রবিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১

পিয়াংকী

             





 গরমবাহার কুড়িতমপর্ব



গুড়জ্বাল আর তিলের নাড়ু মুড়ির মোয়া


আজ খুব শীত, উত্তুরে হাওয়ার গতিবেগ ক্রমশ বাড়ছে।  মনে পড়ে যাচ্ছে সেইসব দিনগুলোর কথা যখন এরকম অঘ্রানের রাতে আমার আম্মা একটা শাল মুড়ি দিয়ে বিছানায় বসে মহাভারত মুখস্থ করতে করতে তন্দ্রাঘোরে ,মা সেসময়  উনুনে কাঠ ঢুকিয়ে তিল ভাজত কাঠখোলায়, ফটফট করে শব্দ হত,সুন্দর হালকা গন্ধ ছড়িয়ে পড়ত ঘরময়, মা জ্বাল দিত আখের গুড় তারপর সেই গুড়ে চিট এলে একতার দুইতার মেপে অর্ধেকটা মুড়ির পাক আর বাকি অর্ধেকে সাদাতিল।এরপর দু'টো পাত্র আর সর্ষেরতেলের শিশি বিছানায় রেখে দিয়ে  আম্মাকে বলত,"ওকেই পুরোটা খাইয়ে দেবেন না মা, কিছুটা টুলুর বাড়ি পাঠাব"। 




আম্মা মোয়া আর নাড়ু গড়ে নিয়ে আমার দু'হাত ভরে চারটে দিয়ে বলত,"লুকাইয়া ফ্যাল"। কাঁথার নীচে আমার পাদু’টো গরম করার জন্য শীতের এই সন্ধেগুলোতে আমার আম্মাই রসুনসর্ষেরতেল ফুটিয়ে গরম গরম মাখিয়ে দিত পায়ে হাতে পিঠে বুকে। ঠান্ডা লাগার ধাঁচ বলে যত্ন করতে করতে বলতো," ক্যাডায় কয় রূপসীরে লইয়া যাইব একদিন, আমি দিমুনা যাইতে"।আজ আম্মা নেই। আমার যত্ন উধাও হয়ে গেছে অ্যালোভেরা জেল আর সানস্ক্রিনের মোড়কে। কিন্তু কেন জানি না  গুড়জ্বালটা সুইগিজোমাটোতে আজও অর্ডার করতে পারি না। তারাদের দেশ থেকে আমার  মা আর আম্মা মোয়া - নাড়ু হয়ে ফুটে থাকে রাতের নক্ষত্রে...



মীনাক্ষী ঘোষ

                            


কোল্হাপুর ডায়েরী ৫


রাতে নিজের বাংলোয় সকলকে ডিনারের আমন্ত্রণ জানিয়ে বাড়ির সামনে ড্রপ করে বৌদি বিদায় নিলেন।
মন্দিরের কাছাকাছি জায়গাটা দিয়ে যাবার সময়  মিমি  কোল্হাপুর শহরের পুরনো রূপটা যেন দেখতে পেল। মিমিদের ফ্ল্যাট যেখানে সেটা কোল্হাপুরের পশ এরিয়া। সেখানে কসমোপলিটান ভাবটাই বেশী। কিন্তু মহাদ্বার রোডের এদিকটায়  এলে কোল্হাপুরের আসল চেহারাটা প্রতিভাত হয়।পুরনো শহরের মতোই সরু সরু পথঘাট। পুরনো কেল্লার ভগ্নাবশেষ কেল্লার তোরণের মতো প্রবেশ ফটক মারাঠা ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।আর কোল্হাপুরকে বেষ্টন করে বয়ে চলেছে পঞ্চগঙ্গা নদী।
এই মহাদ্বার রোডেই বিখ্যাত চপ্পল গলি। ভারত বিখ্যাত কোলাপুরী চপ্পলের উৎপত্তিস্থল।   কোল্হাপুরি চপ্পল (ইংরেজি: Kolhapuri chappal) হল ভারতের মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকে প্রচলিত ও পরম্পরাগত হস্তশিল্পজাত একপ্রকার চামড়ার জুতো। স্থানীয়ভাবে উদ্ভিজ্জ বা প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করে এই জুতোর চামড়া পাকা করা হয়। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে কোলহাপুরি চপ্পল পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেড মার্ক নিয়ন্ত্রক জেনারেলের কাছ থেকে ভৌগোলিক নির্দেশক স্বীকৃতি লাভ করেছে।
ইতিহাস প্রাচীন এই শহরটার মূল সুরটি যেন ক্রমশ একটু একটু করে ধরা দিচ্ছে মিমির কাছে।
কোল্হাপুরে  মারাঠা সম্প্রদায়ের প্রাধান্য বেশী। মারাঠা হলো মূলত ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়। স্বয়ং শিবাজী মহারাজ ছিলেন মারাঠা কুলতিলক। ক্ষত্রিয়রা স্বভাবত
যুদ্ধপরায়ণ।কোল্হাপুরে এখনো মারাঠা গৃহে তলোয়ার দেখা যায়। এরা এমনিতে খুব নির্ঝঞ্ঝাট ও নির্বিবাদী। অকারণ কলহে এরা  পটু নয়। কিন্তু ক্রুদ্ধ হলে ওরা তলোয়ার বের করতে দ্বিধা করেনা।
দু'বছর পুণে থাকার সুবাদে মিমি  মারাঠি ভাষাটা একটু একটু বুঝতে পারে। কোল্হাপুরে মারাঠি বলার ধরণটা
একটু ভিন্ন। একটু গ্রাম্য টান থাকলেও আন্তরিকতার ভাবটা সুস্পষ্ট।
আজ সূর্য একটু তাড়াতাড়িই ফিরেছে অফিস থেকে। আজ প্রথম দিন। জয়েনিংয়ের যাবতীয় ফর্মালিটিজ মিটিয়ে অন্যান্য কলিগদের সাথে আলাপ পরিচয় সেরে রওনা
হ য়ে পড়েছে। আজ অফিসেই সবার সাথে লাঞ্চ সেরেছে। আগামীকাল থেকে আশীষ এসে লাঞ্চ বক্স নিয়ে যাবে।
সূর্যর কাছে দারুণ একটা মজার কথা  শুনলো মিমি। সূর্যর প্ল্যান্টটা কাগাল পরগণায়। বাড়ি থেকে সড়কপথে দূরত্ব পঁচিশ কিলোমিটার।  মহারাষ্ট্রের শেষ সীমানা ওইটাই। সূর্য যেহেতু প্ল্যান্ট হেড, প্রোডাকশন ও মেইনটেনান্সের দায়িত্বভার ওর ওপরেই। ওর কেবিনটাও তাই শপ ফ্লোরের ভেতরেই। লাঞ্চের পরে কেবিন সংলগ্ন ওয়াশরুমে যেতেই মোবাইলে টিংটং করে মেসেজ বেজে উঠলো। ' ওয়েলকাম টু কর্নাটক'।বাহ  এতো ভারী মজার ব্যাপার। কেবিন মহারাষ্ট্রে আর ওয়াশরুম কর্নাটকে!এ যেন ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে কাঁটাতারের বর্গচ্ছেদ। যদিও এখানে কাঁটাতার অদৃশ্য তবু এই ভাগাভাগিতে বেশ মজাই লাগলো।
সন্ধ্যার একটু পরেই মিমি সপরিবারে রওনা দিলো মিঃ বোসের বাড়ীর উদ্দেশে।
ক্রমশঃ


ছবিঃ কোলাপুরী চপ্পল
 

সুবীর সরকার

                             


গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়া



২৬.
গঙ্গাধর আর গদাধর নদীর পারে পারে কত কত হাট।বড় হাট মাঝারি হাট জৌলুস হারানো কিংবা জাকজমকের হাট।এই সব হাট ঘিরে ভূমিলগ্ন মানুষের বেঁচে থাকা।মানুষের জীবন ঘিরে এত এত হাটের কুহক।
সে আলমগঞ্জের হাট বলো, প্রতাপগঞ্জের হাট হোক,পাগলাহাট বা কাছারিহাট যাই হোক না কেন;
সব হাট ছাপিয়ে ভেসে উঠতে থাকে গৌরীপুরের হাট।গোলকগঞ্জের হাট।এই আখ্যানের প্রায় সব চরিত্রই একবার হলেও ঢুকে পড়ে গৌরীপুর আর 
গোলকগঞ্জের হাটের কেন্দ্রে।
আমরা দেখে ফেলি গৌরীপুরের হাটে গান গাইতে গাইতে ঘুরে বেড়ানো ভিখিরিদের।তাদের মুখের লালায় জিভের শরীরে লেগে থাকে গৌরীপুরের খিলি পান।গোলকগঞ্জের মজা গুয়া।হাটের প্রান্তে প্রান্তে উড়ে বেড়াতে থাকে তাদের গান_
"নদীত ফোটে 
নদীয়া হোলা"

২৭.
"একবার হরি বল মন রসনা
মানব দেহাটার গৈরব কইরো না"

মালতিগুরির চর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই রহস্য মাখা অঘ্রান সন্ধ্যায় চরের কোন অন্দর থেকে এই গানের সুর হাহাকার জাগিয়ে বা হাহাকার জড়িয়ে ছুটে আসছিল নন্দকান্ত বায়েনের দিকে।কিন্তু তখন
নন্দকান্তর ঘাড়ে তার চিরদিনের সেই ঢোলটি ছিল না।কিন্তু এই গান নন্দকান্তর সমগ্র শরীরের পেশিতে কেমন এক উন্মাদনা এনে দিতে থাকে।তার ইচ্ছে করে ঢোল নিয়ে কুয়াশার ভেতর দিয়ে কোন এক গানের জুলুসে চলে যেতে।তারপর গানে গানে জীবনের মস্ত আখ্যান বয়ন করতে করতে জীবন মায়ায় কেবল কান্না আর কান্না বিছিয়ে দিয়ে একপর্বে মালতিগুরির চর অতিক্রম করে নন্দকান্ত বায়েন নেমে যেতে থাকেন নদী তোর্সার শীতল জলে।
আমরা জল ভাঙবার শব্দ শুনি।আর ভাঙা জলের সোতায় নন্দকান্তর ছায়া দুলতে থাকে।
এভাবেই জীবনের পর জীবন বাঁচে এই সব হাটপরিধী জুড়ে জুড়ে।আখ্যানের পর আখ্যানের পরিসরে তীব্র এক গঞ্জহাটের কোরাস!

(সমাপ্ত)

রবিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২১

পিয়াংকী

                           


গরম বাহার। ঊনিশতম পর্ব।আজ নিম্নচাপ, শীত জমিয়ে পড়ার আগে এটা একটা ট্রেলার বলা যায়, এই মরসুমে টুকটাক আন্দোলন তো হয়েই যেতে পারে, তেল কড়াই ধনেপাতা লংকা ফুলকপি বাঁধাকপি... উঁহু আর কী চাই।


"শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা"...সুপর্ণা এল কম্বলের তলায় পা ঢুকিয়ে বসল। নরম ঠান্ডা দু'গাল বেয়ে তখন বৃষ্টি।  জমিয়ে শীত। কি রান্না করব ভাবতে ভাবতেই... 


আজ যাকে পকোড়া বলে,আমরা সেকেলে বাঙালিরা একেই আবদার করে বড়া বলি। আজ রইল গরমাগরম ফুলকপির বড়া আর বাঁধাকপির বড়া



মীনাক্ষী ঘোষ

           



কোল্হাপুর ডায়েরী ৪

অ‍্যাপার্টমেন্টের নীচেই একটা সাউথ ইন্ডিয়ান রেষ্তোঁরা আছে সেখান থেকে লাঞ্চের অ‍্যারেঞ্জমেন্ট হোলো।
আগামিকাল সূর্যের জয়েনিং ডেট।
বিকেল চারটে বাজে। দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে অবস্থানের কারণে সূর্যাস্ত হয় দেরীতে। লাঞ্চের পরে সবাই যখন নিজের নিজের ঘরে বিশ্রামের আয়োজন করছে মিমি পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ালো লিভিংরুম লাগোয়া বর্গাকৃতি ছোট্ট খোলা ছাদটার রেলিং ঘেঁষে। এখানে সবাই এই ধরণের সংলগ্ন খোলা ছাদকে টেরেস বলে।  ব্যালকনিকে
বলে গ্যালারি।
তিনতলার টেরেস থেকে নীচে ব্যস্ত সড়কের ছবি প্রতীয়মান। মিমি তার দৃষ্টি ভাসিয়ে দিলো সুদূরে। দূরে চক্রাকারে বেষ্টিত পাহাড়ের  অস্পষ্ট রেখা দিগন্তে গিয়ে মিশেছে। আপাতশান্ত কোলাহলবিহীন এই শহরটির প্রতি এক অজানা ভালবাসা বুকের ভেতর জারিয়ে যাচ্ছিলো আস্তে আস্তে।
সম্বিৎ ফিরলো কলিংবেলের আওয়াজে। এইসময় আবার কে এলো? দরজা খুলতেই সামনে দাঁড়িয়ে সৌম্যদর্শন মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক ও পাশে স্মিতহাস্যে মধ্যবয়সিনী  ভদ্রমহিলা। চকিতে মিমির মনে পড়লো সূর্য বলেছিলো বটে ওর নতূন অফিসের বস কোম্পানির এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর মিঃ বোস আসতে পারেন।  ওর মাথা থেকে কথাটা একেবারেই বেরিয়ে গেছিলো।ইশশ ছি ছি। ওর অপ্রস্তূত মখ দেখে ভদ্রলোক হাতযোড় করে নিজের পরিচয় দিলেন। কোনরকমে অপ্রস্তুত ভাব সরিয়ে মিমি ওঁদের ভেতরে আসতে অনুরোধ জানালো। এই কোম্পানিতে সূর্য ছাড়া উনি আর একমাত্র বাঙালি।
অল্পক্ষণের মধ্যেই অপরিচয়ের দূরত্ব কমে অন্তঙ্গতার সুরটি ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠলো। মিসেস বোস ক্রমশ হয়ে উঠলেন মিমির কাছে 'বৌদি'। স্নেহশীলা এই মানুষটি মিমিকে প্রথম থেকেই  নিজের ছোট বোনের মতো করে কাছে টেনে নিয়েছিলেন। মিমিও তাকে নিজের বড়দিদি  ভেবেই ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হয়েছিলো ধীরে ধীরে।
নানান আলাপচারিতায় মিমি জানতে পারলো কোল্হাপুরের মহালক্ষ্মীদেবীর মন্দিরের কথা।মিমির উৎসূক মন জানতে পারলো আরো অজানা কিছু তথ্য।করবীর তালুকার অন্তর্ভুক্ত কোল্হাপুরকে করবীর তীর্থ ও বলা হয়।
বৌদি প্রস্তাব দিলেন পরদিন সকালে সূর্য অফিসে বেরিয়ে এগেলে উনি মিমিকে নিয়ে মহালক্ষ্মী মন্দির দর্শন করাতে যাবেন। নতুন জায়গায় মাতা অম্বাবাঈয়ের কাছে পুজো দিয়ে শুভারম্ভ করা ভালো।
পরদিন সকালে সূর্য অফিসে বেরিয়ে গেলে মিমি স্নান করে
রেডি হয়ে রইলো। ছেলেমেয়ের ব্রেকফাষ্ট  টেবিলে ঢাকা দিয়ে বৌদি আসা মাত্র  বেরিয়ে পড়লো দেবী সন্দর্শনে।। বাড়ি থেকে খুব বেশী দূর নয় মন্দির। বৌদির সাথে গাড়ী ছিল। মিনিট দশেকের মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেল মন্দিরের কাছে। মন্দিরের প্রবেশপথ মোট চারটি। পশ্চিমদিকের প্রবেশদ্বার দিয়ে মিমি আর বৌদি প্রবেশ করলো মন্দিরে।
মিমি অবাক বিস্ময়ে দেখছিলো মন্দিরের কারুকাজ।
পঞ্চগঙ্গা নদীটি কোল্হাপুরকে বেষ্টন করে প্রবাহিত হয়ে চলেছে।আর এর তীরেই রয়েছে বিখ্যাত দেবী মহালক্ষ্মীর মন্দির।প্রায় ছয়হাজার বছরের পুরনো এই মন্দিরটি কালো গ্রানাইট পাথরে গুহার আদলে নির্মিত। অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী ও ভাস্কর্যের মেলবন্ধনে এই মন্দিরটির শৈল্পিক গুরুত্ব ও অপরিসীম।
মূল মন্দিরটির শীর্ষদেশে পাঁচটি চূড়া। চূড়াগুলিতে যথাক্রমে পাঁচটি বড় ও ছোট সোনার কলস স্থাপিত।। এত সকালেও দূরদূরান্ত থেকে ভক্ত সমাগম যথেষ্ট।
,  হরি পুরাণের  কাহিনী অনুসারে তপস্বী ভৃগু বৈকুন্ঠে পদার্পণ করে কলহবশত বিষ্ণুর বুকে পদাঘাত করলে বিষ্ণুপত্নী কুপিতা হন। বিষ্ণুবক্ষেই যে দেবী লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান!স্বামীর অপমানে ক্রোধান্বিতা দেবী এত অপমানের পরেও শ্রী বিষ্ণুকে প্রসন্ন ও সহাস্য বদনে মহর্ষি ভৃগুর প্রতি ক্ষমার্হ নয়নে দৃষ্টিপাত করতে দেখে  বিষ্ণুধাম পরিত্যাগ করে মর্ত্যে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।মর্ত্যে দেবী যে স্থানটিকে নির্বাচন করেন সেটি হোলো এই কোল্হাপুর। স্বয়ং বিষ্ণু ও দেবীর সাথে বৈকুণ্ঠ  পরিত্যাগ করে শ্রীক্ষেত্রে বসবাসের সূচনা করেন।দেবীর অগণিত ভক্তের আকুল আবেদনে মাতা চিরকালের মতো এখানেই আপন অধিষ্ঠান স্থাপনা করেন।তদবধি তিনি সমস্ত রকম দৈব রোষ থেকে এই স্থানের রক্ষাকর্ত্রী হিসাবে পূজিতা। এমনকি প্রলয়কালে যখন সমগ্র ধরিত্রী জলরাশিতে নিমজ্জিত তখনো শ্রী বিষ্ণু ও মাতা লক্ষ্মী ভক্তদের পরিত্যাগ করে বৈকুণ্ঠ গমনের ইচ্ছা পরিহার করেন। কোল্হাপুরে তাই বিষ্ণু এবং লক্ষ্মীর চিরকালীন অধিষ্ঠান। লোকশ্রুতি, কোল্হাপুরে কেউ কখনো অন্নাভাবে অভুক্ত থাকেনা।
অন্য মতানুসারে দেবাদিদেব মহাদেবের বরে অপ্রতিরোধ্য কোলাসুরকে দেবী যুদ্ধে পরাস্ত করে হত্যা করতে উদ্যত হলে অসুর মিনতি করেন তার মৃত্যুর পর এই স্থানটিকে যেন তাঁর নাম অনুসারে নামাঙ্কিত করা হয়।
তার নামানুসারে স্থানটির নাম হয় কোল্হাপুর।
দেবীকে মাতা ভবানী  উমা বা পার্বতী পক্ষান্তরে অম্বা মাতা রূপে পূজা করা হয়।
এই মন্দিরটি সপ্তম শতাব্দীতে চালুক্যবংশীয় রাজা কর্ণদেব নির্মাণ করান। সামনে দক্ষিণভারতীয় স্থাপত্যশৈলীর আদলে  একটি বৃহৎ দীপাধার। গুহার আদলে তৈরী মন্দিরটির প্রবেশাভিমুখে বাঁদিকে দেবীর চরণ চিহ্ণ যা শ্রীযন্ত্র নামে খ্যাত সেখানে প্রণাম করে মূল মূর্তির অভিমুখে যাত্রা। প্রবেশপথটি অত্যন্ত অপরিসর। সিংহদরজা পেরিয়ে মাতৃসন্দর্শনের স্থানটি অপেক্ষাকৃত পরিসরযুক্ত।
কালো পাথরে তৈরী মাতৃমূর্তিটি নাতিবৃহৎ। দৈর্ঘ্যে তিনফুট। নানানরকম দুর্মূল্য রত্নালঙ্কার ভূষিতা মূর্তির ওজন চল্লিশ কিলোগ্রাম।মূর্তির পিছনে  কালো পাথরে রচিত সিংহমূর্তি দেবীর বাহন। মূর্তির মস্তকোপরিভাগে শেষনাগ ছত্ররূপে বিরাজমান।
মাতৃমূর্তি চতুর্ভূজা।  দেবীর নিম্ন দক্ষিণহস্তে একটি ফল- মতুলিঙ্গ।দক্ষিণ উপরিভাগে একটি বৃহদাকার গর্ধভের মস্তক ভূমি নিবদ্ধ দৃষ্টি।বাম উপরিহস্তে একটি বর্ম ধৃত এটিকে খেতক বলা হ য়। ও বাম নিম্নহস্তে একটি পানপাত্র। দেবীমূর্তি পশ্চিমমুখী। বৎসরের তিনদিন পশ্চিম দেয়ালের একটি ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠ থেকে অস্তগামী সূর্যের  বিদায়রশ্মি দেবীর মুখে  আলো প্রদান করে দেবীকে প্রনিপাত জানায়।
মুগ্ধ হয়ে মিমি মন্দিরের অনুপম ভাস্কর্য দেখছিলো। এই পাথরের গায়ে গায়ে কত অজানা কাহিনী লিপিবদ্ধ হয়ে আছে তার কথা আর কে বলবে! নির্বাক অথচ বাঙ্ময় যেন প্রতিটি গাত্র শৈলী।
শুধু দেবীমূর্তি নয় এই অদেখা ভাস্করদের  অনুপম কারুনৈপুণ্যের প্রতি প্রণাম জানিয়ে মিমি মন্দির থেকে বেরিয়ে এল।
ক্রমশঃ

 

সুবীর সরকার

                 


গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়া



২৬.
গঙ্গাধর আর গদাধর নদীর পারে পারে কত কত হাট।বড় হাট মাঝারি হাট জৌলুস হারানো কিংবা জাকজমকের হাট।এই সব হাট ঘিরে ভূমিলগ্ন মানুষের বেঁচে থাকা।মানুষের জীবন ঘিরে এত এত হাটের কুহক।
সে আলমগঞ্জের হাট বলো, প্রতাপগঞ্জের হাট হোক,পাগলাহাট বা কাছারিহাট যাই হোক না কেন;
সব হাট ছাপিয়ে ভেসে উঠতে থাকে গৌরীপুরের হাট।গোলকগঞ্জের হাট।এই আখ্যানের প্রায় সব চরিত্রই একবার হলেও ঢুকে পড়ে গৌরীপুর আর 
গোলকগঞ্জের হাটের কেন্দ্রে।
আমরা দেখে ফেলি গৌরীপুরের হাটে গান গাইতে গাইতে ঘুরে বেড়ানো ভিখিরিদের।তাদের মুখের লালায় জিভের শরীরে লেগে থাকে গৌরীপুরের খিলি পান।গোলকগঞ্জের মজা গুয়া।হাটের প্রান্তে প্রান্তে উড়ে বেড়াতে থাকে তাদের গান_
"নদীত ফোটে 
নদীয়া হোলা"

২৭.
"একবার হরি বল মন রসনা
মানব দেহাটার গৈরব কইরো না"

মালতিগুরির চর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই রহস্য মাখা অঘ্রান সন্ধ্যায় চরের কোন অন্দর থেকে এই গানের সুর হাহাকার জাগিয়ে বা হাহাকার জড়িয়ে ছুটে আসছিল নন্দকান্ত বায়েনের দিকে।কিন্তু তখন
নন্দকান্তর ঘাড়ে তার চিরদিনের সেই ঢোলটি ছিল না।কিন্তু এই গান নন্দকান্তর সমগ্র শরীরের পেশিতে কেমন এক উন্মাদনা এনে দিতে থাকে।তার ইচ্ছে করে ঢোল নিয়ে কুয়াশার ভেতর দিয়ে কোন এক গানের জুলুসে চলে যেতে।তারপর গানে গানে জীবনের মস্ত আখ্যান বয়ন করতে করতে জীবন মায়ায় কেবল কান্না আর কান্না বিছিয়ে দিয়ে একপর্বে মালতিগুরির চর অতিক্রম করে নন্দকান্ত বায়েন নেমে যেতে থাকেন নদী তোর্সার শীতল জলে।
আমরা জল ভাঙবার শব্দ শুনি।আর ভাঙা জলের সোতায় নন্দকান্তর ছায়া দুলতে থাকে।
এভাবেই জীবনের পর জীবন বাঁচে এই সব হাটপরিধী জুড়ে জুড়ে।আখ্যানের পর আখ্যানের পরিসরে তীব্র এক গঞ্জহাটের কোরাস!
   



রবিবার, ৫ ডিসেম্বর, ২০২১

সুবীর সরকার

                


গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়া



২৪.

এই পৃথিবীর সঙ্গে সব সম্পর্ক শেষ হতে চলেছে ভবতারণ বাবুর।পেছনে পড়ে থাকবে একটা চার কুড়ি পঁচাশি দিনের মস্ত জীবন।তার বন্ধ চোখের ভেতর এখন হেমন্তের মাঠের ছায়া।অগ্রহায়ণের খড় বিচালির ঘ্রাণ। বেঁচে থাকতে থাকতে একটা আস্ত জীবন কিভাবে ফুরিয়ে যায়!সরকারবাবুর জোত জুড়ে সেই কবেকার একুশ মহিষের ভইসা গাড়ি।
গাড়ির নিচে কালি পড়া লন্ঠন দোলে। পরনকথার গল্প ভেসে যায় আঞ্চলিক নদীতে।
জমে ওঠে হেমন্তের গানবাড়ি_
"দোলার জল থই থই
আছে মাগুর সিঙ্গী কই"
এই নদী টদি বাথান টাথান খেত খামার মানুষজন বাড়ি টাড়ি ঘিরে জমে ওঠা মানুষের জীবনযাপন থেকে দীর্ঘ হাই তোলে মানুষের জীবন।
যে জীবন ঘিরে থাকে মরণ।
মৃত্যুর স্বাদ তো নিতেই হয় মানুষ কে।
ভবতারণ বাবু তার মস্ত এক জীবন থেকে চলে যাচ্ছেন।তিনি তার শ্বাসপ্রশ্বাসের ক্রম জটিলতার ফাঁকে ফাঁকে মাঠে মাঠে ছড়িয়ে থাকা গান শুনতে শুনতে নুতন এক লোকপৃথিবীর দিকে পা বাড়াচ্ছেন।
মরণের ভেতরের বিষাদ থেকে তখন ভেসে আসে গান_
"পানিয়া মরা যাবার না দেয়
কেমন করিয়া যাং"
ভবতারণ বাবু চলে যাচ্ছেন।
সঙ্গ থেকে সঙ্গহীনতার দিকে।
আলো আর অন্ধকারের কুহক থেকে নিঃসঙ্গতার উপর ঝুঁকে পড়ে ভবতারণ বাবুর আস্ত আয়ুষ্কাল।
এই যাওয়া রাজকীয়।
এই প্রস্থান মহামহিম হয়ে জেগে থাকে।নুতন নুতন গল্প দিয়ে ভরিয়ে তোলা লম্বা আখ্যানের মতন।
এই চলে যাওয়া চিরকালীন শুন্যতার জন্ম দিতে থাকে।আর সেই জন্ম মরণের ভিতর শিস দেয় হেমন্তের পাখিরা।
২৫.
ছত্রশালের সিথানে কালডোবার হাটে অঘ্রাণ সন্ধ্যায়
ভরা সভায় গান গাইতে শুরু করেন আলাউদ্দিন গিদাল। মানে সেই আখ্যান থেকে ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে উঠে আসা আলাউদ্দিন এম এল এ।সঙ্গে দোতরায় সঙ্গত করছে আব্দুল জব্বার।আলাউদ্দিন গান ধরেন আর মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে দোতরায় ঝড় তোলেন জব্বার।জমায়েতে মানুষ ঢুকে পড়ে।জমায়েত থেকে বেরিয়ে যায় মানুষ।এই যাতায়াতের
মাঝখানে,মানুষের প্রবেশ প্রস্থানের ভেতর খুব নিবিড়তা নিয়ে কেবল জেগে থাকে গান।মাটির গান।মাটিতে বসবাস করা মানুষের জীবনযাপনের গান।আমরা শুনি গান উড়ে বেড়াচ্ছে,ঘুরে বেড়াচ্ছে_
"বাইরা খোলান তোর ঝিকি রে মিকি
ঘরে জ্বলে ঘিয়ের পঞ্চবাতি
সোনার চান রে"
গানের পর গান চলে।গানের ফাঁকে কত গল্প করেন আলাউদ্দিন সাব।কত কত কিসসা শোনান।
রাজার হাতি পার করানোর সেই রাজড়াঙার ঘাটের কথা বলেন।একাব্বর ঘাটোয়াল আর তার "শিমুল খুটার" সেই মস্ত বাহারি নৌকোর গল্প বলেন।
এভাবেই মানুষের ঘন হয়ে আসাটা বেশ টের পাওয়া যায়।জমায়েতে উড়ে বেড়াতে থাকে বিড়ির আগুন,হুকা টানবার শব্দ, কোলার ছাওয়ার ডুকুরি
ডুকুরি কান্দন।রাত বাড়তে থাকে।গ্রামদেশে শেয়ালের ডাক ভেসে আসে।গঙ্গাধরের বাতাসে শীত প্রগাঢ় হয়।আলাউদ্দিন এম এল এ আর গীদাল জব্বার খুব খুব ডুবে যেতে থাকেন গানেরই ভেতর_
"হস্তীর সনে মাহুতের পিরিতি
হস্তী ছাড়া মাহুত চলে কেমনে"

মীনাক্ষী ঘোষ

                     



কোল্হাপুর ডায়েরী ৩

সূর্য ওর কোম্পানির এইচ আর ডিপার্টমেন্টকে জানিয়ে রেখেছিল ওদের পৌঁছবার কথা।  সেই রাতটার মতো কোম্পানির তরফ থেকে কোল্হাপুরের একটি নামী
হোটেলে দুটো রুম অ‍্যলটেড ছিলো যাতে এতটা জার্নি
করে এসে রাতটুকু  নিশ্চিন্ত আয়াসে বিশ্রাম নিতে পারে।
হোটেলের লবিতে এইচ আর ডিপার্টমেন্টের একজন প্রতিনিধি  উপস্থিত ছিলেন। সব ব্যবস্থাপনা মিটিয়ে রুমে আসতে আসতে সন্ধ্যার তিমির তখন ক্রমশ নিবিড় হয়ে আসছে।
রুমে ঢুকে খানিকটা ফ্রেশ হতে না হতেই কফি আর স্ন্যাকস নিয়ে রুম সার্ভিস হাজির। এতটা জার্নিতে খিদেও পেয়েছিল একটু।  ছেলে এবং মেয়ে ওদের চেঞ্জ নিয়ে পাশের রুমে চলে গেল। আর সূর্য চেঞ্জ করে সুখশয্যায় গা এলিয়ে দিতেই নিদ্রাদেবীর করতলগত।
নতুন জায়গায় আসার আবেগে আর উত্তেজনায় মিমির ভেতরে তখন সহস্র অশ্বক্ষুরের শব্দ।
সূর্য অকাতরে ঘুমোচ্ছে। দরজাটা আলতো করে টেনে মিমি এলো পাশের ঘরে। পুত্র এবং কন্যা দুজনেই চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসেছে দাবাখেলার সরঞ্জাম নিয়ে। ওদের ব্যাকপ্যাকের সর্বক্ষণের সঙ্গী এই চেসবোর্ড। পাসটাইম হবিও বটে! খুব যখন ছোট সূর্য ই শিখিয়েছিল। এখন ফাঁক পেলেই দুই ভাইবোন খেলতে বসে পড়ে এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়।
মিমি পায়ে পায়ে এগোলো ওদের ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিটার দিকে। কি নিরিবিলি শান্ত নির্জন পরিবেশ!।গার্ডেন ফেসিং ব্যালকনিটায় দাঁড়িয়ে মিমি নতুন শহরের গন্ধটাকে বুকের ভেতর ভরে নেবার চেষ্টা করছিলো।
খানিকক্ষণ পরে রুমে ডিনার ও সার্ভ করে গেল। সূর্য ততক্ষণে একটা ন্যাপ নিয়ে এই ঘরে এসে বসেছে। ওদের খেলার মাঝখানে ছোটখাটো ফুটনোট ও দিয়ে চলেছে। প্রায় সবটাই মেয়ের পক্ষে আর তাই ছেলে আরো সিরিয়াস ভঙ্গীতে  পরের মুভটা নিয়ে  যৎপরোনাস্তি দার্শনিক হয়ে পড়ছে। ছেলের অবস্থা দেখে মিমির হাসি পেয়ে গেল।
ছেলেকে বললো-' তোর বাবার খালি  পার্শিয়ালিটি।  এবার
রাখ দেখি। চল্ নতুন জায়গার খাবারগুলো টেষ্ট করে দেখি। সূর্য হার্ডকোর ননভেজ। মেনুতালিকায় কোল্হাপুরী
শুখা মটন  জিরা রাইস আর ভাকরি। জিরা রাইসের সাথে রসনা পরিচিতি থাকলেও বাকি দুটো নিতান্ত ই এযাবৎ
অনাস্বাদিত।
কোল্হাপুরের লোকেরা সাধারণত একটু মশলাদার খাবার পছন্দ করে। কোল্হাপুরী মাটন তার অন্যতম। এটা বানাবার বিশেষ একটা পদ্ধতি আছে। স্বাদেগন্ধে অতুলনীয় এই পদটির রন্ধনপ্রণালী পরে মিমি আয়ত্ত্ব করেছে।কোল্হাপুরী মাটনের সাথে আরো দুটো পদ পরিবেশিত হয়।
এই দুটি যথাক্রমে তাম্বড়া রসা আর পান্ডরা রসা।
রসা অর্থ হলো রস। কোল্হাপুরী রান্নায় শুকনো নারকেলের প্রচলন খুব বেশী। প্রায় সব রান্নাতেই শুকনো নারকেলের গুঁড়ো ব্যবহার করা হয়।
তাম্বড়া রসাটি তাম্রবর্ণের বা রক্তাভ। লাল লঙ্কা এর প্রধান উপকরণ। পান্ডড়া শব্দটির মারাঠি অর্থ হোলো সাদা।  এর বর্ণটিও তাই সাদা। এই রসটি বানাবার মূল উপকরণ হোলো প্রধানত তিল পোষ্তদানা আর শুকনো নারকেল গুঁড়ো। এগুলি একত্রে পিষে  তরল চাটনির মতো তৈরী করা হয়। অ‍্যাপেটাইজার বা খিদেবর্ধক হিসেবে এটি ভালো কাজ করে।  আর তাম্বড়া রসা হোলো মাংসের গ্রেভি বা জলীয় অংশ। শুকনো মাংসের সাথে এটি পরিবেশন করা হয়। এছাড়াও  এখানে বাটারমিল্ক বা ছাঁস পরিবেশন করা হয় হজমকারক হিসাবে। এটি মিমির খুব পছন্দের পানীয় একটি।দই দিয়ে ঘোলের মতন বানিয়ে তার মধ্যে পুদিনা পাতাও ভাজা জিরেগুঁড়ো দিয়ে কিছুক্ষণ রেখে পরিবেশন করা হ য়। অত্যন্ত কম ক্যালরিযুক্ত ও পুষ্টিবর্ধক পানীয় হিসাবে এটি খুব জনপ্রিয় ও বটে। ভাকরি হলো যবের রুটি। এটিও অত্যন্ত কম ক্যালরিযুক্ত।।  এই হোটেলের প্রতিটি খাবারের স্বাদ নিতে নিতে কোল্হাপুরী রন্ধনপ্রণালীর  এক অনন্যতা অনুভব করছিলো মিমি যা পরবর্তীতে তাকে কোল্হাপুরী মশলার স্বকীয়তা সম্পর্কে উৎসাহী ও কৌতূহলী করে তোলে।
সবশেষে ছিলো এক বিশেষ ধরণের লঙ্কার আচার যাকে ওরা থেচা বলে। মিমি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেও সূর্য বা ছেলেমেয়েরা কেউই আর মখে তুলতে পারলোনা। ওরা কেউই তেমন ঝাল খেতে অভ্যস্ত নয়।
ডিনারের পাট চুকিয়ে ছেলেমেয়েকে গুডনাইট জানিয়ে
নিজেদের ঘরে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই দুচোখের পাতা জুড়ে নেমে এলো নিবিড় ঘুম।রাস্তার ধকল নতুন জায়গায় আসবার উত্তেজনা সর্বোপরি ভোজনের পারিপাট্য মিমিকে আর জেগে থাকার অবকাশ দিলোনা। রাতবালিশের নিবিড় কোমল স্নেহস্পর্শে তলিয়ে যেতে লাগলো নিশ্চিন্দিপুরীর স্বপ্নরাজ্যে।
সকালে ঘুম ভাঙলো সূর্যের ডাকে। সামনের দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল ন টা বাজে।পাশের বেডসাইড টেবিলে মর্নিং টি আর বিস্কিট রাখা। ওকে চোখ মেলতে দেখেই সূর্য বললো-
'মিমি আমাদের  প্যাকার্স অ‍্যান্ড মুভার্সের গাড়ি এসে গেছে। কোম্পানির লোক ফ্ল্যাটে পৌঁছে গেছে আসবাবপত্র ঠিকঠাক অ‍্যারেঞ্জ করার জন্য।তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাষ্ট করে নাও। আমরা ফ্ল্যাটে যাবো।
সূর্য ই পাশের রুম থেকে ছেলেমেয়েকে ডেকে তুললো।ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে রেডি হয়ে আবার নতুন ঠিকানায়।
হোটেলের বেশ কাছেই নির্ধারিত ফ্ল্যাটটি। একেবারে তিনরাস্তার মোড়ে। একেবারে উল্টোদিকে বিবেকানন্দ কলেজ। কলেজ ক্যাম্পাসে স্বামী বিবেকানন্দের একটি আবক্ষ মূর্তি প্রতিষ্ঠিত।
ফ্ল্যাটে ঢুকে মিমির মনটা  আনন্দে ভরে গেল। তিনটে বেডরুম ড্রইং ডাইনিং কিচেন মিলিয়ে অনেকটাই স্পেশাস। সবচেয়ে বড় কথা বেডরুমগুলো সবকটাই রাস্তার অভিমুখী। মিমিরা পৌঁছতে পৌঁছতে কোম্পানির  লোকজন  ততক্ষণে ফার্নিচার মোটামুটি সেট করে ফেলেছে।কিচেনে ঢুকে দেখলো  অল্পবয়েসী একটি ছেলে বাসনপত্র সব বের করে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখছে। নাম জানালো আশীষ। কোম্পানির পিওন।  সূর্যর অফিসে লাঞ্চ পৌঁছোবার দায়িত্ব  ওর তার সাথে ফাঁকে ফাঁকে ঘর গেরস্থালির কাজে সাহায্য করার জন্য ওকে নিয়োগ করা হয়েছে। মিমির অবশ্য এই ব্যাপারটা একেবারেই না পসন্দ। অফিসের বেয়ারাকে দিয়ে ঘরের কাজ করাবার একেবারেই পক্ষপাতী নয় সে। কথায় কথায় জানলো ছেলেটি কোল্হাপুরের শিবাজী ইউনিভার্সিটি থেকে মারাঠি ভাষায় এম এ পাশ করেছে!ছেলেটি ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত।
নম্র ভদ্র বিনয়ী ছেলেটি সহজেই সকলের মন জয় করে নিল।
ক্রমশঃ