রবিবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২১

পিয়াংকী

                              



লোটেঝুরঝুর 



গরম বাহার। আঠেরতম পর্ব।অনেকদিন পর আজ ফিরে এলাম।নিয়ে এসেছি বাঙালির একটি মাছের প্রিপারেশন। অনেকেই এই মাছটা খেতে পছন্দ করেন না আবার আমার মত কেউ কেউ আছেন যারা বিরিয়ানির থেকে বেশি ভালবাসেন এই মাছ।হ্যাঁ আমি বলছি লোটে মাছের কথা।কৌলিন্যে এ মাছ জায়গা করে নিতে পারেনি কোন আনুষ্ঠানিক ভোজের মেনুতে।কিন্তু তা বলে এর গুণাবলি কম নয় কিন্তু।ইংরেজিতে নাম blue bay sea fish কেউ বলেন Bombay duck.প্রচুর পরিমাণে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ এই মাছ হিমোগ্লোবিন বাড়াতে সাহায্য করে। প্রোটিন তৈরিতে সাহায্য করে। এছাড়াও ক্যালসিয়াম এবং আয়রন থাকার জন্য পেশির সমস্যা কমাতে হেল্প করে


আজ আমি এই মাছ যেভাবে রান্না করব তাতে মাত্র এক চামচ তেল ব্যবহার হবে।কারণ মাছের গুণাগুণ তখনই বজায় থাকবে যদি রান্না খুব কম তেলে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে বানানো যায়


প্রথমেই মাছগুলো ধুয়ে একটা স্টেনারে রেখে জল ঝরিয়ে নিতে হবে।এই স্টেপটা জরুরি। জল ঝরানো মাছের মধ্যে একে একে মিহি করে কুচোনো পেঁয়াজ, রসুনবাটা, কাঁচালঙ্কাবাটা, টমেটোকুচি, নুন সামান্য এক চামচ তেল, ভাজা জিরের গুঁড়ো, পাতিলেবুর রস, কয়েকদানা চিনি আর অল্প একটু গরমমশলার গুঁড়ো দিয়ে, বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে মেখে নিতে হবে।এভাবে ম্যারিনেট করে অন্তত দু'ঘন্টা রেখে দিতে হবে চাপা দিয়ে।এরপর গ্যাসে একটা ননস্টিক প্যান গরম করে তাতে কয়েক ফোঁটা তেল ব্রাশ করে নিয়ে ম্যারিনেট করা লোটেমাছ দিয়ে  মিনিট পাঁচেক বেশি আঁচে রান্না করার পর গ্যাসের তাপ কমিয়ে চাপাঢাকা দিয়ে রাখতে হবে অন্তত আধ ঘন্টা। এর ফাঁকে ফাঁকে দু'বার ঢাকা খুলে নেড়েচেড়ে আবার ঢাকা।কিছুক্ষণ পর থেকেই দেখা যাবে প্রচুর জল বেরিয়েছে মাছ থেকে।সেই জল টানতে টানতে শুকিয়ে আসবে আর প্যানের গা ছেড়ে বেরোতে শুরু হবে।একসময় নাড়তে নাড়তে কচুবাটার মত পাক হয়ে এলে বুঝতে হবে রান্না রেডি  

তেল মশলা দিয়ে খুব রিচ করেই সাধারণত আমরা এই মাছ রান্না করে থাকি কিন্তু তাতে পুষ্টিগুণ কিছুই থাকে না।ঠিক এই তেলছাড়া এভাবে করে নিলে সুস্বাদুও হবে সাথে স্বাস্থ্যসেবাও৷


    


মিনাক্ষী ঘোষ

               


দেখতে দেখতে হৈ হৈ করে কেটে গেল একটা সপ্তাহ। এরমধ্যে এল পিজি ট্রান্সফার ও ব্যাঙ্কের আনুষঙ্গিক প্রয়োজনীয় কাজকর্ম মেটাতেই অনেকটা সময় কেটে গেল। ছেলের টুয়েলভ ফাইনাল হয়ে গেছে।মেয়ের স্কুল থেকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট ও নেওয়া হোলো। কোল্হাপুরে খুব নামকরা একটা কনভেন্ট রয়েছে মেয়েকে সেখানে গিয়ে অ‍্যাডমিশন করাতে হবে।  তার একটা চিন্তাও মাথায় আছে বৈকি! মিমি জানে একটা উপায় ঠিক হবেই।যত সমস্যাই আসুকনা কেন মিমির স্থির বিশ্বাস তার থেকে সে বের হয়ে আসতে পারবেই। এ বিশ্বাসটুকুকে ভর করেই অনেক দুরূহ বাধা সে অতিক্রম করেছে এখনো পর্যন্ত।
প্যাকার্স অ‍্যান্ড মুভার্সের দায়িত্বে মালপত্র  ন্যস্ত করে রবিবার মিমিরা রওনা হোলো নতুন শহরের উদ্দেশে।
সূর্য ই ড্রাইভ করছিলো। মিমি পাশে বসে  সমস্ত যাত্রাপথের ছবিটা কেবল বুকের ভেতর এঁকে রাখার চেষ্টা করে গেছে।
পুণে থেকে কোল্হাপুরের দূরত্ব প্রায় দুশো পঁচিশ কিলোমিটার। সহ্যাদ্রি পর্বতমালার ধার ঘেঁষে এই  উপত্যকা শহরটি হোলো কোল্হাপুর।  মারাঠি ভাষায় 'কোল্হা'' শব্দের অর্থ হোলো উপত্যকা। কোল্হাপুরের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হোলো উপত্যকার শহর বা 'সিটি অব ভ্যালিজ'।
 মূলত ব্যাঙ্গালোর পুণে ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরেই পুরোটা পথ চলা। এই দু' বছরে মিমি পুণের বাইরে কোথাও যায়নি। পুণে থেকে সাতারা পর্যন্তযেতে পথে দুটি ঘাট সেকশন পেরোলো ওরা। পাহাড়ী রাস্তা। খুব শার্প  চড়াই উৎরাই যদিও নয় তবুও চুলের কাঁটার মতো পাকদন্ডী পথ পেরোবার  সময় বুকের ভেতর শিরশির করে উঠছিল। এরপর কতবার এ পথে মিমি যাতায়াত করেছে তবু প্রতিবার ই বুকের ভেতরটা পাহাড় পেরোতে ধুকপুক করতে থাকে। নীচে অতলস্পর্শী খাদ। যদিও রাস্তা বেশ চওড়া তবু মূহুর্তের অসতর্কতায় খাদের গভীরে তলিয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। সূর্য ড্রাইভিংটা যথেষ্ট ভাল করে। পাহাড়ি রাস্তাতেও নিয়মকানুন মেনেই ফার্ষ্ট গীয়ারে আস্তে আস্তে পাহাড়ে উঠছিলো। একপাশে ঘন সবুজ গাছগাছালিতে ঘেরা পাহাড় অন্যদিকে খাদ। বেশ অনেকটা রাস্তাই সাতারা ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্টের আওতায় পড়ে।  যদিও প্রচুর গাড়ি চলাচল করছিলো পাহাড়ি পথ বেয়ে মিমির মন কিন্তু ওই নিবিড় অরণ্যানীর মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিলো একটু একটু করে। এই পাহাড়ী পথেই শিবাজীর মারাঠা সৈন্যদল মোঘলশত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে গেছে। 
তবু বশ্যতা স্বীকার করেনি।  এসব ভাবতে ভাবতে মিমি কখন ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে গেছিলো চমক ভাঙলো
সূর্যর ডাকে। সূর্যর গাড়ি ততক্ষণে সমতলের মাটি ছুঁয়েছে।
- 'মিমি সামনে একটা চায়ের দোকান আছে চলো একটু
দাঁড়িয়ে চা খাই।'
টানা দু ঘন্টা ড্রাইভ করে সূর্য একটু ক্লান্ত। আরো ঘন্টা
তিনেক ড্রাইভ করতে হবে। চা খেয়ে একটু ফ্রেশ হ য়ে নেওয়া এই আর কি! কাছের দোকানটায় একজন ভদ্রমহিলা চা  বিক্রি করছিলেন।
- 'কাকু দৌ কাপ চায়ে'
মারাঠীতে  কাকিমাকে কাকু বলা হ য়। সম্বোধনটির মধ্যে অপরিচয়ের আধিক্যের চাইতে অন্তরঙ্গতার আবেদনটুকু
অনেক বেশী। মিমি মারাঠি ভাল বলতে না পারলেও বুঝতে পারে একটু একটু। কাকুর কাছে শুনে বুঝলো বাকি রাস্তাটা মোটামুটি সমতল  আর ঘন্টা দেড়েক পথ পেরোলে কারাড শহর। এটিও বেশ বর্ধিষ্ণু একটি শহর।
কারাড থেকে কোল্হাপুর আরো ঘন্টা খানেকের পথ।
 কাকুর কাছে গরম গরম বড়া পাও পাওয়া গেল। পাঁউরটির ফাঁকে আলুর বড়া। এটা এখানকার খুব জনপ্রিয় খাদ্য। ছেলেমেয়ের ও খুব প্রিয়।
এরপর টানা ড্রাইভ। দেখতে দেখতে কারাড পেরিয়ে গেল। এরপর এলো ইচলকরঞ্জি। এখানে বেশ কয়েকটি টেক্সটাইল ইন্ডাষ্ট্রি নিয়ে টেক্সটাইল হাব তৈরী করা হয়েছে।
ছোট্ট ছোট্ট টিলার ওপর বাড়িগুলো ছবির মতো সুন্দর।
পথে কয়েকটি টোল পড়লো। মহারাষ্ট্র গভর্ণমেন্ট রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পে খানিকদূর পরপর এই টোল ট্যাক্স ধার্য করেছেন। রাস্তা যেমন চওড়া তেমন মসৃণ। প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রকল্পিত সোনালি চতুর্ভূজ সড়ক যোজনা বা গোল্ডেন কোয়াড্রিল্যাটারাল 
ন্যাশনাল হাইওয়ের অন্তর্গত এই মহাসড়কটি।
কোল্হাপুর পৌঁছতে পৌঁছতে সূর্যদেব  ততক্ষণে পশ্চিম দিগন্তের পথযাত্রী।
কোল্হাপুর প্রবেশের আগে মিমি দেখলো অদূরে বিরাট আকৃতির গণেশ মূর্তি। পরে জেনেছে এটি চিন্ময় গনেশ নামে খ্যাত।বিঘ্নহর্তা সমস্ত রকম আসন্ন বিপদের  হাত থেকে শহরটিকে রক্ষা করবার জন্য প্রবেশপথের নিকটে দন্ডায়মান।
ব্যাঙ্গালোর পুণে হাইওয়ে সোজা চলে গেছে ব্যাঙ্গালোরের দিকে। আরেকটা রাস্তা বাঁদিক ঘেঁষে নেমে গিয়েছে কোল্হাপুরের দিকে। সেই পথ ধরে মিমিদের গাড়ি এবার প্রবেশ করলো কোল্হাপুরের তোরণদ্বারে। সুন্দর একটি ফটকের ভেতর দিয়ে কোল্হাপুর শহরের  প্রবেশপথ।উল্টোদিকের রাস্তাটা চলে গেছে গান্ধীনগরের দিকে। মূলত সেটি বস্ত্রবিপণীর জন্য বিখ্যাত।
কোল্হাপুর শহরে ঢুকতেই মিমির চোখে পড়লো একেবারে কেন্দ্রস্থলে অশ্বপৃষ্ঠে আরূঢ়া এক নারীমূর্তি।হাতে সুউচ্চ উন্মুক্ত তরোয়াল। পরণে মারাঠি কায়দায় পরিহিত ন' ওয়াড়ি শাড়ি। মহারাণী তারাবাইয়ের মূর্তি এটি।
মহারাণী  তারাবাই ছিলেন  অসীম সাহসিকতার প্রতিমূর্তি।তিনি বিখ্যাত মারাঠা জেনারেল হাম্বিতরাও মোহিতের  কন্যা,মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শিবাজী পুত্র রাজারাম ভোঁসলের  পত্নী এবং  শিবাজী দ্বিতীয়ের মাতা।তিনি স্বামী রাজারামের সম্পর্কিত ভগ্নী ও ছিলেন। উপস্থিত বুদ্ধি ও বিচক্ষণতায় মহারাণী তারাবাই ছিলেন অতুলনীয়া।অশ্বচালনায় ও যুদ্ধবিদ্যায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুচতুর।
১৭০০ খ্রীষ্টাব্দে স্বামী রাজারামের মৃত্যুর পরে তিনি  তাঁর নাবালক  শিশুপুত্র শিবাজী দ্বিতীয়কে উত্তরাধিকারী হিসাবে ঘোষণা করেন ও আওরেঙ্গজেবের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করেন।এবং মোগলবাহিনীকে পর্যুদস্ত করেন। ১৭০৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি মোগল বাহিনীকে শর্তাধীন যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দিলে মুঘল শাসক সেটা প্রত্যাখ্যান করেন।১৭০৭ পর্যন্ত তারাবাই তার সমস্ত শক্তি নিয়োজিত করে মোগল বাহিনীকে প্রতিরোধ করেন। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তারাবাইয়ের নেতৃত্বে মারাঠা অঞ্চল বিপন্মুক্ত হয়। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ যদুনাথ সরকার বলেছিলেন ১৭০০ -১৭০৭পর্যন্ত মহারাণী তারাবাইয়ের অসীম সাহসিকতা ও প্রশাসনিক দক্ষতা মারাঠা জাতিকে ভয়াবহ সংকটের হাত থেকে রক্ষা করেছিল।এবং এই সময়ের মধ্যে মহারাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বাহিনীর নির্দেশক রূপে বিধবা রাণী তারাবাই মোহিত ভিন্ন সেইসময় সঙ্কটকালীন উপদেষ্টা হিসাবে আর কোন মন্ত্রী ছিলোনা।
ক্রমশঃ


সুবীর সরকার

                                  


গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়া



২২.
যাতায়াতের রাস্তায় কত রকমের মানুষের সঙ্গেই যে দেখা হয়!অন্তহীন কথা হয়।গল্প হয়।সেই গল্প জুড়ে পুরোন কোন ধনীবাড়ির খোলানে ঘুরে বেড়ানো হাঁস মুরগী কইতরের দল যেমন থাকে তেমন থাকে পাকঘর,পুরোন খড়ম আর ঢেঁকি পাড়ের শব্দ।
গঙ্গাধরের পারের চর গুলি থেকে ধান নিয়ে যান জামালউদ্দিন ভাই।তার জোড়া মহিষের "ভইসা গাড়ি"।সন্ধ্যের শেয়াল দৌড়ে বেড়ায়।একটা মেটাফিজিকাল ডার্কনেস জড়ানো পৃথিবীতে গান বাজে,গান ঘুরে বেড়ায়_
"আরে নবরঙ্গের ময়না
ময়না না যান গৌরীপুরে রে"
আর জামালউদ্দিন ভাইয়ের "ভইসা গাড়ি"_র নিচে দুলতে থাকে ভুসো কালি মাখা লন্ঠন।
আমি কূপি আর লন্ঠন হারানো হাটগুলোর কথা ভাবতে থাকি।
তখন ঘোড়া জোতদারের টাড়িতে চুপচাপ মস্ত এক ছায়াশরীরের মত এগিয়ে আসতে থাকেন মহি গিদাল।রাত ঘন হতে থাকে। নিশি পংখী উড়াল দেয় গঙ্গাধর পেরিয়ে বুঝি নদী গদাধরের দিকে।
মহি গীদাল তার দোতরার কান মোচড়ান আর গানের ভিতর ডুবে যেতে থাকেন_
"ফুলবাড়ীত ফুলমালার বাড়ি
হাট করিতে যামো হামরা গরুর গাড়িত চড়ি"
আমি গল্পের শরীরে হাত রাখি।
এভাবে গঙ্গাধরের পারে পারে জীবনের পর জীবন বেশ গুছিয়ে রাখা থাকে,হেমন্ত মাঠে শুয়ে থাকা পাকা ধানের আটির মত!
২৩.
তখন মরা দুপুরের  প্রাক শীতের নরম রোদে ভিজতে ভিজতে এমএলএর হাট থেকে হাতি হারানো জোতদারের জোতের দিকে হেঁটে যেতে থাকে ইজাজ মাস্টার। পাটের শনের মতন তার দীর্ঘ পাকনা চুল দোল খেতে থাকে হাওয়ায় হাওয়ায়।চার কুড়ির এক জীবনে বাঁচতে বাঁচতে ইজাজ মাস্টার দূরাগত বাতাসের ভেতর ঢুকে পড়তে থাকে।তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় মস্ত এক স্মৃতির খামার।
ইজাজ মাস্টার আসলে বাইচ খেলার দক্ষ বাইচার।
বাইচ খেলায় ইজাজের নাও কখনো হারে না।এই পঞ্চাশ সত্তর গ্রাম গঞ্জে সবাই তাকে ইজাজ মাস্টার বলেই ডাকে।জানে।চেনে।
ইজাজ তখন হাতি হারানো নরকান্ত জোতদারের
আখ্যানগুলির মধ্যে ডুবে যেতে থাকে।ইজাজ তখন ১৫/১৬।রূপসীর জমিদারের চড়ক মেলায় ইজাজ তার নানার সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।নানাই তাকে প্রথম জোতদারকে চেনায়।দীর্ঘ মেদহীন পেশীবহুল সেই জোতদারের রাজকীয় ছবি সুরত আজও ইজাজের
স্মৃতিতে জীবন্ত হয়েই রয়ে গেছে।
তারপর সেই বড় বন্যার বছর "লক্ষীমালা" নামের সেই জোতদারের হাতিটি হারিয়ে গেলে সেই জোতদার "হাতি হারানো জোতদারের" কিংবদন্তিতে
ক্রমে রূপান্তরিত হয়ে যান।
এখন ইজাজ মাস্টার তার বেটার ঘরের বেটি, বেটির ঘরের বেটাকে সেই জোতদারের গল্প শোনান।
আর জোতদারটাড়ি জুড়ে উড়ে বেড়াতে থাকে বাইচের গানের কলি_
"ওরে হাউসের মেলা জোড়া খেলা
গঙ্গাধরের  কাছাড়ে
ওরে মাস্টার বেটার নাও ফাইনালে"


রবিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২১

সুবীর সরকার

                    


গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়া



২০.
নদী গঙ্গাধরের ভাটিতে চন্দ্রকান্ত দেউনিয়ার জোত জুড়ে এই হেমন্তে হেউতি ধান কাটার মরসুম।ধান নিয়ে গো_মহিষের গাড়ি চলেছে কৃষকের ঘরে। এ দৃশ্যে উৎসব জড়িয়ে থাকে।জীবনের মায়া জড়িয়ে থাকে।বগা বগির দল উড়ে যাচ্ছে রতিয়াদহর দিকে,বালাজানের দিকে, বিষখোয়ার দিকে,আগমনীর দিকে,গোলকগঞ্জের দিকে,আগমনী পেরিয়ে রূপসীর দিকে।মাঠ মাঠ ধানের মাঝখান থেকে মেয়ে বউদের সমবেত গান ভেসে আসে_
"আজি কার বা বাড়ির ভোন্দা বিলাই
দুয়রত করিলেক হায় ম্যাও"
ধান কাটতে কাটতে কণ্ঠে গান আসে,শরীরে পুলক জাগে।আর শরীরের পেশিতে জেগে উঠতে থাকে নাচের মুদ্রা।বাদ্য থাকে না।বাজনা থাকে না।কিন্তু নাচ থাকে।নাচের সাথে জড়িয়ে থাকে গান।চিরকালের সব গান,যা জীবন নিংড়ে উঠে আসা_
"ধর তো দ্যাওরা ছাওয়াটাক
মুই বিলাইওক সাজা দেও"
জীবন বয়ে চলে এভাবেই।দুর দুরান্তরে ছড়িয়ে পড়া বগা_বগি একসময় ফিরে আসতে থাকে।হেমন্তের ধানের মাঠে তাদের ডানার শান্ত ছায়া বিছিয়ে পড়তে থাকে।
২১.
জীবনের গল্প কখনো শেষ হয় না।হাটপর্ব ফুরোয় না কখনো!আসলে হাট হারানো একটা জীবনের কথা ভাবতেই পারে না মানুষ।গঙ্গাধর নদীর উজান ভাটি জুড়ে কত কত মানুষের জমায়েত।আসা যাওয়া।জমায়েতের ভেতর সারি সারি সাজানো সব গল্পেরা।
এক গল্প শেষ না হতেই নুতন গল্পের শুরু হয়ে যায়।
গল্পে গল্পে মানুষ বাঁচে।মানুষকে আসলে বেঁচে থাকতে হয়।জন্ম জন্ম জুড়েই।
আমরা আবার দেখি হেমন্তের ম্যাজিক জমে থাকা মাঠে আবার বাওকুমটা বাতাস।বগা_বগির হাহাকার মিশে থাকা কান্নার সুর।
আর মাঠের সিথানে চুপচাপ দাড়িয়ে থাকা আবহমান কালের জোড়া মহিষ।ময়কান্ত ব্যাপারী।
আর গুয়া পানের মৌতাতে গান গাইতে থাকেন ফুলেশ্বরী আবো_
"ধান কাটে ধানুয়া ভাইয়া রে
ছাড়িয়া কাটে ওরে নাড়া
সেই মতন মানুষের দেহা
পবন গেইলে ওরে মরা জীবন রে"

মীনাক্ষী ঘোষ

                                       




কোল্হাপুর ডায়েরী


কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজাটা খুলতেই সূর্যর
সহর্ষ চিৎকার- 
-"মিমি' এখানকার পাততাড়ি এবার গোটাও। একসপ্তাহের মধ্যে কোল্হাপুর শিফ্ট করবো আমরা।"
মিমির হাঁ-মুখটা বুজতে  বোধকরি কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো আর সেই হাঁ করা মুখের দিকে চেয়ে মিটমিট করে হেসে চলেছে সূর্য।
-"মানেটা কি? বলা নেই কওয়া নেই 'ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে'!
ধুসস কি ব্যাপার খোলসা করে বলোই না!"
বছর দুয়েক হোলো মিমি সূর্য  ওদের দুই পুত্রকন্যা সহ
পুণেতে এসেছে।অবশ্যই সূর্যের কর্মসূত্রে। এর আগে দীর্ঘ
আঠারো বছরের বিবাহিত জীবন কেটেছে বাংলার বূকেই।
সূর্য পেশায় মেটালার্জিষ্ট।পশ্চিমবঙ্গের একটা বিখ্যাত অ‍্যালুমিনিয়াম কোম্পানির  একটি ইউনিটের সর্বোচ্চ আধিকারিক ছিল সূর্য। বছর তিনেক আগে সেই বেসরকারি কোম্পানিটি অন্য আরেকটি কোম্পানি
টেক ওভার করে।কয়েকমাস যাবার পরে  ভারপ্রাপ্ত নতুন আধিকারিকরা এই ইউনিটটি বন্ধ করে দেবার সিদ্ধান্ত নেন। সূর্যকে বদলির প্রস্তাব দেওয়া হয় মধ্যপ্রদেশের চম্পা জেলায় অন্য একটি ইউনিটের প্রধান হিসেবে।
ওদের ছেলের তখন ক্লাস টেন। সামনে আই সি এস ই পরীক্ষা।মেয়ে ছোট ক্লাস ফাইভ। যেহেতু ছোটবেলা থেকেই ওদের কোন প্রাইভেট টিউটর ছিলোনা।মিমি আর সূর্য ই ওদের পড়ানোর দায়িত্বটা পালন করতো।
বদলি হলে সূর্যকে একাই  যেতে হবে - এই টানাপোড়েনে যখন তারা  ভীষণভাবেই দ্বিধাগ্রস্ত তখন ই পুণেতে কর্মরত মিমির ছোটভাই সূর্যকে পুণে চলে আসার প্রস্তাব দেয়।
সর্য দোনোমোনো করেছিলো। কিন্তূ মিমির প্রবল উৎসাহ আর আগ্রহে শেষমেষ বাংলার পাট চূকিয়ে একরকম হারা উদ্দেশে অনিশ্চিতকে বরণ করে নেবার একটা দুঃসাহসিক
সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে তারা। 
বদলির সিদ্ধান্ত মেনে না নেওয়ায় এবং ইউনিটটি বন্ধ হবার কারণে ছেলের পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের মুভ করার কোনো উপায় ই ছিলনা। আরো একটা কারণ ছিল। মিমির অ‍্যালায়ানস ফ্রাঁসেজে ফ্রেঞ্চ ক্লাসে সিক্স্থ লেভেল কমপ্লিট করার মাস দুয়েক বাকি ছিল। সব চুকিয়ে
পুণে আসতে বছরের মাঝামাঝি।
তারপর থেকেতো জীবনটা বল্গাছাড়া ঘোড়ার মত ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌঁড়েই চলেছে। তার সাথে তাল মেলাতে গিয়ে মিমি দিশেহারা। পুণেতে কনসালট্যান্ট হিসেবে একটা কোম্পানিতে জয়েন করার তিনমাসের মধ্যে সূর্য বদলি হলো দিল্লী। দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে পুণেতে শুরু হলো মিমির চরৈবতি পর্ব। এই দু বছরে সূর্য কখনো দিল্লী কখনো গোয়া  কখনো পুণে এভাবে চাকরির সাযুজ্য বজায় রেখেছে। আর মিমি পুণেতে থেকে গেছে ছেলে মেয়ের জন্য। সবে কাল ই ছেলের টুয়েলভের পরীক্ষা শেষ হ য়েছে।
এরমধ্যে সূর্য চাকরির সন্ধান চালিয়ে গেছে নিয়মিত। যেখানে একজায়গায় পরিবারসহ থিতু হতে পারে। আসলে সূর্য বরাবর ই ঘরকুনো বড় বেশী পরিবার ঘেঁষা।
ঘরে ঢুক ধপ্ করে সোফায় বসেই  মিমিকে বললো- 
'তোমায় বলিনি মিমি। কিছুদিন আগে কোল্হাপুরের একটি বড় কোম্পানির মালিক আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন ওদের ফ্যাক্টরিতে  জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেবার  জন্য। সবটাই টেলিফোনিক ইনটটারভিউয়ের মাধ্যমে। অবশেষে সবকিছু ফাইনালাইজ
করে আজ ওরা ‍অ‍্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাঠিয়েছে।' কোম্পানি রেন্টেড ফ্ল্যাট আর নিজস্ব ব্যবহারের গাড়ি ও দেবে  সেই কোম্পানি। সাত দিনের মধ্যে জয়েন করতে
হবে। অতএব,' চলো মুসাফির বাঁধো গাঠরি।'
মিমির মাথায় এখন আর কিছুই ঢুকছেনা। ওর মনের ভেতর স্লাইড শো হয়ে তখন ভেসে চলেছে একটা অদেখা শহরের স্বপ্নে আঁকা কিছু ছবি। আবার নতুন জায়গা নতুন মানুষ আবার আরেক অনিশ্চিতের হাতছানি  যা মিমিকে সারা জীবন অস্থির করে টেনে নিয়ে বেড়িয়েছে দেশ থেকে দেশান্তরের দিকে। সূর্য যখন কিঞ্চিৎ ইতস্তত করেছে মিমি অভয়দাত্রী হয়ে সাহস জুগিয়েছে। টালমাটাল সময়গুলোকে শক্ত হাতে ধরে ঢেউ সামলেছে একের পরে এক।
কোল্হাপুর  সম্পর্কে মিমির জ্ঞান ছিলো ওই কোল্হাপুরী চপ্পল অবধিই। বালিগঞ্জ ফাঁড়িতে কোল্হাপুরী সেন্টার নামে জুতোর দোকানটা কোল্হাপুর নামটা সম্পর্কে অবহিত করেছিলো। ব্যস ওই পর্যন্ত ই। আর কোন কৌতূহল বা ধারণা কিছুই ছিলনা। এমনকি  এখনো পর্যন্ত মিমির ধারণা নেই পুণে থেকে কোল্হাপুর কতটা দূর! 
 সূর্যর গলার আওয়াজে ছেলেমেয়েও পায়ে পায়ে বসার ঘরে। সবটাই শুনেছে তারা কিন্ত বিমিশ্র অনুভূতি তাদের দুজনের গলায়। ছেলে খুব খুশী। এমনিতেও ও এবার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চলে যাবে বাইরে। কিন্তু মেয়ে--!!!
এখানে দু'বছরে এখানকার স্কুল ও পরিবেশে অনেকটাই ধাতস্থ হয়ে গেছে সে। নতুন ভাষা মারাঠীকেও বেশ ভালোরকম করায়ত্ত্ব করেছে সে এই দুই বছরেই। এখানে নামী কনভেন্টে ভর্তি হবার সুযোগই শুধু সে পায়নি এখানকার স্কুলেও ভালো ছাত্রী হিসেবে স্কুলের সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে ফার্ষ্ট অথবা সেকেন্ড হয়েছে প্রতিটা পরীক্ষায়।
আবার নতুন স্কুলে নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার পরীক্ষা মেয়েটাকে ভীতচকিত করে তূলেছে।কিন্তু মেয়ে অসম্ভব বাবা ন্যাওটা। বাবা আবার একসাথে থাকবে এই আশ্বাসটুকু ভরসা করে তাই সেই ভীতিটুকু হজম করেছে চুপ করে বাবার কোলে বসেই।
রাতে সকলে ঘুমিয়ে পড়লে মিমি ডেষ্কটপ খুলে কোল্হাপুর শহরটার ইতিবৃত্ত পড়লো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
পুণে থেকে দুশো পঁচিশ কিলোমিটার দূরে দক্ষিণ পশ্চিম মহারাষ্ট্রের একটা ছোট্ট সুন্দর শহর হলো কোল্হাপুর। মূলত কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের সংযোগবিন্দু এই  উপত্যকা শহরটি স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত মারাঠা সাম্রাজ্যের  অধীনে ছত্রপতি শাহু মহারাজের স্বায়ত্ত্বশাসিত রাজ্য ছিল।স্বাধীনতার পরে এটি একটি জেলা হিসেবে পরিগনিত।সহ্যাদ্রি পর্বতমালার পূর্বদিকে অবস্থিত এই ছোট শহরটি কেবলমাত্র নান্দনিক সৌন্দর্যেই সমৃদ্ধ নয়।পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক দিক থেকেও এর তাৎপর্য অপরিসীম।
ইতিহাস প্রাচীন এই শহরটি রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল একসময়।মহারাণী তারাবাঈ কোল্হাপুর, কাগাল ও ইচলকরঞ্জি এই তিনটি পরগণা নিয়ে কোল্হাপুর রাজ্যটির পত্তন করেন।পরে উত্তরাধিকার সূত্রে ছত্রপতি শাহু মহারাজের হাতে এর শাসনভার অর্পিত হয়।
সূর্য উঠেছিল বাথরুমে যাবে বলে। মিমিকে  ডেস্কটপের উপর ঝুঁকে বসে থাকতে দেখে মৃদু ধমক দিলো। রাত ও হয়েছে অনেক। কথা না বাড়িয়ে মিমি শুয়ে পড়ার আয়োজন করলো। যেটুকু পড়লো  তাতে যাবার আকর্ষণ আরো প্রবল। বাকিটা গিয়েই নাহয় এক্সপ্লোর করা যাবে। 

ক্রমশঃ


                  




      
    
             
                          



ছবি ১ঃ কোল্হাপুর লোগো
ছবি ২,৩ ঃ মহারাণী তারাবাঈ
ছবি ৪ঃচিন্ময় গনেশ
ছবি৫ঃ কোল্হাপুর প্রবেশপথের মূল ফটক

রবিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২১

সুবীর সরকার

                     


গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়



১৮.
কবেকার কোন এক হেমন্তের হাটে হেমকান্ত দেখে ফেলেছিলেন সেই জোড়া কৈতর। আর হাটে ঢুকে পড়া মেয়েরা তাদের শরীরে নাচ নিয়ে শুরু করেছিল গান_
"আরে নবরঙ্গের ময়না
ময়না না যান গৌরীপুরে রে"
নাচের পর নাচ গানের পর গান চলে,চলতেই থাকে
হেমন্ত জুড়ে।মাঠে মাঠে সোনার ধান।
মানুষের ঘরবাড়ি থেকে দৈনন্দিন কথা বার্তা ভেসে।
হিমে ভেজে খোলানের নিঃসঙ্গ আখা।
দূরে কোথাও আগুন জ্বলে ওঠে।
আগুন ঘিরে মানুষের ছায়া আবছায়া।
আল ও আলি দিয়ে দৌড়ে পালায় হেমন্তের ছাইবর্ন শৃগাল।
রহস্যময় মনে হয়,মনে হতে থাকে দূরে কাছের গ্রামদেশ।
মস্ত চাঁদ ওঠে। জোড়াদিঘির জলে চাঁদ আর সুপুরি গাছের ছায়া।
কোথাও পুঁথি পড়া হয়।
আর গান জেগে ওঠে_
"বাপরে বাপ কি জাড়
মাওরে মাও কি জাড়
জাড়ত কাপে দেখং এল্যা
দিন দুখির সংসার"
এভাবে জীবন সেজে ওঠে।জীবন প্রবাহিত হয়।
জন্ম আর মরণের ঘোর জাগিয়ে রেখে
স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন হেমকান্ত।
আর হেমন্তের মাঠে খেতে হাহাকারের মতন ছুটে
যায় গান_
ওরে মানুষের দেহা
পবন গেইলে হবে মরা"
১৯.
হেউতি ধান,পাখির পালক,শেষ হেমন্তের নদী,ধান নিয়ে ঘরে ফেরা কৃষক,নির্জন কলাগাছের পাতা_এই সব দৃশ্যের মায়া আর ম্যাজিক কেমন নিরিবিলি করে দেয়।
এই সব আসলে চিরকালীন,আবহমান।
যেভাবে জীবনের পর জীবন মানুষ বাঁচে,মানুষকে বেঁচে থাকতে হয়।
পুরোন মানুষ হারিয়ে যায় এই মর পৃথিবী থেকে।
নুতন মানুষ বেঁচে থাকাটাকে ছুঁয়ে থাকে।
জন্ম জন্ম জুড়ে এ এক ধারাবাহিক পক্রিয়া।
ছয় নদী আর নয় ফরেস্ট জুড়ে জুড়ে গল্প নির্মিত কিংবা বিনির্মিত হতে থাকে।শিমুল গাছের শরীরে নখের আচড় রেখে আসে চিতাবাঘ।
হাতির পাল নেমে আসে উত্তরের ধানবনে।
নদীর শিথানে খুব নির্জন হয়ে বসে থাকে সেই আবহমান কালের বগা বগি।
এই জীবন তো আদতে এক ফাঁদ।
আমরা সবাই "ফান্দে পড়িয়া কান্দি"!
আর কার্তিকের কুয়াশায় ভেসে আসে গান_
"চাষার মুখত আর
নাইরে সেই গান"।
জীবনের অদ্ভুত এক মায়া আছে।দূরাগত হাওয়ায় বুঝি জীবনেরই ঘ্রাণ ভেসে আসে!কত কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়।গল্প হয়।মানুষের জীবন জুড়ে না ফুরোন কত গল্প।রতিকান্ত পাইকারের গল্পে কখন বুঝি মিশে যেতে থাকে হাতি জোতদারের হলুদ খামারবাড়ি।আমি নদী পেরিয়ে,চরের পর চর পেরিয়ে হেঁটে যেতে থাকি এরাজ ধনীর জোতে।এইসব আসা যাওয়ার মাঝখানে ছায়া ফেলে জোনাকির আলো। কোথাও দোতরা বেজে ওঠে।দেহতত্ত্বের গান উঠে আসে আর ঘুরে বেড়াতে থাকে টাড়ি বাড়ি নদী উপত্যকা জুড়ে।
এভাবেই জীবন কিভাবে বুঝি উদযাপন হয়ে ওঠে!


রবিবার, ৭ নভেম্বর, ২০২১

জিনাত রেহেনা ইসলাম

                       





স্বাধীনতা  দিবসে মনে  খুশির জোয়ার এনে দিল মুর্শিদাবাদের দৌলতাবাদ,ছয়ঘড়ির (মন্ডলপাড়া গ্রাম)  মহিলা কৃষক মৌসুমি বিশ্বাস। মুর্শিদাবাদের একমাত্র মহিলা কৃষিবোন,যে নিজের হাতে চাষ থেকে শুরু করে মাথায় করে বাজার পর্যন্ত নিজের উৎপাদনকে সন্তানের মত নিয়ে যায়,জেলা  পেরিয়ে  দেশজুড়ে  ছড়িয়ে পড়তে চলেছে তার ধানের বীজ নিয়ে সফল পরীক্ষা-নিরীক্ষার অভিজ্ঞতা। কালই ওর ভিডিও বার্তা প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির দপ্তরের জন্য  চলে গেছে। তারপরের স্তরে সেটা পাঠানো হবে রাষ্ট্রসংঘে। মৌসুমিকে এই বিশ্বের দরবারে যারা নিয়ে হাজির করছে তারা আর কেউ নয়, ন্যাশানাল ইনোভেশন ফাউন্ডেশন।


আট বছর ধরে কলা,পেঁয়াজ সহ  ধানের বীজের উপর  মাঠে বসে গবেষনা চালিয়েছে মৌসুমি। সাফল্যের স্বীকৃতি মিলেছে ধানে। প্রথমে নলাক আর আই আর -৩৬ ক্রস করে।  তারপরেও চার  বার ক্রস চালিয়ে  আনে নতুন ভ্যারাইটি।  নাম এম যামিনী। সেটি সংগ্রহ করে নিয়ে যায় বছর তিনেক আগে গান্ধীনগরের এক তরুণ কৃষিবিজ্ঞানী সহ এক প্রোজেক্ট কো অর্ডিনেটর। গুজরাট ও পশ্চিমবঙ্গ সহ নানা জায়গায় ফলন ফলায় এই বীজ। চাষীরা  বিঘাপ্রতি ৬/৭ কুইন্টাল বেশি ফলনের  রিপোর্ট দেয়। সেচ কম,রোগ কম,আবার ফলনও বেশি। এরপর মৌসুমির ডাক পড়ে দিল্লি ও গুজরাটে যাওয়ার। লকডাউন বাধ সাধলে ভিডিওতেই প্রেরণ করা হয় মৌসুমির ধানের বীজ নিয়ে  সাফল্য ও কাজের বার্তা। 


 ন্যাশনাল ইনোভেশন ফাউন্ডেশন (এনআইএফ) -  ভারত সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের (ডিএসটি) একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা। গ্রাসরুট প্রযুক্তিগত  সৃজনশীল উদ্ভাবকদের স্পেস দেওয়া মিশন এই সংস্থার। এবারে  কৃষক মৌসুমী বিশ্বাসের এতদিনের সংগ্রাম ও গবেষণায়  নতুন পালক সংযুক্ত হওয়ার  অপেক্ষা।


জয়তী রায় ( মুনিয়া)

                       





বেঁচে থাকা একটা সাধনা 

&&&&&&&&&&&&&&&&

     

      দিনের শেষে আমরা কি চাই? 

বাড়ি গাড়ি অর্থ না কি একটু শান্তি?

এক একসময় মনে হয়, সমস্ত কিছুর বিনিময়ে যদি শান্তি পাওয়া যেত! যদি, বালিশে মাথা দেওয়া মাত্র ঘুম এসে যেত! 

কখনো কখনো মনে হয়, চারিদিক অন্ধকার, সন্তান স্বামী অথবা অসুস্থ পরিজন নিয়ে পেরে ওঠা যায় না, একদিক সামলে উঠলে অন্যদিক ঝামেলায় পড়ে, সেজেগুজে ছবি তুলে আরো কত কী করে দেখাতে তো চাই, ভালো আছি, কিন্তু নকল হাসির বন্ধ দরজা ভেদ করে আলো আর ঢোকে না কিছুতেই। জীবনের শুরুতে যে পথ মনে হয়েছিল সহজ সরল, চলতে চলতে দেখতে পাই কত কাঁটা, ছোট ছোট কাঁটা কিন্তু ধারালো, আপাতদৃষ্টিতে তুচ্ছ সমস্যা, কিন্তু আঘাত তীব্র, কর্কশ, ছিন্ন ভিন্ন করে দেয় সাজানো জীবন, বলা যায় না, সহন করা যায় না, অভিনয় করে যেতে হয় তবু, সাজানো সুখের অভিনয়!

************ 


কেন হয় এমন? ত্রুটি করা হয় নি কোনো কাজেই, আকুল হয়ে ভাবতে থাকে মন, কোথায় হয়েছিল সমস্যা, কোথায় ছিল ঠিক সময়ে ঠিক কাজ না করার ভুল, নিজেকে দোষারোপ করতে করতে, অপরের থেকে দোষারোপ শুনতে শুনতে ইচ্ছে করে আত্মহত্যা করে সব জ্বালা জুড়িয়ে দিতে, প্রাণ না থাকলে, থাকবে না ঝামেলা! 

এইভাবে দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে আত্মহত্যার প্রবণতা। পরিসংখ্যান বলছে-- গোটা পৃথিবী জুড়ে গড় আত্মহত্যার সংখ্যা যেখানে ৮ লাখ , সেখানে শুধু ভারতেই প্রায় ১ লাখের উপর। ভারতে জন সংখ্যা বেশি হলেও, জাতীয় ক্রাইম ব্যুরো রেকর্ড বলছে-- ভারতীয়রা আত্মহত্যা করছে বেশি, সমস্ত রকম শ্রেণীর মানুষ আছে সেখানে, উচ্চবিত্ত, সেলিব্রেটি, ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে। সবচেয়ে বেশি, তামিলনাড়ু, কেরালা,পশ্চিমবঙ্গ ও মহারাষ্ট্রে। নারী পুরুষ নির্বিশেষে, সুইসাইড করার বয়স গড়ে পনেরো থেকে চুয়াল্লিশ এর মধ্যে। মনের ডাক্তার বলে-- মানসিক চাপ ও হতাশার মোকাবিলা করার শক্তি যখন হারিয়ে যায়, মানুষ তখন জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজতে আয়ু কমিয়ে দেওয়ার 

পরিকল্পনা করতে থাকে, একসময় সফল হয়। 

***********

রামতনু বাবু আত্মহত্যা করেন কারণ,ছেলে পরীক্ষায় অকৃতকার্য, শীলা সহ্য করতে পারেনি, শ্বশুরবাড়ির কথার আঘাত, এমন আরো কত...! যৌনতা সম্পর্কিত সমস্যা, রোগে জর্জর হয়ে যাওয়া, প্রিয় ব্যক্তির মৃত্যু, প্রিয় পোষ্যের মৃত্যু, সামাজিক খ্যাতি পড়ে যাওয়া-- তালিকা বাড়িয়ে লাভ নেই-- আশি পার্সেন্ট শিক্ষিত লোক বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার পথ। 

************

শিক্ষিত লোক  উদাহরণ দেওয়ার পিছনে কারণ হল, আত্মহত্যাই সমাধানের পথ, এমন যারা ভাবতে বাধ্য হন, শিক্ষা তাদের কী কাজে লাগল!

অনেকেই তর্ক করবেন, যুক্তি দেবেন, সুশান্ত সিং রাজ্পুতের মর্মান্তিক ঘটনাকে অনেকেই বলেছেন, খাদের কিনারায় এসে গেলে আর উপায় থাকে না, সুইসাইড অনিবার্য। আমিও তর্ক করেই উত্তর দেব, সুইসাইড করতে যাওয়ার আগে ঘুরে দাঁড়ানোর যে শিক্ষা, যেটা ছোট থেকে শেখানো উচিৎ, তথাকথিত শিক্ষিত মানুষজন সেই কৌশল শেখে না, তবে কি শেখে? কি করে সেরা হয়ে উঠতে হয়, কি করে সমাজের মাথা হয়ে উঠতে হয়, কি করে নিজের প্রিয় বন্ধুকে সরিয়ে জায়গা করে নিতে হয়, মায়ের টেলিফোন কথোপকথন, বাবার মদ্যপান বিজনেস মিটিং-- সমস্ত সময় আলোচনা-- চারপাশ জুড়ে আছে কেবল খারাপ মানুষ! সকলে বিশ্বাসঘাতক, সকলে ফালতু, সকলে স্বার্থপর। 

এইরকম অবিশ্বাসের কথা শুনতে শুনতে বড় হয়ে ওঠা সন্তান, একদিন নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারেনা, বিশ্বাস না থাকলে বেঁচে থাকার মত পুষ্টি কি করে পাবে মানুষ? 

**********

মনের ডাক্তারের কাছে যেতে হয় কখন? যখন আর উপায় থাকে না। শরীরের ডাক্তারের কাছেও তো যেতেই হয় শেষপর্যন্ত, কেন যেতে হয়? শরীরের যত্ন নেওয়া হয় না ঠিক মত, নিয়মিত চেকআপ যাওয়া হয় নি, হঠাৎ ধরা পড়ল ভিতরে ভিতরে বড়  একটা অসুখ বাসা বাঁধছে, তখন আর কোনো উপায় থাকে না। 

মনের চেক আপ করে নিয়মিত করা জরুরি বলে কেউ মনেই করে না। যেহেতু, মনের জীর্ণ দশা চোখে দেখা যায় না, অথবা, তাত্ক্ষণিকভাবে  খুশিতে থেকে, বেড়িয়ে এসে কেনাকাটা করে, ব্যাঙ্কে সম্পত্তির হিসাব মিলিয়ে খ্যাতির লিস্টি মিলিয়ে সুখী ভাবতে চাওয়ার মধ্যে থাকে মস্ত ফাঁকি। পরিসংখ্যান বলছে-- মোট আত্মহত্যার বেশির ভাগ পারিবারিক অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে নিজেকে শেষ করে দেয়। আর এই মুহুর্তে অতিমারি একটা বিরাট কারণ। 

বোঝা যাচ্ছে, মনের জমিতে ফাটল ধরছে ক্রমাগত, সেই ফাটল মেরামত করতে হবে, ছোট  থেকেই গড়ে তুলতে হবে সুস্থ মন। সতর্ক থাকতে হবে, কোথাও টোল খেলো কি না! মানুষ ছাড়া জীবন কিসের? মানুষকে অবিশ্বাস করে ঠকে যাচ্ছেন না কি মানুষকে সব বিলিয়ে দিয়ে আশা করে আছেন? বাঁচতে হবে নিজের শর্তে, মানুষ পাশে থাকলে ভালো আর না থাকলে? আরো ভালো। প্রয়োজন নেই। নিজের শর্তে বাঁচতে হবে। সাফল্য নিতে পারব, পার্টি দেব আর ব্যর্থতা মানতে পারব  না? তখন গলায় দড়ি দেব? 

**********

জীবন একটা যুদ্ধ তো বটেই, ওঠা  পড়া  থাকবে, অপমান থাকবে, তবে শেষপর্যন্ত দেখতে হবে, হেরে যাই তো ঠিক আছে, আগের থেকে হার মানলে চলবে না। 

  মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ, অমুক ওই করেছে, তমুক তাই করেছে, এগুলি না ভেবে দেখতে হবে আমি কি করেছি, সেটাই প্রয়োজন, সেটাই জরুরি। বাকি আর সব তুচ্ছ। 

   বেঁচে থাকা একটা সাধনা, প্রাণ আছে তো সমস্ত কিছু আছে। প্রাণের সাধনা করতে হবে প্রতিদিন। 

   চেষ্টা করি আসুন, সাধনা সফল হোক।

পিয়াংকী

                      





গরম বাহার, নামেই যার উত্তাপ তার কাছে গেলে ছ্যাঁকা খেতে হবে এ আর এমন কী কথা! 

আসলে আমি বলতে চাইছি আপনি ছ্যাঁকা খান সমস্যা নেই কিন্তু আপনার ওয়েটমেশিন যেন কোনভাবেই পুড়ে না যায়🙂,আর এসব যাতে না হয় তার জন্যই এত আয়োজন।


বলতে চাইছি একটি ওয়েটলস লাঞ্চের কথা। বাটার ভেজ উইথ ক্রিস্পি কর্ণ চিকেন। শুনতে ভজঘট হলেও আদতে বিষয়টি খুবই সহজ এবং সময় রক্ষক।


গাজর বিন ক্যাপসিকাম ব্রকোলি রেড বেলপেপার ইয়ালো বেলপেপার, চাইলে পছন্দমত অন্য ভেজিটেবলও নিতে পারেন।লম্বা শেপে কেটে নিয়ে ৬০-৭০%সেদ্ধ করে জল ঝরিয়ে নিন,মেরেকেটে মিনিট সাতেক সময় লাগবে,এরপর ননস্টিক প্যান গরম করে তাতে সামান্য বাটার। মেল্ট হলে রসুনকুচি। গন্ধ বেরোলে সেদ্ধ সবজি,পরিমাণমত নুন, কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে দুধে গোলা কর্ণফ্লাওয়ার দিয়ে একটু সময় টস করলেই তৈরি বাটার ভেজ


এবার পালা ক্রিস্পি চিকেন তৈরির। চিকেনপিসগুলো ফ্রিজের ঠান্ডা জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে দশ মিনিট, এরপর জল চেপে তুলে নিয়ে গোলমরিচ গুঁড়ো লেবুর রস নুন আমচুর পাউডার সামান্য সর্ষের তেল দিয়ে মেখে আধঘন্টা রেস্টে রেখে দিতে হবে।তারপর প্যানে অলিভ অয়েল ব্রাশ করে পিসগুলো রেখে কম আঁচে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রান্না করতে হবে, অন্তত মিনিট কুড়ি সময় লাগে এই কাজটায়।এরপর অন্য একটি প্যানে অল্প বাটার দিয়ে তারমধ্যে পেঁয়াজ আদা রসুন পেস্ট দিয়ে তিন চার মিনিট রান্না করার পর কাঁচা গন্ধ চলে গেলে  ফার্স্ট স্টেপ রেডি করা চিকেন পিসগুলো দিয়ে, তারমধ্যে একটু টমেটো সস চিলি সস মিশিয়ে দিয়ে রান্না করলেই তৈরি আজকের পদ।

সোনালী চক্রবর্তী

                           


ফাত্রাতুন



"শিবে রুষ্টে গুরুস্ত্রাতা গুরুরুষ্টে ন কশ্চন:
ইতি কঙ্কালমালিনীতন্ত্রে..."

শেষটুকু উচ্চারণের আগেই প্রায় বিবর্ণ পাতা প্রথমে ঝাপসা আর তারপর- 'তুমি তো নারী, তোমার কবিতায় জলের অধিক কিছু থাকার ছিলোনা'। কে রুষ্ট হলো তার? জন্মইস্তক শিবপূজা করে আসছে প্রায় ভগ্ন, অশ্বত্থঘেরা দেউলঘাটে শ্রী, যে পুণ্যভূমি হালিশহরের গঙ্গাজলমৃত্তিকার ঘ্রাণের মধ্যে মিশে থাকেন মহাসাধকের বেড়া বাঁধার সঙ্গিনী লীলাবতী মহাকালী। লোকে বলে তারই অর্জন চট্টোপাধ্যায় বংশে তার বিবাহ, তিন পুত্রের সর্বকনিষ্ঠটির বধূ হলেও তারই হাতে দেড় শতাধিক বৎসর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত পঞ্চলিঙ্গের (বাণেশ্বর, চন্দ্রমৌলীশ্বর, রত্নেশ্বর, রামেশ্বর, অর্ধনারীশ্বর) নিত্যপূজার দায়িত্ব কমলিনী মারফত এসে পড়া। সেই রাতেও কি আরিদ্রা নক্ষত্র হেসেছিলো? জানা নেই। এই প্রাপ্তির লৌকিক ব্যাখ্যা চন্দ্রস্রোতে ভেসে যায় তার গুরুসম্বন্ধীয় অলৌকিক সৌভাগ্যে। সপ্তমবর্ষীয়া কন্যাটি দীক্ষা পেয়েছিলো স্বয়ং শ্রী সারদা মায়ের সাক্ষাত গৃহীশিষ্য শ্রী লাবণ্যকুমার চক্রবর্তীর থেকে। পরমহংসের নশ্বরতা বিষয়ে যারা চর্চা করে থাকেন তাদের কাছে পরিচিত "যুগজ্যোতি" ও "ঠাকুরের বাউল" সহ বহু গ্রন্থের রচয়িতা, প্রেমেশ মহারাজের প্রিয়তম কবি এই সাধকের নাম। শৈবলিনীও বিস্মিত ছিলেন বরাবর এত কিছুর পরেও শ্রীয়ের অন্তর্মুখীনতায়, অধ্যাত্মের পারদভারকে স্ফটিকের স্বচ্ছে নীরব জ্বালিয়ে রাখার দক্ষতায়। সন্তানকে পার্থিব প্রাপ্তিতে সন্তৃপ্ত দেখে সন্তুষ্ট হওয়ার সাধারণ মা তিনি ছিলেন না। ফলত, যোগীচক্ষুর বিচলনের প্রয়োজন পড়েনি। নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন মেয়ে তার শান্তিসূত্রের সমীকরণ নিজেই এঁকে নিচ্ছে বলে। নীলাদ্রীকে দেখে তার নিয়তিতে বিশ্বাস দৃঢ় হয়েছিল- "বারাণস্যাং তু বিশ্বেশম ত্র্যম্বকং গৌতমীতটে" । তিনি মেনকা ছিলেন না কিন্তু একথাও তো সত্য পার্বতী শুধুমাত্র কিছু পুরাণমতের নাম। শক্তি ও তার আধার প্রসঙ্গে পুঁথি মানা হলে শেক্সপিয়র কেন নয়? "What's in a name?" 


সেই শ্রী আজ অন্তর্দ্বন্দ্বে বিক্ষত। কোনো অসতর্ক মুহূর্তে কি বাণলিঙ্গ আঘাত পেয়েছেন? সদাশিবের অত্যন্ত উগ্ররূপ এই উপবৃত্তাকার স্বয়ম্ভু লিঙ্গ। রুদ্রজ ব্রাহ্মণেরাও অতি সন্তর্পণে তাঁকে আরাধনা করে থাকেন। কিন্তু তবুও তো শ্রীয়ের গুরুদাদু আছেন। সে জানে শ্রীশ্রীমা নহবতখানায় থাকাকালীন একদিন তাঁর স্বপ্নধ্যানে পিঙ্গলজটা দুলিয়ে বাঘছাল পরা এক শুভ্রকায় শিশু দৌড়াতে দৌড়াতে এসে নালিশ জানিয়েছিলো- "আমায় ফেলে দিয়েছে"। মা তাকে কোলে বসিয়ে আদর করে বুঝিয়ে শান্ত করেছিলেন এই বলে যে "ইচ্ছে করে তো করেনি বাবা, সবই তো তোমার সন্তান, অপরাধ নিতে নেই"। তাহলে? কীসের অপরাধে তাহলে এই শূন্য বাড়িতে অধিকতর শূন্যতা ধারণ করে তার তাকিয়ে থাকা? আজ ষোলোদিন পেরিয়ে গেলো নীলাদ্রি নার্সিংহোমে। স্বধা রোজ ছয় ঘন্টার জন্য বাড়ি ফেরে। মেয়ের মুখ দেখে সে কোনো প্রশ্ন না রেখেই বুঝে যায় অমাবস্যার দেরী নেই। তাহলে কি... তাহলে কি... সে নিজেই হোতা, অধ্বর্যু ও উদ্গাতা এই আকস্মিক 'যজ' ধাতু ', 'ঞ' প্রত্যয়ের অবশ্যম্ভাবী আবির্ভাবের? আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে যে সূক্ষ্ম চিড় ধীরে মহাখাত হয়ে আলাদা দুটি সভ্যতায় পরিণত করলো তাকে ও নীলাদ্রীকে, সে কি জেন হ্যারিসনের তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠা দিলো তবে?

"Collectivity and emotional tension, two elements that tend to turn the simple reaction into a rite"

শীতল লাভার মতো তার অভিমানসমূহ এভাবে বধযোগ্যতা দিলো নীলাদ্রীকে? 



চন্দ্রগর্ভের ক্ষতগুলিকে কলঙ্ক নামে রোম্যান্টিসাইজ করাই প্রথা। সেইহেতু এই প্রশ্ন কখনো ওঠেনা যে শুধুমাত্র শ্রেষ্ঠ সুন্দরী তথা পাণ্ডবশক্তির কেন্দ্রস্থল বলেই দ্যূতসভায় রজস্বলা পাঞ্চালীকে বিবস্ত্র করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিলো নাকি কেশবসখী হওয়ার দায়ে তাঁর জন্মলগ্ন থেকে বিবাহ- প্রতি পলেই কুরুক্ষেত্র? শুধু কৃষ্ণা তো নন, অজস্র উদাহরণ রয়েছে যেখানে ঈশ্বরনির্ভরতাই কারণ জীবনব্যাপী দুর্ভাগ্যের। "দুঃখ তাঁর দয়ার দান" উচ্চারণকারী গান্ধারী কি বাসুদেবকে অভিসম্পাত দানে বিরত থাকতে পেরেছিলেন শেষতক? শ্রী তার জীবনের প্রেক্ষিতে এই সূত্রের বহু সম্ভাব্যতা খোঁজার চেষ্টা করেছে এতো বছর ধরে। সে শৈবলিনীর মতো বৈরাগ্যপ্রতিমা নয়, কমলিনীর মতো সিংহতেজাও না। এই দুইজন ব্যক্তিগত আদর্শকে যাপনে পরিণত করতে পেরেছিলেন কারণ ভাগ্য তাঁদের যে মুক্তি দিয়েছিলো তাতে তারা মেধা ও কাঠিন্য মিশিয়ে নিস্তেল স্বাধীনতার অণ্বেষণে নিজেদের ব্যস্ত করে তুলেছিলেন। অথচ শ্রী? অধ্যাত্মের তীব্র ফল্গু তার মধ্যে প্রবহমান জেনেও তার মা তাকে পাত্রস্থ করেছিলেন অতিরিক্ত দ্রুততায়। যতই শৈবলিনী দাবী করুন নীলাদ্রি সাধারণ পুরুষ নন কিন্তু একমাত্র নিজস্ব মায়াবিশ্বাস ছাড়া এ প্রমাণ তিনি কোথায় দিয়েছিলেন শ্রীকে যে তার জন্য নির্বাচিত জন শর্ব? শ্রী যা পেয়েছে তাতে যদি নীলাদ্রি অনঘও হন তবুও তার রূপ মণিকর্ণিকায় শবের কানে তারকব্রহ্ম নামদায়ী কামারী, কৈলাসে উমার পুরুষ সোম নন। রাগ-রাগিণী সামপ্রিয় নীলাদ্রীর দুর্বলতা অথচ কখনো শ্রীকে শুনতে চাইলেন না তো তিনি। প্রাইমারি থেকে উচ্চবিদ্যালয়- যে শ্রীয়ের দিকে তাকিয়ে হেন প্রাণী নেই অবাক হতোনা গন্ধর্বসম আলোয়, কখনো তাকেই দেখার সময় নীলাদ্রীর চোখে তো মুগ্ধতার অঞ্জন লাগলোনা। কেন? অথচ নীতিজ্ঞান ও চরিত্রে নীলাদ্রীতুল্য পুরুষ দুর্লভ। এক্ষেত্রে তিনি অবিসংবাদী অজাতশত্রু। তাহলে কি অতিশৈশব থেকে ঈশ্বরবোধের যে বেদী নির্মাণ করেছিলেন শৈবলিনী তাইই শ্রীয়ের বোধ ছাপিয়ে শরীরী উপত্যকাকে দেবজ অংশ করে তুলেছিলো যাকে ঘিরে মন্ত্রোচ্চারণ করা যায় কিন্তু অন্তরঙ্গে আনার স্পর্ধা দেখানো যায়না? অগ্নিকে আলিঙ্গন কেই ই বা করেছে কোনদিন? তাহলে কি যে অনীশ্বরকে ভিত্তি করে কমলিনী ও শৈবলিনী সাম্রাজ্যজয়সুলভ সুখলাভ করেছিলেন সেইই শ্রী ও নীলাদ্রীর মধ্যবর্তী আলোকবর্ষ ব্যবধানের মূল রহস্য? 


স্বধা পৃথিবীতে আসার আগে ও পরে, মাত্র একবার, প্রথম ও শেষবারের মতো নীলাদ্রীকে আঘাত করতে চেয়েছিলো শ্রী, যদি রূপকথার মতো গুহামুখ থেকে পাথর সরে গিয়ে জন্ম নেয় নদী না হোক অন্তত কোনো সিল্করুট। সে তখন দ্বিতীয়বারের জন্য সন্তানসম্ভবা। ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ তখনো নিষিদ্ধ না হওয়ায় কে আসবে সে জানত। 

-- "পুত্রার্থে ক্রিয়তে ভার্যা"
যাক, তোমাকে অন্তত এই যুক্তিতে বিয়েতে রাজি করানো গেছিল"

মুহূর্ত কয়েকমাত্র। উত্তর এসেছিল...


-- "নির্বাচন করো শ্রী। আমি তোমায় চব্বিশ ঘন্টা দিলাম। তুমি এই সন্তানকে জন্ম দেবে কিনা, দিলে আমায় সারাজীবনের জন্য হারাবে। যদিও আমি আমার জীবদ্দশায় তোমার কোনো দায়িত্ব কর্তব্যেই ত্রুটি রাখবো না সে তুমি যে সিদ্ধান্তই নাও। স্বামী কিনা, প্রেমিক তো নই"


পরবর্তী ইতিহাস কোনো পাঁচালী নয়। গর্ভস্থ পুত্রটি হত্যা হয়েছিলো। আর ঠিক সেইদিন থেকে স্বধা দেখেছিলো কীভাবে একই রাতের আকাশের নিচে একই যুদ্ধক্ষেত্রে অন্ধ নৈশব্দ্য নিয়ে পাশাপাশি অবস্থান করে দুই শত্রুশিবির, পরের কোনো সূর্যই যেখানে এমন আসেনা যখন শঙ্খনাদে রণ ঘোষিত হবে। শুধু অস্ত্রেরা নিপুণ থেকে নিপুণতর হতে থাকে, কৌশলেরা নিখুঁত থেকে নিখুঁততর, লক্ষ্যরা তীক্ষ্ থেকে তীক্ষ্তর আর দূরত্ব... অনতিক্রম্য।



স্বধা শুধু ভেবে চলে মাধবের 'শত্রু' সম্বন্ধীয় শ্লোকটি। কী প্রবল পারস্পরিক সংবেদী হলে দুইটি অস্তিত্ব এইভাবে নিজেদের উন্মাদ ক্ষয়কে শক্তিস্তম্ভে প্রতিস্থাপিত করতে পারে? সমর্পণ নয় অথচ প্রত্যাহারও নৈব নৈব চ। যদি এ প্রেম না হয় তাহলে আজ অবধি পৃথিবীতে একটিও কবিতা লেখা হয়নি। 




সুবীর সরকার

                         


     

গৌরীপুরের পান আর গোলকগঞ্জের গুয়া
সুবীর সরকার

১৭.
ইয়াকুব ব্যাপারীর সঙ্গে আবার আমাদের দেখা হয়ে যায় ঘুঘুডাঙার হাটে।তখন মধ্য দুপুর।ভরা হাটের
গুমগুম শব্দ।ইয়াকুব গরুহাটির পাশে ঝাঁকড়া শিমুল গাছের নিচে ভবেন বৈরাগীর গান শুনছিল।ভবেনের গায়কখ্যাতি তিরিশ চল্লিশ গঞ্জ হাটে কিংবদন্তির মত।গৌরীপুরের লালজি রাজা তার গান.

ভালোবাসে।প্রতিমা বাইদর দলেও একসময় দোতরা
বাজাতো সে।
হাটে হাটে গান গেয়ে গেয়েই জীবন কাটিয়ে দিল ভবেন বৈরাগী।
ইয়াকুব আজ বায়না করেছিল দেহতত্ত্ব মনশিক্ষার
গানের।
আমরা যখন ইয়াকুবকে ভরা হাটের পাশে ঝাঁকড়া শিমুল বৃক্ষের নিচে আবিষ্কার করি,তখন সে ভবেনের
গানে উদ্বেল_
"ওরে টাকা পয়সা ভিটা বাড়ি
জীবন গেইলে সব রইবে পড়ি
সঙ্গের সাথী তোর কেউ তো হবে না"
গান শুনতে শুনতে ইয়াকুবের চোখ ভিজে যাচ্ছিল চোখের জলে।
সে কি দূরাগত হাওয়ায় মৃত্যুর ঘ্রাণ পেয়েছিল!
জন্ম কিংবা মরন নিয়ে কোন দার্শনিকতা তাকে আক্রান্ত করেছিল!
সমাধানহীন এই প্রশ্নের ফাঁকে ফাঁকে গান কিন্তু বেজেই চলছিল_
"আরে হাতি মার্কা কেরাসিন তেল
কায় বা আইনছেন দ্যাশতে
বাপরে বাপ 
মাওরে মাও
আজি মোর গাও ঝনঝন করে রে"
১৮.
গঙ্গাধরের উজানে মাইল মাইল হাঁটতে হাঁটতে একসময় দাড়িয়েই পড়তে হয় বিমল মালিকে।
সে মুখ ফিরিয়ে পেছনে শীতের নদীকে দেখে।বিমলের কাধে ঢোল।গোয়ালপাড়ার কাঠি ঢোল।
এই ঢোলের জাদুতে অন্তহীন গানবাড়ির মানুষেরা উদ্বেল হয়ে ওঠে। বিমল মালির ঢোল কথা বলে।মানুষের দৈনন্দিন যাপন গানে আর ঢোলে ছড়িয়ে পড়ে দিক ও দিগরের দিকে।
"রাজার বেটির" দলে কত কত বছর জুড়ে বেজে চলেছে বিমল মালির জাদু ঢোল।
গত রাতে বিমল গিয়েছিল সিতানন্দ বুড়ার বাড়ি।
সীতানন্দর সারিন্দা আর বিমলের ঢোল_প্রায় সারারাত চলেছিল তাদের আসর।এমন আসর প্রায়ই বসে তাদের।সঙ্গে "চাওলা" আর "নাসিরউদ্দিন বিড়ি"।
গান চলে।গান থামে।
দুঃখ সুখের কথা হয়।দেশ গ্রামের কথা হয়।
এভাবে মত্ততা জাগে।স্মৃতিকন্দর থেকে ভুস করে জেগে ওঠে গানের কলি_
"বুড়া মাছ মারে রে
গঙ্গাধরের পারে
মাছ মারিতে মাছ মারিতে
বুড়াক নিল চিলে"
অন্যমনস্কতার ঘোর থেকে একসময় বেরিয়ে আসে
বিমল মালি।তারপর সে আবার হাটতে থাকে
গঙ্গাধরের উজানে।
এভাবে কত গল্প জমে ওঠে আমাদের এই চারপাশের পৃথিবীতে।