রবিবার, ২৮ জুন, ২০২০

কস্তুরী সেন









এই সপ্তাহের কবি কস্তুরী সেন ৷ প্রথম দশকের কবি।  স্নাতকোত্তর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় । বিষয় বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। লেখালিখির শুরু স্কুলজীবনে। পত্রিকাপ্রকাশ ২০১৬য় প্রথম। প্রথম বই, ধীরে বলো অকস্মাৎ, ২০১৭, ধানসিড়ি প্রকাশন। পেয়েছে 'সহজ' সাহিত্য সম্মান। দ্বিতীয় বই নাম নিচ্ছি মাস্টারমশাই, ২০১৯, ধানসিড়ি প্রকাশন। পেয়েছে 'কথাস্বপ্ন পত্রিকা' পুরস্কার এবং 'একুশে' সৃজন সম্মান। নিয়মিত লেখালিখিতে কৃত্তিবাস, বৃষ্টিদিন, কবিসম্মেলন, আবহমান ইত্যাদি পত্রিকা এবং ঐহিক, বাংলালাইভ, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম সহ নানা ওয়েবজিনে। পেশা শিক্ষকতা। তার কিছু কবিতা পড়া যাক ৷
১/  #আয়ু

আমরা কি মেপে রাখব দোরে আয়ু 
উঠোনে বাঁধন
আমরা কি ভরে উঠব স্রোতজলে 
আর সেই জল কাটব আল খুঁড়ব সুবচনীপয়ে
আমরা কি রোগ পার হব 
আর হয়ে বলব -
যা তোমার মারীতেষ্টাইচ্ছেতীব্রনীল
এত কষ্ট সোয়ো না গো, 
দাও দাও অশ্রুমতী গ্রাম

দাও মৃত শস্যগাছ দাও ক্লিষ্ট নভোতলস্বাদ
বিষাদ ও চ্ছলচ্ছল দাও ঋতু সুফসল হবে-
আমাদের দৃঢ়বর্ণ
আমাদের  অন্ধপাঠশালা!
মেপে রাখা ধাতু...
বন্ধু আমরা তো জিহ্বাগুণে এতদূরও
একাকী এলাম!



২/ #ভাঙন
     

বিষাদ লিখব না বলে
দুপুরের পর গিজার, 
বিষাদ লিখব না... 
দেখি আজ নিয়ে তিনদিন ক্যাজুয়াল, 
শীতকাল বিশ্রি লাগে, 
বিষাদ লিখব না, শুধু মেঘ চাই, 
বন্ধু হে পরবাসী, 
মানবেন্দ্র শুনব একা ঘরে...
বিষাদ লিখব না, আজ সকালেই তো কথা হয়েছে...
বন্ধুকে বুঝিয়ে বলব 
ডিপ্রেসড করে দিও না, 
দ্যাখো আমরা এইরকমই!
দ্যাখো আমরা দুপুরবেলা, 
ফ্রিজে সবজি, 
আনন্দবাজারের হেডলাইন

দ্যাখো আমরা এই নিয়ে কতবার, ও কিছুই না

পায়ের তলায় জল, জলের তলায় মাথা তুলি

বিষাদ লিখব না, 

দ্যাখো এরও বেশি আরও কত ভিটে উপড়ে
ভেসে গেছে ছেষট্টির জলে!

৩/ #সহজ
     
 দুর্দিনের এই খুদকুঁড়ো খুব সহজ নাকি...
নদির অতই নিকটে আবার
নিষিদ্ধ ফুল ফুটে উঠবার
অলীক নিয়ম!
মানুষ হয়েই একটি জীবন 
মানুষের কাছে এই বেঁচে থাকা,
সহজ নাকি
জাগ্রত সব রাত্রির পরে অখণ্ড ঘুম
শরীরস্নাতক ভোর, আয়ু, 
ফুল ছিঁড়বার নেশা

বনদেবতার সে নির্বাসন...

সহজ ছিল না
তোমাকে চিনেছি সকলরকমে,
এমন আমার মিথ্যাভাষণ!

৪/ #সুরস্থান
    

অলীক ও অলীক দ্যাখো এত স্মৃতিমাত্র হলে চলে
ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছি বান্ধবীর 'আর জানিস কাল মাঝরাতে ও...' ইত্যাকার কথার উত্তরে!
আর দেখেছ অলীক, দ্যাখো 
এইসব খিলখিল এইসব বৃত্তাকার মধুগন্ধী অক্ষরেরা যত 
এসে কে কাকে বলছে পড়ো অমুকের লেখা 
শোনো অমুকের গান, 
গান, ও অলীক দ্যাখো তোমাকেই বলি উফ এত কি দ্রুততা হলে চলে?
এত কি ফাল্গুনমাত্র, ফুটপাথমাত্র, 'আমি কিন্তু পৌঁছে গেছি'
'দাঁড়া দুমিনিটমাত্র!' হলে চলে, 
'এ গান যেখানে সত্য'...সেইখানে তুমি তো জানোই
কোন্ জুলাইমাসের রাত্রি, 
সারারাত্রি সারারাত্রি অন্তরাসঞ্চারী ছাদ আর 
আমি
আমিই তো প্রতিবার দাঁড়াচ্ছি এসে, 
দাঁড়াবই, 
তোমার সমস্ত ফেলে আসা 
তোমার সমস্ত আগামীরও শ্রীপঞ্চমীস্তবে...

৫/#পলাতক_ও_অনুসরণকারী
  

আর এই দরজা ঠেলে ঢুকলেই 
কেমন সকালবেলার রোদে আমার কিশোরী ছোটদিদা যে গান গেয়েছিলেন সেই গান!
সেই ছোটদিদা যাঁরও ডাকনাম ছিল হাসি 
আর প্রায় সেই থেকে তিনি তো আমাদের উমা বসুই, 
উমা বসু হয়ে পরের মোড় ঘুরতেই 
দ্যাখা পাবার কথা ছিল দিলীপকুমারের 
অথচ পরের মোড়ে কিন্তু আর গান নেই কোনও, 
সকাল নেই, সবে বৃষ্টি থেমে গেছে রথের বিকেলে, অঙ্কখাতার পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে 
দোতলার জানলা থেকে উড়িয়ে দিচ্ছে ওই যে স্কুলভীতু বালক, 
ওই বালকটি কি আমার বাবার সাতবছর বয়স, 
ভাবতে ভাবতেই পরের বাঁকে হই হই করে ঢুকে পড়ল যারা, তাদের পায়ে ভোরবেলার ময়দান, 
আমেদ ভাল না ধনরাজ ভাল তর্কে তর্কে 
গলার শির ফুটে উঠছে যে কঠিন ছেলেটির 
সন্ধেবেলায় সেই তো মিনতি নামের মেয়েটিকে বলবে ব্রহ্মপুত্র ছেলেবেলার গল্প 
আর মিনতি, মেজজ্যাঠাইমা, 
এই সেদিন অবধি নাম গুলিয়ে ফেললেও 
যিনি একলহমায় বলে ফেলতে পারতেন আত্মীয়স্বজনের বিয়েথা, উৎসব আয়োজনের সব তারিখ, 
তাঁর জন্যও না থেমে এই গান যে শেষপর্যন্ত যাবেটা কোথায়, গিয়ে থামবে কোন চুরাশি সালের সপ্তমীর দিনে 
কিংবা কলামন্দিরের একক সুমনে 
সেসব তো আর এই লেখার হাতে নেই, 
না থাকুক, আমরা যারা অবাক হতে জন্মেছি
বরং ব্রত শুনবার মত করে হাতে তুলে নিই এই আশ্চর্য পানের পাতা 
আর দেখি, অসুখবিসুখ ধারদেনা
মন্দিরমসজিদের ফাঁক গলে
কী অবিশ্বাস্য উপায়ে এক্কাদোক্কা খেলার মতো করে 
এগিয়ে যাচ্ছে একা বেইমান সুর
আর খুব কাছ থেকে না হোক, কিন্তু দূর থেকেই 
চিরদিন সেই পলাতককে অনুসরণ করে যাচ্ছে 
এই লেখার যত 
অক্ষরের পর অক্ষরের পর অক্ষরের পর অক্ষর...

৬/#ফাঁদ
   

এসব কিছুই নয়, অক্ষরবৃত্তগুলি গুনে গুনে দ্যাখা
এসব কিছুই নয় মাত্রা সব এলোমেলো মাপি
এসব কিছুই নয়, বলে ওঠা কী অসহ্য শেষের কবিতা
এসব কিছুই নয়, মুখভার কেন তুমি গিয়েছ বেপাড়া!

শুধু প্রাণ ঝলসে উঠবে, শুধু এই মাত্রাস্থানে ছোঁয়াবে আঙুল
শুধু ভুল ধরে দেবে, শুধু বলবে কী যে বন্দি জীবন হতাশ!

তোমাকে গোপন ক'রে শুষে নেব সেই ঝলসে ওঠা
ভোর নামবে, আমার সমস্ত জুড়ে নতুন কবিতা হবে, তাই
এতেক ঘটিয়ে তুলি অবলার বলে!
অক্ষরে অক্ষরে আমি তোমারই তো নাম নিই মাস্টারমশাই!

৭/ #দোষ
    

ভাষা তো শীতল জল, 
সহসা উতল হয়, বুদ্ধনাটকগানে 
মনের শরীর! 
ভাষা তো কর্পূরগন্ধ, একটি কাঁসার গ্লাসে
লিখে রাখে নামধামছবি...
ভাষা তো গোপনপথ
কে পালায় দিনমানে, 
চিতা থেকে অব্যাহতি গত শতকের!
ভাষা তো প্রেমের কথা, দোষ পায়
কী নাছোড় তবু কিন্তু
আজীবন লিখে যায় কবি!



রবিবার, ২১ জুন, ২০২০

শুভম চক্রবর্তী


এই সপ্তাহের  কবি শুভম চক্রবর্তী ৷তার  লেখালেখির সূত্রপাত ২০১০ সাল নাগাদ অর্থাৎ প্রথম দশকের কবি বলা যায়৷ বাণিজ্যিক-অবাণিজ্যিক নানান পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। এখনো পর্যন্ত তিনটি কাব্যগ্রন্থ আছে - শব্দের বিহ্বল ডানা (২০১৭), শরীরপরব (২০১৮),  আয়াত (২০১৯)। 
কবি ২০১৭ সালে পেয়েছেন 'উতল হাওয়া সাহিত্য সম্মাননা', ২০১৯-এ 'শরীরপরব' কাব্যগ্রন্থের জন্য মাসিক কবিতাপত্র পত্রিকার পক্ষ থেকে 'কবি জয়দেব বসু পুরস্কার'। 
সম্পাদিত পত্রিকা - 'কর্ষণ', 'অনপেক্ষ'।       




অনুচ্চারিত
-------------------



বাইরে ভীষণ বৃষ্টি আর ঝড়
শব্দ করে দরজা খুলছে, বন্ধ হচ্ছে
মেঘ ডাকার রেশ লেগে থাকছে সারা আকাশে
বৃষ্টি ধোয়া বিদ্যুৎ-এর আলোয় আলোকিত সব
এরকম মুহূর্তই তোমার দিকে নিয়ে যায়
স্মৃতি-বিস্মৃতির পরম্পরা টপকে, আদুল হয়ে,
মাছ ধরছে ছেলেরা, পথেই
স্মৃতির মধ্যে ঢুকে যাওয়া এইসব গ্রামজীবনের খণ্ড চিত্র 
পেট ফোলা ব্যাঙ, লুকোনো সাপ, গুরুতর বিদ্যুৎচমক, ছায়া ও অন্ধকারও ঢুকে পড়ে
পুকুরের পাড় ভেঙে জল ঢুকে যায় গ্রামে
পুকুরের পাড় ওঠা দিয়ে জন্মতারিখ নির্ধারণ হওয়া আশি নব্বই বছরের প্রাচীন গ্রামছবির সঙ্গে তোমার স্মৃতি সংযুক্ত হয়ে গেল
খণ্ড খণ্ড জগৎছবি মেশালাম কিঞ্চিৎ  শুশ্রূষা সহযোগে 
এবার আমরা আরশিনগরের দিকে চলে যাব
দুদিনের হোটেলবাস, পাহাড়ে বেড়াতে যাওয়া, অনাথ আশ্রমে থাকা কিছু দিন
আমাদের মধ্যে আর আলাদা আলাদা ভাবে উচ্চারিত হবে না কখনও
বাইরে ভীষণ বৃষ্টি আর ঝড়, বিদ্যুৎ চমক
কী যেন ধুয়ে, মুছে এক করে দিল


মৃত্যুকে যেমন দেখায় 
---------------------------------

বর্ণ ও বর্ণহীনতার ছড়িয়ে পড়া, অভিযাত্রা এমনই
যেন সকাল থেকে মা ডেকে তুলছে আর কেউ উঠছে না
যেন ভোরের পাখি ডাকা ডাকা আকাশ কবলিত তোমার স্নিগ্ধ মুখ, বিনুনির ওম পৃথিবীর নৈরাজ্য-পীড়িত এলাকার দিকে উড়ে গেল
আর তাকেই আঁকড়ে ধরতে চেয়ে কেউ একটা ছুটে গেল ভেতরের দিকে
সেখানে ছোটেনি কেউ, কেউ আর স্থির হয়ে নেই
ইতস্তত হাওয়ায় কাঁপছে বর্ণদীপখানি
সে আলো সারা গায়ে মেখে ঘুমিয়ে রয়েছে একটি পাগল, প্রশান্ত ঘুমের দেশে, এত জবাফুল




তারারাত্রি
-----------------



তারারাত্রির আকাশে ছড়িয়ে দিলাম মদ, ছড়িয়ে দিলাম মাংসকুচি
রক্তাভ আবেদন ছড়িয়ে পড়লো নিভৃত সর্বাঙ্গে
খুব উট উট পেল আমার
গাভিন কামদুঘার মৌনব্রত পেল
রাত্রি রঙিন খানকির মতো আবেদনময়ী এবং স্থূল
এইসব মেদ, মাংস, পচুই মদের সান্দ্র কুহক ভাসমান হয়ে রইলো আকাশে


মাকড়সার জালের ধারণায় সংকীর্ণ প্যাঁচপয়জারময় আকাশের দিকে তাকালাম
ধোঁয়া তার জাগতিক পাথেয় শুষে মহাজাগতিক কুয়াশায় বুঁদ
ধীরে, মোটা গ্যাদগেদে মেঘে, সিঁদুরমাখানো মথ ঠ্যাং উলটে পেচ্ছাপ করছে
তাকে মানবী অবয়ব দাও
দিগন্তে, লাট খেতে খেতে, ঘুড়িবিপন্নতায়, অস্থির প্রশ্নচিহ্নে, দানবীয় ধর্ষকাম তার চরিতার্থ হবেই
এই নিগূঢ় দ্যোতনাটুকু
সংকীর্ণ প্যাঁচালো মশারিতে ঝালর, আকাশধারণা 


ফিরে এলাম
সঙ্গী কিছু অনুচ্চারিত কথার খুচরো
গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে রয়ে গেল ভেতরে
আর আমি
কাশবন সাঁতরানো দামাল বাচ্চা
সাদা পিষে পিষে পেশি স্ফীত করে তুললাম
স্মৃতি, পলেস্তারা গুঁড়ো 
এতো ঝরে
হাত তুলে তুলে তাকে নাগাল পাব না 

           
 নড়বড়ে হাওয়ায় মৃত্যু-মুহূর্তের যে অনিশ্চয়তা দোলা দিচ্ছে, আমরা তারই পথিক
গাঢ় অন্ধকার রাতে
বিজ্জলতা মাখানো শরীরে
উলোটপালোট গ্রীবায় 
একে অপরের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে
অনিঃশেষ খুবলে খুবলে নিচ্ছি আলো, জাদুপরত



দিনলিপি
-------------- 

চাঁদ খুব ঘোলাটে, নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে এইমাত্র দেখলাম
পর্দাহীন জানলার ফাঁক দিয়ে  বিছানার দুলে ওঠা দেখলাম
বাকিটা সঙ্গম, ঝগড়াঝাটি বা শিশুর দুলে ওঠা  ভাবনারা এসে পূর্ণ করে দিল
চাঁদ খুব ঘোলাটে, বাদামি রঙের ধুলোর আস্তরণ সারাগায়ে
দূরে, ব্যালকনিতে, ঝুকে কেউ ফুলগাছে জল দিচ্ছে
ঘন অন্ধকার জল
এই দৃশ্যকে মনে রেখে কালকের দিনটা শুরু করব।


 সর্পিলাকার বিপন্নতা  ১
----------------------------------

শুভম চক্রবর্তীকে নিয়ে শুভম চক্রবর্তীর সংশয় গেল না ! 
ছ'হাতের কাছাকাছি একটা সাপ বারবার পায়ের পাতায় ছোবল 
কিন্তু গিলছে না...
অন্ধকারের যাবতীয় ইন্তিবিন্তি ঘেঁটে যাদের সর্পিলাকার বিপন্নতা একটু লম্বা হয়েছে 
তাদের পাশ সড়সড়িয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে হাওয়া 
এই পাতা এই বৃত্তাকার উপবৃত্তাকার আলোছায়া 
এই দাবানল গোছের কিছু সোঁদা অবসাদ 
তাকে লাট খাওয়াচ্ছে আকাশে কিন্তু হচ্ছে না ভোকাট্টা
কত কত নৌকো চলে গেল
জাহাজও নোঙর ফেলছে
পথিমধ্যে দেহাতী খালাসিরা আঙুল বাড়িয়ে দেখাচ্ছে
দ্যাখ ব্যাটাকে, সমুদ্র চেনে না
দ্যাখ ব্যাটাকে, অকুল ছপাছপ গায়েই মাখেনি
সে শেষতম মৃত ছিল, হয়তো
শেষতম জীবিত 
হয়তোর আগুন ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে কোত্থাও পৌঁছায়নি সে, এখনও
সংশয় গেল না !



সর্পিলাকার  বিপন্নতা  ২
------------------------------------

সামনেই একজন ঘুমন্ত মানুষ 
রোঁয়া রোঁয়া শরীর মেলে শুয়ে আছে
ভোরবেলাকার স্বল্প আলোয় তার শ্বাসের ওঠানামা হাড়সর্বস্ব দুলিয়ে দুলিয়ে তাৎক্ষণিক ভাবে অন্ধকারকে আরও গাঢ় করে তুলছে
সামনেই একজন ঘুমন্ত মানুষ 
হাঁ-ক্লান্ত বিকেল শেষে, রাতে, ঘুম জমাট বেঁধেছে দেরি করে
সারারাত সে অনিদ্রার সঙ্গে খেলেছে 
খেলেছে পাশে খুলে রাখা এলোমেলো পোশাক নিয়ে 
কোনো শরীর ছিল না
অন্ধকার লাল আলোর টানেল 
একটার পর একটা পেরিয়ে পেরিয়ে যাওয়া
ঝাঁপিয়ে 
গড়াগড়ি 
অন্তর্গত অন্ধকার   ছায়া  খোলাজানালা    ইশারাহীনতা
সামনেই একজন ঘুমন্ত মানুষ 
গৎ এখনও পড়েনি
পড়লেই আবার ঠেলে ঠেলে পৌঁছনো
কোথায় কোথায়
লোমশ ভুঁড়ি কুৎসিত কদাকার চা করে দেব সকালে
আমরা বিকেল হচ্ছি না সকাল
সকাল হচ্ছি না বিকেল
তার সিঁধেল পাঁয়তারা পাশে ছড়িয়ে রাখা ছতিচ্ছন্ন জামা ও কাপড় 
মনস্তাত্ত্বিক  চোরা বাঁক 
অন্ধকারকে গাঢ় করে তুলছে
ঝিঁঝি রব আরে গ্রামেই থাকে
তার যাবতীয় ভঙ্গিমা সৃষ্টি পেঁয়াজি সে খুলবে খুলবে করে খোলেনি 
বিছানায় ভুঁই-এ মজা পুকুর চলে এলো
ব্যাঙের কোকরকোকর আর অন্তহীন ঝিঁঝিরব
বলাৎকার 
জ্যোৎস্নারাত
মা গো 
সামনেই একজন ঘুমন্ত মানুষ, ঘুমোবে কখন 
না ঘুমোলে আমি যে ভিতর নিয়ে জাগতে পারছিনা !


সর্পিলাকার বিপন্নতা  ৩ 
------------------------------

পায়ু ও অণ্ডকোষের মাঝামাঝি যে স্থান সেখানে আমার সব রোমহর্ষ স্থির হয়ে ছিল
তুমি তুমুল জাগাতে...
জিভ দিয়ে, জিঘাংসা দিয়ে
ঘেঁটে তুলতে থিতিয়ে যাওয়া ওয়াক
সব সাপ হয়ে যেত, বড় সাপ সাপ হয়ে যেত সব
তারপর কত যে উল্টেপাল্টে আর সোজা করে নিয়ে
গতানুগতিকতার পুটকি মারতাম 
আজ তুমি নেই স্থিরবৎ জলের সপসপে
বুড়ি, কোমল মনের ভালো মাগি
কুণ্ডলিনী ফেটে যাক ফেটে যাক যা কিছু কঠিন



রবিবার, ১৪ জুন, ২০২০

সেলিম মণ্ডল


এই সপ্তাহে কবি সেলিম মণ্ডল ৷ তার কবিতা আমাদের কাছে খুবই পরিচিত ৷  কবিসত্ত্বার পাশাপাশি সম্পাদক ও প্রকাশক রূপে চূড়ান্ত সফল ৷

‘তবুও প্রয়াস’ পত্রিকা নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন তিনি। বর্তমানে ওয়েব ও প্রিন্টেড দুই মাধ্যমেই প্রকাশিত হয়।  লোকসংস্কৃতির ওপর কাজ করার আগ্রহ আছে তার।

তার দুটি কাব্যগ্রন্থ ‘মায়াজন্ম’ ও ‘লবণ খেতের জোনাকি’ প্রকাশিত । প্রকাশিতব্য কাব্যগ্রন্থ ‘কাঁচা মাংসের বাড়ি’ও সম্পাদিত গ্রন্থ ‘ছাদ পেটানোর গান’l


সেলিম মণ্ডলের কবিতা


বেদনাবীথি

৫৮
বসন্ত ঠুকরিয়ে ঠুকরিয়ে বর্ষা আনল। বৃষ্টি হল নিঃসঙ্গতায়। ছাতা পারল না, ঠোঁট দিয়ে মেঘ ধরতে। মেঘ বাড়ির ভিতর, তোমার ভিতর, আমার ভিতর একই শীতকাল হয়ে লেপ মুড়িয়ে আছে।

৫৯
ওই লাল সাইকেল করে কি ফেরি করো? সন্ধ্যার পথ তোমার নাভির ভিতর হারিয়ে বেজে উঠবে কি ক্রিং ক্রিং করে?

কেরিয়ারে অলস যে ঘুঘু, ফাঁদ পাতবে বলে ইশারা করে চলেছে নিয়মিত, তার ডিম…

৬০.
তুমি বলো ছায়া হও, ছায়া হও। আমি ছায়া হতেই চেয়েছি। তবে দীর্ঘ  নয়। ছায়া দীর্ঘ হলেই অন্ধকার নেমে আসে। আমি জানি, অন্ধকার তুমি ভয় করো।

দু-জনে


একই স্বপ্নে দু-জনের ঘুম ভাঙল।
স্বপ্নে, দুজনই‍‍‍—
একটি পাহাড়ের গায়ে বড়ো বড়ো হাঁ দেখে আঁতকে উঠেছিলাম।

দাগগুলো ছিল‍‍‍— মানুষের মুখের মতো।


দু-জন কেউ কারো নয়। কথা হয় গাছের পাতায়।
গাছ গেছে ঝড়ে ভেঙে।
মাটিতে কোলাহল। মাটিতে পোকার সহবাস‍‍‍—
এমন বৃষ্টিদিনে‍‍‍— নিমফুলের মধু নিয়ে
মৌচাকে রেখেছি হাত

গাছ কথা কয় না, ঝুলে পড়া গাছে আমিই আদিম কচ্ছপ!


সাড়ে তিন ফুট দূর থেকে হাত নাড়িয়ে
চলে গেছ‍‍‍— আদিম লড়াইয়ে

দু-জনের কালো নৌকা, লাল হতে হতে
ঢুকে গেল বাড়ির ভিতর

বাড়ির জল ঘোলা হোক; বিপদজনক নয়

ভাঙা দাঁড়ে ফুল বেঁধে সবাই ভেবেছে এটা

আমাদের গল্প


বিধবার ভাতা নিয়ে ভোর আসে।
নিকটে, অতিনিকটে পড়ে থাকে সিঁদুর।
আমাদের গল্পে জানাজায় বিয়ে হয়
পাত পেতে একসঙ্গে খায় সাপ ও অলস ময়ূর।


আমাদের গল্পে মরা ইঁদুর পড়ে থাকে।
কাকে খাক চাইনি আমি এবং তুমি
পচেগলে দুর্গন্ধ ছড়ায়। তবুও তার ঝকঝকে দাঁতে
তুলে দিই আগামীর সঞ্চয়। মাঠভরা। আমাদের মাঠভরা সবুজ
ইঁদুরের গর্ভে ছিল। সে করেছিল অগাধ নালিশ।


গল্পের গল্প যেন দুধে মাখা সাদা ভাত।
শিশুর মুখে তুলে দেবে মা।
হাঁটিহাঁটি পা পা: টলমল খসে পড়ে নুপূর।
গল্পে রাত আসে না। এই গল্প শুধুই
খাঁ খাঁ। বাঞ্চোত দুপুর।

চিঠি, সাপ ও ময়ূর

একদিন চিঠি এল বাড়ি‍‍‍‍—
"পেখম মেলার আগেই সাপটি খাবে ময়ূর"
আমি সন্তুষ্ট হয়ে দশ টাকা বকশিস দিলাম পিয়নকে

একমাস পর আবার চিঠি এল‍‍‍‍—
"সাপটি ফণা হারিয়ে গর্তের মধ্যে ঢুকে পড়েছে"
আমি আরও সন্তুষ্ট হয়ে কুড়ি টাকা বকশিস দিলাম পিয়নকে

আবারও চিঠি এল একমাস পর‍‍‍‍—
"সাপ ও ময়ূর কাউকেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না"
এবার আমি আরও খুশি হয়ে ত্রিশ টাকা বকশিস দিলাম পিয়নকে

এরপর একমাস যায়
                    দু-মাস যায়
                           তিন মাস যায়

চিঠি আসে না

একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখলাম‍‍‍‍—
আমার বালিশের পাশে একটা ফণা পাওয়া গেছে
আর আমার খাটের নীচে তৈরি হয়েছে বিরাট গর্ত

দূর থেকে সেই মোটা গোঁফওয়ালা পিয়ন সাইকেলে ক্রিং ক্রিং করে চলে যাচ্ছে‍‍‍‍—
                                                       আমাকে না দেখার ভান করে

আমি মরে গেছি

'আমি মরে গেছি'— এ-কথা
ডাঙা থেকে কুমিরকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না
সে বলতে লাগল: জলে এসো
আমি আমার শরীর নিয়ে জলে নামলাম
কুমির আমাকে ছুঁয়ে বলল: মিথ্যা, মিথ্যা
সারা শরীর কামড়ে দাগ বসিয়ে দিল
কিছুক্ষণ পর জলে ভেসে উঠলাম
এবার সত্যি সত্যি মরে গেছি ভেবে জলের গভীরে চলে গেল কুমির
এখন জলের উপর একা আমি বেঁচে আছি, ভেসে আছি
কাউকে বিশ্বাস করানোর প্রয়োজনবোধ করছি না


ঘটনা

একটি ফুল আত্মহত্যার আগে
একটি ফলের কাছে দুঃপ্রকাশ করে
ফল, বীজের কাছে জানতে চায় সম্পূর্ণ ঘটনা!


জ্বর

সন্দেহ হলে জ্বর আসে
জ্বরের রং নীল

আমাদের শাদায় তৈরী দেওয়াল
ছোট্ট ঘুলঘুলি
কড়ি বরগা
লুপ্তপ্রায় চড়ুই
একে একে ঢুকে যায় থার্মোমিটারে

জ্বর বড়ো হয়
জ্বর কপালে টিপ পরে

জ্বর তার যোনিতে খুলে রাখে একটা থ্যাঁতলানো চোখ


আমি

আসবে জানলে দরজা খুলে রাখতাম

প্রয়োজন হল না।  একটা ঝুল জমা ঘুলঘুলিতে
হারিয়ে যাওয়া কোনো আদুরে চড়ুই
বারবার উচ্চস্বরে বলতে থাকে: একা হও, শক্ত হও
কোনো ধাতুর মতো

আলো জ্বলে ওঠে

দরজায় বসে জোনাকির মেহফিল

আর আমিই হয়ে উঠি এমনই হুজুর যার আল্লা ছাড়াও
একজন 'আমি' আছে

চিৎকারপুর

চিৎকার নিয়ে বেঁচে থাকা সহজ
চিৎকার ভুলে যে মানুষটি ময়ূরের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে
মুখে পুরে নিল সাপ—
সে কোনোদিন হয়ত চিড়িয়াখানায় যায়নি


চিড়িয়াখানা থেকে ফিরে যে মানুষটি
ঠিক করেছিল প্রচণ্ড টক-ঝালের ফুচকা খাবে
সে গরম রসগোল্লার লোভে ঢুকে পড়ল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে
মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে দীর্ঘদিন ছানা নেই! কিছু ঝকঝকে বিড়ালের
তীব্র চিৎকারে সে পালিয়ে এল বাড়ি


মানুষটি বাড়ি ফিরতে চায়নি
ফিরে যখন এল, ভাবল: আর কোত্থাও যাবে না
কারো মুখ দেখব না
ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দিল বাড়ি
বাড়িতে ইঁদুর ঢুকল
সে ইঁদুর মারল না, ত্রিপল সেলাই করল
পরপর আরও ইঁদুর ঢুকল
বিরক্ত হয়ে একদিন নিজেই খুলে ফেলল ত্রিপল
ততদিনে নেমে গেছে বর্ষা
সে আবার রওনা দিল—



রবিবার, ৭ জুন, ২০২০

মনোজ দে


"সৃজন " এই সপ্তাহের কবি মনোজ দে ৷

মনোজ এই সময়ের এক প্রতিভাবান কবি ৷১৯৯২  বাঁকুড়ায় জন্ম৷অতিথি অধ্যাপনা পেশা ৷ তার উল্লেখযোগ্য দুটি কাব্যগ্রন্থ " আমি ঈশ্বর ছুঁইনি (২০১৮) এবং শরীরে সংগীত রেখো ( ২০১৯) ৷


অসুখ পেরিয়ে যাওয়া কোনও মিথের সকালে
•••

১.
ছোঁয়াছুঁয়ি সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা আর নেই
এমনই সকালে ঘুম ভেঙে দ্যাখো
সরকার তোমার জন্য ফুল পাঠিয়েছে
হাতে তুলে, শুঁকে নাও 
সেই উদ্ভাসিত আলো ঘরময় ছড়িয়ে পড়লে
                                    আমরা ফের হাঁটতে বেরোব


২.
আলিঙ্গন ফের স্বাভাবিক
উষ্ণ চায়ের পেয়ালা, দ্রিম দ্রিম ওড়ে ধোঁয়া

বৃষ্টি তখনও আসেনি, ঝড় বলতে, শ্বাসাঘাত
                                             ছন্দ ভুলে চুম্বনে মিশেছে


৩.
এতদিন যাকিছু লিখেছ, নিজের ফাঁকফোকর

এসো, দুজনে মিলিয়ে দেখি
আঙুল তো এত সূক্ষ্ম নয়, উপশম ঢালু
                           অভ্যাসে গড়িয়ে দিও শুধু


৪.
জীবনের অপর নাম পাহাড়

হাত ধরো। ফুটম্যাপ বিশ্বাসে ভাসিয়ে দাও
তোমার উন্মুক্ত পিঠ যেন মহৌষধি
ছুঁয়ে আছি, এই বিশ্বাসে, শিহরণ জাগায়


৫.
ওড়না প্রাচীনপ্রবাদ। প্রকাশ্যেই দেখা হবে আমাদের
স্পর্শে কোনও বিষ নেই আর
তোমার আঙুল ছুঁয়েই প্রথম প্রমাণ পেলাম


৬.
কমিউনিটি কিচেন আজ খেলার সামগ্রী
                                            যে যার পেশায় মত্ত

এবার তোমায় পাশে পেতে হলে
ফের নাটকের দরখাস্ত


৭. 
একদিন সন্ধ্যে হয়ে যাবে
বাড়ি ফিরব না কেউ

একদিন কারফিউ থাকবে না শহরে
সারারাত একসাথে দেখব চাঁদ


৮.
রাস্তা যে যার মতই ব্যস্ত

তোমার হাতের প্লেট উড়ে যাচ্ছে 
হওয়ায়, তখনও পকেটভর্তি ক্রাইসিস


আরও একবার একটাই প্লেট ভাগাভাগি করে নেব


৯.
এঁটো নিয়ে তো ছুঁৎমার্গ নেই
শুধু কে প্রথমে মুখে তুলবে

আলতোভাবে আঙুলে কামড়, একটি স্মৃতি
আমাদের প্রথম দিনের কাছে নিয়ে যাবে



১০.
মুষড়ে পড় না প্রিয়
সময় এখানে শেষ নয়
অসুখের আয়ু, জেনে রেখো
মৃত্যু পেরতে পারে না
এই যে স্থাপত্যে মোড়া দেশ
হাজার হাজার প্রিয় গান
তুমিও কিছু তো লিখে রাখো
পড়ে নেব আগামী সকালে



মনোজ দে।
জন্ম - ১৯৯২
ঠিকানা - বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ।
পেশা - অতিথি অধ্যাপক