রবিবার, ২৮ জানুয়ারী, ২০১৮

অর্ঘ্য দত্ত



মিউজের বাকোয়াস- ২০ //


মখমলে মুড়ে রাখি চুম্বনের ঠোঁট
লজ্জাবতী লাব-ডুব নমিত রেখেছি
করতল খুলে রাখি যাক ঝরে যাক
মগ্ন এই কুয়াশার মিরুজিন চোখ



অথচ কী স্বাদু ছিল প্রথম কম্পন
উচাটন, প্রেমভাব, কুসুম কুসুম
মনে আছে, ফুটেছিল জুড়ুয়া জারুল
একসাথে? সব ঢেউ থেমেছে এখন

থেমেছে কি! সব দাগ মুছেছে জনাব?
কোথাও কি লেগে নেই পাপড়ির ঘ্রাণ?
সারারাত কত কথা, সব ভুলে যাব!
ভুলে যাব ডান ঘেঁষা ও কন্ঠার তিল?


একদিন দেখা হলে দু চোখ বুজেই
চিনে নেব মোহনীয়া যাদুকরী তোকে

************************************************

মিউজের বাকোয়াস- ২১ //

তোকে ছোঁবো বলে হাঁটুতে ভেঙেছি প্রিয় বাঁশি,
গুনে গুনে রাখি উনিশ পাপড়ি ওই পায়ে!
করতল মেলে ডেকেছি তোকেই, প্লিজ চলে
আয় ন্যাকা ওই নন্দকিশোরটিকে ভুলে...

চেনা এই খেলা, তুইও যেমন ছাড়বি না সে'
কচি শ্যামরায়, আম্মো বেহদ বদের ধাড়ি
দূর থেকে তোকে সোহাগে রেখেছি কী দায়হীন!
এক সাথে শুধু জোছনা চেটেছি চাঁদ খুঁটে


আলো কমে এলে, চকোর চকোরী দুটি যেন
উড়ে উড়ে রোজ ডানা মেলে মাখি সে শবনম

**********************************************************

মিউজের বাকোয়াস- ২২
ফিরে পাওয়া শহর ঘেঁটে খুঁটে তুলছি রঙ
শার্সি ভাঙা কাচের কান্না, রাত জাগা অক্ষর
ছুঁয়ে ফেলছি দুখ জাগানি আমলকি চোখ জোড়া
উফ্, পারি না! সেল্ফি এবং ছুঁই-মুঁই উচাটন

এ শহরেই কাদের যেন দেখা হয়েছিল
পাগলা শহর পোষ মেনেছে বাধ্য ছেলে আজ
পথের মোড়ে মানুষের ভিড়, গাড়ি, আলো সবই
আছে, কেবল দেখা হওয়া মিটে গেছে কবেই

সে দর্শনে, হ্যা, ছিল খুব ড্রামাবাজি নাকি
ভিজে পল্লব যেমন চির তৃষ্ণা শিশিরের
সারারাত্রি জেগেইছিল মধুকূপীর কাম
ঘুচেও গেল হঠাৎ খেলা বেলা না যেতেই


নেই দেখো আজ উঁচু বল্লম, মিছিল তলোয়ার
কী শান্ত এ শহর! শুধু বুকের ভিতর সন্ত্রাস...

শনিবার, ২৭ জানুয়ারী, ২০১৮

শুভাশিস , পারমিতা

হিলস্টেশনের ঘুম
১)
 খিদের সামনে বসে 
নরম একটা সংকোচ 
হাত রাখলেই গলে যেতে পারে 
২)
একদিন ফিরতে হলে 
ঠোঁটের পরোয়া করবো না 
অরণ্যের শোকমিছিলে সামিল হব
পাতা সরিয়ে দেখে নেব 
"বিসর্জনঘটিত তার গলি ও গন্তব্য"
৩)
একটা অতিক্রমযোগ্য ভুলের পর 
শীত রাম অবতারে 
শুধরে নিতে চাইলে 
তিন পেগ মগ্নতাই যথেষ্ট 
৪)
কেউ হিসাব রাখেনি 
কতটা স্তব্ধতা ভাঙলে - তিস্তার পাথর গলে 
মেজাজ বদলাচ্ছে অনিকেত 
শরীরের এবং ঠোঁটের

এখন টেবিলজোড়া নিবন্ত সিগারেটে চেয়ে  হিলস্টেশনের ঘুম 

সম্পাদকীয়



সেসব আমলকী মাখা শাখায় প্রতি রাতে কোকিল ডাকে 
যেমন করে হাওয়া প্রতিবেশী হয় পৌষের বুকে 
এই তো সেদিন হাঁটতে দেখলাম অফিম দানার বিকেলকে 

সে রাতে মৃত্যু এসেছিল জানলার কাছ থেকে
কোথাও এতটুকু চিড় পড়েনি 
শিশিরকণাকে মূক ,বধির হতে দেখেছিলাম 
সবান্ধবে 

শহর যখন গ্রামকে তাচ্ছিল্য করত মাছের কানকোর মত
কিশোর থেকে যুবতী মাঠ এক হয়েছিল
মাতৃজঠর থেকে ভূমিষ্ঠ শিশুর কান্নার মত 

কোথাও এতটুকু দাগ পড়েনি


শীতকাল মানেই উৎসব I আর সেই উৎসবের  সাথে তালে তাল মিলিয়ে থাকে নলেন গুড়ের সুবাস৷পলাশ মাখা বিকেলে একত্রিত হয় শব্দের অনুরাগ৷আর তার সাথে যোগ হয় বইমেলা বা বই উৎসব ৷  মেলা হল এমন এক ক্ষেত্র যেখানে ভিন্ন মানুষের আনাগোনা হয়ে থাকে  ৷ ইতিমধ্যে জেলাভিত্তিক লিটিল ম্যাগাজিন মেলা শুরু হয়ে গেছে । আসন্ন কলকাতা বইমেলা ৷ নতুন বইয়ের গন্ধ সমস্ত বইপাড়াগুলোতে ৷ বই হল এমন এক  মাধ্যম দুটি ভিন্ন হৃদয়ের মানুষের যোগসূত্র স্থাপন করে । 

" সৃজন " অনলাইন সেই কাজটি করে চলেছে নিরলস ভাবে ৷ বইমেলা অাসলে বইপ্রকাশ হয় ৷ এই বইগুলোর সাথে আপনাদের পরিচয় ঘটানো  " সৃজন " ও " শব্দের হাতেখড়ি " গ্রুপের কাজ ৷ এই কাজে আপনাদের সহায়তা আর বেশী দরকার ৷"আমার সৃজন " দ্বিতীয়  ও মুদ্রিত সংখ্যা আসন্ন ।



প্রতিনিয়ত যুক্ত হচ্ছেন  
" সৃজন "এ  নবীন ও প্রবীণ লেখক / কবিবৃন্দ ৷ পলাশ রঙে সেজে উঠেছে "সৃজন " দ্বিতীয় বছর প্রথম সংখ্যা । আপনার সৃষ্টি আমাদের কাছে পাঠিয়ে দিন দ্রুত  ৷আপনারা  থাকুন আমাদের সাথে আরো ভীষণ ভাবে ৷ " সৃজন " ,
"আমার সৃজন "  আরো বিস্তারিত হোক  এটা আমাদের আশা৷ ভালো থাকুন সবাই । সৃজনে থাকুন ৷

চিত্রঋণ : পাবলো পিকাসো


তুষ্টি ভট্টাচার্য

রুমি ও আমি /

আয়না বলেছে – আমি সুন্দর
আমি বলেছি রুমিকে –
বিচ্ছেদের গুজব রটেছে চারিদিকে
ওই তারাগুলো তবুও নীল ওড়নার আড়াল থেকে
মোমবাতির মত আমাদের ডাকছে
যেন ওখানে এক অদৃশ্য সমতল ভূমি রয়েছে
যেন ওখানে কিছু আশ্চর্য মানুষের বাস!
এই অনন্তের মাঝে সুন্দর থাকে
এক অসীম একাকিত্বের মধ্যে তার ওড়না খুলে দেয়

সে তার মুখের সামনে আয়না তুলে ধরে
আর নিজের সুন্দর মুখ দু হাতে তুলে ধরে ভাবে,
একে আমি চিনি, অনেকটাই চেনা যেন এই মুখ
আমার চোখ নেই, তবু এরই সুন্দর চোখ
অনন্তকে দেখে ফেলেছে!

সুন্দর ভালবাসার ঘরে থাকে।   

ফাল্গুনী ঘোষ

বেড়ু বেড়ু ৪
 জয় মাতা দি
    আধা জাগরণ আধা ঘুমের ধোঁয়াশা ছিঁড়ে ‘কুঁকুরু কুঁ’ ডাকে তেড়েফুঁড়ে উঠল মন। না না, মোরগ মুরগী ভাবার কারণ নেই, ডিজিটাল যুগ কিনা! ভোর চারটেতে গরম জলের ধারায় শরীরের আড় ভাঙতে না ভাঙতেই হাজির সেই রাজপুত্তুর। আহা এজেন্ট কয় যাহারে! ‘যাত্রী পরচি’ বানানোর অফিসিয়াল খুঁটিনাটি সেরে লাইনবন্দী ঘোড়ার সামনে দাঁড়ানো। জীবনে ঘোড়া অনেকবারই দেখেছি, কিন্তু এইরকম তেজী, নরম, কর্কশ, মোলায়েম নানান পরিচয় ও আকৃতির ঘোড়া দেখে মন বেশ থমকে গেল। আমি তো আর রাজপুত্রী হয়ে জম্মায় নি রে বাবা! নিদেনপক্ষে ইংরেজ আমলের লেডি। এই পাহাড়ি রাস্তায় ঘোড়া ছুটবে টগবগিয়ে, আর আমি ঘোড়ার পিঠে! বয়স্ক মায়ের কথাটা তাহলে একবার ভাবুন! আমাদের ছ’জনের টিমে কাকু, কাকীমা, জেঠ্যু জেঠিমার দলে আমিই শুধু ‘হংসমধ্যে বক যথা!’ আমার মুখে নিরুপায় হয়ে তাই দেঁতো হাসি ঝোলাতেই হল।
    কিন্তু ওকি দেখি! চিরিদিনের ঘোমটা টানা বাঙালি গৃহবধূরা আজ দলে দলে চুড়িদার পাজামা’তে সজ্জিতা। পোশাকের সাথে সাথে মনের ভারও তাদের হালকা হয়ে উঠেছে দেখলাম। আমার এইসব ভাবতে ভাবতে তাঁরা অশ্বারোহী। প্রত্যেকটা ঘোড়ার সাথে একটা করে সহিস। আমার কপালে জুটলো তাজা ছটফটে ঘুড়ী। সে মহিলা আবার মাঝে মাঝে হালকা চালে দৌড় বা নেচে নেয়। সব শুনে মনে হল এর থেকে হাঁটা ছিল ভালো। আর রাজপুত্ররূপী এজেন্ট সেই যে মুখে হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে, তাতে এক বাঙালি ললনার চোখে ভীতি দেখলে সে যে সমগ্র বাঙালি নারীদের লজ্জা, সে অস্বীকার করার নয়। সুতরাং ঘোড়াযাত্রা শুরু হল। প্রথমে ভয়ে ভয়ে ঘোড়ার রাশটি প্রাণপণ আঁকড়ে থাকলেও সেই দুলকি চালে শরীর অভ্যস্ত হতেই মন আর চোখ ছুটে গেল দুপাশের দৃশ্যে। ঘন সবুজের চাদর মোড়া পাহাড়ের দুর্ভেদ্য অন্ধকার ভেদ করে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। হিমেল হাওয়ায় হেমন্তের অনুভূতি। সারারাত হেঁটে ক্লান্ত কোনও যাত্রী পথের পাশে পা ছড়িয়ে ঝিমোচ্ছে। স্থানীয় কিশোর গরম তেলে জলের মালিশ দিচ্ছে উদরপূর্তির আশায়। সে খাড়াই রাস্তার দুপাশে অগুনতি ঝুলন্ত দোকান খাবার ও ধর্মীয় পসরা নিয়ে। এদের ঈশ্বরসাধনার মূল মন্ত্রই হল—“ আরামসে চলো! সামালকে চলো! খাতে খাতে চলো!” উপোসী হয়ে দন্ডী কাটা এই প্রকৃতি ও পরিবেশে পোষানোর নয়।
    যেহেতু সারারাত পূণ্যার্থীদের সমাগম তাই পাহাড় তার সম্পূর্ণ সত্তা নিয়ে জাগছে তাতো বলা যায় না। তবে কোথাও আড়মোড়া ভাঙছে তো কোথাও ঝিমুচ্ছে। হঠাত ঘোড়া দুলকি চাল ছেড়ে নাচতে শুরু করল। আমার মনের প্রশান্তি যে আমার ঘোড়ার দিকে ট্রান্সফার হয়ে তাকে আনন্দে উজ্জীবিত করে তুলবে কে জানত! ‘ওরে বাবা! বাঁচাও!’ মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলেও সহিসের জন্য বাকি গালিগালাজ গুলো মনে মনেই সমাপ্ত করলাম। কিন্তু কোথায় কি! আমার চীৎকার সার! ওদিকে ঘোড়া ছেড়ে সহিস বাকিদের সাথে ‘ডোগরী’ ভাষায় আলাপে মশগুল।


আমার চীৎকার শুনে সে কি সমবেত হাসি! “জলদি আইয়ে। আ কর থামাইয়ে!”— আমার মুখ নিঃসৃত এই রাগমিশ্রিত চোস্ত হিন্দীও তাদের জোরালো হাসির বড় কারণ ছিল বোধহয়। কারণ এরা যে বাংলাটা বেশ বোঝে তা মালুম হয়েছিল শ্রীনগরের ডাল লেকে। সে গপ্পের জন্য অবশ্য আপনাদের ধৈর্য রাখতে হবে। যাকগে সহিসের হাতের সিপিসিপে বেতের বাড়ি আর ‘চল কুড়ি! ধিককিত ধিককিত’—এই ধমকে আবার ঘোড়া দুলকি চালে ফিরল, আমার জানে জান এল।
    ঘোড়া, ব্যাটারিচালিত টোটো এইসব অধ্যায় পেরিয়ে মাতারানীর ভোগ কিনে ‘লাইন লাগাও’। মূলমন্দিরের কিছু আগে থেকে সেই বিপুল জনস্রোত। নিজের পায়ে দু’পা আর স্রোতের টানে দশ পা এগিয়ে যাবেনই, পিছোনোর সম্ভাবনা নেই পাক্কা। এই কায়দার মাঝে এজেন্টের ‘চালাকি ন চলিষ্যতি’। ত্থুত্থুড়ে দাদু, টগবগে জোয়ান, ছটফটে উচ্চিংড়ি বাচ্চা, হাঁসফাঁসে হিন্দিভাষী বহুরানী সব্বার মুখে নাড়া –“জোরসে বোলো জয় মাতা দি!” “ফিরসে বোলো জয় মাতাদি!” আমার মত নাস্তিকের মুখ দিয়েও দু-একবার বেরিয়েছিল বৈকি। তবে গুহাবাসিনী বৈষ্ণদেবীর কাছে পৌঁছানোর রোমাঞ্চ মার্বেল, টাইলস মোড়া সিঁড়ি নষ্ট করে দিয়েছে। সেই শিকড়বাকড় ঝোলা, নুড়ি পাথরে পিচ্ছিল অন্ধকার গুহার বন্ধ দরজার মুখে বিষণ্ণ মন ঠোক্কর খেতে থাকল। এইবার সময় পেয়েছি কিছু মিথ কপচানোর। তাছাড়া দেবীমহিমা দু-চার কথা না কইলে নয়, পাপ পূণ্যের একটা ব্যাপার আছে। দেবী এখানে পিন্ডি রূপে ধরা দিয়েছেন। মহালক্ষ্মী, মহাকালী, মহাসরস্বতী রূপে অধিষ্ঠাত্রী বৈষ্ণদেবী ভীষণ জাগ্রত। পিন্ডিরূপিনী দেবীর চরণতল থেকে নিঃসৃত জলস্রোত চরণগঙ্গা নামে পরিচিত, যা পান করলে রোগমুক্তি হয়। এটাই জনশ্রুতি।

      এই গুহাগুলি কিকরে তৈরী হল তা আজও কুয়াশায় ঘেরা কুহেলিকা। মোট তিনটি গুহার মধ্যে  শুধুমাত্র একটি গুহাই জনসাধারণের জন্য খোলা থাকে বাকি গুলো বিভিন্ন সময়েই বন্ধ। মহাভারতে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকালে অর্জুন এই মহাদেবীর উল্লেখ করেন, যিনি যম্বু( জম্মু ও কাশ্মীর) পর্বতে অবস্থান করেন। ত্রিদেবী। মন্দির স্থপতিদের দাবী, প্রায় ৭০০ বছর আগে স্থানীয় কোনও পুরোহিতকে কন্যা রূপে মা দেখা দেন, আর স্বপ্নে এক দুর্গম গুহা পথের নির্দেশ দেন। ত্রিকূট পাহাড়ের সেই চূড়োয় যাত্রা করলে ব্রাহ্মণ গিয়ে তিনটি পাথরের শিলা পান। দেবী তখন তাকে তাঁর স্বরূপ দেখান। তখন থেকেই বৈষ্ণদেবীর পুজো প্রচলিত হয়। এই সব তথ্যের ঠিক ভুল বিচারে বসার ভুল করলে হতাশ হবেন কারণ আমার সব ঐ ‘এজান্টায় নমঃ।’ বকতে বকতে এবার জিভ তালু সব শুকিয়েও এসেছে তাছাড়া।
    পুজো, ভোগের থালি, পবিত্র জল এদের সাথে পাল্লা দিয়ে পেটে ছুঁচোর দৌড় দুশ থেকে চারশ মিটারে পরিণত হচ্ছে দেখে মন্দির থেকে বেরিয়ে আলু পরাঠা, ছোলে বাটোরা(সব নিরামিষ্যি) যা যা গোগ্রাসে ঢোকে থলিতে ঠুসা হল। নাহলে এইসব বুড়োবুড়িদের নিয়ে আবার ঘোড়দৌড় করতে হবে হেলিপক্টার স্টেশনে। ফট- ফট- ফট... গোঁ গোঁ আওয়াজে কান ফাটিয়ে লাল কালোর কনট্রাস্টে দুটি কপ্টারের চরকিবাজি চলছে ‘সঞ্জিছট’ এরোড্রামে। কাটরা থেকে সঞ্জিছট তিন-চার মিনিটের উড়ানের চক্কর। কপ্টারযানে সওয়ারি হওয়ার এই প্রথম অভিজ্ঞতা। রীতিমতো হুকোমুখো হ্যাংলার হাঁ নিয়ে ধুলোর ঝড় গিলছি। এক ট্রিপে ছ’জন। ওজনের মাপজোপ করে দুই কাকু কাকীমা অন্য দলে ভিড়লেন। মাথার উপরে মাঝ দুপুরের চড়া রোদ্দুর, আর এরোড্রামের চারদিকে ছবি তোলার কড়া নিষেধ। প্লাস্টার চটে যাওয়া লাল-হলুদ রাস্তাপথের নির্দেশের মুখে দাঁড়িয়ে মোবাইলে লুকোচুরি খেলতে খেলতে যথাস্থানে ডাক এল।

      এবার আমাদের নম্বর। আমার জায়গা হল সামনে। চালকের আসনের পাশে চৌকি চেপে (পড়ুন সিট চেপে) কষে আমাকে বেঁধে দেওয়া হল। মন তখন ফুরফুরে। পাখির মতো আকাশে চক্কর কাটতে কাটতে নীচেটা দেখব। আহা! গোঁত্তা খেয়ে একবার আকাশে উড়ুক। ডাইনে, বাঁয়ে, সামনে কাঁচের ফটফটে জানলা। পায়ের নীচে একটু এগিয়ে ইঞ্জিনের কাছে ইঞ্চিখানেক ফাঁকা জায়গা। আশ মিটিয়ে দেখে নেব! এই তো ডানা মেলেছে। কিন্তু পেটের তলার দিকটা হালকা লাগছে কেন! পা কি ছেড়ে গেল নাকি! অনুভব করছি না তো! আর পায়ের নীচের ঐ ফাঁক থেকে ঘন সবুজ পেল্লাই পাথরের স্তুপগুলো ওরকম কটকটে চোখে চাইছে কেন! হে মাতারানী, আমি না করলেও মা তো মন দিয়ে পুজো করেছে। জয় মাতা দি!
    হোটেলে ফিরে আলুপোস্ত কলাইয়ের ডাল ভাত খেয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লুম। আলসে কুঁড়ে, আড্ডাবাজ বাঙালি হয়েই জীবন সার্থক বাপু। বিকেলে অন্যান্য সহযাত্রীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাত পা মেলে  হোটেলে বা হোটেলের সামনের সারিবাঁধা দোকানপাট থেকে ‘মাতারানীর’ রেপ্লিকা ব্যাগে পুরে কাটাচ্ছিল। আর আমি ব্যাগ সামলাতে সামলাতে সুইজারল্যান্ডের দিবাস্বপ্নে বিভোর হচ্ছিলাম। আরে আমাদের ভারতের সুইজারল্যান্ড।  

ভজন দত্ত


            ।।  পুরুলিয়ার মুখ ।।
প্রথম পর্ব :
                                    
১.
কবি,প্রিয় কবি।'বাংলার মুখ' কবি দেখেছিলেন। তিনি তো কবি, দেখতেই পারেন, অসুবিধে কী! প্রিয় পাঠক, প্লিজ আমাকে এ প্রশ্ন করে বিব্রত করবেন না। আমি দুটি হাত তুলে আত্মসমর্পণ করছি। তাতে শান্তি না হলে,করজোড়ে মার্জনা চাইছি,আঞ্চলিক আমি, 'দেখা হয় নাই মুখখানি '।দার্জিলিং এ গিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা পর্বতকে দেখে মনে হয়েছে এই বুঝি সেই। আবার দীঘা বা সুন্দরবনে গিয়েও তাই মনে হয়েছে।
এবঙ্গের প্রান্তভূমি পুরুলিয়ার চড়িদা গ্রামে যখন দেখছিলাম মুখোশ তৈরির 'কারিকুরি ' তখন মনে হলো এই তো সেই। না।আমি বাংলার মুখ খুঁজতে চাই না, বাংলার মুখ মনে করে করে কষ্টার্জিত নিদ্রাকে পরিত্যাগ করতে চাই না।( আজ ১৯/০১/২০১৮এ লেখা যখন লিখছি, তখন বাংলার মুখ মনে করলেই দেখতে পাচ্ছি সেই বুলেটবিদ্ধ নিষ্পাপ শিশুটিকে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এলোমেলো হয়ে যায় সব অক্ষর।পাঠক মাফ চাইছি। পারলে অপ্রাসঙ্গিক প্রসঙ্গ উথ্থাপনের জন্য ক্ষমা করবেন।)



আমি পুরুলিয়ার মুখ, হ্যাঁ, মুখ দেখেছিলাম, মুখোশ নয়।পুরুলিয়া জেলার বিখ্যাত পাহাড় অযোধ্যর পাদদেশে, বাঘমুন্ডি ব্লকের গ্রাম চড়িদা-য়।পুরুলিয়ার চড়িদা গ্রামে তৈরি 'ছো নাচ' এর মুখোশ আজ যথার্থই তা পুরুলিয়ার মুখ হয়ে উঠেছে। তা কি, বাংলার মুখ নয়? কবি কি দেখেছিলেন কোনোদিন, কোনোদিন কি এ অহল্যাভূমি তাঁর পাদস্পর্শে ধন্য হয়েছিল?
বাংলার মুখের একদিকে আমি দেখতে পাই পুরুলিয়ার মুখ আঁকা আরেকদিকে বাঁকুড়ার পাঁচমুড়ায় তৈরি পোড়ামাটির ঘোড়া।
২.
গ্রামের নামটি কেউ বলেন চড়িদা, কেউ বা বলেন চোড়দা। তা নামে কি এসে যায় তো পুরনো কথা। বাঘমুন্ডির রাজবাড়ি থেকে প্রায় তিন কিমি দূরে একবর্গ কিমি জুড়ে একটি গ্রামকে বিখ্যাত করে দিয়েছেন ছো নাচের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী, পদ্মশ্রী গম্ভীর সিং মুড়া। তিনি বলেছেন, মুখোশ না থাকলে  তাঁদের নাচ এত বর্ণময় হয়ে উঠত না।এই গ্রামের সূত্রধর  সম্প্রদায় মুখোশ তৈরির সঙ্গে যুক্ত।
গ্রামটি দুদিকে পাহাড় ও অরণ্য দিয়ে ঘেরা।রসহীন পাথুরে জমিতে সামান্য  কিছু চাষযোগ্য জমি।আকাশের বৃষ্টিতে পাথর না নড়লে চাষাবাদ করা যায় না সেসব জমিতে।এরমধ্যেই তাঁরা বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে নিয়েছিলেন।
তরুনদেব ভট্টাচার্য তাঁর 'পুরুলিয়া' গ্রন্থটিতে লিখেছেন।চড়িদা গ্রামের সূত্রধরগণ এসেছিলেন বর্দ্ধমান জেলা থেকে। ভাদু সহ অন্যান্য দেবদেবীদের মূর্তি গড়ে দেওয়ার শর্তে বাগমুন্ডির রাজা তাঁদের  জমি দিয়ে এখানে এনে বসিয়েছিলেন। সেসব মূর্তি তৈরি হত মাটি দিয়ে।
চল্লিশ - পঞ্চাশ বছর আগে ছো নাচের মুখোশ তো সারাবছর বিক্রি হত না।তাই জীবিকার প্রয়োজনে তাঁরা একসময় পালকি, কারুকার্য়সহ কাঠের আসবাবপত্রও তৈরি করতেন। প্রতিমা তৈরির সময়ে অনেকে দূর দূর জায়গায় গিয়ে প্রতিমা তৈরি করার কাজেও যুক্ত হতেন। এখনো তাঁরা যান বিভিন্ন জায়গায়।
৩.
উপকরণ:
এখানে যে মুখোশগুলি তৈরি হয় তার প্রধান উপকরণ হল, এ্যাঁটেল মাটি,পুরাতন খবরের কাগজ,ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো, ময়দা,আঠা, তেঁতুলের বীজ দিয়ে একরকম আঠা,মুখোশগুলি পালিশ করার জন্য গর্জন তেল, ধুনো,নকল চুল,পাখির পালক,পাট, নানা রকমের পুঁতি, রাংতা, শালমা, বিভিন্ন রঙের ও সাইজের চুমকি ও সাধারণ কিছু যন্ত্রপাতি।
পদ্ধতি :
প্রথমে ছাঁচে ফেলে তাঁরা মূর্তিগুলির মুখমন্ডল তৈরি করেন। কিছুটা শুকনো হলে তার উপর ছাইয়ের গুড়ো ছড়িয়ে দেওয়া হয়। ওঁদের কথায় 'ছাঁচা' তৈরি।
এরপর তাঁরা পাতলা আঠার মধ্যে মাপমতন কাগজ ভিজিয়ে ঐ ছাঁচার ভেতরের দিকে আটকে দেওয়া হয়।এভাবে ৭- ১০ বার করার পর, আঠায় ভেজানো কাপড় ও কাগজ দিয়ে তা আরো মজবুত করা হয়। শক্তপোক্ত করা না হলে মুখোশগুলি পরে ছো নাচের মত বীরত্বপূর্ণ নৃত্য প্রদর্শন করা যায় না।
তৃতীয় ধাপে চলতে থাকে চরিত্রানুযায়ী মুখোশগুলির রূপদান। নির্মিত ঐ ছাঁচাটির ওপর মাটি দিয়ে নাক,চোখ,মুখ,ঠৌঁট,থুতনি,কান সব করা হয়। এরপর গোলা কাদামাটির মন্ডে পাতলা মিহি কাপড়ের টুকরো দিয়ে ওই ছাঁচাটির ওপরে টানটান করে আটকানো হয়। এই প্রক্রিয়াকে ওরা বলেন 'কাবিজ লেপা '।
পরের ধাপে শিল্পীরা তাঁদের দক্ষ হাতে সেগুলিকে পালিশ করেন কাঠের তৈরি এক কর্ণিক দিয়ে।একে ওরা বলেন 'থাপি' বা 'থুপি'। পালিশের পর রোদে শুকিয়ে নেওয়ার পালা শুরু।আধশুকনো হলেই ওই ছাঁচা থেকে কাগজ ও কাপড়ের আবরণ খুলে ফেলা হয়।বাড়তি কিছু থাকলে তা কাটছাঁট করে সেই অবয়বটিকে নিঁখুত করে তৈরি করার চেষ্টা হয়।
এর পর ঐ অবয়বে চোখ ও নাকের জায়গায় ফুটো করা হয়। ছো নাচের শিল্পীরা যাতে মুখোশগুলি পরে দেখতে পান ও শ্বাসপ্রশ্বাস কাজ চালাতে পারেন সেদিকে বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখেন তাঁরা।
এভাবে মুখোশের কাঠামো তৈরির কাজ শেষ হলে শুরু সেই মুখোশগুলিতে চরিত্রানুযায়ী রঙ করার কাজ শুরু হয় প্রতিমা তৈরির মতো। গর্জনতেল লাগানো হলে এই পর্যায় শেষ হয়।
সেগুলিকে চুল,চুমকি,শলমা,রাংতা,পুঁতি, পালক ইত্যাদি যা দরকার তাই দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয়।
মুখোশশিল্পীরা রামায়ণ, মহাভারত,পুরাণ বর্ণিত রূপ অনুযায়ী সেগুলিকে সজ্জিত করে থাকেন।
মুখোশ নির্মানের ক্ষেত্রে চড়িদা প্রাচীন ঐতিহ্যধারাকে অনুসরণ করে চলেছে বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছেন।
(পরের সংখ্যায় সমাপ্ত হবে) 


আলোকচিত্র : উজ্জ্বল দাস। 

অজিত রায়


আমায় ঘিরে যে নদী
-----------------------------------
দামোদর আমার কাছে এক অবসেশন।
ঝাড়খণ্ডের পালামৌ জেলার টোরির কাছে সাড়ে তিন হাজার ফুট উঁচু খামারপৎ পাহাড় থেকে নির্গত হয়েছে পূর্বভারতের অন্যতম উল্লেখযোগ্য নদ দামোদর।  যে জলধারাগুলি নেমে এসেছে ঐ পাহাড়ের গা বেয়ে, সেগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড় ধারাটির নাম সোনাসাথী।  এই সোনাসাথীই দামোদরের উৎস।  রামগড়ের শ'খানেক কিলোমিটার পশ্চিমে হাজার ফুট উঁচু হাজারিবাগ পাহাড় পেরিয়ে নাম নিয়েছে 'দামোদর' (অনেকের মতে 'দামুণ্ডা' থেকে এসেছে দামোদর নামটি।  জৈন নির্বাণগ্রন্থে বরাকর নদকে বলা হয়েছে 'ঋজুকলা'।  কল্পসূত্রে এই নদই 'উজ্জুবালিয়া'।  বরাকর বা দামোদর নামের উৎস নিয়ে বিতর্কের সমাধান আগেই হয়ে গেছে।  প্রবাদ মতে, 'ক্ষুদে, নোনা, বরাকর ---- এই তিন নিয়ে দামোদর'।  সুতরাং ঋজুকলা, ঋজুপালিকা আর উজ্জুবালিয়া এই দামোদরই।)  রামগড়ের ভুরকুন্ডার কাছে বাঁক নিয়ে রামগড়-হাজারিবাগ রোডের তলা দিয়ে চিত্তরপুর-গোলার দিকে এগিয়ে কিছুটা দূরে এসে বোকারোয় ঢুকে খানিকটা পুরুলিয়া ছুঁয়ে পুনরায় বোকারো মাড়িয়ে ধানবাদের দক্ষিণ সীমান্তে সিন্দ্রির পাশ দিয়ে কালুবাথানের দিকে ছুটে গিয়ে শালতোড়া থানার শিরপুরনামা গ্রামের কাছে বাঁকুড়ায় ঢুকে, ক্রমশ দক্ষিণপূর্ব দিকে শালতোড়া, মেজিয়া, অর্ধগ্রাম, বড়জোড়া, সোনামুখী, পাত্রসায়ের আর ইন্দাস থানার সোমসারে দামোদর বাঁকুড়া জেলা ছেড়ে বর্ধমান জেলায় ঢুকে রায়নগরের কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ দু-ভাগ হয়ে একটি ধারা ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে তারকেশ্বরের পানে ধেয়ে গেছে, আর অন্য একটি ধারা ৫৬৫ কিলোমিটার দূরত্ব পেরিয়ে অবশেষে গিয়ে মিশেছে বঙ্গসাগরে।
এই দামোদর আমার কাছে এক অবসেশন।
টোরি থেকে ডিসেরগড় পর্যন্ত দামোদরের উচ্চপ্রবাহ।  বরাকরের সঙ্গম থেকে বর্ধমান শহরের আগে পর্যন্ত মধ্যপ্রবাহ।  এরপর জলের তোড় ক্রমশ কমে গিয়েছে।  অতিকায় দামোদর ধানবাদ জেলার তেলমোচো-পারজুরিয়া-তালগড়িয়া-আমলাবাদ-ভাঁওরা-চাসনালা পেরিয়ে কান্দ্রার কাছে সামান্য বাঁক নিয়ে ক্রমশ সিন্দ্রি-কালিপুর-ঘরবার-বেগুনবাড়ি-দলদলি দিয়ে জেলার দক্ষিণ সীমানা চিহ্নিত করে পাঞ্চেৎ ড্যামে গিয়ে বরাকরের সঙ্গে মিশেছে।  একসময় পুরুলিয়া সদর থেকে ধানবাদ মহকুমাকে বিচ্ছিন্ন করেছিল নদীটি।  এঁকেছিল চাস থানার দক্ষিণ সীমান্ত।  ১৯৫৬-এ চাস থানা ধানবাদের অন্তর্ভুক্ত হলে প্রায় সাড়ে তিন দশক ছিল জেলার প্রাকৃতিক সীমারেখা বিলুপ্ত।  ১৯৯১-এ বোকারো জেলার জন্ম হলে এই নদই পুনরায় বিভাজক-রেখা হয়েছে বোকারো-ধানবাদের মাঝখানে।
     মাইথন আর পাঞ্চেৎ বাঁধ নির্মাণের আগে, অর্থাৎ ১৯৫৬-এর আগে পর্যন্ত, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে, শোকেরই শমন ছিল দামোদর।  আগে বলে নিই, যে জলাধার-দুটির উচ্চার এলো, পাঞ্চেৎ আর মাইথন, সে-দুটোয় বহু রক্ত বহু জ্বালা বহু অভিসম্পাত কবরিত।  কত যে গাঁ আর মন্দির জলের তলায় রয়ে গেছে!  আবার, বাঁধ না হলেও অতিকায় দস্যি দরিয়া শোকেরই সমন ছিল একদা, আকাশে আষাঢ় ছাইলে চরায় টান ধরত নৌকোর, মাঝির।  বছরের পর বছর ভয়াল বিগ্রহ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে সে, দামাল দামুণ্ডা।  যেমন তার দাপ, তদনুগ কলোচ্ছ্বাস!  মাকড়া পাথরের রোড়া-বালি আর বড় বড় চাটান-চেরা খাত, দু'ধারে খাড়াই ডাঙা, অনাবৃত কঠোর শিলাস্তর ফেড়ে করোগেটেড বক্ষঃস্থল, যার ভাঙাভাঙা বেবন্দেজ খোয়াই পাড়ে মাটির গোচর মেলে ক্কচিৎ, কাঁধার জুড়ে কোথাও ছাড়া-ছাড়া প্যাংলা বাদাড়, পুটুশ বনতুলসী আর চোরকাঁটার গোঁফ, কোথাও-বা শাদা দানাদার পাথরের নিরবচ্ছিন্ন দাহাড়।  নারী যেমতি, প্রকৃতি যেরম, দামুণ্ডাও কিছুমাত্র উনিশ নয় তার-চে।  কিন্তু ঐ দাপ, ঐ মস্তি, সবই থেৎলে গেছে এই আগুনডাঙা ধানবাদে উচোট লেগে।  এখন দামুণ্ডা সহ এ টাঁড়ের যাবৎ নদী সম্বৎসর শুকিয়ে, অন্তঃসলিলা , এমনকি বালুকার তলহাটিতে তাদের তোয়প্রবাহ, বড়জোর পায়ের গুলি, মালাইচাকি ডোবে কদাচিৎ।  সেই দফনিত রক্ত ও খেদ মানুষের পিছা না ছাড়ে।
তো, যেটা বলছিলাম।  এই দামোদর আমার কাছে এক অবসেশন।
দাম যার উদরে, আগুনখেকো, বছরের পর বছর ভয়াল মূর্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই বহতা বলশালী বাওলা নদ, ধ্বংস করেছে জনপদ, তছনছ করেছে শস্যসম্পদ।  ১৮৯৮-এর বর্ষায় বন্যা এমন উগ্ররূপ ধারণ করেছিল যে সরকার বাধ্য হয় এ ব্যাপারে নজর দিতে।  অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।  ১৯১৩ আর ১৯৩৫ সালের বন্যায় দামোদর তার ভয়ানকতম রূপটিও দেখিয়ে দেয়।  বর্ধমান জেলার প্রায় অর্ধেক ডুবে গিয়েছিল জলের তলায়।  ১৯৪৩-এর বন্যা ছিল ঐতিহাসিক ঘটনা।  গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড নিমজ্জিত হয়েছিল জলের তলায়, রেল লাইনগুলি ঠাহর করা দুষ্কর হয়ে উঠেছিল।  কলকাতার সঙ্গে ভারতের অন্যান্য অংশের যোগাযোগ সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়েছিল।  দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সেই জরুরি মুহূর্তে এহেন দুর্বিপাকে স্বভাবতই চিন্তিত করে তুলেছিল সরকারকে।  সেই প্রথম সত্যিকার অর্থে টনক নড়ে সরকারের।  বিশ্ববরেণ্য বৈজ্ঞানিক ড. মেঘনাদ সাহার সুপারিশে ১৯৪৩ সনেই আমেরিকা থেকে ডেকে আনা হলো টেনেসি ভ্যালি অথরিটির ইঞ্জিনিয়ার ডব্লিউ এল ভরডুইনকে।  ১৯৪৫সালে ভরডুইন নিজের রিপোর্টের মাধ্যমে বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ সহ জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের পরামর্শ দেন।  পরিকল্পনাটি ইংরেজ সরকারের মনে ধরেছিল।  কিন্তু বাস্তবায়ন হতে হতে ইংরেজ ভারত ছেড়ে চলে যায়।  ১৯৪৮-এর ৭ জুলাই আমেরিকা টেনেসি ভ্যালির ধাঁচে গঠিত হয় 'দামোদর ভ্যালি করপোরেশন'।  এরপর পরিকল্পনা অনুযায়ী চারটি বাঁধ দিয়ে ডি ভি সি বেঁধে ফেলে ৫৬৫ কিলোমিটার দীর্ঘ দামাল নদ দামোদরকে।  বাঁধগুলি হলো তিলাইয়া ও মাইথনে বরাকর নদে, কোনারে কোনার এবং পাঞ্চেতে মূল দামোদর নদে।
এই দামোদর আমার কাছে এক অবসেশন।
বিরসা সেতুর কাঁখ বেয়ে কলকল বহে চলেছে দামোদর।  দু-কূলে এলায়িত বালুস্তূপের মধ্যে, তরল রজতরেখার সদৃশ।  বালির পর খাদ-প্রমাণ পাথুরে বাদাঁড়, বনতুলসীর ঝোপ।  পাখিদের জেগে ওঠা, গাছে-বেগাছে।  ঐ মহুলবনি ঘাট।  ঐ চেলেমার পাড়।  মাঝি-মাল্লাদের জটলা-করা অনেককটি নৌকো।  বালির পাড়ে খালুই, ফেটাজাল, খেপলা, চুপড়ি।  হাঁড়িয়ার তিতিল।  তীরে ফের বুনো ঝোপ, আলকুশি, সিয়াকুলের ঝাঁকা।  গাছে গাছে তিতির বটের ভারুই ঘুঘু সিপাহি বুলবুল।  পেয়ারা গাছের গুঁড়ি আঁকড়ে গিরগিটি মোল্লার ঠায় বুকডন।  কোথাও ক্কচিৎ বুনো হনুমান দাঁত খিঁচিয়ে দিল।  হ্যা-হ্যা কুকুর খৈনি চেয়ে লালা ঝরাল।
এই দামোদর, আমার একটা অবসেশন।
দামোদরের কাছে এসে দাঁড়ালেই এমন।  পৃথিবীর থ্রি-ফোর্থ আঁধার ও উত্তেজনা এখানে।  কলকল কলকল।  অবিরত কলকল।  তিন হাজার ফুট খামারপত শৈল থেকে আছাড় খেয়ে, দাম যার উদরে, আগুনখেকো, বহতা বলশালী বাওলা  নদ, রামগড়-হাজারিবাগ-চিত্তরপুর-গোলা-বোকারা-পুরুলিয়া মাড়িয়ে শুধু যে আমারই জন্য।  যাবে সে শিরপুরনামা গাঁয়ের মাজা বেড়িয়ে শালতোড়া, মেজিয়ার পাড়ে আমাদের দেশের বাড়ি ভুলুই।  তারপর সেথায় খানিক নিদিয়ে সে ফের ধাইবে বড়জোড়া, সোনামুখী, পাত্রসায়ের, ইন্দাস থানার সোমসার হয়ে রায়নগরের সন্নিকটে, তদুপরি দু-বেণীতে ক্ষীণ হয়ে দ্বারকেশ কিম্বা বঙ্গসাগর।  আমি যে সেই বঙ্গসাগর ছুঁয়ে আছি ফের দ্বারকেশও।  ছুঁয়ে আছি ভুলুই, জগৎরাম, রামপ্রসাদ!!
ঝাড়খণ্ডের নদী তথা  নদী-উৎসের কথা বলতে গেলে প্রাগেতিহাসের প্রসঙ্গ আসে।  পনেরো-বিশ কোটি বছর আগেকার প্রাক-টার্সিয়ারি ভূ-দৃশ্য কল্পনা করা আজকের মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়।  ভাবলে কল্পকথা মনে হয়, একসময় আমাদের গোটা ভূখণ্ড জমাট বেঁধে একটি বৃহৎ মহাদেশ রূপে অবস্থান করত।  প্রায় উনিশ কোটি তিরিশ লক্ষ বছর আগে সেই অখণ্ড মহাদ্বীপ বিভিন্ন অংশে ভেঙে গিয়ে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে।  ছোটনাগপুর মালভূমির অংশটিও প্রাগুক্ত মূল বৃহৎ ভূখণ্ডের দক্ষিণ ভাগ (গন্ডোয়ানা ল্যান্ড) থেকে আলাদা হয়ে ক্রমশ উত্তর দিকে চালিত হয়ে আজকের অবস্থানে চলে আসে।  ওই সময়েই জন্ম নেয় মৌসুমী বায়ুপ্রবাহ।  এই বায়ু থেকে যে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হয়, তারই জেরে জন্ম নেয় অসংখ্য নদী।  তাদের মধ্যে অন্যতম হলো আজকের দামোদর, সূবর্ণরেখা, উত্তর ও দক্ষিণ কোয়েল।
ছোটনাগপুর বা ঝাড়খণ্ডের নদীগুলির তোয়প্রবাহ অনুধাবন করলে বিশাল গাছের ডালপালার মত এক চমৎকার কেন্দ্রবিমুখ নদীব্যবস্থার ছবি ফুটে ওঠে, যে বৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোথাও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।  প্রায় একই উৎস থেকে জন্ম-পরিগ্রহ করেও উত্তর কোয়েল ছুটেছে উত্তরের শোন নদের পানে, দক্ষিণ কোয়েল ধেয়ে গেছে আরও দক্ষিণের দিকে, দক্ষিণ-পূর্বগামী সুবর্ণরেখা বয়েছে বঙ্গোপসাগরে মেশার তরে আর দামোদর চ্যুতি-উপত্যকার মধ্য দিয়ে ধেয়েছে পুবে ভাগীরথীর খোঁজে।  ছোটখাটো উপনদীগুলিরও এরকম ছন্নছাড়া গতিধারা।  সামগ্রিকতায় বৃক্ষরূপী নদীব্যবস্থা।  সবগুলিই বয়ে চলেছে ভূমির প্রকৃতি অর্থাৎ ধাপগত সাযুজ্য মেনে।  একা দামোদরই অতিক্রম করেছে তিনটি অসমান ধাপ।  এক-একটি ধাপ অন্য ধাপ থেকে ঝাঁপিয়ে দিয়েছে হঠাৎ-হঠাৎই।  এই আকস্মিক লাফঝাঁপ কোনো কোনো ক্ষেত্রে সামলাতে পারেনি দামোদর, ফলত তৈরি হয়েছে জলপ্রপাত।  হুড্রু, জোনহা, দুমারগারহি, দশম ইত্যাদির পেছনে একই কাহিনী।  ধানবাদ শহরের সন্নিকটে, প্রায় ৪৫ কিমি দূরে দামোদরের কোল থেকে খসে পড়া এমনি একটি জলপ্রপাতের হদিশ মেলে গিরিডি জেলার উশ্রীতে।  আরও একটি ছোট্টো প্রপাত রয়েছে ভাটিন্ডায়।
ধানবাদের কথাই বলি।  এখানকার বড়-ছোট সমস্ত নদীর জন্ম যেহেতু বৃষ্টিপাত থেকে, সুতরাং নদীগুলির স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হলো সম্বৎসর জল না থাকা।  বেশির ভাগ নদীই অন্তঃসলিলা এবং বালুকার তলহাটিতে উত্তরপশ্চিম থেকে দক্ষিণপূর্ব অভিমুখে তাদের তোয়প্রবাহ।  ভীষণ বর্ষায় কিছুদিনের জন্যে নাব্য হয়ে উঠলেও, অধিকাংশ নদীর খাতগুলি গ্রীষ্মে তো বটেই, শীতকালেও প্রায়শ শুকনো থাকে।  দুটি পুরুষ নদ ও একটি নারী নদী পরিক্রমা করেছে ধানবাদকে।  এ-বাদে আরও তিন-চারটি ছোট নদী রয়েছে এই জেলার বুকে।  উলঙ্গ, কঠিন শিলার চাটান ব্যতিরেকে, সাধারণত নদীগুলি বয়েছে গভীর খাতের ভিতর দিয়ে।  খাতে-খাতে নুড়িবলি, বড় বড় পাথুরে চাঁই, দু'পাশে খাড়াই পাড়, অনাবৃত কঠোর শিলাস্তর কেটে রচিত হয়েছে সুগভীর নদীবক্ষ।  চাটানের পাড়ে মাটির দেখা মেলে ক্কচিৎ।  তটভূমি জুড়ে কোথাও ছাড়াছাড়া শীর্ণ জঙ্গল, আগাছা আর বনতুলসীর এলাহি ঝোপ; কোথাও-বা স্ফটিকের মতো শাদা দানাদার পাথর।  বালির প্রান্তর, ধূ ধূ।  বালি ফুরিয়ে ফের এবড়ো-খেবড়ো রুখু জমি, ধূসর গাছপাথর।  ধুলো ক্ৰমে কালো রঙ ধরে দিগন্তে হাপিশ।
ছোটনাগপুরের পালামৌ জেলার টোরির কাছে সাড়ে তিন হাজার ফুট উঁচু খামারপৎ পাহাড় থেকে নির্গত হয়েছে দামোদর।  এই নদটির কথা বিশদে বলেছি এর আগের পোস্টে।  আজ বলব বরাকর এবং ডি ভি সির বাঁধগুলোর কথা।  ১৯৫৬ সালে দামোদরের ওপর রূপ পেয়েছে ১৩৪ ফুট উঁচু আর ২২১৫৫ ফুট লম্বা পাঞ্চেত ড্যাম ১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে।  এটি ডিভিসির বৃহত্তম প্রকল্প।  ১২১৪০০০০ একর ফুট জল ধরে রাখার ক্ষমতা এই জলাধারের।  ৪০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ তৈরি হচ্ছে এর হাইডেল পাওয়ার স্টেশনে।  আজ যেখানে এই পাঞ্চেত ড্যাম, ইতিহাসে তার নাম পঞ্চকোট পাহাড়।  পাঁচটি পাহাড়ের সমাহার ঘটেছে এই পাহাড়ে।  সুদূর অতীতে উঁচু মালভুমি ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে এখানকার মাটি পাহাড়ের চেহারা নিয়েছে।  ধানবাদের দক্ষিণ-পূর্ব এবং পুরুলিয়ার উত্তর-পূর্ব কোণে চুরাশি পরগনায় বিরাজমান এই পাহাড়টি কামথি বেলেপাথরে তৈরি।  পাহাড়টি আকারে দীর্ঘ, শৈলশিরায় দাগ কাটাকাটা, শীর্ষে গিয়ে মিশেছে পূর্বান্তে।  ছোট ছোট ঘন জঙ্গলে ঢাকা উত্তুঙ্গ খাড়াই, মানুষ ও পথচারী ভারবাহী পশুর পক্ষে গম্য হলেও, ঢাকাওলা শকটের পক্ষে দুর্গম।  পাহাড়টি লাগাতার বাঁকুড়ার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বিহারীনাথ পর্বতমালার সঙ্গে মিশে গিয়েছে।  বিহারীনাথ পাঞ্চেতেরই একটি শৃঙ্গ।  দামোদর পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে বয়েছে, তারই দু-তিন মাইল দূরে গিয়ে শালতোড়া থানার কাছে বিহারীনাথ সহসা মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।  শালতোড়ায় শুশুনিয়া আর অন্যান্য পাহাড়েরও জমঘট হয়েছে।  তাদের মধ্যে মেজিয়া পাহাড়ের নাম উল্লেখযোগ্য।  সমস্ত পাহাড়ই পাঞ্চেতের জাতভাই।
দামাল দামোদর গিয়ে ঢুকেছে পাঞ্চেত পাহাড়ের বিরাট জলাধারের ভেতর।  এই জলাধারেই এসে মিশেছে বরাকর।  আর এখানেই সঙ্গম ঘটেছে ধানবাদ, পুরুলিয়া আর বর্ধমানের।  জলাধারের সীমান্তে গোয়াই নদীর অনেকটা পুরুলিয়ায় ঢোকা, খানিকটা বোকারোয়।  পাঞ্চেত পাহাড়ের পুব দিকে দামোদর বেঁকে গিয়েছে।  পাহাড়ের দু-দিক থেকে দুটি নদী এসে মিলেছে।  পশ্চিম থেকে এসেছে উতলা নদী আর পুব থেকে বিসরামঝোর।  পাঞ্চেতের উত্তরে ধাঙ্গি পাহাড়।  পাঞ্চেত থেকে দূরহত পাহাড়ের পনেরো-বিশ কিমি দক্ষিণে দ্বারকেশ্বর-দামোদর বিভাজিকা।  বর্ধমানের গা-ছোঁয়া বাঁকুড়ার সমতলভূমি জেলার মাঝ-বরাবর এসে উঁচু-নিচু গড়ন পেয়ে পশ্চিমে টিলা পাহাড় আর শৈলশিরায় রূপান্তরিত।  সেই পাহাড় প্রান্তর ক্ৰমে ধানবাদ ছুঁয়ে মিশে গেছে রাঁচির পাহাড়ে।  ভাষান্তরে, রাঁচির মালভুমি, পুরুলিয়া-বোকারোর বুকে চড়ে ধানবাদ মাড়িয়ে উঠেছে বাঁকুড়ার মাথায়।  মাটির ঢাল বেয়ে নিচে নেমে গেছে দক্ষিণ রাঢ়ের আসানসোল-রানীগঞ্জের পাহাড়ি এলাকায়, বাঁকুড়ার শুশুনিয়া-বিহারীনাথ শৈলভূমে।
দ্বাদশ শতকে রাজন্যপোষিত কবি সন্ধ্যাকর নন্দী তাঁর 'রামচরিত' কাব্যে লিখেছেন দামোদর তটবর্তী তেলকুপি গ্রামটি ছিল শিখর রাজাদের রাজধানী।  অর্থাৎ আজ যে জায়গাটি পাঞ্চেত জলাধারে নিমজ্জিত, সেটি ছিল শিখরভূম রাজ্যের অংশ।  অবশ্য আইন-ই-আকবরীতে শেরগড় পরগনাকেই বলা হয়েছে শিখরভূম, যা ছিল বর্ধমানের দামোদর-অজয়ের সংযোগস্থল।  যা হোক, ১৯৫৬ সালে পাঞ্চেত ড্যাম তৈরির সময় তেলকুপির বেশ কিছু প্রসিদ্ধ মন্দির জলের তলায় চলে যায়।  তলিয়ে যায় বহু শাক্ত-শৈব-জৈন সৌধ মূর্তি।  এছাড়া বেশ কিছু গ্রামও জলে ডুবে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।  যে-কারণে বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষজন বেশ মারমুখী সংগ্রাম চালিয়েছিলেন।  সেই আন্দোলনের ছবি ধরা হয়েছে আমার যন্ত্রস্থ উপন্যাস 'দামুণ্ডাচরের কালিখপুরাণে'।  পাঞ্চেত পাহাড়ের পাদদেশে পঞ্চকোট রাজাদের প্রাচীন গড় আর রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ চোখে পড়ে আজও।  ভাঙাচোরা কিছু মন্দিরও।  অন্যান্য পাহাড়ের চূড়াও দেখা যায় এখন থেকে।  একটি শিখরের নাম 'ঘাতক পাহাড়'।  জনশ্রুতি, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের ওই পাহাড়ের চূড়া থেকে ধাক্কা দিয়ে মেরে ফেলা হতো।
বরাকর দামোদরের ভাই।  তারও উৎস হাজারিবাগ পাহাড়।  জাতীয় সড়ক ২, ৩১ ও ৩৩-এর সংযোগস্থল বিরহী থেকে আঠারো কিমি দূরে বরাকর নদে ডিভিসির প্রথম প্রকল্প তিলাইয়া বাঁধ।  কোডরমা স্টেশন থেকে উনিশ কিমি।  ১২০০ ফুট দীর্ঘ এবং ৯৯ ফুট উঁচু এই বাঁধে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বিরহী ছাড়িয়ে হাজারিবাগ রোড ক্রস করে বরাকর পিরটাঁড়ের দিকে এগিয়েছে অত্যন্ত শ্লথ গতিতে।  ধানবাদ জেলার উত্তর সীমান্ত শিখর ছুঁয়েছে সারা বা নওয়াটাঁড়ের কাছে।  তারপর পঞ্চাশ মাইলেরও বেশি দূরত্ব অতিক্রম করে ধানবাদ-গিরিডি, ধানবাদ-সাঁওতাল পরগনা এবং ধানবাদ-বর্ধমানের সীমারেখা চিহ্নিত করে পাঞ্চেতে ঝাঁপ দিয়েছে দামোদরের বুকে।  গিরিডির সীমান্তে উশ্রী নদী এসে বরাকরকে দিয়েছে গতি।  তারপর টুন্ডি, পানড্রা, মাইথন, চিরকুন্ডা হয়ে বরাকর ছুটেছে পাঞ্চেত অভিমুখে।  ধানবাদ শহর থেকে ৫০ কিমি দূরে ঝাড়খণ্ড-পশ্চিমবঙ্গ বর্ডারে মাইথনে এই বরাকর নদের ওপর বাঁধা হয়েছে ১৫৭১২ ফুট লম্বা আর ১৬৫ ফুট উঁচু ডিভিসির অন্যতম প্রধান বাঁধ মাইথন ড্যাম।  সাবেক সালানপুর গ্রামের অর্ধেকটা হয়েছে আজকের মাইথন।  পর্যটকদের পাঞ্চেতের চেয়ে বেশি টানে মাইথন।  সত্যিই রমণীয় বাঁধটি।  বাঁধের ওপর দাঁড়িয়ে একপাশে চোখে পড়ে দু-পাশে বিস্তীর্ণ বালুকাস্তূপের মধ্যে তরল রজতের মত অতিকায় বরাকর।  অন্যপাশে দেড়শো ফুট নিচে খাদ-প্ৰমাণ জঙ্গল ও পাথুরে জমি।  বাঁধের নিচে ৬০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ তৈরির হাইডেল পাওয়ার স্টেশন।  পাহাড়ের গভ্যন্তরে ১৩৫ ফুট গভীর এই প্রকল্প।  এছাড়া রয়েছে ডিয়ার পার্ক, আর শীতের দিনে উড়ে এসে জুড়ে বসা হরেক রকম পাখিদের স্যাঙ্কচুয়ারি।  এখানকার আরেকটি আকর্ষণ বরাকর-দেন্দুয়া ভায়া মাইথন সড়কে হ্যাংলা পাহাড়ের গায়ে পাঁচশো বছর পুরনো কল্যাণেশ্বরী মাতার মন্দির।  শোনা যায়, কুষাণদের তাড়া খেয়ে হরিগুপ্ত পালিয়ে এই পাহাড়ে আশ্রয় নেন।  এখানে তিনি রাজ্য গড়ে তোলেন।  মন্দিরটিও তাঁর তৈরি।  কৃত্রিম গুহার দ্বারে অষ্টধাতুর প্রতিমা, অন্দরে সোনার তৈরি দেবীর মূল বিগ্রহ।  মন্দিরের উত্তরে স্রোতস্বিনী চালনা বা চাল্লাদহের পাড়ে দেবী কল্যাণেশ্বরী বা শ্যামা যেখানে শাঁখা পরেন তারই স্মৃতিতে তৈরি হয়েছে বিখ্যাত মন্দির।  পঞ্চকোটের মহারাজা কল্যাণ শেখর আনুমানিক ১২১৫ শকে সেনবংশের কুলদেবী শ্যামারূপাকে এনে শ্রীশ্রীকল্যাণেশ্বরী নামে এই অষ্টধাতুর চতুর্ভুজা ত্রিপুরী দেবীর মূর্তিটি প্ৰতিষ্ঠা করেছিলেন।  মায়ের পদচিহ্নও রয়েছে পাষাণবেদিতে।  আর আছে চতুর্দশ শিবমন্দির।  শীতলা মায়ের থানে মনস্কামনা পূরণার্থে ঢিল বাঁধার প্রথা আছে।  এ-বাদে নতুন তৈরি হয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির।  'মায়ের স্থান' বলেই তিন বর্গ কিমি জুড়ে তৈরি টাউনের নাম মাইথন।

তন্ময় ধর

ঙ্গা, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছো?
                               

তপোলোক-দেবলোক-ব্রহ্মলোকের ছোঁয়াছুঁয়িতে এখানে সব পথ মৃত্যু পেরোনো অমরত্বের পথ। পৃথিবীর সংসারের দুঃখ-যন্ত্রণা-মলিনতা পেরিয়ে অপার শাশ্বত সৌন্দর্য্যের ধাক্কায় সম্মোহিত হয়েই আপনাকে এপথে চলতে হবে। যাত্রা শুরু হবে কাকভোরে, সে আপনি দেরাদুন থেকেই আসুন কিম্বা হরিদ্বার-হৃষীকেশ থেকেই আসুন। হরিদ্বার-হৃষীকেশ থেকে চাম্বা হয়ে যে পথটি উত্তরকাশীর পথে গিয়েছে, সেটি দীর্ঘ, তার সৌন্দর্য্যেও কিছু কমতি রয়েছে। সুতরাং আপনাকে বেছে নিতে হবে দেরাদুন-মুসৌরি-সুবাখোলির পথ। সে পথ বড় দুর্গম।  পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে যাওয়া সর্পিল সংকীর্ণ পথের পাশে একবার অপরূপকথার আলোর উঁকি তো পরমুহুর্তেই ভয়ঙ্কর ধস আর অতল খাদের ভয়াল ভ্রুকুটি। স্বর্গ ছেঁড়া জলপ্রপাত এসে কখনো ভিজিয়ে দিয়ে যায়। কখনো পাইন-দেওদারের শরীর ছোঁয়া একিচলেত রোদ্দুর এসে এক অন্য পৃথিবীর উষ্ণতার ছোঁয়া দিয়ে যায়। প্রভাতকল্পার তরল আলো ভেঙে দেরাদুন থেকে বাস যাত্রা শুরু করতেই ঘন্টাখানেকের মধ্যে মুসৌরির ৬০০০ ফুট পাহাড়ের কুয়াশা ভিজিয়ে দেব আপনাকে। পিছনে ফিরে দেখবেন, বহুদূরে পড়ে রয়েছে মানুষের সংসারের কোলাহল।


সবুজে মাখা পাহাড়, দুধেল শাদা ঝর্ণা, নাম-না-জানা ফুলের উপত্যকা আর অজানা পাখির কলকাকলির পাশ দিয়ে আপনি যখন এক অজানা মায়াময় জগতের গহনে হারিয়ে যাবেন, তখন হঠাৎই ব্রেক কষবে বাস। জায়গাটার নাম সুবাখোলি। সত্যিই সুবহ মানে ভোরের এক অনন্য সৌন্দর্য্য চোখ মেলে রয়েছে পথে, পথিকের চোখে, পথিকবনিতার স্বপ্নে। এখানেই পাইন-দেওদারের নরম রৌদ্রছায়ার খেলার ভেতর সেরে ফেলতে হবে প্রাতরাশ। ধোঁয়ার গন্ধ মাখা চা আর গরম পরাটা বা থুকপার স্বাদই আলাদা।   আবার যাত্রা সর্পিল পথে। হঠাৎ একটা নদীর সঙ্গে দেখা। নদীর গহন নীল চোখে চোখ রাখতেই যুগযুগান্ত পেরিয়ে ভেসে আসবে অদ্ভূত একটা পাহাড়ী গানের সুর। পাইন-দেওদারের লুকোচুরি থেক একটা পাখি করুণ সুরে ডেকে উঠবে। দূর পাহাড়ী গ্রাম থেকে এক দেবশিশু হাত নেড়ে টা-টা করে দেবে। ঘুম-ঘুম সব পাহাড়ের শিলালিপি পড়তে পড়তে আপনি হঠাৎ দেখবেন, নরম আলো মাখা সূর্যটা প্রায় মাঝ আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে। আর শীতল হাওয়া মাখা একটা মস্ত পাহাড়ী ধ্বসের সামনে এক তেমাথার মোড়ে বাস থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। এ জায়গাটার নাম ধরাসু। ‘বাঁটুল দ্য গ্রেট’ কমিক্সের খলনায়ক ভক্করাসুর সাথে নামের মিল খুঁজে পেলেন নাকি? এ জায়গার ধস সত্যিই গোটা পথের ভিলেন অংশ। ধুলো, নুড়িপাথর আর বিপজ্জনকভাবে ঝুলে থাকা পাথরখন্ডের পাশ দিয়ে খুব সাবধানে পেরোতে হবে পথের এই অংশটুকু। যারা বড়কোট-হনুমানচটি হয়ে যমুনোত্রীর পথে যাবেন তারা বাঁদিকের পথ ধরবেন। আপনি যাবেন ডানদিকে, গ্যানসু-উত্তরকাশী হয়ে গঙ্গোত্রীর পথে। ভোর সাতটায় যে বাস দেরাদুন ছাড়ে, তা উত্তরকাশী পৌঁছায় দুপুর দেড়টা নাগাদ। উত্তরকাশীতে দুপুরের আহার সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে গঙ্গোত্রী যাওয়ার ছোট বাস বা গাড়িতে চেপে যান বিকেল তিনটের আগেই। সাড়ে তিন ঘন্টার পথ।



তিনটের পরে আর বাস পাবেন না। আর যদি একটা দিন উত্তরকাশীতে বিশ্রাম নিতে চান, তাহলে প্রচুর সস্তার হোটেল আছে। রয়েছে অনেক ধর্মশালাও। সন্ধেয় ঘুরতে পারেন ভাগীরথীর তীরে মায়াময় পথে পথে। শক্তিমাতার মন্দির এবং বিশ্বনাথ মন্দির দেখে নিতে পারেন পায়ে হেঁটেই। কোন প্রবেশমূল্য বা লাইন দেওয়ার ব্যপার নেই। একটু দূরে রডোডেনড্রনের বাগান কিম্বা মানেরি ড্যাম দেখতে যেতে পারেন, হাতে দু-তিন ঘন্টা সময় থাকলে।
পরের দিন খুব সকালে গঙ্গোত্রীর পথে বেরিয়ে পড়ুন। তীর্থের মরশুমে অর্থাৎ মে থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত উত্তরকাশী থেকে গঙ্গোত্রী পর্যন্ত ছোট বাস চলে। বাকি সময় ছোট গাড়ি। ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এপথ তুষারপাতের জন্য বন্ধ থাকে। উত্তরকাশী থেকে গঙ্গোত্রীর দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। পথের এক-তৃতীয়াংশ পেরোতেই তুষারধবল পর্বতশৃঙ্গেরা আপনার চোখ আটকে রেখে দেবে। দেবলোকের এই পথের ঝর্ণা-নদী-গাছ-ফুল-পাখি সব লক্ষ্য করতে করতে এগিয়ে চলুন। এমন দৃশ্যসুখ জীবনে খুব বেশী আসে না। মাঝপথে গাংনানিতে থামবে গাড়ি। উষ্ণজলের একটি ক্ষীণধারার ঝর্ণা আছে এখানে। স্থানীয় মানুষদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র এই ধারা। আশেপাশের দোকানে সামান্য জলপানের ব্যবস্থা আছে। গরম চা, পরোটা, পকোড়া খেতে পারেন। ঠান্ডা হাওয়া আর কুয়াশামোড়া পরিবেশে ওসব খাবারের স্বাদই আলাদা। খাওয়া সেরে স্থানীয় উলের শীতবস্ত্র কিনে নিতে পারেন। এরপর যত গঙ্গোত্রীর দিকে এগোতে থাকবেন, দুর্গম পথে হাড়হিম শীতল বাতাসের তীব্রতা বাড়তে থাকবে। এরই মধ্যে গাড়ির ড্রাইভার পাইনবনের পাশে এক চিলতে নদীবিধৌত এক গ্রামের পথে থেমে যাবে। এই গ্রামের নাম হর্শিল। আপেল এবং অন্যান্য সুস্বাদু পাহাড়ী ফলের বাগান আছে। দুরন্ত এক ঝর্ণাধারা দেখিয়ে ড্রাইভার বলবেন, এখানেই ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’ ছায়াছবির ‘তুঝে বুলায়ে ইয়ে মেরি বাহেঁ’ গানের দৃশ্যায়ন হয়েছিল।
গঙ্গোত্রীর ছোট্ট বাসস্ট্যান্ড থেকেই শুরু হয়ে গেছে দোকানের সারি। বিচিত্র পূজার সামগ্রীর অভাব নেই সেখানে। তবে সব কোলাহল ছাড়িয়ে ভরে আছে গঙ্গা এবং অসিগঙ্গার তীব্র জলধ্বনি। আর সব দৃশ্যের উপর উজ্জ্বল হয়ে আছে শিবলিঙ্গ এবং ভাগীরথী গ্রুপের অন্যান্য তুষারশুভ্র শৃঙ্গগুলি। গঙ্গোত্রীতে হোটেল এবং ধর্মশালা রয়েছে প্রচুর। মন্দির এবং নদীসঙ্গমের কাছাকাছি কোন হোটেলে থাকতে পারেন। গঙ্গোত্রীতে দ্রষ্টব্য স্থান প্রচুর। বাসস্ট্যান্ডের গা বেয়ে ট্রেকিং-এর রাস্তা চলে গিয়েছে ভোজবাসা-গোমুখ-তপোবনের পথে। এই পথে যেতে হলে সকালেই অনুমতি নিয়ে নেতে হবে স্থানীয় ফরেস্ট রেঞ্জ অফিস থেকে। গঙ্গোত্রী থেকে গোমুখ হিমবাহ প্রায় ১৮ কিলোমিটার পথ। দুর্গম এই পথে পায়ে হেঁটে যেতে সময় লাগে প্রায় ৫ ঘন্টা। প্রতিদিন মাত্র ২০০ পর্যটককে এপথে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। কাজেই সকালে দ্রুত নাম লেখাতে না পারলে এর আশা ত্যাগ করতে হবে। সেক্ষেত্রেও আপনার জন্য অজস্র দ্রষ্টব্য অপেক্ষা করে আছে গঙ্গোত্রী মন্দিরের আশেপাশে।
গঙ্গোত্রী মন্দিরটির বয়স বেশী নয়। অষ্টাদশ শতকে জেনারেল অমর সিং থাপা এই মন্দির তৈরি করেন। বর্তমানে সংস্কার করে ঝকঝকে-তকতকে করা হয়েছে। মন্দিরের একপাশে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে পারেন ভগীরথশিলায়। এখানে বসে তপস্যা করেই ভগীরথ স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে মর্ত্যে আনেন। সিঁড়ি বেয়ে আরো নীচে নেমে স্নান করে নিতে পারেন ভাগীরথীতে। মন্দিরে পূজা দিয়ে দুপুরের আহার সেরে নিতে পারেন কাছাকাছি কোন রেস্টুরেন্টে। এরপর সামান্য বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন স্থানীয় দ্রষ্টব্যগুলির জন্য। মন্দির থেকে কয়েক পা এগিয়ে লোহার সেতু পেরিয়ে পৌঁছে যান গৌরীকুন্ড এবং সূর্যকুন্ডে। এখানে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখুন উন্মত্ত জলরাশির খেলা, সুবিশাল প্রস্তরখন্ডের মৌনতা, ঘিরে থাকা চির-অরণ্যের আলোছায়ার খেলা, চিরচঞ্চল জলরাশি থেকে বিচ্ছুরিত তীব্র জ্যোতি। ব্যাকগ্রাউন্ডে চির-উজ্জ্বল হয়ে জেগে আছে শিবলিঙ্গের তুষারশৃঙ্গ। এখানে জীবন তুচ্ছ। অনন্ত সৃষ্টির এক চিরায়ত সৌন্দর্য্যের সামনে বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকুন। মহাকালের জপের মালায় আজকের দিনটি নেই। জন্ম-মৃত্যু-দুঃখময় সংসারের অন্ধকার পেছনে ফেলে আপনি চলে এসেছেন আলোকতীর্থে। এরপর ভাগীরথীর তীরের অরণ্যময় পথ ধরে এগিয়ে চলুন পান্ডবগুহার দিকে। মাত্র দু’ কিলোমিটার পথ। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে সেই জনবিরল পথ আর ফুরোতে চাইবে না। সন্ধের নির্জনতায় সে পথ আরো গা-ছমছমে হয়ে ওঠে। ফিরে এসে জলমগ্ন শিবলিঙ্গ দেখতে চলুন। এখানেই শিব তাঁর জটা থেকে মুক্ত করেছিলেন দেবী গঙ্গাকে। আরো অসংখ্য দ্রষ্টব্য ছড়িয়ে রয়েছে আশেপাশে।
গঙ্গোত্রীতে কিন্তু কোন এটিএম নেই। পথে শেষ এটিএম হর্শিলে, গঙ্গোত্রী থেকে ২৮ কিলোমিটার আগে। বিএসএনএল ছাড়া বাকি সংস্থাগুলির টেলিফোন নেটওয়র্ক অত্যন্ত দুর্বল।

কিভাবে যাবেনঃ-
দেরাদুন থেকে উত্তরকাশীর বাস ছাড়ছে সকাল ৭ টায়, ৮ টায়, বেলা ১ টায় এবং ২টোয়। সময় লাগে সাড়ে ছ’ঘন্টা। উত্তরকাশী থেকে ছোট গাড়িতে গঙ্গোত্রী যেতে সময় লাগে সাড়ে তিন ঘন্টা।
তীর্থের মরশুমে হৃষীকেশ থেকে সরাসরি গঙ্গোত্রী যাওয়ার বাস ছাড়ছে সকাল ৭টায়। সময় লাগে প্রায় এগারো ঘন্টা। 

মেঘ অদিতি

একটি আত্মঘাতী ফুল, তোমাকে



উপসংহারের দিকে ছুটে যাওয়া সন্ধ্যাকে
আজ গল্প জানছি
কথাকে গাছ, গাছকে কুয়াশা

কোথাও যাবো না-
ভাবতে ভাবতে ছাদ ফুঁড়ে উঠলো মাথা
অয়েল না প্যাস্টেল
প্যাস্টেল না এ্যাক্রেলিক
প্যালেটে চাপ দিলে
বেরিয়ে আসছে চাপ চাপ অন্ধকার
শরীরে ডাকছে বান
আত্মভ্রমণের পাখিজগত আমার
সন্ধ্যার সমুহ মায়ায়
তোমাদের এক হাত দেখে নেওয়া গেলো ভেবে
দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ছি



উদযাপনের এত এত শেড
এত তীব্র অন্ধকার
প্রিয় মুখ-
স্বীকার করি সুতীব্র চিৎকারের পাপ
স্বীকার করি দুরভিসন্ধির সন্ত্রাস
ঠিকরে গেছে আমার সেপিয়ার টোন
ঘুণপোকা কেটে নিলো এই জন্মান্ধের আয়ু

তোমাকে আলো দেবো বলে
সকালের কাছে যত রাত কুড়োচ্ছি
আলোয় পুড়ে যাচ্ছে তোমার দীর্ঘশ্বাস

সারাদিন ঘুড়ি ওড়াচ্ছি কসমোপলিটান আলো-ছায়ায়



ঘটনার প্রত্যাবর্তন না কি বাটারফ্লাই ইফেক্ট
বলতে পারবেন তাত্ত্বিকরা

আমি শুধু জানি
নক্ষত্রের দিকে ছুটে চলা ওই মুখে
ভোরের মুখেই সন্ধ্যা ঘনালো
বুদ্বুদ কেটে বসানো হলো
দুরের জংশনের ল্যান্ডস্কেপ

চলে গেলে-
জানলাম ফুলেরাও আত্মঘাতী হয়

পিয়ালী বসু ঘোষ

সাঁঝবিহান
পর্ব -7

সতীশ এসে কলমির ঘরের পথে পা রাখতেই ছুটে এলো ফজিরাম । ওর চোখে মুখে অনাবশ্যক হাসি । হাতে সর্ষের শাক ।বলল কলমি পাঠিয়েছে দাদাবাবু ।তুমি আজ ফিরবে বলে আমার হাতে দু গাছি শাক ধরিয়ে দিয়ে বলল ফজি দাদা বাবু কে দুটি রেঁধে দিও । আমরা গরীব গুর্বো মানুষ আমরা রাঁধলে বাবুর ভালোলাগবেনা  তাই তুমিই দিও রেঁধে।
সতীশ মনে করলো শীত শুরুতে ঘরের পাশের জমিতে সর্ষের চাষ করতে বুদ্ধি দিয়েছিলো কলমিকে ও । কলমি বলেছিল সর্ষের শাক খেতে নাকি খুব ভালো হয় ।সতীশ কলকাতার বাড়ীতে খায়নি কখনও ।আজ ফজিরাম কে বলল কলমি কে বলো এ শাক আজ ওকেই রান্না করতে আর সাথে কলাই এর ভাঙা ডাল। সঙ্গে গন্ধরাজ লেবু আর ওর হাতের পাঁচমেশালি আচার ।আজ দুপুরে আমি ওর ওখানেই খাব । এই বলে আলমারি থেকে খদ্দরের মোটা পঞ্জাবিটা পাজামা সহ নিয়ে বেড়া দিয়ে ঘেরা ওর কুয়োতলি তে ঢুকে গেলো ।যাবার আগে ফজিরামের কাছে ধুধুলের ছোবড়টা চাইলো ।বলল ও যেন কলমি কে খবরটা দিয়েই ফিরে আসে ।ওর সাথে কিছু কাজের কথা আছে ।

ফজিরাম উসখুশ করছিলো ওকে সাঁঝ এর কথা বলার জন্য কিন্তু সতীশ কে কেমন উদাস বিষন্ন অথচ দৃঢ় মনে হলো ওর ।পুরুষের এই আশ্চর্য রূপ তখনই হয় যখন হয় সে হারিয়ে ফেলে কিছু তা সে স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় । একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে যায় ও.......

চানঘরে গিয়ে ধুধুলের খোসা দিয়ে বেশ করে রগড়ে স্নান করে সতীশ । দাঁড়ি কামায় । তারপর নিপুণ ভাবে দূরের বনপাহাড়ের গন্ধ গায়ে মাখে নগ্ন হয়ে ।দুদিন বাড়ীতে গিয়ে ও কেমন এলোমেলো হয়ে ফিরে এসেছে ।এই জায়গা তো ওর কর্মক্ষেত্র ওর আজন্মলালিত স্বপ্নভূমি তো নয় এটা তবু এখন এখানেই ওর সব ।ও ভাবতেই পারেনা এখান থেকে ও চলে যাবে কখনও । এখানকার জলহাওয়ার সাথেই ও একাত্ম বোধ করে যেন জন্মাবধি ও এখানেই ছিল......মা বলতেন শরীরে যা সওয়াবি তাই সইবে ।সত্যিই শরীর তো তাই কিন্তু মনও যে তেমনই এ কথা ও যেন এখানে এসেই জানলো। তবু কি এক তীব্র একাকীত্ব ওকে দিন দিন ওকে গ্রাস করছে.....
মন উড়ছে -সন্ন্যাসী মন,ধুলো উড়ছে -রুখু ধুলো তবু ফিরে যেতে ইচ্ছে করেনা আর ওর ।
কাকে ঠকাচ্ছে কি পাচ্ছে এসব ভাবতে ভাবতেই হেলাল হাফিজের কবিতার সাথেই নিজেকে মেলাতে থাকে

"জন্মাবধি ভেতরে এক রঙিন পাখি কেঁদেই গেলো
শুনলো না কেউ ধ্রুপদী ডাক,
চৈত্রাগুনে জ্বলে গেলো আমার বুকের গেরস্থালি
বললো না কেউ তরুন তাপস এই নে চারু শীতল কলস।
লন্ডভন্ড হয়ে গেলাম তবু এলাম"

পার্বতী রায়

:

তিনটি কবিতা :

১.

তোমাদের কাছে পৌঁছে দেবার জল নেই 

বিচ্ছিন্ন মানবসেতু


ভয়ের পতাকা নড়ে

২.

খোলার ভেতর শ্বাস নিচ্ছে ফুল 

একটু অসাবধান হলেই 

বার্ধক্যজনিত সমস্যা 




৩.

 ইন্দ্রিয় গুলো 

যখন তখন বিদ্রূপ করে

সমস্যা একটাই 

নিমগ্ন থাকার অভ্যেস নেই

অনিন্দ্য রায়


হয়তো তোমারই
   •


 চোখ, মনে হয়,চিনি; চেনা পুষ্করিণী
সাঁতারে নেমেছি কোনোদিন
হয়তো দেখেছি জলে কোনো মলিনতা নেই, দেখে 
ওষ্ঠ ফাঁক করে খেয়েছি ,তরল প্রাণ
 সে পানীয়ে আগুন মেশানো
শরীরের সব জল বাষ্প হয়ে ওড়ে
আমিও ডুবতে থাকি
ডুবে যেতে থাকি 

নীচে, জলের তলায় এক রূপকথা সিঁড়ি
শ্যাওলার ঝোপ, শোণিতের শ্বাস আর স্বেদ
আমিও পিছলে পড়ি 
সিঁড়ি টানে নিজের গভীরে
ভাঁজ-করা অন্ধকার খুলে যায়, আবার গুটিয়ে আসে 
আশ্চর্য কম্পনে আকাশেও ফুটো হয়ে যায়
ঝরে বারি, ছিটকে আসে চোখে

জ্বলে যায়
জ্বলে যায়
জ্বলে

নেভে সকল আতস 
অন্ধের আবেগে ছুঁই অনাদি খিলান
ছুঁই দ্বার, আপৎ জানলা
মাথাও গলিয়ে দিই
মুখে লাগে তীব্র রসায়ন
তোমাকে অম্ল ভেবে ক্ষারকের ধর্মে ঢুকে পড়ি

হে রক্তবাহিত সুখ, হে প্রাণ মোক্ষম
যা থাকে ভূমির নিচে আধখানা চাঁদ
কলঙ্কে বোলাই হাত , সে খাঁজে আঙুল
আটকে যন্ত্রণা পাই,  সহ্য করি, ও হো

তোমাকে নিরস্ত্র ভেবে বর্ম খুলে ফেলি
তোমাকে সাক্ষর ভেবে চিঠিপত্র লিখি
তানপুরা ভেবে তারে হাত দিতে যাই
এবং মানবী ভেবে প্রস্তাব করেছি

প্রতিটি চুম্বনে থাকে রণবাদ্য, ভেরি
আয়ুধ যতটা পারে পরাক্রমশালী
প্রতিটি প্রবেশ যদি ব্রহ্মাণ্ড ওল্টায়
বারবার, বারবার, বারবার, মরি

মৃত্যু না, জন্মের জন্য আয়োজন এই
এই শ্রম, এই জ্বর
এই ঘেমে ওঠা

চক্ষুরুন্মিষতি, প্রণয়ের সম্ভাবনা, রতি
চাঁদের গায়ে তো চাঁদ
প্রাণে প্রাণে
শব্দের কাঁসরঘন্টা
আঘাতে বাজছে

ক্ষতে মুছি ব্যথা ও গরল
আঙুলে আঙরা, শিরা দপদপ, অস্থি ছাইপাঁশ
রতন খুঁজতে এসে তুমি পাও ধাতুর কলস
রয়েছে সামান্য ছিদ্র মাটির ঢাকনায় 
ওইটুকু শ্বাসরন্ধ্র , কাব্য ওইটুকু 
ঠোঁটে চেপে ফুঁ দিই, চুষি হাওয়াফল

বীজে যত আলোড়ন আমাদের বাজনা সেরম
চিত্রঋণ : পাবলো পিকাসো 

সুনীতি দেবনাথ

মসলিনের সাতকাহন
-----------------------------------



একটি বহুল প্রচলিত গল্প আছে — মুঘল সম্রাট ঔরঙজেবের দরবারে একদিন তাঁর এক কন্যা এলে ঔরঙজেব কন্যাকে স্বল্প বস্ত্র পরে আসার জন্য তিরস্কার করেন। বিস্মিত কন্যা জানান তিনি আব - ই - রওয়ানের ( এক বিশেষ প্রকারের মসলিন) সাতটি জামা পরে আছেন। বিস্ময়! আরো বিস্ময় চল্লিশ হাত লম্বা আর দুই হাত চওড়া সূক্ষ্ম এই শ্রেণীর  মসলিন কাপড় একটা আংটির ছিদ্র দিয়ে পার করা যেতো। মাত্র এক পাউন্ড সুতোর দৈর্ঘ্য হতো প্রায় আড়াই শ মাইলা! ৫০ মিটার দীর্ঘ মসলিন কাপড় একটা দেশলাই বাক্সে জায়গা হতো। ১৭৫ গজ মসলিন কাপড় একসঙ্গে গুটিয়ে নিলে একটি পায়রার ছোট্ট ডিমের সাইজ হতো। বিস্ময়ের ব্যাপার কতটা সূক্ষ্ম বস্ত্র ছিলো এই পুরোনো কালের মসলিন।

    পুরোনো কালের বস্ত্র মানে কতটুকু পুরোনো কালের? নামটাই বা মসলিন কেন? কোন স্থানে তৈরি হতো এমন জাদুকরী বস্ত্র প্রাসঙ্গিকভাবে এসব প্রশ্ন আসে।বিশেষ এক প্রকার তুলোর আঁশ থেকে প্রস্তুত সুতো দিয়ে বয়ন করা এক প্রকারের অতি সূক্ষ্ম বস্ত্র বিশেষ মসলিন।  এটি ঢাকাই মসলিন নামেই অধিক পরিচিত। ফুটি কার্পাস নামের তুলো থেকে প্রস্তুত অতি চিক্কণ সুতো দিয়ে মসলিন তৈরী করা হতো। চরকা দিয়ে কাটা, হাতে বোনা মসলিনের জন্য সর্বনিম্ন ৩০০ কাউন্টের সুতো লাগতো। সুতোর কাউন্ট চার পাঁচশোও হতো।  যার .জন্য মসলিন হতো কাচের মতো স্বচ্ছ। এই মসলিন রাজকীয় পোশাক নির্মাণে ব্যবহার করা হতো। মসলিন প্রায় ২৮ রকম হয়ে থাকে যার মধ্যে এখনও জামদানি নামক একপ্রকার মসলিন বিপুলভাবে প্রচলিত। নানা কারণে আঠারো শতকের শেষার্ধে বাংলায় মসলিন বয়ন বন্ধ হয়ে যায়।

সম্পাদনা প্রচলিত বাংলা শব্দ মসলিনের মূল আরবি, ফারসি বা সংস্কৃত শব্দ নয়। এস. সি. বার্নেল ও হেনরি ইউল নামের দুজন ইংরেজ দ্বারা প্রকাশিত  অভিধান ' হবসন জবসন '-এ উল্লেখ করা হয়েছে মসলিন শব্দটি এসেছে 'মসুল' থেকে। ইরাকের এক বিখ্যাত বাণিজ্যনগরী হলো মসুল।এই মসুলেও অতি সূক্ষ্ম কাপড় প্রস্তুত হতো। এই 'মসুল' এবং 'সূক্ষ্ম কাপড়' -এ দুয়ের যোগসূত্র মিলিয়ে ইংরেজরা অতি সূক্ষ্ম কাপড়ের নাম দেয় 'মসলিন'।অবশ্য  'মসলিন' বলতে বাংলার ইতিহাসে বোঝানো হয় তৎকালীন ঢাকা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে উৎপাদিত অতি সূক্ষ্ম একপ্রকার কাপড়কে।কেউ কেউ বলেন ইংরেজরা মসলিপত্তনমে বাণিজ্য ঘাঁটি গেঁড়েছিলো বলে মসলিন নাম হয়।
    মসলিন তৈরির জন্য যে বিশেষ প্রকারের কার্পাস ফুটি কার্পাস দরকার হতো তা মেঘনা নদীর তীরে ভালো জন্মাতো। বিশেষ করে মেঘনার পশ্চিম তীরে তা খুব ভালো জন্মাতো। ঢাকা জেলার কয়েকটি জায়গায় তা ভালো জন্মাতো। শ্রীরামপুর, কেদারপুর, বিক্রমপুর, অধুনা কাপাসিয়া বলে খ্যাত অঞ্চলে ফুটি কার্পাস ভালো জন্মাতো। মেঘনা এমনিতে বড় নদী, সমুদ্রের কাছাকাছি, দুকূলপ্লাবী বন্যায় পলি জমতো। এই পলিতে ভালো চাষ হলেও এক বিঘা জমিতে ভালো মসলিনের জন্য ছয় কেজির বেশি কার্পাস হতোনা। মসলিনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় গুজরাট থেকে তুলো আনা হতো। কিন্তু এ তুলোয় ভালো মানের মসলিন হতো না।
 
  নানা সূত্রে জানা যায় ১৮৫১সালে লণ্ডনে এক প্রদর্শনীতে ঢাকা থেকে যে মসলিন যায় তার এক পাউণ্ড সুতোর দৈর্ঘ্য আড়াই মাইল হয়। ' লণ্ডন ক্রনিকলে ' বলা হয় হাবিব্বুল্লাহ তাঁতির বোনা একখণ্ড দশ গজ মসলিনের ওজন মাত্র তিন আউন্স হয়। রূপসী বাংলার রূপ বৈচিত্র্যের মত বাংলার এই মসলিন জাঁকালো সৌন্দর্যের ঝলসানিতে মন বিমোহিত করেছিল সেকালের মিশরের ফারাও, গ্রীক থেকে শুরু করে মোগল সম্রাটদের। ইংরেজরা এর লোভে পাড়ি দেয় হাজার হাজার মাইল। হাতে কাটা এই মসলিনের এক একটা সুতোর ব্যাস ছিলো ১/১০০০ ইঞ্চি থেকে ১/ ১৫০০ ইঞ্চি। অত্যন্ত মিহি সূক্ষ্ম সুতোয় তৈরি মোহনীয় মসলিনের সুতোর কাউন্ট ৪০০ থেকে ৫৫০ বা তারও বেশি হতো।
   বাংলার মসলিনের ইতিহাস হাজার বছরের। আশ্চর্য হতে হয় মিশরের ফারাওরা মমিকে সমাধিস্থ করার সময় লিনেনের মসলিন জড়িয়ে দিতো বলে জানা যায়। ফারাওদের ইতিহাস কয়েক হাজার বছরের। গ্রীক, আর্মেনীয়ান, আরবীয়রা মসলিনের ব্যবসা করতো। মসলিন চালান যেতো গ্রীসে। গ্রীকরা পাথরের দেবী মূর্তিকে মসলিন পরাতো।

   আরবীয় বণিক ও ঐতিহাসিক সোলায়মান তাঁর নবম শতাব্দীতে লেখা বই 'সিলসিলাতি -তাওয়ারিখ '- এ বাংলার মসলিনের নান্দনিকতার উল্লেখ করায় বোঝা যায় হাজার বছর আগেই আরব দুনিয়ায় মসলিন বার্তা পৌঁছে গিয়েছিল। সে সময় জেদ্দা, মসুল ,বসেরা বন্দরেও বাংলার মসলিন গৌরবের সাথে পরিচিতি পেয়ে গিয়েছিল। প্রাচীনকালে মসলিনকে বলা হতো 'গঙ্গাবস্ত্র ', ' গঙ্গাপট্টহি'। সপ্তদশ শতাব্দীতে বাংলার এই অতুলনীয় বস্ত্রের নামকরণ ইংরেজরা করে মসলিন।

    ঢাকা, ধামরাই, জঙ্গলবাড়ি, টিটবাদি, সোনারগাঁ,বাজিতপুর মসলিন তৈরির জন্য বিখ্যাত ছিলো। জঙ্গলবাড়ির বেশিরভাগ লোকের পেশা ছিলো মসলিন বোনা। উনিশ শতকের প্রথমদিকে একশো ঘর তাঁতি পরিবার ওখানে মসলিন বুনতো। বাজিতপুরে উন্নত মানের কার্পাস উৎপাদন হতো বলে ওখানে উচ্চমানের মসলিন তৈরি হতো। মসলিন তৈরির কাজ ছিলো প্রচণ্ড কঠিন ও জটিল। এছাড়া অসামান্য নৈপুন্য, শ্রম ও ধৈর্যের প্রয়োজন হতো। সুতো কাটা থেকে শুরু করে মসলিন বুনতে দুজন সহযোগী সহ একজন তাঁতির কমপক্ষে দু 'তিন মাস সময় লাগতো। সাধারণত মেয়েরাই প্রচণ্ড পরিশ্রম ও ধৈর্যের কাজ সুতো কাটা ও তোলার কাজ করতেন। সুতো তোলার সময় কম তাপ ও আর্দ্রতার প্রয়োজন হতো বলে সকাল ও বিকেলে এ কাজ করতে হতো। আর্দ্রতার জন্য অনেক সময় নদীতে নৌকোয় বসে এ কাজ করতে হতো। এতো পরিশ্রমসাধ্য কাজের পর একজন মহিলা মাসে আধা তুলা সুতো তুলতে পারতেন। অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ ছিলো বলে ধীরে ধীরে সুতো কাটুনির সংখ্যা কমে আসতে থাকে । উনিশ শতকের শুরুতেই দক্ষ মহিলার সংখ্যা কমতে থাকে। জানতে পারা যায় সুতো কাটার কাজ বিশেষ অঞ্চল ছাড়া অন্যত্র হতো না। এর বিশেষ কারণ ঢাকার ফুটি কার্পাস এবং সুদক্ষ,  পরিশ্রমী ও অভিজ্ঞ শ্রমিক।

     সুতো তৈরির পর তাঁতিরা তাঁতে মসলিন বুনতো,. এ কাজও অত্যন্ত সতর্কতা ও ধৈর্য্য সহকারে করতে হতো। মসলিন তৈরির পর সেটা ধোয়ার কাজ। সোনারগাঁও- এর কাছে এগারোসিন্ধুর জল মসলিন ধোয়ার জন্য খুব ভালো ছিলো। আসলে জল ভালো হওয়াই       বড় কথা ছিলো না। দরকার পড়তো ধোপার দক্ষতা আর ক্ষার বা সাবান সঠিকভাবে ব্যবহার। আঠারো শতকের গোড়ায় এক টুকরো মসলিন ধোয়ার খরচ পড়তো দশ টাকা। ধোয়ার জন্য একটা বিশেষ শ্রেণী তৈরি হয়েছিলো, সবাই সেটা পারতো না। ধোয়ার সময় নানাপ্রকার ফলের রস দিয়ে কাপড়ের দাগ ওঠাতে হতো। আবার নারোদিয়া নামের একশ্রেণীর লোক যারা ধোয়ার সময় কাপড়ে কোথাও সুতো সরে গিয়ে থাকলে তা রিপু করতো। এরপর কুণ্ডুগার নামের আরেক শ্রেণীর লোক চালধোয়া জল ছিটিয়ে শঙ্খ বা ছোট মুগুর দিয়ে কাপড় ইস্ত্রি করতো। সেও অত্যন্ত সতর্কতার কাজ। কোন কোন মসলিনে সুঁচের কাজ বা চিকনের কাজ করা হতো। ঢাকার চিকনের কাজের সুনাম ছিলো। কোন কোন কাপড়ে রঙ করা হতো । এরপর কাপড় প্যাক করা হতো। এই কাজ যারা করতো,তাদের বলা হতো বস্তাবন্দ। ইংরেজদের কারখানা ছিলো তেজগাঁও -এ, ওখানে সব কাজ শেষে প্যাকিং হলে কলকাতা পাঠানো হতো। সেখান থেকে ইউরোপে পাঠানো হতো।

   সুতোর সূক্ষ্মতা, বুনন শৈলী ও নকশার পার্থক্য অনুযায়ী আলাদা করা হতো বিভিন্ন ধরনের মসলিনকে। আলাদা আলাদা নাম থেকে সহজেই মসলিন সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যায়।
   
ঝুনা : ‘ঝুনা’ শব্দটি, জেমস টেইলরের মতে, এসেছে হিন্দী ঝিনা থেকে, যার অর্থ হলো সূক্ষ্ম। ঝুনা মসলিনও সূক্ষ্ম সুতো দিয়ে তৈরি হতো, তবে সুতোর পরিমাণ থাকতো কম। তাই এ জাতীয় মসলিন হালকা জালের মতো হতো দেখতে। একেক টুকরা ঝুনা মসলিন লম্বায় ২০ গজ, প্রস্থে ১ গজ হতো। ওজন হতো মাত্র ২০ তোলা। এই মসলিন বিদেশে রপ্তানি করা হতো না, পাঠানো হতো মোঘল রাজ দরবারে। সেখানে দরবারের বা হারেমের মহিলারা গরমকালে এ মসলিনের তৈরি জামা গায়ে দিতেন।
আব-ই-রওয়ান : আব-ই-রওয়ান ফারসি শব্দ, অর্থ প্রবাহিত জল। এই মসলিনের সূক্ষ্মতা বোঝাতে প্রবাহিত জলের  মতো টলটলে উপমা থেকে এর নামই হয়ে যায়। লম্বায় হতো ২০ গজ, চওড়ায় ১ গজ, আর ওজন হতো ২০ তোলা। আব-ই-রওয়ান সম্পর্কে প্রচলিত গল্পগুলোর সত্যতা নিরূপন করা না গেলেও উদাহরণ হিসেবে বেশ চমৎকার।
খাসসা : ফারসি শব্দ খাসসা। এই মসলিন ছিলো মিহি আর সূক্ষ্ম, অবশ্য বুনন ছিলো ঘন। ১৭ শতকে সোনারগাঁ বিখ্যাত ছিলো খাসসার জন্য। ১৮-১৯ শতকে আবার জঙ্গলবাড়ি বিখ্যাত ছিলো এ মসলিনের জন্য। তখন একে ‘জঙ্গল খাসসা’ বলা হতো। অবশ্য ইংরেজরা একে বলতো ‘কুষা’ ।
শবনম : ‘শবনম’ কথাটার অর্থ হলো ভোরের শিশির। ভোরে শবনম মসলিন শিশির ভেজা ঘাসে শুকোতে দেয়া হলে শবনম দেখাই যেতোনা, এতোটাই মিহি আর সূক্ষ্ম ছিলো এই মসলিন। ২০ গজ লম্বা আর ১ গজ প্রস্থের শবনমের ওজন হতো ২০ থেকে ২২ তোলা। তাছাড়া ডোরিয়া,নয়ন সুখ,বদন খাস, সর- বন্ধ, রঙ্, আলিবালি, তরাদ্দাম,তনজেব,সরবুটি,চারকোনার কথাও জানা যায়।

   মসলিন তৈরির  জন্য দরকার হতো বিশেষ ধরনের তুলা, ফুটি কার্পাস। এ বিশেষ ধরনের কার্পাসটি জন্মাতো মেঘনা নদীর তীরে ঢাকা জেলার কয়েকটি স্থানে। একদম ভাল মানের কার্পাস উৎপন্ন হত মেঘনার পশ্চিম তীরে। যে ক’ধাপ পেরিয়ে তৈরি হতো মসলিন সেগুলো হলো; সুতো নাটানো, টানা হোতান, সান বাঁধা, নারদ বাঁধা, বু- বাঁধা , আর সবশেষে কাপড় বোনা। এসব শেষ করতে একজন তাঁতি আর তার দু’জন সহকারীর লাগতো কমপক্ষে দু’তিন মাস।
 মসলিন ছিল নানা রকমের। এর পার্থক্য নির্ণীত হত সুতার সূক্ষ্মতা, বুনন আর নকশার বিচারে। সবচেয়ে সূক্ষ্ম সুতার তৈরি, সবচেয়ে কম ওজনের মসলিনের কদর ছিল সবার চেয়ে বেশি, দামটাও ছিল সবচেয়ে চড়া। “মলবুস খাস” ছিল সবচেয়ে নামী, সেরা মসলিন। সম্রাটের জন্য তৈরি হত এই মসলিন।

   

চরকায়  সম্পদ, চরকায় অন্ন
বাংলার চরকায় ঝলকায় স্বর্ণ
বাংলার মসলিন
বোগদাদ রোম চীন
কাঞ্চন  তৈলে কিনতেন এক দিন


মসলিন তার সূক্ষ্মতা ও রমণীয়তা পেলবতার জন্য জয় করে নিয়েছিল সম্রাট, সম্রাজ্ঞী, নায়েবে নাজিম, শাহজাদা-শাহজাদীদের হৃদয়।  ত্রয়োদশ শতকে বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা যখন সোনারগাঁও আসেন তখন তিনি সোনারগাঁওয়ের মুসলিম তাঁতিদের বয়নকৃত সূক্ষ্ম বস্ত্রের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। চতুর্দশ শতকে গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের রাজত্বকালে চৈনিক পরিব্রাজকরা কংসুলোর নেতৃত্বে সোনারগাঁও, পাণ্ডুয়া ভ্রমণ করেছিলেন। চীনা দূতদের মালদহের আম খাওয়ানোর পাশাপাশি সূক্ষ্ম মসলিন বস্ত্র উপহার দেওয়া হয়েছিল।

চীনাদের ইতিহাস মিংশরে বাংলার মসলিনের কথা উল্লেখ আছে। চীনা দূতরা বাংলার মুসলিম কারিগরদের বয়নকৃত কয়েক পদের বস্ত্রের কথা উল্লেখ করেছিলেন। সে সময় জেদ্দা, বসরা, মসুল বন্দরেও ব্যবসায়ীদের আরাধ্য বস্ত্র হিসেবে পরিচিতি পায় বাংলার মসলিন। তবে ঢাকাই মসলিন তার খ্যাতি এবং মনোযোগের শীর্ষে পৌঁছায় মূলত মোঘল শাসন আমলেই।

১৭৪৭ খ্রিস্টাব্দে জেমস টেলর ঢাকাই মসলিম রপ্তানি সংক্রান্ত যে হিসেব দিয়েছেন তাতে দেখা যায় ঢাকা জেলার আড়ত থেকে বছরে প্রায় ২৮ লক্ষ টাকার মসলিন বিদেশে রপ্তানি হতো। তারমধ্যে  সোনারগাঁও- এর আড়ত থেকেই উৎপাদিত হতো প্রায় ৩ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার মসলিন। ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের পর ইংরেজরা যখন বাংলার কর্তা  হয়ে ওঠে তখন তারা বছরে আট লাখ টাকার মসলিন রপ্তানী করতো। সেই সময়ে ফরাসিরা কিনেছিলো প্রায় তিন লাখ টাকার মসলিন। এরা ছাড়াও ইরানি, তুরানি, আর্মেনীয়দের পাশাপাশি দেশী ব্যবসায়ীরাও এ নিয়ে ব্যবসা করতেন। সব মিলিয়ে এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সে আমলে ঢাকা আর বাংলাদেশ থেকে রপ্তানীর জন্য কেনা হয়েছিল প্রায় ঊনত্রিশ কোটি টাকার মসলিন।

চার পাঁচশো বছর আগে যে মসলিন হয়ে উঠেছিল পৃথিবী বিখ্যাত, মাত্র দেড়শো বছরের  মধ্যেই তা হারিয়ে গেল কেন?

পলাশীর যুদ্ধের পর পর মসলিন রপ্তানীর ব্যবসা প্রায় পুরোটাই ধীরে ধীরে করায়ত্ত করে নেয় ইংরেজ কোম্পানি। তাদের রপ্তানী হতো মূলত ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে। পলাশীর যুদ্ধের আগ পর্যন্ত দালালরা বিভিন্ন জায়গা থেকে দামি মসলিন সংগ্রহ করে কোম্পানিতে সরবরাহ করতো। পলাশীর যুদ্ধের পর মসলিন সংগ্রহের জন্য গোমস্তা নিয়োগ করা হয়, যারা ছিল কোম্পানির বেতনভূক্ত কর্মচারী। এই গোমস্তারা মসলিন সংগ্রহের জন্য হয়ে উঠে নিষ্ঠুর, চালাতে থাকে অমানুষিক অত্যাচার। মসলিন তাঁতিরা দিশেহারা হয়ে উঠে এই গোমস্তাদের অত্যাচারে। দেশীয় গোমস্তারাই হয়ে উঠেছিলো দেশের মানুষের শত্রু।

মসলিনের সাথে জড়িত আমাদের দেশের প্রতিটি কৃষক, শ্রমিক, তাঁতিকে নানাভাবে ঠকানো হতো, নির্যাতন করা হতো। গরীব চাষিকে টাকা ধার দিয়ে তার কাছ থেকে খুব কম দামে কার্পাস নিয়ে যেতো একশ্রেনীর দেশী মানুষ। দেশী মানুষরা যারা দালাল-পাইকার হিসেবে কাজ করতো তারাও তাঁতিদেরকে ঠকাতো নানা ভাবে। গোমস্তারা তো রীতিমত অত্যাচার করতো তাঁতিদেরকে। হিসেবে দেখা যায়, আনুমানিক ১৭৪০ সালের দিকে এক টাকায় পাওয়া যেতো প্রায় একমণ চাল। আর একজন তাঁতি মসলিনের কাজ করে পেতো মাসে দুই টাকা, অর্থাৎ দুই মণ চালের দাম! যাতে তার পরিবারের খাবারই ঠিকমত চলতো না, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যতো অনেক দূরের কথা।

সরোজিনী নাইড়ুর একটি কবিতায় নির্মম এই দুর্দশার ছবি জীবন্ত হয়ে উঠেছে —

“Weavers weaving solemn and still,
Why do you weave in moonlight chill?
White as a feather and white as cloud,
We weave a dead man’s funeral shroud’.


কি ভীষন ট্রাজেডি, যাঁরা তৈরি করতেন বাংলার গর্ব, যাঁদের তৈরি কাপড় গায়ে উঠতো সম্রাটের, রপ্তানী হত বিদেশে, তাঁর গায়েই থাকতো না কাপড়, পেটে পড়ত না ঠিক মত খাবার। আর সবচেয়ে দুঃখজনক বোধহয় এটাই যে এই অবিচারের পেছনে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছিলো এ দেশেরই দালাল, পাইকার আর গোমস্তারাই।

ইংরেজরা মসলিন তাঁতিদের আঙুল কেটে ফেলতো। আবার এও শোনা যায় যে- তাঁতিরা
নিজেরাই নাকি নিজেদের আঙুল কেটে ফেলতো, যাতে করে এই অমানুষিক পরিশ্রম আর কম পারিশ্রমিকের কাজে তাদের বাধ্য না করা হয়। সোনারগাঁয়ে জনশ্রুতি রয়েছে, সেখানকার একটা পুকুরেই মসলিন শিল্পীদের কাটা আঙুল নিক্ষেপ করা হত। তবে আঙুল কেটে ফেলার ঘটনা কোন ইংরেজ ঐতিহাসিক স্বীকার না করলেও কার্পাস কৃষক আর তাঁতিদের উপর কোম্পানী, ব্যবসায়ী, গোমস্তা আর পাইকাররা যে অমানুষিক অত্যাচার চালাত সেটি জাজ্বল্যমান সত্যি। আমাদের গর্বের এই মসলিনের সঙ্গে কালিমার মত লেপ্টে আছে এই রূঢ় সত্যটাও।

বিলাতে ঢাকাই মসলিনের ওপরে উচ্চহারে কর আরোপ করা হয়,ফলে মসলিনের দাম ওখানে বেড়ে যায় অস্বাভাবিক হারে। স্বভাবতই বিক্রি কমে যায় মসলিনের।
ভারতে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে উনবিংশ শতাব্দীতে তৎকালীন ব্রিটিশরাজ স্থানীয় শিল্পকে ধ্বংস করবার জন্য পরিকল্পিতভাবে  দেশীয় বস্ত্রের উপরে ৭০থেকে ৮০ শতাংশ কর আরোপ করে, যেখানে ব্রিটেনে প্রস্তুত করা আমদানীকৃত কাপড়ের উপরে মাত্র ২ থেকে ৪ শতাংশ কর ছিলো। বিলেতের সস্তা সুতো ঢাকায়, ভারতে আসতে থাকে, তা  থেকে তৈরি হতে থাকে কাপড়, হারিয়ে যেতে থাকে মসলিন।

 মসলিনের পড়তির সময়টায় পতন ঘটতে থাকে আমাদের নবাব-সম্রাটদেরও। তাঁরা আর বেশি টাকা দিয়ে মসলিন কিনছেন না— চাহিদা কম ছিল অভ্যন্তরীণ বাজারেও। তাছাড়া মুঘল সম্রাট, নবাব, ব্যবসায়ী—কেউই এ শিল্প রক্ষা কিংবা প্রসারে কোন সময়ই তেমন কোন উদ্যোগ নেননি, সব সময় চেষ্টা করেছেন কিভাবে কৃষক-তাঁতিদের যতটা সম্ভব শোষণ করে নিজেরা লাভবান হওয়া যায়। এই সব মিলিয়ে এভাবেই ধীরে ধীরে আমাদের আরও অনেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের মত হারিয়ে যায় মসলিনের স্বর্ণযুগও।
চিত্রঋণ : অন্তর্জাল 

কৌশিক চক্রবর্ত্তী


পুরুষোত্তম শ্রীচৈতন্যদেব
(পর্ব- চার)


চৈতন্যদেবের নবদ্বীপে বাল্যজীবন নিয়ে আলোচনার কোনো অবকাশ থাকে না৷ তা নিয়ে বহু গ্রন্থে ও গবেষণায় বহুবার আলোচনা হয়েছে৷ অন্নপ্রাশন, উপনয়ন থেকে গয়ায় পিতৃকার্য এবং ঘর ছেড়ে নীলাচল গমন- এই পর্যায়টুকু বহুল আলোচিত এবং সর্বজনজ্ঞাত৷ তবু জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখা যেতে পারে যে নবদ্বীপে চৈতন্য জীবনকে সরাসরি দুটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়৷ প্রথম পর্যায়ে যদি আমরা পরম জ্ঞানী, বিদ্যানিধি অধ্যাপক নিমাই পন্ডিতকে দেখি, তবে দ্বিতীয় পর্যায়ে দেখা যায় কৃষ্ণপ্রেমে দিব্যোন্মাদ এবং সংকীর্তনরত বিশ্বম্ভরকে৷ এই পরিবর্তনের পটভূমিকা হয়তো সাজানো ছিল বহু আগেই, শুধু গয়ায় শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরীর সংস্পর্শে এসে তিনি দিব্যচৈতন্য লাভ করেন৷ পিতৃকার্য সেরে গয়া থেকে নবদ্বীপ ফিরে আসার পর বৈষ্ণবরা পেয়েছিলেন এক নতুন নেতা'কে - সংকীর্তন কান্ডারি প্রভু বিশ্বম্ভরকে৷ এই সময়েই দূর হয়েছিল তাঁর সমস্ত পান্ডিত্যের অহংকার আর অধ্যাপনার ইচ্ছে৷ তথাপি ছাত্ররা আর কেউ অন্যত্র শিক্ষালাভে যেতে রাজি ছিলেন না৷ তাই সকলে মিলে শুরু হলো এক নতুন অধ্যায়৷ নবদ্বীপের পথেঘাটে সন্ধ্যেবাতি আর শাঁখের শব্দের সাথে ধ্বনিত হতে লাগলো খোল কর্তালের মাতন৷ সুসজ্জিত চৈতন্যদেবের অগ্রভাগে নাচ ও কীর্তনের মাধ্যমে নেতৃত্বদানে বৈষ্ণবরা পেলেন এক নতুন উদ্যমশক্তি৷ 
নগর কীর্তনে জমায়েত হতে শুরু করলেন অগণিত মানুষ৷ শুধুমাত্র চৈতন্যদেব নন, বৈষ্ণব সমাজের কান্ডারীদের মধ্যে নেতৃত্ব দিলেন দ্বিতীয় নেতা তথা অবধূত নিত্যানন্দ,  আচার্য অদ্বৈত, বণিক শ্রীবাস, গায়ক মুকুন্দ, গদাধর প্রভৃতি বৈষ্ণবগণ৷ বাংলার ইতিহাসে শাসকের অত্যাচারের ওপর কার্যত এ এক প্রথম প্রতিরোধ৷ 

জীবনী গ্রন্থকার বৃন্দাবন দাস ও কৃষ্ণদাস কবিরাজ এই সময়কালে প্রভুর একাধিকবার ভাবাবেশের কথা উল্লেখ করেছেন৷ দশ অবতারের ভাব থেকে হলধর ভাব- বিভিন্ন সময়ে ভক্তরা দেখতেন প্রভুর আবেশ৷ নিত্যানন্দ আগমনের পূর্বেও হলধর ভাবে আবিষ্ট হন চৈতন্যদেব৷ নিত্যানন্দ আসছেন এই স্বপ্ন দেখে প্রভু বলছেন 

কহিতে প্রভুর বাহ্য সব গেলো দূর
হলধর ভাবে প্রভু গর্জয়ে প্রচুর
"মদ আন, মদ আন" বলি প্রভু ডাকে
হুঙ্কার শুনিতে যেন দুই কর্ণ ফাটে 
(চৈ:ভা:)

হলধর বলরাম মদিরা পান করতেন৷ তাই হলধর আবেশে মদিরার কথাই বলতে শোনা যায় বিশ্বম্ভরের মুখে৷ এমন নিত্য আবেশে শিশুসুলভ চাঞ্চল্য প্রকাশ থেকে অবতার ভাব প্রদর্শন- প্রতি মুহূর্তে চলতো নিত্য নতুন লীলা৷ 

চৈতন্যদেবের নবদ্বীপ পর্যায়ে আরো দুটি বিখ্যাত ঘটনা হলো নবদ্বীপের অত্যাচারী চাঁদ কাজী এবং কোটাল জগ্ননাথ ও মাধবের (জগাই মাধাই) মধ্যে মানবপ্রেমের বীজবপন৷ চৈতন্য জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা শাসক ও রাজশক্তির সামনে চৈতন্যপ্রভাব বারে বারে দেখে থাকি৷ নবদ্বীপে কাজী থেকে উড়িষ্যার প্রবল পরাক্রমশালী গজপতি রাজা প্রতাপরুদ্রদেব বা রাজামুন্দ্রীর প্রশাসক রায় রামানন্দ - প্রত্যেকেই ছিলেন একনিষ্ট চৈতন্য সেবক৷ এমনকি গৌড় সুলতান হুসেন শাহের দুই উচ্চপদস্থ হিন্দু কর্মচারী দবীর খাস ও সাকর মল্লিক উড়িষ্যায় থাকাকালীন চৈতন্যদেবের সাথে গোপনে দেখা করতেন৷ পরবর্তী সময়ে এঁরাই বৃন্দাবনে বিখ্যাত ছয় গোঁসাইয়ের অন্যতম রূপ ও সনাতন গোস্বামী নামে শ্রীকৃষ্ণের গুপ্তলীলা প্রকাশ করেন৷ তবে অনেক গবেষকের মতে চৈতন্যদেব রাজা প্রতাপরুদ্র ও উড়িষ্যাকে রক্ষা করার জন্য বিভিন্ন কৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন৷ উড়িষ্যার প্রধান শত্রু বাংলা। আর এই বাংলার দুই প্রধান রাজকর্মচারীকে কৃপাপ্রদান তারই অঙ্গ কিনা তা অবশ্য প্রমাণসাপেক্ষ৷ তবে বিভিন্ন সংকটে তিনি যে উড়িষ্যা ও তাঁর গজপতি রাজশক্তিকে ছায়াপ্রদান করেছিলেন তা অনস্বীকার্য৷ এই কারণেই তাঁর আর এক নাম 'প্রতাপরুদ্র সংত্রাতা'৷ উড়িষ্যার বিভিন্ন লৌকিক ও অলৌকিক ক্রিয়ার বিবরণগুলি পর্যায়ক্রমে আমরা পরবর্তী পর্বগুলিতে নিশ্চই আলোচনা করবো৷ 

চৈতন্য চরিত্রে প্রকট ছিল অনেকগুলি সত্ত্বা৷ নবদ্বীপে কখনো তাঁকে দেখা যেত শিশুর মতো গঙ্গায় জলক্রীড়া করতে৷ আবার কখনো বলিষ্ঠ নেতার মতোই দৃঢ় ছিল তাঁর বজ্রকঠিন নেতৃত্ব৷ তাঁর নেতৃত্বগুনে দেখা যেত সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার আকুতি, দোষীকে শাস্তিদানের ব্যবস্থা এবং জাতিভেদকে তুচ্ছ করে মানবধর্মকে শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করার মতো দৃঢ়চেতা পদক্ষেপ৷ তাঁর দণ্ডদানের সমতাভাব বোঝাতে নবদ্বীপের একটি ঘটনা আলোচনা করা যেতেই পারে৷ তিনি বলেছিলেন শচীমাতার বৈষ্ণব অপরাধ ছিল৷ আচার্য অদ্বৈতর কাছে তিনি অপরাধী ছিলেন৷ তাই তাঁর প্রেম ভক্তি পাবার অধিকার ছিল না৷ শচীমাতার জ্যেষ্ঠ পুত্র বিস্বরূপ ছিলেন আচার্যের ছায়াসঙ্গী৷ পরবর্তী সময়ে নিমাইও হয়ে ওঠেন তাঁর সহচর৷ স্বভাবতই মাতা শচী সবসময় শঙ্কিত থাকতেন এবং আচার্য কে খুব একটা পছন্দ করতেন না৷ তাই বিশ্বম্ভর বলেন আচার্যের পদধূলি গ্রহণ করলে তবেই মা হবেন অপরাধমুক্ত৷ এই কথা শুনে আচার্য অদ্বৈত বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং সেই অবসরে শচীমাতা আচার্যের পদধূলি গ্রহণ করেন৷ এমনই ছিলেন চৈতন্যদেব৷ মানবশিক্ষার প্রতিটি পর্যায়ে তিনি ছিলেন কাঁচের থেকেও স্বচ্ছ৷ তাঁর কাছে আপন-পর তুচ্ছ৷ তিনি নির্দ্বিধায় বুকে জড়িয়ে ধরতে পারেন ভিক্ষু শুক্লাম্বরকে, আবার অবলীলায় ত্যাগ করতে পারেন রাজ্আমন্ত্রণ৷ 

এহেন প্রভুর আবির্ভাবে নদিয়ার লোকজন যে বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট হবেন, তা বলাই বাহুল্যতা৷ চৈতন্যের শক্তিতে তাঁরা সকলে ছিলেন বলীয়ান৷ যে সময় নবদ্বীপের কাজী চাঁদ খানের সাথে বিবাদ বাঁধে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের, সেই সময় তিনি নিজে সংগঠিত করেন মানুষের আন্দোলন৷ কাজী হরিনাম সংকীর্তনের বিরোধিতা করবার জন্য নির্বিচারে মৃদঙ্গ ভাঙতেন, ছত্রভঙ্গ করতেন কীর্তন মিছিল৷ তখন প্রভু নবদ্বীপ থেকে বিশাল মিছিল সহযোগে এগিয়ে এসেছিলেন কাজীর দরজায়৷ প্রত্যেকের হাতে শান্তির মশাল৷ সেই সময় ভারতবর্ষ দেখেছিলো প্রথম মানুষের আন্দোলন, শান্তিপূর্ণ সত্যাগ্রহ৷ সেই প্রেম ভক্তির বন্যায় ভেঙে যায় কাজীর যাবতীয় প্রতিরোধ, কাজীও হয়ে ওঠেন চৈতন্য অনুগামী৷ বাংলার ইতিহাসে এ এক অনন্য গৌরবের কাহিনী৷ শাসকের অত্যাচারে অতিষ্ট মানুষের মুক্তিলাভের কথা৷ নেপথ্যে সেই চৈতন্যদেব৷ 

তাঁর মতো বলিষ্ঠ তথা সহানুভূতিশীল নেতা বর্তমান ভারতবর্ষের কাছে উদাহরণস্বরূপ৷ তাঁর অনুগামী ও ভক্তদের মধ্যে যে একতা এবং মৈত্রীভাব দেখা যেত, তা চৈতন্য পরবর্তী ভারতে সত্যিই বিরল৷ পন্ডিত শ্রীবাসের একমাত্র পুত্রের মৃত্যু হয় তাঁর অন্দরমহলে চৈতন্যদেবের কীর্তন কালে৷ অন্য ভক্তদের কীর্তন আনন্দে বিঘ্ন ঘটবে বলে তিনি ঘরের রমনীদের কাঁদতে পর্যন্ত বারণ করেন৷ এমনকি বেদনায় জর্জরিত শ্রীবাস নিজেও কীর্তনে মেতে থাকেন বহু সময়৷ পরে চৈতন্যদেব জানতে পারলে নিজে হাতে শ্রীবাসের পুত্রের দেহ সৎকারে নিয়ে যান নবদ্বীপের গঙ্গার পাশে৷ মধ্যযুগের বৈষ্ণব ইতিহাসে এ এক উজ্জ্বল সময়৷ মৈত্রীর এমন উপমা সারা বিশ্ব কতবার দেখেছে, তা আজও গুনে বলা যায়৷

(ক্রমশ)

মৌসুমী বন্দ্যোপাধ্যায়

পরিস্থিতি


‘শর্মিলা, এই শর্মিলা, একটু শুনে যাও না ।’ ঘুম জড়ানো গলায় ডাক দেয় অলক ।
ময়দা মাখা হাত নিয়েই ঘরে ঢুকে শর্মিলা চোখ পাকিয়ে বলে, ‘কী হল, উঠবে, তবে তো চা দেব নাকি ?’
‘না গো, চা নয় । সে তো উঠেই খাব ।’ বলে অলক ।
‘তবে এত হাঁকডাক কেন ?’ শর্মিলা ছদ্মরাগে বলে ।
‘তুমি বড্ড কুঁড়ে হয়ে যাচ্ছ । কদিন ধরে এত জাঁকিয়ে ঠান্ডা পড়েছে আর তুমি কম্বলগুলো রোদে দেবার নামগন্ধও করছ না ।’ একটু নিচুস্বরেই বলে অলক । জানে এর পরের কথাগুলো খুব একটা সুখকর হবে না ।
কিন্তু অবাক করে দিয়ে বিপরীত প্রতিক্রিয়া পায় শর্মিলার কথায় ।
‘আরে জানি তো । কিন্তু লতা আজ নিয়ে চারদিন আসছে না । হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি সামলাতে । ঠিক আছে দেখছি । আজ যেভাবেই হোক রোদে দেব । কিন্তু তুমি উঠে পড়ো । নাহলে কিন্তু অফিসে লেট হয়ে যাবে ।’
অলক অফিসে আর কুন্তলা কলেজে বেরিয়ে যেতেই শর্মিলা ভাবে, আগে কম্বলগুলো ছাদে রোদে দিয়ে আসি । অলকটা খুব শীতকাতুরে । ঠান্ডায় বেচারা বড্ড কাবু হয়ে যায় ।
ছাদে উঠতে পাশের বাড়ির সিক্তাদির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায় । এই ভদ্রমহিলাকে শর্মিলা একটু এড়িয়ে চলারই চেষ্টা করে । যত রাজ্যের পিএনপিসির খবর মজুত ওনার কাছে ।
সামান্য হেসে উল্টোদিকে পা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই ডাক দেন সিক্তাদি ।
‘শুনেছ শর্মিলা, রাজীবের ছেলেটা চোর হয়ে উঠেছে ! নিজের বাড়ির আলমারি থেকেই টাকা চুরি করেছে । রাজীব কী মারটাই না মারল ছেলেটাকে । আর কী অদ্ভুত ব্যাপার জান, ছেলেটা দাঁতে দাঁত চেপে মার খেল, তবু একটা কথা তো দূর, চোখ দিয়ে একফোঁটা জলও পড়ল না ।’
স্তম্ভিত হয়ে যায় শর্মিলা । হাত থেকে কম্বলগুলো আপনাআপনিই পড়ে যায় ।
বুবান এই কাজ করেছে ! এই তো সবে দশে পড়ল । কয়েকমাস আগেই কত ধুমধাম করে উপনয়ন হল । বাড়িতে এসে রাজীব আর মালা দুজনেই নিমন্ত্রণ করে গেল । মালা বলল, ‘জানোই তো শর্মিলাদি বুবানের অন্নপ্রাশনে কিছু হয়নি । রাজীবের মা তার একমাস আগে মারা গিয়েছিলেন । তাই আমার ইচ্ছে ওর পৈতেটা একটু ধুমধাম করে হোক । আর আমার বাবা-মায়েরও বয়েস হচ্ছে । ওনাদেরও একটা ইচ্ছে যে নাতির পৈতেটা দেখে যাবে ।’
‘আরে সে তো খুব ভাল কথা । কিন্তু বুবানটা যে বড্ড ছোট । এই তো নয় বোধহয় । পারবে তো সব নিয়মকানুন মানতে ?’ বলে শর্মিলা ।
‘হ্যাঁ গো পারবে, পারবে । ছেলেটা তো বড় বাধ্য, জানোই তো । জন্ম ইস্তক তো দেখছ । আর তুমি হলে ওর স্পেশাল মানুষ । জেঠিমা হয়েও মাসুন ।’ বলেই হেসে ফেলে মালা ।
ঠিকই তো । ছোট্ট বুবান একদিন কচি কচি গলায় ডেকেছিল মাসুন বলে । শর্মিলা হাসতে হাসতে বলেছিল, ‘ওরে আমি তোর জেঠিমা হই ।’
দুটো গোলগোল চোখ মেলে মিষ্টি গলায় বলেছিল, ‘মাসুন !’
সেই বুবান নাকি চোর ! বুবানের মায়াভরা মুখটা বারবার ভেসে উঠছিল শর্মিলার চোখের সামনে । রাস্তায় দেখতে পেলেই দৌড়ে কাছে চলে আসবে । বলবে, ‘মাসুন ভাল আছ ? কোথায় যাচ্ছ ? সাবধানে যাবে । কুন্তলাদিদি কি কলেজ গেছে ?’
মেলাতে পারে না শর্মিলা । সব কিরকম তালগোল পাকিয়ে যায় । সিক্তাদি আরও কত কী বলে যায় । কানেই ঢোকে না শর্মিলার । শুধু বলে, ‘আমি আসছি সিক্তাদি । অনেক কাজ পড়ে আছে ।’
নিচে ঘরে এসে গুম হয়ে বসে পড়ে শর্মিলা । মনের মধ্যে একটা তোলপাড় চলে । বুবান তো সামনের রাস্তাটায় রোজ বিকেলে সাইকেল চালায় । গত দুদিন দেখেনি । তাহলে এইজন্যেই বুবান বাইরে বেরোয়নি !
রাতে অলককে সব কথা বলে শর্মিলা । অদ্ভুত এক নির্লিপ্ত মানুষ অলক । বলে, ‘ছাড়ো তো ওসব । ছেলে অন্যায় করেছে, বাবা তাই মেরেছে । এই নিয়ে এত মাথাব্যথার কিছু নেই ।’
কিন্তু শর্মিলা এত সহজে ব্যাপারটা ঝেড়ে ফেলতে পারে না । মনে মনে ভাবে, আজ হোক, কাল হোক, বুবানকে বাইরে বেরোতে দেখলেই ব্যাপারটা বুবানের মুখ থেকেই জানবে ।
কিন্তু একদিন, দুদিন, তিনদিন, এই করে সাতদিন কেটে গেল, বুবানের দেখা মিলল না । অথচ বুবানদের বাড়িতে গিয়েও খোঁজ নিতে পারল না । যদি মালা কিছু মনে করে ।
আটদিনের মাথায় বাইরের জানলা দিয়ে শর্মিলা দেখল বুবান সাইকেল চালিয়ে ওদের বাড়ির দিকেই আসছে । অবশ্য এই ছোট রাস্তাটা, এটাই বুবানের সাইকেল চালানোর রুট । নিজেদের বাড়ি থেকে শর্মিলাদের বাড়ি ।
বুবান কাছাকাছি আসতেই শর্মিলা ডাকে, ‘বুবান, একবার আয় ।’
বুবান সাইকেল থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, কিন্তু কাছে আসে না । মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে ।
‘আয় না সোনা, দরকার আছে আমার ।’ আবার ডাকে শর্মিলা ।
গুটিগুটি পায়ে  ঘরের ভিতরে এসে দাঁড়ায় । কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ‘কী হয়েছিল রে ? বাবা মেরেছিল কেন ?’
চোরের ঠ্যাঙানি খেয়ে যে ছেলে কাঁদেনি, সেই ছেলে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল ।
বলল, ‘কী করব মাসুন, বাপি তো ঠিক করে খেতে দেয় না । অর্ধেকদিন রান্নাই করে না । খিদে পেয়েছে বললে, বলে বিস্কুট খা । তুমিই বলো মাসুন, বিস্কুটে কি খিদে মেটে ?’
‘এই দাঁড়া দাঁড়া । তোর বাবা রান্না করবে কেন ? তোর মা কোথায় ?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে শর্মিলা ।
বুবান বলে, ‘তোমরা তো কেউ জানো না মাসুন । মা তো মামারবাড়ি চলে গেছে । অনেকগুলো দিন, মনে হয় একমাস হবে । বাপি আর মায়ের তো খুব ঝগড়া হত অনেকদিন ধরে । শেষকালে মা চলে গেল । আমাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল । কিন্তু বাপি কিছুতেই যেতে দেয়নি । মা বলেছিল, ছেলেটা তো তোমার পথের কাঁটা হবে । তার থেকে আমি নিয়ে যাই আমার ছেলেকে । তাও বাপি যেতে দেয়নি । আবার এখন বাপি কী বলে জানো ? আর কিছুদিন পরেই নতুন মা আসবে । তখন পেট ভরে খাস । আচ্ছা মাসুন, নতুন মা মানে তো স্টেপমাদার, তাই না ?’
শর্মিলা কী বলবে, সে তো স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে ছোট্ট ছেলেটার মুখের দিকে ।
বুবান নিজের মনেই ঘাড় নেড়ে বলে যায়, ‘আমি জানি, স্টেপমাদাররা খুব খারাপ হয় । খেতে দেয় না, ভালবাসে না । শুধুই মারে । আমি তো তাই টাকা চুরি করেছিলাম । ভেবেছিলাম পেট ভরে খাব । তারপর ট্রেনে করে মামারবাড়ি চলে যাব । কিন্তু হল না গো মাসুন । আর আদর করে ভালবেসে কেউ আমায় খাওয়াবে না । আধপেটা খেয়ে, মার খেয়েই থাকতে হবে ।’ অঝোরে কাঁদতে থাকে বুবান ।
শর্মিলা অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে । ভাবে, এ কোন্‌ বুবান ? নির্দয় পরিস্থিতির চাবুক কী করে এইটুকু সময়ের মধ্যে এত পালটে দিল ছোট্ট ছেলেটাকে !
চিত্রঋণ : পাবলো পিকাসো 

জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়


 মাদুলী 



তিলপাড়া ময়ূরাক্ষী ব্যারেজ থেকে একটু এগিয়েই শক্তিপুর, আর তার পাশে জুনিদপুর। নদীর পারে দুটো গ্রাম, এটা শুনতে ভাল লাগলেও... এইখানে ময়ূরাক্ষীতে চড়া, জল কম। ভরা শ্রাবণের কথা আলাদা, তবে ওই দু-একমাসে কী হয়... সেই ভেবে কি দিন কাটানো যায়? তারাপীঠ, বোলপুর, দুবরাজপুর, কেন্দুলী এদের অবস্থান বিন্দুগুলো জোড়া লাগালে একটা ঘুড়ি কিংবা হীরক খণ্ডের জ্যামিতিক আকারের মত দেখতে... আর তার প্রায় মাঝামাঝি অঞ্চলে এই শক্তিপুর। 
    নাহ্‌... শক্তিপুরের কোনও শক্তিপীঠের গল্প কিংবা বলার মত অন্য কোন গল্পও আছে বলে জানা নেই। তবে ওই বক্রেশ্বর, তারাপীঠ কিংবা আরও অন্যান্য দেশ-গাঁ জুড়ে ছোটবড় মন্দির, থান, মাজার - এসবের প্রভাবে... ঠাকুর-দেব্‌তায় ভক্তি, পাপ-পুণ্যের ভয়... এইসব এখানেও আছে। আর ঘটনা বা গোলমাল, এইসব কিছুও সেই নিয়ে। তাঁতিপাড়ায় একটা বুড়োশিবের মন্দির আর একটা মা মনসার থান আগে থেকেই ছিল, এই মাস চারেক হ'ল একটা রক্ষেকালীর বেদী বসেছে নিমগাছতলায়। বেদী ছিল না... মানে, কিছুই ছিল না। একটা পুরনো টালিভাঙা ঘরে গেল বছর একটা লোক এলো, সে নাকি ওই বাড়ির শরীক... এখন থেকে এখানেই থাকবে। তারপর দেখা গেল সে মাঝে মধ্যেই ভোরবেলা চান-টান সেরে নিমগাছটার তলায় বসে পুজোটুজো করে। ভিজে মাথা দিয়ে টপটপ করে জল পড়ে... ভিজে ধুতি... গাছতলার মাটি ভিজে যায় পূর্ণিমা, অমাবশ্যা, একাদশী... তিথিতে, বারে বেশ মন দিয়ে পুজো চলছে দেখে লোকজনও আসত প্রণাম ঠুকতে। পয়সা-টয়সা দিয়ে, ফল-শবজি রেখে যেত। তারপর এলো মানত... গাছের ডালে লাল সুতোয় বাঁধা ঢিল... মাটি ঠাসা মাদুলী। ব্যস্‌... সেই শরীক থেকে গেছেন। কপালে লাল তিলক আর গলায় রুদ্রাক্ষের মালা এসেছে। টালির চাল সারানো হ'ল এবছর বর্ষার আগেই... আর এই মা রক্ষাকালীর বেদী, নিমগাছ তলাটা সিমেন্টে বাঁধিয়ে দেওয়া হ'ল। লোকটা এসেছিল খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর এলোমেলো চুল নিয়ে, কিন্তু থাকতে থাকতে দাড়ি আর চুলও কেমন লম্বা হয়ে গেল - ঠিক যেমনটি সবকিছুর সাথে মানান সই হয়, তেমনটি। 

    প্রহ্লাদ সহিসের বউকে আজকাল একটু বেশি দেখা যায়, মায়ের বেদীতে মাথা খুঁড়তে, ফাঁড়া কাটাতে কড়ে আঙুল দিয়ে। প্রহ্লাদ সহিস ছাড়াও সহিসদের আরও তিন চারটে পরিবার বহুকাল ধরে আছে তাঁতিপাড়ায়; পুরুলিয়া থেকে এখানে এসেছে প্রায় দুইপুরুষ হয়ে গেল। বুড়োশিবের থান ছাড়া কোথাও এই সহিসদের এত মাথা ঠুকতে দেখা যায় না। অথচ এই মাস দুয়েকের মধ্যে নিমগাছের গোড়ায় চারটে লাল সুতো বাঁধা হয়ে গেছে প্রহ্লাদের বউয়ের। দু'বার এসে মাদুলীও নিয়ে গেছে। সব মেয়ের জন্য। মাস ছয়েক হ'ল প্রহ্লাদের মেয়ে রুমকি বাঁ চোখে কেমন ঝাপসা দেখছে। চোখে চশমা দিয়েও কমেনি। দু'তিন রকম ড্রপ দেওয়ার পর সদরের ডাক্তার বলেছে বড় শহরে নিয়ে গিয়ে দেখাতে, ছুড়িকাঁচি ছাড়া সারবে বলে মনে হয় না। উনিশ-কুড়ি বছরের মেয়ে, সবে কলেজে ভর্তি হয়েছে... কোথায় পড়াশুনো নিয়ে থাকবে, তা নয়, এই উটকো টানাপোড়েনে জেরবার। সেই রুদ্রাক্ষের মালা পরা লোকটা বলছে... মায়ের পা থেকে একটা ফুল নিয়ে মাদুলী দিলে মায়ের কৃপায় সব সেরে যাবে। মেয়ে রুমকি, মায়ের সঙ্গে রোজ সন্ধেবেলা আসে; লোকটার দেওয়া মন্ত্রপড়া জবাফুল চোখে ঠেকায়, মন্ত্রপড়া জল আই ড্রপের মত চোখে দেয়... ভেজা চোখ নিয়ে ঘরে ফিরে যায় ওপরের দিকে তাকিয়ে; যাতে জল গড়িয়ে পড়ে না যায়। 

     ওই তাবিচ কবচে হোক, ডাক্তারের আই ড্রপে হোক, বা হাবিজাবি যে কারণেই হোক... রুমকি আবার সন্ধেবেলা পড়তে শুরু করল। বই, নোটের খাতা... আর পাতার ফাঁকে গুঁজে রাখা কাগজ। বাপ মায়ের থেকে অনেক বেশি ভক্তি দেখা গেল রুমকির। মা বড়ই জাগ্রত। কলেজে যেতে আসতে দু'বার রক্ষাকালীর থানে মাথা ঠেকিয়ে যেত। সেই লোকটা কাছাকাছি থাকলে ফুলটা, বাতাসাটা দিয়ে দিতো হাতে; মুখে অমায়িক হাসি নিয়ে। রুমকিও হাসত। রুমকি সেই ফুল চোখে ঠেকিয়ে, চরণামৃতর হাত মাথায় মুছে কলেজ যাওয়ার বাস ধরবে বলে এগিয়ে যেত। আর মায়ের সেবায়েৎ সাইকেল বার করে, তাতে চটের ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরতো বাজারের দিকে। একা মানুষ তো কি?... রেঁধে-বেড়ে খেতে তো হয়। মা রক্ষাকালীর পুজো ভাল রকমই চলছিল। প্রহ্লাদ সহিসের মত অন্য আরও অনেকে বেশ ভালই ভক্ত হয়ে উঠল মায়ের। না ঠিক মা একা নয়, তার সঙ্গে তাবিচ, কবচ, আংটি, জল-পড়া... আরও যা কিছু ওই লোকটা ব্যবস্থা করে দিতে পারে। মায়ার শরীর লোকটার। কাউকে ফেরায় না। এমনই একদিন সকালে বিপিন গড়াই এসেছিল মায়ের থানে। একদম সক্কাল সক্কাল এসে হাজির হয়েছিল, দুদিন ধরে পেটে একটা মোচর দিয়ে উঠছে ঘণ্টায় ঘণ্টায়। এই ভাবে মুদির দোকানে বসে থাকা দায়। লোকটা বলেছিল সকাল সকাল খালি পেটে আসতে, একটা শেকড়-বাটা দেবে। খালি পেটে মধু দিয়ে খেতে হবে। কিন্তু এসে দেখল মায়ের থানে কেউ নেই। মা রক্ষাকালী একাই মুখে সকালের রোদে মেখে দাঁড়িয়ে আছেন। কিছু দূরের ওই টালির চালের ঘরটার দরজা বন্ধ, বড় তামাটে রঙের একটা আট-লিভারের তালা সূর্যের আলোয় চকচক করছে। বেলা বাড়তে খবর পাওয়া গেল... প্রহ্লাদ সহিসের মেয়ে রুমকিকেও সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।  ভোরবেলা শেষ দেখা গেছিল, বাড়ির পেছনে পানা পুকুরের দিকে যেতে.. যেমন রোজ সকালে যায়। সাত সকালে মেয়েটা হঠাৎ গেল কোথায়? ক'দিন আগে কলেজের পরীক্ষা শেষ হয়েছে বলে সকালের বাসে মামার বাড়ি চলে গেল? নাকি অন্য কোনও আত্মীয়ের বাড়ি? কাউকে না বলে একাই চলে গেল? প্রহ্লাদের বউ মুখে আঁচল গুঁজে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে বসে শুধু ফুঁপিয়ে গেল । প্রহ্লাদ গেল পাশের গাঁয়ে শালার কাছে খোঁজ নিতে। পাড়ার, আর আশপাশের অঞ্চলের আর যারা এই খবর পেয়েছে তারা কেউ চিন্তিত হল, কেউ মুচকি হাসল, কেউ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শুধু বিপিন এসবের মাঝে গাল চুলকোতে চুলকোতে বলেছিল - 'সকাল থেকে ওই মনোহর বাবারও দেখা নাই। পেটটাও শান্তি দেয় না... কী যে করি!' 

    নাহ্‌, তিনদিন পার হয়ে যাওয়ার পরেও রুমকির কোনও খবর পাওয়া গেল না। আশপাশের গাঁয়ে কাছাকাছি কোনও জ্ঞাতির বাড়িতেও সে যায়নি। উলটে এতে পাঁচকান হচ্ছে বেশি দেখে প্রহ্লাদ ক্ষান্ত দিলো। স্বদেশ মাস্টারের সদোপদেশ মেনে পুলিশে এফআইআর করল - মিসিং কেস। আর সেই লোকটা... মানে মনোহর; তাকেও আর দেখা গেল না শক্তিপুর বা তার আশেপাশের কোথাও। জাগ্রতা মা পুজো পাচ্ছেন না দেখে বুড়োশিবতলার বামুন তারক ভচ্চাযের ভাইপো বিভূতিই যেচে পড়ে নিমতলায় এসে বসতে শুরু করল। মাকে ত্রিসন্ধ্যা জল-বাতাসা দেওয়ার দায়িত্ব এখন বিভূতির। তবে ওইটুকুই, ওকে কেউ তাবিচ-কবচ-মাদুলী... এসবের জন্য বলে না। আর, মনোহরকে খোঁজার জন্য এফআইআর করার কথা কেউ ভেবেছিল কি না... তাও আর জানা যায় নি। 

                                                                                                            ---                  ---                  ---  

- খবরগুলো দেখলেই কেমন লাগে, মুসোলমান ছেলেগুলো বিয়ে করে নিয়ে যাচ্ছে... বলছে 'লাভ জেহাদ'!'
- থাম তো... ফালতু ব্যাপার যেতো। এগুলো নিয়ে লোকে টাইম পাস করে। 
- তোমাদের গ্রামে লাভ জেহাদ হয়? এই যে তুমি আমাকে বিয়ে করে নিয়ে এলে। এটা লাভ জেহাদ হ'ল না?
কথাটা শেষে করে ঠাকুরের আসনের সামনে ধূপকাঠিটা রেখে একটা নমস্কার করল রুমকি, তারপর ছোটো প্লেট থেকে চারটে নকুলদানা তুলে এগিয়ে এলো শামসুরের দিকে। নকুলদানাটা একবার মাথায় ঠেকিয়ে মুখে চালান করে দিলো শামসুর। তারপর  হাসতে হাসতে বলল " 'লাভ', মানে প্রেমের জন্য কেউ কোথাও সত্যিই জিহাদ করলে তোকে আমাকে এভাবে পালাতে হ'ত? এভাবে বর্ধমানে এসে নাম ভাঁড়িয়ে লুকিয়ে থাকতাম? "  
শামসুরের মুখে একেবারেই দাড়িগোঁফ নেই, তাকে দেখে শক্তিপুরের কেউ এখন আর মনোহর বলে চিনতে পারবে কি না কে জানে? কিন্তু জুনিদপুরের লোকজন তো দেখলেই চিনবে! আপাতত, আরও একবার নাম পালটে এই বর্ধমানের একটা অনামী অঞ্চলে ভাড়াবাড়িতে থাকা ছাড়া বেচারার গতি নেই। রুমকি নাম পালটাতে পারেনি, তাহলে ওর আর নতুন কলেজে ভর্তি হওয়া হ'ত না।