সোমবার, ৮ অক্টোবর, ২০১৮

সম্পাদকীয়




আর কটা দিন পরেই পূজো I চারিদিকে মা আসছে মা আসছে গন্ধ ৷ এরই মধ্যে ঘটে যাওয়া সুপ্রিম কোর্টের রায়ে দেশ উত্তাল ৷ মানুষজন বুঝে কিংবা না বুঝে পরকীয়া নিয়ে নানা টিপপনি করছেন । কোনটা স্বকীয়া আর কোনটা পরকীয়া তা নিয়ে চলছে বিস্তর বাদানুবাদ ৷ সকল তর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে সেই নারী । আদি অন্তিম কাল থেকে তাকে নিয়ে রহস্যের অন্ত নেই ৷ যুগ যুগ ধরে ঘটে চলা শ্বাশত বাণীর মত চিরন্তন ৷ 


 দুর্গা আমাদের ঘরের মেয়ে I কিন্তু দুর্গা নিয়ে পুরাণ যা বলেছে তাতে নারী নিয়ে সুচিন্তা বা ভাবনা হয়েছে ইতিহাস তা বলে না ৷
ব্রহ্মার মানসপুত্র দক্ষ প্রজাপতির ছিল আট মেয়ে। তাঁদের মধ্যে সবার বড়ো ছিলেন সতী। দক্ষরাজ সতীকে শিবের হাতে সমর্পণ করেছিলেন। শাস্ত্রে আছে শিব শ্বশুরকে যথোচিত সম্মান করতেন না। বরং শ্বশুরের সামনেই তাঁর অশেষ গুণাবলির নিদর্শন স্থাপন করতেন।এই প্রথা যেন আজও চলে আসছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় ৷ চিরায়িত সত্য এই শ্বশুড় ও জামাইয়ের সম্পর্ক ৷ পুরাণ থেকে অাজও যেন কোথাও এক বিশাল বেড়াজাল । সেই জালের মধ্যে কখনও কোন স্বাভাবিকতা নেই ৷ 



  দক্ষরাজ তাঁর এই জামাইটির প্রতি বিশেষ সন্তুষ্ট ছিলেন না কখনও । সঙ্গে সঙ্গে সতীও হয়ে উঠেছিলেন বাবার বিশেষ অনাদরের পাত্রী। দক্ষরাজ তাঁর অন্য মেয়ে-জামাইদের বাড়িতে ডাকতেন। এখানেও কেমন যেন ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ছাপ দেখা যায় ৷ অর্থ , প্রতিপত্তি নির্ধারণ করত সামাজিক পরিচয় সেই পুরাণ থেকে আজও  ৷ তাই তিনি  শিব-সতীকে কখনই ডাকতেন না। সতীর বিয়ের কিছুদিন পরে দক্ষরাজ এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। যথারীতি সেই যজ্ঞে তিনি অন্যান্য মেয়ে-জামাইদের আমন্ত্রণ জানালেন; শুধু ডাকলেন না শিব-সতীকে। যে যজ্ঞে সমস্ত দেবতা, প্রানী, ঋষি, গন্ধর্ব, যক্ষ, কিন্নর, অসুর, নাগ, অপ্সরা, চারন, নবগ্রহ, সপ্তর্ষি এমনকি ব্রহ্মা, বিষ্ণু কে পর্যন্ত নিমন্ত্রণ জানালেন ৷সতী লোকমুখে জানলেন বাবার যজ্ঞ আয়োজনের খবর।তিনিও যজ্ঞস্থলে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। শিব বারণ করলেন। সতী শুনলেন না। আমাদের তথাকথিত নারীদের এই দোলাচল থেকেই যায়  ৷ বাবা ও স্বামী দুই পুরুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব কোনদিনই ঘুচবে না ৷ 


দক্ষরাজ জানতেন এই যজ্ঞের  খবর ঠিকই পৌছবে শিব সতীর কাছে এবং তাদের যে না ডাকার কারণটা প্রতিষ্ঠিত হবে তাদের পরিচিতমহলে ৷ এই বিভেদে সব থেকে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে যে তাঁর মেয়ে তা যক্ষরাজ হয়ত বোঝেননি বা বুঝেও না বোঝার ভান করেছিলেন ৷ কিন্তু সতী পারেননি নিজেকে ধরে রাখতে ৷অনাহত হয়ে সটান যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হয়ে  প্রশ্ন করে বসলেন, ‘বাবা, দেবাদিদেব মহাদেব কেন এই যজ্ঞে আমন্ত্রিত হননি?’ দক্ষরাজ উত্তরে বললেন, ‘শিব সংহারের দেবতা। তাই তিনি অমঙ্গল বয়ে আনতে পারেন। তাছাড়া তাঁর বেষভূষাও ভদ্রজনোচিত নয়। তিনি শ্মশানচারী। ভূতপ্রেত তাঁর নিত্যসঙ্গী। সেই সব নগ্ন অনুচরবৃন্দের সম্মুখে তিনি নানান কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি প্রদর্শন করে থাকেন। তাঁকে নিমন্ত্রণ করলে সমবেত সুধী দেবমণ্ডলীর সামনে আমাকেও অপ্রস্তুত হতে হবে। সেই কারণেই শিবকে এই যজ্ঞে নিমন্ত্রণ করা হয়নি।’ এমন কঠিন বাক্য স্ত্রী হয়ে সহ্য করা অসম্ভব ছিল সতী'র কাছে  ৷ একদিকে বাবা অন্যদিকে স্বামী ৷ স্বামী হলেন  তাঁর প্রাণের ঠাকুর। বাপের মুখে পতিনিন্দা সতীর প্রাণে শেলের মতো বিঁধল। যজ্ঞাগ্নিতে সতী-দেহ আহুতি দিলেন শিবানী। সতীর দেহত্যাগের সংবাদ পৌঁছালো দেবাদিদেবের কানে। ক্রোধে উন্মত্ত দেবাদিদেব বীরভদ্র, ভদ্রকালী প্রমুখ অনুচরবৃন্দকে দিয়ে দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করালেন। কন্যার দেহত্যাগের কারণে যক্ষের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন। তারপর সতীর অর্ধদগ্ধ দেহ কাঁধে তুলে উন্মত্তের মতো ছুটে বেড়াতে লাগলেন এলোক থেকে সেলোক। ত্রিভুবন ধ্বংস হওয়ার জোগাড় হল তাঁর ক্রোধের তেজে। তখন আসরে নামতে হল বিষ্ণুকে। সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করে ছড়িয়ে দিলেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে। সতীদেহের অন্তর্ধানে শান্ত হলেন শিব। বসলেন মহাধ্যানে।

এই হল পুরাণ ৷ হর পার্বতীর এই প্রেমের গল্প আমরা শুনে আসছি ছোটবেলা থেকেই ৷ কিন্তু সতীর এই যজ্ঞে আহূতি দেবার কারণ কি ! পুরাণে যজ্ঞ হলেই আহূতি দেবার প্রচলন ছিল তা পশু হোক বা মানুষ ৷ তবে কি সতীকে জোড় করা হয়েছিল নিজেকে আহূতি দেবার জন্য ৷ সতীদাহ প্রথার জন্ম তখন থেকেই হয়েছিল ৷ প্রাচীন কালে রাজা মহারাজরা যজ্ঞ করতেন কোন উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য ৷ যক্ষরাজ কোনদিনই শিব - সতীর বিয়েকে  মেনে নিতে পারেননি ৷ যেহেতু শিব দেবমহলে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন তাই তাকে আক্রমণ করা যক্ষরাজের পক্ষে সম্ভব ছিল না ৷ ফলসরূপ সতী যক্ষরাজের মেয়ে হবার সত্ত্বেও তাকে সেই অসম বিবাহের দায় বহন করতে হয়েছিল ৷ সম ও অসম সম্পর্কের দায়ভার চিরকালই বহন করে চলতে হয়েছে নারীদের ৷ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এটাই স্বাভাবিক l শিব দেবশ্রেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও সেই ক্ষমতা বা ব্যবস্থার উর্ধ্বে উঠতে পারেননি ।তাই তার ক্রোধের উপহারসরূপ যক্ষরাজের মুণ্ডচ্ছেদ করে থাকেন ৷ ক্রোধ ,হিংসা এই রিপুগুলি আমাদের সৎ ইচ্ছাকে দমিয়ে দেয় ৷মানুষের  অস্তিত্ব ,আশ্রয় বিপন্ন হলে দেবতা'র পায়ে ঠাঁই নেয় ৷ কিন্তু সেই দেবতাগণ লোভ ,হিংসার উর্দ্ধে উঠতে পারে না । তাই তুল্যমূল্য বিচার করলে দেখা যায় দেবতা ও মানুষ সমান্তরাল পথে দাঁড়িয়ে থাকে ৷সেখানে নেই কোন বিভেদ নেই দ্বন্দ্ব ৷যে সমাজব্যবস্থা চলে আসছে অতীত কাল থেকে তার কোন শেষ নেই ৷  হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে-তিন প্রধান দেবতার (ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর বা মহাদেব) অন্যতম। ইনি স্বয়ম্ভূ। ইনি ধ্বংসের অধিকর্তা। এঁর প্রধান অস্ত্র ত্রিশূল। ধনুকের নাম পিনাক। ইনি বিশ্বধ্বংসকারী পাশুপাত অস্ত্রের অধিকারী। মহাপ্রলয়কালে ইনি বিষাণ ও ডমরু বাজিয়ে ধ্বংসের সূচনা করেন।এককথায় ধ্বংসের দেবতা বলা যেতে পারে ৷আবার অপরদিকে ইনি মহাযোগী,সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী, নির্গুণ ধ্যানের প্রতীক। একই দেহে দুটো সত্ত্বা বহন করে আনেন ৷ একদিকে ত্যাগী অপরদিকে বিনাশী ৷ রক্তমাখা বাঘছাল নিম্নাঙ্গে ধারণ করেন, কিন্তু উর্ধ্বাঙ্গ নগ্ন। তবে কখনো কখনো কৃষ্ণসার হরিণের চামড়া উত্তরীয় হিসাবে উর্ধ্বাঙ্গে পরিধান করেন। শরীর ভস্ম দ্বারা আবৃত। মাথায় বিশাল জটা। কপালের নিম্নাংশে তৃতীয় নেত্র, উধ্বাংশে অর্ধচন্দ্র ও কণ্ঠে সাপ ও কঙ্কাল মালা।প্রলয় শেষে ধ্বংসের মধ্য থেকেই তাঁর উৎপত্তি ঘটে। সে কারণে শিব, শঙ্কর বা ভৈরব নামে চিহ্নিত। জনন শক্তির পরিচায়ক হিসাবে শিবলিঙ্গ। এর সাথে যোনি প্রতীক যুক্ত হয়ে প্রজনন বা সৃষ্টিশক্তিরূপে হিন্দু ধর্মে পূজিত হয়। ধ্বংস ও সৃষ্টি উভয়েরই কারণ বলে ইনি ঈশ্বর। সুতরাং শিবের পরিধান এবং চরিত্র অনুযায়ী তাকে যৌনসত্ত্বার প্রতীক হিসাবে দেখা যায় ৷ একদিকে সতীর মত স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও কৈলাসে তাকে সিদ্ধ, চারণ, কিন্তু গন্ধর্ব এবং প্রমথগণ পরিবেষ্ঠিত অবস্থায় বাস করতে হত ৷ চিরায়ত এই ব্যবস্থা শিখিয়েছে আমাদের শাস্ত্র । সেই ব্যবস্থা আজও চলে আসছে ৷ যে দেবতা পূজীত হন সৃষ্টির ধারক হিসাবে তাঁর পরিধানের মধ্যে এমন অসলগ্নতা থাকবে কেন ! আসলে এই কেন উত্তর পাওয়া যাবে না ৷কারণ আমাদের এই সমাজ বেআব্রু হতে দেখিয়েছে পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সেই প্রাচীনকাল  থেকে ৷দেবতাগণ সর্বদা অপ্সরা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতনে ৷ সুরা , নাচ, গান আমোদ প্রমোদের মধ্যে থাকতেন এনারা ৷ চারিদকে এত আমোদের মধ্যে থেকেও দেবতাগণ পূজীত হতেন ৷ তার ব্যাতিক্রম শিব ছিলেন না । কিন্তু সতী তাঁর স্বামীকে নিজের প্রাণের থেকে বেশী ভালোবাসতেন ৷ তাই নিজের বাবা ,যার কাছে বেড়ে ওঠা তার মুখে পতীর নিন্দা সহ্য করতে পারেন নি ৷ এই চিত্র শিখিয়েছে ভারতীয় নারীদের ৷ "বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে ৷" পতিসেবা পূর্ণ সেবা ৷ এই হল নারীর অভিধান ৷ সতী সেই নিয়মের বাইরে যেতে পারেনি ৷ তাই সতীর এই দেহত্যাগ আমরা শুধু ধর্মের বেড়াজালে আটকে রেখেছি ৷ কিন্তু তার এই দেহত্যাগ আসলে ধনত্যান্ত্রিক , পূজিবাদ ব্যবস্থার বিপরীতে বলিদান বলা চলে ।সে ব্যবস্থায় পূজিবাদ , প্রতিপত্তি মুখ্য ৷সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে সতী নিজের জীবন দিয়ে ৷ এই সমাজব্যবস্থা শিখিয়েছে নারীকে অবলা ভাবতে  । পতী সেবা পরম ধর্ম ৷এটাই শিখিয়েছে আমাদের সমাজ নারীদের ৷তাদের চিরকাল পর্দার আড়ালে থাকতে পছন্দ করেছে ।অপরদিকে পুরুষ একাধিক মহিলা পরিবেষ্টিত হয়ে থাকাটা আমাদের সামনে এসেছে ৷ তার দেবতাই হোক কিংবা সাধারণ মানুষ ৷ব্রাক্ষণ সমাজে একজন পুরুষ একাধিক বিবাহ প্রথা প্রচলন ছিল । প্রতিদিন এক এক বউ বাড়ি গিয়ে থেকে চব্য - চোষ‍্য- লেহ্য খেয়ে টাকা ,পয়সা নিয়ে বিদায় হতেন ৷


এই সমাজব্যস্থায় দাঁড়িয়ে  একমাত্র সতী না বহু সতী রক্তপাত করেছে সমাজের বেষ্টনীতে ৷ইতিহাস তাদের মনে রাখেনি ৷ আর রাখে না ৷ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া ঘটনা কখনও লিপিবদ্ধ হয় না ৷ থেকে যায় সহস্র যন্ত্রণার মাঝে , মনের গহীনে ৷ 


"সৃজন " শারদ সংখ্যাটি দ্বিতীয় বর্ষ দশম সংখ্যায় পড়েছে ৷ "সৃজন " সকল পাঠক , লেখক বন্ধুদের জানাই শুভ শারদীয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা ৷ভালো থাকুন সবাই ৷ 
পারমিতা চক্রবর্ত্তী

সৃজন 
সম্পাদিকা 

মলয় রায়চৌধুরী


        
হৃৎপিণ্ডের সমুদ্রযাত্রা : রবীন্দ্রনাথের দাদুর মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ ও দেবেন্দ্রনাথের সমালোচনা 





হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না বিয়ের আগেও ছেলে-মেয়েরা ট্যাবলেট খেয়ে যতোবার  যতোজনের সঙ্গে ইচ্ছে সেক্স করতে পারে । ইচ্ছে মেয়েদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে ।
        তুই অতো ভাবছিস কেনো, দেখে যেতে পারিনি বটে, মেয়েদের স্বাধীনতা তো আমার জন্যেই সম্ভব হয়েছে, আমি যদি না অঢেল টাকা রোজগার করতাম, আমাদের বাড়ির মেয়ে-বউরা কি নারী স্বাধীনতা আনতে পারতো?
        হায়, রাজকুমার দেখে যেতে পারলেন না কানির বদলে মেয়েরা স্যানিটারি ন্যাপকিন বাঁধে ।
        তুই ভুল ভাবছিস, হুলি ।
        হায়, রাজকুমার এতো সাহসী ছিলেন হয়তো নিজেই স্যানিটারি ন্যাপকিনের কারখানা বসাতেন ।
        হ্যাঁ, আমিই কারখানা বসাতুম, ওতে বিশেষ লগ্নির দরকার হয় না ।
         আমার মনে পড়ল যে বিশ শতকের সাতের দশক আমি একটা কলেজে সমাজবিজ্ঞান পড়াতুম, আমার নাম ছিল হুলিচরণ ভট্টাচার্য, স্নাতকোত্তর সিলেবাসে ‘ভুতবিদ্যা কামাখ্যাতন্ত্র’ নামে একটা বই ছিল, রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড নিয়ে পৌঁছোতে মোটে এক সপ্তাহ বাকি,  আশঙ্কায়, কী করবে ঘাটে নেমে ঠিক করে উঠতে পারছিলুম না, কেননা রাজকুমারে এতো শত্তুর ছিল, তারা নিশ্চই জেটিতে এসে ব্যাগড়া দেয়া আরম্ভ করবে ।
        চোখ বুজে আঁচ করতে পারলুম, জেটির খালি-গা হেটো ধুতি বামুনগুলো আর অতিবামুন কাল্টের কোরাধুতি কাঁধে চাদর লোকেদের নির্ঘাত ভুতে পেয়েছে, জানি আমি, রাজকুমারের হৃৎপিণ্ডের দিকে এক ঠায় তাকিয়ে এক্কেবারে নিশ্চিত হলুম ।
          ‘ভুতবিদ্যা কামাখ্যাতন্ত্র’ বইয়ের মন্তর মনে পড়ে গেল যা স্নাতোকোত্তরে ছাত্র-ছাত্রীদের মুখস্হ করাতুম যাতে ওরা জীবনে বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে কেউকেটা হয়ে উঠতে পারে, আইআইটি আইআইম-এ ভর্তি হতে পারে, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে পড়াশুনা করে সেদেশের মেম বিয়ে করে এদেশে মাবাপকে ভুলে যেতে পারে । জাহাজের জেটিতে পৌঁছে, যাদের ভুতে পেয়েছে, আর তাদের মগজে ঢুকে নানা উৎপাত করছে, তাদের কাছে গিয়ে চুপিচুপি এই মন্তরটা তিনবার পড়তে হবে আর ওদের শরীরে তিনটে ফুঁ দিতে হবে ।
        জেটিতে নামার পরে তো কাছ-ঘেঁষতে দেবে না ওরা, আমি যে শুদ্দুর, তাই জাহাজের কেবিনে বসেই এই মন্তরটা তিনবার পড়লুম :
ভুত কে ? আমি কে ? কে বলতে পারে ?
ভুতের সন্ধান করি বেড়াই ঘুরে ঘুরে ।
ভুতের দেখা পেলাম হেথা ।
ভুতের সঙ্গে কই কথা ।
শুনাই কানে হরেকৃষ্ণ হরেরাম ।
সজীব ছিল নির্জীব হলো শুনে রামনাম ।
ভুতের রাজা মহাদেব রাম নামেতে খেপা ।
ভুতকে ডেকে নিলেন কাছে বুকে পেয়ে ব্যথা ।
দোহাই শিবের, দোহাই রামনামের ।
জেটিতে যারা দাঁড়িয়ে থাকবে তাদের ঘাড় থেকে শিগগির যা ।
জয় ভুতনাথ জয় জয় শিবশঙ্কর ।
          মনে মনে মন্তরটা তিনবার আওড়ালুম ।
          রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড শুনতে পেলে চটে যাবেন, বলবেন তোদের এইসব ভুতপ্রেতে বিশ্বাস গেলো না, বিলেত ঘুরিয়ে নিয়ে এলাম, তবুও গেঁয়ো মুর্খ থেকে গেলি, সভ্য মানুষ হতে পারলি না ।
          না, রাজকুমারের হৃৎপিণ্ড সেসব কিছুই বললেন না । বয়ামে ফরম্যালিনের শরবতে হয়তো উনি এখন ঘুমোচ্ছেন, সমুদ্রের এমন ঢেউ, এমনিতেই ঘুম পায়, মনে হয় মায়ের কোলে দোল খাচ্ছি । আর ওনার তো নিজের মা ছিলেন না, যদিও সৎমা ওনাকে খুবই ভালোবাসতেন ।
         ভুত যার কিংবা যাদের ঘাড়ে ভর করে সহজে তাদের ছেড়ে যায় না । আমার মনে হতে লাগলো জেটিতে যারা হৃৎপিণ্ডের জন্য অপেক্ষা করছে, তাদের ঘাড়ের ভুতগুলো হয়তো তাদের ঘাড় থেকে নেমে তাদের ছেলেপুলের ঘাড়ে চাপবে, ছেলেপুলের ঘাড় থেকে নেমে তাদের ছেলেপুলের ঘাড়ে চাপবে, হয়তো কেন, নিশ্চই ঘাড়ের পর ঘাড়ে চেপে সব বাঙালির ঘাড়ে ভুতেরা ভর করেছে, তাদের আর যাবার নাম নেই, রাজকুমারকে হিংসে করার লোক কি কম আছে আজকের দিনে ? একজন আরেকজনকে হিংসে না করলে শ্বাস নিতে পারে না।

স্বপন রায়





মাধবী সিরাপ-৪১  
................

মাঝখানে  ‘ঝরিছে শ্রাবণধারা...’ কেউ নেই ওদিকে। ফাঁকা জায়গাটায় মাধবী না এলেও মাধবী। যে লিখেছিল, প্রযত্নেঃ পরানসখা, যে কখনো লেখেনি, ফিরে এসো। তখন লেখা হত। মাঝখানে শুধু বিশ্বাস। হে দেবব্রত, সে লেখেনি কখনো। সেও কি মাধবী। অন্ধকার খুলে যে কত কিছু পরতো। নাকি পরছে? তাই এত হাওয়া, স্থাণু।
ঝড়ের রাতে ‘যত্ন’ ভেসে যাচ্ছে, দেখে মাধবীও। খিলখোলা সেই দরজা মাধবীর, আস্কারা ট্রলির। ছুরি, কাঁচি, অ্যান্টিবায়োটিক। রক্ত মাধবীর, যত্নে মুছে দিচ্ছে শেষ জ্যোৎস্না, খুব ধবধবে ছিল যা, নার্সটির যেমন। সঘনগহন মোহ নয় কিন্তু। সামান্য তেরছা আলোয় অচেনা শোক মিশলে যেমন হয়, সেরকম।
শ্রাবণসোঁতায় ঘোলা এই মাঝারিয়ানা আমার। শুধু আমার।
মাধবীর নয়....

পিনাকী মুখোপাধ্যায়



পরকীয়া
 
“ ধূর ! ভাল্লাগে না ! “ স্মার্ট ফোনটা সজোরে বিছানায় ছুঁড়ে স্বগতোক্তি করে উঠল দিয়া ।
কুরুশ দিয়ে একটা টেবিলক্লথ বুনছিলেন সুনয়না । মৃদু হেসে বললেন , “ কী হল ? মোবাইল আবার কী দোষ করল ? “
ভুরু কুঁচকে ঠাম্মির দিকে তাকিয়ে দিয়া বলল , “ ফেসবুক , হোয়াটস অ্যাপ জুড়ে শুধু পরকীয়া আর পরকীয়া । আর যেন কোথাও কোন বিষয় নেই । একটা ইস্যু পেলেই হল ! এদের কি কারো কোন কাজ নেই ? “
সুনয়নার মুখের হাসি আরও একটু প্রসারিত হল । বললেন , “ তুই বুঝিস পরকীয়ার    মানে ? “
ঠোঁট বেঁকিয়ে দিয়া বলল , “ না বোঝার কী আছে ? বিবাহিত হয়েও অন্য একটা সম্পর্ক প্যারালালি চালিয়ে যাওয়া … “
“ তা তোর কী মত ? সেটা ভালো না খারাপ ? “ জিগ্যেস করলেন সুনয়না ।
এতক্ষণ উপুড় হয়ে পা নাচাচ্ছিল দিয়া । এবার উঠে বসে বেশ উত্তেজিত গলায় বলে উঠল, “ অবভিয়াসলি খারাপ । একটা সম্পর্কে লয়ালিটি থাকবে না ? বনিবনা না হলে সেপারেট হয়ে যাও । তারপর অন্য সম্পর্কে যেতেই পার । কিন্তু একসঙ্গে গোপনে একাধিক সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়া ! আমি জাস্ট ভাবতে পারি না । “
সুনয়না স্থির চোখে তাকিয়ে ছিলেন দিয়ার দিকে । বললেন , “ জীবনের সব হিসেব অঙ্ক কষে হয় না রে দিদি । দুয়ে দুয়ে সবসময় চার হয় না । “
“ তার মানে তুমিও পরকীয়াকে সাপোর্ট করছ ? আচ্ছা ধর , তুমি জানতে পারলে মা তার কোন অফিস কলিগের সঙ্গে প্রেম করছে , ভালো লাগবে তোমার ? মেনে নেবে তুমি ? রাগ হবে না ? কষ্ট হবে না ? আমি তো তবে কোন সম্পর্কই রাখব না মায়ের সঙ্গে । “
এবার হেসে ফেললেন সুনয়না । বললেন , “ বাপ সোহাগি মেয়ের কথা শোন ! যদি উল্টো টা হয় ? যদি তোর বাবা অমনটা করে ? “
অপ্রতিভ মুখে দিয়া বলে ওঠে , “ ধ্যাত ! বাবা অমন করতেই পারে না । মা ও পারবে না । আমি তো জাস্ট কথার কথা বললাম । তুমি পরকীয়াকে সাপোর্ট করছিলে তাই … “

হাতের বোনাটা একপাশে রেখে বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে সুনয়না বললেন , “ আমি সাপোর্ট করি কি করিনা সে কথা বলিনি । আমি বলছি জীবনটা বড্ড জটিল । চলার পথে  অনেক অনেক বাঁক । কোন বাঁকে কী অপেক্ষা করে আছে কিচ্ছু বলা যায় না । আরও জটিল মানুষের মন । কখনো সে প্রবৃত্তির বশীভূত কখনো সে পরিস্থিতির শিকার । “
তর্কের সুরে দিয়া বলল , “ পরিস্থিতির দোষ দিচ্ছ কেন ঠাম্মি ? পরকীয়া যারা করে তারা প্রবৃত্তির জন্যই করে । “
“ বোধহয় সবসময় তা নয় রে দিদি । একটা ঘটনা বলি তবে । শোনার পরে তুই বিচার করিস । “
গল্পের গন্ধ পেয়ে ঠাম্মির কোল ঘেঁসে এল দিয়া । সুনয়না বলতে শুরু করলেন ।
“ আরতি আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল । আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না ওদের । কিন্তু পড়াশুনা খুব ভালোবাসত মেয়েটা । টিউশুনি করে নিজের পড়ার খরচা চালাত । এভাবেই ভর্তি হয়েছিল কলেজে । স্বপ্ন ছিল টিচার হওয়ার ।
“ কলেজে যাওয়া আসার পথে তাকে দেখে পছন্দ করেছিল এক অভিজাত বাড়ির সুচাকুরে ছেলে ।প্রস্তাব এল আরতির মা , বাবার কাছে । দাবি দাওয়াহীন এমন সুপাত্র পেয়ে তাঁরা তো হাতে চাঁদ পেলেন ।আরতির কথা কেউ শুনতেই চাইল না । শিক্ষিকা হবার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল । বিয়ে হয়ে গেল আরতির ।
“ বিয়ের পরে পরেই বউকে নিয়ে বর চলে গেল ভিন রাজ্যে তার কর্মক্ষেত্রে ।বিরাট কোয়ার্টার । অনেক ঠাকুর চাকর । তেমন কোন কাজই ছিল না আরতির । সে ভেবেছিল সুযোগ মত  বরকে বলে নতুন করে পড়াশুনা শুরু করবে ।
“ কিন্তু তার আগেই প্রকাশ হয়ে পড়ল বরের প্রকৃত স্বরূপ । সে ছিল প্রচণ্ড বদমেজাজি আর সন্দেহপ্রবন । তার ওপর যখন সে ড্রিঙ্ক করত তখন আক্ষরিক অর্থেই অমানুষ হয়ে যেত । কাজের লোকেদের নিয়েও নোংরা সন্দেহ করত আরতিকে । মার খেতে খেতে সারা শরীরে কালশিটে পড়ে গিয়েছিল আরতির ।
“ বাপের বাড়িতে জানিয়ে কোন লাভ হয় নি । তাঁরা বলেছিলেন অ্যাডজাস্ট করে নিতে । আরতি আর পারছিল না ।সহ্যের সব সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছিল যেন । আরতি যখন নিজেকে শেষ করে দেবার কথা ভাবছিল তখনই ঠিকে কাজের মেয়ে একটা চিরকুট এনে দিয়েছিল তার হাতে ।
“ পশ্চিম দিকের বন্ধ জানলাটা খুলে সেদিনই প্রথম চোখাচোখি হয়েছিল তার সঙ্গে । অতলান্ত সেই চোখদুটোতে ছিল সমবেদনা আর নির্ভরতার আশ্বাস ।


“ আরতির বরের সাব অরডিনেট ছেলেটি থাকত আরতিদের উল্টোদিকের ব্যাচেলার’স কোয়ার্টারে । বেশ কিছুদিন পরে আরতি আর সেই ছেলেটা হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যায় । শুনেছি পরে বরের থেকে বিচ্ছেদ নিয়েছিল আরতি । সেই ছেলেটার সঙ্গে বিয়েও হয়েছিল । আর শিক্ষিকা হবার স্বপ্নও সত্যি হয়েছিল আরতির । ওঁদের সম্পর্কটা কোন বাড়ি থেকেই কেউ মেনে নেয় নি । ওরা একলা হয়ে গিয়েছিল । তবে ওরা দুজনে খুব সুখী হয়েছিল । “
নিঝুম হয়ে বসে ছিল দিয়া । সুনয়না বললেন , “ আরতি আর ওই ছেলেটার সম্পর্ককেও  তো পরকীয়াই বলবে লোকে । খারাপও বলবে বেশিরভাগ লোক । আরতি যদি বরের অত্যাচার সহ্য করে থেকে যেত হাসিমুখে তবেই হয়ত সমাজ প্রশংসা করত তার।এবার বল তুই কী বলবি?”
“ আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ওঁদের । “ ধরা ধরা গলায় দিয়া বলল  , “ কতটা ভালোবাসা আর উদারতা থাকলে তখনকার সময়ে এমন একটা কাজ করতে পারেন কেউ ! সামনে পেলে ভদ্রলোককে একবার প্রনাম করতাম । “
হঠাৎ বুক নিঙরে কান্না উঠে এল সুনয়নার । রুদ্ধ গলায় বলে উঠলেন , “ ওই তো দেওয়ালে ঝুলছে মালা পড়ান আমার ভগবানের ফটো । যা , প্রনাম করে আয় দাদুকে । “


শ্রাবণী সোমযশ

#অণুগল্প
বিষয় -অভিশাপ
অনুতাপ" কি গো খোকার ফোন এলো? এত্তোবার বলি তাও যে কেন একটা খবর দেয়না। আমরা কত চিন্তা করি নিজে বাবা হয়েও বুঝলোনা"।  গজগজ করতে করতে সরমা নিজের কাজে লেগে যান।  সপ্তাহ ঘুরে আবার রবিবারের অপেক্ষা। এবার কিন্তু ঠিক সময়েই ফোন বাজে।  এটা  সেটার পর বলেই ফেলেন,  "সপ্তাহে একবার তাও বন্ধ করে দিলি!  নাতিটার গলাটা শুনবো বলে বসে থাকি জানিস তো। কবে বাড়ি আসবি একটু দেখতেও তো সাধ যায়! দুদণ্ড গল্প করতে " এক নিঃশ্বাসে বলে একটু দম নেন। ওপার  থেকে বিরক্তি সীমা ছাড়ায়," কি যে বাজে বকো, ওইতো বস্তাপচা আজগুবি গল্প শোনাবে সানি কে, আর এর বাড়ি ওর বাড়ি ঘুরে ঘুরে সময় নষ্ট। জানো  কত খরচ একবার ইন্ডিয়া যেতে। বাড়ি আয় বাড়ি আয় করে বাজে না বকে টাকা লাগলে বলো কিছু পাঠাচ্ছি।"  মুচড়ে ওঠে বুকটা গাল ভিজে যায়, তাও সামলে নিয়ে বলেন, "খোকা টাকা লাগবেনা আমার কথায় রেগে যাসনা।" উপেন বাবু ফোনটা হাত থেকে নিয়ে রেখে দেন, " খোকা ফোন কেটে দিয়েছে , তোমার কথা ও শুনতে পাবেনা। তিন দিন পরই আবার বেজে ওঠে ফোন, কর্তা গিন্নি কেউই গা করেন না। ফালতু ফোন ধরে আর কি হবে, মনে  মনেই ভাবেন। রোববারে আবার ফোন এলেও আসতে পারে হয়তো। কিন্তু ধরতেই হয়, বড়ো অধৈর্য্য হয়ে বেজেই চলেছে একনাগাড়ে।  এতো খোকার ফোন! " মা" বলেই কান্নায় ভেঙে পরে , "তোমার অভিশাপ লেগেছে মা, আমি তোমায় বাজে বাজে কথা বলেছি তার ফল। সানি  খুব অসুস্থ। কোন বন্ধুর সাথে মজা করে  ড্রাগ নিয়েছে। ছেলেটা হসপিটালে ভর্তি মা। আমরা আর এই পরিবেশে থাকবোনা, সব ঠিক করে ফেলেছি। আমরা দেশে ফিরে যাবো একবারে। তোমার সাথে বাবার সাথে তোমাদের সানি  মানুষের মতো মানুষ হবে।"  ছেলেকে শান্ত করেন সরমা, "ঠিক আছে যা করবি ভেবেচিন্তে করিস ঝোঁকের মাথায় না। আর শোন বাবা, অভিশাপ বলে কিছু হয়না। মা তো শুধু সন্তান কে আশীর্বাদই করে । অভিশাপ একটা সংস্কার মাত্র। খারাপ কর্মের ফল খারাপ হয় আর ভালো কর্মের ভালো। ভগবানের রাজ্যেও এই নিয়ম। এটাও বিজ্ঞান খোকা।"                                      একমাস পর সরমা আর উপেন মাঝে নাতিকে নিয়ে নিজেদের ছোটবেলায় ফিরে যান। ছেলে বৌমাও নিশ্চিন্ত সন্তানের সুরক্ষিত ভবিষ্যতে। খুশির মুহূর্ত চিরস্থায়ী হয় জীবনে।  

দেবাশিস মুখোপাধ্যায়

সোমবারের#অনুগল্প

একা ও একা—

সুর্য ওঠে রোজ একা, ভরপেট খেয়ে পরে থাকা অজগরের মতো দমবন্ধ করা দিনটাকে কাটায় অবহেলায়, অধৈর্যের সাথে, আবার সন্ধ্যার পর একা একাই শুতে যায়। ওর ঘরের দরজার বাইরে, ও জানে, একটা অনেকদিন অব্যবহৃত মরচে ধরা তালা লাগানো আছে। বাইরে যাওয়ার সিঁড়ি সেদিকেই। অন্যদিকে দুখানা জানালা, আরো একটা দরজা সেটা খোলাই থাকে দিবারাত্র। দরজার বাইরে একটা ছোট্ট বারান্দায় ওর সাধের ইজিচেয়ারটা পাতা। দিনের বেলা যায় না। বাইরের দরজা দিনে রাতে দুবার খোলে। চাঁদনী আসে ওর খাবার নিয়ে। সকাল বিকেলের চা সুর্য নিজেই বানিয়ে নেয়। হরেক রকমের বিস্কিট, মুড়ি, চিঁড়ে ওর ঘরের সাথে লাগানো ছোট্ট কিচেনেই থাকে।

সন্ধ্যের পর যখন আলোর রেখা মুছে যায় আকাশ থেকে, একটা দুটো করে তারারা দেখা দেয় আকাশের কালো আঁচলের আড়াল থেকে, তখন বাইরে আসে ও। বড় মগে কফি করে আনে, কালো, চিনি ছাড়া। চোখ থেকে কালো কাঁচের চশমাটা খুলে তারা গোনে, বেড়ায় ছায়াপথ ধরে, উল্কার পিঠে চড়ে কথা বলে আসে কালপুরুষের সাথে। সপ্তর্ষী মণ্ডলের ঋষিদের জানায় সশ্রদ্ধ প্রণাম। ছায়াপথের অপর পারে থাকা মহাকাশে পাঠায় চিঠি, লম্বা লেজওয়ালা কোন ধূমকেতুর সাথে। ফিরে আসতেই হয়, আসার আগে ক্ষয়াটে দুর্বল চাঁদের গায়ে বুলিয়ে আসে স্নেহাস্পর্শ।

যখন সৃষ্ঠির কাজে লিপ্ত থাকে সুর্য। ছোটছোট টানে নানা রঙের কাগজে ফুটে ওঠে মনভরানো ছবি। সাদা পাতায় কলমের দ্রুত দৃপ্ত পদক্ষেপে চোখ মেলে গল্প, উপন্যাস, কবিতারা। আঁধারে, আবডালে থাকা ভালোলাগার ক্ষণ, রাগ অনুরাগের মুহূর্তগুলো খিলখিলিয়ে ওঠে সুর্যর আঙুলের স্পর্শে। তারপর ধূসর কাগজের খামে ঢুকে এগিয়ে যায় অসংখ্য অনুরাগীর মন জয় করার উদ্দেশ্যে। সেই সব রাতে, আলো আঁধারি ঘরে চাঁদনী আসে। এমনিই আসে। ক্ষয়ে ক্ষয়ে চতুর্থীর চাঁদ হয়েও আসে। দূর থেকে মেখে নেয় সুর্যরশ্মি। জ্বলে ওঠে অকাল পূর্ণিমার আলোয়।

ব্যস ওইটুকুই। এর বেশি সুর্যের কাছে যাওয়ার উপায় নেই ওর। এই স্বেচ্ছা নির্বাসনে যখন পা বাড়িয়েছিল সুর্য, তাকে হাত ধরে যে এগিয়ে দিয়েছিল চাঁদনীই। একটা আকাশে সুর্য একাই থাকে, চাঁদনীও। সুখ, সৃষ্ঠি খুঁজতে গিয়ে আজ দুজনেই একা, বন্দী যার যার নির্জন দ্বীপে।


শুভশ্রী সাহা




নির্জনতার কাছে---

বহুদিন পর অনিরুদ্ধ এলো এই জায়গাটায়। সিমলিপালের পাহাড় এখান থেকে কিছুটা দুরেই।  কোর জঙ্গল, ভেতরে পোচার্ডের ভয়ে ওড়িশা গভার্মেন্ট রেস্ট্রিক্টেড করে দিয়েছে জঙ্গলে ঢোকার রাস্তা।   বেশ কিছু প্ল্যান্টেশন এর কাজ চলছে বারিপদায়। অনিরুদ্ধ সেই সব কাজ নিয়েই এসেছে হরিপুরে। এই স্বেচ্ছানির্বাসন এই নির্জনতা অনির একার ই।  মুম্বাই বায়োটেক্সের লোভনীয় চাকরি ছেড়ে সে আজ এখানে। যার জন্যে এসেছিল সেই লহরী আজ আসছে দেখা করতে। অনিরুদ্ধ জীপ থেকে নেমে এক বিশাল পাথরের পৈঠার উপর বসল। তার পায়ের নিচে ছিপছিপে সালান্ডী নদী শাড়ির আচঁলের মত ছড়ানো। সে দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে গেল লহরীর কথা। লহরী বিবাহিত জেনেই জড়িয়ে গেছিল অনি তার সাথে। লহরী পাগলের মত ভালবাসত তাকে। তার বদ্ধ ঘরে একমাত্র অক্সিজেন ছিল অনি। শান্তুনুদা তার মাসতুতো দাদা, লহরী বউদি।  লহরী নি:সন্তান শুধু একটি দিন দাবী করেছিল অনির কাছে সন্তানের জন্যে। পারেনি দিতে, চোরের মত সে এখানে চলে আসে, কেন জানেনা, সেকি তবে কাপুরুষ!!  লহরী তাকে চায় যে ভাবে, সে কেন চাইতে পারেনা লহরীকে এ ভাবে!!!! কিন্তু ভালোবাসে সেও তো ------
আজ ও লহরী হয়ত এই নির্জনে মিলিত হতে চাইবে! কি করবে সে! এই জঙ্গল, নিঝুম প্রান্তরাজি, এই অসীম নির্জনতা ছাড়া সে যে কারুর কাছেই নগ্ন হতে পারেনা ! যদি তার পৌরষত্ব জাগ্রত না হয়! কি বলবে সে লহরীকে! তার থেকে ও ফিরে যাক বরাবরের মত আশা নিয়েই নতুন করে, আর নির্জনতাকে নিয়ে থাক অনিরুদ্ধ , তার মত--- জিপে ফিরে গেল সে এবারও--( 

ঋষেণ ভট্টাচার্য্য


রুমাল



সন্ধ্যে পৌনে সাতটায় বুকে ব্যাথা নিয়ে নার্সিং হোমে ভর্তি হয়ে সাতাশি বছরের অমিতাভ বাবু যখন রাত বারোটা নাগাদ মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়লেন, তখনো তাঁর হাতের মুঠিতে শক্ত করে ধরা হলদে হয়ে আসা আকাশী রঙের সিল্কের রুমাল।

রুমালের এক কোণে লেখা 'এ'।

দু'টো কেমো নিয়ে মাথায় চুল উঠে যাওয়ার পর অমিতাভ বাবু প্রতিদিন যত্ন করে রুমালটা বেঁধে দিতেন অণিমাদেবীর মাথায়।
পয়ঁত্রিশ বছর আগে চতুর্থ কেমোটার পর, অমিতাভ বাবুকে ছেড়ে চলে গেলেন অণিমাদেবী আর সেদিন থেকে অমিতাভ বাবুর সর্বক্ষণের সঙ্গী এই রুমালটা।

ডেডবডি বের করে, কেবিন নাম্বার ট্যু হান্ড্রেড ফোরের বেডটা ক্লিন করে, ওয়ার্ড বয় একটা হলদেটে নোংরা রুমাল ছুঁড়ে ফেলে দিলো ওয়েস্ট বিনে।

পঞ্চাশ বছর আগে এক ঝকঝকে সকালে গ্যাংটকে চাম্বালামার দোকানের সামনে ঝুলন্ত একটা হাল্কা আকাশী রঙের রুমাল দেখে এক তরুণী তার সঙ্গীকে হাত ধরে টেনেছিলেন।
কাল ভোরবেলা সুইপার এলে, ওয়েস্ট বিনে পড়ে থাকা হলদে রুমালটা চলে যাবে গারবেজ ভ্যাটে।


জয়তী রায়

রুমাল
______
     তৃণা নাক কুঁচকে রইল। মলয়ের পকেটে টাকা, রুমাল আর এক বিশেষ গন্ধ। গত তিনদিন ধরে একই গন্ধ। আবার শুঁকল রুমাল। কোনো ভুল নেই।
    আজ পুরোনো বন্ধুদের গেট টুগেদার। এক এক বাড়িতে ঘুরে ফিরে হয়। এবার তৃণা মলয়ের বাড়ি। শনিবারের রাত। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে উন্মাদনা। হঠাৎ নীলা এগিয়ে আসে। পুরোনো বান্ধবী। পরম মমতায় তৃণার কাঁধে হাত রেখে বলে__কি গো। এত ব্যস্ত কেন আজকাল? বরের দিকে চোখ রেখ।
     তৃণা একদম চমকে উঠল! মানে? কিছু কি চলছে তবে? রুমালে কিসের গন্ধ? কার শরীরের নিষিদ্ধ গন্ধ?
   তৃণা অপেক্ষা করতে লাগল । পার্টি শেষ হতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল রাগী বিড়ালের মত
   বলতেই হবে। কিসের গন্ধ? রুমালে?
 ভালো করে চোখ খুলতে পারছে না। টলছে মলয়। অবোধের মত চাউনি__কিসের রুমাল? কিসের গন্ধ? কাল সকালে...।
__না। এখনি।এখুনি।
 মলয় ঝাঁকুনি দিয়ে সিধে দাঁড়াল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল
   আমার মায়ের। যে মাকে বিয়ের পর নানারকম অত্যাচার করে বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে বাধ্য করেছ? সে ই মায়ের। হ্যাঁ । এখন আমি রোজ যাই। রোজ। রুমালের গন্ধ মায়ের শরীরের পান দক্তার গন্ধ।

অমিতাভ দাস

রুমাল ।।


...
 চোখ ভিজে যাচ্ছে বারবার । বুকের ভিতর এতটা শোক তবে ছিল ! শোক নাকি আবেগ বুঝতে পারছেন না অপার্থিববাবু । এতকাল সেভাবে মনে পড়েনি তেমন । একাকী ব্যস্ত লেখক জীবনে কই , বকুলের কথা মনেই পড়েনি তাঁর ।

আজকেও হোম থিয়েটারে মৃদু শব্দে সেতার বাজছে । টেবিলে ফুলদানে রজনীগন্ধা । পাশেই কাচের গ্লাসে দামী হুইস্কি । ছাইদানে আধপোড়া ফিল্টার ...
ফোনটা করেছিল বকুলের বান্ধবী অন্তরা । সে অপার্থিববাবুরও বান্ধবী ।যোগাযোগ এত বছরেও ম্লান হয়নি ।

এত রাতে ফোন মূলত আসেনা । তাছাড়া অপার্থিববাবু রাতের এই নিজস্ব সময়ে কারো ফোন রিসিভ করেন না । অন্তরা নামটা দেখেই রিসিভ করেছিলেন । শুনলেন চরম দুঃবাদটা যে , বকুল আর নেই । সন্ধ্যায় চলে গেল । ওর ডাক্তার বর অনেক চেষ্টা করেছিল । তবু শেষ রক্ষা হল না ।

খবরটা শোনার পর থেকেই কেমন যেন লাগতে শুরু করল অপার্থিব মুখার্জির । প্রায় পঁচিশ বছর আগেই সেই চঞ্চল মেয়েটা । কবিতা পাগল । আবৃত্তিকার বকুল ভেসে উঠল । সেই মেয়েটার প্রেমে পাগল হলেন বয়সে অপেক্ষাকৃত বড় আবৃত্তির বিচারক তরুণ লেখক অপার্থিব ।তারপর নন্দন - ভিক্টোরিয়া - রবীন্দ্রসদন । নাটক- সিনেমা । পায়ে পায়ে কলকাতার ধুলো ।চার বছর প্রেম ।

অপার্থিববাবু উঠে গেলেন । আলমারিটা খুললেন । ভেতরের চোরাকুঠুরী থেকে রের করে আনলেন একটা সাদা রুমাল । পঁচিশ বছর আগের । রুমালে ছোপ ছোপ দাগ । হাতে নিয়ে গন্ধ শুকলেন । কই , সেই গন্ধটা তো নেই -- ন্যাপথালিনের গন্ধ । কিন্তু তাঁর নাকে লেগে আছে আজো প্রথম দিনের সেই মিষ্টি গন্ধটা । সেই গন্ধটাই তিনি খুঁজছেন অথচ আজ কেন পাচ্ছেন না ?

মনে পড়ে গেল প্রথম বার পার্কে দেখা করার দিনটি । দুপুর গড়িয়ে বিকেল , বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা-- এবার তো উঠতে হবে , বলে উঠে দাঁড়াল বকুল । হাত টেনে ধরলে অপার্থিব । তোমাকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না । একটু এগিয়ে নিজের হাতের সুগন্ধী রুমালটা ছুঁড়ে দিয়েছিল অপার্থিব- এর হাতে । বলেছিল , আমার পরিবর্তে এইটা দেখবে । গন্ধ নেবে । আমাকেই পাবে । সেই থেকে বড় যত্নে রেখেছে সে এই রুমালটিকে ।

আজ এত দিন পর সব স্মৃতিগুলিই জীবন্ত হয়ে উঠৈছে চোখের সামনে । নিজের অজান্তেই ভেজা চোখ মুছলেন রুমালটা দিয়ে অপার্থিববাবু । মনে হল বকুল-ই যেন মুছিয়ে দিচ্ছে তাঁর চোখের জল । জীবন - যন্ত্রনার দাহ ।


মেঘশ্রী ব্যানার্জী



#বড়গল্প
#বোধন


(১)
- 'সুপ্রিয়াদি তোমার মোবাইলটা কখন থেকে কেঁপে যাচ্ছে। ধরে নাও।'
- 'তুই লেখ ঠিক করে যা বলছি। ফোন বাজুক। গতকালের ভুল রিপিট না হয়।'
প্যাথোলজি সেন্টারের টেকনিশিয়ান সুপ্রিয়া নিজের কাজে খুব সিরিয়াস। তার উপর রিডিং গুলো লিখছে যে মেয়েটি সে নতুন আর তার বয়সটাও কম। কালই একটা ভুল করে ফেলেছিল। অবশ্য সুপ্রিয়া শুধরে দিয়েছে। তাই কোনভাবেই অন্যমনস্কতাকে প্রশ্রয় দেয়না সে। 
- 'বেডের ওপাশে টিস্যু আছে। আপনি ওখানে নেমে জেলটা মুছে নিন।'
এই মেয়েটি প্রথমবার ইউ.এস.জি করাচ্ছে। নরম করে ইন্সট্রাকশন দেয় সুপ্রিয়া। মোবাইলটা আবার কেঁপে ওঠে। চেনা কোন নাম নয়। টেবিলে ওটাকে নামিয়ে রেখে অপেক্ষারত পরের জনকে ডেকে নেয়। এক মাঝবয়সী দেহাতি লোক। প্রেসক্রিপশন আগেই নেওয়া ছিল। তাকে হিন্দীতে বোঝাতে শুরু করতে না করতেই হুড়মুড়িয়ে ঢুকল রিসেপশনিস্ট সুমনা।
-'সুপ্রিয়াদি সেই অ্যাডভোকেট বারবার ফোন করছেন গো! তোমাকে ফোনে পাননি। এক্ষুনি কথা বলবেন বলছেন!'
-'আমার সেল নাম্বার উনি পান কি করে? আমি এই তো ঘন্টা খানেক আগে কথা বলে এলাম ফেস টু ফেস! আবার কি চাই? আচ্ছা সমস্যা তো!' এবার মেজাজ হারায় সুপ্রিয়া।
-'আরে আমাকেই তো জিজ্ঞেস করতে লেগেছেন বারবার- রিপোর্টে কি আছে - এক্স না ওয়াই? আমি জানিনা বলাতে তোমাকে ফোন করেছেন বোধহয়। তুমি ওঠাওনি তাই আবার রিসেপশনে ফোন করেছেন! আমি কি করি বলোতো!' কাঁদো কাঁদো হয় সুমনা।
-'আরে ঘাবড়াবার কি আছে? বলো এটা আইনত অপরাধ!' কথায় কথায় ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ একদম ভালো লাগে না সুপ্রিয়ার।
-'দিদি বাসু স্যর নাকি ওনাকে কল করে জেনে নিতে বলেছেন। উনি হুমকি দিচ্ছেন না বললে মি: বাসুকে জানিয়ে দেবেন!' গলা নামিয়ে বলে সুমনা।
এবার বিরক্তিতে মুখটা কুঁচকে যায় সুপ্রিয়ার। মি: বাসু এই সংস্থার গভর্নিং বডির একজন। লোকটার কিছু পলিটিক্যাল হোল্ডও আছে। ঠিক সৎ বলা যায়না। 
-'আচ্ছা তুমি যাও আমি দেখছি। 
আরে!! আপ অভিতক খাড়ে কিঁউ হ্যায়? লেটিয়ে উধার...' 
কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সুপ্রিয়া। কিন্তু মনে মনে প্রস্তুতি চলতে থাকে আরেক লড়াইয়ের। ভালোই জানে সুপ্রিয়া এবার মি: বাসুর কেবিনে তার ডাক পড়তে চলেছে।
যা ভেবেছিল ঠিক তাই! সুমনা বলে যাবার পরও যখন সুপ্রিয়া ব্যাপারটা পাত্তা দিল না মি: বাসু তাকে ডেকে পাঠালেন সেদিনই বিকেলে। আজ সারাদিন প্রচুর পেশেন্ট ছিল। ক্লান্ত শরীর আর অবসন্ন মনটাকে টেনে নিয়ে গেল সুপ্রিয়া একটা অনিবার্য পরিণতির দিকে। ঘরে ঢুকতেই ভনিতা না করে মি: বাসু সরাসরি আক্রমণে এলেন 
-'আমার ক্লিয়ার ইনস্ট্রাকশন থাকা সত্ত্বেও আপনি টেস্ট রেজাল্ট কেন জানাচ্ছেন না মি: চ্যাটার্জীকে?'
-'নিশ্চয় জানাবো। আপনার অফসিয়াল প্যাডে লিখিত ইনস্ট্রাকশন দিন তারপর। আসি তাহলে?' 
নমস্কার ঠুকে বেরিয়ে পড়ে সুপ্রিয়া - পিছনের দুজোড়া শিকার ফসকে যাওয়া আশাহত বাজের কুটিল দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। খুব ভালো করেই জানে সুপ্রিয়া আজ না হোক কাল নয়তো পরশু তাকে কোন অযুহাত দেখিয়ে কাজ থেকে বের করে দেওয়া হবে বা এর চেয়েও খারাপ কিছু। সে একা মানুষ। তার অভিজ্ঞতা আর কর্মদক্ষতা কোথাও না কোথাও চাকরি ঠিক পাইয়ে দেবে। তবু এই অন্যায়ের কাছে মাথা নোয়াবে না সুপ্রিয়া - যেমন মাথা নোয়াননি তার মা। মা শ্বশুরবাড়ি থেকে প্রতিবাদের আগুন জ্বেলে বেরিয়ে না এলে কবেই প্লাস্টিক বন্দী এক রক্তাক্ত ফিটাস হয়ে কুকুরের খিদে মেটাতো সুপ্রিয়া ! 

(২)
বলাকা গলি থেকে শেষ পথটুকু প্রায় উড়ে এলো অটো স্ট্যান্ডে। এসময়ে বড্ড লাইন পড়ে। আজ এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। যদিও পুজোর ছুটি পড়ার দিন তেমন ক্লাস হবে না তবু দেরি হলে অ্যাটেন্ডেন্স নিয়ে সমস্যা করেন ব্যানার্জী ম্যাম। অটো স্ট্যান্ডে এসে সামান্য চমকায়! উৎসবের পরিবেশ পুরো। ড্রাইভাররা সবাই হাসছে আর একটা ছেলে যার অটোতেই বেশিরভাগ সময় যায় বলাকা সে সবাইকে একটা প্যাকেট থেকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। এদিকে লাইন লম্বা হচ্ছে ! অনেকে বিরক্তও বেশ। একজন একজন করে অটো স্টার্ট দিতে শুরু করল। প্রথম চারটে বেরিয়ে যাবার পর পাঁচ নম্বরে জায়গা হল বলাকার। ভাগ্যক্রমে সেই ছেলেটিরই অটো! কৌতূহলী হয় বলাকা
-'তোমরা কি এবার পুজো করছ নাকি? এত খুশি সব?'
-'না দিদি! আমার ঘরে মা দুগ্গা এয়েচেন! বউ এক ফুটফুটে মেয়ে নিয়ে ঘরে এলো কাল। দেবিপক্ষে এমন আশীব্বাদ পেলাম তাই আরকি একটু খাওয়া দাওয়া!! মিষ্টি নিন না সবাই!' একগাল হেসে সে চারজন যাত্রীকে লাড্ডু ধরিয়ে দিল একেকটা - যেন মা দুর্গার আগমনে দক্ষরাজ প্রজাদের রত্ন বিলোচ্ছেন!
দশ মিনিট অটোয় গিয়ে এম.জি. থেকে মেট্রো ধরে কলকাতা ময়দান, সেখান থেকে দশ পনেরো মিনিট হেঁটে তবে স্কুলে পৌঁছবে বলাকা। আজ আর পা চলছে না। মেট্রো থেকে নেমে স্টেশনেই বসে রইল অনেকক্ষণ। হাতে সেই লাড্ডুটা ধরাই আছে! বলাকা স্মৃতিযানে চড়ে কয়েক মাস আগে ফিরে গেছে।
প্রথমবার মা হওয়াটা আলাদাই একটা অনুভূতি! সমীরণ আর তার ছোট্ট বেবিটাকে নিয়ে কত্ত জল্পনা কল্পনা! প্রথম ইউ.এস.জি. রিপোর্টটা কত রাত যে বালিশের পাশে নিয়ে শুয়েছে। ছবি দেখে কিছুই বুঝত না, তবু দেখে দেখে আশ মিটত না । তার ছেলেমানুষিতে খুব হাসত সমীরণ। তাদের ভালোবেসে বিয়ে। বন্ধন আরও মজবুত হতে চলেছে। তুরীয় আনন্দে দিন কাটছে বলাকার!
পরের ইউ.এস.জি. হবার পর থেকেই পাল্টে গেল সব। শ্বশুর শাশুড়ি যারা কিনা এত আনন্দে ছিলেন এত যত্ন করছিলেন - সবাই গম্ভীর হয়ে গেলেন। সমীরণও একটা চাপা টেনশনে। কাকে যেন বারবার ফোন করছে! বলাকার সাথে ভালো করে কথাই বলছে না!  বলাকা বুঝতে পারছে সাংঘাতিক একটা সমস্যা আছে তার রিপোর্টে - তবে কি বাচ্চাটা আর নেই? নাকি কোন অ্যাবনর্মালিটি নিয়ে জন্মাতে চলেছে সে? সমীরণ সেজন্যই হয়তো ফেস করতে চাইছে না বলাকাকে - জানেই তো কত আশায় ভালোবাসায় জড়িয়ে আছে বলাকা তার বেবিকে!
কদিন পরে সমীরণ বলাকাকে নিয়ে যেতে চাইল অন্য কোন এক নামকরা ডাক্তারের কাছে। ঠিকই ভেবেছে বলাকা নিশ্চয় তার কম্প্লিকেটেড প্রেগনেন্সি! বাড়ির গাড়িতেই বেরোল তারা। অজানা আশঙ্কায় কেঁদেই চলেছে বলাকা! কি জানি নতুন ডাক্তার কি বলবে!
যেমনটা ভেবেছিল বড় কোন ডাক্তারের চেম্বার হবে তেমনটা নয়তো! ওরা বসতেই একটা ফর্ম দিয়ে গেল নার্স। পড়ে দেখার মত শক্তি নেই আর বলাকার। সমীরণ তো আছে পাশে - ও বুঝে নিক সব। সই করে ছেড়ে দিল শুধু। কেবিনে ঢোকার ঠিক আগের মুহূর্তে সমীরণের উষ্ণ হাত বলাকার তিরতির করে কাঁপতে থাকা হাতটা ধরে ঠান্ডা গলায় বলল
-'বলাকা আমরা এই বেবিকে না রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তোমাকে আগে বললে তুমি মানতে না। দাদার আগেই দুটো মেয়ে আছে। আমার বাবা মা চাননা আমাদেরও মেয়ে হোক। বংশ রক্ষার তাগিদেই শুধু এই সিদ্ধান্ত! তুমি দয়া করে আমাকে ভুল বুঝো না! আমি বলতেই পারতাম বেবি অ্যাবনর্মাল! কিন্তু তোমাকে অন্ধকারে রাখতে চাইনা।'
কোন কোন ঘটনার অভিঘাত এতই নি:শব্দ-প্রবল হয় যে কিছুক্ষণের জন্য মানুষের বোঝার বলার চলার শক্তিকে সহজেই হরণ করে নিতে পারে। অভিশপ্ত অহল্যার মতই পাথর হয়ে গেল বলাকা। মস্তিস্কের কয়েকটা কোষ ওকে প্রতিবাদ করার বারুদ জুগিয়ে যাবার চেষ্টা করে চলেছে - অনুরণিত হচ্ছে মাথায় "এর চেয়ে বেশি অন্ধকারে আর কিইবা রাখতে পারত সমীরণ তোকে"! কিন্তু মন আর শরীর যন্ত্রবৎ আচরণ করছে - রিমোট সমীরণ আর নতুন ডাক্তারের হাতে।
অবসন্ন চিন্তার জাল ছিন্ন করে মেট্রো স্টেশনে স্বল্প সিগন্যালেও ফোনটা বেজে উঠল। রুনা - বলাকার কলিগ।
-'কি রে কোথায় তুই? তোর ক্লাসের বাচ্চাগুলোকে আর চুপ রাখা যাচ্ছেনা তো! নিজের ক্লাস ছেড়ে বারবার আসা যায় এভাবে? মেট্রোয় প্রবলেম নাকি?' কোন দূর থেকে যেন ভেসে আসে কথাগুলো।
-'আমি আজ আসছি নারে। শরীরটা বড্ড খারাপ! স্যরি আগেই ফোন করা উচিৎ ছিল। স্-স্যরি!' বলেই কেটে দিল বলাকা। আজকের দিনটা সে শুধুই নিজের সাথে কাটাবে। যে কষ্টটাকে গত আড়াই মাস ধরে রোজ বুকের মাটির ভিতর একটু একটু করে ঠেলে ঢুকিয়ে দিত আজ তাকে খুঁড়ে বার করবে। সেই কষ্টটা আজ অনেকদিন পরে দুটো কচি হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরবে - বন্ধনটা একটু একটু করে দৃঢ় হবে - আরও আরও চাপ দেবে তার কন্ঠনালীতে - রুদ্ধ করে দেবে তার শ্বাস - নিজের সাথে টেনে নিয়ে যাবে তার না দেখতে পাওয়া ছোট্ট দুনিয়ায় যেখানে বলাকা ছোট্ট দলা পাকানো কষ্টটাকে পরম মমতায় রক্ষা করবে সমস্ত বিপদ থেকে! 
একপা একপা করে এগোয় বলাকা! হাতে লাড্ডুটা ধরা। পরের মেট্রোটা তীব্র আলো আর বেগ নিয়ে ছুটে আসছে তারই দিকে! 

(৩)
ক্লাস শেষ হতে না হতেই ফোন বাজতে থাকে
-'কি রে কত দেরি? অনেক রাত হয়ে গেল তো!'
-'হয়ে গেছে মা! সবে রাত আটটা বাজে! এত চিন্তা করার কোন কারণ নেই মা! রাখছি।' এবার মা টেনশন আর রাগের মিশেলে একগাদা ইমোশনাল কথা বলবে। তাড়াতাড়ি ফোন কেটে পা চালায় বলাকা। স্কুলের চাকরির পর একটি এন.জি.ও তেও পড়াবার ভার নিয়েছে বলাকা। নিজের জীবনটাকে আস্তে আস্তে আবার সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। মায়ের চিন্তার কারণও বলাকা নিজেই মাকে দিয়েছে। সেদিন মেট্রো স্টেশনের ওই অবসাদী সিদ্ধান্ত তার জীবনটাকে শেষ করে দিতে পারত -- কিন্তু সব ওলোটপালট করে দিল একজনের উপস্থিতি।
একপা একপা করে সে যখন কি এক অমোঘ টানে এগিয়ে চলেছে ছুটন্ত আলোর দিকে পিছন থেকে তার হাতটা শক্ত করে টেনে ধরলেন এক ফরিস্তা! ঘোর লাগা চোখে তাকে চেনা চেনা ঠেকলেও চিনে ওঠার আগেই বলাকা এলিয়ে পড়ে তার বুকে। জ্ঞান হতে দেখে তাকে ঘিরে একটা ছোট ভিড় জমেছে। পাশে বসে মানুষটি তার চোখেমুখে জল ছিটোচ্ছেন , গাল ধরে নাড়া দিচ্ছেন। জ্ঞান ফিরতেই একটা স্বস্তির বাতাবরণ চারিদিকে। ভিড় পাতলা হতে থাকল। মানুষটি সকলকে ধন্যবাদান্তে জানাচ্ছেন উনি মেয়েটিকে চেনেন - আর কোন সমস্যা নেই! অপলকে তাকিয়ে থাকে বলাকা ওই শান্ত কঠিন মুখটার দিকে।
-'এখান থেকে বেরিয়ে কথা বলি?' অনুমতির অপেক্ষা না করেই অতি যত্নে বলাকাকে মেট্রো স্টেশনের বাইরে আনেন উনি। কাছেই একটা স্ন্যাকস অ্যান্ড ফ্রুট জুসের দোকানে বসে ওরা। টুকটাক অর্ডার দিয়ে উনি আবার কথা শুরু করেন 
-'তোমার মেয়েকে আমি বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলাম। আজকে বুঝতে পারছি তুমি পারোনি। তাবলে নিজেকে শেষ করে দিতে হবে?' বলাকার মাথায় হাত রাখলেন সুপ্রিয়া।
বলাকা প্রথমটা চমকে ওঠে। তারপর আস্তে আস্তে মনে পড়ে প্যাথোলজি ল্যাবের ম্যাডামকে। কান্নায় ভেঙে পড়ে সে। সেদিন সুপ্রিয়া মি: বাসু আর অ্যাডভোকেট চ্যাটার্জীর কথা সবটা জানাল বলাকাকে । দুজনে আরও কত কথা হল - কত শোকের আদান প্রদান - যেন জন্ম-জন্মান্তর ধরে তারা বিনি সুতোর মালায় গাঁথা! সুপ্রিয়ার ওই চাকরিটা গেছে।প্রেটোরিয়া স্ট্রীটের একটি নামী হসপিটালের সাথে এখন তিনি যুক্ত। সাথে সাথে বল্লরী নামের এক এন.জি.ও এর সাথে উনি বিশেষভাবে জড়িত। সুপ্রিয়াদিই তাকে বল্লরীতে পড়ানোর কথা ভেবে দেখতে বলেন।
সেদিনটা বলাকা তার শ্বশুরবাড়িতে ফিরেছিল। একদম স্বাভাবিক আচরণে রাতটা কাটায় আর নিজের সমস্ত ডিগ্রি সার্টিফিকেট, মেডিকেল রিপোর্ট আর টুকিটাকি গয়না ব্যাগে গুছিয়ে নেয়। পরের দিনই অ্যাডভোকেট সমীরণ চ্যাটার্জীর বাড়ি ছেড়ে মায়ের কাছে চলে আসে। মা, সুপ্রিয়াদি আর বল্লরীর এক উকিল বন্ধুর সহায়তায় ডিভোর্স কেসও ফাইল করে সমীরণের বিরুদ্ধে। হতচকিত সমীরণ আর তার বাবা-মা-দাদা প্রথমটা চোখ রাঙালেও সমাজে বদনামের ভয়ে পিছিয়ে আসে। শুধু একটাই আফসোস বলাকার এই রুখে দাঁড়ানোর শক্তি যদি সে কমাস আগে পেত!
-'অনেক রাত হল! আপনাকে এগিয়ে দেব একটু?' বর্তমানে ফেরে বলাকা। মায়ের চিন্তা যেন সাগ্নিকের মনে সঞ্চারিত হয়েছে। সাগ্নিকও পেশায় শিক্ষক। স্কুলের পর বল্লরীর একনিষ্ঠ কর্মীও। মানা করেনা বলাকা। রাতের অন্ধকার তার গালের কিঞ্চিৎ রক্তরাগের আনাগোনা লুকিয়ে ফেলে। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সাগ্নিকের বিবাহ প্রস্তাবকে সম্মান জানাবে - তবে সাগ্নিককে এখনো জানায়নি কিছু। মৃদু স্বরে গল্প করতে করতে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে ভবিষ্যতের এক সুন্দর স্বপ্ন।

মৃত্তিকা মুখার্জী চট্টোপাধ্যায়

ব্যর্থ জ্যোৎস্নায়


যখন তুমি বৃষ্টিভেজায় ব্যস্ত দারুণ
আমার ছাদেও চাঁদ নেমেছে, সজল করুণ।
দু'হাত পেতে যেই দাঁড়ালো সামনে আমার,
ভাবছি তখন,উপায় তো নেই এড়িয়ে যাবার।
সেদিন থেকেই জোয়ার আমার জ্যোৎস্নামাখা,
মরবো বলেই একটু একটু বাঁচিয়ে রাখা-
শিরীষ শাখায় আজকে আবার চাঁদ উঠেছে,
মরা আগুন দ্বিগুণ হয়ে রাত ছুটেছে।
এখনও কি ভেজো,তেমন পাগলপারা?
আমার ছাদেও চাঁদ নেমেছে ছন্নছাড়া।
এখন আমি জ্যোৎস্নাকে নয়,সূর্য ভীষণ ভালোবাসি,
চাঁদ নামে তাও নিয়মিত, হাহাকারের হাপিত্যেশি।।

সৌমনা দাশগুপ্ত




রোদের মুখোশ
খুলে নেমে যাই
সিঁড়ি ছিল 
মিছিমিছি 
হাওয়া দিল
জোনাকি উড়িয়ে
খুব হাওয়া ছিল
তাপের ভেতর 
পারদের স্বর
ছলনায় লেখা
কত অক্ষর 
মিছিমিছি
শব্দের লোফালুফি 
হাওয়া এল
তুমিও উড়েছ
খুব সাবধানে 
বাতাসে চুবিয়ে
দিলে এই হাত
স্বরধ্বনি 
সপাটে এড়ালে
চোরচোর খেলা
মাটি আছে ছিল
কিছু এখনও
রয়ে গেছে তার
স্বাদ এই জলে
ফসিলের ভাঁজে




তুষ্টি ভট্টাচার্য

অ্যালবাম /

অ্যালবামের পাতা উল্টে
ট্রেস পেপারের গায়ে আটকে থাকা ছবি
ঝরে পড়ে আচম্বিতে।
কেউ কেউ, এখনও দেখে স্মৃতি খুলে
কিছু বলছে কি কেউ?
কালের কথা সেই একঘেয়ে সুরে
ভুলের গহ্বরে মুখ বুজে পড়েছিল যারা
তাদের মুখ, চোখ থেকে সত্যি ঠিকরে পড়ছে যেন আজ
 
যৌবন পার করে চোখ যায় কিশোর বেলার দিকে
সেই অমলিন, পবিত্র রূপ যাকে ছবির ভেতরেই রেখে আসা চলে
সেই ভুবন ভোলানো বৃদ্ধের হাসি মুখ-
কোলে তুলেছিল পরম মমতায় তার আদরের শিশুটিকে
যে শিশু শিশ্নের ভারে ন্যুব্জ আজ
স্তনের নতমুখ আজ ফের অঙ্কুরোদগম দেখেছে
মাঝখানে কত গুলো দিন, রাত কেটেছে, হিসেব আছে?
কতখানি বোঝা ঝেড়ে ফেলা গেছে, জান?

লুকনো প্রেমিকের ছবিটি, ছিঁড়ে ফেলা প্রেমিকা-ছবির একফালি মুখ
এখনও রয়েছে! মনে ছিল ওরা? এখন কোথায় আছে কে জানে!
হয়ত লুকিয়ে রয়েছে কোনখানে-
প্রথম প্রেমের ছবি নেই, সে ছিল একান্ত গোপনীয়
দ্বিতীয় বা তৃতীয় চিহ্ন রেখেছে।
চিহ্ন রাখে কোন ছবি? এই অ্যালবামে মন রাখা আছে।

ওই সেই ভাড়া ঘর, পুরনো দেওয়ালের দাগ
শিশুটির রেলিং ঘেরা খাটে শুয়ে নিরাপত্তা
কতটা নিরাপদে সে আজ আছে
দাগ হীন নতুন বাড়িতে?
বাড়-বৃদ্ধি ও ভরসা তেমনই আছে?
লাল ট্রাইসাইকেলের ভাঙা চাকা সাক্ষী
সাক্ষী রয়েছে অ্যান্টেনার কাক আর
টবের সেই গাছটি, যাদের ছেড়ে তুমি
কিছুতেই এসে পড়তে পারনি এই বাড়িতে-
অ্যালবামে ছবি আভাষ দিয়েছে আজ এই সব-
স্মৃতিকে ছেড়ে এসেছে ভেবে মায়ের কোল
আজও দুলে ওঠে, দুলে ওঠে অ্যালবামও।

স্মৃতি উস্কে দিতে তাকে ডেকেছ
উদ্বেল হয়ে ভাবছ এখন-
কোথায় লুকিয়ে ফেলি এই ভার
পাহাড়ের মত চেপে বসেছে কেন এতদিন বাদে-
ভেবেছ? ভেবেছিলে এ নিছকই ক্ষণিকের ছবি
সময় পেয়েছ বলে পাতা উল্টে যাবে-
চলে গেছ ভেবেছিলে!
প্রিয় বন্ধুর পাশে ওই যে তুমি গায়ে গায়ে লেগে,
হাসছ- বন্ধু ছেড়ে গেছে অকালে এ পৃথিবী
তুমি রয়ে গেছ, ভুলেও ছিলে তাকে।
তবে এই ছবি কেন বন্ধুর স্বরে কথা বলে আজও?
মৃতরা বেঁচে উঠেছে আজ একে একে
জীবিত হয়ে এসেছে তোমার কাছে, ওরা পাঁচজন
স্বীকার কর অন্তত ওদের কাছে-
মৃত্যু মানে সমাপ্তি নয়!
বয়সের ভারও মুছে দেয়নি ওই অ্যালবাম। 

জয়িতা ভট্টাচার্য



অমরত্ব
কোনো অলৌকিক সারল্যের ভিড়ে
চারাগাছে দিয়ে মাটি আর জল।
চলে গেছি আশ্চর্যের আশায় আশায়।
তারপর গেছে দিন আর রাত।
ভালোবাসার হাত ধরে দূরে সরে 
যাই দূর রাতের আলোতে 
অলৌকিক সেই স্পর্শে আমি জাগি।
পাখিরা ঠোঁটে নিয়ে উড়ে,উড়ে যায়
আর খুঁটে খায় শব্দের দানাপাণি।
ভালোবাসা হাত ছেড়ে গেলে একা 
আমি বসে বসে দেখি সরোবরে 
মহীরুহ ছায়া ফেলে সে পরিসরে।
কথারা শুধু কথা হয়ে থেকে যায়
অন্ধকারে শেকড় গভীরে আরো 
অনন্ত সুরঙ্গপথে যাত্রা করে 
এখন গাছের মতো বাঁচি আর
মরে যাই ফের স্বখাত সলিলে।

মানসী গাঙ্গুলী



 সূর্যপ্রণাম

      রোজ বিকেলে গঙ্গার ধারে পার্কে এসে আরতিদেবী আগেই গঙ্গার দিকে ফিরে দুই হাত জোড় করে প্রণাম করেন,তারপর ঘড়িধরে আধঘন্টা হাঁটেন আর তারপর বেঞ্চে বসেন, যতক্ষণ না সূর্য অস্ত যায় উনি বসে থাকেন, এটা তাঁর নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার।হাঁটার সময় উনি কোনোদিকে তাকান না,কারো সাথে কথা বলেন না,সেটা ওখানে যাঁরা আসেন সবাই জানেন তাই কেউ ওনাকে বিরক্ত করেন না।না,তাই বলে উনি অসামাজিক নন,বেঞ্চে বসে উনি গল্প করেন যিনি বা যাঁরা পাশে বসে থাকেন তাঁদের সঙ্গে।তেমনি সূর্যাস্তের সময় অস্তগামী সূর্যকে প্রণাম করে বাড়ি ফেরেন।এমনই চলছিল গত চার পাঁচ বছর।
       এরপর অমিতবাবু পার্কে আসা শুরু করলেন। দীর্ঘকাল প্রবাসে বাস করে ফিরে এসেছেন ঘরে,ছেলে বউয়ের সংসারে।বাড়ি যদিও ওনারই,স্হায়ীভাবে বসবাস করেননি কখনও বাড়িতে। চাকরির সুবাদে বাইরেই কাটাতে হয়েছে ওনাকে চিরকাল,এমনকি রিটায়ারমেন্টের পরেও চাকুরী থেকে অব্যাহতি পাননি তাঁর কর্মদক্ষতা ও সুনামের জন্য।তবে গত চারমাস আগে স্ত্রীর মৃত্যুতে একা হয়ে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ায় তাঁর ছুটি মেলে।কিন্তু বাড়ি ফিরেও তিনি শান্তি পান না একে তো জীবনসঙ্গিনীকে এইবয়সে হারিয়েছেন, তারপর এতদিন কর্মব্যস্ত ছিলেন,তাই অলস জীবন যেন তাঁর কাটতেই চায় না।ছেলে বউএর সাথে থাকাও অভ্যাস নেই,তারাও সারাক্ষণ নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত,তাই সব সময় নিজেকে অবাঞ্ছিত,অবহেলিত মনে হতে থাকে তাঁর।
        গত সাত-আটদিন থেকে তিনি আসছেন গঙ্গাধারের এই পার্কে আর প্রথমদিন থেকেই চোখে পড়ছে তাঁর আরতিদেবীকে।দেখেই যেন মনে হয় শান্তির প্রতিমূর্তি। তাঁর ভক্তিভরে গঙ্গাপ্রণাম দেখে অমিতবাবুর মনে হয় কত শান্তি ওনার জীবনে,তাই এত ভক্তি আসে ওনার প্রাণে। আস্তে আস্তে কয়েকজনের সাথে আলাপ হয়, ভালোই লাগে পার্কে আসতে।আরতিদেবীর সাথেও আলাপ হয়,প্রথম প্রথম হাসি ও কুশল বিনিময়,পরে ক্রমে তা বন্ধুত্বে পরিণত হয়।
           ব্যক্তিগত কথার আদান-প্রদান শুরু হলে অমিতবাবু জানতে পারেন আরতীদেবীর স্বামী অনেককাল আগে গত হয়েছেন যখন তাঁর ছেলে ছয় বছরের।সেই ছেলেকে মানুষ করতে আরতিদেবীকে অনেক ঝড়ঝাপটা সামলাতে হয়,বয়স কম তাই নিজেকে সামলানোও প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল।সব কিছু অতিক্রম করলেন তিনি,সেই ছেলে বড় হলো,চাকরি পেল,উনি তার বিয়ে দিলেন নিজেই পছন্দ করে কিন্তু এই প্রৌঢ়বয়সেও পরিশ্রমের হাত থেকে তাঁর মুক্তি নেই। সংসারের যাবতীয় কাজ,রান্নাবান্না সবই নিজের হাতে করেন।অমিতবাবু তাঁর বৌমার কথা জিজ্ঞাসা করলে আরতিদেবী সস্নেহে বলেন,"আহা ছেলেমানুষ এখন, আমার মেয়েরই তো মত,একটা মেয়ে থাকলে কি আমি তাকে করতে দিতাম?সারাটা জীবন তো রইলোই পড়ে, যখন আমি থাকব না......" আরতিদেবীকে অবাক করে দিয়ে অমিতবাবু হঠাৎ হাত দিয়ে তাঁর মুখটা চেপে ধরেন, বলেন,"আর কোনোদিন এমন বলবেন না,আমি শুনতে পারি না। আপনার কথা শুনে আমার আপনার জন্য কষ্ট হচ্ছে,আপনাকে যত দেখি আমি অবাক হই,জীবনে এত কষ্ট পেয়েও আপনি এত শান্তভাবে এমন কথা বলেন কি করে? এত ভক্তিমতী হলেন কি করে? এমন এক শান্তির প্রতিমূর্তি,আপনাকে দেখলে মনে হবে না এত কষ্ট পেয়েছেন জীবনে আর আজ এই বয়সেও এত পরিশ্রম হাসিমুখে,কোনো অভিযোগ নেই,কি করে করেন আপনি? আমি যেন দিন দিন কেমন হয়ে যাচ্ছি, জীবনটাকেই এখন অসহ্য মনে হয়"।আরতিদেবী অমিতবাবুর এই আচরণে খানিক থমকে যান কিন্তু চকিতে নিজেকে সামলে তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় মৃদু হাসেন,বলেন,"মশাই কষ্ট পেলে কি করে চলবে বলুন,আমাদের যার যেটুকু করবার তা তো করতেই হবে,যার যেটুকু পাবার সেটুকুই সে পাবে। আমার যে কদিন স্বামীসঙ্গ পাবার ছিল পেয়েছি,সেটাই মেনে নিয়েছি,তাই মনে কোনো অশান্তি ছিল না।হ্যাঁ,দুঃখ হত পাশের মানুষটাকে হারিয়ে,অসহায়ও লাগত অনেক সময়,কিন্তু নিজেকেই নিজে বোঝাতাম,না হলে আর কি-ই বা করতাম বলুন।আর নিজের সংসারের কাজ করব এতে দুঃখের কি আছে?আমি তো খুশিমনেই করি। আমি আমার সংসারটাকে বড় ভালবাসি জানেন"।অমিতবাবু যত দেখেন তত অবাক হন,কি অবলীলায় ভদ্রমহিলা বলে যাচ্ছেন,কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই ওনার তবে তিনি কেন পারছেন না সব মেনে নিতে,সবেতেই যে তাঁর অসহ্য লাগে,কেবল ভাল লাগে এই আরতিদেবীর সান্নিধ্যটুকু। এক অমোঘ আকর্ষণে ছুটে আসেন বিকেলে গঙ্গার ধারে এই পার্কে, ক্ষণিকের আনন্দ,ক্ষণিকের শান্তিটুকু পেতে।ওনার সান্নিধ্যে আস্তে আস্তে নিজেও একটু শান্ত হচ্ছেন অমিতবাবু,ওনার জীবনদর্শন অনুযায়ী চলার চেষ্টা করছেন,আর কিছুটা হলেও নিজেকে একটু করে শান্ত করতে পারছেন অমিতবাবু।
        কিন্তু আরতিদেবী সেদিন বাড়ি ফিরে আর নিজেকে শান্ত রাখতে পারেননি,বাথরুমে ঢুকে অঝোরে কেঁদেছিলেন,অমিতবাবুর হাতের স্পর্শে যেন তার ঠোঁটের ওপর চিরকালের জন্য দাগ কেটে দিল, অনেকদিন পর আজ স্বামী হারানোর শোকটা যেন জেগে উঠল,কিন্তু স্বামীর কথা মনে করতে অমিতবাবুর মুখটাই তাঁর চোখে ভেসে উঠতে লাগল বারবার।স্বামী মারা যাবার পর কত হাতছানি উপেক্ষা করে নিজেকে পবিত্র রাখার চেষ্টা করেছেন তবে আজ কেন এই স্পর্শ তাকে উতলা করে তুলল! আরতিদেবী নিজেকে শান্ত করতে পারছেন না,ভেতরে অপরাধবোধ হচ্ছে,এই প্রৌঢ়বয়সে এসে এ কি বিপর্যয়! সারারাত বিছানায় শুয়ে দুচোখ বেয়ে জল পড়েছে আর আকাশ-পাতাল ভেবেছেন,তাঁর কি করা উচিত,তিনি কি পার্কে যাওয়া বন্ধ করে দেবেন?পরদিন সকালে যখন তিনি অফিসযাত্রী ছেলেকে খেতে দিয়ে পাশে বসেছেন ছেলে সুখবরটি দিল যে তিনি নাকি ঠাকুমা হতে চলেছেন। আনন্দে আত্মহারা আরতিদেবীর কিন্তু প্রথমেই মনে হোলো অমিতবাবুর কথা,কখন তাঁকে এই সুখবরটা দেবেন।
         বিকালে যথারীতি পার্কে এসে আরতিদেবী দেখেন অমিত বাবু আগেই হাজির কিন্তু আরতিদেবীর নিয়মের ব্যতিক্রম নেই।তিনি তাঁর আবেগ দমন করে গঙ্গাপ্রণাম করে হাঁটতে শুরু করেন যেমন রোজ করেন।এক পাক ঘুরে আসার সময় দেখেন অমিতবাবুও গঙ্গাপ্রণাম করছেন।ভালো লাগায় মনটা ভরে গেল আরতিদেবীর এই ভেবে যে মানুষটা বোধহয় কিছুটা হলেও মানসিক শান্তির সন্ধান পেয়েছেন।তারপর অমিতবাবুও হাঁটতে শুরু করেন,এতদিন পার্কে এসে চুপ করে বসেই থাকতেন,জীবনকে নিজের গতিতে চলবার জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন।সেই তিনি আবার নিজের স্বাস্থ্যের কথা ভাবছেন,জীবনে এই প্রথম আরতিদেবী জয়ের স্বাদ অনুভব করতে লাগলেন।একটা মানুষকে শান্তির সন্ধান দিতে পারার মধ্যে যে এত আনন্দ আছে তা আগে তিনি জানতেন না।এর পর হাঁটা শেষ হলে বেঞ্চে বসলে খানিক পর অমিতবাবু হেঁটে এসে বসেন আরতিদেবীর পাশে। তখন আরতিদেবী সুখবরটা জানান আর অবাক হয়ে দেখেন অমিতবাবু এতটাই খুশি হয়েছেন যে সুখবরটা যেন তাঁর নিজস্ব জীবনের।
        দিনমনি পাটে বসলেন,দিনের আলো ফুরিয়ে এল, আকাশ লালে লাল,আরতিদেবী উঠলেন সূর্যপ্রণাম করতে।চোখ বুজে প্রণাম শেষে চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলেন অমিতবাবু তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে তখনও সূর্যপ্রণাম করছেন।




মানস চক্রবর্ত্তী


এই ভাবে পা ডুবিয়ে বসে আছো 
শিরশিরানি কিভাবে অজান্তে আমোদ দেয় 
তা তোমার চোখ দেখলে বুঝি গো

দূরের দিকে নজর রেখে রেখে আর সতর্ক  
শিকারের নিয়ম মেনে 
সাঁতার ডাকছো অবিরাম 

অসমাপ্ত ঘুর্ণিগুলো লেচ্চিতে আটকে রেখে
জলকে চলতে দেবে তা কি হয়

ভিজে উঠে আসছে উরুথ বরাবর
জবজবে চেটে দিচ্ছে যোনীকেশর
ওহো ফিজিওলজি 
এখানেও হরমোণ পাঠিয়ে পাঠিয়ে কিভাবে যে
আমাকে কুমারসম্ভব পড়াতে চাও

চোখ বুজে আসছে নজর জমা রেখে
ক্রমশ  স্পষ্ট আয়োজন



মৌসুমী মৌ


শ্মশান কালী //  

সকাল থেকেই ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি ঝরেই যাচ্ছে | যাকে আদর করে সবাই ইলশে গুঁড়ি বলে | ভারি অলস সকাল, কারণ নেই তবু মন কেমন করা এক চিনচিনে   কষ্ট | টুশকি নিজের মনকে খুব একটা বেশি পাত্তা না দিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়লো | আজ সে ঠিক করেছে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে অফিসে যাবে না, একটা দিন নিজের মতো করে কাটাবে |

টুশকির শ্বশুরবাড়িটি আধা যৌথ পরিবার, (আধা বলতে পৃথকান্ন  কিন্তু মনে মনে সবাই সবার পাশে আছে) নিউক্লিয়ার পরিবার থেকে এসে এই  পরিবারের এতো লোকজন , তাদের সব বিচিত্র ধরণধারণ, বাচনভঙ্গি বেশ লাগে | এমনকি এদের অকারণ অতিরিক্ত কৌতূহল পর্যন্ত | আজ বেলা পর্যন্ত জানলা খোলা দেখে পাশের ঘরের মিষ্টি কাকী কথা ছুঁড়ে দিলো , কিরে টুশকি অফিস যাবিনা, দীপ্ত বেরিয়ে গেছে ?
--- সেতো  ট্যুরে, আর আমি আজ যাবো না গো |
বেলায় পারলে এসো আড্ডা দেব |
মর্নিংওয়াক থেকে ফেরার পথে মধুরা টুশকিকে দেখে এক গাল হেসে বলে,’ কিগো আজ ডুব মারলে | তাহলে চলো ‘ হামি ’দেখে আসি ‘? টুশকি এই সুযোগে রসিকতা  করতে ছাড়ে না, ‘মিষ্টি কাকীর কান বাঁচিয়ে বলে ওটা কি দেখার’ ? মধুরাও কম সেয়ানা নয় উত্তরে চোখ টিপে বলে, ‘তাহলে চলো চেখে আসি’|
হালকা রসিকতায়  টুশকির মনের মেঘ আসতে আসতে কেটে যায় |

হঠাৎ দেখে সামনে পিছনে দরাদ্দম দরজা, জানলার কপাট গুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে | মধুরাও ছুট্টে ঘরে ঢুকে গেল | কিছু বোঝার আগেই হঠাৎ সেই বুক ফাঁকা করা আওয়াজ, ‘কীরে রাঙা বৌ বাড়ী আছিস , অনেকদিন বাদে দেখলাম তোকে,খুশি করে দিবি কিন্তু আজ, শনিবার মায়ের পুজো আছে রাতে |’

টুশকির চোখে দুস্টুমি ঝিলিক মারে , এবার সে বুঝতে পারে কেন সবাই দরজায় খিল দিলো | যতটা না ভয় তার থেকে বেশি অজানা আতঙ্ক | এই কালিকা দিদি শ্মশানে থাকে| কপালে মোটা করে সিঁদুর লেপা , মিশমিশে উজ্জ্বল কালো সাড়ে পাঁচফুটের  পেটানো বানডাকা শরীর , যার তীব্র ঝিম ধরা মাদকতা বোধহয় এবাড়ির সাবেকিয়ানার সাথে বড়ো বেমানান, বড়ো দৃষ্টিকটু | শরীরী মাদকতা, ঈষৎ পুরুষালি বাজখাঁই গলা, শ্মশানের চোরা ভয় -- সব মিলে মিশে এই রুচিশীল, স্ট্যাটাস সচেতন বনেদি বাড়িতে কালিকার আগমন বেশ জোরে ঝাপ্টা মারে | সবাই যা করে টুশকি বরাবরই তার বিপরীত করবে এটা ওর স্বভাব | সুতরাং কালিকা দিদিকে দেখে সবাই যখন দরজায় কপাট দিলো তখন  টুশকির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল , এটা ওর ক্ষেত্রেই স্বাভাবিক | ও ভাবে ভালোই হলো আজ কিছুক্ষন শ্মশান মোশানের গল্প শুনে সময়টা অন্য ভাবে কেটে যাবে |

যে শ্মশানের বাসিন্দা কালিকা, সেখানে এখনো ইলেকট্রিক চুল্লি হয়নি | তিরতির করে বয়ে চলা মজা গঙ্গার পাড়ে এখনো মড়া পোড়ে | টুশকি যেন মনে মনে কালিকার গায়ে সেই আদিম পোড়া গন্ধ পায়, ভালো কি মন্দ সেটা প্রশ্ন নয়, বিয়ের পর থেকে এই দশ বছর  টুশকির এই গন্ধে কোনো অসুবিধে হয়না | দীপ্ত থাকলে সঙ্গে সঙ্গে দশ বিশ টাকা দিয়ে বিদায় দিতো কারণ তার কাছে কালিকার এই আবদার, এই আনসান গল্প পাগলামো ছাড়া কিছু নয় |

কিন্তু এবাড়ির কেউ বোঝেনা এমনকি দীপ্তও নয় মরা পোড়ানো কালিকার বরের পেশা | ওরা জাতিতে  ডোম সহজ সাদা সিধে মানুষ সব | গ্রাম বা শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে এদের বাস | বংশপরম্পরা ধরে ওরা এই কাজ করে বলে তথাকথিত ভদ্রলোকেদের অন্তিম  যাত্রা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়| মরা পোড়াবার আগে কালিকার বর এক ভাঁড় তাড়ি খেয়ে নেয় তার পর মরার গায়ে হাত দেয় |
-- টুশকি জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি খাও’?
-- কালিকা বলে কী ?
-- ওই যে তাড়ি !
-- লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলে তা খেতে হয় বটে,
মাঝে মাঝে মরদের সাথে আমাকেও থাকতে হয় তো, ওর সাগরেদ বুধিয়া তো রাতে ভিতে নেশা করে পড়ে থাকে, অনেক সময় কাজ করতে চায় না মোটে, তখন |
-- তোমার ভয় করেনা কালিকা দিদি ?
-- ভয় করবে কেন! আমার বাবাও শ্মশানের ডোম ছিল, বর ও তাই, ভয় কিসের ?এখানে সবাইকে আসতে হয়রে, যতই আমাদের তোরা ঘেন্না করিস |
-- কি যে বলো ! ঘেন্না করবো কেন ?
-- তোর কথা বলছিনা তুই আলাদা কিন্তু ভদ্দর পাড়ায় সবাই আমাদের দেখে ঘেন্না পায়|
-- টুশকি বলে ছাড়ো ওসব কথা এবার অনেকদিন পর তোমায় দেখলাম | কবে তোমাদের মায়ের উৎসব ?

কালিকার মুখে টুশকি আগে শুনেছে ওই শ্মশানে কালী মায়ের মন্দির আছে| প্রতি অমাবস্যার রাতে পুজো হয়| তবে বছরে  দুবার ধুমধাম করে সারা রাত ধরে উৎসব হয় | তখন সেখানে গঙ্গার পাড় জুড়ে মেলা বসে | দূর দূর থেকে সাধু সন্ন্যাসীরা আসে | অনেক আগে নাকি এক কাপালিক আসতো পঞ্চমুন্ডীর  আসনে বসে সারা রাত ধরে সাধনা করতো | যা বলতো তাই ফলে যেত | অনেক রাতে তেনারাও আসতেন | টুশকি ভাবে আহা! ওনারাতো রাতেই ঘুরে বেড়ায়, প্রসাদ খেতে ইচ্ছে করেছে হয়তো | দৈবশক্তিধর কাপালিক যদি আজও বেঁচে থাকতো ও তাহলে ঠিক লুকিয়ে একবার অন্তত দেখা করে আসতো|

টুশকি কালিকাকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করে ওঠে তুমি -- ‘দেখেছো ওনাদের ?’
নারে দিদি, বলে হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলতে শুরু করে-- ‘ তবে অল্প বয়সী একটা বৌ, অপঘাতে মরা আরকি, পরে শুনি বরই কি কারণে খুন করেছে| সোনার পেতিমে দেখতে | একদিন এক বৃষ্টির রাতে  বডি ঢুকলো , আমিও বরের সঙ্গে ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলে গেলাম কাজে | যাত্রী মোটে পাঁচ ছজন | টুকটুকে আলতারাঙা পা দুখানা, কি মনে হতে শাড়ি জামা খোলাতে গিয়ে হঠাৎ বাজের আলোয় মুখটা দেখে বুক কেঁপে ওঠে |  ওমা গো! মা! অতটুকু বৌ কত সাধ আল্হাদ জলাঞ্জলি দিয়ে চললো ওপারে ! ওই একদিনই বরকে বলেছিলুম আজ কিছুতেই আমি তোর সাথে মরা পেটাতে পারবোনা, বুধিয়াকে ডাক|
সে রাতে ঘরে এসেও নিদ্ আসেনি চোখে | শনশন হওয়ার ঝাপটে দূর থেকে যেন গোঙানি ভেসে আসছে,
মন বলছে কোনো অতৃপ্ত আত্মা চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, টুশকিও কেমন আনমনা হয়ে পড়ে | কেন ওই টুকটুকে আলতা পরা বৌটা চলে গেল সবাইকে ছেড়ে ! হয়তো যেতে চাইনি, হয়তোবা বাঁচতে চেয়েছিলো খুব, গুছিয়ে সংসার করার  বড়ো সাধ ছিল তার ….

বৃষ্টিটা আরো বাড়লো| কালিকা তার পাওনাগন্ডা  বুঝে নিয়ে মিনিট পাঁচেক হলো বিদায় নিয়েছে | ঝড়ের দাপটে পুবের জানলার পাল্লাটা জোরে শব্দ করে হাট হয়ে খুলছে, বন্ধ হচ্ছে |  কাল রাতে শুরু হওয়া নাছোড় বৃষ্টিতে বাড়ির পিছনের দিকের মস্ত পাঁচিল থেকে বোধহয় কয়েক গাঁথনি ইঁট খসে পড়ার বুককাঁপানো আওয়াজ হলো প্রচন্ড জোরে , বাদলা দিনের ফিকে আঁধারে রোজ দেখা কালো বিড়ালটার নীলসবুজ চোখ দুটোতে যেন অশরীরি দৃষ্টি !! টুশকি উঠে যে জানলার কপাটটা বন্ধ করবে সেটুকু শক্তি কোই ?? এক অদ্ভুত আবছা আদ্র পরিবেশ টুশকির মনকে আস্তে আস্তে গ্রাস করছে !!!  ও কোথায় যেন ডুবে যাচ্ছে

শিখা দত্ত

-সংলাপ-
আমার বিষাদ বসন্ত বিদায় নিতে চায় এখনই
যখন আমি লিখছি অন্য এক সংলাপের কাব্য ।
আগুনের মৃদু ছোঁয়ায়। 
স্মৃতিমেদুর অতীত হয়ে ওঠে সব কুশীলব
আমার সমর্পণের বিভঙ্গে ফুটে ওঠে এক আশ্চর্য্য কমললতা।
আমার বিষাদ সিন্ধু জন্ম দেয় অন্য এক জন্মের
নতুন প্রতীক্ষা আর নীরবতার মাঝখানে
ছোট ছোট আলোর তরঙ্গ দ্যুতি খেলা করে।
দূর হতে ভেসে আসা সাহসী পরাগ
আলগোছে ছুয়ে যায় সুগন্ধি বাতাস।
এখন কোন ক্লান্তি নয়, অভিমান নয়
হলুদ এক বসন্তের পায়ে দিবারাত্রির কাব্য
গচ্ছিত রেখে, আঁচলে বেঁধে নিই
অগনন নক্ষত্রের দীপাবলির পান্ডুলিপি

পিয়াংকী মুখার্জী






রোদ-চশমা
**********

*************** 

সমাজে এখন আগুন আর জলের সহাবস্থান 
তরলকণা প্রকৃতিতে পুড়ে পাথর করে দিয়েছে জন্মশোক 

 শিল্পী  আজকাল আর ছৌ নাচের মুখোশ পরেন না , শুধু পৃথিবী থেকে নিজেকে আড়াল করতে চোখে ঠেসে নেন রোদ-চশমা । 

বাষ্পের ধোঁয়াশায় ঘনীভূত হয় ঝাপসা আলো 
উন্মুখ মুখগুলো অনাবৃত অহংকারে ধুইয়ে দেয় পতাকার রং 

আমি পেশাদার খবর গ্রাহক , 
বাধ্যতামূলক শরীরে চাপিয়ে নিই বর্ম 

ওদের ঘর্মসিক্ত লবণজল আমার দেহ চুঁইয়ে অংকুরিত করে ভেজা মাটি 

সাময়িক সুখের পরিপূরক হয়তোবা ওই রোদ-চশমাই !

দ্বিতীয় কবিতা 
""""''''''""""""""""""

অপরিবর্তনীয় 
************

***************

আকাশকে ছুঁয়ে  পা মেপে মেপে মুক্তির পথে এগোয় ঔদাসীন্য । 
মেঘের নীল ঠোঁট বিনাকারণেই বিষাক্ত করে তোলে পাহাড়ের দেহ , 
জলীয়বাষ্প পর্বতারোহণের  সময় হাহাকার শুরু করে তৃষ্ণার্ত পথিকের মতো , 
ওর শরীর জুড়ে কামুক বাতাসের অবগাহন । 

নিম্নে নদী চাতকের মতো অপেক্ষার পোশাক  বুনেই চলে , 
যত শক্ত হতে থাকে বুনোট উল্টোপক্ষে ততই আলগা হয় মায়াজাল । 

ভূগোল বদলায় , 
গণিতের নতুন নতুন নিয়ম তৈরি হয়,  
বিজ্ঞান প্রতিনিয়ত আবিষ্কার করেই চলে প্রযুক্তি , 
সাহিত্য জগতেও জন্ম নেন আগামীর যোগ্য উত্তরসূরি 

কিন্তু সূর্য চন্দ্র সাক্ষী রেখে  ...
ইতিহাস অপরিবর্তিতই  থেকে যায় কালের নিয়মে ॥