে তাদের মানসপুত্তলির ভেতর, এমনটাই আশা। নারীকে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে পুরুষের মুখাপেক্ষি অথবা বিদ্বেষী হতে হয় না। 'কাম' ধাতু থেকে 'কন্যা' শব্দের উৎপত্তি। অর্থাৎ কামনা করা মাত্রেই যে তার প্রাপ্তব্য লাভের যোগ্য, সেই ই 'কন্যা'। 'শ্রী' ও 'পরাবিদ্যা' সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান যাদের আছে তারা জানেন শারীরিক সামর্থ্য আর অধিগত তেজ নিয়েও প্রকৃতপক্ষে পুরুষ বড়ই অসহায়। তার প্রয়োজন হয় নারী আধারের। শক্তিরূপ ছাড়া যাবতীয় ক্ষমতা নির্বীর্য। দুই নারী এই কারণেই আজ কামনা রাখছেন নতুন সহস্রাব্দে তাদের নশ্বর শরীর থাকুক বা না থাকুক, প্রাচীন এই মিথের সিস্টেম খানখান হয়ে যাক। পুরুষের প্রয়োজনার্থে আরোপিত শক্তির সেবাদাসী হিসাবে নয়, নারী তার নিজের আধারকেই আলো দিক, অধিকার দিক পূর্ণতার। এই বোধের উত্তরাধিকার তারা দিয়ে যাবেন তাদের মানসীকে। তাদের ত্যাগ, তিতিক্ষা, তপশ্চর্যা সব একটিই উদ্দেশ্যে, সে এসে তাদের হয়ে ভেঙেচুরে দিক সব আর্কিটাইপ, শীতল আগুনের চোখ নিয়ে প্রশ্ন রাখুক ইতিহাস ও বিনির্মাণে, সে ধর্ম হোক বা শিল্প, প্রতিটি রণক্ষেত্রে।

আজ কমলিনীর পৌত্রী আর শৈবলিনীর দৌহিত্রীর ভূমিষ্ঠ হওয়ার কথা। মেয়েই হবে তো? ফলিত জ্যোতিষে চর্চা রাখেন কমলিনী। উৎকণ্ঠা তাকে আরেকবার গণনায় বসালো। নক্ষত্র ইঙ্গিতে ইশারা অভ্রান্ত... রোহিণী। তিনি আশ্বস্ত হলেন। শৈবলিনী স্থির করে রেখেছেন নাম...স্বধা...যে নিজেতেই নিজে সম্পূর্ণ।

"ॐ স্বাহায়ই, স্বধায়ই, নিত্যমেব তবস্থিতি"
( ক্রমশঃ) 

চিত্রঋণ: পারমিতা চক্রবর্ত্তী

অর্ঘ্য নাথ

                                


পরাজিত
..............

আলিপুর ছুঁয়ে
ছোপ লাগা ইমারত ছুঁয়ে
যে মায়াজাল খবর লাফিয়ে নেমেছে
আমরা অন্ধ হয়ে তার নরমে ঘুমিয়ে পড়েছি।
আমাদের কোনো জন্ম নেই
আমাদের কোনো মৃত্যুও নেই।
আমরা কদাচিৎ ভোরের আকাশে চাঁদ উঠলে
থমকে যাই
লিঙ্গ চেপে ধরে হ্যারিকেনের পোষা আগুনকে
খিস্তি চেনাই।

পরাজিত দের কেউ মনে রাখে না!


মনখারাপ
...............

ধীরে ধীরে দিকশূন্যপুর ছুঁলো
শেষ বিকেলের নৌকো
আমি গৃহী খরগোশের মতো নেমে আসা
কুয়াশায়
মনখারাপ খুঁজি।


শ্রাবণ ১
........

আমার নিজের কোনো ঘর নেই।
আমার আমি ছাড়া নিজের কোনো মানুষও নেই।
তাই এই ভরা শ্রাবণেও
আমি তোমার অন্বেষণে -
হয়তো প্রাপ্তিতে মেঘ মেঘ
এক কাপ অন্ধকার কফি
অথবা
প্রগাঢ় এক চুম্বন।

আমার ইট কাঠ কয়েদ অন্বেষণের নেশামুক্তির জন্য
এটুকু বিষ প্রয়োজনীয়!



শ্রাবণ ২
............

এই বিন্দু বিন্দু অসময়ের ভাললাগা তোমায় দিলাম।
আমার তো সারাজীবনই শ্রাবণ মাস ...


বিবর
........

তোমায় দেখে ফুচকা ভাঙার মতো
একটা কুড়মুড়ে শব্দ হয় বুকের ভিতর।
অকারণে রুমাল খুঁজি
শুকিয়ে আসা ঠোঁটের উপর বুলিয়ে দিই
চেরা জিভের বিবর।


জড়ফুল
.............

চলে যাবার সময় হলে
তোমার মতোই ফিরে তাকাবো না।
শূন্য থেকে যাওয়া ঋণের পাত্র
ফোঁটা ফোঁটা জল -
বাহুল্যপ্রবাসে মরুপথে জড়ফুল ।


বানপ্রস্থ
............

আমি এখন একাই পাখি দেখি
দেখি ওদের ডানা ঝাপটানো
দু ' একটা পালক পড়ে থাকতেও দেখি
আর দেখি
বাসায় ফেরার পুরনো গল্প -
একটা ফুরফুরে বিকেল ।





শর্মিষ্ঠা দত্ত

                                       


                                


খোঁজ 

(১৪)

--মুন্নি কোথায় ছিলিস তুই এতক্ষণ? দেখ, তোর মায়ের কি অবস্থা ! 

শর্মিলাকে দেখেই রাজশ্রী চিৎকার করে উঠলেন l শর্মিলা দৌড়ে ঢুকল এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে l বেডে শুয়ে অপর্ণা  ছটফট করছিলেন, শর্মিলাকে দেখে স্থির হলেন l  চোখদুটো টকটকে লাল l ইনজেকশন পুশ করলেন একজন সিস্টার l কল্লোলদা বসে রয়েছে মায়ের পাশে l শর্মিলা দৌড়ে এসে মাকে জড়িয়ে ধরল l 

--মুন্নি... মুন্নি বলতে বলতে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ল মা l কিছুক্ষণ পরে কল্লোলদার সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে এল শর্মিলা l 

--কাকিমার বিপিটা মারাত্মক বেড়ে গিয়েছিল l আজ অ্যাডমিট করে নিচ্ছি l হসপিটালেই অবজার্ভ করতে হবে l ভালো থাকলে কাল ছেড়ে দেব l তোকে খুঁজে না পেয়ে অসম্ভব টেনশন করছিল l তোকে কিন্তু এখন কাকিমার কথা ভাবতে হবে শর্মিলা l কাকিমা আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন এমনকিছু করিস না l 

মুখটা নামিয়ে নিল শর্মিলা l বাইরে শম্পা আর মৈত্রেয়ী দাঁড়িয়ে l ওরা কখন এল ! মেঘনাই বা গেল কোথায়? 

--মেঘনা কোথায় গেল জানিস? ও একটা গাড়িতে একজন ভদ্রলোকের সঙ্গে...

--ও চলে গেছে l ব্যাপারটা পরে বলব তোকে l 

ছোটকা এসে পৌঁছয়নি এখনও l বাবার ডেথ সার্টিফিকেট লিখিয়ে বডি রিলিজ করার থেকে শুরু করে শ্মশানযাত্রার ব্যবস্থা পিসেমশাই আর সমীরণকাকুই  মিলেই করে ফেললেন l সকালে ছোটকা এসে পৌঁছলেই যাত্রা শুরু হবে l ততক্ষণে ডেডবডি  হাসপাতালের মর্গে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে l এই নিয়ে মৈনাকদা আর কল্লোলদার  সঙ্গে কথা বলছিলেন পিসেমশাই l রাত বাড়ছে l কাবেরীকাকিমা মৈত্রেয়ীর সঙ্গে শর্মিলাকে ওদের বাড়িতে চলে যেতে বললেন l শর্মিলা যেতে চাইল না l 

--আমি মায়ের কাছেই থাকব কাকিমা l সকালে তোমরা হসপিটালে থেকো, আমাকে তো আবার শ্মশানে যেতে হবে l 

শান্ত গলায় বলল শর্মিলা l 

--তোকে যেতে হবে না মুন্নি l অলোক যদি না করে দাদার মুখাগ্নি আমি করব l তুই কোত্থাও যাবি না l 
রাজশ্রী বলে উঠলেন l 

--না পিসি, ছোটকা নয় l বাবার সন্তান হিসেবে এটুকু আমাকেই করতে দাও l বাবার জন্য তো আর কোনোদিন কিছুই করতে পারব না l 

সকাল দশটা নাগাদ অলোক এসে পৌঁছনোর পর ওরা কেওড়াতলায় গেল l অপর্ণা তখনও ঘুমোচ্ছেন l নিষেধ করা সত্ত্বেও শর্মিলার জেদের কাছে হার মানল সবাই l খটখটে শুকনো চোখে যন্ত্রের মত বাবার মুখাগ্নি থেকে শুরু করে অস্থি বিসর্জন পর্যন্ত সবটুকুই করল ও l ইলেকট্রিক চুল্লির গনগনে আগুনে বাবার শরীরটা যখন ঢুকে যাচ্ছিল সেদিকে তাকিয়ে অন্তর্দহনে পুড়ে যাচ্ছিল শর্মিলা l সারাক্ষণ মৈত্রেয়ী আগলে রাখল ওকে l মৈনাকদা আর কল্লোলদাও ছিল ওদের সঙ্গে l 

বিকেলে ওকে নিয়ে পিসির বাড়িতে ফিরল সবাই l অপর্ণা খানিকটা সুস্থ, তাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছেন রাজশ্রী l ওই বাড়িতে আর ওদের ফিরতে দেবেন না l কাবেরীবৌদি আর কেয়াবৌদির সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দরকার হলে এবার বৌদির ওপর জোর খাটাবেন l অলোক আর শবনম বলেছিল ওদের না হয় নারকেলডাঙায় নিয়ে যাবে l কষ্ট করেই থাকবে সবাই l রাজশ্রী বলে দিয়েছেন, 

 --দরকার নেই, আমি যতদিন বেঁচে আছি আমার ভাইঝি আর বৌদিকে আর চোখের আড়াল করব না l 

অপঘাতে মৃত্যু l তিনদিনেই শ্রাদ্ধ-শান্তি মিটে গেল l ছোটকারা আসেনি l পিসি আর পিসেমশাইই ব্যবস্থা করলেন, একটা মঠে কাজ করল শর্মিলা l পিসির যত্নে মা খানিকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে l চন্দননগর থেকে অসীমমামা আর মাইমা এসেছিলেন l দাদু বলে পাঠিয়েছেন শর্মিলা যেন মাকে নিয়ে এখন থেকে চন্দননগরে গিয়ে থাকে l ওখানে অনেক ঘর, থাকার কোনো অসুবিধা নেই, তাছাড়া ওখানকার কলেজে ভর্তি হতেও শর্মিলার কোনো অসুবিধে হবে না l ইতিমধ্যে অপর্ণা নিজেকে সামলে নিয়েছেন l মেয়ের জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই হবে তাঁকে l 

আশ্চর্য লাগে শর্মিলার l এখন সবাই ওদের মা- মেয়েকে নিয়ে যেতে চাইছে l অথচ বাবাকে নিয়ে ওরা যখন বিপর্যস্ত তখন পিসি ছাড়া কেউ একবারও ওদের আশ্রয় দেওয়ার কথা ভাবে নি l 

অপর্ণা বললেন, 

--কাকাকে বলিস আমরা দু- চারদিনের জন্য চন্দননগর থেকে ঘুরে আসব l কিন্তু এই মুহূর্তে এই চাকরিটা আমি ছাড়তে পারব না l তাই কলকাতাও ছাড়তে পারব না l চাকরিটা এখন আমার খুব দরকার l 

স্বরূপবাবু অপর্ণাকে বললেন, 

--বৌদি আমাদের বাড়িতে এতগুলো ঘর খালি পড়ে রয়েছে, তুমি কেন অন্য বাড়িতে থাকবে বল তো ! তিনতলার ছাদের সঙ্গে যে ঘরটা আছে সেখানে  তোমরা থাকবে l তুমি তো চাকরি করছই বরং বাড়িভাড়া হিসেবে আমাকে কিছু টাকা দিও, তাহলে তো তোমার খারাপ লাগবে না ! 

এত কষ্টের মধ্যেও হেসে ফেললেন অপর্ণা l 

--বৌদি আমার নিজের বোন থাকলে কি আমি তাকে নিজের কাছে রাখতে চাইতাম না ! তুমি কি আমাদের এখনও নিজের লোক বলে ভাবতে পারো না?
  
সরাসরি জিজ্ঞাসা করলেন স্বরূপবাবু l 

-- রাজু আমার নিজের বোনের থেকেও বেশি স্বরূপদা l ও আমার জন্য যা করেছে আমার নিজের বোনরাও করতে পারেনি l সুখে নয়, সংকটে বন্ধু চেনা যায় l কিন্তু  সমাজে তো আরো পাঁচজন রয়েছে l আপনার আত্মীয়স্বজনই বা কি ভাববে? 

--তুমিও সারাজীবন আমাদের জন্য কম কিছু করনি বৌদি l যারা দাম দিতে পারে না, তাদের  দূরে থাকাই ভালো l আর এখন না হলে আর কবে তোমার পাশে দাঁড়াব বল তো ! আমি নিজে স্বাবলম্বী l তাই কারুরই কিছু বলার নেই l  আমাকেও তো একটু ঋণশোধের সুযোগ দাও ! আর মুন্নি আমার ভাইঝি হলেও আমার সবটুকু জুড়ে রয়েছে সেটা বোঝো না ! ওর নিরাপত্তার জন্যই তোমাদের আমি অন্য কোথাও থাকতে দিতে পারব না l

--হ্যাঁ রাজু, এই পরিস্থিতিতে তুমিই আমাদের সবথেকে নিরাপদ আশ্রয় l এখন তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য নেই আমার l 

জীবন থেমে থাকে না l পথচলার সঙ্গী হাত ছেড়ে চলে গেলেও মানুষ আবার সোজা হয়ে দাঁড়াতে শিখে যায় l আরো কিছু বন্ধুর হাত এসে তাকে ঘিরে ধরে l ওই বাড়ি থেকে যৎসামান্য যা জিনিসপত্র ছিল, সেসব নিয়ে আসা হয়েছে পিসির বাড়ির তিনতলার ঘরে l ওখানে মাত্র কয়েকদিনের বসবাসেই জীবন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গিয়েছে শর্মিলার l সামান্য আঘাতেই  নুইয়ে পড়ত যে ভীতু গাছটা, প্লাবন দেখে নিয়েছে সে l ঝড়জলের সামনে মাথা সোজা করে দাঁড়াতে সে ভয় পায় না আর l অপর্ণা আবার নার্সিংহোমের চাকরিতে যেতে শুরু করেছেন l রাজশ্রীও স্কুলে চলে যান l পিসেমশাই চেম্বারে l দুপুরবেলাটা যেন হাঁ করে গিলে খেতে চায় শর্মিলাকে l পরীক্ষার আগে পিসির বাড়ি থাকতে চায়নি শর্মিলা l কিন্তু এখানে এখন মানিয়ে নিতে কোনো সমস্যাই হল না l এ বাড়িতে অনেক বই l সারা দুপুর নানারকম বিষয় নিয়ে পড়তে পড়তেই সময় কেটে যায় l  মাঝে মাঝে চলে যায় মৈত্রেয়ীদের বাড়ি l মৈত্রেয়ী জয়েন্ট ছাড়াও আরো কিছু পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত l কাকিমার সঙ্গে বসে বসে গল্প করে l শম্পাদের বাড়িতেও গেল একদিন l শম্পার কাছেই শুনল মেঘনা এখন একজন ফিল্ম প্রোডিউসারের সঙ্গে মেলামেশা করছে l সেদিন সন্ধ্যেবেলা তার সঙ্গেই গাড়ি করে ফিরছিল পার্কস্ট্রীটের কোনো হোটেল থেকে l সেখানে নাকি শ্যুটিং চলছে l একটা সিনেমায় সহনায়িকার পার্টে অভিনয় করছে l 

--আর ওর বর? 

--তুই জানিস না? ওর বর তো এখন ওকে ছেড়ে অন্য একটা ঘাটে নৌকো বেঁধেছে l মেঘনা তো এখন বাবা- মায়ের কাছেই থাকে l কি জানি কি করে বেড়াচ্ছে ! দেখে তো মনে হয় হাতে প্রচুর পয়সা l সৌমিলি তো সেদিন যাচ্ছেতাই বলল ওর নামে l ওই আধবুড়ো প্রোডিউসারটার সঙ্গে নাকি ওর রিলেশন l এমনি এমনি কি আর সিনেমায় চান্স পেয়েছে ! ওর জন্য নাকি কারুর কাছে মুখ দেখানো যায় না l সৌমিলিটার জন্যই আরো খারাপ হয়ে গেল মেঘনা l 

--কাকু - কাকিমা কিছু বলে না ওকে?  

-- বললেই শুনছে আর কি ! দেখছিস তো ওকে ছোট থেকে l প্রচণ্ড ডেসপারেট l তবে ওর মনটা কিন্তু সত্যি ভালো l সেদিন ও না থাকলে তোর যে কি হত ! 


উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর সময় হয়ে এল l অথচ তেমন উত্তেজনা নেই শর্মিলার l রেজাল্ট যেমনই হোক, যে কোনো অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার মানসিক জোর অর্জন করে ফেলেছে ও l এরইমধ্যে একদিন টুবলুদা কয়েকদিনের জন্য দেশে ফিরল l সঙ্গে তার বিদেশিনী বান্ধবী l কয়েকদিন কলকাতায় থেকে ওরা যাবে বিষ্ণুপুর l আর্কিওলজি নিয়ে পড়াশোনা করছে ইভলিন l প্রাচীন বাংলার মন্দির ওর গবেষণার বিষয় l ইভলিন ভাঙা ভাঙা বাংলাও বলতে পারে l শর্মিলার সঙ্গে একটু একটু বন্ধুত্ব হয়ে গেল ওর l 

(চলবে )








অমিতাভ সরকার

                                           


               


বেজন্মা (দশম পর্বের পর)

সকালে ক্যাম্পে যোগ দিতেই এক বন্ধুর কাছে খবরটা পায়। তাদের ব্যাটেলিয়ানকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কাশ্মীরে রাজৌরি জেলায় নৌশেরা সেক্টারে। অফিসারের সঙ্গে দেখা করে কৃষাণ।  

“স্যরি কৃষাণ, তোমাকে ডেকে আনতে হলো। আসলে ওপর থেকে নির্দেশ এসেছে, আমাদেরকে চলে যেতে হবে কাশ্মীরের নৌশেরা সেক্টারে”। 

“স্যার একটা খবর দেওয়ার ছিল। এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেল, যে জানাতে পারলাম না। মানে, দুম করে বন্ধুরা বিয়েটা দিয়ে দিল স্যার”। 

“কনগ্রাচুলেশন! খুব ভালো খবর। একটা কাজের কাজ করেছো তুমি। এবার তোমার মনমরা ভাবটা যাবে। হাঃ হাঃ হাঃ”। 

“আসলে বিয়ের দিনেই খবরটা পাই, স্যার। খবর পেয়েই চলে আসতে হল…। আসার সময় রাবেয়া, মানে আমার স্ত্রী খুব কান্নাকাটি করছিল”। 

“ঠিক আছে, নৌশেরা সেক্টারে জয়েন করো, দেখি তোমাকে ছুটির ব্যবস্থা করতে পারি কিনা…”।   

ভূস্বর্গ কাশ্মীর!! ট্রেন থেকে নামতেই ঠান্ডা বাতাস কাঁপিয়ে দিল। তাড়াতাড়ি গরম জামাকাপড় পরে স্টেশনের বাইরে এলো কৃষাণ। শ্রীনগরে যেতে চোখে পড়লো ছোট বড় সবুজ কার্পেটে মোড়া পাহাড়ের চূড়ায় কে যেন ঢেলে দিয়েছে শুভ্র তুষারের রেণু। 

ভ্যান থেকে নেমে চারিদিক তাকায় কৃষাণ। সবুজ কার্পেটে মোড়া ঢেউ খেলানো জমিনে ছোট ছোট বেগুনী, হলুদ, সাদার বিচিত্র কারুকাজ, আসমানি আকাশে সাদা মেঘের ভেলা, এক পাশে পাইনের সারি আর এক পাশে পীর পাঞ্জাল রেঞ্জের তুষারাবৃত শিখর। স্বর্গ যেন ধরা দিল তার কাছে। বিস্ময়ে পাথরের মূর্তির মত তাকিয়ে থাকে কৃষাণ। পরক্ষণে মনে পড়ে রাবেয়ার কথা, যদি তাকে পাশে পেতো, তাহলে স্বর্গের এই সৌন্দর্য আরো বেশী করে ধরা দিত।   

প্রায় পাঁচ মাস রাজৌরিতে থাকার পর পনেরো দিনের জন্য ছুটি পেয়ে যায় কৃষাণ। অবশ্য এর জন্য তার অফিসারের কৃতিত্বও কম নয়।  

যাওয়ার পথে শ্রীনগরে কয়েকটা শাল, সোয়েটার, আর কার্ডিগান কিনে নেয় কৃষাণ। গত তিনমাস প্রতিদিন হয় রাবেয়া ফোন করেছে অথবা কৃষাণ ফোন করেছে রাবেয়াকে। সিংজী ও মানিকদাকেও ফোন করেছে কয়েকবার। মানিকদা জানিয়েছে রাবেয়ার ভর্তির বিষয়টা ঠিক হয়ে গেছে। সিংজী জানিয়েছেন, ফর্মে অবিভাবক হিসাবে তিনিই সই করবেন ।   

রোববার জম্মু থেকে রাত সাড়ে দশটায় হিমগিরি এক্সপ্রেস ধরে কৃষাণ। প্রায় ছত্রিশ, সাঁত্রিশ ঘন্টার জার্নি…। এই ছত্রিশ সাঁত্রিশ ঘন্টা রাবেয়ার কথা ভাবতে ভাবতেই কেটে যায়, পরিচয় সময়, একসঙ্গে বেড়ানো, মনাচিতোর থেকে তুলে নিয়ে আসা, সব…সব…। এতদিন নিজেকে দুর্ভাগা বলেই ভেবে এসেছে। আজ মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান বোধহয় সে। তার আপন ভাইয়ের মতো বন্ধুরা, পিতৃস্থানীয় সিংজী, এমন পরিবার ক’জনের আছে! ভেবেছিল কাউকে না জানিয়ে সবাইকে চমকে দেবে। অনেক ভেবে সিংজী আর মানিকদাকে ফোন করে জানায়। সিংজী আর মানিকদাকে বলে দেয়, কাউকে না জানিয়ে কোনও ভাবে রাবেয়াকে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে দশটায় হাওড়ায় নিয়ে আসতে। 

মঙ্গলবার সকাল, এবারে একটু লটবহর বেড়েছে…। দূর থেকে দেখে সিংজী, মানিকদা আর বিদ্যাভাবীর হাত ধরে কথা বলতে আসছে রাবেয়া। সিংজীই দূর থেকে হাত তোলে। সেটা লক্ষ করে রাবেয়া তাকায় তার দিকে…। কৃষাণ দেখে বিদ্যাভাবীর হাত ছেড়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় রাবেয়া। স্থান কাল ভুলে কৃষাণেকে ধরে কেঁদে ফেলে। ট্রেনের যাত্রীরা তাকায় তার দিকে। বিদ্যাভাবী এসে ধরে রাবেয়াকে, পেছনে সিংজী আর মানিকদা হাসতে থাকে। মিনিট খানিক পরে নিজেকে সামলে নেয় রাবেয়া।  

“খারাপ, খুব খারাপ, খবর দিলে কী হতো? কেউ জানায় নি আমাকে…”। অভিমান ঝড়ে পড়লো কথায়।  

“খবর দিলে তোমার এমন অবস্থা দেখতে পেতাম কী করে?” কৃষাণের কথায় হাঃ হাঃ করে হাসেন সিংজী।   

“চল বেটা, আভি ঘর চল… তেরা টিকট হো গেয়া”। মানিকদা এসে জোর করে কৃষাণে সুটকেসটা তুলে নেয়। 

ট্রেনে যেতে যেতে রাবেয়া বলে যে, সিংজী আর মানিকদা তাকে নিয়ে গিয়ে স্কুলে ভর্তি করে এসেছে। লাভপুরের এক স্কুলের বন্ধুকে দিয়ে মনাচিতোরের বাড়ী দেখতে পাঠিয়েছিল। সে জানিয়েছে, দরজা বন্ধ, তবে বাড়ীর দরজার সামনে পার্টির ফ্ল্যাগ টাঙ্গানো…।    

দেখতে দেখতে দশ বারো দিন কেটে যায়। রোজ বিকেল হলেই রাবেয়াকে নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছে। ছুটির  দিনে কলকাতার নানান দর্শনীয় স্থানেও নিয়ে গেছে রাবেয়াকে। মাঝে মধ্যে বিল্লুরাও সঙ্গ নিয়েছে তাদের। কয়েকদিনের জন্য নান্টা, শ্যাম আর জোর করেই সিংজী আর ভাবিকে নিয়ে দীঘায় ঘুরে এসেছে। বিল্লুর একটা বাড়ি ভাড়ার খবর এনেছিল, সিংজীদের প্রচন্ড আপত্তিতে তা বাতিল হয়েছে। রাবেয়া আর আম্মু সকলের সঙ্গে মিশে গেছে দেখে কৃষাণও নিশ্চিন্ত হয়েছে অনেকটা। ফিরে যাবার আগের দিন রাবেয়া সবাইকে নেমতন্ন করে খাইয়েছে, অবশ্য আম্মু আর বিদ্যাভাবী হাতে হাতে কাজ করেছেন।  

#

দেখতে দেখতে দুটো বছর কেটে যায়। বছরে দুবার ফোর্স থেকে ছুটি নিয়ে আসে। সকলে মিলে হৈ হৈ করে কাটায় দিনগুলি। রাবেয়া ভালোভাবে হাইয়ার সেকেন্ডারী পাশ করে এখন কলেজ ছাত্রী। কৃষাণেরও পদোন্নতি ঘটেছে।  

একদিন নৌশেরা সেক্টারে রাতে পেট্রোলিং সময় গোপন সুত্রে খবর পায় কৃষাণ। সঙ্গীদের নিয়ে সন্তর্পণে নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর এগোতেই হঠাৎ চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলকানি আর প্রচণ্ড শব্দে ছিটকে পড়ে কৃষাণ ও সঙ্গীসাথিরা। চারিদিক দিয়ে ট্যাঁ ট্যাঁ স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের শব্দ…, কোনও কিছু বোঝার আগেই চারিদিক অন্ধকার হয়ে আসে, জ্ঞান হারায় কৃষাণ।    


রাজৌরি হাসপাতালের বেডে শুয়ে কৃষাণ। ধীরে ধীরে চোখ মেলেই দেখে রাবেয়াকে। তার চারদিকে দাঁড়িয়ে সিংজী, ভাবী, মানিকদা বিল্লু…। মনে পরে যায় সেই রাতের কথা। উঠতে গিয়েও ডান পায়ের যন্ত্রণায় উঠতে পারে না। তাড়াতাড়ি সিংজী এগিয়ে এসে ধরে ফেলে। রাবেয়ার দিক তাকিয়ে হাসে কৃষাণ। রাবেয়া এগিয়ে এসে হাত ধরে কৃষাণের পাশে বসে। কয়েক ফোঁটা জল পড়ে কৃষাণের হাতে।   

“বেটা, তেরে লিয়ে বহু দো’দিন ঠিক সে খানা নেহি খায়া”।  

“জানো, এনারাও দুই দিন ঠিক মতো খায় নি”। বলতে বলতে লেফটেন্যান্ট এসে সামনে দাঁড়ায়। 

“কেমন আছেন এখন? অল্প বয়সী বাঙ্গালী যুবক। কৃষাণ সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। হাতজোড় করে নমস্কার করে লেফটেন্যান্ট।  

“ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে এলাম। এমনিতে মারাত্মক কিছু হয় নি, তবে মাইন বিস্ফোরণে ডান পা সাংঘাতিক ভাবে ফ্র্যাকচার হয়েছে। আগামীকাল অথবা পরশু একটা অপারেশন হবে। তারপর একমাস বিশ্রাম…”।  


কৃষাণের অপারেশনের পর রাবেয়াকে নিয়ে ফিয়ে যায় সবাই। যদিও রাবেয়া থেকে যেতে চাইছিলো…। কৃষাণ অনেক চেষ্টা করে শেষ পর্যন্ত বোঝাতে সক্ষম হয়।  

“একটু ভাবো রাবেয়া, এখানে থাকার মত জায়গা নেই, তুমি একা একা হোটেলে কী করে থাকবে? তোমার জন্য কাজ ক্ষতি করে কে থাকবে? একটু বোঝার চেষ্টা করো”।    

“তার চেয়ে বরং তোকে দেখাশোনা করার জন্য আমি থেকে যাই। কী বলিস কৃষাণ”? বিল্লুর কথায় হেসে ফেলে কৃষাণ। মানিকদা বিল্লুর কান টেনে ধরে…।     

“এটা কী বললি, তোর কি আর বুদ্ধি হবে না? তোর থাকা আর রাবেয়ার থাকা কি এক হোল? আর তোকে রাখলে মমতাজ আমাদের আস্ত রাখবে? আমাদের এই বিল্লুটা আর পালটালো না”। মানিকদা কথা শুনে রাবেয়া ফিক করে হেসে ফেলে। তাই দেখে সকলে নিশ্চিন্ত হয়…।   




(ক্রমশঃ) 

রবিবার, ১৮ জুলাই, ২০২১

অনিন্দ্যসুন্দর পাল

                               


 চর্যাপদ চর্যাগীতি ও সমীক্ষা (দ্বিতীয় পর্ব)

আজকের বিষয় : পুঁথি ও পরিচয়

এই পুঁথি আবিষ্কার শুধু বাংলা নয় হিন্দী মৈথিলী ওড়িয়া প্রভৃতি অন্যান্য নব্য ভারতীয় আর্য ভাষা ও সাহিত্যের ঐতিহাসিকদের মধ্যে প্রথম আলোড়ন নিয়ে আসে। ফলে নেপালের সমস্ত গ্রন্থাগারের পুঁথিগুলির প্রতি ভারতীয় গবেষকদের ঝোঁক বাড়তে থাকে স্বাভাবিকভাবেই। এই তৎপরতা যেমন একদিকে বাংলা ভাষার প্রতি পুরোনো ধ্যান ধারণা পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করে ঠিক তেমনই অন্যদিকে হরপ্রসাদশাস্ত্রী মহাশয়ের আবিষ্কৃত তথ্যাদির বিশ্লেষণ সমস্ত গবেষকদের অন্তরে নিবিড়তার জন্ম দেয়। তারপর থেকেই শুরু হয়ে যায় আবিষ্কৃত পুঁথি সম্পর্কিত চমকপ্রদ বিশ্লেষণ। সেই ফলস্বরূপ বেরিয়ে আসতে থাকে নতুন সব প্রমাণাদি ও ব্যাখ্যামূলক তথ্য। যেমন উল্লেখ করা যেতে পারে এই পুঁথিগুলির নামকরণের নামে একটি অপভ্রংশের ইতিহাস। এক, পুঁথিগুলির ভাষাকে বাংলা বলে মনে করা হলেও পরবর্তীতে দেখা যায় এর সমস্ত ভাষা বাংলা নয়, এর তিন চতুর্থাংশই পশ্চিমা অপভ্রংশের। দুই, এই লিপিকর সম্পূর্ণটিই টোকা বা copied। এর কারণস্বরূপ হিসাবে দেখানো হয় 'চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়' নামক একটি পুঁথি, যা এই কোপিডের প্রামাণ্য বিষয়। স্বভাবতই প্রমাণিত সমগ্র বিষয়টি যেহেতু মূল গ্রন্থ থেকে গৃহীত বা টোকা, তাই তাঁর নাম ভুলবশত চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়ের বদলে চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয়  রূপে নামাঙ্কণ ঘটেছে বা ঘটানো হয়েছে,অর্থাৎ নামটি ভুল করে লেখা হয়েছে- 'চর্য্যাচর্যবিনিশ্চয়' এই রূপে। এই মতানুসারে 'চর্য্যাচর্যবিনিশ্চয়' নামক অপভ্রংশে  পুঁথিটির পরিচয় টিকে যায় দীর্ঘদিন পর্যন্ত। এছাড়াও আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, পরবর্তীতে নাকি জানা যায়, মূল বৃত্তাকারের আসল নাম মুনিদত্ত। অনুমান করা হয়, নেপালের গ্রন্থাগার থেকে পুঁথিগুলি সম্পূর্ণ রূপে সুরক্ষিত হিসাবে না পাওয়া যাওয়ায় শেষের দিক থেকে অনেকগুলো পাতা সন্ধান মেলে না, হয়ত এই কারণকেই গবেষকগণ মুনিদত্ত নামটি মুছে যাওয়ার জন্য প্রধান দায়ী করেছেন। তবে মুনিদত্ত মাত্র পঞ্চাশটি চর্যার ব্যাখ্যা করে গেছেন।এতদপরেও  পুরো নির্মাণটি ত্রুটিময় হলেও এর সম্পূর্ণ ভাবার্থটির একেবারেই  অর্থহীন বা ভ্রান্তময়, একেবারেই বলা যায় না। কারণ, জানা গেছে, এই সমস্ত অনুবাদের ভার প্রথমে শ্রীযুক্ত সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় নিলে, তাঁর সূত্র ধরে ডঃ প্রবোধচন্দ্র বাগচীও পরের দিকে পরীক্ষা নিরীক্ষার পাশাপাশি অনুবাদও চালান, তাতে দেখা যায় তথ্যানুসারে মূল গীতিসংগ্রহের যে  আসল নাম উঠে আসে, তা হলো 'চর্যাগীতিকোষবৃত্ত'।

১৯১৬ সালে হাজার বছরের 'পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোঁহা' প্রকাশের সময় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী পুঁথিটিকে চর্য্যাচর্য্যবিনিশ্চয় নামে আখ্যায়িত করেছেন কিন্তু নেপালের রাষ্ট্রীয় অভিলেখায় পুঁথিটির নাম নাগরী হরফে 'চর্য্যাচর্য্যটীকা' হিসাবে উল্লেখ আছে। তাই তিনি হয়ত ১৯১৫ সালে তাঁর প্রকাশিত 'A catalogue of Palmleaf and selected Paper MSS  belonging to the Durbar Library Nepal' গ্রন্থে দুই জায়গায় ওই চর্য্যাচর্য্যটীকা নামটি ব্যবহার করেছিলেন। বিশেষত, পুঁথিটি তালপাতায় লিপিতাত্ত্বিকদের পরিভাষায় প্রত্ন বাংলা অক্ষরে লেখা এবং দীর্ঘতর পাতাগুলির মাপ হিসাবে লেখা আছে "লে ১২এবং৩/৪ চৌ ১এবং৯/১০ ও শাস্ত্রী উল্লেখিত ক্যাটালগ মাপ ১২ এবং ১/২  X ২ ইঞ্চি। এছাড়াও, পুঁথির প্রথম পত্রের সামনের পৃষ্ঠায় বাঁ দিকের উপরে লাল কালিতে নাগরী হরফে লেখা আছে: "৭৪১ ভাদ ষমবাত" = ভাদ্র ৭৪১ সংবৎ। আবার নেওয়ার সংবতের সূচনা কাল হিসাবে ধরা হয় ২০ অক্টোবর ৮৭৯সাল বা বর্ষারম্ভ কার্তিক মাসের শুক্লা প্রতিপদ। অর্থাৎ ৭৪১ সংবৎ + ৮৭৯ সংবৎ = ১৬২০ সাল। যা অনুমান করা হয় পুঁথিটির সংগৃহিত সময়কাল হিসাবে। তবে এখানে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। কারণ ভাষাবিচারে মুনিদত্তের জীবৎকাল ত্রয়ো শতাব্দী ধরে নিলে বলা যেতেই পারে, চর্যা পুঁথিটি ত্রয়োদশ শতকের শেষ দিক বা চতুর্দশ শতকের একবারে গোড়ার দিকে রচিত। এক্ষেত্রে চতুর্দশ শতক সময়কালটি প্রমাণিত।

প্রসঙ্গত, পুঁথি পরিচয়ের আরো গভীরে প্রবেশ করলে বোঝা যাবে অনেক জায়গায় পুঁথিতে উল্লিখিত গানের পাঠের সঙ্গে টীকা পাঠের বেশ কিছু অসামঞ্জস্যতা রয়ে গেছে। উহাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে "লাড়ীডোম্বীপাদানাং সূনেত্যাদি চর্যায়া ব্যাখ্যা নাস্তি" টীকাটি। যেখানে দশম চর্যার মূল পাঠ ও টীকার পরবর্তীতে এবং একাদশ চর্যার পূর্বে লাড়ীডোম্বীপাদের একটি চর্যা ও সেটির সূচনা সূন শব্দ দিয়ে হলেও নির্দিষ্ট টীকার অভাবে গানটি ব্রাত্য হয়েছে, যা এখানে একটি Collated text বা যুক্ত সংকলন হিসাবে নির্মিত। যা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায় অসামঞ্জস্যতার কারণসমূহ। তাই হয়ত লিপিকর পুঁথিকে দুইভাগে ভাগ করেছিলেন- ১. শুধু গানের পুঁথি যা টীকাহীন আর ২. শুধু টীকা পুঁথি যা গীতিহীন। এক্ষেত্রে এই শুধু গানের পুঁথি বলতে আমরা চর্যাগীতিকোষের কথাও বলতে পারি যা বুধগণের অনুদিত চর্যাগীতিকোষবৃত্তি একপ্রকার রতিব্বতি অনুবাদ, কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয়এই গানের পুঁথি মুনিদত্ত ব্যবহার করেন নি। সেকারণেই হয়ত তাঁর লেখার মধ্যে ভিন্নতা দেখা দিয়েছিল। তবে অনুমান করা যায় এই ধরনের collated text ধরনের পুঁথিগুলি বৌদ্ধ পন্ডিত ও বিদ্যার্থীদের ভীষণ প্রিয় ছিল। তাই এগুলো হয়ত অন্যভাষাতেও অনুবাদ হয়। যেমন- কাশ্মীর পন্ডিত কীর্তিচন্দ্রের উপদেশানুসারে চতুর্দশ শতকের তিব্বতীয় অনুবাদ Grags-pargyal-mchan ও Kvarne ১৭৪১ থেকে ১৭৪৯ সালের মধ্যে চীনের মঙ্গোলীয় অনুবাদ। সুতরাং বলা যেতেই পারে শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুঁথিটি চর্যাগীতির একমাত্র পুঁথি কিন্তু নয়, যা আসলে অন্যতম পুঁথির একটি রূপ।



ক্রমশ...........

পিয়াংকী

 .                                     



ছোড়ি ছোলে

 




"খুব হেকটিক সিডিউল চলছে মা, প্লিজ  কুক সাম ইয়াম্মি " গতকাল সন্ধেয় একথা ভেসে এসেছিল আমার সহযোদ্ধার ঘর থেকে।ফুর্তি। আমার মেয়ে।মা মেয়ে দু'জনেই... ডায়েটে আছি অনেকদিন হল। ডায়েট মানেই যে শুধু কাঁচা বা সেদ্ধ সবজি খাওয়া নয় সেটা ও জেনে গেছে আগেই।তাই অগত্যা বায়না মেটাতে যা করেছিলাম, আজ  'গরম বাহার' এ সেটাই বলব।


রবিবারের সন্ধেতে আড্ডাবাজি করতে করতে ঘরের সেই মানুষগুলোকেও এটা খাওয়াতে পারবেন যারা কিনা তেলালোঝোলালো শব্দ ছাড়া কিচ্ছু বোঝেন না।


প্রয়োজন পরিস্থিতি সবচেয়ে বড় কথা হল মাতৃত্ব আমাদের অনেককিছুই শিখিয়ে নেয়। সেরকমই, ঘরে অনেকদিন মিইয়ে পড়ে থাকা বালিতে ভাজা কিছু ছোলারই কায়দা করে সদগতি করেছিলাম। ছোলা মিক্সিতে ঘুরিয়ে  ১০-১২ সেকেন্ড করে দু'বার। হ্যাঁ দুবার।  তাতে  মিহি করে কুচোনো পেঁয়াজ, অল্প কয়েক কোয়া রসুন, গ্রেটেড গাজর এবং বিন (ইচ্ছে মত অন্য সবজিও দেয়া যায়), কাঁচালংকা আর ধনেপাতা কুচি,পরিমাণ মত নুন, কয়েকদানা চিনি।এবার সামান্য জোয়ান, ড্রাইরোস্ট সাদা জিরে আর এক চিমটি গোলমরিচগুঁড়ো এবং দু'চামচ ব্যাসন। এক পিঞ্চ বেকিং সোডা। জোয়ান  জিরে গোলমরিচ ওয়েটলস স্টেজে খুব ভালো কাজ করে। এবার একটা বড় বাটিতে নিয়ে সব উপকরণ একত্র করে নরম হাতে মেখে ফেলুন। 


ননস্টিক প্যান ।ওয়ান কিউব বাটার ।মেল্ট হলে অয়েলব্রাশের সাহায্যে ছড়িয়ে দিন প্যানের গোটা সারফেস জুড়ে। হাতের দুই তালু জল নিয়ে স্যাঁতসেঁতে করে নিন,মেখে রাখা মিশ্রণ থেকে পাঁচ আঙুলে ওঠে যতটা ততটা পরিমান নিয়ে একটু চ্যাপ্টা আকৃতিতে গড়ে প্যানে দিন।আঁচ থাকবে মাঝারি। ঢাকনা দিন,তিন মিনিট, উল্টে নিয়ে আরও এক মিনিট। 


এরপরের স্টেজটা 'ডাকাতিয়া বাঁশি'র মত। আরে না না, চুরি ডাকাতি করতে বলব না আপনাদের। টিকিয়াগুলো একটা একটা করে একটা সাঁড়াশিতে চিপকে ধরে ডাইরেক্ট আগুনে।হালকা পোড়া পোড়া সেঁকা সেঁকা হলেই তৈরি  'ছোড়ি ছোলে'


টিপসঃ দু'বার মিক্সি চালান। অল্প অল্প আধভাঙ্গা করে,একেবারে এক মিনিট ঘোরালে ছোলার ছাতু হয়ে যাবে।ক্রিস্পি ভাব থাকবে না


আরেকটা টিপ শেয়ার করি। যেকোনো টিকিয়া গড়বার সময় হাতে জলের ওপর কাঠখোলায় ভাজা সুজি ছিটিয়ে নিন।শেপিং পরিপাটি দেখতে লাগবে সাথে অনেকক্ষণ মুচমুচে থাকবে।

সোনালী চক্রবর্তী

                                   


 

আঞ্জুমান




নীল কাঁচের ডোম, ক্ষীরোদ বিদ্যুত... "কুবলাই খাঁ" যারা পড়েছেন একটু ভেবে নিতে পারেন চেহারাটা। লৌকিক থেকে অলীকের তারতম্যে 'নীল' ছাড়া অন্য বর্ণের এখনো প্রবেশাধিকার নেই নশ্বর মুণ্ডুদের কল্পনায়। যে কোনো অলৌকিক আদতে নিষিদ্ধ রহস্য বই তো কিছু নয়। পৃথিবীর দুই প্রবল আলোচিত পুরুষ আজ মুখোমুখি। সিদ্ধার্থ ও আর্নেস্তো। সময়খণ্ড বা কর্মপরিধি যতই আলাদা হোক, কোনো না কোনো নারীর ইথারে পৃথিবীর সব দিকপালদেরই একদিন না একদিন কোর্ট মার্শাল হয়। আজ বুদ্ধ ও বিপ্লবীর পরস্পরকে খননের দিন।


মৃত শরীরেও যার চোখ বন্ধ করে ফেলার সমর্পণ আসেনি, খুব স্বাভাবিকভাবে তারই প্রথম প্রশ্ন ভেসে এল -

"কী পেলেন শ্রমণ? 'শান্তি' শব্দ যে শুধুই মোহের সর্বনাম এ বোধির উপাদান আপনার পরমান্নে বাদ থেকে গেলো কী করে?"

দুর্ভাগ্য, ট্যাটু আর টি শার্টে এঁকে যারা চে'কে সাজায় শরীরে, তারা বোঝার চেষ্টাই করলো না কোনোদিন, বুলেটের ভিতর কিছু থাকে না, আগ্নেয়াস্ত্রেও না, যে সিনা তা ওঠাতে সিদ্ধান্ত নেয়, যন্ত্রের সার্বিক সাফল্য আর ব্যর্থতা তার মাপেরই সমানুপাতিক। এখানেই নির্ধারণ হয় কে রাষ্ট্র বা রিপুর ভাড়াটিয়া আর কে দেশ-কাল-ইতিহাসকে অপ্রাসঙ্গিক প্রমাণ করা লিজেন্ড, স্বয়ং অগ্নি।

নির্বাণ যিনি পেয়েছেন, যে কোনো আঘাতের প্রথম উত্তর তার কাছ থেকে পরম শূন্য এক হাসি দিয়েই আসবে, এও তো অস্বীকারের নয়। ব্যতিক্রম ঘটল না। তথাগত মৌনতা ভাঙলেন -

"তুমিও কি শান্তিই চাওনি? দ্রোহ, জেহাদ, গুয়েভারিসম... উদ্দেশ্য তো একটাই ছিলো"

-- "আমি অধিকার চেয়েছিলাম। রাষ্ট্রের তরফে তার নাগরিকদের প্রাপ্য মৌলিক সুরক্ষা শুধু। আপনাকে তো রাষ্ট্রধর্মেই প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়া হয়েছিলো, হায় কী প্যারাডক্স তথাগত! আপনি বলছেন আমাদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো একটিই - শান্তি, তাই তো? তাহলে আমি যদি বলি পরিণতি আপনারও কিছু ব্যতিক্রম ঘটেনি আমার থেকে নিতান্ত হত্যা ছাড়া, কী বলবেন? আমার শরীরটুকু আর আপনার সমগ্র আদর্শ। এক, সম্পূর্ণই এক, যতদূর আমার দৃষ্টি যাচ্ছে।"


সিদ্ধার্থ স্তব্ধ হলেন। কী করে উচ্চারণ করবেন এই অমোঘ সত্যের যন্ত্রণা? আর্নেস্তো তো ভুল কিছু বলেনি। প্রথমে গোষ্ঠী, সম্প্রদায় ভাগ... শেষে চন্ড এক ক্ষমতাভুক সাম্রাজ্যবাদীর হাতিয়ারেই তো পরিণত হয়েছিলো তার চতুরার্য সত্য। পরিহাস, সেই নৃপতি আজ শান্তির আইকন, আর তিনি? নির্বাসিত... মূর্তিপূজার মনেস্ট্রিতে। বুদ্ধ কবেই চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়ে গেছেন বিরাট বিরাট প্যাগোডার ধনসম্পদের শো অফে নিজের প্রাণাধিক বোধিদ্রুমকে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যেতে দেখতে দেখতে। আজও গুয়েভারা আর গৌতমের যাবতীয় স্যুভেনিরের বাজার চাহিদা, তুঙ্গী। তাদের দৈহিক সৌন্দর্য কিঞ্চিত অনার্যসুলভ হলে বাস্তবচিত্র কী হতো সে অনুসন্ধানে বুদ্ধিমান মাত্রেই বিরত থাকে। কনসিউমার ইকোনমিক্সে লুম্বিনীর শাক্য বংশীয় রাজপুত্র আর আর্জেন্টিনার ভুবনমোহিনী গেরিলা সম্রাটের কীর্তি কতটা প্রাসঙ্গিক তার থেকে অনেক বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে তাদের চেহারা কতটা খাবে তার উপরেই  বরাবর, ভবিষ্যতেও হবে। তথাগতের কান্না পেল খুব। তিনি খুঁজতে চাইলেন কার চিন্তার তরঙ্গ আজ এভাবে সত্য মিথ্যার যাবতীয় ধোঁয়া ভেঙে তাদের একাকার করে দিচ্ছে যৌথতায়... অসহায়, বড় অসহায় লাগছে তার।


ওহ! স্বধা...? দিনের আঠারো যার এখন কাটে বাবার মাথার কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা কোভিড কেবিনে রোজ। যে এখনো জানেই না মৃত্যুভয়ের থেকেও বড় সংকট তার আগামী ঘন্টা কয়েকের ভিতর আসতে চলেছে। নারী যদি মেধা আর বোধের সঙ্গে চামড়াটাও ব্যতিক্রমী নিয়ে জন্মায় তার অনিবার্য পরিণতি হয় এসাইলাম নাহয় আত্মহনন এই অব্দি প্রমাণিত, তবে সঙ্গে যদি জিভ আর শিরদাঁড়া জুড়ে থাকে, তবে সভ্যতা ও সমাজের সংকট ঘনায় এ কথাও মিথ্যে নয়। না তারা মরে, না আপোস করে। ফলত: সহস্র সহস্র খঞ্জরে শান পড়তে থাকে তাদের জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে। তেমনই কিছু ঘটতে চলেছে। তথাগত বিষণ্ণ হলেন।


আজ চে যাবতীয় বৌদ্ধিক নির্লিপ্তিকে বিদ্ধ করবেন বলেই নিজের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। জরিপ করলেন গৌতমকে... প্রশ্ন রাখলেন-

"আজ এত বিচলিত কেন আপনি তথাগত? যশোধরার জন্যে তো সামান্য মায়াও কখনো বরাদ্দ ছিলো না আপনার। নাকি ৪৮৩ বিসিই থেকে এই ২০২১ এর দীর্ঘ পথ আপনাকে স্বল্প হলেও মানবিক করে তুলেছে?"

--"তুমি যাকে যশোধরা বলো সে আমার ত্রিকালের সাধনসঙ্গিনী আর্নেস্তো, আমার বদ্দকাচন্না, আমার সমস্ত শক্তির অধিক ক্ষমতাশালী এক অলৌকিক নারী, আমার পথপ্রদর্শক, সে স্বীকৃতি কি তার অলাতশান্তির সময় আমি দি নি? কেন অকারণ আক্রমণ করছ? আমি তো তোমায় প্রশ্ন করছি না তোমার হিল্ডা বা এলেইডা অথবা চার দেবশিশুর মুখ উপেক্ষা করা নিয়ে, ডাক্তার হিসাবে তোমার কর্তব্যের অবহেলা নিয়ে কারণ এই ই পুরুষকার। আমাদের দুর্বল হলে চলে না। মহতী প্রয়োজনে ব্যাক্তিস্বার্থ ত্যাগ করাই নিয়তি।"


দুজনেই শান্ত প্রায়। অথচ কী এক অশান্তি দুজনের কাউকেই স্বস্তি দিচ্ছে না পার্থিব চুম্বকতরঙ্গ থেকে এই এতোদূরে বসেও। কোথাও একটা ঝড় উঠছে, অত্যুজ্জ্বল ধুলো রঙের, ডানাহীন অথচ প্রবল উড়ানে।কাদের যেন কন্ঠস্বর... ভার্জিনিয়া ব্রণ্টি প্লাথ গৌরি সাবিত্রী শিন্দে রামবাঈ... প্রশ্ন উঠছে, অজস্র প্রশ্ন, 'হিস-স্টোরি' নিয়ে। তাহলে কি ধর্ম শান্তি দ্রোহ বিপ্লব সবের শিকড়ে একটিই আদিম রহস্য, পুরুষতন্ত্র? যে ফ্যাসিজমে সিদ্ধার্থর সঙ্গে আর্নেস্তোর, রামের সঙ্গে ক্রাইস্টের, মোহাম্মদের সঙ্গে কানহার আদতেই কোনো পার্থক্য নেই? এই আগ্রাসনে সবাই ই হিটলার? পাঁচ হাজার বছরের গুহাঙ্কন স্বস্তিক যেভাবে একদিন অধিক পরিচিতি পায় নাজি প্রতীক হিসাবে, ঠিক সেভাবেই শুধুমাত্র মেয়ে বলে শক্তির বিস্ফার চিরকাল উপেক্ষিত? 

রিং বাজছে স্বধার মোবাইলে - তীব্র কর্কশ - মাত্র চোখ লেগে এসেছিল কুড়ি ঘন্টা পর বিছানার নরমে - 'নার্সিংহোম কলিং - আর্জেন্ট - লাল রে -' সে ঘোরে একটা মুখ দেখছিল তখন - অনেকটা যেন জন স্নো - এক হ্যাঁচকায় ছিঁড়ে গেলো... 

চিত্রঋণ - পারমিতা চক্রবর্ত্তী

জয়তী রায় মুনিয়া

                         


                



মনের ব্যাংক

আজ বলব মনের ব্যাংকিংয়ের কথা। ব্যাংক শব্দটা জড়িয়ে আছে জীবনের প্রতিটি স্তরে। নিচুতলা থেকে উঁচুতলা ব্যাংকের দ্বারস্থ সবাই। কারণ, জমা থাক কিছু পুঁজি। অসময়ে কাজে লাগবে। বিপদে পড়লে কাজে লাগবে। 

জমা করা ,জড়ো করা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আরো নানান দিক আছে এই জমিয়ে রাখার ব্যাপারে। যেমন , কথায় কথায় আমরা বলি, এনার্জি বাঁচিয়ে রাখতে। একটু ঘুমিয়ে নিতে। শরীর ফ্রেশ হয়ে যাবে। পরে কাজ করার সময় বাঁচিয়ে রাখা এনার্জি সাহায্য করবে। ঠিকমত ঘুম, পুষ্টিকর খাবার, সঠিক ব্যায়াম করে শরীর ঝরঝর তাজা করে ফেলার উপদেশ সর্বক্ষণ শুনতে হয়। 

তাহলে মনের ব্যাংকিং কি? মনের ঘরের জমা খরচের হিসেব ঠিক কি রকম?

     ******

  মুশকিল হল, ব্যবহারিক জগৎ আর তার উপযোগিতা নিয়ে সর্বক্ষণ হিসেব নিকেশ করে চলেছি। নিজেদের খুব বুদ্ধিমান ভাবছি। চারিদিকে সবকিছু সামলে চলে নিজের পিঠ নিজেই চাপড়ে বাহবা দিচ্ছি। আজ এমন দুজন মহিলার  গল্প করি। গল্প নয়। সত্য ঘটনা। 

 প্রথমজন  বাংলাদেশ হতে প্রচুর সংগ্রাম করে কলকাতা এসে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। জিরো থেকে একেবারে হিরো। ছেলেগুলো হীরের টুকরো বললেও কম বলা হয়। সেইসঙ্গে মা অন্ত প্রাণ। স্বামী অকালে স্বর্গে চলে গেলেও ওনার কোনও  সমস্যা হয় নি। উনি প্রচুর পুজো করতেন। উপোস করতেন। এবং কাউকে বিশ্বাস করতেন না। এককথায় চতুর যাকে বলে। চারিদিকে সতর্ক নজর। টাকা পয়সা অনেক। ছেলেরা হাতের মুঠোয়। ধন্য ধন্য করত লোক। 

  আজ তিনি বিছানায় শয্যাগত। ছেলেরা রাজকীয় চিকিৎসায় রেখেছে। তার স্মৃতি ক্রমশঃ লোপ পাচ্ছে। কথা বলেন। কথার বেশিরভাগ হল অশ্রাব্য গালি। নোংরা কথার তুবড়ি। নিজের মনেই বলে যান। আয়া নাকি ওনার গোপনাঙ্গে হাত দিয়েছে। একটার পর একটা আয়া বদল। ওনার গালি গালাজ চলতেই থাকে। 


       গল্প ২

____________

 আরেক মহিলার গল্প। সংগ্রামের ইতিহাস দুজনের প্রায় সমান। সাফল্যের বিচারে দ্বিতীয়মহিলা অনেক কম। অর্থভাগ্য ভালো নয়। সন্তান ভাগ্য ভালো নয়। দিনান্তে নিজের ভাত নিজের ফুটিয়ে খাওয়া ছিল তার ভবিতব্য। 

********

এই মহিলা দুজনকে তাদের মধ্যবয়স থেকে দেখেছি। খুব কাছের থেকে। তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ করতাম। দুজন মহিলা আমার কাছের মানুষ। দুজনেই বিধবা। দুজনেই পরস্পরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। 

আমি লক্ষ্য করতাম ওদের চলাফেরা, কথাবার্তা। সফল মহিলার চলা ফেরার মধ্যে উগ্র অহঙ্কার ফেটে পড়ত। মুখে একফোঁটা হাসি নেই। সর্বদা অবিশ্বাস। ভুরু দুটি কুঁচকে আছে। নিরামিষ খেলেও প্রচুর ফল দুধ হরলিকস একেবারে সময় মেপে খান। বাড়িঘর নিয়ে ভীষন সচেতন। সিল্কের শাড়ী, গহনা।  অপর মহিলা একবেলা আহার করেন। যত অল্প খাওয়া যায়। নিরন্তর মুখে হাসি। সকলের সঙ্গে কুশল বিনিময়। যে সন্তান রোজ আঘাত করছে তার জন্য প্রার্থনা। অচেনা লোকের জন্যেও শুভ কামনা। সাদাথান ছাড়া কোনো কিছু নেই। এমনকি একটুকরো সোনা পযর্ন্ত নেই। আমি শুনেছি, সফল মহিলা ব্যঙ্গ করে বলতেন," তুমি ভাই ভীষন বোকা। 

উত্তরে মহিলা হাসতেন। বলতেন," আমি খুব শান্তিতে আছি। 

ব্যর্থ মহিলা সুস্থ থেকে সজ্ঞানে দেহত্যাগ করেছেন। এক ফোঁটা সেবা নেননি কারো কাছ হতে। সফল মহিলা বিছানায়। সাধের বাড়িতে রাজত্ব এখন আযাদের, ছেলেরা দেখাশোনা করে কিন্তু থাকে নিজেদের ফ্ল্যাটে। সিল্কের শাড়ির হিসাব নেই। গহনা মেয়ের হেফাজতে। কোনো জ্ঞানই নেই। গালাগালি কেন দেন, সেটা এখন আমি জানি। এ বিষয়ে পড়াশুনো করে বুঝেছি, মনের ব্যাংকে যা যা সঞ্চয় হয়ে থাকবে সেগুলো অবচেতনে বেরিয়ে আসে।ওই যে ওনার স্বভাব, যাকে উনি লালন করেছিলেন সযত্নে, মনে করতেন এটাই উচিত। সন্ধ্যে হলেই বাংলা সিরিয়াল দেখতেন। রাতে সেই সিরিয়ালের গল্প বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন। দিনে রাতে চব্বিশ ঘণ্টা ওনার মন একটাই সংকেত দিত সেটা হল, কোথাও বিশ্বাস নেই। নিজের কাজ গুছিয়ে নিতে হবে। এটা হয়ত কোনো অন্যায় নয়। বেঁচে থাকার একটা উপায়। কিন্তু সে উপায় ঠিক না ভুল সেটার প্রমাণ দেয় সময়। উনি মারা গেলে কি হত জানি না তবে বেঁচে আছেন এবং নেগেটিভ স্মৃতির মধ্যে তলিয়ে আছেন। ওনার মনের ব্যাংকে জমা হয়ে আছে অবিশ্বাসের পুঁজি। অহঙ্কার। ক্ষমতা লিপ্সা। সেটাই এখন ফোয়ারার মত বেরিয়ে আসছে। 

 মন : ভীষণ শক্তিশালী যন্ত্র। সমস্ত রেখে দেয় নিজের ভিতর। মূল কথা হল আনন্দ এবং এনার্জি। ওই যে অসফল মহিলা , উনি ভিতরে কখনো ক্ষোভ পুষে রাখেন নি। যা পেয়েছেন যতটুকু পেয়েছেন আনন্দের সঙ্গে গ্রহণ করেছেন। তৃপ্ত থেকেছেন। সন্তান ওনাকে আঘাত করলেও উনি তার জন্য প্রার্থনা করেছেন আর ওই সফল মহিলার সন্তান মাথায় করে রাখলেও উনি ভাবতেন যথেষ্ট করা হচ্ছে না। সুতরাং, সচেতন থাকতেই হবে। আমরা সবচেয়ে বেশি ছেলেখেলা করি মন নিয়ে। যা পারি, যেভাবে পারি ঢোকাতে থাকি। রাগ অভিমান দুঃখ ক্ষোভ ... যেন এটা আমার ডাস্টবিন। নাহ্। এই মন আমার বর্ম। আমার অস্ত্র। যা খুশি ভাবে তাকে ব্যবহার করার আগে ভাবতে হবে বইকি। এই ভাবনা আমাদের এনার্জি লেভেল বাড়িয়ে দেবে। শরীরের উপর কত নজর ! চুল এই করো, ত্বক ওই করো। কিন্তু, চিন্তন? মন? সারাদিন তাকে কি দিচ্ছি?

এই মুহূর্তে আমরা অনেকেই লেখালিখির সঙ্গে যুক্ত। লেখালিখি কথাটা বলতে এবং শুনতে যত সুন্দর হোক না কেন, সে জগৎ কত ভয়ঙ্কর সে কথা সকলেই জানি। দিনরাত সেখানে অবিশ্বাস আর দুর্নামের খেলা চলছে। একে অপরের নামে বলছি আমরা। পোস্ট লিখছি। ঠকছি। ঠকাচ্ছি। সারাদিন এইভাবেই ভাবছি কি করে আরো আরো লাভবান হওয়া যায়। 

 ঈর্ষা হোক মহতের তরে... 

    কালজয়ী কবি এমন বলতে পারেন। সৃষ্টির মূল কথা ঈর্ষা। 

প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকলে কাজের আনন্দ কিসের? কিন্তু তার মানে এই নয় যে , চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আঠারো ঘণ্টা প্রতিদ্বন্দ্বী র কথা ভাবতে থাকব অথবা অপর কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে ক্ষোভ আর হতাশায় ডুবে থাকব। 

  যদি প্রশ্ন হয়, ব্যবসা করতে গেলে কিছু নিয়ম মানতে হবে, না হলে সফলতা আসবে না। সব সফল মানুষ কোনো না কোনো সময় অন্যায় করেছেন এবং করছেন। তবে? তারা কি ভালো নেই? সাধু আর বোকা হয়ে এই দুনিয়ায় কোনো লাভ নেই। 

 সমস্যা হল অন্য জায়গায়। জীবনে লাভ হচ্ছে না ক্ষতি সেটা বুঝতে যখন পারি তখন দেরি হয়ে যায় অনেক। মাটির যেমন ধারণ ক্ষমতা পরিমিত, তার উপর অযথা ভার চাপিয়ে গেলে এক সময় সে বিদ্রোহ করে, মনের জমির নেওয়ার কিছু সীমিত ক্ষমতা আছে। তাকে এনার্জি তে ভরপুর রাখতে হয়। নেগেটিভ কথা আর কাজের পাহাড় চাপিয়ে দিতে দিতে এক সময় বিদ্রোহ করে সে। 

 শেষের সে দিন কে দেখেছে? লোকে বলবে ভালো লোক কি কষ্ট পায় না? কষ্ট কখনো ভালো মন্দ বিচার করে না। যার পাওয়ার সে পাবেই। কথা হল, মনের ধারণ ক্ষমতা বা শক্তি যার বেশি সে কষ্ট নিয়েও ভালো থাকে। সুন্দর ভাবনা থাকার ফলে তার ভিতর তৈরি হয় পজিটিভ এনার্জি। ওই এনার্জি সাহায্য করে। বয়স হলে শরীরের যন্ত্রপাতির ক্ষয় হবে। কালের নিয়ম। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হল, মনের সঙ্গে বয়সের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রতিদিন এনার্জি যোগান দিলে মন সতেজ থাকবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। মন ব্যাংকিং। জমা করতে হবে ভালো ভাবনা। সুন্দর চিন্তা। সুন্দর সঙ্গ। সুদে আসলে ফেরত পাওয়া যাবে সময় হলে। 

 টাকা বাঁচিয়ে ব্যাংকে ফেলতে হয়। মন বাঁচিয়ে রাখতে হয় বইকি। সোশ্যাল মিডিয়ার কোন কোন দিক আমাকে বিরক্ত করছে, কোন বন্ধুর সঙ্গ আমাকে ক্লান্ত করে তুলছে ... এগুলো সুদূর ভবিষ্যতে  এনার্জি ব্যাংকের পুঁজি নষ্ট করে দেবে। সাবধান হতে হবে এখন থেকে। 

ভালো লেখক হওয়ার জন্য নামী পাবলিশার হওয়ার জন্য প্রতিদিন এই যে ধার করা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি, ভাবছি কি ভবিষ্যত কি নিয়ে আসছে? অকারণ এনার্জি ক্ষয় করে লাভ নেই। বাঁচিয়ে রাখতে শিখতে হবে। জীবন থাকলে কোনো না কোনো দিকে আমাদের পথ খুলেই যাবে। 

  নিজে আনন্দে থাকলে জগৎ আনন্দময়। এমন চিন্তাশক্তি সবল থাক যার ফলে ভালো হতে বাধ্য। মনের ব্যাংকে বেড়ে উঠুক মঙ্গলধ্বনি। একদিন সেটা কাজে লাগবে আমাদের।।


চিত্রঋণ - অন্তর্জাল

শনিবার, ১৭ জুলাই, ২০২১

অমিতাভ সরকার

                                     


   



বেজন্মা ( নবম পর্বের পর) 


রবিবার দুপুরে কৃষাণকে ফোন করে রাবেয়া। রাবেয়া জানায়, লাভপুরের এক ব্যবসায়ী লোকজনকে নিয়ে আবার এসেছিল। তার মাকে কয়েক লক্ষ টাকা দেওয়ার কথাও বলে গেছে। বলতে বলতে ভেঙ্গে পড়ে রাবেয়া। কৃষাণ অনেক কষ্টে রাবেয়াকে আশ্বস্ত করে বলে যে, মঙ্গল বা বুধবারের মধ্যে তারা আসছে। ফোন রেখেই সিংজী আর মানিক’দা জানায় কৃষাণ।          

বিকেল নাগাদ সিংজী খবর দেয়, একটা টাটাসুমো জোগাড় করা গেছে। তাঁর এক আত্মীয়র গাড়ির ব্যবসা, সব কথা শুনে সে নিজেই ড্রাইভ করবে বলে জানিয়েছে। মঙ্গলবার সকলে যেন বিকেল পাঁচটার মধ্যে ধাবায় চলে আসে। সেখান থেকে সোজা বোলপুর। রাতটা বোলপুরে থেকে ভোর চারটে নাগাদ লাভপুর…।      

বিকেলে স্টেশনে যাওয়ার পথে রাবেয়াকে ফোন করে কৃষাণ। জানিয়ে দেয় বুধবার ভোর পাঁচটার সময় দুজনে যেন রেডি থাকে, যাতে ফোন করা মাত্র বেরিয়ে পড়তে পারে। বাজারের রাস্তায় এটিএম বুথ থেকে বেরতেই দেখা হয়ে  যায় শ্যাম আর নান্টার সাথে। পরবর্তী ট্রেনের জন্য ওয়েট করছিল ওরা। কৃষাণকে দেখেই তাদের মালপত্র ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়ে সঙ্গ নিল। তাদের এই ভাবে কাজকর্ম বাদ দেওয়ার জন্য বকাবকি করল কৃষাণ। যদিও তাদের উৎসাহ দেখে  না করতে পারল না। মনে হল যেন, রোজকার গতানুগতিক ফেরি করা থেকে একটু অন্য কাজের স্বাদ পেয়েছে তারা। তাদেরই উৎসাহে আয়রণের খাট, গদি, তোষক, বালিস অর্ডার করে দেয়। ঠিক হয় মঙ্গলবার সকালে তারা নিয়ে যাবে। নান্টার কথামত, দেখেশুনে একটা আলমারিরও অর্ডার করে দেয় কৃষাণ। আসার সময় বাসনপত্রের দোকানও ঘুরে আসে। ধাবায় আসতেই সিংজী তাদেরকে কৃষাণদের জন্য বরাদ্দ ঘরটা একবার দেখে আসতে বললেন। দুজনকে নিয়ে সিংজীর বাসার দিকে এগোয়। তাছাড়া বিদ্যাভাবীর সঙ্গেও কথা বলা দরকার।       

#

সোমবার দুপুরে রাবেয়ার সঙ্গে কথা বলে নেয় কৃষাণ। রাবেয়া জানায় শামসুদ্দিন তাদের ফোন করেছিল। রাবেয়ার মা’র সঙ্গেও কথা হয়েছে কিছুক্ষণ। ভদ্রমহিলা রাবেয়ার জন্য চিন্তায় রাতে ঘুম হচ্ছে না, অশুভ সংকেত পাচ্ছেন তিনি। এটা নাকি কৃষাণ যাওয়ার পরই শুরু হয়েছে। অনেকেই রাবেয়ার সঙ্গে কৃষাণকে লক্ষ্য করেছেন।    

বিকেল সাড়ে তিনটের মধ্যে হাজির হয়ে যায় সকলে। আসন্ন ধর্মযুদ্ধে যাওয়ার উদ্দীপনা সবার চোখেমুখে। শ্যাম আর নান্টা মন খারাপ করে খাটিয়ার ওপরে বসে আছে দেখে কৃষাণ এগিয়ে যায়।   

“তোরা আগামীকাল ফার্নিচারগুলো নিয়ে আসিস। আমি তোদেরকে মাঝে মাঝে ফোন করে পরিস্থিতি জানাবো, মন খারাপ করিস না। তোদেরকে রেখে আমারও কি যেতে ইচ্ছে করছে? তোরা এর মধ্যে ওঁনাদের জন্য বিদ্যাভাবীর সঙ্গে কথা বলে খাওয়ার ব্যবস্থা করে রাখিস। বিদ্যাভাবীর যদি কিছু দরকার হয়, নিয়ে আসিস”। কথা বলতে বলতে সিংজীর আত্মীয় মনজিৎ হাজির হয় সুমো নিয়ে। সিংজী ধাবার লোকজনদের কিছু নির্দেশ দিয়ে মনজিৎএর পাশে গিয়ে বসে।     

রাত্রি আটটার সময় বোলপুরে খুঁজেপেতে একটা লজে গিয়ে ওঠে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নেয় সকলে। সেই ফাঁকে রাবেয়াকে ফোন করে কৃষাণ। রাবেয়া জানায়, তার মা স্বামীর বাড়ি-জমি ছেড়ে যেতে চাইছেন না। শুধু রাবেয়াকে চলে যেতে বলছেন। রাবেয়া আম্মুকে ফোন দিলে কৃষাণ ভদ্রমহিলাকে আপ্রাণ চেষ্টা করে বোঝাতে…। বলে যে, বিয়ে হয়ে গেলেই কৃষাণ তাঁকে দিয়ে আসবে। খাওয়া দাওয়ার পর নিজেদের মধ্যে প্ল্যানটা একবার ঝালিয়ে নেয়। ঠিক হয় চারটে নয়, একটু আগেই বেরবে। গ্রামে সবার ওঠার আগে, মানে অন্তত চারটের সময় লাভপুর পৌঁছে যেতে হবে।   

কীর্ণাহার পৌঁছতেই আর একবার রাবেয়াকে ফোন করে কৃষাণ। লাঘাটা ব্রীজের সামনেই আসতেই মনজিৎ-কে সুমো থামাতে বলে। গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে নামার সাথে সাথে বিল্লুকে ডেকে নেয় কৃষাণ।      

“সিংজী এখানে ওয়েট করুন, ওদের নিয়ে আসছি”। বিল্লুকে সঙ্গে নিয়ে লাঘাটা ব্রীজের ধার দিয়ে নিচে নেমে যায়। একটু হেঁটে কোপাইয়ের সরু অংশটুকু এক লাফে পেরিয়ে বিল্লুকে হাত ধরে পার করায়। তারপর দু’জনে ওপরের অঙ্গনবাড়ি ট্রেনিং সেন্টারের পাশ দিয়ে দ্রুত হেঁটে পেছনের দিকে একটা খেজুর ঝোপের কাছে বিল্লুকে দাঁড়াতে বলে গ্রামে ঢোকে কৃষাণ। রাবেয়ারা প্রস্তুতই ছিল, কৃষাণ এসে তাঁদের বড় ট্রাঙ্কটা কাঁধে তুলে নেয়। তাই দেখে হায় হায় করে ওঠে রাবেয়ার আম্মু। কৃষাণ চাপা স্বরে চুপ করতে বলে। খেজুর ঝোপের কাছাকাছি আসতেই বিল্লু এগিয়ে যায়। তাকে দেখে চমকে ওঠেন ভদ্রমহিলা। কৃষাণ বিল্লুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। বিল্লু এগিয়ে এসে রাবেয়ার হাত থেকে জোর করেই ব্যাগটা নিয়ে নেয়। ট্রেনিং সেন্টারের পাশ দিয়ে নীচে এসে কোপাইয়ের সামনে দাঁড়াতে নজরে পড়ে মানিকদা আর মনজিতের দিকে। তাদের সাহায্যেই সকলে পার হয়ে যায় কোপাই। ওপড়ে উঠতেই বিল্লুর স্ত্রী রাবেয়াকে জড়িয়ে হাত ধরে রাবেয়ার আম্মাকে ডেকে নেয়।  

“আমি মমতাজ, বিল্লুর বিবি। আসুন ফুফু আম্মা”। সিংজী কৃষাণের কাছ থেকে ট্রাঙ্ক নিয়ে গাড়ির ছাদে তুলে দেয়। মনজিৎ গাড়ি স্টার্ট দেয়। গাড়িতে উঠে কৃষাণ রাবেয়ার দিকে তাকায়…। রাবেয়া চোখ জলে ভরে উঠেছে। রাবেয়া আর আম্মু একদৃশ্যে তাকিয়ে আছে ফেলে আসে তাঁদের গ্রামের দিকে…।   

“আম্মু, মন খারাপ করবেন না, আমরা আবার ফিরে আসবো”। ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায় মনাচিতোর, রাবেয়া কৃষাণের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে। কীর্ণাহার ছাড়িয়ে সোজা এগোয় সুমো।    

সিংজীর নির্দেশে ফুটিসাঁকো এসে একটা ধাবার দাঁড়ায় গাড়ি। অনেকের মধ্যেই একটা চাপা টেনশনে চুপ করে ছিল। সকলকে গাড়িতে বসতে বলে সিংজী আর মনজিতই গাড়ি থেকে নেমে বড় গ্লাসে চা আর বিস্কুট সকলের দিকে এগিয়ে দেয়। রাবেয়ার আম্মু খেতে চাইছিলেন না, সিংজীর অনুরোধে চায়ের গ্লাসটা হাতে নেন।       

বর্ধমানের হাইরোডে ল্যংচার দোকানের এসে গাড়ি দাঁড় করিয়ে সকলকে নেমে পড়তে বলে সিংজী। একবার হাত-পা ছাড়িয়ে নেওয়া দরকার। কৃষাণ ফোন করে শ্যামকে…। সিংজী সুমোর দরজা খুলে দিয়ে রাবেয়াদের বেরিয়ে আসতে বলে।   

“বহেনজী উতরিয়ে…। আউর কিছু চিন্তা নাই। একদম চিন্তা করবেন না। কৃষাণ আমার বেটা, এবার বেটী ভি পাবো। আমার ঘরের বগলমেই থাকবেন…। ঘরে আমার জেনানা ভি আছে, ও ভি আপনার সাথি হবে। সব ঠিক হো জায়গা”।      

সবাই একটা টেবিলের চারদিকে বসে পড়ে। কৃষাণ সকলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয়। বিল্লুর বৌ রাবেয়ার হাত ধরে নিয়ে বসে। ফিস ফিস করে কানে কানে কী যেন বলে বিল্লুর বৌ। চোখ মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যায় রাবেয়ার। তা দেখে বিল্লু চিৎকার করা ওঠে…।     

“এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না, ওর সঙ্গে কানা কানে কথা বলা…। আমরাও তো শুনতে পারি, ঠিক না মানিক’দা?” বিল্লুর কথা শুনে হো হো করে হেসে ওঠে। 

“এই চুপ কর। ওসব তুই বুঝবি না। ওসব মেয়েদের কথা। আমাদের বিল্লুটা একদম পাগল”। এবারে সকলের সঙ্গে রাবেয়া আর রাবেয়ার আম্মুও হেসে ওঠে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাবেয়ারা সহজ হয়ে যায় সকলের কাছে। পেমেন্ট করতে কাউন্টারের দিকে এগোয় কৃষাণ। আলাদা করে কয়েকটা ল্যাংচার প্যাকেট নিয়ে গাড়ীতে ওঠে।   

সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ সিংজীর বাড়ির সামনে পৌঁছায় সকলে। শ্যাম, নান্টা হৈ হৈ করে বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। পাশের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন বিদ্যাভাবি। তিনি রাবেয়া জড়িয়ে ধরে মমতাজকে রাবেয়ার আম্মুকে ভেতরে আসতে বলেন। কৃষাণ, শ্যাম আর নাণ্টার গলা ধরে সকলকে নিয়ে নতুন ঘরে ঢোকে। দুজন মিলে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে ঘরটাকে। একটা মাটির হাঁড়িতে রজনীগন্ধার স্টিকও রেখেছে এককোনে। সকলে দুজনের পছন্দের প্রশংসা করে।    

“কৃষাণ, আমি যাই রে, স্নান করে কাজে যেতে হবে। বিল্লু তুই যাবি না?” 

“তুমি এগোও মানিকদা। আমি আসছি…”।  

“একটু দাঁড়াও মানিকদা…এটা নাও, বৌদিকে দিও। আর একবার আসতে বলো। রাবেয়ার সঙ্গে আলাপ করে দেব”। কৃষাণ একটা প্যাকেট মানিকদার হাতে দেয়। মানিকদা কোনও ভনিতা ছাড়াই খুশী মনেই প্যাকেটটা নেয়। 

“বাব্বা, এই টেনশনে তোর মনেও আছে দেখছি ! এবার খরচ-টরচ একটু কম করে কর…। মনে রাখিস, তুই এবার সংসার করতে যাচ্ছিস…”। মানিকদা যাওয়ার একটু পরেই বিল্লুর বৌ তাদের জন্য কয়েকটা প্লেটে আলুর পরোটা আর রায়তা নিয়ে ঢোকে। 

“মানিকদা কোথায় কৃষাণদা?”

“মানিকদাকে কাজে যেতে হবে তাই চলে গেল। সত্যি…, অনেক ক্ষতি হয়ে গেল আমার জন্য”।      

“দূর ছাড় তো, তুই কি পর? আমিও তোর বৌদিকে বাড়ীতে পৌঁছে দিয়ে কাজে যাব। দে, আমার প্যাকেটটা দে”। বিল্লুর কথা শুনে সকলে হেসে ওঠে।   

“ও, দাঁড়া সিংজীর ঘরে মিষ্টির প্যাকেটটা দিয়ে আসি”। সিংজীর ঘরে গিয়ে দেখে রাবেয়াদের স্নান হয়ে গেছে। সকলে মিলে টেবিল চেয়ারে বসে আলুর পরোটা খাচ্ছে। কৃষাণকে দেখে বিদ্যাভাবি হেসে এগিয়ে আসেন। 

“বাবেয়া, মেরা বেটা আ গেয়া… তুমারে বিনা রহ নেহি সকতা”। সবাই হেসে ওঠে। শুন কৃষাণ, আজ কুছ পাকানেকা জরুরত নেহি। আজ তুমলোক রেস্ট লো, কাল সে বহুত টেনশন হুয়া। কাল দেখা জায়গা। রাবেয়া অউর বহেনজী ইখানেই থাকবে।        

একটু পরে বাবেয়া আর আম্মা নতুন ঘরে ঢোকে। সবকিছু দেখে আম্মা চোখেমুখে নিশ্চিন্তের ভাব চোখে পড়ে কৃষাণের। রাবেয়াকে সঙ্গে নিয়ে বাজারে যায় কৃষাণ। রাবেয়া আর আম্মির জন্য কিছু জামাকাপড়, রাবেয়ার কথা মত চাল, ডাল, মশলা আর রান্নার কাঁচা মালের সাথে একটা ছোট সিলিন্ডার আর ওভেন কিনে একটা রিকশায় উঠে। রিকশায় উঠে রাবেয়া কৃষাণের একটা হাত জড়িয়ে ধরে। কৃষাণ মনে করিয়ে দেয়, আজ সন্ধ্যায় রেজিস্টার আসার কথা।       

সন্ধ্যা সাতটায় মানিকদা রেজিস্টারকে নিয়ে হাজির হয় সিংজীর বাড়িতে। মনজিৎও চলে আসে ঠিক সময়ে। কৃষাণ অনেকবার ফোন করেছিল আসার জন্য। মানিকদা স্ত্রী তার বছর দশেক ছেলেকে নিয়ে একটু পরে আসে।  বিল্লুর বিবি আর বিদ্যাভাবি সুন্দর করে সাজায় রাবেয়াকে। সকলের প্রশংসায় লজ্জায় মাথা নিচু করে বিল্লুর বিবিকে আঁকড়ে ধরে থাকে রাবেয়া। কৃষাণ মুগ্ধচোখে তাকায় রাবেয়ার দিকে। কৃষাণকে দেখে সকলে হাসাহাসি শুরু করে দেয়। মানিকদা কনুইয়ের ঠেলা দিয়ে সতর্ক করে কৃষাণকে। কৃষাণ অপ্রস্তুত হয়ে চারদিক দেখে লজ্জায় হেসে ফেলে। হঠাৎ কাঁধের ওপর ভারি হাতের স্পর্শে ফিরে তাকায়।            

“এটা পরে লে…। শাদিমে তেরা এ প্যান্ট আচ্ছা নেহি লাগতা…” একটা নতুন পায়জামা-পাঞ্জাবীর সেট এগিয়ে দেয় সিংজী। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে না কৃষাণ। সকলের সামনেই কেঁদে ফেলে…। সিংজী দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে কৃষাণকে। তা দেখে সকলে এসে কৃষাণের পাশে এসে দাঁড়ায়।   

পায়জামা, পাঞ্জাবী পরে এসে সিংজী আর বিদ্যাভাবিকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে কৃষাণ। সিংজী কৃষাণকে নিয়ে রাবেয়ার আম্মুর কাছে নিয়ে যায়। তাঁকে প্রণাম করে কৃষাণ। রাবেয়াও প্রণাম করে সিংজী ও বিদ্যাভাবিকে। সিংজী দুজনকে রেজিস্টারের সামনে এসে বসায় বাবেয়া আর কৃষাণকে। রেজিস্টার কাগজ এগিয়ে দেন।     

“দাঁড়াও দাঁড়াও, সবচেয়ে জরুরী কাজটা এখনো বাকি যে…। কবুলনামা করতে হবে তো…”। বিল্লুর ভাব দেখে রাবেয়াও হেসে ফেলে।   

কবুলনামার পর কৃষাণ, রাবেয়া কাগজে সই করে। সাক্ষী থাকে রাবেয়ার আম্মু, মানিকদা, আর সিংজী দম্পতি। মানিকদা তার ব্যাগ থেকে দুটি রজনীগন্ধার মালা এগিয়ে দেয় দুজনের দিকে। ধাবা থেকে সকলের জন্য খাবার আসে। গল্পগুজবের পর অনেক রাতে সকলে ফিরে যায়।  

  

রোজকার অভ্যাসে ভোরে উঠে মোবাইলে একটা ম্যাসেজ দেখে কৃষাণ। গতকালই এসেছে, নানান কাজে খেয়াল হয় নি। ফোর্স থেকে জানিয়েছে, কৃষাণ যেন সাতদিনের মধ্যে জয়েন করে। খবরটা পেয়ে সকালেই মনটা ভারি হয়ে যায় কৃষাণের। খবরটা শুনলে নিশ্চয়ই মন খারাপ হয়ে যাবে রাবেয়ার। কত আশা করে রয়েছে মেয়েটা…।   

সকালের নাস্তার টেবিলে সকলের সামনে কথাটা বলে কৃষাণ। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সকলে। রাবেয়ার দিকে তাকায় কৃষাণ। রাবেয়া ছলোছলো চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অনেক কষ্টে হাসে কৃষাণ। 

“নিশ্চয়ই জরুরী দরকার হয়েছে…। সেই কাজ সেরেই আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবো”। 

“ঠিক হ্যায় বেটা, কুছ চিন্তা নাই। বহিনজী আউর বেটী আমার কাছে থাকবে। কীরে বেটী থাকতে পারবি না? রাবেয়ার কাঁধে রাখে বিদ্যাভাবী। ওড়না দিয়ে চোখ মুছে সায় দেয় রাবেয়া।

“একদম মন খারাপ করবে না। আমরা আছি, চিন্তা কি আছে…। বুলায়া হ্যায়, জানে তো পরেগাই”। সিংজী সাহস দেয় কৃষাণকে। 

“কবে ফিরবে বাবা? আমি জানি এখানে সবার সঙ্গে মেয়ে ভালো থাকিবে। এমন মানুষজন পাবে কোথায়? অনেক ভাগ্য মেয়ের, না হলে কী যে হতো। আমি বলছিলাম, আমাকে যদি মনাচিতোর রেখে আসতে…” 

“এক্ষণি যাওয়া ঠিক হবে না আম্মি। ওদিকে হয়তো শোরগোল পড়ে গেছে…। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে আসবো। এমনিতে আমার অনেক ছুটির পাওনাও আছে”। এখানে সকলে আছে, কোনও সমস্যা হবে না”।   

সকাল দশটায় হাওড়া গিয়ে পাশ ভাঙ্গিয়ে যাওয়ার টিকিট কেটে নেয় কৃষাণ। বিকেলে রাবেয়াকে সঙ্গে নিয়ে বেরোয়। এটিএম বুথ থেকে কিছু টাকা তুলে একরকম জোর করেই রাবেয়ার হাতে দেয়। কৃষাণের চলে যাওয়ার খবর শোনার পর রাবেয়া চুপ হয়ে গেছে। হাঁটতে হাঁটতে রাবেয়ার হাত ধরে কৃষাণ।    

“রাবেয়া, মন খারাপ করো না। তোমাকে তো বলেছি, এই আমাদের জীবন। ফেলে যেতে আমারও কি ভালো লাগছে? কিন্তু কী করব বলো? একটা কথা বলি, তোমাকে আমি শুধু আমার দুর্ভাগ্যের কথা বলে ছিলাম, কিন্তু আমার সৌভাগ্যের কথা বলিনি। আমার সৌভাগ্য, আমি সিংজী আর বিদ্যাভাবীর মতো অবিভাবক পেয়েছি, আর পেয়েছি আপন ভাইয়ের মতো বন্ধুরা। এখানে তোমার কোনও অসুবিধা হবে না। বিদ্যাভাবী তো আছেই, তাছাড়া মমতাজ বৌদি রোজ একবার করে আসবে। চলো বিল্লুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসি…”   

বিল্লুর স্ত্রী মমতাজ তাদের দেখে রাবেয়াকে জড়িয়ে ধরে ভেতরে নিয়ে যায়। কৃষাণ তার যাওয়ার কথা বলে। মমতাজ অভয় দিল, সে রোজ একবার রাবেয়ার সঙ্গে দেখা করে আসবে। তাছাড়া মাঝে মধ্যে আশপাশটা ঘুরতেও যাবে দুজনে।  

“কিরে…? দুই বন্ধু খুব মজা করবো। অবশ্য কৃষাণদা থাকলে যা হতো, সেটা অবশ্য হবে না…! মমতাজের কথা শুনে দুজনেই হেসে ফেলে।     

রাবেয়াকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে কৃষাণ স্টেশনে আসে। সকলের সঙ্গে আলোচনা করা দরকার। যাওয়ার আগে রাবেয়ার নামে ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। সবচেয়ে বড় কাজ হলো, রাবেয়াকে স্কুলে ভর্তি করা। সেটা অবশ্য এর মধ্যে হবে কিনা কে জানে…। 

স্টেশনের প্রান্তে তাদের পরিচিত আড্ডায় সকলে একে একে জড়ো হয়। খবর শুনে সকলেরই মন ভারি হয়ে যায়। মানিকদা জানায় স্কুলে ভর্তির ব্যাপারে গ্রামের মেম্বারের সঙ্গে কথা বলবে।   

রাত দশটায় শিয়ালদহে সবাই বিদায় জানাতে আসে, সিংজী, বিদ্যাভাবী, রাবেয়া আর আম্মু। জীবনের এক স্মরণীয় মূহুর্ত। স্টেশনে পৌঁছে সকলে মিলে কফি খেতে খেতে কৃষাণের বন্ধুরাও এসে যোগ দেয়। ট্রেন ছাড়তেই বিদ্যাভাবীকে ধরে কান্নায় ঢলে পড়ে রাবেয়া।