বাড়ির নাম সুখপাখি
___এই যে ওষুধগুলো সব দেখছেন র্যাকটার উপর,এগুলোর
ঠিকানা এখন সুখপাখির এই ঘরটা জানেন। আসুন,এদিকে আসুন,দেখুন এই সব তত্ত্বকথা,মহাপুরুষদের
বাণী সমৃদ্ধ গ্রন্থ দেখছেন, সবই এখন সুখপাখির ঠিকানায়__কি আশ্চার্য না, বীথি সেন আর
তত্ত্বকথা ! হোয়াট আ জোক…! যে কিনা এসব কোনো দিনই পাত্তা দিতে চাইনি। আর তার থেকেও
বড় আশ্চার্যের বিষয়, ঠিক এক বছরের মাথায় আপনাদের সামনে আবার আমি সেই উন্মাদ ডাক্তার
বীথি সেন । অবশ্য আপনাদের দোষই বা দিই কিভাবে ? শহরের সবথেকে নামকরা অ্যাঙ্কোলজিস্ট
ডক্টর বীথি সেন মানসিক বিকার গ্রস্ত। আর তার উন্মাদনার ঘটনায় আজ খবরের শিরোণামে এই বিখ্যাত হাসপাতালটি। অবশ্য আপনারা তো আপনাদের কাজ করে গেছেন ।এমন মুখরোচক
খবর পেলে মশাই কোন পাগলে বলুন তো তাকে হাতছাড়া করতে পারে ? তাই নয় কি মিস্টার বাসু,ইউ…
অ্যাম আই রাইট…? হা, হা, হা…
___অ্যাকচুয়ালি কি জানেন তো, পাগল আমি কোনো কালেই
ছিলাম না । যেটা ছিলো আমার,তা হলো আমার দৌড়ানোর নেশা। এগিয়ে যেতে হবে অনেক অনেক দূর।
আসলে, যখন সদ্য সদ্য অক্ষরের সাথে পরিচয় ঘটে আমার,ঠাকমার শেখানো একটা বিখ্যাত লাইন
আমার মনে ধরে যায় । আপনারাও হয়ত ! আহা, হয়ত কেন আবার,অবশ্যই জেনে থাকবেন---“লেখাপড়া
করে যে,গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে ।“ আর এই গাড়ি ঘোড়া চড়েই যে আমাদের এগিয়ে যাওয়াটাই প্রধান
লক্ষ্য,সেটাই ধীরে ধীরে আমার রক্ত,মজ্জায় ঢুকে যেতে থাকে বায়ু সেনার অফিসার বাবা এবং
অধ্যাপিকা মায়ের সহচর্যে । তবে যা ছিলাম,একটু বেশি অনুভূতিপ্রবণ । আর সেটাই হয়ত আমার
প্রথম পাগলামির লক্ষণ !কখন যে কোথায় চলে যেতাম একা একা,নিজেই জানতাম না। একদিন তো মা
কলেজ থেকে ফিরে দ্যাখেন,আমি ঘরে নেই। বাবাও খুব কম ফিরতেন সে সময় শহরে—তারপর আর কি
,খুঁজে খুঁজে আমাকে পাওয়া গেল আমাদের ফ্ল্যাটের ঠিক দক্ষিণ বরাবর যে রাস্তাটা চলে গিয়েছে,সেখানেই
একটা কবরস্থানের কাছেই ।ভয় ডর তো প্রাণে তেমন ছিলো না,আবার ছিলো না বললেও হয়ত কিছুটা
ভুল হবে। আসলে,কেন জানি,আমার এই একটা মনের ভিতরে অনেকগুলো মনের বাস ছিলো ।এই যেমন আমি
ছুটতেও পারি জীবনের সাথে তেমনই এই একাকীত্ব,এই নির্জনতাও আমার প্রবল ভালোবাসার। তাই
কখনো বা ফ্ল্যাটের জানলার রেলিং ধরে নিজের মনে কথা বলে যেতাম আবার কখনও বা আমার থেকে
অনেক অনেক ছোট্ট বাচ্চাদের পেলেই বসে যেতাম ওদেরকে নিয়ে সেই ছোট্ট বেলার মতো । হ্যাঁ
জানি,আশেপাশের লোকজন চোখ ট্যাঁরা করে দেখে নানান উপহাস করত,কিন্তু সত্যি বলতে কি,এসব
সেভাবে আমার মনেই ঢোকেনি কখনও ।
__ আরে
মশাই দেখুন তো ভুলেই গেলাম…আসুন এবার একটু চা হয়ে যাক ।আজ যেরকম ওয়েদার করে আছে সেই সকাল থেকে !এই পরিবেশে গরম গরম চা কিন্তু ভালোই মানাবে…কি বলো বাসবী ?
তুমি তো আমাকে অনেকগুলো বছর ধরেই চেনো ।খুব একটা ভুল না হলে তা সেই তোমার প্রথম অফিস
থেকে ! যাইহোক, আমার বিশু কিন্তু বেশ ভালোই চা বানায়…নিন ! ( ট্রে টা সামান্য এগিয়ে
দিলো বীথি )
__ যা বলছিলাম,আমার ছোটো বেলার কথা । সেভাবে হয়ত
কাটেনি আমার ছেলেবেলা ।ঠামের মৃত্যুর পর বাবার অভাব আর মায়ের ব্যস্তময় জীবনের প্রতিটি
পদক্ষেপই আমাকে শিখিয়েছে ছুটতে হবে,ছুটে চলতে হবে । বই,খাতা,পেন নিয়ে গাড়ি,ঘোড়া থেকে
আরও অনেক অনেক বড় রাস্তার উদ্দেশ্যে ।গতির নেশা পেয়ে বসেছিল আমায় । আর এই ছুটতে গিয়েই
সব…( বীথির মুখটা এখন হয়ত সুখপাখির জানলায় কাউকে না কাউকে খুঁজতে চায় ) বরাবরই স্বাধীনচেতা
মানসিকতার ছিলাম আমি । একা থাকব,কারোর উপর কখনই ডিপেন্টডেন্ট হবোনা,আর তাই মনে হয় এইসব
প্রেমটেম আমার জীবনে তেমন পাত্তা পাইনি ।ঠিকই করেছিলাম বিয়ের পিঁড়িতে বসব না কোনোদিন।বিদেশে
সেটইল করব । তবু মায়ের মৃত্যুর পর বাবা চাইলেন আমিও যেন সব মেয়ের মতো বিয়ে করে সুখী
হই ।
__তবে কি জানেন,সুস্থ হয়ে উঠছিলাম ধীরে ধীরে। আসলে,খুব
যে একটা পাগলামি করতাম,তা তো নয় !হয়ত কিছুটা লক্ষণ ছিল। চিকিৎসায় ভালো রেসপন্সও ছিল।
ক্রমশ নিজের চেম্বারে আবার বসতে শুরু করলাম,হাসপাতালেও নিয়মিত যাতায়াত শুরু করলাম ।
কিন্তু ওই যে,সেদিন! কি যে হলো ! আপনারা তো জানেন সব (মুখটায় তাচ্ছিল্যের হাসি রেখে)
!
__অবশ্য সে সময় মনে হয় আমাদের এই সংবাদ মাধ্যমের
ব্যবসা ভালোই চলেছিলো ।কি বলেন মিস্টার বসু ? আসলে কি জানেন তো,এই ‘পাগল’ শব্দটা আমার
বড় অপছন্দের । অবশ্য সেটাই মনে হয় সব পাগলদের প্রাথমিক লক্ষণ ।কিন্তু কেউ কি আর নিজেকে
সেভাবে মানতে চায় বলুন _( নিজের ডান হাতের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে গেলেন বীথি ওর সামনে
উপস্থিত সাংবাদিকদের ।)
__হ্যাঁ,যা বলছিলাম, আর সহ্য করতে পারলাম না সেদিন
।কয়েকদিন ধরেই বেশ একটা কানাঘুষো শুনছিলাম। কিছুটা ট্রেস কাটিয়ে ফিরে আসার পর আমাকে
নিয়ে মানে আমার পাগলামো নিয়েই চর্চা ,সে আর বুঝতে অসুবিধা হয়নি আমার ।প্রথমে বিশেষ
পাত্তা দিইনি জানেন, কিন্তু সেদিন ওই পেশেন্টের সাথে আসা ওই ব্যক্তি ! ওর রিলেটিভ কিংবা
বন্ধু গোছের কেউ হবে,তার এমন অবাক করা আচরণ ! আসলে কি জানেন তো মানুষ কিন্তু আজও মানসিক অবসাদ আর পাগলামো,এই দুটো ভীষণই এক করে ফ্যালে । যাইহোক,
এটাই আমার চাকরী জীবনের সমাপ্তি কাল ।তবু ওই যে,অপরিসীম জেদ,হারবো না কিছুতেই…ডুবে
গেলাম ক্রমশঃ আরো গভীর ডিপ্রেশনের ভিতর ।যদিও অ্যাসাইলাম থেকে ফিরে আসার পর অতীতের
ঘটনা তেমন করে আর মনে নেই,মনে রাখতেও চাইনা আর । তবে বিশুর মুখে শুনেছি সত্যিই আমি
ধীরে ধীরে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম । কথাবার্তা,চালচলনে অসংলগ্নতা প্রকাশ পেতে
থাকে। বদ্ধ উন্মাদের মতো যা খুশি তাই ভাঙচুর করা…উফ !!! এখন ভাবলে সত্যিই অবাক লাগে
। আর শৌনক! শৌনক মিত্র, যার সাথে সুখে থাকতে দেখলে আমার বাবা এবং প্রয়াত মা সবথেকে
বেশি খুশী হতেন,সেই সহজ সরল মানুষটাকেও সুখে রাখতে পারলো বীথি সেন ।
___ছেড়ে এসেছিলাম শৌনক কে নিজের অত্যাধিক ইগোর
বশে ।ও, এক মিনিট…প্লিজ নোট ডাউন…আমাদের কিন্তু আজও ডিভোর্স হয়নি ।আসলে মনে মনে আমি চেয়েছিলাম ডিভোর্স
। কিন্তু শৌনক যে শুধুমাত্র একজন মানুষ নয়,আরও অনেক বেশি কিছু,সেটা তখন বুঝে উঠতে পারিনি
।বাবার সাথেও সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেল । আরও অনেক অনেক নাম,যশের আশায় ছুটে চললাম রাতদিন
।এই ‘সুখপাখি’ তারই নিদর্শন । কত সুখ না আজ এই সুখপাখির ভিতরে, দেখেছেন ?
__তবে, শৌনক আর আমার পিতৃদেব এখনও কিন্তু সেই
আগের মতো আমার সুখ কামনা করে চলেছেন । অথচ, আজ
আমি,সেই উচ্চাকাঙ্খী বীথি সেন এত সুখ আর চাইনা । এবার থামতে চাই। শুধু থামতে…লিখে
নিন, আপনাদের আজকের সান্ধ্য শিরোণাম_ উন্মাদ ডাক্তার বীথি সেন আজ ক্লান্ত…ঘুমাতে চায়,শুধু ঘুম। আশাকরি,এই সোসাইটি
বেশ ভালোই খাবে খবরটা ।
---